বডিগার্ড

উন কুরলা এক্সপ্রেসের সেকেন্ড ক্লাসে চড়ে টাটানগর থেকে হাওড়া ফিরছিল প্রকাশ। তার এমআর-এর চাকরি। আগের দু-দিনে সব ডক্টর্স চেম্বার ভিজিট করা হয়নি। শনি-রবিতে প্রায় সব চেম্বারে রোগীর এত লাইন থাকে যে,পাঁচ মিনিট ডেমনস্ট্রেশন দেওয়ার জন্য এক দেড় ঘন্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তাই আজ সকালেও তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে ঘন্টা চারেক টাটানগরে টো টো করে ঘুরতে হল। অভ্যাস অনুযায়ী সকালবেলায় খবরের কাগজ পড়ারও সময় মেলেনি। ট্রেনে চেপে ব্যাগটা কোনও মতে বাংকে তুলে প্রকাশ দৈনিকটা খুলে বসেছে। তারপর দু’ঘন্টা ধরে আর তার হুঁশ ছিল না। কাগজের ষোলো-সতেরো পাতা যখন প্রায় মুড়ো ল্যাজা করে পুরোপুরি পড়া হল, তখন ট্রেন ঝাড়গ্রামে ঢোকার আগে লেভেল ক্রসিং পার হচ্ছে।

ঘড়ি দেখে বিরক্ত হল প্রকাশ, কুরলা এক্সপ্রেস টানা দুঘন্টা টাটায় লেট ছিল, আর এখন তিন ছুঁই ছুঁই। কত রাত করে যে হাওড়া ঢুকবে, ভগবানেরও অজানা। ওঠার পরে এতটা সময় পার করে দিয়ে, এই প্রথম কামরার অভ্যন্তরে চোখ বুলোবার ফুরসত পায় প্রকাশ। লম্বা সিটে তাকে নিয়ে চার চার আটজন, ওপাশে জানালার ধারে সিঙ্গল সিটে আরও দু’জন। সকলেই দেহাতি, মলিন পোশাক। এদের কেউ খড়গপুরের এপারে যাবে বলে মনে হয় না। তাতে অবশ্য প্রকাশের কিছুই হেলদোল নেই। যেন আগুনের পরশমণি প্রাণে জাগিয়ে বসে আছে।

প্রায় দু’বছর ধরে মাসে দু’তিনবার ট্রেনে জার্নি করা খাওয়া-শোয়ার মতো অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। কথা বলার মতো সঙ্গীর দরকার হয় না। অনেকে বলে খালি ট্রেনে চোর-ডাকাতের উৎপাত হয়, প্রকাশ আমল দেয় না। সেই কবিতার লাইনটা মনে পড়ে, ‘হঠাৎ আলো দেখবে যখন, ভাববে কী বিষম এই কান্ডখানা।’ হঠাৎ আলো মানে আরপিএফ জওয়ানদের লাঠির গুঁতো আর গুলির খোঁচা। তবে কুরলা নিয়ম করে লেট করে ঠিকই, কিন্তু ভিড় কমে গেলে কামরায় চুরি ছিনতাই হয়, এই গাড়ির বেলায় এমন বদনাম শোনেনি। নিজেও তো এল গেল এবার নিয়ে সাত-আটবার।

ফালতু কথা আর না ভেবে প্রকাশ ঝাড়গ্রাম প্ল্যাটফর্মে চোখ বোলাতে থাকে। সকালে ইস্পাত এক্সপ্রেসে আসার সময় দেখেছে, স্টেশন লোকের ভিড়ে জমজমাট আছে। এখন শুনশান। ঝাঁকড়া গাছগুলোয় কিচিরমিচির করে পাখিরা আসর জমিয়ে রেখেছে। তিন নম্বর, মানে লুপ লাইনে গাড়ি থেমেছে। হয়তো, এখানেও খানিক লেট করানো হবে। বিরক্ত মুখ কামরার ভেতরে ফেরাতে গিয়েই চোখ পড়ল ভদ্রমহিলার দিকে। এখান থেকেই উঠলেন। হাতে ঢাউস ভ্যানিটি ব্যাগ, জলের বোতল। উলটোদিকের সিটে বসতে চাইতেই দুই দেহাতি বুড়ো নিজেদের মধ্যে ছ’ইঞ্চি জায়গা খালি করে দিল। ভদ্রমহিলা বেশ দ্বিধায় পড়েছেন, প্রকাশ দেখেই বুঝতে পারে। উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আপনি বরং এই জানলার ধারে এসে বসুন, আমি ওপাশে চলে যাচ্ছি।

– থাক না, একটু বাদে খড়গপুরে অনেকে নেমে যাবে মনে হয়। তখন ভালো করে বসব।

– আরে বসুন। আমি টাটা থেকে জানালার ধারে এলাম।

ভদ্রমহিলা আর কথা বাড়ালেন না। বসতে গিয়ে প্রকাশকে একটা অনুরোধ করলেন– আমার এই ব্যাগটা যদি বাঙ্কের একটু ভিতর দিকে তুলে দেন। বেঁটে চেহারার মানুষকে এই সাহায্যটা প্রতিবারই কারও না কারও কাছে চাইতে হয়।

প্রকাশ হেসে ফেলল। ‘বেঁটে’ শুনে ভদ্রমহিলাকে প্রথম ভালো করে দেখল। তখনই মনে হল, আগে কোথাও দেখেছে।

এইমাত্র জানালা ছেড়েছে, এইবার গায়ে পড়ে ‘মনে হচ্ছে আগে কোথাও যেন দেখেছি আপনাকে’ বলাটা নাটকের মতো হয়ে যাবে। মহিলা সুন্দরী হলেও বিবাহিতা, বয়সে ওর সমান কিংবা খানিক বড়োও হতে পারেন। বাড়তি মনোযোগ দেবার তেমন কোনও কারণ নেই। তাই প্রশ্নটা ঢোঁক গিলে মনোযোগ দিয়ে বাঙ্কে ব্যাগ ওঠাল প্রকাশ। দুই বুড়োর মাঝখানে আলগোছে বসতেই ট্রেন নড়ে উঠল।

বাঁশতলা এবং সারদিয়া স্টেশন পার হয়ে খেমাশুলিতে গাড়ি আবার ঘটাং করে থেমে গেল। তখনই কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে পিলপিল করে উঠতে থাকে আদিবাসী মহিলারা। মিনিট দুই তিনেকের মধ্যে লোকাল ট্রেনের চেহারা নিল কুরলা এক্সপ্রেসের সেকেন্ড ক্লাস। দুই সিটের মধ্যে এত লোক ঢুকেছে যে, নড়াচড়া করাই দায় হল। কুরলা এক্সপ্রেসে এতবার ফিরেছে প্রকাশ, এরকম ঘটনা আগে কখনও চোখে পড়েনি। মনে করে দেখল, স্টপেজই নেই লো-লেভেল স্টেশন খেমাশুলিতে। হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল চমকে মোড়া বিস্ময়– এত লোক এই জঙ্গল দেশে কোথা থেকে এল?

– কপালে সিঁদুর লেপা দেখে বুঝতে পারছেন না, এরা গুপ্তমণির পুজো দিতে গিয়েছিল। আজ হয়তো কোনও বিশেষ উৎসব আছে। হাইওয়েতে বাস বন্ধও হতে পারে। জানলার ধারে ভদ্রমহিলা বললেন।

অনেকক্ষণ পরে তাঁর দিকে ফিরে তাকাল প্রকাশ। ভিড়ের মধ্যে মুখটুকুই শুধু দেখতে পাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করল, সবার কপালে টিপ তো দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু গুপ্তমণি আবার কে?

– তিনি আমাদের দুর্গা বা কালীর মতো এই এলাকার আদিবাসীদের প্রিয় এক দেবী। সবাই বলে খুব জাগ্রত। হাইওয়ে দিয়ে বাসে গেলে দেখতেন, যাত্রী থেকে ড্রাইভার কন্ডাক্টর, সকলে মন্দির পার হওয়ার সময় নমস্কার করে পয়সা ছুড়ে দেয়। সেই পয়সা কুড়োতে মন্দিরের পনেরো কুড়ি জন লোক সবসময় ছুটে বেড়ায়।

প্রকাশ এমন বিচিত্র দেবীস্থানের মাহাত্ম্যের কথা শুনে মজা পায়। উপরন্তু অবাক ভাব চাপতে না পেরে ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞাসা করে– আপনি এখানকার অনেক কিছুই জানেন দেখছি!

– এটা জানার মতো কোনও বিষয় নয়। ঝাড়গ্রামে আমার প্রায় আঠারো উনিশ মাস মানে দেড় বছরেরও বেশি চাকরি হয়ে গেল। উইকেন্ডে ফিরে যাই। এই ট্রেন প্রায় দিনই লেট করে। তখন বাস ধরে খড়গপুর বা গিরি ময়দান যেতে হয় লোকাল ট্রেন ধরার জন্য। সেই বাসেই দেখেছি গুপ্তমণির মন্দির।

প্রকাশ কথা ঘোরায়– আপনার চাকরি ঝাড়গ্রামে, রাজ কলেজে নাকি?

– বাঃ, আপনিও তো দেখছি অনেক কিছু জানেন। রাজ কলেজের নাম বলে দিলেন। তবে, আমি স্কুলে পড়াই, রানি বিনোদ মঞ্জরী।

– এ নামটাও শুনেছি মনে হচ্ছে। মেয়েদের স্কুল। বোধহয় সরকারি।

– ঝাড়গ্রাম তো দেখছি, আপনার নখদর্পনে। অথচ গুপ্তমণির নাম শোনেননি?

– আসলে, আমার এক মেসোমশাই বেশ কয়েক বছর আগে রাজ কলেজে পড়াতেন। সরকারি কলেজ তো, হুগলি মহসিন থেকে দু-বছরের জন্য ট্রান্সফার হয়ে এসেছিলেন। তখন আমি উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে কয়েকটা দিন কাটিয়ে গেছি। বলে রাখি, আমার সেই মেসোমশাইয়ের নাম জগৎ লাহা।

– তাই বলুন।

– এখনও রাজবাড়ি, জঙ্গলমহল, চিলকিগড় আর ডুলুং নদীর কথা ভালোই মনে আছে। মেসোমশাই যে জায়গাটায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতেন সেখানকার নাম রঘুনাথপুর না রঘুনাথগঞ্জ কী যেন।

এবার ভদ্রমহিলার অবাক হওয়ার পালা। বললেন– আপনার স্মৃতি দেখছি একেবারে টাটকা রয়েছে। আমিও রঘুনাথপুরে থাকি, স্টেশনের কাছেই।

ভিড়ের চাপে, বাচ্চাদের তারস্বরে কান্না আর বায়নায় একসময় কথা চালাচালি বন্ধ হয়ে গেল। আধঘন্টা বাদে শেষ বিকেলের সোনা হলুদ আলো মেখে খড়গপুর স্টেশনে ঢুকল ডাউন কুরলা এক্সপ্রেস।

কামরা খালি করে প্রায় সবাই নেমে গেল। প্রকাশদের খোপে সে এবং ভদ্রমহিলা ছাড়া উলটোদিকের জানালার ধারের লোকদুটো শুধু বসে রইল। ভদ্রমহিলার মুখোমুখি জানালায় সরে গেল প্রকাশ। দেখতে চেষ্টা করল, প্ল্যাটফর্মে কোনও কফিওয়ালা দেখা যাচ্ছে কি না। তখনই এদের খোপে ফাঁকা সিটের দখল নিল জনা পাঁচেক লোক। হাবভাব দেখে ডেলিপ্যাসেঞ্জার বলে মনে হচ্ছে। ধুপধাপ বসেই কোনও কথা না বলে সিগারেট ধরাল। মুহূর্তে ধোঁয়ায় খোপটা নরক গুলজার করে তুলল। প্রকাশ দেখল, উলটোদিকে ভদ্রমহিলা নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বসে আছে। প্রাণপণে কাশি চাপতে চেষ্টা করছেন। বিরক্ত মুখে ও লোকগুলোর দিকে ফিরল। বলল– কম্পার্টমেন্টের ভিতরে এভাবে স্মোক করছেন কেন? জানেন না, এটা নিষিদ্ধ? দরজায় দাঁড়িয়ে শেষ করে আসুন।

লোকগুলো উঠে যাওয়ার কোনও গরজ দেখায় না। যেন কথা শুনতেই পায়নি। প্রকাশ আবার তাই গলার জোর আরেকটু বাড়িয়ে বলে– আপনাদের বলছি, সিগারেটগুলো দরজায় গিয়ে ফিনিশ করে আসুন। আমাদের খুব অসুবিধা হচ্ছে।

এইবার দলের একজন ঝাঁঝিয়ে উঠল– বেশি বকবেন না তো। রোজই আমরা এই ট্রেনে যাই।

এইবার প্রকাশের রাগ বেড়ে যায়। উঁচু গলায় বলে কী বলতে চান আপনারা, রোজ এক ট্রেনে গেলে কি আইন ভাঙার অধিকার জন্মায়?

– আইন আপনার বাড়িতে গিয়ে দেখাবেন। জানালায় বসেছেন, খানিকক্ষণ এখন নাকে রুমাল চাপা দিয়ে প্রকৃতির শোভা দেখুন। সিগারেট একসময় নিজেই ফুরিয়ে যাবে।

রাগে লাল হয়ে উঠল প্রকাশ। কোনওরকম সিভিক সেন্স নেই এদের। একবার ভাবে, টিটিই-র কাছে কমপ্লেন করা যেতে পারে। কিন্তু এটা ভেস্টিবিউল কম্পার্টমেন্ট নয়, টিটিই-কে কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে, তার ঠিক নেই। কমপ্লেন করেও কোনও ফল হবে কি না, তা নিয়েও সংশয় আছে প্রকাশের। যাতায়াতের পথে এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন লোকজন তো কম দেখল না। তাই প্রকাশ একবার ভাবল, তর্ক চালিয়ে যাবে। তাতে পরের রাউন্ডে সিগারেট ধরানোর আগে লোকগুলো অন্তত দ্বিতীয়বার ভাববে। শেষ পর্যন্ত উলটোদিকে বসা সদ্য পরিচিতার অস্বস্তিতে ঘেমে ওঠা মুখের দিকে তাকিয়ে সামলে নিল নিজেকে। ভদ্রমহিলাকে পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখতেই তার আবার মনে হল, খুব চেনা। স্মৃতি হাতড়ে বিরক্তি আর সময় কাটাতে থাকল প্রকাশ। সংবিৎ ফিরল মেচেদা পৌঁছে, জানালার কাছে ‘গরম চপ-সিঙাড়া’ ওয়ালার বাজ পড়ার মতো হাঁক শুনে। কামরার ভেতরে তখন টিমটিমে আলো জ্বলে উঠেছে। পাশের লোকগুলো যথারীতি ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হাঁটুতে হাঁটুতে তোয়ালে পেতে তাস খেলার আসরে মেতে উঠেছে। অকারণে তর্ক জুড়ে কামরা ফাটাচ্ছে। সামনে ভদ্রমহিলা যথারীতি নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বসে রয়েছেন, দৃষ্টি প্রকাশের দিকে। এক পলকে দেখল ও, তার চোখেও কেমন অবাক করা ভাব। এ চোখের ভুল, ভেবে প্রকাশ দৃষ্টি ফেরাল মেচেদার ভিড়ের দিকে।

ট্রেন স্টেশন ছাড়তেই বাইরের ঝুপসি অন্ধকার ধেয়ে এল। ভিতরে পরিবেশ এতই বিরক্তিকর যে, বাইরের সে অন্ধকার রাজ্যে চোখ সওয়াবার চেষ্টা করতে থাকে প্রকাশ। গাড়ি এবারে বেশ গতি নিয়েছে। কোলাঘাটে রূপনারায়ণের সেতু পার হওয়ার পর ও আবার ভাবতে শুরু করে, সামনে বসা ভদ্রমহিলাকে ও কোথায় দেখতে পেয়েছে আগে। এমন সময় সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রমহিলা। হয়তো টয়লেটে যাবেন। তাসখেলা লোকগুলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন– তোয়ালেটা একটু সরিয়ে নিন, আমি বাইরে যাব। খেলা থেকে চোখ না সরিয়ে একজন কড়া গলায় জবাব দেয়– এখন গোটানো যাবে না। সিটে গিয়ে বসুন। সাঁতরাগাছি ঢুকলে খেলা শেষ হবে।

– তা কেন? আমাকে যেতে দিন।

তাসুড়ের গলা এবার আরও চড়ল– বাইরে যাওয়ার এত তাড়া থাকলে জানালার ধারে বসেন কেন? নিজের বাড়ির সব সুবিধা তো ট্রেনে মেলে না।

একে ভদ্রমহিলা, তায় তার ওপর মানসিক জবরদস্তি। মনে হচ্ছিল প্রকাশের, ভদ্রমহিলার বাথরুমে যাওয়ার কথা শুনে তাঁর মন এবং শরীরকে মানসিক ভাবে ভিসুয়ালাইজ করছিল তারা।

আরেকজন চোখ নাচিয়ে বলল– আমি ঘোড়াঘাটা যাচ্ছি। এই তো ঘোড়াঘাটা চলে এল বলে। আর বড়োজোর ঘন্টা খানেকের মামলা। মেয়েরা তো ঘন্টার পর ঘন্টা বাথরুম চেপে রাখতে পারে।

সংকোচে বাক্রুদ্ধ হয়ে ভদ্রমহিলা বসে পড়লেন। এতক্ষণ প্রকাশ চুপচাপই ছিল। মন বসাতে চেষ্টা করছিল বাইরের অন্ধকারে। এবারে তার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। উঠে দাঁড়িয়ে আদেশের সুরে বলল– খেলা বন্ধ করুন এবার।

লোকগুলো কথা শোনার পাত্র নয়। ওর চেয়েও এক কাঠি বেশি রাগ দেখিয়ে একজন বলল– আপনি তখন থেকে ফালতু বকে চলেছেন কেন বলুন তো। সব প্রসঙ্গের মধ্যে ঢুকছেন! যার বাথরুম যাওয়ার দরকার ছিল তিনি তো চুপচাপ বসে রয়েছেন।

– নোংরা কথা বলবেন না। মহিলাদের সঙ্গে শালীনতা বজায় রেখে কথা বলতে জানেন না আপনারা?

– আমরা জানি না, আর আপনি দরকারের চেয়ে বেশি কথা বলেন। এই তো শোধবোধ হয়ে গেল। এবারে তবে থামুন।

নিজেকে প্রকাশ আর সামলে রাখতে পারল না। কলার চেপে ধরল সবচেয়ে উঁচু গলার লোকটার। তখন বাকিরা ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রকাশের উপর– ছাড় শালা। রাজার চালে যাবি তো এসিতে চাপতে পারতিস। মেয়েরা সেখানে সারাদিন বার্থ আর বাথরুম করে কাটালেও কেউ কিছু বলবে না।

সিঙ্গল সিটে বসা লোকদুটোর দিকে ফিরে মরিয়া ভাবে প্রকাশ বলে– শুনুন আপনারা। আবার নোংরা কথা বলছে। এরা মহিলাদের সম্মান করে না। আপনারা চুপ করে থাকবেন?

প্রকাশের আশা বৃথা। গ্রাম্য লোকদুটো এদিকেই তাকিয়ে বসেছিল, কথা শুনে নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে জানালার দিকে ঘুরে বসল। পাশের খুপরি থেকে কয়েকটা উৎসুক মুখ উঁকি দিল। তাদের একজন তাসপার্টির নেতাকে জিজ্ঞাসা করে– কীসের ঝামেলা, মজুমদারবাবু? হাত লাগাতে হবে নাকি?

– আরে না দাদা, একজন অসভ্য লোক সেই ট্রেনে ওঠা থেকে ভাট বকেই যাচ্ছে। আমরা চেপে বসিয়ে দিয়েছি। সঙ্গে মহিলা থাকলে সবাই তো একটু বীরত্ব দেখাতে চায়। প্রকাশ এরকম পরিস্থিতিতে হতোদ্যম হয়ে গেল নিজের অসহায়তা অনুভব করে। নোংরা লোকগুলো দলে ভারী। এদেশে সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার লোক ক্রমেই কমে আসছে। বিষিয়ে যাওয়া মন নিয়ে নিজের সিটে বসে পড়ল প্রকাশ। ও এবং সামনের মহিলা, দু’জনের দৃষ্টি মাটির দিকে। তাসুড়েরা কিন্তু নির্বিকার, তাসের চাল নিয়ে আবার তুমুল তর্কে ফিরে গেল। একটু বাদে খুপরির ভিতরের অস্বাভাবিক গুমোট ভাবটা কাটানোর জন্য ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা শুরু করে প্রকাশ– আপনি যাবেন কোথায়?

– চন্দননগর।

– আজ অনেক রাত্রি হয়ে যাবে হাওড়া ঢুকতে। ন’টা আটান্নোর মেন লাইন বর্ধমানটা পাওয়া যাবে কি না কে জানে।

– আপনি কি ওদিকেই?

– হ্যাঁ, কিন্তু আপনার অনেক আগে নামব, কোন্নগর।

মৌড়িগ্রামে কুরলা ঢুকছে। আউটার সিগনাল লাল হয়ে থাকায় থেমে গিয়ে ঘন ঘন হুটার বাজাচ্ছে। এইবার তাসপার্টির আসর গোটানোর তাড়া লাগল। তোয়ালে ভাঁজ করতে করতে লোকগুলো নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল– আমি ভাবলাম লোকটা নিজের লোকের জন্য গলা ফাটাচ্ছে, এখন দেখছি অচেনা।

আরেকজন হেসে গড়িয়ে গিয়ে বলল– মজুমদার, মেয়েদের মতো ন্যাকামি কোরো না। তুমিও বয়সকালে পরিচিত মহিলার কাছে এমনই হিরো সাজতে চাইতে।

– তা হতে পারে, কিন্তু মালটাকে কোন্নগরে আগে দেখেছি বলে তো মনে হয় না।

– ফি হপ্তায় আটটা দশটা করে ফ্ল্যাটবাড়ি গজিয়ে উঠছে আর কত উটকো লোক রোজ থাকতে আসছে। কোন্নগরের বনেদি লোক বলে কি সবাই তোমার চেনা হবে?

– তা একরকম ঠিকই বলছ। আমরাই এখন কোন্নগরে কোণঠাসা।

ওরা ভাব এমন করছিল যেন নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। কিন্তু প্রকাশ ও ভদ্রমহিলা দুজনের কানেই যাতে পৌঁছোয়, ততটাই জোরে বলছিল।

মহিলা আবার সংকুচিত হলেন। তাসের আসর গোটানো হতেই টয়লেটের দিকে চলে গেলেন। প্রকাশ একটুক্ষণ আগে যে লোকটার জামার কলার চেপে ধরেছিল, সে এই সুযোগে ওর দিকে ফিরল। গলায় দারুণ ঘৃণা ঝরিয়ে বলল– ঝামেলা পাকানো ধাতে নেই বলে আজ ছাড় পেয়ে গেলে। অন্য কারও গায়ে হাত দিলে মেরে শুইয়ে দিত। আমিও কোন্নগরে থাকি, তিনপুরুষের বাস। মুখটা ভালো করে চিনে রাখো।

বিরক্ত প্রকাশ উঠে দাঁড়াল। ভদ্রমহিলা যে-দিকে গিয়েছেন তার উলটোদিকের টয়লেটের পথে পা বাড়াল।

শেষবার প্রতিদিনের নিয়মমতো ট্রেনটা মার খেল টিকিয়াপাড়া ইয়ার্ডে। হাওড়া ঢুকল দশটা বাজার পর। তাসপার্টি শেষবার প্রকাশের দিকে আগুনের মতো দৃষ্টি হেনে তাড়াহুড়ো করে নেমে গেল। বাংক থেকে নিজের ও ভদ্রমহিলার ব্যাগ নামাতে নামাতে বলল প্রকাশ– চলুন, একটু তাড়াতাড়ি হাঁটলে দশটা সতেরোর ব্যান্ডেল লোকালটা মনে হয় পেয়ে যাব। কোন্নগর পর্যন্ত একসঙ্গেই যাওয়া যাবে। তারপরেও ট্রেনে ভালো ভিড় থাকে। ভয় পাবেন না।

ভাগ্যক্রমে ব্যান্ডেল লোকালে পাশাপাশি দুটো সিট পাওয়া গেল। ট্রেন ছাড়ল। মাত্রই কয়েকটা স্টেশন পার হয়ে কোন্নগর। প্রকাশ ‘এবার আসি’ বলে বিদায় জানিয়ে উঠে পড়ল ভিড় ঠেলে দরজার দিকে এগিয়ে যাবে বলে। কোন্নগরে ট্রেন ঢোকার মুখে ভদ্রমহিলা গলা তুলে জানতে চাইলেন– এতক্ষণ জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল, আপনার নাম কী ভাই?

পিছনে প্রবল ঠেলা খেতে খেতে প্রকাশ কোনওমতে জবাব দিল– প্রকাশ সেনগুপ্ত, আপনার?

উত্তর শোনার আগেই এক ধাক্বায় প্লাটফর্মে। প্রকাশ ট্রেনের জানালায় হাত নাড়তে যেতেই ভদ্রমহিলা উত্তেজিত হয়ে এগিয়ে এলেন জানালার সামনে। বললেন– প্রকাশ আমি তোমার পারমিতা দিদি। ঝাড়গ্রাম থেকে মনে হচ্ছিল, কোথায় যেন দেখেছি। এইমাত্র চিনতে পারলাম। আর কোনও কথা হওয়ার আগেই দ্রুত বেরিয়ে গেল ব্যান্ডেল লোকাল। প্লাটফর্মে হতবাক প্রকাশ। সেও এইমাত্র চিনতে পেরেছে পারমিতা দিদিকে। চেনার সঙ্গে সঙ্গেই আবার হারিয়ে যাওয়া।

দুঃখিত প্রকাশ মনে মনে ফিরে গেল চব্বিশ পচিঁশ বছর আগে। স্কুলে পড়ার দিনগুলোতে। তখন ওরা ভাড়াবাড়িতে ঢাকুরিয়ায়। স্কুল বাসে গড়িয়াহাট মোড়ের কাছে স্কুলে যাতায়াত করত ও। বড়ো ছেলেরা বাসের জানালা আর প্যাসেজের দিকের সিট সবসময় আগলে রাখত, ওকে কিছুতেই মাঝখানে ছাড়া বসতে দিত না। দুজনের মাঝখানে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে স্কুলে যাওয়া যেন অলিখিত নিত্যনৈমিত্তিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওঠা নামার সময় তাড়াহুড়ো করলেও দাদারা টেনে ধরে আটকে, অকারণে চড়চাপড় লাগাত। বাসের কাকুদের কাছে দু-একবার কাঁদো কাঁদো হয়ে অভিযোগ জানিয়েও কোনও ফল হয়নি। বাসযাত্রার ভয়ে ‘কাল স্কুলে যাব না’ একসময় নিত্যনৈমিত্তিক বোল হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রকাশের। রোজ শুতে যাওয়ার আগে একপ্রস্থ আর সকালে ঘুম থেকে চোখ ছাড়ানোর পর একপ্রস্থ।

সমস্যাটা কী, তা জানতে বাবা-মা বারদুয়েক স্কুলের আন্টির সঙ্গে দেখাও করে এলেন। স্কুল থেকে কোনও গ্রহণযোগ্য কারণ না পেয়ে তারাও দিশাহারা হয়ে পড়লেন। ঠিক সেই সময় একদিন স্কুলবাসে যেতে পাদানিতে উঠতে আরম্ভ করে ডাকাবুকো পারমিতা দিদি। প্রকাশ যখন ক্লাস ওয়ান, পারমিতা তখন সিক্স। ওদের স্টপ থেকে দুটো কালো সাপের মতো লম্বা বিনুনি ঝুলিয়ে উঠত। ছোট্ট প্রকাশের ওপর বড়োদের অত্যাচারের কথা শুনে দু-তিনদিন পরেই কাছে ডেকে নিল। জানালার সিট ছেড়ে সেখানে বসতে দিল। বড়ো ছেলেদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলে দিল– আজ থেকে রোজ তুই আমার পাশের সিটেই বসবি। কেউ মেরে তুলে দিতে এলে আমাকে বলবি, তাকে উচিত সাজা দেব। এরপর থেকে অনেকদিন ধরে প্রকাশকে আগলে আগলে রাখত পারমিতা দিদি। এর জন্য দাদাদের সঙ্গে ঝগড়াও করত। একসময় তাই বাসের সকলে পারমিতা দিদিকে ‘প্রকাশের বডিগার্ড’ বলে ডাকতে শুরু করে।

অভিভাবক মহলেও নামটা ছড়িয়েছিল। প্রকাশের বাবা-মা ছেলের বডিগার্ডকে খুব ভালোবাসতেন। প্রকাশ স্কুল বদল করার আগে পর্যন্ত তার প্রত্যেক জন্মদিনে বডিগার্ড-এর নিমন্ত্রণ বাঁধা ছিল। প্রকাশরা কোন্নগরে নিজেদের বাড়িতে উঠে আসতে সব যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। আজকের ঘটনার কথা ভেবে অসহায় প্রকাশের নিজের প্রতি চরম বিরক্তি জাগল, অসভ্য লোকগুলো দিদিকে অপমান করে গেল আর উচিত জবাবটুকুও একজন পুরুষ হয়ে সে দিতে পারল না। নিজের দু’গালে চড় কষালেও বোধহয় খারাপ লাগা দূর হবে না।

কোন্নগরে তখন রাত প্রায় এগারোটা। প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে দাঁড়িয়ে পড়েছিল প্রকাশ। কুরলা এক্সপ্রেসের সেই তাসুড়েদের মধ্যে কোন্নগরের বাসিন্দা দু’জন প্লাটফর্ম থেকে নামার পথে আবিষ্কার করল তাকে। শুনিয়ে শুনিয়ে একজন আরেকজনকে বলল– দ্যাখ, ভ্যাবলাটা দাঁড়িয়ে আছে। বউদির বডিগার্ড।

কক্ষচ্যুত

ঘরের দেয়ালময় দাদার পছন্দের ক্রিকেটারদের পাশাপাশি ইন্দ্রজিতের নায়করা– ব্রুস লি, জ্যাকি চ্যান, অক্ষয় কুমার। এই তিনজন তারকার চটকদার অনাচ্ছাদিত সিক্সপ্যাক সমৃদ্ধ পোস্টারের পাশে, এখন জুড়েছে আরও কয়েক জনের মলিন ছবি– মাসুতাৎসু ওয়্যামা, হিদেয়েৎসু আশিয়ারা। পত্রিকার পাতা কাটা কাগজের ঝাপসা ছবিতে মুখ চেনার উপায় নেই, শুধু পোশাক জানান দিচ্ছে তারা মার্শাল আর্টিস্ট। জ্যাকি চ্যান-এর মতো কমেডি বা ব্রুসলির মতো তাক লাগানো হলিউডি অ্যাকশন হিরো নয়, অক্ষয় কুমারের মতো নাচিয়ে ঝাড়পিট করা বলিউড তারকাও নয়। এরা ক্যারাটের এক একটি ঘরানার নির্মাতা। অবশ্য জিৎকোন্ডোর মতো ক্যারাটে আর তাইকোন্ডোর মিশেল দেওয়া লড়াকু শিল্পের জনক হিসাবে ব্রুস লিরও একটা বাড়তি সমীহ প্রাপ্য। ইন্দ্রজিৎ অতশত না বুঝে অক্ষয়, ব্রুসলিদের দেখেই ক্যারাটেতে ঝুঁকেছিল। মার্শাল আর্ট কথাটার সঙ্গেও তখন পরিচয় ঘটেনি। দত্তপুকুরে তাদের বাড়ির কাছে যে – সম্মিলনি ক্লাব, সেখানে সাদা ঢোলা পোশাক আর কোমরে বাঁধা বেল্ট নিয়ে ছেলেদের ‘ইয়া ইয়া’ করে হাত পা ছুড়তে দেখে তারও শখ তীব্র হয়। মা-বাবার কাছে আবদার করে ঢুকেও পড়ে।

একদিন এক বেঁটে গাঁট্টাগোট্টা মাঝ বয়সি এক পুরুষকে তাদের অনুশীলন দেখে বিদ্রূপের হাসি হাসতে দেখে। মন্তব্য কানে আসে, ‘বেসিক স্টান্সগুলো না শিখেই কিক, আপার ব্লক, লোয়ার ব্লক? বেশ বেশ। এসবই তো চলছে এখন। কারই বা জ্ঞান আছে আসল জিনিস শেখাবার আর কজনেরই বা ধৈর্য আছে শেখবার? কয়েক বছরের মধ্যেই তো সব ব্রাউন বেল্ট, ব্ল্যাক বেল্ট পেয়ে যাবে সিলেবাস কমপ্লিট করে।’

ইন্দ্রজিৎ সেদিন থেকে পিছু নিয়েছিল ব্রহ্মদেশ থেকে আসা এই একটেরে লোকটার। আসল জিনিস শিখবে। ভদ্রলোকের ছাত্র পেটানোর মোহ নেই। খেদিয়েই দিয়েছিলেন ইন্দ্রজিৎকে আজকালকার নিষ্ঠাহীন ফাঁকিবাজ ওপর চালাক ছোকরার দলে ফেলে। ইন্দ্রজিৎও একদিন বলেই ফেলল, ‘শেখানোর মুরোদ নেই যখন, অন্যের তালিমকে হ্যাটা দেওয়া কেন? শুভ্রাংশু স্যাররা তো কিছু দিচ্ছে আমাদের মতো ফালতু ছেলে ছোকরাদের। আপনি ক’জনকে তৈরি করেছেন?’

ভদ্রলোক খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে ইন্দ্রজিতের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন, ‘বেশ কাল ভোর পাঁচটায় এসো। স্কুল কটা থেকে? দেখি তোমার কত এলেম, কত নিষ্ঠা।’ ওঁর কাছ থেকেই শোনা মাসুতাৎসু হলেন কায়োকুশিন ধারার প্রবর্তক। অত্যন্ত আক্রমণাত্মক এই শৈলীটি ক্রীড়ামঞ্চে গ্রহণযোগ্য নয়। বিশ্বজুড়ে শোটোকান ও গোজুকান-এরই রমরমা। হিদেয়ুকো আশিয়ারা কায়োকুশিনকে একটু নরম ধাঁচে ফেলে নিজস্ব ঘরানা তৈরি করেন, কায়োকুশিন আশিয়ারা। বিনোদ শেঠ ব্রহ্মদেশে থাকা কালে এই শৈলীটিই ‘সামান্য একটু’ শিখেছিলেন।

পরের দিন ইন্দ্রজিতের নবলব্ধ জেনারেল নলেজের ভাণ্ডার দেখে আকৃষ্ট হয়ে সম্মিলনি ক্লাবের আরও কিছু ছেলে বিনোদদার বাড়িতে হানা দেয়। বিনোদদার উঠোনে অতজনের জায়গা হবে না। তিনি বাধ্য হয়ে বাড়ির পাশের মাঠে প্রশিক্ষণ শুরু করলেন। দক্ষিণার কথা জানতে চাইলে হাসতেন, ‘আগে মাসখানেক দেখি।’

বস্তুত এক মাসের আগেই ইন্দ্রজিৎ আর সুজয় ছাড়া বাকিরা কেটে পড়েছিল। তারা আবার নাকে খত দিয়ে সম্মিলনিতে। অনেক ত্যারছা মন্তব্য হজম করতে হয়েছিল তাদের, ‘দেখি আসল জিনিস কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস তোরা? শার্টের পকেটে না প্যান্টের পকেটে, নাকি জাঙিয়ার বুক পকেটে?’

বিনোদদা শুরু করেছিলেন দাচি বা স্টান্স দিয়ে। কিবাদাচি বা ঘোড়সওয়ারের ভঙ্গি, জাঙ্গুৎসুদাচি বা সামনে ঝোঁকার কায়দা, কোকুৎসুদাচি বা পেছনে ঝুঁকে দাঁড়ানোর কৗশল, সানচিংদাচি বা থ্রি পয়েন্ট স্টান্স, কুমিতেদাচি বা রণপ্রস্তুতি– এইসব। দুই পায়ের নানারকম অস্বাচ্ছন্দ্যকর ভঙ্গি ও হাতকে বিশেষ অবস্থানে রেখে দাঁড়িয়ে থাকা। শুরুর কিবাদাচি অনেকটা ভরতনাট্যমের ভঙ্গিতে দাঁড়ানো। প্রথমটায় উৎকটাসনের মতো সহজ মনে হলেও যখন ওই স্টান্সে পনেরো মিনিট দাঁড়াতে বলা হতো, বেশিরভাগই ‘উঃ আঃ’ করে সাত আট মিনিটের মাথায় উঠে দাঁড়াত।

সময়টা বাড়তে থাকলে ছাত্র সংখ্যা কমতে থাকল। কেউই জাঙ্গুৎসুদাচির পর টিকে থাকেনি। ইন্দ্রজিৎ আর সুজয়কে যখন কোনও স্টান্সে এক ঘণ্টা পর্যন্ত দাঁড় করিয়ে রেখে দিতেন বিনোদদা, প্রবল যন্ত্রণাবোধটা যখন ক্রমশ অস্তিত্ব অসাড় করে দিত, তখন ইন্দ্রজিতের সংশয় হতো, লোকটা সত্যিই কিছু শেখাতে চায় তো। কিন্তু কষ্ট সহ্য করার অলৗকিক ক্ষমতা অর্জনের সাথে সাথে মাসখানেক পর স্নানের সময় নিজের উরু আর গুলির পেশির দিকে তাকিয়ে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। নার্সিসাসের মতো নিজেকে আয়নায় দেখে যেত। মুখখানা তো তার মারকাটারি ছিলই। কিন্তু শরীর ডিগডিগে, হাত-পা টিংটিঙে। ওই সুগঠিত পা’দুটো ইন্দ্রজিৎ পুরকায়স্থেরই তো? শুধু দাঁড়াতে শিখেই এই? তাহলে হাত পা ছুড়ে অক্ষয় মার্কা চেহারা পেতে কত দিন?

সুজয়ের চেহারা বরাবরই দোহারা। তার গায়ের জোর, ঘুসির পরিধি অনেক বেশি। তবু ইন্দ্রজিৎ ওর সঙ্গে সমানে টক্বর দিয়ে যেত। ওর সম্পদ ছিল নমনীয়তা, গতি আর অ্যাকিউরেসি যাকে বাংলা করে ত্রুটিহীনতা বললে বাড়াবাড়ি শোনাতে পারে। সম্পূর্ণ ত্রুটিহীন কেই বা হতে পারে? বছর তিনেক পর সুজয় গেল অন্য গুরুর কাছে। বিনোদদার শিক্ষানবিশি যত উচ্চাঙ্গেরই হোক, তিন বছরেও একটা ন্যূনতম ‘ইয়েলো বেল্ট’-ও দিতে পারল না। কোনও স্বীকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয় যে। ওদিকে, গৗরাঙ্গরা লম্ফঝম্প করে ব্রাউন বেল্ট থেকে এখন ব্ল্যাক বেল্টের দাবিদার। সম্মিলনি নয়, সুজয় গেল কলকাতার এক নাম করা প্রতিষ্ঠানে। তারা সোটোকান শৈলী শেখায়। তা হোক। সুজয়ের অসুবিধা হল না। বছর দুয়েকের মধ্যে সে-ই নতুন বাচ্চাদের তালিম দেওয়ার কাজ পেয়ে গেল। ক্যারাটেকেই ধ্যান জ্ঞান করেছে সে। মাধ্যমিকে ভালো ফলের অভিলাষ নেই, উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চায় না, তার পরে না পড়লেও চলে।

সুজয় বন্ধুকে লুকিয়ে চলে যায়নি। সঙ্গে নিতেই চেয়েছিল। কিন্তু ইন্দ্রজিতের পড়াশুনোয় ভালো হিসাবে মাধ্যমিকে স্টার পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল, উচ্চমাধ্যমিকের পর জয়েন্ট ইত্যাদির পরিকল্পনা ছিল। স্কুল টিউটোরিয়াল করে বাড়ির কাছে বিনোদদার আখড়াটা চালানো যায়, কলকাতায় দৗড়ে সময় নষ্ট করা সম্ভব নয়। তাছাড়া বিনোদদাকে ভালোও বেসে ফেলেছিল। ইন্দ্রজিতের বাবা এসে মাস তিনেক বিনে পয়সায় শিক্ষার পর খামে ভরে টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই থেকে ছেলের হাতেও মাসের শুরুতে খাম পাঠিয়ে দিতেন। সুজয়কেও লজ্জায় পড়ে গুরুদক্ষিণা চালু করতে হয়েছিল। কিন্তু এমন নির্লোভ আপনভোলা গুরু আজকের যুগে কেন, ত্রেতা যুগেও কেউ ছিল কিনা কে জানে? অন্তত দাপরে যে ছিল না, তার প্রমাণ দ্রোণাচার্য, পরশুরামরা রেখে গেছেন। গুরুগৃহে শ্লোক মুখস্থ ও পেট ভাতার বিনিময়ে বৈদিক যুগের ছাত্রদের গুরুর গরু চরানো, ক্ষেত চষা, বাড়ির কাজ সবই করতে হতো। সে অন্যত্র গেল না।

কিন্তু বিনোদদা বিনা নোটিসে বেমক্বা হার্টফেল করে চলে গেলেন। অমন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, কোনও মন্দ দোষ বা নেশা অন্তত ছিল না। হিসাব মিলছিল না। অনাত্মীয় মানুষটা কেন বার্মা ছেড়ে এই দত্তপুকুরে জমি কিনে বসবাস শুরু করেছিলেন, সেটাও অজানা থেকে গেল। উনি মারা যাওয়ার পর কোনও এক দূর সম্পর্কের ভাইপো নিজেকে একমাত্র বৈধ উত্তরাধিকারী প্রমাণ করে ওই বাড়িতে সপরিবারে প্রতিষ্ঠিত। বাড়ির উঠোনে এখন দড়িতে শাড়ি, জামা, কাঁথা ঝোলে এক গাদা। সম্মিলনিতে ফিরে যাওয়ার মুখ নেই। ক্যারাটে তার এই পর্যন্তই ভাগ্যে ছিল।

আজকাল জয়েন্টের সিট অনেক বাড়ানো হয়েছে। নব্বই দশকের গোড়াতেও মেডিকেলের আসন ছিল হাজারের কম, ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বারোশোর মতো। এখন নাকি বসলেই পাওয়া যায় প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর রমরমায়। বাবার ইচ্ছে কারিগরি, নিজের আয়ত্বে জীবনবিজ্ঞান। দুটোতেই বসেছিল। মেদিনীপুরের একটা কলেজে অ্যাডমিশন হয়েও যেত। কিন্তু বাবা শিবপুর, যাদবপুর বা বড়ো জোর উত্তরবঙ্গের সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ছাড়া প্রাইভেট কলেজগুলোতে পড়ে কিছু শেখা যায় বলে মানতেই নারাজ। হয়তো খরচায় কুলোলে মত বদলাতেন। মা বলেছিলেন, ‘পলিটেকনিক দে’। বাবা নাক সিঁটকে বলেন, ‘কোথায় বিই, আর কোথায় পলিটেকনিক ইঞ্জিনিয়ার? যে ডাক্তার হওয়ার যোগ্য, তাকে বলছ আয়া হয়ে থাক। অশিক্ষিত মেয়েমানুষের বুদ্ধি আর কাকে বলে? দরকার হলে ফিজিক্স নিয়ে জেনারেল পড়বে।’

‘কেন তোমার বন্ধু তিমিরবাবু পলিটেকনিক পাস করেই তো কোম্পানির অ্যাডিশনাল চিফ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে রিটায়ার করবে। আমি যেটা সহজে হবে আর ও পারবে সেটা বলেছি। মুখ্যু মানুষের খোঁটা তো নতুন নয়। তুমি ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে টেকনিক্যাল অফিসার…’

‘যা বোঝো না, তাই নিয়ে কথা বোলো না। অফিসে আমার কাছে এখনও সবাই আসে যে-কোনও টেকনিক্যাল সমস্যা নিয়ে, এমনকী যে-কোনও ক্রিটিক্যাল চিঠি ড্রাফট্ করাতে হলেও অবিনাশ পুরকায়েত। এত বছর কাজ দেখিয়ে…। আমার দুর্বল জায়গায় একদম ঘা দেবে না। আদর্শ স্ত্রী হওয়ার শিক্ষাই পাওনি, আর ছেলের পড়াশুনো নিয়ে ফোড়ন কাটতে এসেছে…’

দাদা বাবাকে কিছু বলতে সাহস পায় না। মায়ের ওপরই বিরক্তি প্রকাশ করে। সে নিজের জেদে এমকম করে আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভালো চাকরি করে। ইন্দ্রজিতের এখনও পড়াশুনোই শেষ হয়নি। তবু দাদা অরবিন্দের ভাষায় সে বেকার। ছোটো ভাইয়ের কেরিয়ার নিয়ে আলোচনা হতে একদিন মন্তব্য করল, ‘মা, বাবার কিন্তু বেশিদিন চাকরি নেই। ভস্মে ঘি ঢালার পর নিজেদের খাওয়া পরার ব্যবস্থাটা যাতে থাকে সেটা দেখো।’

সারা জীবন সবার জন্য এত করে নিজের ছেলেকে কি কোনও নৈতিকতা শেখাতে পারেননি অবিনাশ? বুড়ো মানে অরবিন্দ নিজের বাবাকে দেখেনি কীভাবে ঠাকুমা দাদু তিন কাকা, তিন পিসির অত বড়ো সংসার টেনেছেন? বাড়িতে এসোজন বোসোজন লেগেই থাকত। মা অভূক্ত থাকলেও কোনওদিন অভিযোগ করেননি। এখনও দুপুরে এলে কেউ না খেয়ে যেতে পারে না। সেই বাপ মার ছেলে হয়ে নিজের মায়ের পেটের ভাইয়ের দায়িত্ব এড়িয়ে হিংসা? ছোটনের তো এখনও দায়িত্ব নেওয়ার সময় শুরুই হয়নি। এখনও এই সংসার বাপের টাকায় চলে। রোজগেরে ছেলে খেয়াল খুশি মতো এটা সেটা শখের জিনিস কিনে নিজের ঘর সাজায়। সংসারে দেওয়ার মধ্যে পুরোনো ফ্রিজ বদলে একটা দুই দরজার ফ্রিজ কিনেছে। সেটাতেও সদা সতর্ক। যেন সে ছাড়া আর কেউ রেফ্রিজারেটর ব্যবহার করতে জানে না, নষ্ট করে ফেলবে। ছোটনের মতো শান্ত ও বাধ্য ভাই, যে বাবা দাদার ফরমাসে দিনে শতবার দোকান হাট ইলেকট্রিক অফিস, গ্যাসের দোকান দৌড়োচ্ছে, এমনকী পরীক্ষার আগেও মুখে কোনও ভাবান্তর ঘটায় না, তার প্রতি কেন এত বিদ্বেষ? ছোটো ছেলেটার মুখচোখ মায়ের আদলে বেশ চোখা চোখা, বাবার মতো মাঠো মাঠো গায়ের রং। বড়োর মাথা আর গায়ের রং দুটোই টকটকে পরিষ্কার, শুধু মনটাই সাফ হয়নি। …কাঁধে ব্যথা নিয়ে ইন্দ্রজিৎ দাদার ঝাঁজের কারণ খানিকটা অনুমান করতে পারে।

কস্তুরী সল্টলেকের একটা কল সেন্টারে চাকরি করে। শিফ্ট ডিউটি। কখনও ভোরে উঠে দৗড়োতে হয়, কখনও দুপুরে আবার কখনও সময় রাত্রি আটটায় অফিসের বাস ধরার জন্য এই মোড়ের মাথায় এসে দাঁড়ায়। অফিস ফেরতা তাকে প্রায় রোজই দেখত অরবিন্দ। একবার রবিবারে বাজারে দেখা হওয়াতে দুজনেই দুজনকে দেখে হেসেছিল, ‘বাজার করতে?’

কস্তুরীর নাইট শিফ্ট না থাকলে নিয়মিত দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই ছোটো ভাই নিয়ম করে বাজার করলেও রবিবার অরবিন্দ একবার বাজারে চক্বর দিয়ে যায়। রবিবার সকাল আটটা নাগাদ যেতে পারলে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সবজিপাতি, মাছ মাংস কী লাগবে জানা না থাকায় খান দশেক মিষ্টি কিনে বাড়ি ফেরে। কস্তুরীকে দেখতে পেলে খানিক গল্পগুজব আর প্রশ্ন, ‘নাইট শিফট কবে থেকে?’

আমেরিকান শিফট থাকলে কস্তুরী আজকাল একটু আগে আগেই অফিসের বাসের জন্য মোড়ের মাথায় অপেক্ষা করতে থাকে। আর অরবিন্দ স্টেশনে নেমে একটু দেরিতে বাড়ি ঢোকে।

‘রবিবার দিন বাজার ছাড়া আর কোথাও দেখা করা যায় না?’

‘এই তো দেখা হচ্ছে।’ হেসেছিল কস্তুরী।

অতঃপর দুজনেরই বাজারের ঘটা বেড়ে যায়। রোজগেরে ছেলে শুধু মিষ্টি কিনে বাড়ি ফিরলে ভালো দেখায় না বলে মাছ, মাংস, পনির, গোলদারি যেসব দোকানে কস্তুরী লাইন দেয়, অরবিন্দকেও সেখানে সেখানে হাজিরা দিতে গিয়ে এটা সেটা কিনতেও হয় মাঝেমধ্যে। যদিও জানিয়ে দেয়, সংসার খরচ বাবদ মা আর বাজার বাবদ ছোটো ভাইকে টাকা দেওয়াই আছে। কস্তুরীর একটাই উত্তর, মৃদু হাসি।

ফেরার পথে একটা চায়ের দোকানে খানিকক্ষণ বসা। দুজনেই বাড়ি গিয়ে মায়ের হাতে বানানো চা খেতেই পছন্দ করে। তবু। চায়ের দোকানে বসার প্রস্তাব অরবিন্দের হলেও তার খুচরোর অভাবে দাম বেশির ভাগ কস্তুরীই মেটায়। সঙ্গের হাসিটা ফাউ।

সেদিনও চা খেতেই ঢুকেছিল। দোকানটায় বড্ড বেশি ভিড় ছিল ওইদিন। একদল টি-শার্ট পরা ছোকরা উচ্চকণ্ঠে গুলতানি করছিল। কস্তুরী বলল, ‘আজ থাক। এত ভিড়ের মধ্যে…। চেয়ারও তো ফাঁকা দেখছি না’।

‘কেন, এই তো জায়গা ফাঁকা ওদিকে। সব সময় কি অধৈর্য হলে চলে? ফাইভস্টার হোটেলেও অনেক সময় ক্যাফেটেরিয়ায় টেবিল পেতে লাইন দিতে হয়। হাবু দা চারটে বেগুনি আর দুটো চা দাও।’

‘না না। আজ এই ক্যালর-ব্যালোরের মধ্যে বসতে ইচ্ছা করছে না। আমার বাড়িতে এসো বরং, চা খেয়ে যাও।’

একটা তালঢ্যাঙা লোক কস্তুরীর দিকে মন্তব্য ছুড়ে দিল, ‘ভিড়ে পোষাচ্ছে না? নিরিবিলি চাও? সকালবেলাতেই ফুর্তির ফোয়ারা বসাবে নাকি মান্তু? সন্ধেটা ফ্রি থাকলে আমাদের কাছে এসো না, সব পুষিয়ে দেব।’

‘একদম বাজে কথা বলবেন না। মিনিমাম ভদ্রতাটুকু নেই। এদের জন্যই আমি এখানে বসতে চাইছিলাম না। এখন বুঝেছ তো? শুধু শুধু এইসব নোংরা কথা শুনতে হল।’ কস্তুরী বেশ শান্ত মিষ্টি মেয়ে। এভাবে রেগে গলা চড়িয়ে কথা বলতে দেখেনি অরবিন্দ।

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আজ থাক। চলো যাই।’ অরবিন্দ কস্তুরীর বাহু ধরে টান দিল।

ওই দলের আর একজন উঠে এসে বলল, ‘মেয়েছেলের হাত ধরে টানাটানি করছিস। তার বেলা কিছু নয়। আর আমার ফ্রেন্ড দুটো রসিকতা করল তো ইজ্জত খসে গেল?’ ছেলেটা সোজা কস্তুরীর অন্য হাত ধরে টান লাগাল।

‘একী? একী অসভ্যতা! ছাড়ুন বলছি হাত। আমি কোথায় বসব, কার সাথে চা খাব আমার ব্যাপার। আপনারা মাথা গলানোর কে? হাবুদা কিছু বলুন। দেখছেন তো কী করছে।’

হাবুদা মন্তব্য করল, ‘শালা, মেয়েছেলে থাকা মানেই ঝঞ্ঝাট!’

বাকিরা কেউ কিছুই বলছে না। গুনগুন করে যে আওয়াজটা হল তাতে মনে হল হাবুর কথাটা একাধিক সমর্থন পেল। অরবিন্দও চুপ। সে কস্তুরীর হাত ছেড়ে দিয়েছে।

কস্তুরী স্তম্ভিত হয়ে অরবিন্দের দিকে তাকাল, ‘তুমিও কিছু বলবে না? আমাকে এখানে নিয়ে এসে এখন বিপদে ফেলে ল্যাজ গুটিয়ে পালাবে?’

‘তুমি চুপচাপ ওই কোণার টেবিলে ওয়েট করলে এত কথা হতো না। তা নয়, ঘটা করে নিজের চলে যাওয়া অ্যানাউন্স করে ওদের প্রভোক করলে।’

‘আমি প্রভোক করেছি? তোমাকে দোকানে ঢোকার আগেই বললাম এখান থেকে চলো যাই। ছেলেগুলোর হাবভাব দেখেই সুবিধের নয় মনে হয়েছিল। আমরা ভেতরে ঢুকলে কি ওরা টিজ করত না? এত স্পর্ধা আমার গায়ে হাত দিচ্ছে!’ কস্তুরী উত্তেজনায় কাঁপছিল।

‘গায়ে তো হাতই দিয়েছি সোনা। অন্য কিছু তো নয়। খিক্খিক্।’ ঢ্যাঙার মন্তব্যে দলের সবকটা মিলে বিকট হাসতে শুরু করল। দোকানের ভেতরে খদ্দেরের ভিড় কমে গেল, বাইরে দর্শকের ভিড় বাড়তে লাগল।

হাবুদা গজগজ করল, ‘মেয়েছেলে রোজগার করলে ধরাকে সরা জ্ঞান করে।’ কী আশ্চর্য! লোকটা সব দেখেও ছেলেগুলোকে কিছু বলছে না। কস্তুরীর ওপর ঝাল ঝাড়ছে, যে নিয়মিত আসে। আরও আশ্চর্য– অরবিন্দের প্রতিবাদের সাহস না থাকুক, কস্তুরীকে দোষ দিয়ে পালানোর পথ খুঁজছে?

‘এবারের মতো ছেড়ে দিন। ওকে বাড়ি পৌঁছে দিই।’ বাপরে, অরবিন্দ অনেক সাহস দেখিয়ে ফেলল তো।

‘আমরা কি খুকিকে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারি না?’

অকস্মাৎ জনতার জটলা ভেদ করে এক সুদেহী যুবক বেরিয়ে এল। আততায়ীর কবজি চেপে ধরে কস্তুরীর হাত ছাড়িয়ে নিল ওদের হাত থেকে। ‘দাদা তুই কস্তুরীদিকে নিয়ে চলে যা, আমি এদের দেখছি– কত বড়ো মস্তান। চিন্টু সুজয়কে খবর দে তো।’

সুজয় আসার আগেই তিনটে ছেলেকে দোকান থেকে টেনে বের করে মেরে পাট করে দিল ইন্দ্রজিৎ। বাকিরা আক্রোশে কাপ-প্লেট ভেঙে, চেয়ার হাতে নিয়ে আক্রমণ করতে এল ইন্দ্রজিৎকে। অরবিন্দ সেদিন কার মুখ দেখে উঠেছিল কে জানে? কিন্তু ভাইকে সাবধান করার মতো গলার জোরটাও নেই। কস্তুরীর উদ্দেশ্যে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল, ‘তোমার জন্য এই ঝামেলার উৎপত্তি। ছেলেগুলোকে গালাগাল না দিয়ে ভদ্র ভাষায় বলা যেত না? বোলতার চাকে ঢিল ছুড়েছ। এবার দেখো, কদ্দুর গড়ায়। চলে এসো।’ হাত ধরে টানল অরবিন্দ।

কস্তুরী এক ঝট্কায় হাত ছাড়িয়ে নিল। ‘আর যার সাথে যাই, তোমার সঙ্গে তো নয়ই। আর কাউকে আমার জন্য বিপদে পড়তে দেখে তোমার মতো পালিয়ে যেতে আমি পারব না। ছোটন, তোমায় চেয়ার তুলে মারতে আসছে!’ কস্তুরী চেয়ার মাথায় ছেলেটাকে ঠেলার চেষ্টা করল। বাকিরা ওকে যাচ্ছেতাই ভাবে জড়িয়ে ধরল।

সুজয় আর সম্মিলনি কতগুলো ছেলে চলে এসেছে। অত বড়ো হাট্টাকাট্টা চেহারা নিয়ে সুজয় এক পাশে দাঁড়িয়ে রইল। অতনু তার প্যানপ্যাঁকাটি চেহারা নিয়ে চিতার মতো অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার দেখাদেখি তনয়। সুজয় সামান্য খাঁকারি দিল দল ভারি হতে, কিন্তু ষোলো ইঞ্চির বাইসেপস্ওয়ালা হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে রইল একপাশে। মাথা বাঁচলেও চেয়ার কাঁধে লেগে ইন্দ্রজিতের মুখ যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেল।

‘তোমার পরিচয় পেয়ে গেছি। আমার সঙ্গ পাবে বলে এখানে নিয়ে এসে কতগুলো ইতর হুলিগানের হাতে তুলে দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছ? নিজের ভাইকে দ্যাখো’।

‘ওর মাস্তানি দেখানো বেরিয়ে যাবে। গুন্ডা বদমাশদের সঙ্গে যেচে কেউ লাগে? ওদের কাছে ছুরি-ছোরা, আর্মস থাকে। ক্যারাটে শিখে হিরোগিরি দেখাচ্ছে।’

‘ছিঃ! প্রতিবাদ করার সাহস সবার থাকে না। যা ঘটছে চারদিকে, সেটা করা নিরাপদও নয়। কিন্তু নিজের অক্ষমতা ঢাকতে কখনও আমাকে দোষারোপ করছ, কখনও নিজের ভাইকে। আমি কিন্তু ছোটনের সঙ্গে নয়, তোমার সঙ্গে এখানে এসেছিলাম। ও মাগো! ছোটন সাবধান!’

সুজয় এসে আক্রমণকারীকে অনুনয়ের ভঙ্গিতে পেছন থেকে জাপটে ধরল। ‘ভাই কী হচ্ছে কী? শান্ত হও। শুধু শুধু…।’

সুজয়ের দুই বাহুর আলিঙ্গনে একসাথে দুজন চ্যাঙড়া চলৎশক্তিহীন হয়ে গেল। অথচ ওই বিশাল দেহ আর বল নিয়ে সে এতক্ষণ চুপচাপ দেখছিল। ও আগে এগিয়ে এলে ইন্দ্রজিতের আঘাত লাগত না, অতনুর মুখ মাথা ফেটে কনুই কেটে রক্তারক্তি হতো না। সুজয় ছাড়া অল্প-বিস্তর চোট লেগেছে, এ পাড়ার যে ছেলেগুলো এগিয়ে এসেছিল তাদের সবারই।

অরবিন্দের সঙ্গে এক মুহূর্ত থাকতে রাজি নয় দেখে, কস্তুরীকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য সুজয় রিকশা ডেকে চড়ে বসল। কস্তুরী ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আমি একাই যেতে পারব। তার আগে আমার জন্য যারা ইনজিওরড্ হল তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করব।’

কস্তুরীর সঙ্গে বাড়ি ফিরতে অরবিন্দর কী ঝাঁজ! ‘ক্যারাটে ব্ল্যাক বেল্ট, বীরত্ব দেখানোর হাতে গরম পুরস্কার পাওয়া হয়ে গেল তো? ইস্! এমন দয়াময়ী সাহসিনী আর দুচার পিস থাকলে ওই ইভটিজিং-এর প্রোটেস্ট করা ছোকরাগুলোকে বেঘোরে মরতে হতো না।’

কস্তুরী মুখ খুলল, ‘নিজের ভাইয়ের ওই ছেলেগুলোর মতো পরিণতি হোক চাইছিলে মনে হচ্ছে!’

‘আমাকে ভদ্রলোকের মতো খেটে খেতে হয়। বাপের হোটেলে থেকে আর ভাইয়ের অন্ন ধবংস করে মারামারি শেখার সৌভাগ্য তো সবার হয় না। আর লম্বা চওড়া মাসল্ বাগানো বডি নিয়ে হিরোইজম দেখাতে কার না সাধ যায়?’

‘দাদা, অন্যায়ের প্রোটেস্ট করতে সবার আগে যেটা দরকার হয় সেটা হল মেরুদণ্ড। স্ট্রিট-ফাইটিং-এর জন্য মাসলস-এর চেয়ে আগে দরকার কলজে। অতনুকে দেখলি না? ওই নিঙলে চেহারা নিয়ে কীভাবে ফুঁসে উঠল? তনয়, বাপি এরাও কেউ ব্রুস লি বা হলিফিল্ড নয়। ওদিকে সুজয় আমার দেড়া চেহারা নিয়ে চুপচাপ আমাদের মার খেতে দেখে গেল। ওরা কোণঠাসা হওয়ার পর শালা মিটমাট করতে ময়দানে নামল। না হলে সবকটাকে পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখাতাম আমরা। কস্তুরীদি তো আগে অতনুকে হাসপাতালে অ্যাডমিট করার ব্যবস্থা করল। বাকিদেরও হসপিটালে ফার্স্টএইড দেওয়া হয়েছে।’

অরবিন্দ ভেতর ঘরে যাওয়ার আগে হিসহিসিয়ে স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে কথা ছুড়ে দিয়ে গেল, ‘সবচেয়ে উপাদেয় পদটা শেষপাতের জন্য তোলা থাকে।’

কস্তুরী চোয়াল শক্ত করে তারপর চোখ বুজিয়ে রাগের সঙ্গে বোধহয় খানিকটা কান্নার দলাও গিলে ফেলল। তারপর ধরা গলায় বলল, ‘মাসিমা, এলাম। ডাক্তার কিন্তু গরম জল নয়, আইস কম্প্রেস করতে বলেছেন। হট ওয়াটার ব্যাগ থাকলে তার মধ্যেও বরফ ভরে নিতে পারেন। ডাক্তারবাবু এক্স-রে প্লেট দেখে নিয়েছেন, কিন্তু ক্লিনিক থেকে রিপোর্টটা আজ সন্ধেবেলায় কালেক্ট করতে হবে। ওষুধগুলো মনে করে খেও ছোটন। আর পরের কথা– ভগবান দুটো কান দিয়েছেন কেন জানো তো?’ তারপর নিজেকেই বলল, ‘আমি ভেবে পাই না, মেয়েরাই যেখানে টার্গেট হয় সেখানে তাদের নিদেন পক্ষে সেলফ্ ডিফেন্সটুকু শেখারও ব্যবস্থা থাকে না বেশিরভাগ জায়গায়। অ্যাটাক করে ভয় না দেখালে রেসকিউ করে ছেলেরা কথা শোনাবে কী করে?’

বাকিদের কাটা ছড়া, হাড়ে ফাটল ধীরে ধীরে সেরে গেলেও ইন্দ্রজিতের কাঁধের ব্যথাটা ছ মাস পরেও পুরোপুরি গেল না। এখনও বাজার দোকান করে, মানে করতে হয়। কিন্তু ডান হাতে বা কাঁধে ভারি ব্যাগ নিলেই পুরো হাতটাই খচকা লেগে অবশ হয়ে আসে। কস্তুরী জোর করে কিছুদিন ওর চিকিৎসার খরচ চালিয়েছিল। বাড়ি এসে খোঁজ করে যেত মাঝে মাঝে। অরবিন্দের উপস্থিতি বা প্রতিক্রিয়া যেন দেখতেই পেত না। রিকশায় বসিয়ে সঙ্গে করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেত।

অতনুরা ওদের একসাথে দেখে একবার দুই আঙুলে ‘দারুণ’ মুদ্রা ফুটিয়ে মন্তব্য ছোড়ে, ‘বস, সচীনের চেয়ে অঞ্জলি সাত বছরের বড়ো, অভিষেকের চেয়ে ঐশ্বর্যও দু-তিন বছরের বড়ো।’ বুকের ভেতরটা যে একটু শিরশির করেনি তা নয়। দাদার বান্ধবী বলে কস্তুরীকে দিদি ডাকে, না হলে বয়সের ফারাক তেমন কিছু নয়। কিন্তু বন্ধুদের রসিকতায় কস্তুরীর সাহস ও সহানুভূতি দুটোর প্রবাহই বন্ধ হয়ে গেল। এখন রাস্তাঘাটে চোখাচোখি হলে, ‘ভালো?’– এর বেশি কথা হয় না।

কাঁধের ব্যথাটা এমনিতে নিয়ন্ত্রণেই থাকে। কিন্তু ডাক্তার ও ফিজিওথেরাপিস্টের দেখানো ব্যায়াম ছাড়া আর কোনও কসরত করতে গেলেই হাত নড়ানো, ঘাড় ঘোরানোর উপায় থাকে না বেশ কিছু দিন। ওয়েট ট্রেনিং তো নৈব নৈব।

বিনোদদা চলে গেছেন চার বছরের ওপর। সুজয় এখন সম্মিলনি ক্লাবের সুজয় স্যর। কস্তুরী কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে। কথা তো দূর, দেখাই হয় না আর। নতুন নম্বরও নেওয়া হয়নি। চাকরির পরীক্ষা সাক্ষাৎকারের ছোটাছুটির মধ্যে দেহটাকে যোগাসন করে সচল রেখে চলেছে। কাঁধে মাঝেমধ্যে চিড়িক মারা চিনচিনে ব্যথার মতো দাদার এখনও অবদি চালিয়ে যাওয়া তির্যক মন্তব্যগুলোও যেন জিইয়ে রেখেছে কিছু গোপন পর্বের স্মৃতি– চার বছরের তদগত মার্শাল আর্ট সাধনা অথবা কাঁধে কস্তুরী…দির হাতের স্পর্শ, ‘ছোটন পেইনকিলার বেশি খেয়ো না, সেঁক নিও। তুমি আবার প্রাকটিস শুরু করতে না পারলে নিজেকে বড়ো অপরাধী মনে হবে।’

জোড়া-বকুল

বকুলগাছটার ভেতরে কী ছিল কে জানে! ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হলেই গাছটা কেমন যেন মোহময়ী রহস্যের ঘোমটা পরে নিত। তখন তার পাতায় পাতায় হিল্লোল। ডালপালায় দু’হাত বাড়ানো আর্তি। ইমন এসব ছোটোবেলায় বুঝত না। ধীরে ধীরে পরত খোলার মতো জেনেছে নিজের অনুভূতি দিয়ে। পুরো বর্ষাকাল এখন তাকিয়ে থাকে বকুলগাছটার পাতার দিকে। গাঢ় সবুজ পাতার প্রান্তে সামান্য কোঁকড়ানো ভাব, স্থূল চোখে দেখা যায় না। মন দিয়ে দেখলে, যেমন সব মেয়ের লম্বা চুলেই ঢেউ খুঁজে পাওয়া যায়, তাদের বাড়ির পশ্চিমদিকের বকুলগাছের সব পাতাতেই তেমন প্রান্ততরঙ্গ দেখা যাবে, ইমন লক্ষ্য করেছে।

– এই ইমন, ইস্কুল যাবি না?

ইমনের মা প্রতিভা মেয়ের কাছে জানতে চায়। ইমনের আজ স্কুলে যাওয়ার খুব একটা ইচ্ছা নেই। আজ ৫ সেপ্টেম্বর। শিক্ষক দিবস। স্কুলে পড়াশোনা বিশেষ হবে না। নাম কা ওয়াস্তে স্কুল। তাই যাওয়ার বিশেষ ইচ্ছা নেই। আবার সিএল-ও শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। কিছুটা সময় নিয়ে ইমন নিজেকে রাজি করায় স্কুলে যাওয়ার পক্ষে।

– হ্যাঁ মা, যাব। তুমি ওয়াড্রোব থেকে কমলা ঘিয়ে পিত্তর সিল্কটা বের করে রাখো। আর কালো ব্লাউজটা। আমি বাথরুমে গেলাম।

– কোনটা বলতে কোনটা বের করব! তুই এসেই বের করিস।

প্রতিভা ঈষৎ বিরক্ত হয় মনে মনে। কিন্তু মেয়েকে বুঝতে দেয় না। শাড়ি ব্লাউজ বার করে দিতে তার অসুবিধা নেই কিন্তু ঠিক ঠিক কোনও দিনই বার করতে পারে না।

বাথরুমের দরজা বন্ধ করতে করতে ইমন মায়ের সঙ্গে খুনসুটি করে, তবে তোমার পছন্দের শাড়ি একটা বেছে দাও। যেটা পরলে তোমার মেয়েকে যে-কোনও পাত্রের একবারেই পছন্দ হয়ে যায়।

– সে ভাগ্য কি আমার হবে! তোর বাবা থাকলে এত চিন্তা করতাম না!

ইমন মায়ের সঙ্গে কথা বাড়ায় না। হড়াৎ করে বাথরুমে ঢুকে যায়। তার দেরিও হয়ে গেছে। ন’টা কুড়ির শিয়ালদা লোকালটা ধরতে হবে। হাতে আর মাত্র পঁচিশ ছাব্বিশ মিনিট। এই ট্রেনটা মিস করলে পরেরটা ন’টা পঞ্চাশে। বলরামপুর স্টেশন থেকে বারুইপুর এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিট। স্কুল অবশ্য স্টেশনের কাছেই। রিকশায় পাঁচ মিনিট আর হাঁটলে মিনিট দশেক। আজকাল লোকের যা চাপ গাড়ি ঘোড়া চালানোই যায় না। ইমন অবশ্য রোজ রিকশাতেই যায়। লোকের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি তার ঠিক পছন্দ হয় না। গা চিড়বিড় করে যেন। অবশ্য ট্রেনের কথাটা আলাদা। উপায় নেই। তবুও সে চেষ্টা করে লেডিজ কম্পার্টমেন্ট ধরতে।

হাতে সময় না থাকলে মানুষ বাথরুমে ঢুকেই জামাকাপড় খুলে ফেলে। তারপর ঝপাৎ ঝপাৎ জল ঢালে শরীরে। নগ্নতার গা মোছে। কিন্তু ইমন সেটা পারল না। বাথরুমের জানলা দিয়ে বকুলগাছটা দেখা যায়! আজ ইমনের চোখে পড়ল বকুলগাছটা কেমন চকচকে চোখে তাকিয়ে আছে। অন্যদিনের থেকে বেশ অন্যরকম তাকানো। ইমন কিছুতেই সালোয়ার খুলতে পারে না। কোনওদিনই পারে না। ইমন আজ বাথরুমের ছোটো জানলাটা বন্ধ করে। খুব লজ্জা পাচ্ছে আজ তার। জানলাটা বন্ধ করার পরেও সে জামাকাপড় পরেই স্নানটা সারে। বাথরুম থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এসে যেন বাঁচে। বকুলের চোখের আড়াল না হলে লজ্জা যেন যাবার নয়।

অনেকটা জায়গা নিয়ে ইমনদের বাড়ি। বাড়ির পরেই পরিখা। আসলে লম্বা খালের মতো চারদিকে চারটে পুকুর। বাবা খুব গর্ব করে পুকুরগুলোকে পরিখা বলত। তাই ইমনও পরিখা বলে। সেই পুকুরগুলোর চওড়া উঁচু পাড়। সেই উঁচু পাড়ে নানান বৃক্ষের সমাবেশ। শিরীষ, সেগুন, সোনাঝুরি, অর্জুন, কদম প্রভৃতি দামি কাঠের গাছগুলো পুকুরের বাইরে সার সার দাঁড়িয়ে আছে যেন প্রহরী। তাদেরই মধ্যে পশ্চিম দিকে ইমনের প্রিয় বকুল গাছ ঝাঁকড়া হয়ে উঠে গেছে আকাশের দিকে। বকুলগাছটা ইমনের বাবারও প্রিয় ছিল। আলাদা ভাবে যত্ন করত বকুলগাছটার, ইমনের মনে আছে। আর মনে আছে একটা কথা। গাছটা বসানোর দিনেই বাবা কাউকে ফোনে বলছিল, গাছটা যতদিন বাঁচবে তোমাকে পাব!

পরিখার ভেতরে যত ফলের গাছ। নানান আমগাছ। এমনকী একটা আলফানসো আমেরও গাছ বসিয়েছিল ইমনের বাবা। কোথা থেকে কিনে এনেছিল ইমন জানে না। ইমন তখন খুব ছোট্ট। ক্লাস থ্রি। জাম, লিচু, জামরুল, সবেদা, চালতা, ডেয়াঁ ফল। এমন ফল নেই তাদের বাগানে, যা এ অঞ্চলে ফলে না। ইমনের সামনেই গাছগুলো বড়ো হল, এখন ফল দিচ্ছে। সব ঠিকঠাক। যেমন যেমন বাবা বলেছিল, দেখিস আম ফলবে আগে, তারপর লিচু, হয়তো সে বছরই জাম ধরবে। চালতার একটু দেরি হবে। সবেদা অল্প অল্প দু’বছর পর থেকেই ফলবে। সব বাবার কথামতোই ফল দিচ্ছে। শুধু বাবাই হঠাৎ করে চলে গেল। দুদিনের ধুম জ্বর। ডাক্তার, হসপিটাল করার আগেই সব শেষ।

ইমনের তখন ক্লাস ফাইভের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখে তাদের বাড়ি ভর্তি লোকজন। চেনে না জানে না এমন সব লোক বাবার বসানো গাছগুলোর গায়ে উঠে পড়ছে যেন। গাছগুলো তখনও বেশ ছোটো। ধাক্বা মারলে ভেঙে যাবে। ইমনের খুব রাগ ধরছিল লোকগুলোর উপর। তার থেকেও বিস্ময়। এত লোক কেন! দৗড়ে ঘরে ঢুকে দেখে বাবা বিছানায় নিস্পলক শুয়ে। সেই প্রথম মৃত্যু-ছুঁয়ে দেখে ইমন। তবু তার মনে যে-প্রশ্নটা প্রথম জাগে, সেটা বকুলগাছটা নিয়ে। বাবার থেকে জানা হল না, বকুলগাছটা কার নামে বসানো!

বাবা মারা যাওয়ার পর বকুলগাছটার যত্ন নিতে শুরু করে ইমন। কিন্তু বৃক্ষের যত্ন কিবা! যত্ন নেবার কিছুই নেই। ইমন লোক দিয়ে বকুলগাছটার গোড়ার মাটি কুপাতো। মা হাঁ হাঁ করে উঠত! কাঠের গাছের অত যত্ন নিতে হবে না!

তবু ইমন লুকিয়ে সার কিনে আনত। বোনডাস্ট। ছড়িয়ে দিত বকুলতলায়। কিন্তু বকুলের শিকড় তো অনেক গভীরে! তার জল হলেই চলবে। তবে গভীর শিকড়ে বকুলটা আস্তে আস্তে জড়িয়ে নিচ্ছিল ইমনকেও। ইমন প্রথম দিকে গাছটার প্রতি বাবার ভালোবাসার কথা ভেবে যত্ন করত। বাবার কোনও গোপন মানুষের কথা ভেবে হয়তো বসানো।

সে মাকে এ নিয়ে কিছু বলেনি। তার মা বকুলগাছটা সম্বন্ধে কিছুই জানত না। তাছাড়া মা তখন সদ্য বিধবা হয়ে সংসার চালাতেই হিমসিম। ঢেউ-এর মাথায় পানসি নৗকার মতো চলছে কোনওক্রমে তাদের সংসার। ইমনের বাবার দোকান বিক্রির টাকায় আর বাগানের ফলমূল বেচে কত আর চলে সংসার। সোনায় হাত পড়ে বছর বছর। প্রতিভার বকুল নিয়ে আদিখ্যেতা করার সময় কোথায়! ইমন হয়েছে বাবার মতো! ইমনের বাবার মোড়ের মাথায় স্টেশনারি দোকান ছিল। লাভ ছিল ভালোই। কিন্তু লাভের থেকে বাবার খরচ ছিল বেশি। তাছাড়া দোকানের টাকা জমিয়েই তো বাবা সখের এই বাড়ি বাগান করেছিল।

একটু বড়ো হতে, ক্লাস টেন ইলেভেনে উঠতে বকুলগাছটার ফুল ফোটে, ফল হয়। পাকা ফল বকুলগাছের গোড়ায় বিছিয়ে পড়ে থাকে। বিস্কুট রঙের ফল অনেকটা খেজুরের মতো। বকুলফুলের কী সুবাস। প্রাণ ভরে যায় যেন। তখন থেকে বকুলগাছটা তার কাছে অন্যরকম হয়ে যায়। বাবার প্রিয় মানুষ, কিংবা তার নিজস্ব বন্ধু। বকুলগাছটা যেন তখন থেকেই কথা বলে ইমনের সঙ্গে। ইমন তখন থেকে একটু একটু বুঝতে শেখে বকুলের ভাষা।

– এই ইমন, দিনরাত বকুলতলায় কী করিস তুই?

ছোটোবেলায় ইমন সঙ্গীর অভাবে খেলতে পেত না। কিন্তু তার খেলার সঙ্গীর অভাব হয়নি। বাগানের সবকটা গাছ ছিল তার বন্ধু। বিশেষকরে বকুলের সঙ্গে তার ভাব ছিল খুব। বকুলটাকে নিয়েই সে পুতুল খেলত। তখন খুব মোটা হয়নি। ফুট খানেক বেড় আর সবে সবে বাড়ির দোতলা ছুঁয়েছে তখন। গাছের গোড়ায় কাপড়ের বেড় দিয়ে শাড়ি পরাত। কখনও ইমন বকুলকে মেয়ে করে বিয়ে দিত বাগানের সেগুন গাছের সঙ্গে। আবার কখনও বকুলকে নিয়ে নিজেই বর-বউ খেলত। কখনও সে বউ, কখনও বকুল। তার সময় কেটে যেত কোনও বন্ধু ছাড়াই।

– আসছি মা!

আসছি বলেও ইমন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিত বকুলগাছটার সঙ্গে।

ইমনের স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছা অন্য একটা কারণেও নেই। সুমনবাবু স্কুলের নতুন ম্যাথের টিচার। মাস ছয়েক জয়েন করেছে। ইমনের থেকে টিচার হিসাবে জুনিয়র। কী নাকি বিসিএস দেবে বলে টিচারি নেয়নি। এখন বয়স হয়ে যাচ্ছে দেখে স্কুলে ঢুকে বিসিএস-এর জন্যও পড়ছে। ক’মাসেই স্কুলে খুব জনপ্রিয়। ছাত্ররা তো সুমনবাবু বলতে অজ্ঞান।

যদিও কো-এড স্কুলে ছাত্রীরা সবথেকে পছন্দ করে তাদের সুন্দরী কেমিস্ট্রি টিচার ইমনকে। কিন্তু ছাত্রীরা তো আর ছেলেদের মতো হই হই করে জানান দিতে জানে না। তারা ইমনকে ভালোবাসে গোপনে, মনে মনে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে রাখে। ছাত্ররা সেই মাথায় করে রাখা সুমনবাবুর সঙ্গে ইমনদির তুলনা করে। কে বেশি ভালো তাই নিয়ে। আর প্রতিবার নিজেরাই জিতিয়ে দেয় সুমনবাবুকে। এইসব ইমনের একদম ভালো লাগত না প্রথম প্রথম। তখন ভাবত জেনারেল ট্রান্সফার নিয়ে অন্য স্কুলে চলে যাবে! এই স্কুলে আর না।

তারপর ঘটনা বদলে গেল অন্যদিকে। ছাত্রদের প্রিয় সুমনবাবু কয়েক মাসেই ইমনদির সঙ্গে এক রিক্সায় স্টেশন থেকে স্কুলে যেতেই ইমনের স্কুলটা আবার ভালো লাগতে শুরু করে। কিন্তু ছেলেটার বড্ড তাড়া। সব যেন একদিনেই চায়। গ্রীষ্মের শুরুতে স্কুলে জয়েন করল। বর্ষা পড়তে না পড়তেই ইমনকে প্রপোজ করে বসে। আর সারাটা বর্ষা জ্বালাচ্ছে, কী হল ইমন আমাকে চুমু দেওয়ার?

আরে বাবা বললেই কি সবাই এত দ্রুত সব কিছু পারে? ইমন ছোটোবেলা থেকেই চাপা স্বভাবের। সুমনের সব কথায় চুপ থাকা মানে কি যে ইমন তার সব কথা মেনে নিয়েছে! যদিও ইমনের সুমনকে খুব ভালো লাগে। ইমনের বাবার মতোই দিলদার হাসি। দেখতেও সুন্দর। ম্যাথে মাস্টার্স করা। যে-কোনওদিন বিসিএস লাগিয়ে দেবে। পাত্র হিসাবে সত্যিই ভালো সুমন। কিন্তু ইমন যেই সুমনের কথা ভাবে, বিশেষকরে বাড়িতে থাকলে, বকুলগাছটার পাতায় পাতায় মন খারাপের পলক পড়ে। ইমন বুঝতে পারে।

ইমন এক পা বাড়ায় সুমনের দিকে আর বাড়ি ফিরেই দু’পা পিছিয়ে যায় বকুলগাছটার কথা ভেবে। সে বকুলগাছটাকে ছেড়ে কিছুতেই থাকতে পারবে না। পুরো বর্ষাটা সে ভাবছে উচ্ছল সুমনকে কী বলবে! হ্যাঁ বলাটাই স্বাভাবিক। তবু বকুলগাছটা পিছনে টানছে খুব। আজ আবার সুমনের নানান পরিকল্পনা ইমনকে নিয়ে। শিক্ষকদিবসের তাড়াতাড়ি ছুটিতে ওকে নাকি মুখ ফুটে জানাতেই হবে, ভালোবাসি।

ইমন মাকে কিছুই বলে না। প্রতিভা একটুতেই উৎকণ্ঠিত হয়। না হলে আজকের দিনে মাত্র সাতাশ বছরের মেয়ের বিয়ে নিয়ে কেউ মাথায় ভাদ্রের তালপড়া ব্যথা নিয়ে চিন্তা করে না। ইমন সুমনের কথা ভেবেই আজ স্কুলে যেতে চাইছিল না। অথচ তার কথা ভেবেই স্কুলের দিকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যায়।

স্টেশন থেকে স্কুল পর্যন্ত রিকশায় আসতে আসতেই সুমন ইমনকে জানিয়ে দিয়েছে, আজ তাকে বাড়ি নিয়ে যাবে। মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে। সেই থেকে ইমন রেগে আছে সুমনের উপর। সুমন যেন ধরেই নিয়েছে ইমন ওকে ভালোবাসে বা ভালোবাসতে বাধ্য। অবশ্য একা সুমন কেন, সারা স্কুল যেন ধরেই নিয়েছে দুই সুন্দরের মিলন শুধু সময়ের অপেক্ষা। অথচ ইমন নিজেই জানে না সে সুমনের ব্যাপারে কতটা আগ্রহী। বিশেষ করে বিয়ের ব্যাপারে।

অবশ্য আজকে এই মুহূর্তে ইমন সুমনের উপর রেগে আছে অন্য কারণে। ইমন আজ স্কুলের ধকলের কথা ভেবে পিওর সিল্ক শাড়ি পরেছে। কিন্তু তার চেহারা রোগার দিকে। আগে থেকে যদি বলত, তাহলে সে তাঁতের শাড়ি পরে আসত। তাঁতের শাড়িতে তাকে মানায় ভালো।

স্কুলের শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠান বড়ো করে কিছু হয় না। প্রার্থনার সময়েই বড়দি শিক্ষকদিবস সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতার পর জানিয়ে দিয়েছেন, উঁচু ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীরা জুনিয়রদের ক্লাস নেবে। বড়োদের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা আর ছোটোদের মধ্যে গুনগুন গুঞ্জন। টিফিনের আগেই সব স্যার ম্যাডামরা যে যে-ক্লাসের ক্লাসটিচার সেখান থেকে ছোটোখাটো উপহার পেয়েছে ছাত্রছাত্রীদের তরফ থেকে। ইমনও ক্লাস নাইন ‘বি’-এর ছেলেমেয়েদের থেকে একটা দামি পেন পেয়েছে। প্রতি বছর সে এদিন তার ক্লাসের ছেলেমেয়েদের লজেন্স দেয়। আজ সে ভুলে গেছে একদম। খুব রাগ হয় সুমনের উপর। তার ছন্দে বাঁধা জীবন, যেখানে বকুলফুলের মৃদু সুবাস নিয়ে সে বেঁচে থাকে, সেখানে সুমন তার সমস্ত আকর্ষণ দিয়ে তছনছ করে দিচ্ছে। বাবার তৈরি বাড়ি ছেড়ে সে যাওয়ার কথা ভাবেনি এখনও। বিয়ের কথা তো সুমনের নাছোড় আবেগের আগে কখনও ভাবেইনি! ইমন মনে মনে ঠিক করে, আজই সুমনকে না বলে দেবে। সুমনের মায়ের সামনেই ব্যাপারটা জানিয়ে দেবে। জানিয়ে দেবে, তার পক্ষে বকুলগাছটাকে ছেড়ে থাকা সম্ভব নয়।

ট্রেনে একটাও কথা বলেনি ইমন। সুমনের পাশে শক্ত হয়ে বসে আছে। মনে মনে শক্ত হয়ে উঠতে শরীরের কাঠ কাঠ ভাবটা খুব কাজে দেয় ইমন জানে। কিন্তু সুমন সেসব খেয়ালই করছে না। সে আগের মতোই কানের কাছে বকবক করে চলেছে আলতু ফালতু অথবা দামি সব আবেগের কথা। ইমন সেসব আবেগ নিতে পারছে না। সে হয়তো তার সব আবেগ জমা রেখে এসেছে বকুলগাছের পাতায় পাতায়।

বারুইপুর থেকে সোনারপুর হয়ে চম্পাহাটি এমন কিছু দূর না। জায়গাটা এখনও গ্রাম গ্রাম। অনেকটা তাদের বলরামপুরের মতোই। চম্পাহাটি থেকে রিকশা নিতে হয় সুমনের বাড়ি পর্যন্ত। বেশ পুরোনো পাড়া। ছাড়াছাড়া বাড়ি। সুমনদের বাড়িটা অনেকটা জায়গা নিয়ে।

ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে দুজনে একছাতার নীচেতেই সুমনের বাড়ি ঢোকে। সুমনের মা-ই দরজা খোলে। সুমনের মাকে দেখেই ইমনের মনটা ভালো হয়ে যায়। কিন্তু ইমন বুঝতে পারে, ভদ্রমহিলা ভাদ্রের বৃষ্টিভেজা বিকালে ছেলে কোনও মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ঢুকবে এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তবু আপ্যায়নে আন্তরিকতার অভাব রাখে না, সম্ভবত ছেলের সততার উপর বিশ্বাস রেখে।

– মা, এ ইমন। আমাদের স্কুলের জনপ্রিয় কেমিস্ট্রির টিচার। আমার থেকে টিচার হিসাবে সিনিয়র তবে এমনিতে জুনিয়র। ভালো গান গাইতে পারে। আবৃত্তিও শিখেছে ব্রততীর কাছে…

সুমনের মা হেসে ফেলেন। ছেলেকে ভালোই চেনেন। বলেন, তুই সব বলবি না ওকেও কিছু বলতে দিবি!

তারপর ইমনকে হাত ধরে নিয়ে যান নিজের ঘরে। ফ্যান চালিয়ে বসান বিছানায়। আর নিজে পাশের রান্না ঘরে চলে যান, জল, শরবত আনতে। সেখান থেকে কাচের গ্লাসে স্টিলের চামচ দিয়ে টুং টাং করে শরবত বানাতে বানাতে ইমনের সঙ্গে কথা চালিয়ে যান। সুমন এইসময় ছাতা মাথায় সাইকেল নিয়ে বের হয়। সম্ভবত ইমনের জন্য মিষ্টি কিনতে। ইমন ভাবে আসার সময়ই তো কিনে নিতে পারত সুমন। আচ্ছা বোকা সুমনটা। বকবক করা ছাড়া কিচ্ছু জানে না।

– কী নাম মা তোমার? পাগলটা হুড়মুড় করে কী বলল বুঝতে পারিনি। খুব জ্বালায় না, তোমায়!

– আমি ইমন বিশ্বাস।

– কোথায় বাড়ি তোমার? বাড়িতে কে কে আছে?

– জয়নগর লাইনের বলরামপুরে বাড়ি আমার। বাবা নেই। মা আর আমি থাকি। শরবত করা বন্ধ রেখে সুমনের মা ঘরে ঢুকে আসে। ইমনের খুব কাছে এসে বলেন, কোথায় বাড়ি বললে?

– বলরামপুর।

– তোমার বাবার নাম কী?

ইমন তার বাবার নাম বলে।

সুমনের মা এবার খাটে বসা ইমনের মুখটা তুলে ধরে বলেন, তোমাদের বাড়িতে একটা বকুলগাছ আছে না? বাড়ির পশ্চিমদিকে?

কথাটা শেষ করতে করতে সুমনের মা জানলার কাছে চলে যান। ইমন হঠাৎ যেন কোনও পরিচিতকে দেখতে পেয়েছে পূর্বজন্ম থেকে, জানলার কাছে গিয়ে সুমনের মায়ের কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বলে, আপনি কী করে জানলেন? আমাদের বাড়ির পশ্চিমদিকে বকুলগাছ আছে!

সুমনের মা জানলা দিয়ে যেন বহুদূরে তাকিয়ে। দিগন্ত থেকে বলে, আমার বাপের বাড়িও তো বলরামপুরের পাশের গ্রাম সুজনপুর।

তারপর ইমনকে জানলার কাছে টেনে যুবতির উচ্ছ্বাসে প্রৌঢ়া  বলেন, দেখো দেখো ইমন, আমাদের পশ্চিমেও একটা বকুলগাছ। বলরামপুরের বকুলগাছটার সমবয়সিই হবে জানো!

উপলব্ধি

মঞ্জরির আজকাল কিছুতেই বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না, অথচ আগে ও বাড়ি ফেরার জন্য ছটফট করত। সেই কবে মাত্র ঊনিশ বছর বয়সে শিশিরের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছে সেই থেকে সংসারটা যেন ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। সংসার ছাড়া অন্য কিছুতে মন দেওয়ার কোনও আগ্রহই বোধ করেনি কোনওদিন।

ছেলে-মেয়ে এখন বড়ো হয়েছে। শিশিরও ব্যাবসার কাজে বেশিরভাগ সময়ই শহরের বাইরে থাকে। ছেলে অতনু এমএস করতে আমেরিকা গিয়েছিল এখন ওখানেই ও ওয়েল সেটেলড। মঞ্জরি ভালো মতোই জানে ও কোনওদিন দেশে ফিরবে না। এষা আর মঞ্জরির সম্পর্কটা ঠিক মা-মেয়ের মতো নয়। দুটিকে দেখে মনে হয় অসমবয়সি বান্ধবী। সর্বদা একসঙ্গে, দেখে মনে হয় না ওদের জীবনে অন্য কারও প্রয়োজন আছে।

অথচ এই বন্ধুত্বের মায়াও মঞ্জরিকে ত্যাগ করতে হল। আগের সপ্তাহেই এষাকে এয়ারপোর্টে তুলে দিতে এসে মঞ্জরি চোখের জল কিছুতেই আটকাতে পারল না। মনে হচ্ছিল শরীরের একটা অংশ যেন কেটে নেওয়া হচ্ছে। অথচ মিলানে ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য স্কলারশিপ পাওয়ার কথাটা যখন এষা জানিয়েছিল তখন সবথেকে বেশি খুশি বোধহয় মঞ্জরি-ই হয়েছিল।

শিশির অবশ্য ওকে বলেছিল মহিলাদের কোনও সংস্থার হয়ে সোশ্যাল ওয়ার্ক করার জন্য কিন্তু মঞ্জরি রাজি হয়নি। ওর মনে হয় সোশ্যাল ওয়ার্কের নামে সমাজসেবা করাটা সংস্থার উদ্দেশ্য নয় বরং অর্থবান স্বামীদের অর্ধাঙ্গিনিরা নিজেদের টাইম পাস করার জন্য এই সব সংস্থায় জয়েন করে। অন্যদের মতো কার চারিত্রিক দুর্বলতা কোনটা, কে কোন গয়না কিনল বা কত টাকা গয়না কিনতে খরচ করল অথবা বাড়ি ডেকে নিয়ে গিয়ে দামি আসবাবপত্র বা নতুন ক্রকারি দেখাবার মতো মানসিকতা মঞ্জরির ছিল না। আগেও ও দুবার সংস্থার হয়ে কাজ করেছে কিন্তু পুরোটাই ছিল দুঃস্থ পরিবারের বাচ্চাদের নিয়ে কাজ। বাচ্চাদের নিয়ে সারাদিন কাটাতে ওর খুব ভালো লাগত। ও যেন নিজের শৈশবে ফিরে যেতে পারত, ভুলে যেত পঞ্চাশের কোঠা ও পার করে ফেলেছে। কিন্তু সংসারের প্রয়োজনে সংস্থা যখন ওকে ছাড়তে হয়েছিল তখনকার স্মৃতি ওর কাছে মোটেই মধুর ছিল না। সংস্থার অন্যান্য সদস্যরা ওর এই হঠাৎ ছেড়ে দেওয়াটা ভালো চোখে দেখেননি এবং এই বিষয়ে কিছু কটূক্তি শুনতেও মঞ্জরি বাধ্য হয়েছিল।

এষা চলে যাওয়ার পর সময় কাটাতে মঞ্জরি প্রায়শই বাড়ির কাছের পার্ক-টায় গিয়ে বিকেলে বসত। বাচ্চাদের খেলাধূলো দেখতে দেখতে বেশ সময়টা কেটে যেত। একদিন পার্কে বসে মোবাইলে এষার পাঠানো ছবিগুলোতে তন্ময় হয়ে পড়েছিল মঞ্জরি, হঠাৎই ধ্যানভঙ্গ হল একটি কণ্ঠস্বরে, ‘এক্সকিউজ মি’।

চমকে তাকাতেই দেখল সামনে ২৯ বছর বয়সি একজন যুবক দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছেলেটি বেশ লম্বা এবং হ্যান্ডসাম। বেঞ্চে পাশে রাখা মঞ্জরির পার্স-টা সরাতে অনুরোধ করছে। পার্সটা সরাতেই যুবকটি মঞ্জরির পাশে এসে বসল।

মিনিট পাঁচেক এইভাবেই কাটল দু’জনের। কেউ কাউকে চেনে না। যুবকটি মাঝেমধ্যেই অধীর আগ্রহ নিয়ে গেটের দিকে তাকিয়ে কারও যেন অপেক্ষা করছে। মঞ্জরি কোতূহল দমন করতে পারল না, জিজ্ঞেস করল, ‘কারও অপেক্ষা করছেন?’

মঞ্জরি প্রশ্নটা করেই বুঝতে পারল একটা বড়ো ভুল করে ফেলেছে। সম্পূর্ণ অপরিচিত এক যুবক সুতরাং তাকে প্রশ্ন করার অধিকার ওর নেই। নিশ্চই যুবকটি বিরক্ত হয়েছে ওর আচরণে। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার, যুবকটি বিন্দুমাত্র বিরক্ত না হয়ে মঞ্জরি-কে বলল, ‘হ্যাঁ… হ্যাঁ… আমি একজনের আসার অপেক্ষা করছি… কিন্তু আপনি একলা নাকি?’

‘হ্যাঁ… বাড়িতে ভালো না লাগলে এখানে এসে একটু বসি। আমার বাড়িতে সকলেই ব্যস্ত মানুষ শুধু আমি ছাড়া। হয়তো আপনজনের সঙ্গ পাওয়ার আশায় এখানে এসে বসে থাকি’, মঞ্জরির কথায় হতাশা ফুটে উঠলেও একটু মজার ভঙ্গিতেই কথাগুলো বলল।

‘হয়তো… হয়তো এটাই ঠিক। আমিও আমার গার্লফ্রেন্ডের অপেক্ষা করছি। অবশ্য গার্লফ্রেন্ড না বলে হাফ গার্লফ্রেন্ড বলাটাই ভালো। ও বাচ্চাদের হোস্টেলে অফিসার ইনচার্জ। ওর প্রচুর কাজ থাকে সুতরাং টাইমে কোনও দিনই আসতে পারে না’, পাশে বসা মঞ্জরিকে মনের কথা খুলে বলে যুবকটি। মঞ্জরির ব্যবহারে এমন একটা আন্তরিকতা অনুভব করে ও যে, নিজের কথা বলতে দ্বিধা করে না। নিজের পরিচয় দিয়ে নামটা বলে মঞ্জরিকে, ‘আমার নাম সম্রাট, আর আপনার?’

‘মঞ্জরি’, একটু ইতস্তত করে মঞ্জরি নিজের পরিচয় দেয়।

‘আপনার গার্লফ্রেন্ডের নামটা কি আর কেনোই বা ও এখনও আপনার হাফ গার্লফ্রেন্ড?’

‘ওর নাম রিয়া… মুম্বইতে আমরা ক্লাস সেভেন অবধি একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি। তারপর ওর বাবার ট্রান্সফার হয়ে যায় কলকাতায়। হঠাৎ-ই তিনমাস আগে ওর সঙ্গে আবার দেখা হয়। প্রথমটায় বুঝতে না পারলেও একে অপরের পরিচয় দিতেই বুঝতে পারি যে ও আমার পুরোনো পরিচিত। ব্যস, তারপর থেকেই মেলামেশা শুরু হয়। আমরা দুজনেই একে অপরকে পছন্দ করি কিন্তু এখনও কেউ কাউকে ওই তিনটে ম্যাজিক শব্দ বলে উঠতে পারিনি।’ মঞ্জরিকে এত কথা বলতে গিয়ে সম্রাট কিছুটা লজ্জা বোধ করে।

‘তাহলে তো তুমিও রিয়ার হাফ বয়ফ্রেন্ড, তাই না?’ মঞ্জরি বুঝতে পারে ছেলেটির সঙ্গে গল্প করতে ওর বেশ ভালো লাগছে।

‘না… না একদমই না কারণ রিয়া আমার মনের কথা খুব ভালো করেই জানে। আমি অত রেখে ঢেকে কথা বলতে পারি না কিন্তু ম্যাডাম… বাপরে, পুরোনো দিনের সাইলেন্ট মুভির হিরোইন। আগেও যেমনি নায়িকারা নায়কদের নিজেদের পিছনে ছুটিয়ে মারত এখনকার মেয়েরাও ছেলেগুলোকে বাধ্য করে পিছনে পিছনে দৌড়োবার জন্য।’ সম্রাটের এই শিশুর মতো স্বীকারোক্তি মঞ্জরির হৃদয়ে স্নেহের  উদ্রেক করে। ওর প্রতি কেমন যেন একটা মায়া অনুভব করে মঞ্জরি।

‘সম্রাট, তুমি যা বললে সেটা পুরোটাই নির্ভর করে ব্যক্তিবিশেষের উপর। আমি কোনওদিন কাউকে আমার পিছনে দৗড় করাইনি। যেদিনই বুঝেছিলাম শিশিরকে ভালোবাসি, সেদিনই সময় নষ্ট না করে ওর কাছে স্বীকার করে নিয়েছিলাম। শিশির কেন, আমি কারও কাছেই মনের কথা চেপে রাখতে পারি না। আমার সন্তানই হোক বা বন্ধু, সকলের কাছেই আমার ফিলিংস পরিষ্কার হয়ে যায়।’ মঞ্জরি কথা বলতে বলতে উদাস হয়ে পড়ে।

‘ঠিকই বলেছেন, আমিও চুপ থাকতে পারিনি। রিয়াকে পরিষ্কারই নিজের মনের কথা বলে দিয়েছি। এখন ওর মুখ থেকে শুনতে চাই আমার প্রতি ওর কী ফিলিংস’, উত্তেজিত হয়ে পড়ে সম্রাট।

‘সম্রাট, আমি সহজে সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারি। কিছু ক্ষেত্রে হয়তো এটার জন্য লোকে আমার চরিত্র নিয়ে আঙুল তুলবে। কিন্তু এটার জন্য জীবনে অনেক কিছু শিখেওছি। রিয়ার মনের কথা কীভাবে বার করবে আমি তোমাকে বলে দেব… ঠিক আছে?’

‘ডিল?’

‘ডিল!’

দুজনেই একসঙ্গে হেসে ওঠে। একে অপরের ফোন নম্বর নিয়ে মঞ্জরি বেরিয়ে আসে পার্ক থেকে।

সেক্টর ফাইভে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে সম্রাট ভালো পদে কাজ করে। ও একাই কোম্পানির ফ্ল্যাটে থাকে। মা-বাবা দুজনেই মুম্বই থাকেন। সম্রাটের স্বভাব মিশুকে হলেও খুব কমজনই ওর হূদয় অবধি পৌঁছোতে পারত। বন্ধু বাছার ব্যাপারে ও খুব চুজি ছিল। মঞ্জরির স্নেহশীল ব্যবহারে সম্রাট ওর প্রতি আকৃষ্ট হয়। দুজনের মধ্যে প্রায়শই দেখা-সাক্ষাৎ হতে থাকে, ফোনেও দুজনের কথাবার্তা চলতে থাকে।

মঞ্জরির সঙ্গে দেখা হলেই, সম্রাট হাজারো মনের মধ্যে জমে থাকা সমস্যা মঞ্জরির সামনে উজাড় করে দিত সমাধান পাওয়ার আশায়। মঞ্জরিও ধীর ভাবে সম্রাটের প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করত। রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন যখনই সম্রাটের কথায় স্পষ্ট হয়ে উঠত, মঞ্জরি তৎক্ষণাৎ গভীর ব্যাখ্যার মাধ্যমে রিয়া সম্পর্কে সম্রাটের মন থেকে সমস্ত সংশয় দূর করে দিত।

সম্রাট বুঝে গিয়েছিল পঞ্চাশোর্ধ মঞ্জরির কাছে আজও প্রেম শব্দটার একটা গুরুত্ব এবং গাম্ভীর্য রয়েছে। বয়সের সাথে সাথে মঞ্জরির জীবন থেকে প্রেম দূরে সরে যেতে পারেনি। তাই সম্পর্কের মাধুর্য আজও মঞ্জরিকে নাড়া দিয়ে যায়। প্রেমকে অবহেলা করলে মঞ্জরি সেটা সহ্য করতে পারে না। তবে মঞ্জরির মূল্যবোধগুলো জীবনের প্রান্তে এসে অনেক বেশি পরিপক্ব যার প্রশংসা সম্রাটকে মনে মনে করতেই হয়। মঞ্জরির স্নেহধন্য হয়ে সম্রাট মনের মধ্যে এক গভীর প্রশান্তি লাভ করে। মঞ্জরিও সম্রাটের উৎসাহে প্রভাবিত হয়ে মনের মধ্যে এক উদ্দাম শক্তির প্রকাশকে অনুভব করতে শুরু করল। ধীরে ধীরে দুজনে এক অজানা সম্পর্কের বাঁধনে জড়িয়ে পড়তে লাগল।

প্রায় একমাস বাইরে বাইরে থাকার পর শিশির বাড়ি ফিরে নতুন এক মঞ্জরিকে আবিষ্কার করল। এই মঞ্জরি অনেক বেশি হাসিখুশি। লাল কেপ্রির উপর লম্বা ক্রিম কালারের কুর্তা পরে, পছন্দের পারফিউম লাগিয়ে যে মেয়েটি শিশিরকে স্বাগত জানাল সে যেন তিরিশ বছর আগের ফেলে আসা মঞ্জরি।

সুটকেশ হাতে করে নিজের ঘরে ঢুকতেই শিশির দেখল খাটের পাশে রাখা সোফাটায় ল্যাপটপ কোলে নিয়ে একজন অচেনা যুবক। শিশির কিছু বলার আগেই মঞ্জরি কফির ট্রে সাজিয়ে ঘরে ঢুকল। শিশিরের সঙ্গে সম্রাটের পরিচয় করিয়ে দিল, ‘আমার বন্ধু সম্রাট।’

শিশিরকে অবাক হতে দেখে এবার সম্রাটই কথা বলল, ‘জানি আপনি আশ্চর্য হচ্ছেন কারণ আমাদের বয়সের অনেকটা তফাত। তবু আমিও এই সম্পর্কটাকে বন্ধুত্বই বলব। আপনার কোনও আপত্তি নেই তো? আমি ওনাকে আমার বন্ধু বলতে পারি?’ সম্রাটের সরলতা মুহূর্তে শিশিরের মন জয় করে নিল।

‘শুধু বন্ধু বললেই হবে, মন থেকেও তো ওকে বন্ধু বলে মেনেও নিতে হবে। মনে হচ্ছে তোমার মধ্যে ও এমন একজন বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছে যাতে আমাদের ম্যাডাম দুনিয়াদারি সব ভুলে গিয়েছে। যাক একটা ভালো হয়েছে, এবার থেকে কলকাতার বাইরে গেলে মঞ্জরিকে নিয়ে আমার কোনও দুশ্চিন্তা থাকবে না।’ শিশির সম্রাটের পিঠ চাপড়ায়। কফি খেতে খেতে তিনজন গল্পে বুঁদ হয়ে যায়। সময়ের খেয়াল থাকে না কারওরই।

রিয়াকে নিয়ে সম্রাটের চিন্তা দেখে মঞ্জরি মাঝে মাঝে না হেসে পারত না। রিয়ার মনের কথা জানার জন্য সম্রাট ব্যস্ত হয়ে পড়ত। নিজেদের সম্পর্কটাকে একটা নাম দেওয়ার অধীর অপেক্ষায় থাকত। মঞ্জরি সম্রাট-কে রিয়ার সামনে একটু রিজার্ভ থাকার পরামর্শ দিল যাতে রিয়া নিজে থেকে সম্রাটের প্রতি ইন্টারেস্ট নেয়। মঞ্জরির কথা মেনে সম্রাট রিয়াকে বারবার ফোন আর মেসেজ করা বন্ধ করে দিল। কাজের প্রেশারের দোহাই দিয়ে হোয়াট্‌সঅ্যাপ থেকেও নিজের নাম তুলে নিল। এতে ভিতরে ভিতরে সম্রাট কিছুটা আন-ইজি ফিল করলেও শেষমেশ ও যা চাইছিল তাই হল।

কফি শপে মুখোমুখি বসে দুজন। সম্রাট চাইছিল রিয়ার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিতে। মঞ্জরির কথা মনে পড়ল। নিজেকে রিয়ার চোখে কাচের মতো পরিষ্কার করে তুলে ধরার দিন শেষ। নিজের আঙুলগুলো নিয়েই খেলা করতে লাগল সম্রাট। রিয়া একটু অবাকই হল। ওর সামনে সম্রাটকে এতটা চুপচাপ হয়ে থাকতে কোনওদিন দেখেনি। ওর অনর্গল কথার স্রোতের মাঝে লাগাম লাগাবার কাজটা রিয়াকেই করতে হতো। সম্রাটই মুখ খুলল তবে নিজের কথা দিয়ে নয়। অফিসের নানা সমস্যা, তাই নিয়ে কথা। চুপচাপ খানিক্ষণ শোনার পর রিয়া বোর হতে শুরু করল, ‘প্লিজ সম্রাট… অফিসের কথা ছাড়ো না। বরং তোমার ছোটোবেলা, কলেজের কথা বলো। স্কুলে তোমাকে দেখেছি, তখন তুমি খুব চুপচাপ থাকতে।’

‘উফ! আবার আমার লাইফের বোরিং অধ্যায়গুলো’, কপট বিরক্তি প্রকাশ করল সম্রাট।

‘আমার তো খুব ভালো লাগে তোমার সম্পর্কে জানতে।’

‘রিয়েলি… কিন্তু আমার কথা ভালো লাগার নিশ্চয়ই একটা কারণ তো হবে?’ আশা জাগে সম্রাটের মনে।

‘সব কিছুর কি কারণ থাকতেই হবে… তোমার চিন্তাধারাই অন্যরকম।’

‘আমার উপর রাগ করে কি লাভ? আমাকে তুমি ভালোবাসো, এই কথাটা তুমিই বলতে পারছ না উলটে আমার উপর রাগ দেখাচ্ছ।’

‘সব কথা মুখে বলার দরকার পড়ে না। আমি কি কখনও তোমাকে ভালোবাসার স্বীকৃতি দিতে চাপ সৃষ্টি করেছি? তোমার কথায়, মেসেজে সব পরিষ্কার এমনিতেই হয়ে গেছে’, রিয়া হাসি চাপতে পারে না।

সম্রাট এবার সত্যি রেগে যায়, ‘হ্যাঁ, আমি মানুষটাই এরকম। মনের কথা চেপে রাখতে পারি না। অথচ এতদিন হয়ে গেল তুমি সেই

মা-বাবার লক্ষ্মী মেয়ে হয়েই রয়ে গেলে।’

‘আরে বাবা… এত রাগ। ঠিক আছে, আজ থেকে আমি তোমার ছায়ায় আশ্রয় নিলাম। কি… আশ্রয় দেবে তো?’

আনন্দে সম্রাট রিয়ার হাত নিজের হাতে তুলে নেয়। মনে মনে মঞ্জরিকে ধন্যবাদ জানায়। সাফল্যের এই রাস্তা তো ওই সম্রাটকে চিনিয়ে দিয়েছে।

বাড়ি পৌঁছেই সম্রাট মঞ্জরিকে ফোন করল। কিন্তু ফোনে মঞ্জরিকে না পেয়ে ছোট্ট একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিয়ে ও শুয়ে পড়ল। সকালেও কোনও উত্তর না দেখে আবার ফোন করতে লাগল কিন্তু কোনও সাড়া নেই। এবার চিন্তা হতে শুরু করল সম্রাটের। শিশির শহরের বাইরে সুতরাং দূরে কোথাও যাবে না মঞ্জরি। তাহলে ফোন ধরছে না কেন? ঠিক করল অফিস যাওয়ার আগে একবার মঞ্জরির বাড়ি হয়ে যাবে। গাড়ি বার করতে যাবে এমন সময় মঞ্জরির ফোন এল। মঞ্জরি জানাল গতকাল থেকে ওর প্রচণ্ড জ্বর। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না।

‘আমি এক্ষুনি আসছি’, বলে সম্রাট গাড়ি বার করল। রিয়াকে ফোন করে জানাল যে, একজন বন্ধু অসুস্থ হওয়াতে ও তার বাড়ি যাচ্ছে। ওখান থেকেই অফিস চলে যাবে আর বিকেলে রিয়ার সঙ্গে দেখা করতে না পারলে ও যেন রাগ বা চিন্তা না করে।

মঞ্জরির বাড়ি গিয়েই প্রথমে ওর কাছ থেকে ডাক্তারের ফোন নম্বর নিয়ে ডাক্তারকে কল করল। মঞ্জরিকে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধের ব্যবস্থা করে সম্রাট অফিস গেল। বিকেলে রিয়ার সঙ্গে দেখা করল। সম্রাটের সঙ্গে দেখা হতেই রিয়া জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার বন্ধু কেমন আছে?’

‘মঞ্জরিকে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ দিয়ে এসেছিলাম। এবেলা অনেকটা ভালো।’

‘তুমি তো বলেছিলে তোমার বন্ধুর শরীর খারাপ।’

‘হ্যাঁ, মঞ্জরি তো আমার বন্ধু।’

‘মানে?’ রিয়ার গলায় অবিশ্বাস ঝরে পড়ে।

‘মানে, তোমারও কি মনে হয় যে একজন পুরুষ কখনও কোনও মেয়ের বন্ধু হতে পারে না?’ খুব সিরিয়াস শোনায় সম্রাটের কণ্ঠস্বর।

‘সম্রাট, তুমি ভুলে যাচ্ছ আমি একজন আধুনিকা। নিশ্চই বন্ধুত্ব হতে পারে। কিন্তু ৫০ বছর বয়সি কাকিমার সঙ্গে বন্ধুত্ব? এটা একটু বাড়াবাড়ি হল না… আই কান্ট বিলিভ ইট…’ বলে রিয়া উঠে দাঁড়াল।

মঞ্জরির বাড়ি হয়ে সম্রাট তাড়াতাড়িই নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ল। খুব ক্লান্ত বোধ করছিল সম্রাট। সারাদিনের ছোটাছুটি, স্ট্রেস তার উপর রিয়ার অবুঝের মতো ব্যবহার। রাগে সম্রাটের মাথাটা দপদপ করছিল। ও একটা ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ল।

পরদিন সকাল সকাল মঞ্জরি ফোন করল ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য। অনেক সুস্থ শোনাচ্ছিল ওর গলা। কিন্তু সম্রাটের গলা শুনে ভালো লাগল না মঞ্জরির, ‘কী হল সম্রাট? মন ভালো নেই নাকি? রিয়া ভালো আছে?’ মঞ্জরির গলা চিন্তিত শোনাল।

‘মঞ্জরি, রিয়া বড্ড ছেলেমানুষ। ও কি সত্যিই কোনওদিন অ্যাডজাস্ট করতে পারবে আমার সঙ্গে?’

‘কেন নতুন করে কী হল আবার?’ মঞ্জরি এটা জিজ্ঞেস করতেই সম্রাট গতকালের পুরো ঘটনা খুলে বলল ওকে।

‘সম্রাট এতে রিয়ার কি দোষ? আমরা এমন সংস্কার নিয়ে বড়ো হই যে নিজেদের স্বাধীন ভাবে জীবন কাটানোর কথা ভাবতেই পারি না। সমাজের সংকীর্ণ মানসিকতার কিছু লোক এমন কিছু নিয়ম শৃঙ্খলে আমাদের মনটাকে বেঁধে রেখেছে যে, আমরা সেটা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে ভয় পাই। সারা জীবনই সেটা অাঁকড়ে বেঁচে থাকতেই ভালোবাসি। রিয়াকেও একটু শুধু বোঝাতে হবে। তুমি চিন্তা কোরো না প্লিজ… দেখছি এখন কী করা যায়’, মঞ্জরির কথায় সম্রাট আশ্বস্ত হয়। ফোন রেখে দেয় মঞ্জরি।

দুদিনে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে মঞ্জরি। সুস্থ হতেই দোকানে গিয়ে প্রচুর চকোলেট কিনে সম্রাটের থেকে ঠিকানা জোগাড় করে, রিয়া

যে-বাচ্চাদের হোস্টেলের ইনচার্জ, সেখানে গিয়ে পৌঁছোয়। ওখানে গিয়ে বাচ্চাদের মধ্যে চকোলেট বণ্টনের ইচ্ছা প্রকাশ করতেই ওর আশা মতো ওকে হোস্টেলের ইনচার্জ রিয়ার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।

ফরসা, তন্বী চেহারার যে-মেয়েটির কাছে মঞ্জরিকে নিয়ে যাওয়া হল সেই মেয়েটি যথেষ্ট সুন্দরী। সম্রাটের কাছে কোনওদিন ছবিও দেখেনি মেয়েটির কারণ সম্রাটের ইচ্ছা ছিল রিয়ার সঙ্গে ওকে মুখোমুখি আলাপ করিয়ে দেবে। মনে মনে রিয়ার সৗন্দর্যের প্রশংসা করল মঞ্জরি। মঞ্জরি নিজের নাম বলল না। ও জানত রিয়া ওকে সামনাসামনি কখনও দেখেনি। সুতরাং ওকে দেখেও রিয়া কিছুতেই চিনতে পারবে না।

রিয়া মঞ্জরিকে হোস্টেলের খেলার মাঠটায় নিয়ে গেল। ওখানেই হোস্টেলের সব বাচ্চদের একত্রিত করা হল। বেশিরভাগই পাঁচ থেকে দশ বছর বয়স। ওখানে যেসব বাচ্চারা থাকে তাদের

থাকা-খাওয়া-জামাকপড় আর পড়াশোনা করাবার সুব্যবস্থা একটি এনজিওর উপর। রিয়া মঞ্জরিকে বলল, ‘জানেন ম্যাডাম, এদের সঙ্গে আমার সময় খুব ভালো কাটে। ওদের থেকেই আমি শক্তি ও সাহস পাই। জীবনের একটা নতুন দিশার সন্ধান ওদের মাধ্যমেই আমি খুঁজে পেয়েছি।’

বাচ্চাদের প্রতি রিয়ার ভালোবাসা মঞ্জরিকে মুগ্ধ করল। রিয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই একটি বাচ্চা এগিয়ে এসে রিয়ার দিকে একটি চকোলেট বাড়িয়ে দিল, ‘ম্যাম এটা আপনি খান।’ রিয়া সামান্য একটু ভেঙে নিয়ে বাকিটা ওর হাতে ধরিয়ে বাচ্চাটিকে আদর করল আর ওকে খেলতে পাঠিয়ে দিল।

‘ওর নাম শ্রেষ্ঠ। একটা অ্যাক্সিডেন্টে ওর মা-বাবা মারা যায় আর ওর চোখও নষ্ট হয়ে যায়। কেন জানি না, ও আমাকে খুব ভালোবাসে। আমিও ওর দুঃখ দেখতে পারি না, বাচ্চাটার প্রতি অসম্ভব একটা টান অনুভব করি। আমারও কোনও কষ্ট হলে আমাকে ছুঁয়ে ও বলে দেয় যে আমার মন খারাপ। আমাকে খুশি করার সবরকম চেষ্টা করতে থাকে।’

‘সত্যিই… খুব দুঃখের। তবে একটাই ভালো হয়েছে সে তোমার মতো একজন বন্ধু পেয়েছে।’

‘আমি জানি না ম্যাডাম এটা আপনি কতটা বুঝবেন… শ্রেষ্ঠ আর আমি একে অপরকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। এত ভালো বন্ধু আমার আর নেই’, মঞ্জরির কাছে রিয়ার নিজেকে তুলে ধরতে কোনও অসুবিধা হল না। মঞ্জরির মিষ্টি, বন্ধুত্বপূর্ণ স্বভাবের জন্য।

‘তাহলে আজ থেকে ২০-২৫ বছর পরেও তুমি কি চাইবে না যে, তোমাদের বন্ধুত্বটা এরকমই অটুট থাকুক? পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেলেই কি তোমার জীবন থেকে বন্ধুর প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে? একটা বয়সের পর মনের চাহিদা কি সত্যিই দাবিয়ে রাখার প্রয়োজন হয়? ভবিষ্যতে শ্রেষ্ঠ যদি আজকের মতোই তোমাকে ভালোবাসে, একাত্মতা অনুভব করে, তাহলেও কি বয়সের এতটা তফাতের কথা মনে রেখে তোমার প্রতি ওর ভালোবাসাটা কমিয়ে ফেলতে হবে? সম্পর্কটা তখন বদলে বন্ধুত্ব থেকে অন্য কিছু হয়ে যাবে? কী নাম দেবে সেই সম্পর্কটার? হয়তো কোনও-ই নাম নেই সম্পর্কটার, সেই ক্ষেত্রে তুমি কী করবে রিয়া?’ রিয়ার দিকে তাকিয়ে মঞ্জরি মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে।

‘ভালোবাসাটা তো একইরকম থাকবে, আমার দিক থেকেও আবার শ্রেষ্ঠর দিক থেকেও। আর নাম… সম্পর্কটার নাম তো বন্ধুত্বই থাকবে। এখনও তাই। পরেও ব্যাপারটা একই…’, রিয়াকে চিন্তিত লাগে।

‘যদি শ্রেষ্ঠ আর তোমার সম্পর্কটাকে বন্ধুত্ব বলা যায় তাহলে সম্রাট আর মঞ্জরির সম্পর্কটাকে নয় কেন…?’ বলতে বলতে মঞ্জরির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়, চেপে রাখা অভিমান অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে ওর দু’চোখ বেয়ে।

সময় গড়িয়ে চলে। দু’জনেই বসে থাকে চুপচাপ। মঞ্জরি-ই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে, ‘আমি আজ উঠি রিয়া। কাল আমার বাড়িতে এসো। সম্রাটকে ওখানেই ডেকে নেব। প্রচুর গল্প করার আছে তোমাদের সঙ্গে।’ রিয়া সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে মঞ্জরিকে বিদায় জানায়।

রিয়ার মনে হল আজ ওর সামনে সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায় উন্মোচিত হল। অপরকে ভালোবাসা, তার জন্য চিন্তা করা, ত্যাগ, আকর্ষণ ইত্যাদি মানুষের সুকোমল বৃত্তিগুলিরই অন্য নাম। এগুলির একত্রে সমাবেশই গড়ে তোলে বন্ধুত্ব সুতরাং এটা সম্পূর্ণই মনের সম্পদ। একজন মানুষের মন একটাই হয়… বন্ধুত্ব কেন তাহলে মনের না হয়ে বয়সের উপর নির্ভর করবে?

সঙ্গে সঙ্গে রিয়া সম্রাটকে মেসেজ করল, সম্রাট…

সম্পর্কের গভীরত্ব এতদিন আমি ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারিনি। কোনও সম্পর্কই ফুরিয়ে যাওয়া উচিত নয় জীবনের শেষ দিনটা পর্যন্ত। আমার ইচ্ছে তোমার এবং মঞ্জরির বন্ধুত্ব সারাজীবন সুরভিত হয়ে থাকুক। আজ বুঝতে পেরেছি পৃথিবীর সেরা উপরহাটা হল ‘বন্ধুত্ব’।

ইতি তোমার রিয়া।

অবস্থান

দরজাটা বন্ধ করে দাও রাজু…। অঙ্কিতা অফিস বেরোল। সিল্কির সঙ্গে পাজল গেম খেলছিল রাজু বারান্দায় বসে। শুনল কি শুনল না, রাতে রান্না বসাতে গিয়ে চোখ কপালে উঠল অনুর––কুকারটা গেল কোথায়! দরজার পাশে এঁটো বাসনের সঙ্গে ছিল যে!

টুলুর মেজে ধুয়ে রেখে যাওয়া বাসনের বাস্কেট, আরও যথা যথাস্থানে হাতড়ে না পেয়ে হতাশ অনু রাজুর সামনে চড়াও হল, দরজাটা তখন বন্ধ করেছিলে রাজু?

দিনভর বন্দিদশা কাটিয়ে গায়ে শার্ট চড়াচ্ছে রাজু। বেরোবে। কুকারের কথায় ভ্রূ কুঁচকে তাকাল,

–মানে… তখন সিল্কি এমন…।

– বাহ্। অনু স্পষ্টত বিরক্ত।

– তাই বলে দরজা বন্ধ হবে না! নতুন জায়গা অচেনা পাড়া, পাশের ফাঁকা মাঠ দিয়ে ময়লা কুড়োতে এসে উঁকিঝুঁকি মারে। একদিন তো ঢুকেই পড়েছিল, এসব তো জানোই…।

রাজু একটু ইতস্তত করে বলল,

– কিন্তু চোর কি শুধু কুকারটাই নেবে! খুঁজলে সব?

অনুর মুখ গনগনে। মিল্কি তার মা আসামাত্র গা লেপ্টেছে। রাজু নিজেও খুঁজতে শুরু করে। বিরক্ত অনু থামা দেয়-– হয়েছে। আর খুঁজে কী হবে! দরজার পাশেই ছিল, খোলা পেয়ে সহজেই নিয়ে সটকান মেরেছে।

ফলত এক অপরাধবোধ এখন। মোড়ের গুমটি থেকে সিগারেট কিনে খাওয়া, কি পাড়ার ছোট্ট ক্লাবঘরে এক চক্বর দিয়ে আসবে, সেই ফুরসতও তার নিজস্ব নয়। কখন কোন দিক থেকে হুকুম আসবে। কোনটা জরুরি হয়ে উঠবে তার ঠিক নেই। আপাতত মশার ধূপ জ্বেলে দিল রাজু। ঘরে পাখা চলছিল। অফ করল। সামান্য একটু অপেক্ষা করল কোনও ফরমায়েশের। পরে বাজারের থলিটা টেনে নিয়ে হাতে মুড়ল। চাল কেনার বাকি টাকাটা সকালে ফেরত

– যায় নি, যাহোক বাজার আনবে ওই থেকে।

নজর করে অনু বলল, ড্যাডিকে চা খেয়ে যেতে বলো মিল্কি।

চটি পরা স্থগিত থাকল। এমনটাই যেন চাইছিল রাজু। এইভাবে ডেকে  চা বা আড়াইশো গ্রাম পেঁয়াজ এনো, বলার ভেতর দিয়ে অনুরও যেন কোথাও খানিক মেরামতির ছুতো থেকে যায়।

কাপ হাতে চেয়ারে বসেছে রাজু। সামান্য তফাতে অন্যমনস্ক অনু। অফিস ফেরত শাড়ি পালটে নাইটি পরেছে। কিন্তু চুলে চিরুনি পড়েনি। ঝুরো ক’গাছি চুল লেপটে আছে বাঁ-গালে। চিবুকের ডৗলটুকু বেশ আধখানা ডাঁসা পেয়ারার মতো। প্লাক্ড ভ্রূর নীচে টানা টানা চোখ দু’টো যেন গাত্রবর্ণকে অনেকটাই ছাড় দিতে পেরেছে। চেহারা কিছুটা ভারীর দিকে হলেও টান টান শাড়ির প্যাঁচে তন্বির চেষ্টা আছে। তবু নজর করলে ফরসা ঢ্যাঙ্গা রাজু ওর ছোটো না বড়ো ভাবতে হবে…।

কাপ নামিয়ে গলা ঝাড়ল রাজু

– অনু, দরজাটা বন্ধ করে দাও…।

সাড়ে ছ’শো স্কোয়ার ফিটের ছোট্ট বাড়িটা শান্তনু শুরু করলেও শেষ করে যেতে পারেনি। বাকি যা ছিল, শোক সন্তাপ কাটিয়ে অঞ্চিতা তাতে হাত দেয়। ভাড়া বাড়ির বসবাস মার মৃত্যুর সঙ্গেই চুকিয়ে, বছরখানেক হল তাদের এখানে আসা।

জায়গাটা এখনও নিরিবিলি। বাইপাস সন্নিকটে না হলেও, জমি ডোবার দ্রুত ভরাটে দোকান, বাড়ি, বাজার যা এগোচ্ছে, বাইপাস সংলগ্ন হতে বেশিদিন লাগবে না।

নতুন কালভার্টের কাজ চলছে, সেটা পেরিয়ে রাজু যেখানে এসে দাঁড়াল, ঝাঁ-চকচকে সুপার মার্কেট-এর এক মিনি মডেল। চতুর্দিকের আলো ঠিকরে ঝলমল করছে দোকানের সম্ভার। এখান থেকে একটি কুকার কিনে অনুর পাশে দাঁড়াতে পারলে পরিস্থিতিটা হয়তো পালটাত। কিন্তু তার পার্সে দু’শোরও কিছু কম পড়ে আছে।

– রাজুদা, তুমি কোথায়?

কানে মোবাইল তুলে নিয়েছে রাজু।  নাম্বারটা দেখেও, কেটে না দিয়ে বলল, বল!

– এই আর কী! মানে বলছিলাম যে…।

শুনতে গরজ নেই রাজুর। চণ্ডীতলার বঙ্কা যে কি বলবে তার জানা। কেনা-বেচার কোনও চক্বরে সে আর নেই। অনেক হয়েছে। শেষে মূলধনেরই পুঁজি থাকে না, তো লাভ। পরে মহাজনের দ্বারস্থ হওয়া, সে এক শনির কোপ। পিছল সেই খানাখন্দে হাঁটার কথা ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয় রাজুর। বস্তুত হিংস্রতার উগ্র আদি বীজ কি রক্তে ওর আদৗ ছিল!

বাপ যার নিরীহ ছা-পোষা রং মিস্ত্রি! তিনতলা বাঁশের ভাড়া থেকে পিছলে পড়ে থেঁতো হল! নেহাত পেটের দায়ে পথের বিচার সম্ভব হয়নি, তাই রাজু কোন পথে না হেঁটেছে। সম্মুখ যখন ধূধূ, দল-দ্বন্দ্বের হাতিয়ার হতেও পিছপা হয়নি। হাত পাকাতে ছোটোখাটো হাতাহাতি চলছিলই। বড়ো সংঘর্ষের সূচনায়, মানে, এলাকা দখলের ছুরি শান দেবার পর্বে পিছোতে হল রাজুকে। লাশ ফেলে দেওয়া যেখানে মুহূর্তের ডিসিশন মাত্র। নিমরাজি ইচ্ছাটা শেষতক সেখানেই ফনা গুটিয়ে নিয়েছিল ওর। বেরিয়ে আসা সহজ ছিল না। যদি না গাড়োল ভেবে নিয়ে তারা লাথি ঝাড়ত।

সেই টানাপোড়েন, সেই মরিবাঁচি সময়ের কতককাল পরে আজকের অধ্যায়টির সূচনা…। মা ভাই নিয়ে একত্র বসবাসের পাট চুকিয়ে তবেই না…। বঙ্কাকে জানিয়ে দিল, আমার সময় হবে না রে বঙ্কা… আমার মেয়ের কাল পোলিও আছে।

– তোমার মেয়ে। বলছ কী, সে আবার কবে হল? খুক খুক হাসছে বঙ্কা। নাকি রাজুরই মনের ভুল, কেটে দিয়ে বাজার ঢুকে পড়ল সে।

জাঁকিয়ে বসেছে সবজির সান্ধ্যহাট। বিট গাজর আলু কাঁকরোল, শেষে কিনল আড়াইশো পেঁয়াজ। মোচা কেনার ইচ্ছা থাকলেও সেটা তাকেই ছাড়াতে হবে ভেবে নিল না। ক’টা মুসম্বি রাখল সিল্কির জন্য। এই ফলের রসটুকু আর অফিস ফিরে মেয়ের পড়া, খাওয়া ছাড়া বাদবাকি যত হ্যাপা রাজুর। স্কুল ইউনিফর্ম পরিয়ে সাইকেলে স্কুলে ছেড়ে আসা, ঘড়ি ধরে ঘরে আনা থেকে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো– সব। মেয়ে না ঘুমিয়ে বলল, কার্টুন চালাও। রাস্তার ডুগডুগি শুনে বাঁদর-নাচ দেখতে চাইল। বলল, মিউ ধরে আনো। কেক খাব। চাউ বানিয়ে দাও। বলল, আমার বন্ধু জিজা তো মার কাছে ঘুমোয়। ওর কোনও ড্যাডি নেই, বাপী আছে… হাজারো প্রশ্ন আর বায়না।

এসময় অদ্ভুত একটা তুলনা মনে এল রাজুর। মঙ্গলা হাট থেকে কিনে ট্রেনে রিকশায় কাপড়ের গাঁটরি বয়ে এনে দোকানে ধরানো, কি সাইকেল চাপিয়ে ফিরি করা, অন্যদিকে সর্বক্ষণ এক মেয়েলি ঘরকন্নার ঊনকোটি দায় সামাল দেওয়া, দুটো কাজের শ্রমগত লাভটা কোনদিকের বেশি।

চট করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলল সে। ভাবল, শ্রমের পাল্লা যেদিকেই ঝুঁকুক, এখানে তার আসা– বিপদে বিপথে বিপর্যস্ত এক যুবকের অবস্থার বিপাকে মাথা বিকানো হিসেবে। অন্যদিকে স্বনির্ভর, সসন্তান এক বিধবার সঙ্গহীন স্বেচ্ছাসমর্পণ। সেদিক দিয়ে দেখলে, প্রয়োজনের পাল্লাটি কোন দিকে কতটা ভারী, নাকি ভারসাম্যতা রাখছে, সেটা খতিয়ে ভাববার।

রাজু হিসাব গুলিয়ে বাড়ির পথ ধরল। ক্লাবে যাবার ইচ্ছা থাকলেও বুধবারে সেখানে তালা ঝোলে। মনটা গুমোট। বাড়ি ঢুকে ততোধিক গুমোট ঠেকল পরিপাশ। সাড়াশব্দহীন ঘর। টিভি। সিল্কিও। এমন উত্তুরে হাওয়া সতর্ক করল রাজুকে। মেয়েকে নিয়ে শুয়ে পড়েছিল অনু। দরজা খুলে দিয়ে আবার ঢুকে গেছে, আর এলই না। চুপচাপ বাজারের থলি চুবড়িতে উপুড় করল রাজু। প্যাসেজে আলো জ্বালাতেই চোখে পড়ল টেবিলে খাবার ঢাকা। ক্লাব থেকে ফিরতে দেরি হলেও তো এটা হয় না। আজ তো ক্লাবই নেই। ন’টাও বাজেনি এখনও। প্লাস্টিকের ঢাকা তুলে দেখল রুটি ডাল ডিমের কারি সাজানো একটাই প্লেট। অনুরটা কোথায়! আগে তো খায় না। না খেয়েই শুয়ে পড়ল নাকি!

খাবার দেখলে খিদে চাগাড় দেয় রাজুর। ক্ষুধা লজ্জাহীন। জীবনভর এই তাড়নাটা তাকে নানা ঘাটের জল খাইয়েছে। কত যে কঠিন সময় তাকে পেষাইকলের দাঁতের মতো চিবিয়েছে! প্রত্যয় হয়েছে, সব মানুষই ক্ষুন্নিবৃত্তির শর্তে বাঁধা।

ঝপ্ করে ঢাকনাটা নামিয়ে দিল প্লেটের। অনুকে বাদ দিয়ে খাওয়া ঠিক হবে না। মান-অভিমানের একটা বড়ো ভূমিকা আছে এই খাওয়ায়। সাধাসাধিতে সেটা ভাঙতে পারলে লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। কিন্তু কীভাবে এগোবে!

– তুমি খাবেনা অনু! শরীর খারাপ? শুয়ে পড়লে যে!

অনু হয়তো কথাই বলল না। বললেও দায়সারা গোছের, – তুমি খেয়ে নাওগে না। আমার ইচ্ছে নেই।

শুনেই হামলে পড়ে একা খাওয়া ভালো দেখায় না। হয়তো বলা উচিত, তোমাকে ছাড়া আমি একা কোনওদিন খেয়েছি, অনু! প্লিজ… ওঠো…! নিজের মনেই হাসল রাজু। কথাগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে অনুর কাছে গিয়ে দাঁড়াল আদত বুঝি খিদের টানেই।

বাক্যব্যয়হীন দিন দুই পর ছুটির দুপুরে অনুকে সহজ হতে দেখা গেল।

ঘরের আসবাব ঝাড়পোঁছ করছিল রাজু। দেয়াল থেকে ল্যামিনেট করা দাম্পত্যের ছবিখানা নামিয়ে, সেখান থেকে ভোঁতা নাক, খুদি চোখ, পুরু ঠোঁটের পুরুষটিকে কি বাদ দিয়ে ধুলো মুছবে রাজু!

পাশের কনেবউ যেখানে আজকের অঙ্কিতা !

দুর্ঘটনার দু’মাস পর সিল্কির জন্ম না হলে আরও একখানি ছবি ঝুলত দেয়ালে। একইভাবে সে ছবি মুছত সে। এই ভবিতব্যের প্রথম দৃশ্য তাই মনে রয়ে গিয়েছে তার।

হসপিটাল থেকে ফিরছে প্রসূতি, ন্যাপিতে মোড়া শিশু। দুধেল গন্ধ মাখা প্রথম বিষণ্ণ মাতৃত্ব। সঙ্গে বৃদ্ধা মা, গলায় গুনগুনে কান্নার বিলাপ। রাজু ছিল ওই অটোর সহযাত্রি। গাড়ির চালক দীপক তার বন্ধু। উচ্চকিত মনটা রাজুর পড়ে ছিল অনিশ্চিত ফায়দার দিকে। বয়ে আনা জামাকাপড়ের গাঁটরির বিক্রি ব্যবস্থা করার আছে। দোকান মালিকের কিস্তিমাফিক টাকায় তেমন লাভ হয় না। নিজস্ব ফিরিতে থেকে যায় উশুলের একটা দুর্নিবার লোভ। দরদামের কচকচি। যেটায় রাজু তেমন পোক্ত নয়।

চিন্তাগুলো ঘোঁট পাকালেও চোখকান পিছলে যাচ্ছিল পাশ্ববর্তিনীর দিকেও। পুতুলের মতো লালচে বাচ্চাটা নজর কাড়ছিল। সেই শুরু…। আর কে না জানে, কোনও সূত্রপাতেরই গড়িয়ে যাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। যাতায়াতে, সাহায্যে – সহযোগিতায়…। পাড়াটি যখন সংলগ্ন আর অটোড্রাইভার দীপক যার বন্ধু…।

ছবি মুছতে মুছতে দেখল রাজু, সামনে দাঁড়িয়েছে দেড়খানা মানুষ।

ভ্রূ নাচাল সে। সিল্কি না মা-কে? সিল্কি ছিল মার কোলে। মাঝেমধ্যে মেয়েকে সাধ করে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় অনু। দিনভর সঙ্গহীনতার চাপা ভরতুকি!

রাজু বলল, কুকারের শোকপালন শেষ হল?

উত্তর এল না।

– তার মানে ওটা পাওয়া গেছে?

– অত সোজা। চোর যেন ফিরিয়ে দেবার জন্য নিয়েছে। সিল্কিকে নামিয়ে অনু মোড়া টেনে বসল। ঝাড় পোঁছে অনুর সঙ্গে শান্তনুকেও সমান মনোযোগ পেতে দেখেই কি এই প্রসন্নতা! মাথা ঝুঁকিয়ে রাজু যখন শান্তনুর চওড়া কপাল থেকে ধুলোর আস্তরণ তুলছিল, অনু ছিল পিছনে, নিঃশব্দ। এখন মুখোমুখি বসে বলল, রাজু, তুমি অনেক কিছুই বোঝো, আবার কিছু জিনিস বোঝার চেষ্টাই করো না।

চশমা ফোঁড় চেয়ে থাকল রাজু সেই বোঝার চেষ্টায়। অনু চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, দিনটা ছিল সেভেন্থ মার্চ…।

–তো! বলেই হঠাৎ মনেপড়ার উদ্ভাসে বলল সে, তাই তো! অনু চোখের জল সামলে বলল, কুকারটা শান্তনু আমাকে সেকেন্ড অ্যানিভার্সারিতে প্রেজেন্ট করেছিল। আমি মাংস রেঁধে খাইয়েছিলাম। অতীত স্মৃতির কাতরতা সামলে বলে, আসলে, যে সময় থেকে স্বামীরা বউকে শুধু বিছানাতেই নয়, রান্নাঘরেও দেখতে চায়, সেই সময়ের কেনা আর কি।

অধোবদন রাজু অনুর একটা দীর্ঘশ্বাস পড়তে শুনল। হাতটি বাড়িয়ে অনুকে ছুঁয়ে বলল, সরি অনু!

উঠে পড়ে দেয়ালে ছবিটা সেট করে রাজু হাত ঝাড়ল। এইভাবে যদি ঝেড়ে ফেলা যেত চোরা ক্ষোভ দ্বন্দ্বের মালিন্য, ধুলোবালির মতোই। তা কী আর হয়! গভীর কারও দুঃখ প্রকাশের সামনে বিমুখতা কী শোভন! জীবন যেখানে সহভাগে মিশেছে। যেজন্য নিজেকে জুড়েছে অনু। তারই পাশাপাশি নিবিড় মিলমিশের এই যে আয়োজন! উন্মুখতা যেখানে একই তৃষ্ণার তাগিদে একাকার! অনু কি তা জানে! নাকি সহজলভ্য দাম্পত্যে তার সেই খেয়াল দরকার পড়ে না! রাজু তার মুখের ভাব লুকোতে ঊধর্বমুখ উত্তর খোঁজে। হাতে তার ঝুলদন্ড।

ছুটির দিন সিল্কির স্নানখাওয়া মার হাতে। কিছুটা পাশ কাটাতে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকে সে। কিন্তু মায়ের গল্পবিহীন ধমকভরা ভাতে সিল্কির গরজ নেই। শুরু হয়েছে ড্যাডির বায়না। এদিকে আলমারির পিছনে মস্ত এক মারড়সা রাজুর নজরবন্দি, ঝুলকাঠিতে জাল সমেত টেনে আনতে যাবে, অনু তার হাত থাবড়ে বলল, ওসব ছাড়ো তো এখন! আগে তোমার মেয়ে সামলাও…।

…সপ্তাহ শেষের দুপুরটা আজ অনুর পাশে গড়ানো গেল না। কাজের মেয়ে টুলু এসে গেল বিকেলের কাজ দুপুরে চুকোতে। রাজু ঠায় চেয়ারে তার পাহারাদার, যতক্ষণ না সে কাজ সেরে বেরিয়ে যাচ্ছে। ফলত ভাতঘুম-ছুট মাথাটার দখল নিল এমন কিছু চিন্তা, যা তার দিনগত আচরণে মিলবে না। অলস মস্তিষ্কের ধর্ম! হবে বা। রাজুর তো মনে হয় শর্তমাফিক রাজুতেই আছে সে। কালি মিশেল হু হু ধুম্র তবে কেন। কোন রন্ধ্র দিয়ে মাথায় ঢুকে তছনছ করে দেয় নিভৃত কুলুঙ্গিটি! যা হয়তো সময়ের অপেক্ষায় তুমুল হতে পারত– কিন্তু রাজুর সতর্কতায় তা হয়নি।

ল্যান্ডফোন বাজল…। কেটেও গেল। উঠতে গিয়ে ওঠা হল না। সদ্য কুকার খোয়া গেছে। ভাবল সে, টুলু গেলে দরজা বন্ধ করল কী! ঘুম থেকে উঠে এই নিয়েই হয়তো ধুন্ধুমার হবে অনু। যাকে যা মানায়। ওর লাইফ স্টাইলে এটাই স্বাভাবিক। শান্তনুর মৃত্যুবাবদ চাকরিটি ওর বেঁচে থাকা কায়েম করেছে। দ্রুত বৈধব্য ঘুচিয়ে রসে বসে রেখেছে আর একটি পুরুষ। রীতিমতো রেজিস্টার্ড স্বামী রাজেন্দ্র দাস। দাসানুদাস। দাসত্ব এমন যে, ছাড়তে হয়েছে রক্তবন্ধনও। মা ভাইয়ের ফোন এলে রাজু ফাঁপরে পড়ে যায়। অনুর ভ্রূ এলোমেলো হয়। মুখ তৗল করে বলে, কে এত ফোন করে বলো তো! তোমার কী ঘরসংসার বউবাচ্চা নেই? কথা বাড়বার আগেই ফোন কেটে দেয় সে।

সময়ের দখলদারিতে অনুর অধিকার, কি আদ্যন্ত নির্ভরশীল এক যুবকের এই অবনমন, রাজুর অস্বাভাবিক মনে হয় না। ক্ষুণ্ণতা তার অন্য জায়গায়। একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষশরীরে অদম্য হয়ে ওঠে যে প্রদানক্ষমতা, যার তাড়না একসময় তাকে প্রজন্মকামী করে তুলতেই পারে– এখানে তা নস্যাৎ করেছে অনু সিল্কিকে একক মনস্থ রেখে। রাজু সিল্কির ড্যাডি। বিনা বিস্তারে রাজুর বংশ? তা হলে…।

এই সময় সেই চারাগাছটির কথা মনে পড়ে রাজুর। কোনও একসময় সবজি চালানের ব্যাবসায় নেমেছিল যখন, মহিষবাথান থেকে জোগান আনতে বাসস্ট্যান্ডে নেমে মেঠোপথে খানিক হাঁটতে হতো খেতের দিকে। রাস্তার পাশে বুনো ঝোপঝাড়ে মিশে থাকা একটি ছোট্ট গাছ, যাকে সে জলধারায় ভিজিয়ে তখন প্যান্টের বোতাম আঁটছে, চকিত চেনায় মাথাজোড়াহীন সেই চারাগাছের দশা দেখে কে বলবে সেটি লংকাগাছ। বিশেষ ঝাঁজ ঝাল যার প্রকৃতিগত। কিন্তু ঘন সন্নিবেশিত কাঁটা ঝোপ তাকে বাড়বার পরিসর দেয়নি। বস্তুত অঙ্গ থেকেও অঙ্গহানি যার, মরণ কি শুধু মরণেই! মাথা নাড়ায় রাজু। পিছনের উত্তপ্ত দিনগুলোর কথা ভেঙে হৃৎপিণ্ড উত্তাল হয়ে ওঠে।

লোডশেডিং। সিল্কি কান্না জুড়েছে।

– একটা পাখা দাও তো…।

গ্রিল বারান্দা থেকে রাস্তার চলাচল দেখছে রাজু। হেলদোল নেই। সদ্য তৈরি ঝকঝকে রাস্তায় আড়াআড়ি একটা বেড়াল পেরোল। কিন্তু কালো নয়। তবু ব্রেক কষে থেমে পড়েছে হাই স্পিডের স্করপিওটি। নিজের মনেই হেসে ফেলল রাজু। …হায় জীবন…।

– কি গো একটা পাখা চাইছি যে…।

অনুর মেজাজ চড়ছে। কটু কথায় তিক্ত হচ্ছে রাজুরও জিভ, চাপা স্বরে বিড়বিড় করল, –দিচ্ছি রে বাবা দিচ্চি… আচ্ছা বে-শরম মেয়েছেল বটে, উঠে পাখাটাও আনতে পারে না! পাখা হাতড়ায় রাজু। কিন্তু কোথায় পাখা! কারেন্ট এলেই যার প্রয়োজন শেষ। খাদানের কুলির মতো খেটে খেটে আর ফুসফুস নিঙড়ে এদের হাওয়া দিয়ে রাজু হবে ডাঙার মাছ। খাবি খাবে।

এইভাবেই অভ্যস্ত আপোসনামা ছিঁড়ে মানুষেরও কখনও কখনও এনার্জিক কারেন্ট চলে যায়। ঘনঘোর অন্ধবোধ বড়ো দুর্বহ তখন, ঠিক এই মুহূর্তটির মতো।

আবার ল্যান্ডফোন…। বাজছে তো বাজছেই।

অনুর তিরিক্ষি নির্দেশ আসবার আগেই দৌড়োল রাজু, – হ্যা..লো..ও..। মুহূর্তেই তার স্বর নেমে এল একপরত – ধরুন, ম্যাডামকে দিচ্ছি…।

খাটের পাশে এসে দাঁড়াল সে প্রকৃত নফরের মতো, বলল, তোমার ফোন। গলার খন্দে আটকে থাকল বাকি কথা।

– কার? অনু চোখ কুঁচকে মাথা তুলেছে।

– ব্যাংকলোনের। চোখ সরিয়ে মাথা নামাল রাজু। রাজুর বিগত ধারদেনার জন্য ব্যাংকলোন নেওয়া আছে অনুর। কিন্তু সিল্কির এককালীন স্ল্যাডমিশন ফি জোগাতে আপাতত সেটা বাদ পড়েছে দু-মাস। অনুর এই অপারগতায় তার যথেষ্ট দুঃখবোধ হলেও, এখান থেকেই যে সুরক্ষাটি তাকে বর্তমান অবস্থানে এনেছে, সেই স্বস্তিসুখও এড়াতে পারে না। একের দায় অন্যে বহন করার মূল রসায়ন সম্বন্ধে আর একটু সচেতন হল কী সে! হয়তো বা। বিছানায় অনুর অনিচ্ছ উঠে বসা দেখতে দেখতে কেনই বা ভেসে উঠবে সেই রসায়নের ছবি। রাজুর পায়ে হোঁচট খেয়ে কবে একদিন পা ছুঁয়ে হাতটি মাথায় ঠেকিয়েছিল অনু। কাছে টানতেই মনোরম হয়ে উঠেছিল সেই সমর্পণ। রাজু বলেছিল, আরে, আরে, প্রণাম কেন। এসব আর চলে না অনু। উচ্ছ্বসিত হয়ে অনু বলেছিল, সময়টা দু’হাজার প্লাস বলেই তুমি এটা বলতে পারলে রাজু। আমাদের দিদিমণি বলতেন, রামায়ণের যুগে মেয়েদের তো পুরুষমানুষের নীচে রাখতে ঊনমানুষ বলা হতো।

দু’জনেই হেসেছিল খুব। সময়মতো সুখস্মৃতির উদ্ভাস যেন বিবেকের পালাগানের মতো সচেতন করে রাজুকে।

অন্তরঙ্গ এমন ঘেরাটোপের পিছনেই তার হিম স্থির এক অতীত, সে জানে। কত যে খণ্ডদৃশ্য। ফিরে ফিরে আসে জিতু রতন গিরিধারীরা…। ঘনশ্যাম দল পালটালেও মদের ঠেক ওকে ছাড়তে হয়েছিল পাবলিকের মারের চোটে। রতন ওয়াগন ব্রেকিং-এ পুলিশের তাড়া খেয়ে ট্রেনে কাটা পড়ল। পড়ে থাকল লাইনের ধারে। খবরটা রাজুকেই দিতে হয়েছিল ওর মাকে।

আর ছিল গিরিধারী। জ্যাংরা এলাকায় নির্মিয়মান ফ্ল্যাটে বিশিষ্ট একজনের জন্য মধুচক্রের ব্যবস্থা করে দিতে গিয়ে, মূল মেহমান ও অন্যান্যরা সটকালেও ধরা পড়ল শুধু গিরিধারী। পুলিশের মারে সে কী ফালাফালা পিঠ। রাজু গা-ঢাকা দিতে পেরেছিল– ক’দিন মাসির বাড়ি বাগনান পালিয়ে।

…সেইসব সহযাত্রীরা …দিকশূন্য বাজপাখিগুলি…। তাদের মুখ থুবড়ে পড়া থেঁতো রক্তাক্ত মুখ, রাতের ঘুম কেড়ে নেয় রাজুর আজও। অস্থির উত্তাল সেই দুর্বহ বোধই কী স্তিমিত হয়ে ফিরিয়ে আনে তাকে আপাত অবস্থানে! তাই যদি, তাহলে খেদ অসন্তোষের দিকগুলি বাদ দিয়ে বাকিটা রাজুর কেমন? কতটা ভাল?

না, প্রাপ্তির তলদেশ ঘাঁটতে আর ইচ্ছা হয় না। বরঞ্চ ভেবে নেওয়া যাক জল বাদ দিয়ে দুধ যেমন একা উথলোয় না, সংসারে দুঃখ সুখের অবস্থানও অনেকটা সেইরকম…। এটাই বোধহয় নিয়ম।

এরপর তার দীর্ঘসময়ের গুমোট নিশ্বাস মোচন, আর পরবর্তী সুখটানের মতো টেনে নেওয়া তাজা বাতাস, দু’টোই তাকে এমন আশ্চর্য সহায়তা দেয় যে, হঠাৎ খেয়াল হয় হাতপাখাটা খুঁজে পেয়ে হাতে নিয়েই তো দাঁড়িয়ে আছে সে। অনু খাট থেকে নামতেই ছিট্কে পড়া তার চপ্পলজোড়া পা দিয়ে টেনে এগিয়ে দেয় অনুর পায়ের নীচে। অবিন্যস্ত নাইটি সামলে, পায়ে চটি গলিয়ে উদভ্রান্তের মতো ফোন ধরতে যাচ্ছে অনু। অপলক রাজু সেই মুখ দেখতে দেখতে সিল্কিকে বাতাস দেয়। ভেবে রাখে, অনু এলে তাকেও দেবে…।

ছেলেধরা

আমি উত্তমকুমার।

হাবরা থানার সেকেন্ড অফিসার টেবিল থেকে মুখ তুলে দুটো ভ্রূ যথাসম্ভব কাছাকাছি আনলেন। তাঁর চোখের শ্লেষ ও বিরক্তির জিজ্ঞাসায় কিছুটা থতমত, টেবিলের অপর প্রান্তের দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি গড়গড় করে বলতে থাকে– মানে আমি উত্তমকুমার দাম। আজ ২টো ২০-র বনগাঁ লোকালে আমার পিক্পকেট হয়েছে। হাজার দেড়েক টাকা ছাড়াও ওয়ালেটে ছিল ব্যাংকের ডেবিট কার্ড। আর পকেটের মোবাইলটাও গেছে। হাবরা থানার সেকেন্ড অফিসারকে এটুকু বলতেই ঘেমে একসার। আসলে থানা-পুলিশ নিয়ে তার দুর্বলতা আছে।

সেদিনও ঘেমে নেয়ে দুপুর রোদের ভেতর এক সংবাদপত্রের অফিসের বিজ্ঞাপন বিভাগে ঢুকে কাগজে লেখা টুকরোটি দিয়েছিল। ‘আমি উত্তমকুমার দাম। বয়স পঁয়ত্রিশ। অবিবাহিত। কর্পোরেট সংস্থায় চাকুরে। বিবাহে ইচ্ছুক। দ্রুত যোগাযোগ করুন।’সেদিন মঙ্গলবার, পরের রোববারের কাগজে বেরিয়ে যাবে বিজ্ঞাপন। সুইং ডোর ঠেলে পথে নেমে পড়ে। দেখা যাক। নীরদ চৌধুরির কথাটা প্রেমে ল্যাং খাবার পর প্রতিদিনই চোখের সামনে ভেসে উঠছে– ‘বাঙালিরা কোনও কাজ নিজে নিজে করতে পারে না, এমনকী নিজের বিবাহটাও নয়।’ দেখা যাক। গোটা ব্যাপারটাই নিজের হাতে করব। ছাঁদনাতলা থেকে রাঁধুনি– সব নিজের হাতে করব। এমনকী করবীকে নিজের হাতেই বিয়ের আমন্ত্রণপত্রটি দিয়ে চা খেয়ে আসব। বিয়ের একটা ডেট ঠিক করে ফেলা যাক। ১৮ অগ্রহায়ণ। শুক্রবার। ঠিক থাকল। না অন্য কেউ দিন ঠিক করবে না। যে মেয়ে বিয়ে করবে তাকেও ওই দিনেই বিয়ে করতে হবে। কোনও পালটাপালটি নয়। কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে আজই কার্ডের নমুনা টমুনা দেখে আসতে হবে। বিয়ের কার্ড অন্তত শ’পাঁচেক ছাপতে হবে। রাসবিহারী কানেক্টরে বোসপুকুরের কাছে বিয়ে বাড়িটার যেন কী নাম– ‘নীলিমা’! অগ্রিম দিয়ে আসতে হবে। ভাবতে ভাবতে দুপুর রোদের ভেতর হেঁটে হেঁটেই ডালহউজি নিজের অফিসে ফিরে আসে।

বেশ ছটফট করছে সে। বুকের ভেতর অশান্তি নামে নাছোড় এক পদার্থ গড়িয়ে গড়িয়ে ছেয়ে যাচ্ছে সমস্ত শরীরে। রক্তের প্রবাহ পথে, তার মনে হচ্ছে সমস্ত শরীরেই এই আনচান ভাবটা ঢুকে পড়েছে। মনে পড়ছে গত পরশু দিন বিকেল বেলায় ওই যে শব্দের ছোবল কানের ভেতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করল– তারপর থেকেই এই অস্থিরতা। গত দুবছরে কতদিনই তো রেস্তোরাঁয় বসে চা-কফি খেতে খেতে পায়ের আশ্লেষে হূদয়ের আকুলতা প্রকাশ করেছে উত্তম। তাতে তো সায়ই দিয়েছে করবী, ওর নগ্ন দু-পা আরও প্রলম্বিত করে। অথচ পরশু শান্তনুর কথাটা তুলে পার্ক স্ট্রিটের ফেলিনি-তে টেবিলের তলায় পা দিয়ে পায়ে ছোঁয়া লাগাতেই, খাঁচার বাঘিনীর মতো গর্জে উঠেছে করবী। ইউ রাসকেল্ হোয়াই আর ইউ প্রেসিং সো হার্ড! মাইন্ড ইট দ্যাট ইউ আর অ্যাবভ থার্টি-ফাইভ, হোয়ারআজ  আই এম টোয়েন্টি টু অনলি। থতমত উত্তম করুণ করে বলেছিল– মানে!

কোনও মানে নেই। সব কথার উত্তর তোমাকে দিতে হবে তার কোনও মানে নেই। শান্তনুও আমার ভালো বন্ধু, তার সাথে আমি সিঙ্গাপুরে যেতেই পারি। বড়ো কথা কোম্পানি আমাদের পাঠাচ্ছে সিঙ্গাপুরে, কোম্পানির স্বার্থেই। উত্তম ভালো করে জানে না কী কোম্পানি, তাদের কী ব্যাবসা সিঙ্গাপুরে। একটা দম নিয়ে পুনরায় করবী বলে, তোমার গায়ে জ্বালা হচ্ছে যখন, লেট মি সে টাটা, বাই। করবী টেবিলটাকে এমন পুশ্ করে উঠে পড়েছিল যে ঝুঁকে থাকা উত্তমের বুকে এসে সজোরে ধাক্বা মারে। উত্তম কোনও কথা বলতে পারেনি। বুকে হাত বোলাতে বোলাতে করবীর তেজী ভঙ্গির ক্ষীপ্র গমনটিকে চোখে গেঁথেছিল, বুঝে উঠতে পারেনি। যেভাবে ভারী কোনও আঘাত প্রথমে সমস্ত ইন্দ্রিয়কে অনুভবহীন করে দেয়– কিছু পরে মস্তিষ্কের নিউরনে যন্ত্রণা পাঠাতে থাকে, তেমনই।

বিয়ে করল উত্তমকুমার। পাত্রীও তার পছন্দের। নম্রস্বভাব। সুশ্রী, সুন্দরী। বিয়ের পরেই প্রেম করবে ভাবল সে। অনেক ভালোবাসবে। ওকে ভালোবেসেই বুকের জমানো অন্ধকার দূর করে ফেলবে। বিয়ের রাতে তৃণাকে উত্তম এক অবসরে জিজ্ঞাসা করেছে– কি, বর পছন্দ? মুখে সলজ্জ হাসি টেনে মাথা নেড়ে ইতিবাচক মতামত জানিয়েছে। উত্তম জানিয়েছে দিন দশেকের মধ্যেই তারা বেরিয়ে পড়বে হানিমুনে। কাঠমান্ডু যাবে। সেখান থেকে ফেরার পথে বেনারস, লখনউ হয়ে একমাস পরে বাড়ি ফিরবে। দশ লাখ টাকা খরচ করবে হনিমুন টুরে।

এসব শোনার পর তৃণা আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছিল উত্তমের। মেয়েবাড়িতে এর বেশি এগোনো যায় না। শুধু ছোঁয়াছুঁয়ি আর আকার-ইঙ্গিতে ভালো লাগা ব্যক্ত করা যায়। বউভাত ও তার পরের কয়েকদিন উত্তমের অসাধারণ কেটেছে। বউভাতে করবীও এসেছিল শান্তনুকে নিয়ে। উত্তম করবীকে নিয়ে বউ-এর সাথে আলাপ করিয়েছে। উদ্দেশ্য আরও কাছ থেকে দ্যাখো, দ্যাখো কে বেশি সুন্দরী– তুমি না আমার বউ। খুব বয়স নয় তৃণার, ২৫-এর কাছাকাছি হবে। উত্তম করবীর মুখের নানা পরিবর্তন দেখে নিজেকে তারিফ করেছে। করবীকে বিট্ করতে পারার এই আনন্দেই যেন কটা দিন চলে গেল। এরপর দ্বিরাগমনের প্রথা ট্রথা কাটিয়ে অফিসে জয়েন করেছে। হনিমুন ট্রিপের জন্য গোছগাছ।

এসময় উত্তমের জন্য আবার একটি ভয়ংকর আঘাত অপেক্ষা করে ছিল। অফিস ফেরত দেখে বউ বাড়ি নেই। বৃদ্ধা মা জানায় সকাল বেলায় এগারোটা নাগাদ ট্যাক্সি ডেকে একটা বড়ো সুটকেশ নিয়ে বউ বাপের বাড়ি চলে গেছে। উত্তম ফোন বাজায় কেউ ফোন ধরে না। উদ্বিগ্ন উত্তম ঠিক করেছে সকাল হলেই সে শ্বশুড়বাড়ি যাবে খোঁজখবর নিতে। পরের দিন সকালের ঘুম ভাঙে তার কলিং বেলের আওয়াজে। ঘুম চোখেই দরজা খুলে দাঁড়িয়ে দেখে একজন পুলিশ অফিসার, সঙ্গে দু-তিনজন কনস্টেবল।

– আপনি উত্তমকুমার দাম?

ভ্যাবাচ্যাকা উত্তম কিছু না বুঝেই ঘাড় নাড়ে।

আপনি আমার সঙ্গে চলুন, কড়েয়া থানায়। আপনার উপর বধূ নির্যাতনের অভিযোগ আছে। আপনাকে দেখে সম্ভ্রান্ত মনে হয়, কিন্তু টাকার জন্য এরকম ফুটফুটে মেয়ের শরীরে সিগারেটের ছ্যাঁকায় বীভৎস দাগ করে দিতে পারেন? ক্যাশ টাকা দিয়েছিল ওরা তিন লাখ, আর আপনার আরও দু লাখের ডিমান্ড ছিল!

উত্তমের মাথায় কিছু ঢুকছে না। একটা বড়ো বিপদ যে আসছে বুঝতে পারল। মোবাইল থেকে সঙ্গে সঙ্গে ফ্রেন্ড-ফিলসফার অফিসের শম্ভুদাকে ফোন করে বলল, কড়েয়া থানায় আসতে। শম্ভুদা ওকে জামিনে ছাড়িয়ে আনল বটে তবে উত্তমের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে তিন লাখ টাকা নিঃশব্দে চলে গেল ওর বউ, মানে তৃণা নামে সেই মেয়েটির বাড়িতে। সোনা-গয়না বিয়ের দামি উপহার সামগ্রী-সহ আরও লাখ দুয়েক টাকার জিনিস মেয়েটা সুটকেস ভর্তি করে নিয়ে গিয়েছিল। হাজতেই ডিভোর্স পেপার সই হয়ে গিয়েছিল। এই তিন লাখের এক লাখ নিঃসন্দেহে থানার বড়োবাবু পেয়েছিল। না হলে এত নিখুঁত, সাজানো নাটক করা যেত না। থানার বাইরে চার-পাঁচজন মহিলাকে ও দেখেছিল পোস্টার হাতে স্লোগান দিতে– নারীনির্যাতনকারী উত্তমকুমার দামের শাস্তি চাই। এত দ্রুত, এত সকালে চলে এসেছে ওরা! বড়োবাবুও খুব ভালোমানুষের মতো উপদেশ দিয়েছে ওদের টাকাটা ফিরিয়ে দিন, আর বিয়েটা যখন ভেঙেই যাবে এখনই ডিভোর্স পেপারে সইটই করে মানসম্মান বাঁচান। এখনও লোক জানাজানি হয়নি তেমন। উত্তম বোঝাতেই পারেনি যে পণ নিয়ে ও বিয়ে করেনি। আর বধূ-নির্যাতনের কথা তো দূরঅস্ত, একটু জোরে বউয়ের নাম ধরে ডাকাও হয়ে ওঠেনি তখনও।

টাকার ক্ষতি, ক্ষতি নয়, নিজের উপর থেকে বিশ্বাসটাই চলে গেল। বুক ভেঙে গেছিল, শোবার ঘর থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে বাইরেই বের হয়নি। এক সময়কার কলকাতার মাঠের ডাকসাইটে স্টপার ছিল। যত গোল করেছে তার চেয়ে ঢের বেশি করিয়েছে। কিন্তু এখন পরপর গোল খেয়ে যাচ্ছে। করবীকে টেক্বা দিতে তেমন কোনও খোঁজখবর না নিয়েই খুব দ্রুত বিয়েটা সেরেছিল। কিন্তু কী করে পারল মেয়েটা! আজও ভেবে পায় না। এখন হাবরা থানায় ডিউটিরুমে বসে এফআইআর লেখাতে লেখাতে উত্তমের মনে পড়ছিল এসব কথা। পাশের কনস্টেবল দাদার কাছ থেকে বিড়ি চেয়ে একটা বিড়ি ধরাল। মাথাটা উত্তর কলকাতার ট্র্যাফিক জ্যামের মতো জমাট হয়ে আছে।

এখন সে বিড়ি খায়। বলে, বিড়ি না ফুঁকলে মাটির কাছাকাছি যাওয়া যায় না। আমার কাজই মাটির সাথে, মাঠের সাথে– বলে অল্প করে হাসে। এবছর উত্তম বড়ো ক্লাবের স্পটার। গোদা কথায় ছেলেধরা। ফুটবল মরশুমের আগে কলকাতার মাঠের বড়ো ক্লাবগুলির রিক্রুটারদের কাছে ওর ডিমান্ড এখন বেশ। গত নয় বছর ও এই ছেলেধরা, মানে স্পটারগিরি করছে। আচমকাই এই কাজটা শুরু হয়। করবীর কাছ থেকে আঘাত ও বিয়ের পর বউ পালানো ও থানা-পুলিশ ইত্যাদির ধাক্বায়, উত্তমকুমার বেশ গভীর একটা ডিপ্রেশনের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিল। অফিসে যেত মাসে হাতে গোনা কয়েকদিন। মানুষজন পছন্দ করত না। নিজের কাছে নিজেকেই লুকোতে চাইত। সারাদিন গোটা কলকাতার খোলা মাঠের কোণটোনে বসে কাটিয়ে, অনেক রাতে ঘরে ফিরত। এরকম করতে করতে গোটা কলকাতার মাঠের ফুটবল খেলা দেখে ফেলেছিল সে বছর। একদিন উত্তর কলকাতার একটা মাঠে স্কুল ফুটবল দেখছিল। একটা বছর ১৪-১৫ ছেলের খেলা ওকে নাড়িয়ে দেয়। স্টপার। খেলা শেষে নাম জিজ্ঞাসা করে। ওর নাম হাসান। বস্তিতে থাকে। দেশবন্ধু স্কুলের ক্লাস নাইনের ছাত্র। উত্তম ছেলেটার ভেতর একদম নিজের গড়ন দেখল। বেশ লম্বা। ছ’ফুটের উপর হবে। দারুণ সম্ভাবনা। রাতে ঘুম হল না। পরের দিন অফিসে গিয়ে শম্ভুদাকে বলল, ওই ছেলেটিকে একটা ক্লাব দিতে হবে। সেই শুরু। ছেলেটিও ইতিমধ্যে ভারতীয় জার্সি গায়ে দিয়ে ফেলেছে।

গত দু’বছরে কলকাতার মাঠের তাঁবুগুলোতে তার নাম একটা বিষয়। এভারেডি ইলেভেন ২ঙ্মঙ্মজ্জ-এর ক্লাব ফুটবলের হিসেব-টিশেব সব বদলে দিয়েছে। চারটে বড়ো ক্লাবকেই গোল মেরে দিয়েছিল। দু’টোর সাথে ড্র, দুটো জয়। সেই এভারেডির দুটো স্টপারই এবছর, ২০০৭-এ গোটা ভারতের মাঠ শাসন করছে। বিড়িখোর উত্তমই ওই স্টপার দুটোর স্পটার ছিল। এবছর বড়ো ক্লাবের স্পটার হিসেবে তিনটে জায়গাতে অ্যাসাইনমেন্ট আছে। গোলকিপার, ডিপ ডিফেন্স আর তার নিজস্ব প্রিয় জায়গা স্টপার পজিশনের জন্য। মোটা টাকার চুক্তি। বছরে বিশ লাখ। দশ লাখ টাকা অ্যাডভান্স পেয়েছে। অফিসে হাজিরা খাতায় সই করে দু-এক কাপ চা খেয়ে, শম্ভু-দার সঙ্গে একবার দেখা করে কেটে পড়ে। প্লেয়ার কোটায় চাকরি হয়েছিল বছর ষোলো আগে। গ্রুপ ডি। এখন পদোন্নতি হয়েছে। গ্রুপ সি। ওর শুধু আসা-যাওয়া। কাজের মধ্যে নিয়ম করে শম্ভুদার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানো। এই মানুষটাকে ও প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে আর শ্রদ্ধা করে। শ্রদ্ধা করারই মতো।

প্রথম দিন শম্ভুদার কাছে গল্পটা শুনেই সে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিল। গল্পটা শম্ভুদার স্ত্রী আত্রেয়ীকে নিয়ে যতটা, তার চেয়ে ঢের শম্ভুদা নিজেই। লাখোটিয়া কম্পিউটার সেন্টার, কলকাতার প্রথম যুগের কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারের অন্যতম। সেখান থেকে এক বছরের কোর্স করেই এন্টালির ডাকাবুকো বিএ পাস শম্ভু রাহা, এই কোম্পানির কম্পিউটার অপারেটরের চাকরিটি পায়। মাঝে মধ্যেই শম্ভুদার সহকর্মী দীপকের খোঁজ করে অফিসের ল্যান্ড ফোনে কল আসত আত্রেয়ীর। দীপক অফিসে বেশ অনিয়মিত ছিল, তাই ফোনটা ধরতেন শম্ভুদাই। প্রথম প্রথম আড়ষ্ট আলাপ, ক্রমশ বন্ধুত্ব। তারপর অন্তরঙ্গতা। এদিকে অনিয়মিত হওয়ার কারণে দীপকের চাকরিটি গেল। একদিন আত্রেয়ী চাইল দেখা সাক্ষাৎ হোক। শম্ভুদা বলল, বেশ। কোথায়, কখন তা আত্রেয়ী ঠিক করে। প্রথম দিন ছিল শনিবার, ধর্মতলায় মেট্রো সিনেমার সামনে, সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটায়। কিন্তু কী করে চিনব, শম্ভুদা জিজ্ঞাসা করেছিল। আত্রেয়ী জানায় সে কালো রঙের চুড়িদার পরবে।

শম্ভুদা বলেছিল, আমি থাকব পিংক টি-শার্ট আর ব্লু জিনসে। শনিবার দুটোর পরেই ছুটি। শম্ভুদা ক্লাব, ক্যান্টিন করতে করতে চারটে বাজিয়েছে মাত্র। আরও দেড় ঘন্টা! সময় আর কাটতেই চায় না। অফিস থেকে এসপ্ল্যানেড হেঁটে দশ মিনিটের পথ। আর এই বিশেষ দিনে তো হাঁটা যায় না, ট্যাক্সি করতে হবে। শম্ভুদা সাড়ে চারটের মধ্যেই চলে এসেছে। এত আগে কী করবে, ফুটপাথে বইপত্রের দোকান থেকে বইপত্র দু-একটা তুলে তুলে দেখছে। ইতিমধ্যে সিনেমার শো ভেঙেছে। অনেক মানুষ। খুঁজে পাবে তো! মনে মনে একটা আশঙ্কাও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে, কই কালো-চুড়িদারে কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না। শম্ভুদা মনে মনে ভাবল, আমার ঘড়িটা ঠিক আছে তো! ঠিক এখানটাতেই তো বলেছিল! তখনও মোবাইল ফোনের যুগ চালু হয়নি। ফলে প্রতীক্ষার দীর্ঘতা অস্বস্তি বুনে চলে মাথার ভেতর। প্রায় একঘন্টা কেটে গেছে, সাড়ে ছ’টা নাগাদ নীল শিফন শাড়ি পরা একটা মিষ্টি মেয়ে তার দিকে এগিয়ে এল। ঘন্টাখানেক আগেই ওই দীর্ঘাঙ্গী সুশ্রী মেয়েটা ওর চোখে পড়েছে। শম্ভুদা ভেবেছিল সিনেমা দেখতে এসেছে, ওর সঙ্গীর জন্য অপেক্ষা করছে। মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল, আপনি শম্ভু রাহা?

হ্যাঁ। কিন্তু আপনি?

মেয়েটি হেসে জবাব দেয়, সে-ই আত্রেয়ী। বড়ো একটা শ্বাস নিয়ে শম্ভুদা অনেকক্ষণ ওর চোখে তাকিয়ে ছিল। কোনো অনুযোগ করেনি। পোশাক পালটানোর কারণও জিজ্ঞাসা করেনি। পরে অবশ্য জেনেছিল, ইচ্ছা করেই আত্রেয়ী নিজের পোশাকের ভুল বিবরণ দিয়েছিল যাতে না-দেখা পরিচয়ের শম্ভুদাকে অপছন্দ হলে নিঃশব্দে কেটে পড়তে পারে। শম্ভুদা বলল কোথায় বসে কথা বলা যায়! চলুন কাছেই কাফে দ্য মণিকা-র দোতলায় কফি খেতে খেতে গল্প করা যাক। কফি খেতে খেতে শম্ভুদা আত্রেয়ীর রূপে মজে যায়। বলে সংশয় ছিল, না না-দেখা আত্রেয়ীর ঘোর, দেখা আত্রেয়ী এসে যদি নষ্ট করে দেয়। কিন্তু এখন দেখছি আমার ভাবনা পেরিয়েও আপনি অপরূপা। আত্রেয়ী অল্প হাসে এবং ঘড়ির কাঁটা দ্রুত সাড়ে আটটা পার করে দেয়। আত্রেয়ী উঠব উঠব করে। শম্ভুদা বলে, রাত হয়ে গেছে। চলুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। আত্রেয়ী সশব্যস্ত হয়ে বলে, না না আমি একাই যেতে পারব। শ্যামবাজার। আপনি আমাকে একটা ট্যাক্সি ধরে দিন শুধু। তারপর হাতব্যাগ খুলে ব্যাগের ভেতর খুঁজতে খুঁজতে মুখ চুন করে বলে, কিন্তু আমার মানিপার্স বাড়িতে ফেলে এসেছি। শম্ভুদা ব্যস্ত সমস্ত হয়ে নিজের মানিব্যাগ থেকে পাঁচশো টাকা বার করে হাতে গুঁজে দিয়ে তাকে ট্যাক্সিতে তুলে দেয়। এরপর প্রায় প্রতিদিনই শম্ভুদার বিকেল কেটেছে আত্রেয়ীর সাথে আড্ডায়। কখনও সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের কফিহাউসে, কখনও ইডেনে, কখনও গঙ্গার ঘাটে, কখনও সেন্ট্রাল লাইব্রেরির চত্বরে, কখনও মেট্রো সিনেমা হলে। প্রায় একবছর শম্ভুদা হাবুডুবু। এই হাবুডুবুতে শম্ভুদা নজর করেনি আত্রেয়ী তার বাড়ির ঠিকানা, পরিবার পরিজন নিয়ে কোনও কথাই বলেনি কোনও দিন। কিন্তু প্রতিদিনই আত্রেয়ী হাত পেতে তার কাছ থেকে দুশো-পাঁচশো টাকা নিয়ে গেছে। এই রহস্যটা ভেঙেছিল দুর্গাপুজোর সময়। হঠাৎ কলেজস্কোয়ারের ঠাকুর দেখতে এসেছিল, ভিড়ের ভেতর একটু ছাড়াছাড়ি হয়েছে। শম্ভুদা সবিস্ময়ে লক্ষ্য করে, একটা ছেলে আত্রেয়ীর হাত ধরে টানাটানি করছে। শম্ভুদা কাছে এসে সজোরে এক থাপ্পড়। ছেলেটি ছিটকে পড়ে, আর সোরগোল ফেলে দেয়। এন্টালিতে থাকা শম্ভুদাকে কলেজস্কোয়ারের অনেকেই চেনে। তখনই ও জানতে পারে, আত্রেয়ী বউবাজারের হাড়কাটাগলির যৌনকর্মী। পাঁচ মিনিটেই সামলে নিয়েছিল এই সত্যতার ঝটকা।

তারপর সেই প্যান্ডেল থেকে সোজা লালবাজার। পরিচিত পুলিশ অফিসারকে সব ব্যাপারটা খুলে বলে। রাত্রেই পুলিশ রেইড ক’রে হাড়কাটাগলি থেকে এক মাসি সহ গোটা চারেক মাস্তানকে তুলে আনে। লালবাজারে আত্রেয়ীকে দেখিয়ে অফিসার বলেছিল, এ আমার বোন, এর দিকে আর কোনও দিন চোখ তুলে যদি তাকিয়েছিস তোরা, মার্ডার কেসে সোজা সবকটাকে যাবজ্জীবন ফাঁসিয়ে দেব। তারপর দিনই কোর্ট-ম্যারেজ। ওই অফিসার তার নিজের বোনের পরিচয়ে পরিচিত করিয়ে শম্ভুদার বাড়িতে আত্রেয়ীকে তুলে দিয়েছিল। তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে শম্ভুদার সুখী পরিবার এখন! শম্ভুদা সে গল্পও করে। শম্ভুদার এই সোজা-সাপটা খাদহীন ভালোবাসার কাহিনিকে আদর্শ মেনেছে উত্তম।

উত্তম, মানে উত্তমকুমার দাম এই মধ্য-চল্লিশেও মেদহীন ধনুকের ছিলার মতো শরীর রেখেছে। মাথায় কদমছাঁট চুল। শহর, শহরতলীর কোথায় কোন পাড়ায় ফুটবল টুর্নামেন্ট সেসব ওর এখন মুখস্থ। কলকাতার মাঠে কম যায়। জেলায় জেলায় খেলোয়াড় হিসেবে নিজের পরিচয়ের সুযোগে সোর্স কাজে লাগায়। যেভাবে পুলিনের কথায় আজ দুটো কুড়ির বনগাঁ লোকালে উঠে যাবে হাবরা। পুলিন হাবরা লিগ ম্যাচে রেফারিগিরিও করে। আজ সবুজ সংঘ ও প্রগতির ম্যাচ। সোর্স পুলিন টেলিফোনে প্রথমে নাটা দেবাশিসের কথা বলেছিল। অসাধারণ ট্যালেন্ট। বল পায়ে চুম্বকের মতো লেগে থাকে আর দারুণ প্রেডিক্ট করতে পারে। মাঠে নামলেই একটা না একটা গোল করবেই। উত্তম সরাসরি নাকচ করে দেয়। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির নীচের কোনও প্লেয়ার নিয়ে ও ভাববে না। ফুটবল বডি গেমও।

ক্রমে যত দিন যাচ্ছে, বিদেশিরা যত আসছে তত রাগবির মতো হতে চলেছে ফুটবল। শরীর কতটা ধকল নিতে পারবে তা কিছুটা উচ্চতা নির্ভরও। সোর্স পুলিন দু’নম্বরটির কথা জানায়। সবুজ সংঘের গোপাল। ভালো হাইট, আর ফুটবলারের চেয়ে বেশি ও দৌড়বীর। এমন চোঁ চোঁ দৌড় লাগায় এদিক ওদিক মনে হয় কিছু একটা যেন হতে চলেছে। অথচ বল হয়তো উলটো দিকে আছে। উত্তম সোর্সের এই তথ্যটাকেই আজকের প্রাইম হিসেবে ঠিক করেছে। চোখে মুখে কিছুটা উল্লাস। এরকমই খুঁজছিল। নাস্তানাবুদ করা স্প্রিন্টার। তারপর ফুটবল তো কোচের হাতে পড়লে কথা বলবে।

উত্তম যা ভেবেছিল তার চেয়ে বেশি। এ একদম ইউরেকা। ছেলেটা একটাও গোল করেনি। কিন্তু ওর টিম দু’গোলে জিতল। বিরতির পরপরই ছেলেটা মাঝমাঠ ক্রস করে হঠাৎ লেফ্ট উইং থেকে

চোঁ-চোঁ করে দৌড় লাগাল রাইট উইং-এর দিকে। দু’টো ডিফেন্ডার কেটে গেল। পেছন থেকে ওই নাটা ছেলেটা সম্ভবত উইথড্রয়াল স্টপার খেলছিল– গোল মেরে দিল মাখনে ছুরি দেবার মতো। ব্রিলিয়ান্ট! গোলটা হবার পরে উত্তম চ্যাঁচাল, তারপর পকেটে হাত দিল পেন আর কাগজ নেবে বলে। কী যেন নাম! হাত চালিয়ে বুক পকেটে পেন, ছোটো ডায়েরি খুঁজে না পেয়ে চোখ নামাল।

আরে আশ্চর্য! আমি তো পেন-টেন নিয়েই বেরিয়েছি। কী মনে করে পেছনের পকেটে হাত দিয়ে দেখে লেপাপোছা। অর্থাৎ জিনসের হিপ্পকেটে তখন কিছুই নেই। উত্তমের বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। সোর্স পুলিনের জন্য হাজার খানেক টাকা ছাড়াও যাতায়াতের খরচ ইত্যাদির জন্য আরও শ’পাঁচেক ছিল। এসবিআই ডেবিট কার্ড, জরুরি কাগজপত্র, কিছু তথ্য, নোট– এতক্ষণের আনন্দে এসময় ভাঁটার টান।

বনগাঁ লাইনের ভিড়। শিয়ালদা থেকেই বসার জায়গা পায়নি। ভেতরের দিকে দাঁড়িয়ে ছিল মনে পড়ছে। দমদম আসতে চারপাঁচজন তরুণী ভিড় ঠেলে ঢুকে পড়েছিল। সকলেই খুব উচ্ছ্বল। নিজেদের ভেতর নানারকম কথাবার্তা চালাচ্ছিল। টুকরো ইংরেজি, হিন্দি, বাংলা মিশিয়ে। মাই নেম ইজ খান থেকে ম্যানিকিউর সবই তাদের বিষয়। উত্তম এসময় খেলাপাগল। নারী নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই। ও মাঠের কথা ভাবতে ভাবতে চলেছে। ভিতরে একটা আর্জ। এবছর এই বড়ো তিনটি ক্লাবের জন্য অন্তত গোটা পাঁচ-ছয় সোনার ছেলে তুলে দিতে হবে। আনকোরা কিন্তু সলিড। বড়ো ক্লাবগুলিরও তাতে লাভ। দু’তিন বছর খুব কম পয়সায় এদেরকে কাজে লাগাতে পারে। হিসেবে অন্তত কোটি টাকার ফয়দা। উত্তমের মনে হচ্ছে আজ একটা হিল্লে হবে।

একটা মেয়ে ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। ভিড়ের ভেতর প্যাসেজেও ডাবল লাইন। মেয়েটির সমুন্নত বুক মাঝে মাঝেই ওর খোলা কনুই ঘষে দিচ্ছিল। উত্তম একবার তাকাতেই মেয়েটি মিষ্টি হাসে। দীর্ঘ সুশ্রী চেহারার। চুড়িদারে লোকাট ফ্রেম। উত্তাল বুকের অনেকটাই প্রকাশমান। ডান দিকের অপেক্ষাকৃত শ্যামাশ্রী মেয়েটি একটু চেপে দিলে ও আরও একটু বাঁয়ে এই সুন্দরীর দিকে ঘেঁষে আসে। এ মেয়েটি তেমন নড়ে না আর তার কোমল বুক সেঁটে উত্তমের গোটা বাহুতে লগ্ন হয়ে যায়। এবার মেয়েটির দেহ থেকে একটা সুগন্ধ টের পায় যা ওর চেনা চেনা লাগে। উত্তমের তখন কাঠকাঠ ভাব। হাত-পা নড়ানোর জায়গা রাখেনি সপ্রতিভ মেয়ে দুটো। জগন্নাথপম অবস্থা। এই স্থির অবস্থায় উত্তম অনুভব করে দুদিক থেকেই দু’টো মেয়ে বুক মেলে ওকে ঘঁষে চলেছে।  ও কোনও দিকে তাকাতে পারছে না। অসহায়ের মতো নিম্নগামী মুখমণ্ডল। উত্তম মাঠের ফুটবল, বল দখল, পজিশন মেকিং– এসবের ভেতর ভাবনা চারিয়ে দিয়ে রাস্তাটুকু পার করে দিতে চাইল।

এই মেয়েগুলিই কি ওকে এতখানি বিপদে ফেলল! এত সুন্দর সুন্দর কথা বলছিল মেয়েগুলো– তবে সেটা ট্র্যাপ! অন্তত ডেবিট কার্ড আর মোবাইল ফোনের জন্য থানায় কমপ্লেইন লজ করতেই হবে। পুলিনকে নিয়ে তাই ও হাবরা থানায় এসে বসেছে।

বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে হঠাৎ ওর মনে ঝিলিক দিল– বাঁদিকে যে-মেয়েটি বেশি লগ্ন ছিল, একটু বেশি বয়সের, সে কোনও কথা বলছিন না কেন! মেয়েটি হাসবার জন্য মুখ ঘোরাতেই ওর চোখ পড়েছিল কানের নীচের তিলটির ওপর। তখন মাঠের ভাবনায় মত্ত থাকায় ফোকাস্ড ছিল নতুন ছেলে রিক্রুটিং নিয়ে। চুলটা মাথার উপরে চুড়ো করে রেখেছিল সে। ফলে মুখটা একটু গোল লাগলেও ওই তিলটি তো ওর চেনা। ওই-ই কি করবী! বাবুঘাটে কতবার ওই তিলের উপরেই চুম্বন রেখেছে সে। না না, তা কী করে সম্ভব! করবী পকেটমারের গ্যাং করেছে! উত্তমের এই একলা একা জীবনের নেপথ্যে দাঁড়িয়ে থাকা একটি স্নিগ্ধ প্রতিমা প্রতীম করবী পকেটমার!

থানায় বসে শিউরে উঠল। গা সিরসির করতে লাগল। ওই নিষ্পাপ মুখমণ্ডলের মেয়েটি, যাকে একদিন এই জীবন তুলে দেবে ভেবেছিল, সোনারপুরের ওই গ্রাম্য মেয়ে করবী নিশ্চয়ই ওকে চিনেছে। এখনও সেরকম ছিমছাম চেহারা উত্তমের। শুধু দুটো জুলফির কাছের কিছু চুল পেকেছে। তবুও ও আমার পকেট কাটল! এখন নিশ্চিত হচ্ছে ওই যে চেনা চেনা লাগছিল গন্ধটা, তা করবীই ব্যবহার করত। ভিক্টোরিয়ার মাঠে সন্ধ্যায় অনেকবার করবীই উত্তমের ঝাঁকড়া মাথা ওর আধখোলা বুকে টেনে নিয়েছে। সুগঠিত স্তনের খাঁজে নাক গুঁজে গেছে। কিন্তু উত্তম কখনও শরীরে হাত দেয়নি। শুধু ওর বুকের ওই মিষ্টি গন্ধটা ও প্রাণ ভরে নিত। ও চেয়েছিল অপাপ করবীকে গৃহলক্ষ্মী করবে।

এসময় উত্তমের খুব শীতবোধ হতে থাকে। গা-হাত-পা ছেড়ে দেয়। থানার বেঞ্চে এলিয়ে পড়ে। পুলিন দাস ফুলস্কেপ সাদাকাগজ কিনে এনে মোবাইলে মিসিং কমপ্লেইন ডায়েরি লেখাতে লেখাতে পেছন ফিরে তাকিয়ে বুঝে যায় শরীর খারাপ হয়েছে উত্তমের। থানার গায়েই হাবরা হাসপাতাল। ধরাধরি করে সেখানে নিয়ে যায়। পুরোনো দিনের খেলোয়াড় পরিচয়ে খুব দ্রুত ডাক্তার অ্যাটেন্ড করে। সেরিব্রাল অ্যাটাক। ম্যাসিভ। ডাক্তার রেফার করে এনআরএস। অ্যাম্বুলেন্স দেয়। মুখে অক্সিজেন সিলিন্ডার। সোর্স পুলিন দাস, হাবরা হাসপাতালের একজন নার্স ও অচেতন উত্তম যশোর রোড ধরে চলেছে। এসময় উত্তম দেখে, সাদা পোশাকের এক মিষ্টি মেয়ে, মুখটা খুব চেনা চেনা, কোনও পরি হবে, তার কপালে আলতো করে দু’টো চুমু খেল। আর কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, আমি তোমাকে ভালোবাসি উত্তম। এই প্রথম উত্তম তার সারাজীবনের কাঙিক্ষত শব্দকটি শুনতে পেল। এবং এই প্রথম তার কান্না পেল। বোজা চোখের দুই কোল ঘেঁষে দুফোঁটা জল গড়িয়ে নামল সাদা চাদরে ঢাকা বালিশের উপর।

এনআরএস-এর এমার্জেন্সির ডাক্তার কয়েক মিনিট দেখেই বললেন, অনেকক্ষণ আগেই প্রাণ দেহ ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।

 

সেই দিনগুলি

মনটা ভালো নেই দীপ্তির। ফোনটা বেজে চলেছে, কিন্তু তুলতে ইচ্ছে করছে না। তুললেই কথা বলতে হবে। কিন্তু যে ফোন করছে সে নাছোড়বান্দা। ছাড়বার পাত্র নয়। অগত্যা দীপ্তিকে ফোনটা ধরতেই হল, ‘হ্যালো!’

‘হাই, কে দীপ্তি?’

‘হ্যাঁ।’

‘বাবা! কী ব্যাপার তোর? দেড় বছর তোর সঙ্গে কোনও কন্ট্যাক্ট নেই। চিনতে পারছিস তো? আমি সূচি।’

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, গলাটা তোর একই আছে। কিন্তু এতদিন কোথায় ছিলি?’

দীপ্তি সাধারণ ভাবেই প্রশ্নটা ছুড়ে দেয়, কিন্তু গলার স্বরে উৎসাহের অভাব লক্ষ্য করে সূচি।

‘কী হয়েছে রে তোর দীপ্তি? গলার স্বরটা কেমন যেন লাগছে। রাগ করিস না প্লিজ। আমারই দোষ, এতদিন তোকে কন্ট্যাক্ট করতে পারিনি। কিন্তু বিশ্বাস কর, প্রতিটা মুহূর্তে তোর কথা আমার মনে হয়েছে। তোর জন্যই মলয়ের সঙ্গে আমার বিয়েটা হওয়া সম্ভব হয়েছিল।’

‘এখন তুই কোথা থেকে বলছিস?’

‘সবে পরশু দেশে ফিরেছি। জানিস-ই তো মলয়ের সঙ্গে আয়ারল্যান্ড চলে গিয়েছিলাম। ওর ওখানে কোম্পানির সঙ্গে দেড় বছরের কন্ট্র্যাক্ট ছিল। আমিও ওখানে একটা চাকরি খুঁজে জয়েন করে নিয়েছিলাম। তবে এত সব দৌড়াদৌড়ির মধ্যে আমার মোবাইলটা শ্বশুরবাড়িতেই রয়ে গিয়েছিল। গতকাল শহরে পৌঁছেছি। আজ সকালে প্রথম তোকেই ফোন করলাম। এবার দেখবি একদিন তোর বাড়িতে উপস্থিত হয়েছি। এখন বল তো, তোর বাড়ির সকলে কেমন আছে? কাকু-কাকিমা, সৌরভদা আর উজ্জ্বল?’

এক নিশ্বাসে সবকিছু বলে দেবার পর সুচি খেয়াল করে দীপ্তি যেন মুখে তালা দিয়ে রেখেছে। ওর কোনওরকম প্রতিক্রিয়া সুচি বুঝতে পারে না।

ধৈর্য হারায় সূচি, ‘কীরে কী হল তোর? তখন থেকে আমি একাই বকবক করে যাচ্ছি। তুই তো কিছুই বলছিস না… কী হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?’ সূচির আওয়াজে ওর অধৈর্য ভাবটা স্পষ্ট ফুটে ওঠে।

‘সবকিছু বদলে গেছে রে সুচি এই দেড় বছরে… বাবা আর নেই, মা বিছানায় পড়ে, প্যারালিসিস। দাদা সারাদিন মদ খেয়ে পড়ে থাকে। মদের নেশা ওকে গ্রাস করছে। বউদি ছোট্ট পারিজাতকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে…’

‘আর উজ্জ্বল?’

‘উজ্জ্বল ঠিক আছে। এখন ক্লাস নাইনে পড়ছে। কিন্তু ভবিষ্যতে ওর-ও যে কী হবে এখনও জানি না। সুচি, বাড়িতে কিছুই ঠিক নেই… বলতে বলতে, দীপ্তির চোখের জল বাঁধ মানে না।

‘কাঁদিস না দীপ্তি… বি ব্রেভ… কলেজে সবথেকে সাহসী বলে পরিচিত, অন্যের যে-কোনওরকম সমস্যায় এগিয়ে এসে তার সমাধান বার করতে যে এক মুহূর্ত ভাবত না, সেই দীপ্তির কাছে নিজের সমস্যার কোনও সমাধান নেই, এমন কখনওই হতে পারে না… কাম অন ইয়ার। এই কথাটা আগে তুই সবাইকে বলতিস এখন আমি বলছি, সমস্যার সমাধান অবশ্যই আছে। চল, আমি পরের সপ্তাহে আসছি। একদম চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ ফোনটা কেটে গেল।

কলিংবেল-টা বেজে ওঠে। শাড়ির আঁচলে চোখের জলটা মুছে নিয়ে দীপ্তি সদর দরজাটা খুলে দেয়। রোজকার সেই চিরপরিচিত দৃশ্য। মদ এবং সুগন্ধির চেনা গন্ধটা এসে নাকে ঢুকল দীপ্তির। নেশার ঘোরে সৌরভ দরজায় ঠেসান দিয়ে কোনওমতে দাঁড়িয়ে। ওকে ঘিরে আরও চার-পাঁচজন বন্ধু যারা নিজেরাও কেউ সুস্থ নয়, কম-বেশি সকলেই নেশায় বুঁদ। দাদার হাত ধরে দীপ্তি ঘরের ভিতর নিয়ে আসার চেষ্টা করে। এই সুযোগে কেউ দীপ্তির হাত-টা ছুঁয়ে নেয়, কারও গরম নিঃশ্বাস এসে পড়ে দীপ্তির পিঠে। পেছন থেকে কেউ দীপ্তির কোমরটা জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে। এক ঝটকায় হাতটা সরিয়ে দীপ্তি দরজাটা বন্ধ করে দেয়। বোনের সম্মান রাখাটা দাদার কর্তব্য কিন্তু সেই দাদা নিজেই যেখানে বেহুঁশ সেখানে বন্ধুদের ও প্রতিরোধ করবে কী ভাবে? দীপ্তির চোখটা আবার জলে ভিজে আসে।

বাবার মৃত্যুর পর, ব্যাবসার সব দায়িত্ব, টাকাপয়সা সবকিছুই সৌরভের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। ব্যাংকের ভালো চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি ব্যাবসায় মন দেয় সৌরভ। ব্যাবসাও বাড়তে থাকে, সেই সঙ্গে টাকাও। কাঁচা টাকা হাতে আসতেই বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যাও বাড়তে থাকে, সৌরভের পা মাটিতে থাকে না। দামি গাড়ি, দামি শখ, বিদেশি মদ অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায় সৌরভের। মা জয়ন্তী স্বামীর মৃত্যুর পর মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েন। সৌরভের বিয়ে আগে থেকেই ঠিক হয়ে ছিল কিন্তু জয়ন্তীর মানসিক ও শারীরিক অবস্থার কারণে বিয়ে আটকে যায়। পাত্রীর বাবা রমানাথবাবু চিন্তিত হয়ে পড়েন। অনেক বুঝিয়ে জয়ন্তীকে সুস্থ করে তোলা হয়। রমানাথবাবু জয়ন্তীকে বলে তাড়াতাড়ি ছেলের বিয়ে দিয়ে দিতে অনুরোধ জানান যাতে বাড়ির পরিবেশ কিছুটা হলেও বদলায়। বিয়ে হলে ছেলেও বাড়িমুখো হবে এটাও ওনার বিয়ের জন্য তাড়া দেওয়ার আর একটা উদ্দেশ্য ছিল।

অনেক ভেবেচিন্তে বিয়ের দিন স্থির করা হল। কিন্তু বিয়ের দিন মদের নেশায় সৌরভ বিয়ের আয়োজন ঠিকমতো করা হয়নি বলে রমানাথবাবুর সঙ্গে গণ্ডগোল পাকিয়ে বসল।

ছেলের ব্যবহারে লজ্জিত জয়ন্তী, রমানাথবাবুর হাত ধরে ক্ষমা চাইতে গেলে, পাত্রী সঞ্চিতা উঠে এসে জয়ন্তীর হাত ধরে থামায়। সঞ্চিতা জয়ন্তীর অবস্থা দেখে নিজেই লজ্জিত বোধ করে। ছেলের জন্য মায়ের এই অপমান মেনে নিতে অসুবিধা হয় ওর। শান্তস্বরে জয়ন্তীকে বলে, ‘কাকীমা, এটা আপনি কী করছেন? এরকম ছেলের জন্য আপনি কেন ক্ষমা চাইছেন? সৌরভের স্ট্যাটাস আমাদের থেকে একটু বেশিই মনে হয় উঁচু হয়ে গিয়েছে। আমিই এই বিয়ে করতে অস্বীকার করছি।’

পরিস্থিতি সামলে শেষমেশ সঞ্চিতা, জয়ন্তীর বাড়িতে বউ হয়ে এল। কিন্তু সৌরভকে বদলাতে পারল না সঞ্চিতা। মেয়ে হয়ে যাওয়ার পরও সৌরভকে সঠিক রাস্তায় ফিরিয়ে আনার সব চেষ্টা বিফল হলে, বিয়ের তিন বছরের মাথায় সঞ্চিতা ছোট্ট পারিজাতকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেল।

এই ধাক্বা জয়ন্তী সহ্য করতে পারলেন না। সেরিব্রাল হয়ে পক্ষাঘাতে সম্পূর্ণ ভাবে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন।

সকালে সৌরভ অন্য মানুষ। মদের ঘোর কেটে গিয়ে হুঁশ ফিরে আসলে নিজের ব্যবহারের জন্য লজ্জিত হতো। মা, দীপ্তি, উজ্জ্বল সকলের কাছেই ক্ষমা চাইতে দ্বিধা করত না। কিন্তু হলে কী হবে? সন্ধে হলেই বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আকণ্ঠ গিলে পুরো মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরত।

মাঝেমধ্যে দীপ্তি সৌরভকে বোঝাবার চেষ্টা করত, ‘দাদা, তুই আর কারও কথা না ভাব, বউদি আর পারিজাতকে তো বাড়িতে নিয়ে আসতে পারিস। তাছাড়া উজ্জ্বল এখনও ছোটো আছে। কী অবস্থায় রাত্রে বাড়ি ফিরিস একবারও ভেবেছিস কি? আর তোর বন্ধুবান্ধবগুলোও বা কী? ওদের সঙ্গে মিশিস কেন?’

‘ওদের সম্পর্কে কিছু বলিস না। বাবার ব্যাবসাটা দাঁড় করাতে ওরাও আমাকে অনেক সাহায্য করেছে, নয়তো আমি ব্যাবসার কী-ই বা জানতাম। ওদের জন্যই এত তাড়াতাড়ি ব্যাবসার এতটা উন্নতি করতে পেরেছি।

আর ওরা সবাই ভালো বাড়ির ছেলে। কমবেশি সকলেই ড্রিংক করে। ওদের নিজেদের উপর যথেষ্ট কন্ট্রোল আছে। শুধু আমারই একটু বেহাল অবস্থা হয় ড্রিংক করলে। কেন, তোর মনে হয় না যে আমার বন্ধুরা তোকে ছোটো বোনের মতো ভালোবাসে?’

মনে মনে হাসে দীপ্তি। কাকে বলবে সত্যিটা কী? সৌরভের মদ্যপ বন্ধগুলোর চোখে লোভ, লালসা ছাড়া আর কিছু নজরে পড়েনি দীপ্তির। ওদের সামনে যেতে ভয়ে, ঘৃণায় দীপ্তির ভিতরটা কুঁকড়ে যায়। কিন্তু কাকে বলবে এই কথাগুলো? সৗরভ মানতে রাজিই নয় যে ওর বন্ধুরা দীপ্তিকে নিজেদের লালসার শিকার বানাতে পারে। দাদা নিজে সুস্থ থাকলে তবেই না বোনের কষ্টটা বুঝতে সক্ষম হবে। সুতরাং সকলের অলক্ষে চোখের জল ফেলা ছাড়া দীপ্তির উপায় কী?

সুচি কথামতো পরের সপ্তাহেই দীপ্তির বাড়ি এসে হাজির হল। সুচিকে দেখে দীপ্তির এতদিনকার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। ধীরে ধীরে সব ঘটনা সূচি দীপ্তির কাছ থেকে জেনে নিল। গলা জড়িয়ে দুই বন্ধু অনেকক্ষণ কাঁদল।

চোখের জল ফুরিয়ে এলে, সূচি সোজা হয়ে বসল। দীপ্তির মুখটা দুহাত দিয়ে ধরে সূচি বলল, ‘চোখের জল মুছে ফেল, দীপ্তি। এই সমস্যার কোনও না কোনও বিহিত নিশ্চয়ই আছে। হার স্বীকার কেন করবি? এবার একটু হাস তো।’

‘দীপ্তি, তোর মনে আছে মলয় কী প্রচণ্ড গুটখা খেত? ডাক্তারের বারণ সত্ত্বেও কিছুতেই নেশাটা ছাড়তে পারছিল না। প্রবলেমটা তোকে বলতেই তুই মজা করে যে সমাধানটা দিয়েছিলি সেটা যে কতটা কাজ দিয়েছিল সেটা কি কেউ ভাবতে পেরেছিল? ঘটনাটা ভাবলে এখনও আমার হাসি পায়।’

ঘটনাটা মনে আসতে দীপ্তির মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ওর কথামতো, সুচি একটা বিয়েবাড়িতে যাওয়ার সময় মলয়ের পকেট থেকে গুটখার প্যাকেটগুলো বার করে কনডোমের কয়েকটা প্যাকেট রেখে দিয়েছিল মলয়ের অজান্তে। বিয়েবাড়িতে গিয়ে গুটখা পকেট থেকে বার করতে গিয়ে সকলের সামনে কনডোমের প্যাকেট হাতে উঠে আসতে সকলের ঠাট্টার পাত্র হতে হয়েছিল মলয়কে। ব্যাস পকেটে গুটখা রাখার অভ্যাস ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল মলয়। শেষমেশ দীপ্তির পরামর্শে সুচি মলয়কে কিছুদিন নেশামুক্তি কেন্দ্রে নিয়ে গেলে মলয়ের গুটখার নেশা একেবারেই চলে যায়।

দীপ্তিকে হাসতে দেখে সুচির মুখও হাসিতে ভরে ওঠে।

চোখে-মুখে জল দিয়ে সুচি একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে নিজের ব্যাগ খুলে একটা ক্যামেরা বার করে দীপ্তির দিকে এগিয়ে দিল, ‘এই নে, এটা তোর জন্য, ভিডিও ক্যামেরা।’

‘বাবাঃ, এটা তো খুব দামি ক্যামেরা। এত দাম দিয়ে আমার জন্য এটা আনার কী দরকার ছিল?’ দীপ্তি কৃত্রিম রাগ দেখায়।

‘কী দরকার ছিল…?’ সুচি দীপ্তিকে ভেংচি কাটে। ‘ফালতু বকবক বন্ধ কর। ক্যামেরার ফাংশনগুলো দ্যাখ। দারুণ ভিডিও তোলা যায় ক্যামেরাটায়।’

ইতিমধ্যে উজ্জ্বলও স্কুল থেকে এসে পড়ে। সুচি আর সঙ্গে ভিডিও ক্যামেরা দেখে ও আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠে, ‘সুচিদি এটা বিদেশ থেকে এনেছ? কি দারুণ ক্যামেরাটা। আমি এটা দিয়ে ছবি তুলব।’

‘বাবাঃ! উজ্জ্বল, তুই কত লম্বা হয়ে গিয়েছিস। বেশ একটা বড়োবড়ো ভাব চলে এসেছে।’

‘দিদি, আমি চেঞ্জ করে আসছি। এসে আমি তোমাদের কথাবার্তা সব ভিডিও করব,’ বলে উজ্জ্বল বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

‘দীপ্তি, আমি ভাবছি এটা দিয়ে তোর সমস্যারও একটা সমাধান করা যাবে।’

দীপ্তি অবাক চোখে তাকায় সুচির দিকে, ‘কীভাবে সেটা সম্ভব?’

‘রাত্রে যখন সৌরভদা বাড়ি ফিরবে তখন লুকিয়ে আড়াল থেকে দাদা এবং দাদার বন্ধুদের কীর্তি সব শ্যুট করতে হবে। সকালে পুরো ভিডিওটা সৌরভদার সামনে টিভির পর্দায় চালিয়ে দিলেই দাদা বুঝতে পারবে ওর বন্ধুরা কীরকম এক-একটা রত্ন,’ সুচি মনের মধ্যে থাকা সমাধানটা দীপ্তির কাছে স্পষ্ট করে।

উজ্জ্বল আর সুচি সৗরভের বাড়ি ফেরার আগেই ক্যামেরা নিয়ে রেডি হয়ে যায়। সুচি বরের থেকে তিনদিনের ছুটি নিয়েই দীপ্তির বাড়ি এসেছিল। বিয়ের আগেও বহুবার দুই বন্ধু একে অপরের বাড়ি রাত কাটিয়েছে। কখনও কখনও সপ্তাহ কেটে গেলেও নিজের বাড়ি ফেরার ইচ্ছে হতো না। দু’জনের বাড়িতেই এটা নিয়ে বাদবিবাদ কখনও হয়নি কারণ সকলেই জানত দু’জনে হরিহরাত্মা। মলয়ও তাই সুচির ইচ্ছায় বাদ সাধেনি।

রাত এগারোটার কাছাকাছি ডোরবেল বেজে উঠতেই সুচি আর উজ্জ্বল, দীপ্তিকে ইশারা করে দরজাটা খুলতে। ওরা দুজন পর্দার পেছনে জায়গা করে নেয় যেখান থেকে সদর দরজাটা পরিষ্কার দেখা যায়। সুচি হাতের ক্যামেরাটার রেকর্ডিং অন করে দেয়।

দরজা খুলতেই সৗরভকে ধরে ওর এক বন্ধু দীপ্তির দিকে এগিয়ে আসে, ‘এই নাও, তোমার ভাইকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেলাম।’ আর একটি ছেলে দরজা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করে, ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখী… আমাদেরও একটু এভাবে ধরে ঘরে নিয়ে যেতে পারো তো সোনা।’ ছিটকে সরে আসে দীপ্তি। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে সুচির হাতটা নিশপিশ করতে থাকে।

অন্য আরও তিনবন্ধু দরজা ঠেলে সৌরভের সঙ্গে ভিতরে ঢুকে পড়ে। তারই মধ্যে একজন দীপ্তিকে জোর করে জড়িয়ে ধরে। সৌরভের কোনওদিকে খেয়াল নেই। নেশায় বুঁদ অবস্থায় সোফার উপরেই এলিয়ে পড়ে। বোনের প্রতি বন্ধুদের অভব্য ব্যবহার কিছুই চোখে পড়ে না ওর।

দীপ্তি উজ্জ্বলকে ডাকে। সবাই ঘরে ঢুকে পড়াতে ও ভয় পেয়ে যায়। উজ্জ্বল লেবুর জল নিয়ে ঘরে ঢুকে সৗরভের দিকে গেলাসটা বাড়িয়ে দেয়।

‘লেবুর জল আমাদেরও একটু দাও উজ্জ্বলবাবু। তোমার দিদিকে দেখে আমাদের নেশা আরও চেপে বসছে। আমরাও তোমার দিদিকে বড়ো ভালোবাসি…,’ বলতে বলতে একটি ছেলে দীপ্তির হাত ধরে টেনে কোলে বসাতে যায়।

‘আমার দিদির হাত ছাড়ুন,’ উজ্জ্বলের তীক্ষ্ন কণ্ঠস্বরে ছেলেটি দীপ্তির হাত ছেড়ে দিয়ে উজ্জ্বলকে জোরে ধাক্বা মেরে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে।

সুচি আর চুপ থাকতে পারে না। একবার ভাবে পুলিশ ডাকবে কিন্তু তাহলে সৌরভদাকেও পুলিশ ছাড়বে না… দীপ্তি কীভাবে এগুলো রোজ সহ্য করে। পরক্ষণেই মন ঠিক করে নেয়। ভয় ঝেড়ে ফেলে ক্যামেরাটা নামিয়ে টেবিলের উপর রেখে বসবার ঘরে ঢোকে। ক্যামেরাতে প্রুফ রেকর্ড করাই আছে সুতরাং লোকগুলোকে বাড়ির বাইরে বার করতেই হবে। কঠিন গলায় সুচি চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কী হচ্ছে এখানে? আপনাদের লজ্জা করে না? সৌরভের বন্ধু হয়ে ছোটো বোনের সঙ্গে এরকম ব্যবহার করছেন। কাকিমা বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না, উজ্জ্বল এখনও ছোটো, স্কুলে পড়ে আর সৌরভদা বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে… আর আপনারা এই সুযোগে বাড়ির ভিতর ঢুকে এসে যাচ্ছেতাই আচরণ করছেন। এই মুহূর্তে আপনারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান, নয়তো আমি এখুনি পুলিশ ডাকব,’ সুচি মোবাইল উঠিয়ে ডায়াল করতে আরম্ভ করে।

সুচির রণচণ্ডী মূর্তি দেখে আর পুলিশের হাতে পড়ার ভয়ে, সৌরভ ছাড়া সকলে উঠে পড়ে দরজার দিকে পা বাড়ায়। দরজা দিয়ে বেরোতেই উজ্জ্বল দৌড়ে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। সুচিকে ধন্যবাদ জানিয়ে দীপ্তি আর উজ্জ্বল সৌরভকে শোবার ঘর অবধি নিয়ে যেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

সকালে একটু দেরি করেই ঘুম ভাঙল সৌরভের। মাথাটাও ভারী ভারী ঠেকছে। গতকাল রাতে মাত্রাটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুগুলো না থাকলে কী যে হতো কে জানে? মনে হল ওদের একবার ফোন করে ধন্যবাদ জানানো দরকার। মুখে চোখে জল দিয়ে ঘরে ঢুকতে যাবে, চোখে পড়ল খাবার টেবিলে বসে দীপ্তি সুচির সঙ্গে গল্প করছে।

‘আরে সুচি না, তুই কখন এলি? হঠাৎ কোথায় চলে গিয়েছিলি? কোনও খবর নেই এতদিন পর? মানসকে পেয়ে আমাদেরই ভুলে গিয়েছিলি?’ মস্তিষ্কে জোর দিয়ে সৌরভ সুচির বরের নামটা মনে করার চেষ্টা করে।

‘দাদা, মানস নয়, মলয়। মলয়ের সঙ্গে দেড় বছরের জন্য বিদেশ চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখানে এসে দেখছি সবকিছুই কেমন বদলে গেছে। তুমি এখানে থেকেও না থাকারই সমান… নিজের লোকেদেরই তুমি ভুলে গেছ…,’ সুচি গলার দৃঢ়তা বজায় রাখে। জানে যেমন করেই হোক সৌরভের বিবেককে জাগাতে হবে।

‘সুচি তুই কী বলতে চাইছিস?’ সৌরভ সুচির পাশের চেয়ারটা টেনে ওর মুখোমুখি হয়।

‘তোমাদের বাড়ির পরিবেশ খুব বদলে গেছে। …কাকু বেঁচে নেই। কাকিমা বিছানায় পড়ে। বউদি, পারিজাতকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে আর তুমি…?

‘হ্যাঁ, তুই ঠিকই বলেছিস সুচি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু এভাবেই বদলে যায়…’ সৌরভ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, ‘তুই একটু বস সুচি আমি ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে আসছি।’

দীপ্তি চা তৈরি করে ডাইনিং টেবিলে এনে রাখল। ইতিমধ্যে সুচি ডাইনিং হলে রাখা টিভি-টার সঙ্গে ভিডিও ক্যামেরাটা অ্যাটাচ্ করে রেখেছিল। সৗরভ এসে চেয়ার টেনে চায়ে চুমুক মারতেই সুচি সামনে এসে দাঁড়াল, ‘দাদা, টিভির রিমোট-টা ধরো। টিভিটা অন করো, ভিডিও ক্যামেরায় একটা ভালো ভিডিও বানিয়েছি। ক্যামেরাটা বিদেশ থেকে দীপ্তির জন্য এনেছি… তুমি ভিডিও-টা দেখে বলো আমি কেমন বানাতে পেরেছি শর্ট ফিল্ম-টা। আমি ততক্ষণ দীপ্তিকে রান্নাঘরে একটু হেল্প করে দিই,’ বলে সুচি দীপ্তির সঙ্গে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

সৗরভ চায়ের কাপটা টেনে নিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে টিভি-টা অন করে দিল। চোখ টিভির পর্দার দিকে। নড়েচড়ে বসল সৗরভ। ভাবতে পারেনি পর্দায় ওরই ছবি ফুটে উঠবে। টিভির পর্দায় নিজের অবস্থা, নিজেরই ড্রইংরুমে বন্ধুদের হাতে দীপ্তি আর উজ্জ্বলের হেনস্থা দেখে লজ্জায়, রাগে সৗরভের মুখ লাল হয়ে উঠতে লাগল। যে বন্ধুদের ও অগাধ বিশ্বাস করেছে, যাদের বিরুদ্ধে একটা কথাও শুনতে চায়নি দীপ্তির মুখ থেকে, তারা যে এত বড়ো বিশ্বাসঘাতক হতে পারে নিজের চোখে না দেখলে, ও কি এটা কোনওদিন বিশ্বাস করত? নিজের দুঃখ, লজ্জা ঢাকবার জন্য সৗরভ দু’হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে নেয়। নিজের ওপরেই ঘৃণা বোধ করে সৗরভ।

সুচি এসে দাঁড়ায় টেবিলের পাশে। টিভি বন্ধ করে দেয় টেবিল থেকে রিমোটটা নিয়ে। ভিডিও-টা শেষ হয়ে গিয়েছিল।

‘সরি… দাদা’, বলে সৌরভের মুখ থেকে হাতটা সরিয়ে দেয় সুচি। ‘দীপ্তি আর কাকিমার বারণ সত্ত্বেও তুমি বন্ধুদের অগাধ বিশ্বাস করে এসেছ। কোনওদিন ওদের আসল চেহারাটা জানারও চেষ্টা করোনি। এর জন্য দীপ্তিকে কী কী সহ্য করতে হয়েছে নিজের চোখেই দেখলে। বাধ্য হয়ে আমাকে এটা করতে হয়েছে… আমি এর জন্য সত্যিই দুঃখিত।’

‘তুই কেন ক্ষমা চাইছিস? দোষ তো আমি করেছি। এত বড়ো অন্যায় করেছি। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে তুই ভালো কাজই করেছিস। আমার জন্য দীপ্তিকে অসম্মানিত হতে হয়েছে, উজ্জ্বলের উপরেও না জানি এই সব ঘটনার কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে কে জানে? মদের নেশায় আমি এতটাই নীচে নেমে গেছি যে বাড়ির লোকদের ছেড়ে আমি বাইরের লোককে বিশ্বাস করেছি। ওদের বোঝানোতেই সঞ্চিতাকেও বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে আমিই প্ররোচিত করেছি। ছোট্ট পরি-কে নিয়ে চলে যেতে ও বাধ্য হয়েছে। রোজ ভাবি মদ ছোঁব না কিন্তু সন্ধে হলে কী যে হয়… জানি না… আমার কী ভবিষ্যৎ?’

‘দাদা, এতটাও ভেঙে পোড়ো না,’ সুচি বোঝাবার চেষ্টা করে, ‘তুমি মনে জোর আনলে অবশ্যই মদ ছাড়তে পারবে… যাবে আমার সঙ্গে দাদা?’

‘কোথায়?’

‘দাদা আজকেই চলো আমার সঙ্গে যেখানে গুটখার নেশা ছাড়াবার জন্য মলয়কেও নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের বাড়ির কাছেই নেশা ছাড়াবার রিহ্যাব। যাবে তো দাদা?’

সৗরভ সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। দীিঀ৫ এসে পিছনে দাঁড়িয়েছিল সৗরভ বুঝতে পারেনি। আনন্দে দীপ্তি পিছন থেকেই দাদার গলা জড়িয়ে ধরে। চোখ দিয়ে বইতে থাকে আনন্দাশ্রু। সৌরভ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দীপ্তিকে বুকে টেনে নেয়। ভাই-বোনের ভালোবাসা দেখে সুচির চোখেও জল চলে আসে।

সুচির দু’বছরের বিবাহবার্ষিকীর দিন দীপ্তি সকাল থেকেই উপস্থিত। দুই বন্ধুর কথার যেন কোনও শেষ নেই। মলয় দু’জনকে কিছুটা প্রাইভেসি ছেড়ে দিতে বাইরের ছোটোখাটো কাজগুলো সারতে বেরিয়েছে। অনুষ্ঠান তো সেই সন্ধেবেলা। ক্যাটারার বলাই আছে সুতরাং বাড়িতে রান্নার কোনও ঝামেলা নেই।

‘হ্যাঁরে দীপ্তি, সৗরভদা তো এখন সম্পূর্ণ সুস্থ তাই না,’ একা পেয়ে সুচি প্রশ্নটা ছুড়ে দেয় বন্ধুর দিকে, ‘বউদিকে কবে বাড়ি নিয়ে আসছিস? তাড়াতাড়ি করে বউদিকে বাড়ি আন তবেই না আমি আমার বউদিকে বাড়ি নিয়ে আসতে পারব।’

‘মানে? কী যে বকিস, কোনও মাথামুন্ডু থাকে না।’

‘সেই! এখন আমার কথা তোর ফালতুই মনে হবে,’ কপট রাগ দেখায় সুচি, ‘তুই তো জানিস না দীপ্তি, আমার জ্যেঠুর ছেলে সিদ্ধার্থ দিল্লিতে চাকরি করে। ও আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে আর তোকেও।’

‘আমাকে?’ আশ্চর্য হয় দীপ্তি।

‘হ্যাঁ, কলেজে ছিলাম যখন তখন দু’তিনবার ও কলেজে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। তখনই ও তোকে আমার সঙ্গে দেখেছে। তাছাড়া তোর অনেক গল্পই আমি ওর সঙ্গে করেছি যার মধ্যে মলয়ের গুটখার নেশা ছাড়াবার ঘটনাটাও রয়েছে। বিকেলে সিদ্ধার্থ-ও আসছে।’

লজ্জায় দীপ্তির মুখ রাঙা হয়ে ওঠে। সুচির কাছে মনের ভাব লুকোবার জন্য উঠে অন্যত্র যাওয়ার চেষ্টা করলে, সুচি দীপ্তিকে বুকে জড়িয়ে ধরে।

উচ্ছিষ্ট

বর্ধমানে পৌঁছে রমেনের বাড়ি খুঁজে পেতে সীমার বিশেষ অসুবিধা হল না। গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দরজার দিকে পা বাড়াল ও। বাইরে থেকে ওকে ধীরস্থির, শান্ত মনে হলেও ভিতরে ভিতরে ওর মন অধীর হয়ে উঠছিল।

দরজা খুলে যে-মহিলা এগিয়ে এলেন, তাকে কোনওমতে একটা নমস্কার জানিয়ে সীমা জিজ্ঞেস করল, ‘রমেন কি বাড়িতে আছে?’

‘আপনি সীমা না?’ ভদ্রমহিলার মুখ-চোখ দেখে মনে হচ্ছিল সীমা যেন ওনার বহু দিনের পরিচিত।

‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনি আমাকে চিনলেন কী করে?’

‘একবার উনি, মানে রমেন অফিসের কোনও ফাংশনের ছবি আমাকে দেখিয়েছিলেন, তাই মনে থেকে গেছে। চলুন ভিতরে চলুন।’ সীমার হাত ধরে মহিলা ওকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেল।

‘আমি কে, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। আমি রমেনের স্ত্রী…।’

‘বন্দনা, তাই না?’ সীমা ওর কথার মাঝেই বলে উঠল, ‘আমিও আপনাকে চিনি। রমেনের ফ্ল্যাটে যে-ফ্যামিলি ফোটোগ্রাফটা লাগানো আছে, সেটাতে আপনাকে দেখেছি। ছবিটা এতবার দেখেছি যে মনের মধ্যে গেঁথে গেছে।’

সীমার কথায় কোনও প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বন্দনা খুব সহজ ভাবে জিজ্ঞেস করল, ‘ওনার অসুস্থতার সম্পর্কে কী করে জানতে পারলেন?’

‘রমেন অফিসে আমার সিনিয়র। ওনার সঙ্গে ফোনে রোজ আমাকে কন্ট্যাক্ট রাখতে হয়। এখন ওনার শরীর কেমন আছে?’ সীমার উত্তরে কোনওরকম আড়ষ্টতা ছিল না।

‘আপনার এই প্রশ্নের উত্তর উনি নিজেই দেবেন। আমি ওনাকে ডেকে দিচ্ছি। আপনাকে কী দেব, চা না কফি? ঠান্ডাও খেতে পারেন।’

‘না-না। কফি হলেই চলবে।’

‘আপনি আমার সম্মানীয় অতিথি। ওনার অফিসের কারও সঙ্গে আমার কোনওদিন পরিচয় হওয়ার সুযোগ হয়নি, আপনিই প্রথম। সুতরাং অতিথি আপ্যায়নে আমি কোনও ত্রুটি রাখতে চাই না। আপনি বসুন, আমি ওনাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি’, বলে বন্দনা হাসিমুখে ভিতরে চলে গেল।

সীমা এবার নিজের চারপাশে চোখ বুলোবার সুযোগ পেল। পরিপাটি ভাবে সজ্জিত ড্রয়িংরুম। চারপাশ গোছানো পরিষ্কার ঝকঝক করছে। ঘরের ডেকরেশনে গৃহিণীর সুরুচির ছাপ সর্বত্র।

বন্দনার ব্যক্তিত্বেরও তারিফ না করে পারল না সীমা। গায়ের রং শ্যামলা হলেও, যথেষ্ট সুন্দরী বলা চলে। দুই সন্তানের মা হয়ে যাওয়াতে চেহারাটা সামান্য ভারী হয়ে গেলেও, আকর্ষণ বিন্দুমাত্র কমেনি।

সীমা জানত, বন্দনার শিক্ষগত যোগ্যতা ক্লাস টেন পর্যন্ত। ও ধারণা করে নিয়েছিল স্বল্পশিক্ষিত অন্যান্য মহিলাদের মতোই বন্দনাও হয়তো ক্লান্ত শরীর নিয়ে সংসার সামলে গেঁয়োভূত হয়ে উঠেছে। অথচ সকাল সকাল বন্দনাকে যথেষ্ট আধুনিক সাজসজ্জায় এবং আত্মবিশ্বাসে ভরপুর দেখে সীমার মনে অনেক প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করল।

একটু পরেই রমেন এসে ঘরে ঢুকল। সীমাকে দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠল তার। সীমার কাছে সরে এসে বলল, ‘তোমাকে আমার বাড়িতে দেখতে পাব কোনওদিন ভাবিনি। কালকে ফোনে কথা হল, বললে না কেন আজ এখানে আসবে তুমি?’

‘আমি বললে, তুমি আমাকে আসতে দিতে? কপট রাগ দেখিয়ে সীমা রমেনের হাতের উপর নিজের হাত রাখে।’

‘হয়তো না।’

‘সেই জন্যেই তো আগে থেকে তোমাকে কিছু জানাইনি, জাস্ট চলে এসেছি। এখন তোমার শরীর কেমন আছে?

‘গত দু’দিন জ্বরটা আর আসেনি, তবে অসম্ভব দুর্বল বোধ করছি।’

‘দেখতেও খুব দুর্বল লাগছে। আরও কদিন বরং ছুটি নিয়ে বিশ্রাম করো।’

‘না-না, আর নয়। সাতদিন হয়ে গেল কামাই করেছি, পরশু সোমবার জয়েন করব ঠিক করেছি। তোমার থেকেও দূরে আর থাকতে পারছি না।’

‘একটু আস্তে বলো’, রমেনের ঠোঁটে হাত রাখে সীমা, ‘তোমার বউ শুনতে পাবে। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’

‘করো।’

‘আচ্ছা, বন্দনা কি আমাদের সম্পর্কের কথাটা জানে?’

‘জানে হয়তো তবে নিজের মুখে কখনও জিজ্ঞেস করেনি।’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে অবহেলার ভঙ্গিতে বলে রমেন।

‘আমার সঙ্গে তো খুবই ভালো ব্যবহার করল। মনে তো হল না, আমার উপর ওর কোনও রাগ বা বিদ্বেষ আছে বলে। কী জানি হয়তো…’, চুপ করে গেল সীমা।

‘সীমা, তুমি আমার কলিগ এবং পরিচিত, আর সেই জন্যই ও তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে না এবং করার সাহাসও ওর নেই। তুমি এখানে আমার বাড়িতে পুরো সেফ। বন্দনাকে নিয়ে কোনওরকম টেনশন করার দরকার নেই’, সীমার গালে আলতো করে একটা টোকা মেরে রমেন সামনের সোফাতে গিয়ে বসল।

অফিসের কাজকর্ম সম্পর্কে কথাবার্তা হতে হতে বন্দনা ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল। কফি আর জলখাবারের ডিশ ট্রে থেকে তুলে টেবিলে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হল।

‘আপনিও আমাদের সঙ্গে বসে কফি খান’, সীমা বন্দনাকে ওদের সঙ্গে বসতে অনুরোধ জানাল কিন্তু বন্দনা সামান্য হেসে রান্নাঘরে কাজ আছে বলে ঘরের বাইরে চলে গেল।

কথা বলতে বলতে সীমা একপ্রকার বন্দনার কথা ভুলেই গেল। ভালোবাসার মানুষটাকে এতদিন পর সামনে পেয়ে সীমার মনের অপরাধবোধটাও এক মুহূর্তে মন থেকে মুছে গেল। বন্দনাও খালি কাপ প্লেটগুলো একবার এসে তুলে নিয়ে গেল কিন্তু তারপর ওই ঘরে ও আর পা মাড়াল না।

বছরখানেক আগে নতুন অফিসে জয়েন করার পর রমেনের সঙ্গে সীমার প্রথম পরিচয় হয়। রমেনের চেহারা এবং ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে সীমা নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে না। রমেন বিবাহিত জেনেও শরীর মন রমেনের কাছে সমর্পণ করে। সীমার এই সম্পর্কের কথা ওর মা-বাবার কানেও পৌঁছোয়। ওর বাবাই একদিন ওকে আলাদা করে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, ‘রমেনের সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা ঠিক কীরকম একটু জানতে পারি?’

‘বাবা আমার এখন ৩৫ বছর বয়স। রমেনকে আমি ভালোবাসি। ঠিক সময়ে তোমরা যখন আমার বিয়ে দিতে পারোনি তখন আমার চিন্তা করা ছেড়ে দাও। তোমরা যদি রমেনের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ দেওয়ার জন্য জোর করতে থাকো, আমি বাইরে কোথাও নিজের থাকার ব্যবস্থা করে নেব।’ সীমার পরিষ্কার জবাবের পর ওর মা-বাবাও বিষয়টি নিয়ে মেয়ের সঙ্গে আলোচনা করাই ছেড়ে দেন।

বহুদিন অবিবাহিত থাকার পর সীমাও ঠিক করে নিয়েছিল ও আর বিয়ে করবে না। কিন্তু একা জীবন অতিবাহিত করা অতটাও সহজ নয়। এদিকে রমেনও নিজের পরিবারের থেকে দূরে একলা শহরে থাকতে থাকতে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করতে থাকে। ফলে উভয়ের প্রথম পরিচয় হতেই একে অপরের প্রতি আকর্ষিত হয়ে পড়ে।

রমেনের প্রতি তীব্র আকর্ষণ সীমার নীরস জীবনটাকেই পুরো বদলে দেয়। প্রেমটা অবৈধ জেনেও অজানা এক আকর্ষণে সীমা বাঁধা পড়তে থাকে। ধীরে ধীরে সীমার মনে আরও কিছু পাওয়ার স্বপ্ন জোরালো হতে শুরু করে।

একদিন অফিস শেষে দুজনে রমেনের ফ্ল্যাটে চলে আসে। সীমাকে চুপচাপ দেখে রমেনই জানতে চায়, ‘কী ব্যাপার, আজ এত চুপচাপ কেন?’

‘রমেন আমি তোমার সঙ্গে লিভ ইন করতেও রাজি আছি, যদি তুমি সেটাই চাও। কিন্তু বিয়ে করে জীবন কাটাবার আলাদা একটা আনন্দ যেমন আছে তেমনি সম্পর্কটাতে একটা সম্মানও আছে।’

‘তুমি রাজি থাকলে আজই আমি তোমাকে বিয়ে করে নিতে চাই’, সামান্য কৗতুকমিশ্রিত কণ্ঠে রমেন উত্তর দেয়। সীমা একটু গম্ভীর হয়, ‘এটা করা মানে তো নিজেকেই ঠকানো।’

‘তাহলে বিয়ের কথা তুলছ কেন?’

‘আমার মনের ইচ্ছা তোমার কাছে বলব না তো কাকে বলব?’ সীমা রমেনকে বোঝাবার চেষ্টা করে।

রমেনও একটু সিরিয়াস হয়, ‘সবই তো বুঝলাম কিন্তু আমাদের বিয়ে করাটা সম্ভব নয়, সেটাও তো তুমি ভালো করেই জানো।’

‘তুমি সত্যিই আমাকে মন থেকে ভালোবাসো তো?’ সন্দেহ উঁকিঝুঁকি দেয় সীমার মনে।

‘অবশ্যই’, সীমার মন থেকে সন্দেহ দূর করতে রমেন সীমার ঠোঁটে  চুম্বন এঁকে দেয়।

‘তুমিই সবসময় বলো, বন্দনা তোমার স্ত্রী হলেও, আমাকেই তুমি মন থেকে চাও। এটা তো সত্যি, তাই না?’

‘হ্যাঁ। বন্দনা আমার দুই সন্তানের মা। ও খুব সরল মনের মেয়ে কিন্তু নিজের স্ত্রী-র মধ্যে যে-ধরনের ব্যক্তিত্ব আমি দেখতে চাই, বন্দনার মধ্যে সেটার অভাব রয়েছে। মা-বাবার পছন্দ মতন আমার বিয়ে করা কখনওই উচিত হয়নি। কিন্তু বন্দনার দেখাশোনা করাটা এখন আমার একটা কর্তব্য ছাড়া আর কিছুই নয়’। মনের কথা খুলে বলতে পেরে রমেন অনেকটা সহজবোধ করে। অনেকদিন ধরেই সীমা চাইছিল ও যেন বন্দনাকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়।

‘কিন্তু তাহলে আমার কী হবে? আমাদের খুশির জন্যেও তুমি বন্দনা-কে ডিভোর্স দেবে না?’ আহত বাঘিনির মতো সীমা রমেনের মুখোমুখি হয়।

‘না, দেব না। এই কথা নিয়ে তুমি এরপর আর কোনওদিন আমাকে প্রেশার দিও না। বন্দনা আমাকে ছেড়ে যেতে চাইলে আলাদা কথা, কিন্তু ওকে ডিভোর্সের প্রস্তাব দেওয়া মানে আমি নিজের চোখে নিজেই ছোটো হয়ে যাব। কারণ ও আমাকে ছাড়া আর কিছুই জানে না। ওর পৃথিবীটা আমাকে ঘিরেই ও তো তোমার মতো সাবলম্বি নয়। বিনা দোষে ওকে আমি এই শাস্তি কিছুতেই দিতে পারব না। সেটা অন্যায় হবে’।

রমেনের কঠোর স্পষ্ট উত্তর দেওয়ার ভঙ্গিতে সীমা আর কথা বাড়াবার সাহস পেল না। কিন্তু মনে মনে সীমা সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিল, বন্দনার সঙ্গে তাকে একবার দেখা করতেই হবে। কারণটা অবশ্য সীমারও ঠিকমতো জানা ছিল না কিন্তু যাকে সে চোখে দেখেনি তার চরিত্র এবং ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানার এক অদম্য কৗতহূল সীমাকে সেদিন গ্রাস করেছিল। হয়তো মনে মনে সীমা চেয়েছিল বন্দনা নিজে থেকেই রমেনকে ছেড়ে চলে যাক এবং এই ইচ্ছাটাকে কার্যকরী করার লক্ষ্যেই রাস্তা খুঁজে বার করতে সীমা, রমেনের খোঁজ নেওয়ার বাহানা করে ওদের বর্ধমানের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল।

বন্দনা-কে দেখে সীমারও মনে হল ও খুব সরল, শান্ত স্বভাবের মেয়ে। সীমার প্রতি কোনও রাগ বা বিদ্বেষ বন্দনার ব্যবহারে প্রকাশ না পাওয়ার ফলে, সীমাও মনে মনে ওর প্রতি বিরূপ মনোভাব কিছুতেই পোষণ করতে পারল না। বরং মেয়েটা-র প্রতি একটা মায়া অনুভব করল সীমা।

রমেনকে সীমা ভালোবাসে ঠিকই কিন্তু নিজের স্ত্রী-র সঙ্গে ওর ব্যবহার কেমন যেন অদ্ভুত মনে হল সীমার। সীমার জায়গায় অন্য কেউ হলে এই অদ্ভুত ব্যবহারের জন্য শুধুমাত্র রমেনকেই দোষারোপ করত, এটা সীমাও অস্বীকার করতে পারল না।

নিজের বাড়িতে রমেন খোলাখুলি ভাবেই সীমার সঙ্গে গল্পে মেতে উঠল। ওর ব্যবহারে কোনও আড়ষ্টতা প্রকাশ পেল না। বন্দনা বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও রমেন সীমার হাতটা নিয়ে নিজের হাতে চেপে ধরে ওর সঙ্গে গল্পে মেতে উঠল।

বন্দনা হঠাৎ যদি এই অবস্থায় ওদের দেখে ফেলে, এই ভয় বোধহয় সীমারই খালি ছিল, রমেনের নয় কারণ রমেনের ব্যবহারে সেটাই বারবর প্রকট হয়ে উঠছিল। গল্পের মাঝে হঠাৎই রমেন, সীমাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে ওর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরতেই সীমা ঘাবড়ে গেল!

‘কী করছ রমেন? বন্দনা যদি এই অবস্থায় আমাদের দেখে ফেলে তাহলে অ্যাটলিস্ট আমি খুব লজ্জা পাব’, সীমাকে সত্যিই খুব নার্ভাস মনে হচ্ছিল।

‘রিল্যাক্স, সীমা’, রমেনকে খুব স্বাভাবিক মনে হল। ওকে এই ব্যাপারটা নিয়ে এতটুকু চিন্তা করতে সীমা দেখল না। ‘আমি তোমাকে মন থেকে ভালোবাসি সীমা। তুমি ভেবো না যে তোমাকে মাধ্যম করে আমি আমার কামনা-বাসনা মেটাচ্ছি। তোমার কাছ থেকে এতদিন যা পেয়েছি, বন্দনার কাছ থেকে সেটা কোনও দিন পাইনি, সেই আনন্দ একমাত্র তুমিই আমাকে দিয়েছ সীমা।’

‘কিন্তু তাও… এখানে, বন্দনার উপস্থিতিতে… ওর বাড়িতে আমাকে আদর করছ– এটা আমার কাছে অত্যন্ত অস্বস্তিকর। রমেন… প্লিজ ছারো’, আকুতি জানায় সীমা।

‘ঠিক আছে, আমি হাত সরিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু একটা ব্যাপার তুমিও খেয়াল রেখো…।’

‘কী ব্যাপার রমেন?’

‘বন্দনাকে ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। ও যদি কোনওদিন আমাকে প্রেশার দেওয়ার চেষ্টা করে তাহলে আমি ওকে ছেড়ে তোমাকে বেছে নেব’। রমেনের কথার মধ্যেই ওর মনোভাব স্পষ্ট ভাবে সীমার কাছে ধরা দেয় যেটা সীমা অ্যাপ্রিশিয়েট করে ঠিকই কিন্তু মনের একটা কোণায় অস্বস্তির অনুভূতি সীমাকে মানসিক ভাবে চঞ্চল করে তোলে।

হঠাৎ-ই সীমার মনে হয় বন্দনার সঙ্গে কথা বলাটা খুব দরকার। বন্দনার ব্যক্তিত্ব, ওর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো জানার অদম্য ইচ্ছা সীমাকে পেয়ে বসে। বন্দনার সঙ্গে কথা না বলা পর্যন্ত রমেনকে ওর থেকে দূর করার কোনও রাস্তা সীমার খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।

বন্দনাও আর একবারের জন্যেও বসার ঘরে ওদের সামনে আসেনি। রমেন-ই বলল রান্নাঘরে দুপুরের খাবার বানাতে ও ব্যস্ত রয়েছে। অথচ সীমার কেন জানি না মনে হল, বন্দনা ইচ্ছে করেই ওদের থেকে নিজের দূরত্ব বজায় রাখছে। ব্যস্ততার ব্যাপারটা শুধু একটা বাহানা মাত্র।

বন্দনা ওদের সঙ্গে একসঙ্গে খেতেও বসল না। সীমা ওকে অনেক জোর করল একসঙ্গে খাওয়ার জন্য কিন্তু ও কিছুতেই খেল না।

‘বন্দনা সব সময় আমার খাওয়া শেষ হলে তবেই খেতে বসে। তুমি শুরু করো, ও পরে খেয়ে নেবে’, বন্দনার তোয়াক্বা না করেই রমেন সীমার প্লেটে খাবার তুলে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

সীমা খেয়াল করল, প্রত্যেকটা খাবার রমেনের পছন্দের বানিয়েছে বন্দনা এবং প্রত্যেকটি পদই অত্যন্ত সুস্বাদু।

‘রান্না কেমন হয়েছে সীমা?’ বন্দনার উপস্থিতিতেই রমেন সীমাকে প্রশ্ন করল।

‘দারুণ হয়েছে’, সীমার উত্তরে পরিষ্কার বোঝা গেল খাবার খেয়ে সীমা অত্যন্ত তৃপ্ত।

‘বন্দনা সত্যিই দারুণ রান্না করে। সেইজন্যই তো ওজন কিছুতেই কম করতে পারছি না।’

সীমা খেয়াল করল, রমেনের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে বন্দনার মুখ রাঙা হয়ে উঠল। ওর দু’চোখে রমেনের জন্য অন্ধ ভালোবাসা ঝরে পড়ার সাক্ষী হয়ে থাকল সীমা।

বন্দনা যে রমেনকে প্রচন্ড ভালোবাসে এবং হয়তো রমেনকে ডিভোর্স দিতে ও কখনও রাজি হবে না, এই ভয়টা হঠাৎ-ই সীমাকে কেন জানি পেয়ে বসল। তার মন অশান্ত হয়ে উঠল।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রমেন এসে ড্রয়িংরুমের ডিভানে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। খানিকক্ষণ পরেই ওর নাক ডাকার শব্দে সীমা মনে মনে না হেসে পারল না। কিছুক্ষণ অপলকে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে সীমা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ওর গন্তব্য রান্নাঘর।

বন্দনা-কে দুটো প্লেটে খাবার বাড়তে দেখে সীমা কৗতূহল চাপতে পারল না, ‘আপনি ছাড়াও আরও কেউ খাবার খেতে বাকি আছে নাকি?’

‘হ্যাঁ, এই অন্য প্লেট-টা আমার বান্ধবী রুনার’, বন্দনা জানলা দিয়ে পাশের বাড়ির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল, ‘ও পাশেই থাকে।’

‘আপনার বান্ধবী এখানে এসে খাবে না?’ আশ্চর্য হয়ে সীমা জিজ্ঞেস করল।

‘না, আমার বড়ো ছেলে বাবলু প্লেট-টা ওর বাড়ি দিয়ে আসবে।’

‘আপনার দুই ছেলেকে তো দেখলাম না, ওরা বুঝি বাড়িতে নেই?’ সীমা প্রশ্ন করে।

‘ছোটোটার জ্বর হয়েছে, ঘরে শুয়ে আছে। বাবলু-কে আমি ডাকছি। সকাল থেকে ও রুনার বাড়িতেই রয়েছে, একবারও বাড়ি আসেনি।’

পিছনের দরজা খুলে বন্দনা ছেলের নাম ধরে ডাকতেই, বাবলু ছুট্টে রুনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল।

মায়ের আদেশ মতো সীমাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। খুব সাবধানে বন্দনা, রুনার জন্য বাড়া থালাটা বাবলুর হাতে ধরাতেই, ও সঙ্গে সঙ্গে আবার রুনার বাড়ির দিকে পা বাড়াল।

‘আপনার ছেলেটি তো খুব মিষ্টি এবং খুবই কাজের’, সীমাকে

প্রশংসা করতেই হল।

‘রুনা-ও ওকে প্রচণ্ড ভালোবাসে… মায়ের মতো। বাবলুই লাভবান, কারণ দু’জন মায়ের ভালোবাসা একসঙ্গে পাচ্ছে ও’, শান্তস্বরে সীমার চোখের দিকে তাকিয়ে বন্দনা কথাগুলো বলল।

খাবার ঘরের পাশেই, বারান্দায় তিন-চারটে চেয়ার পাতা ছিল, বন্দনা প্লেট নিয়ে ওখানেই বসল। সীমাকেও ইশারায় পাশে বসতে অনুরোধ করল। একটা নিঃস্তব্ধতা ওদের ঘিরে ধরল, কারও মুখেই কথা নেই। সীমাই প্রথম নিঃস্তব্ধতা ভঙ্গ করল।

‘রুনার বুঝি কোনও সন্তান নেই?’

‘ও-তো বিয়েই করেনি… আপনার মতোই বিয়ে করবে না বলে মনস্থির করেছে। প্রত্যেকটি মেয়েরই মনে মমতা ভরা থাকে এবং স্বাভাবিক ভাবেই মাতৃহূদয়ও থাকে। রুনা তো বাবলুকেই নিজের ছেলে মনে করে, ওর প্রতি রুনার ভালোবাসার অন্ত নেই’, হাসিমুখে জানায় বন্দনা।

কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে সীমা। কী বলবে ভেবে পায় না। মনে মনে কিছুট সাহস সঞ্চয় করার চেষ্টা করে। হঠাৎ-ই নিঃস্তব্ধতা ভঙ্গ করে ও, ‘সত্যিই আমিও ভেবেছিলাম কোনওদিন আর বিয়ে করব না কিন্তু এখন আমি এমন মানুষকে খুঁজে পেয়েছি যার সঙ্গে আমি সারাটা জীবন কাটাতে চাই। এই ব্যাপারে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই।’

বন্দনার কানে সীমার কথাগুলো ঢুকেছে কিনা সীমা ঠিক বুঝতে পারে না কারণ বন্দনার পরের কথাগুলো ঠিক সীমাকে কেন্দ্র করে নয় বরং বাবলু আর রুনার সম্পর্কটা নিয়ে। আনমনা হয়েই বন্দনা বলতে থাকে, ‘রুনা-কে কতবার বলেছি একটা বিয়ে করতে কিন্তু ও কিছুতেই কথা শুনতে চায় না। সবসময় বলে, বিয়ে না করেই বাবলুর মতন একটা মিষ্টি ছেলেকে যখন সন্তান হিসেবে পেয়েছি, তখন মিছিমিছি একটা অজানা লোককে বিয়ে করে নিজের স্বাধীনতা কেন নষ্ট করব। আমার বাবলু যে ওর বার্ধক্যের অবলম্বন হতে চলেছে এই বিশ্বাস ওর মনে একেবারে গেঁথে গেছে।’

‘বন্দনা, রমেনের সঙ্গে এক বছরেরও বেশি আমার পরিচয়। ওর সঙ্গে দেখা হওয়ার পরেই আমার জীবনে খুশি ফিরে এসেছে, নয়তো এই একাকীত্ব আমায় আত্মহত্যাপ্রবণ করে তুলত। সীমা বন্দনার বলা কথাগুলোকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই যেন বলতে থাকে।

‘রুনার জীবনে আমার বাবলুই খুশির আলো নিয়ে এসেছে। রোজই প্রায় রুনা ওর জন্য গিফ্ট নিয়ে আসে।’

সীমাও নাছোড়বান্দা। ও গলার স্বর সামান্য বাড়িয়ে বলে, ‘রমেন আর আমার সম্পর্কটা বন্ধুত্ব দিয়ে শুরু হয়েছিল ঠিকই কিন্তু এখন অনেক গভীরে পৌঁছে গেছে এই সম্পর্ক। এখন আমরা একে অপরকে ভালোবাসি’। যেন কিছুটা অগ্রাহ্য করার ভঙ্গিতেই।

বন্দনা উদাস হয়ে যায়। দূর দিগন্তে নিজের দৃষ্টি প্রসারিত করে বলে, ‘জানেন, আমার ছেলের মন জেতার জন্য রুনা ওকে প্রচুর লোভ দেখায়। প্রচুর টাকা খরচ করে প্রায়শই রেস্তোরাঁর খাবার নিয়ে আসে বাবলুর জন্য। ছেলেটার বাইরের খাবারে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে যে বাড়ির খাবার এখন আর ওর মুখে রোচে না।’

‘বাবলুর কথা ছেড়ে রমেন সম্পর্কে কেন আপনি আমার সঙ্গে কথা বলছেন না?’ সীমা বিরক্ত হয়ে ওঠে।

আশ্চর্য, বন্দনা সীমার ব্যবহারে এতটুকু বিচলিত হয় না বরং সীমার কাঁধে হাত রাখে যেন সীমা ওর খুব ভরসার পাত্রী, ‘রুনা একদম রান্না করতে পারে না। ওর রান্নাঘর খালিই পড়ে থাকে। অথচ বাবলু যদি ওর নিজের ছেলে হতো তাহলে কি ও এই দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারত? নিজের হাতে নিজের ছেলেকে রান্না করে খাওয়ানো-টা কি তখন ওর বোঝা মনে হতো?’

‘নিজের সন্তানের ইচ্ছে পূরণ করাটা কোনও মায়ের কাছেই বোঝা হতে পারে না।’

‘যাকে আমরা ভালোবাসি, তার খুশির জন্য কিছু করা কখনওই বোঝা হতে পারে না। রুনা-তো প্রায় রোজই আমাকে প্রেশার দিতে থাকে যে ও বাবলুকে অ্যাডপ্ট করতে চায়।’

‘এই বিষয়ে আপনার কি মতামত, বন্দনা?’ বন্দনা মুখে সামান্য হাসি টেনে এনে বলতে লাগল, ‘প্রসবযন্ত্রণা সহ্য না করেই কি কেউ যথার্থ অর্থে মা হতে পারে। সংসার সামলানোর ঝক্বি থেকে শুরু করে যে-কোনও পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়ার শক্তি, নিজে কষ্ট সহ্য করে সন্তানের সুখ-সুবিধার খেয়াল রাখার ইচ্ছে একমাত্র মায়েরই থাকে –কোনও মাসিপিসি বা জেঠি, কাকিমার থাকে না এত কষ্ট করার ইচ্ছে।’

‘হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। আমিও এখন নিজের একটা সংসার পাতার…’

বন্দনা সীমা-কে কথার মাঝেই থামিয়ে দিয়ে কিছুটা গম্ভীর হয়ে যায়। বলে, ‘আমার বাবলুকে রুনা যতই ভালোবাসুক, বাবলু কিন্তু আমার সন্তানই থাকবে… বিশ্ব-সংসার ওকে আমার ছেলে বলেই জানবে। রুনার, বাবলুর পিছনে এত টাকা খরচ করা, বাবলুর ওর বাড়িতে এত যাতায়াত করা ইত্যাদি কিন্তু একটা ‘সত্যি’ কখনও বদলাতে পারবে না যে, বাবলু আমার সন্তান। একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করতে পারি?’

‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই’, সীমা নিজেও একটু গম্ভীর হয়ে যায় কারণ প্রথমবার ওর মনে হয় বন্দনা, বাবলু আর রুনার সম্পর্কটার ব্যাপারে ওর কাছে কিছু জানতে চাইবে।

‘আমি যদি কোনও উপায় না পেয়ে আমার বাবলুকে রুনার হাতে তুলে দিই, তাহলেও কি সত্যি সত্যি রুনা ওর মা হয়ে যাবে? সন্তানকে জন্ম দেওয়ার আনন্দ ও কি করে বুঝবে? আমাকে কাঁদিয়ে ও কি জীবনে সুখী হতে পারবে?’ বন্দনার দুই চোখ হঠাৎই জলে ভরে ওঠে।

সীমা একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে, ‘আপনাকে কষ্ট না দিয়ে কি রুনা আপনার বাবলুকে পেতে পারবে আর আপনার বান্ধবী হিসেবে রুনার বাবলুকে দত্তক নেওয়ার ইচ্ছে মন থেকে ত্যাগ করা উচিত। আমারও এখানে আসাটা উচিত হয়নি। আপনার ব্যক্তিত্বর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর আমার মন আরও অশান্ত হয়ে উঠেছে।’

বন্দনা সীমার হাত নিজের হাতে তুলে নেয়। ভারী গলায় বলে, ‘সীমা, আপনি আমার ছোটো বোনের মতো তাই নিজের মনের কথা আপনার কাছে খুলে বলছি। আমার কাছে আমার সন্তান, স্বামী এবং

সংসার ছাড়া ভালোবাসার আর কেউ নেই। রমেনকে ছাড়ার কল্পনা করাটাও আমার কাছে অসহনীয়।

আমি জানি আমার থেকে আপনাকে বেশি চায় রমেন। এটা আমার জন্য ঠিক নয়। রমেনের সুখ-সুবিধা সবকিছুর খেয়াল অথচ আমিই রাখি। ও নিজের ছেলেদের প্রাণের থেকে বেশি ভালোবাসে। ওদের জন্যই বাড়ির সঙ্গে ওর যোগাযোগ রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। আর এই সত্যিটা আমার মনকে গভীর নিরাপত্তা এবং একইসঙ্গে গভীর আনন্দও দেয়।’

‘আপনাকে দেখে যতটা সরল এবং সাদাসিধে মনে হয় আপনি মোটেও ততটা নন। আপনার সঙ্গে এক মিনিটও আর থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়’, হঠাৎই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সীমা।

বন্দনা নির্লিপ্ত ভাবে জবাব দেয়, ‘আপনি যদি আমার মনের ভিতরে ঢুকতে পারতেন তাহলে আমার উপর রেগে না গিয়ে আমাকে সহানুভূতি দেখাতেন। আমার উপর দয়া হতো। স্বামীকে ভালোবেসেও, ভালোবাসা না পাওয়ার দুঃখ, হাজার চেষ্টা করেও আমি ভুলতে পারি না।

রমেন আর বাবলুর মধ্যে একটা মিল খেয়াল করেছেন কি? নিজেদের চাহিদা পূরণ করার জন্য আমার স্বামী আপনার সঙ্গে আর ছেলে রুনার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে নিয়েছে। কিন্তু এই বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করার জন্য কেউ ইচ্ছে প্রকাশ কখনও করেনি।

দোকানের খাবার বাবলুর স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ জেনেও ছেলের খুশির জন্য আমি চুপ করে থাকি। রমেনের আপনাকে ভালো লাগে, এই নিয়ে আমিও কোনওদিন রমেনের কাছে নালিশ জানাতে যাব না। আমার মৃত্যু খালি পারবে ওদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিন্ন করতে।

যে-কোনও পরিস্থিতিতেই আমি রমেনের সঙ্গে ভালো ভাবে মনে আনন্দ বজায় রেখে থাকতে পারব কিন্তু রুনা বা আপনি এই সম্পর্কটা-কে টিকিয়ে রেখে কী আদৗ লাভবান হতে পারবেন? ওর সন্তান বা আপনার যদি একজন সঙ্গীর প্রয়োজন তাহলে আপনারা নতুন করে কেন শুরু করছেন না? অপরের উচ্ছিষ্ট যতই সুস্বাদু হোক না কেন, সেটা খাওয়ার কী খুব দরকার আছে?’

নিরুত্তর সীমা দাঁড়িয়ে বন্দনার অশ্রুসজল মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। ঠিক এই মুহূর্তে তার মনে হতে থাকে বন্দনার ওই ব্যক্তিত্বের জোরের কাছে, তার সমস্ত আধুনিকতা, বেপরোয়া ভাব, সবই কেমন যেন ফিকে হয়ে গেছে। বন্দনা একটা বিশেষ তারে ঘা দিয়েছে, যা তার মাথার কোশগুলোকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সত্যি কি সে কোনওদিন সম্পূর্ণ ভাবে পাবে রমেনকে? উত্তরটা এই মুহূর্তে তার মতো করে কেউ জানে না। সীমা দরজার দিকে পা বাড়ায়। রমেন তখনও নিশ্চিন্তে সোফায় ঘুমোচ্ছে দেখে, ওকে না জাগিয়েই সীমা নিজের পার্সটা সোফা থেকে তুলে দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে।

মনে মনে, রমেনের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্তটা আরও দৃঢ় হতে থাকে সীমার মধ্যে।

দেশভক্ত

স্কুল থেকে এসে ব্যাগটা খাটে ছুড়ে দিয়ে এনসিসি-র ড্রেসটা খুলতে থাকে উপল। মা পেছন থেকে এসে বলে, ওই ঘেমো জামাকাপড়গুলো বিছানায় তুলবি না, যত রাজ্যের নোংরা লেগে আছে।

উপল ঘেমো শরীরেই মাকে জড়িয়ে ধরে, জানে মা এতে আরও বেশি রেগে যায়। মা-র এই রাগটুকু উপল উপভোগ করে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে নিলেই মা খুশি। গরিবের সংসারে পঞ্চব্যাঞ্জন না হোক, শাকপাতা দিয়ে মা যা রান্না করে, তাই উপলের অমৃত লাগে।

দেরি না করে কলপাড়ে হুড়োহুড়ি করে স্নানটা সেরে নেয় উপল। দুষ্টুমি করে চাতালে বসে থাকা কাকটাকে ভিজিয়ে দেয়। কা কা করে উড়ে কাকটা প্রতিবাদ করে যায়।

মা রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে উপলের সুন্দর, সুঠাম চেহারা দেখে! ছেলেটা দেখতে দেখতে বড়ো হয়ে গেল। শরীরচর্চায় খুব উত্সাহ, পুলিশ বা মিলিটারিতে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। সবসময় বলে, দেশের জন্য কিছু করর, লড়াইয়ে ময়দানে সামনের সারিতে থাকব। ছেলের এরকম ইচ্ছেতে মায়ের মন সায় দেয় না। তবে বড়ো হচ্ছে, ওর মতকেও তো গুরুত্ব দিতে হবে।

গত বছর, পাড়ার ক্লাবের পাশের ঝিলে একটা ছেলে ডুবে যাচ্ছে শুনে, এক ডাকে বেরিয়ে গেছিল, গিয়ে দ্যাখে আশেপাশের লোকেরা ঘিরে মজা দেখছে, কারুর নামার সাহস হচ্ছে না। উপল এক লাফে জলে নেমে, খাবি খেতে খেতেও ওকে উদ্ধার করে এনেছিল।

স্কুলের শারীরশিক্ষার শিক্ষক দীপেনবাবু উপলকে বিশেষ স্নেহ করেন। উপলের সততা, সুন্দর ব্যবহার আর টিম স্পিরিট সকলের নজর কাড়ে। বিবেকানন্দ মিশন স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র উপল, স্যারদের ডান হাত। কোনও কাজেই পিছপা হয় না। কারও বিপদ শুনলে ওইটুকু ছেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

চন্দনা ওদের ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল। উপল যা যা পারে, চন্দনা তা পারে না বলে উপলের ওপর ওর বাড়তি আগ্রহ। উপলের বোন আইরিন একই স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ে। দাদা যে সকলের প্রিয়, এতে ওর প্রচ্ছন্ন গর্ব আছে। চন্দনা ক্লাসের অন্য ছেলেদের কাছে ঘেঁষতে দেয় না। কিন্তু উপল কিছু বলুক, একবার বললেই করে দেবে।

মাধ্যমিকে উপল টায়-টায় ফার্স্ট ডিভিশন পেল, চন্দনার সবেতেই লেটার মার্কস। আরও ভালো স্কুলে একাদশে ভর্তি হতে পারত। বেচারি, উপলের জন্য একই স্কুলে রয়ে গেল।

কৈশোর অতিক্রম করে উপলের ব্যাপারে চন্দনার আগ্রহ এখন নিখাদ ভালোবাসায় পরিণত হয়েে। কীসে উপলের ভালো হয়, পড়াশোনায় ওকে কতটা সাহায্য করা যায় এসবই চন্দনার ধ্যানজ্ঞান। উপল স্কুলের ফুটবল, ক্রিকেট দলের সদস্য, পাড়ার ক্লাবে জিমও করে, লক্ষ্য এখনও পর‌্যন্ত স্থির। চন্দনা চায় উপল পড়াশোনা করে শিক্ষকতা বা ব্যাংক-এ চাকরি করুক। তবু উপলের পছন্দের উপর প্রভাব খাটাতে পারে না। যাহোক দুটো বছর একসঙ্গে পড়াশোনা করবে, চন্দনার কাছে এই-ই অনেক।

চন্দনা বিজ্ঞান নিয়েে, উপল কমার্স। টিউশনির ব্যস্ততা চন্দনার অনেক বেশি, তাও নিয়ম করে উপলের খোঁজ নেয়। বাংলা, ইংরেজি তো ওদের দুজনেরই আছে। যত প্রশ্নোত্তর চন্দনা তৈরি করে, নোটস সব উপলকে দেয়। মনের আশা, ওগুলো পড়ে যদি উপল একটু ভালো রেজাল্ট করে।

এদিকে পাড়ায় ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প হোক কিংবা কোথাও রিলিফ দেওয়ার ব্যাপার সবার আগে হাজির উপল। মা মনে মনে ভাবে, তাদের মতো ছাপোষা সংসারে ছেলেটা যেন কেমন অন্যরকম। সারাদিনের খাটাখাটনির পর, ক্লান্ত শরীরে উপলের বাবার আর কিছু ভাবার ক্ষমতা থাকে না। এভাবেই দিন গড়িয়ে চলে।

উপলদের পাড়ায় এক বৃদ্ধ দম্পতি আছেন, উপল তাঁদের দাদু-ঠাকুমা বলে ডাকে। কদিন আগে ঠাকুমা পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারেন না। কে তুলবে? কে নিয়ে যাবে? উপল হাজির ঠাকুমার সেবায়। প্লাস্টার করিয়ে আনা, রোজকার নিত্যকর্মে সাহায্য করা, এমনকী রান্না করে খাওয়ানো অবধি, উপল একাই করেছে।

মা-র মনে মনে শংকা হয়, এত উদার, এত ভালো ছেলে। কোনও স্বার্থপরতা ওকে স্পর্শ করেনি। যেন দেবতা, মানুষ নয়!

ঠাকুমা তো সুস্থ হয়ে সে কথা জনে জনে বলেন, আমার নিজের ছেলে-বউ,

নাতি-নাতনিরা খোঁজ নিল না। এই প্রাণটুকু কে বাঁচালে? ওই তো উপল।

দেখতে দেখতে দুবছর অতিক্রান্ত হল উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা সামনে। চন্দনার অভিভাবকরা চান ও ডাক্তারি পড়ুক, তাই এসময় তার চাপটা একটু বেশি। উপল যথা পূর্বং তথা পরং। সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে ওর পড়াশোনা।

পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর পর দেখা গেল, উপল টেনেটুনে ফার্স্ট ডিভিশন আর চন্দনা সবেতে লেটার পেয়েছে। উপল জানে চন্দনা ডাক্তারিতেও চান্স পাবে। ওর দিক থেকে চন্দনাকে দখল করে রাখার কোনও চেষ্টা নেই। সময় গড়িয়ে যা হবার হবে, আগে ওর লক্ষ্যপূরণ।

দেশের-দশের কাজ করার সুযোগ আছে, এমন একটা চাকরি পাওয়া খুব জরুরি। পুলিশ, মিলিটারি দুইয়েই প্র‌্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা খুব কঠিন হয়, উপল জানে। শরীরকে তৈরি রাখতে হয়, কতজন দৌড়ানোর ট্র‌্যাকে অজ্ঞান হয়ে যায়। তবে, স্নাতক হয়ে পরীক্ষাগুলো দেবে, তাহলে সুযোগও বাড়বে।

চন্দনা এখন কলকাতা মেডিকেল কলেজের স্টুডেন্ট, মাঝে মাঝে উপল ওকে কলেজেও পেঁছে দেয়। চন্দনার বাবা-মা-ও উপলকে মেনে নিয়েেন, ওর সততা, সুন্দর ব্যবহারের জন্য। উপলের মায়ের অবশ্য আশংকা, অমন মেধাবী মেয়ে তার সাধারণ ছেলেকে শেষ অবধি বিয়ে করবে তো? মায়ের চিন্তা ছেলে যেন কোনও ভাবে দুঃখ না পায়। তবে সাদাসিধে চন্দনাকে ভালোও লাগে। মেযোর সরলতা সবাইকে মুগ্ধ করে। সবচেয়ে বড়ো কথা, এই পরিবারের ওপর ওর টান, যেন এটা ওর নিজেরই পরিবার।

উপল সিটি কলেজে যায়, কলেজ টিমের হয়ে ইন্টারকলেজ কম্পিটিশনে খেলে।

লং-জাম্প-এ ডিস্ট্রিক্ট চ্যাম্পিয়ন। কলেজ মিটে কলকাতা কমিশনিয়ারেট-এর কর্তাব্যক্তিরা উপলের শারীরিক সক্ষমতার প্রশংসা করে, ওকে চাকরির প্রস্তাবও দেয়।

উপল মেঘ না চাইতে জল পায়, খুশি হয়ে আইরিনের জন্য ফ্রক আর বাড়ির জন্য মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢোকে। মা মিষ্টি হাতে নিয়ে চোখের জলে ভাসেন। খুশি হবেন নাকি দুঃখ পাবেন, বুঝে উঠতে পারেন না। আইরিন নতুন ফ্রক পেয়ে তিড়িংবিড়িং করে লাফাতে থাকে। মায়ের পীড়াপীড়িতে চন্দনাকে কলেজ ফেরত আসতে বলে, একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করে সেলিব্রেট করবে বলে।

 

পার্ট-টু পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোতে উপল কলকাতা পুলিশের ট্র‌্যাফিক গার্ডে সার্জেন্ট হিসেবে জয়ে করে। নিয়মমাফিক সব শারীরিক পরীক্ষা উপলকেও দিতে হয়। চন্দনা অবশ্য তেমন খুশি নয়। তারা যখন ঘরে আরাম করবে, উপলকে তখন রোদে গরমে ডিউটি করতে হবে। মনে মনে ভাবে আরও পড়তে পারত। মুখে কিছু বলে না। ওর আনন্দের সঙ্গে তার নিজের আনন্দকে মিলিয়ে নিতে হবে, এতেই তার সুখ।

চাকরিসূত্রে উপলকে কলকাতা চষে বেড়াতে হয়। শুধু ইন্টার অফিস মিট থাকলে খেলার জন্য ছাড় পায়। কখনও গার্ডেনরিচ তো কখনও বেহালার রাস্তায় ট্র‌্যাফিক সামলাতে দেখা যায় তাকে। বেনিয়ম করে গাড়ি দাঁড় করানো, কি ঘুস নেওয়া, এসবে দেখা যায় না উপলকে। চাকরি জগতেও তার বিরল স্বভাবের নিদর্শন চলতে থাকে। চন্দনা এমবিবিএস ফাইনাল দেবে এ বছর, হাজার ব্যস্ততাতেও উপলের খবর রাখে। ওর ক্ষমতায় যতটুকু কুলায় পরামর্শ দেয়।

সেদিন হেদুয়ার সামনে ডিউটি করছিল উপল। উলটো দিকে বেথুন থেকে কলেজ ফেরত মেযো বেরোচ্ছিল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তিন রোমিও ওদের দিকে বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি করছিল। উপলের ব্যাপারটা নজরে আসে। ডিউটির পোশাকে সরাসরি মারধর তো করতে পারে না। গিয়ে ধমক দিয়ে এলাকা ছাড়া করেছিল ছেলেগুলোকে। তখনকার মতো চলে গেলেও,ওরা উপলকে পরে দেখে নেবে বলে শাসিয়ে ছিল।

উপলের কষ্ট হয় এই ভেবে, যে আইরিনও তো দুদিন পরেই কলেজ যাতায়াত করবে আর এইসব ইভটিজারদের খপ্পরে পড়বে। এরা মেয়েের নূ্যনতম সম্মানটুকু করে না, এরা কি আমাদের দেশের পরম্পরা, ঐতিহ্য জানে? কোন ধাতু দিয়ে গড়া, নরকের কীট সব!

চন্দনাকে ফোনে ওইদিনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করায়, ওর ভয় দ্বিগুন হল। এমনিতেই উপলকে নিয়ে সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকে। উপল চন্দনার মধ্যে ওর মায়ের ছায়া দ্যাখে। সকলের স্বাভাবিক চলাফেরা নিশ্চিন্ত করার জন্য, পুলিশের যে বিশেষ ভূমিকা আছে, ওকথা অস্বীকার করার উপায় নেই। চোখের সামনে অপরাধ দেখে যে চুপ করে বসে থাকা যায় না, তা চন্দনাকে বোঝাতে পেরেছিল।

উপল জোর করে বাবাকে ভিআরএস নেওয়া করিয়েছে। সংসারের পুরো দাযিত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েে। আইরিনকে অনেক দূর পড়ানোর স্বপ্ন দ্যাখে। পরদিন পুলিশ মিট উপলক্ষ্যে ধানবাদ যেতে হবে। আজকে নাইট ডিউটি কলেজ স্ট্রিটে। পরদিন রাতে ধানবাদ যাওয়ার ট্রেন। বিকেলে চন্দনার সঙ্গে দেখা করে নিতে হবে। দু-তিন দিনের জন্য বাইরে গেলে এটা উপলের আবশ্যিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।

চন্দনাকে বাড়িতেই ডেকে নিল উপল। চন্দনার এ বাড়িতে যাতায়াত এখন স্বাভাবিক ব্যাপার। চন্দনা এল। একটা গোলাপি রঙের সালোয়ার কামিজ পরেছে। আজ কেন যেন উপলের দুচোখ ভরে চন্দনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। চন্দনা অবাক হয় উপলের এই আবেগ দেখে।

মায়ের বানানো লুচি তরকারি দিয়ে দুজনে বিকেলের জলখাবার সারে। দুজনেই হাক্লান্ত, ক্ষিদেও পেয়েছিল বেশ। খেয়ে নিযে উপলের চুলের গোছা নেড়ে দিয়ে চন্দনা বেরোল। বারবার পেছন ফিরে দেখছিল। বেরোনর আগে, ধানবাদ পৌঁছে খবর দেওয়ার কথা বলেছিল। চন্দনা চলে যেতে, আইরিনকে কটা অঙ্ক বুঝিয়ে রাতের ডিউটিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিল উপল।

 

মা আজ পাড়ায় কীর্তন শুনতে যাবেন। তাও ছেলের কাচা পোশাক, সবকিছু গুছিয়ে দিলেন। কী মনে হতে উপল ঢিপ করে মাকে একটা প্রণাম করে নিল। সংসার চালানোয় মায়ের নিপুণতা উপলকে মুগ্ধ করে। চন্দনাকে ঘিরেও স্বপ্নের বীজ বোনে। বড়ো শ্রীমযী চন্দনা, অফুরন্ত ভালোবাসা দেয় তাকে।

আজ ডিউটিতে উপল ছাড়াও আরও দুজন সার্জেন্ট আছে। রাতের রাস্তা আস্তে আস্তে ফাঁকা হচ্ছে, ভারী গাড়ির আনাগোনা এসময় বেশি। দুজন সঙ্গী কাছের দোকানে চা খেতে গেল। উপল সতর্ক চোখে তাকিয়ে আছে। হঠাত্, ওকি!

বাইকের পেছনে একজন তরুণী, চালাচ্ছে এক যুবক। পাশে একটা গাড়ি থেকে বাইকটাকে ডিসটার্ব করা হচ্ছে। তরুণীর ওড়নাটাকেও টেনে ধরেছে।

গাড়িটাকে দাঁড় করাল উপল। ভেতর থেকে মদ্যপদের খিস্তি, খেউড় ভেসে আসছে। ওরা নেমে এসে উপলের ওপর চড়াও হল। চারজনে মিলে লাগাতার মেরে চলেছে ওকে। একা অভিমনু্য় যেন জগতের সব লাঞ্ছনা মুছে দিতে চাইছে। নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে, পা ভেঙে গিয়েে, কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে না। এমনকী, যে-বাইকআরোহীদের বাঁচাতে সে এগিয়েিল, তারাও না। উপলের দৃষ্টি ক্রমশ ঝাপসা হচ্ছে। চোখের সামনে ভাসছে চন্দনার মুখ, কানে বাজছে আইরিনের দাদা ডাক, মায়ের কাতরতা। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অভিমনু্যর মতোই ক্ষতবিক্ষত, রক্তস্নাত হয়ে পথেই পড়ে রইল সে।

সঙ্গী দুজন ফিরে আসার আগেই শয়তানগুলো পালিয়েে। পুলিশের গাড়িতে চলেছে ভারতমাতার সাহসী সন্তান। নারী লাঞ্ছনার প্রতিবাদে যে নিজের প্রাণটাই বাজি রেখেছে। কাছাকাছি কলকাতা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হল উপলকে। ডিউটি নার্স ওকে দেখেই চমকে উঠলেন। কারণ চন্দনার সঙ্গে উপলকে আগে দেখেছেন আর ও যে পুলিশে আছে সে কথাও জানেন।

ওয়ার্ডবয়ে সাহায্যে দ্রুত ট্রমা কেয়ারের আইসিইউতে নিয়ে চললেন। এক ফাঁকে ফোনে চন্দনাকে সব জানালেন। ডাক্তারি শপথ কি আর প্রিয়জনদের ক্ষেত্রে খাটে? আবেগ কি প্রশমিত করা যায়? চন্দনাও পারল না, শোকে মূর্ছিতাপ্রায় হয়ে বান্ধবীদের সঙ্গে এসে পৌঁছোল। ওর স্যারেরাও জান-প্রাণ লড়িয়ে দিলেন। প্রশাসনিক মহল থেকেও বিশেষ তত্পরতা দেখা গেল। ঘটনাস্থলে প্রচুর ব্লিডিং হয়েিল। তাই অরগ্যানস-এ, বিশেষ করে মাথায় অক্সিজেনের ঘাটতি এমন পর‌্যায় পৌঁছেছে যে, কোনও ওষুধই ঠিকমতো কাজ করছে না। উপল গভীর কোমায় চলে যাচ্ছে। উপলের আত্মীয়পরিজনেরাও এসেছেন ওর মাকে সামলানোর জন্য।

দৈনন্দিন জীবনে যে-যার সমস্যায় ব্যস্ত থাকে কিন্তু বিপদ এলে রক্তের সম্পর্ককে উপেক্ষা করা যায় না। ডাক্তারির অভিজ্ঞতায় চন্দনাও বুঝতে পারছে, শেষের সে ক্ষণ আসন্ন। আগামী চিরবিচ্ছেদের আশঙ্কার মধ্যেও ওর চোয়াল শক্ত হয়, রাস্তার গুন্ডাগুলোর কথা ভেবে। আইসিইউ-এর কাচের বাইরে উপলের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে চন্দনা।

চোখের সামনে অদৃশ্য পর্দায় ভেসে উঠছে তাদের ছোটোবেলা, কৈশোর ও যৌবনে একসঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো। ভেতরে নদীর পাড় ভাঙা টের পাচ্ছে, কেমন জীবন হবে তার উপলকে ছাড়া? মাসিমা, আইরিনকেই বা কীভাবে সামলাবে? ভাবনার ছন্দপতন হল বোস স্যার কাঁধে হাত রাখলেন, হি ইজ নো মোর মাই চাইল্ড, বলে মাথা নীচু করলেন।

ওরা উপলকে ঢেকে দিচ্ছে, এক ছুটে ঢুকল চন্দনা। শেষবারের মতো উপলের চুলে বিলি কেটে দিতে হবে না! ও তো সব দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, অপমান থেকে বহুদূরে আরামে ঘুমোতে যাচ্ছে।

স্কুল জীবনের বন্ধুবান্ধবরাও অনেকে খবর পেয়ে এসেছে, চন্দনার সঙ্গে সঙ্গে থাকছে। শোকেরও তো সুযোগ নেই! পোস্টমর্টেম না হলে তো বডি দেবে না। চন্দনার বাবা-মাও আছেন, সবারই বাড়ি ফেরা স্থির হল। পরদিন আসতে হবে।

চোখের জলে ভেসে, বাবা-মার কাঁধে ভর দিয়ে চন্দনা বেরিয়ে আসে তার রোজকার ফেরার করিডর দিয়ে যে-করিডরে উপলও অনেক দিন তাকে সঙ্গ দিয়েে। মাসিমাকে দূর থেকে দেখতে পায়, উপলের মামাদের সঙ্গে। ওদের দাযিত্ব তো উপল তার ওপরে ছেড়েই অকালে বিদায় নিল।

পরদিন কাচের গাড়িতে উপল চলল সেইসব রাস্তা দিয়ে যে-রাস্তায় একনিষ্ঠতার সঙ্গে ডিউটি করেছে সে। পেরিয়ে যায় ওর কলেজ, থানায় গার্ড অফ অনার নিয়ে চলল পঞ্চভূতে লীন হতে।

চন্দনা মাসিমার সঙ্গে সেঁটে আছে, আইরিনই দাদার মুখাগ্নি করল। ইলেকট্রিক চুল্লির অন্ধকারে মিলিয়ে গেল, আলোকিত এক প্রাণ তার সমস্ত জাগতিক সম্ভাবনা নিয়ে চন্দনা চোখের জল মুছে শক্ত হল। তার এখন অনেক কাজ। প্রথম কাজ হল উপলের ওপর ঘটে যাওয়া জঘন্য অপরাধের প্রতিবিধান করা। প্রশাসন কী কী পদক্ষেপ করছে, তার ওপর কড়া নজর রাখবে সে। সঙ্গে উপলের চাকরির জায়গার পাওনা-গন্ডা পরিবার ঠিকমতো পাচ্ছে কিনা দেখা। ডিউটিরত অবস্থায় যখন ঘটনা ঘটেছে, তখন বিশেষ ক্ষতিপূরণও মাসিমা পাবেন।

খবর এল অপরাধী চারজন ধরা পড়েছে, তবে জেল-আদালতে চক্কর কাটা ছাড়া তো কোন সুরাহা হবে না। চন্দনা ওর এক বান্ধবীকে আইরিনকে পড়াবার দাযিত্ব দিয়েে। সবকিছুর মাঝে উপলের তার বোনকে ঘিরে দেখা স্বপ্নটা নষ্ট না হয়ে যায়। আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার লোকই তো পাওয়া যাচ্ছে না! এক চলমান শহরে, ছুটে চলে যাওয়া সাক্ষীদের কোথায় পাওয়া যাবে?

ওদিকে অপরাধী পক্ষ, সমাজে প্রভাবশালী হওয়ায়, টাকা ছড়িয়ে মিথ্যে সাক্ষী ধরে ধরে নিয়ে আসছে। চন্দনা ওর নেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়েে, ওই বাইকআরোহী আর মেযোকে খুঁজে বার করার জন্য। প্রাইভেট ডিটেক্টিভও লাগিয়েে। পুলিশ চেষ্টা করছে কিন্তু চন্দনা ভরসা রাখতে পারছে না। প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে যদি খোঁজার আন্তরিকতা না থাকে। আদালতে সরকারি উকিল ছাড়াও ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ভালো উকিল ঠিক করে রেখেছে।

নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ওই বাইকআরোহী আর মেযোর খোঁজ পেয়েে। একদিন লুকিয়ে দেখা করতে গেল। বুঝিয়ে বলল, উপলের মা, বোনের কথা। তার নিজের দুঃখের কথা। মেযো লজ্জা, অপমান, অনাগত আশংকায় কিছুতে রাজি হচ্ছে না সাক্ষ্য দিতে। চন্দনা অনেক চেষ্টা করল, ওর বিবেককে জাগ্রত করার। শেষে সব পরিস্থিতি চন্দনা সামলাবে, পুলিশও পাশে থাকবে এসব বলে যখন ফিরছে দূর থেকে দেখল ওই বাড়িতে কারা যেন ঢুকছে।

পরদিন অপরাধীদের সনাক্তকরণ প্যারেডে আনা হল, ম্যাজিস্ট্রেটের কক্ষে। গোপন জবানবন্দিতে মেযো জানাল, অপরাধী বলে যাদের আনা হয়েে তাদের সে চেনে না। কোনও দিন দেখেনি আর ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে ভালো আলো ছিল না বলে, পরিষ্কার ভাবে সে কিছু বোঝেনি। তাকে যেন ভবিষ্যতে আর বিরক্ত করা না হয়।

শেষ আশাও বিফলে যাওয়ায় চন্দনা মাথা নীচু করে বসে আছে। এ সময় ওর কাঁধে কে হাত রাখল। আরে আইরিন! নিঃশব্দে কাঁদছে আইরিন। শক্ত করে ধরেছে চন্দনার হাত। সব আশ্বাস যেন ওই হাতেই আছে। আইরিনের মধ্যেই যেন উপলকে দেখতে পেল চন্দনা।

হার-জিত

রাত প্রায় বারোটা বাজে। রোজকার মতো প্রিয়া বইখাতা খুলে পড়াশোনায় ব্যস্ত। প্রিয়ার বাবা, সোমনাথ দরজায় এসে দাঁড়ালেন। ঘরে উঁকি মেরে জিজ্ঞেস করলেন, এখনও পড়ছিস?

প্রিয়া না তাকিয়ে জবাব দিল, যা বলতে এসেছ বলে চলে যাও।

প্রিয়া জানত এত রাতে বাবা শুধু এখনও পড়ছিস, জিজ্ঞেস করতে ওর ঘরে আসেননি। অন্য কোনও কারণ আছে। কথা বলার আগে একটা ভূমিকা করা, প্রিয়ার একেবারে অপছন্দের। ভিতরে ভিতরে বিরক্ত হল সে।

সোমনাথ দরজা থেকে মুখ বাড়িয়ে মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, এবার ওকে ক্ষমা করে দে প্রিয়া…এমনিতেই ও আমাদের ছেড়ে চলে যাবে।

ক্ষমা, কখনও না, আমি ওকে কোনও দিন ক্ষমা করতে পারব না, অনেক কষ্টে প্রিয়া নিজের রাগ সংযত করে।

কিন্তু প্রিয়া ও তোর মা…

সোমনাথের কথাগুলো প্রিয়ার ভিতরে ঢুকে সজোরে ওকে ধাক্কা মারে, চেঁচিয়ে ওঠে সে। বাবা ওই মহিলা তোমার বউ হতে পারে কিন্তু আমার মা নয়। আর তাছাড়া মায়ের জায়গায় ওকে আমি কোনও দিনই বসাতে পারব না। কোনও শক্তিই আমাকে দিয়ে এ কাজ করিয়ে নিতে পারবে না।

কিন্তু প্রিয়া…

কথা শেষ হবার আগেই প্রিয়া হাতের বইটা মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিল, প্লিজ যাবে এখান থেকে? আমাকে একা ছেড়ে দাও।

মেয়ের রাগ দেখে সোমনাথ চলে গেলেন। প্রিয়া ভিতরে ভিতরে ফুঁসতে লাগল। পনেরোয় পড়েছে প্রিয়া কিন্তু পরিস্থিতি ওকে বয়সের তুলনায় অনেকটাই বড়ো করে তুলেছে। রাগেতে চোখে জল চলে এল তার। হঠাৎই বাবার কথাগুলো তার মনে হল… ও আমাদের ছেড়ে চলেই যাবে। সঙ্গে সঙ্গে মনটা খুশিতে ভরে উঠল তার।

বাবার কথার সহজ মানেটা করে ফেলল প্রিয়া। তার মানে বাবার সঙ্গে ওই মহিলার ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে। সেই জন্যই কি বাবার এত মন খারাপ? বাবার থেকে মনটা সরিয়ে নিজের মনের মধ্যে ডুব দিল প্রিয়া। এতটা খুশি সে অনেকদিন বোধ করেনি।

পরের দিন স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের ক্যান্টিনে নিয়ে গেল প্রিয়া। আজ ট্রিট আমার তরফ থেকে।

কেন রে, হঠাৎ এত খুশির কী হল? বন্ধুদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করল।

ফাইনালি… ফাইনালি অ্যান্ড ফাইনালি আমার বাবার আর মণিকার ডিভোর্স হচ্ছে। মণিকা আমাদের বাড়ি ছেড়ে কিছুদিনের মধ্যেই চলে যাবে, উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল প্রিয়াকে।

সত্যি করেই মণিকাকে কখনও-ই প্রিয়া নিজের মায়ের আসনে বসাতে পারেনি। তাই মা বলা দূরে থাক বরাবরই নাম ধরেই ডেকে এসেছে। সোমনাথ মেয়েকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছেন কিন্তু বাবার একটা কথাও কানে তোলেনি প্রিয়া।

চিন্তা ভঙ্গ হল রিয়ার ডাকে, এই কী ভাবছিস বল তো? আচ্ছা, তোর বাবা আর সৎমায়ের মধ্যে খুব ঝগড়া হয়?

না তো!

বলতে বলতেই প্রিয়া আবার অতীতের দরজায় এসে দাঁড়াল। মনে পড়ে যখন ছোটো ছিল, মা আর বাবার মধ্যে খুব ঝগড়া হতো। ওদের ঝগড়া দেখে প্রিয়া কাঁদতে থাকত। প্রিয়াকে কাঁদতে দেখে ঝগড়া ক্ষণকালের জন্য থেমে গেলেও, আবার শুরু হতো। ওদের ঝগড়ায বারবার প্রিয়ার নামটাও উঠে আসত। দুজনের একই অভিযোগ, অপরজনের জন্য নাকি প্রিয়ার জীবনটা নষ্ট হতে চলেছে। প্রিয়া চুপ করে থাকত কারণ মা-বাবার মধ্যে কাউকেই আলাদা করে বেছে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

কখনও ঘুম ভেঙে গেলেও মৃতের মতো বিছানায় পড়ে থাকত। সে খুব ভালো ভাবে জানত, তাকে কাঁদতে দেখলে মা আর বাবা একে অপরকে দোষারোপ শুরু করবে। ক্রমশ পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হতে আরম্ভ করল যে, মা-বাবা প্রিয়াকে আলাদা ঘরে শোওয়ার ব্যবস্থা করে দিল।

দুর্ভাগ্যের বিষয, সেখানেও প্রিয়া স্বস্তি পেত না। ওদের ঝগড়ার আওয়াজ প্রিয়ার ঘর পর্যন্ত চলে আসত। বালিশ দিয়ে কান চেপে ধরলেও লাভ হতো না। মনে মনে কামনা করত, সব যেন ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু তার মনের আশা কখনও পূরণ হয়নি।

আজও ওই দিনটা প্রিয়া ভুলতে পারে না। ছয় বছর বয়স হবে তখন তার। মা তাকে একটা গোলাপি রঙের ফ্রক পরিয়ে খুব আদর করছিলেন। চোখের জলে ভেসে যাচ্ছিল তাঁর চোখ-মুখ। কাঁদতে কাঁদতেই প্রিয়াকে কোলে বসিযে বললেন, প্রিয়া আমি কেস হেরে গেছি। তোমার বাবা তোমার কাস্টডি পেয়েছেন। আমাকে চলে যেতে হবে। বড়ো হও, আমি তখন যেমন করে হোক, আমার কাছে তোমাকে নিয়ে যাব।

ব্যস, ওর মা বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। প্রিয়া বাবার সঙ্গে রয়ে গেল। প্রথম দুবছর বাবা মাসে একবার করে হলেও মায়ের সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে যেতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। মা, অবশ্য মাঝেমধ্যে প্রিয়ার সঙ্গে ফোনে কথা বলতেন আর কাঁদতেন। মায়ের কান্না প্রিয়ার কোমল মনটাকে ভেঙে চুরমার করে দিত। ফলে ইমোশনাল সাপোর্ট পেতে প্রিয়া নিজের বাবার উপর বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে পড়ল।

 

সেবার প্রিয়ার চতুর্থতম জন্মদিন পালিত হচ্ছিল। বাড়িতেই সোমনাথ সব ব্যবস্থা করেছিলেন ক্যাটেরার দিয়ে। অতিথিরা সকলেই প্রায় উপস্থিত ছিল। মণিকাকে প্রিয়া সেই প্রথম দ্যাখে। লক্ষ্য করে, বাবা একটু বেশিই হেসে হেসে কথা বলছেন মহিলাটির সঙ্গে। মহিলাটির সঙ্গে বাবাকে এতটা কথা বলতে দেখে, প্রথম দিনেই মণিকার প্রতি মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে যায় প্রিয়ার। অথচ মণিকার ছেলে অয়নের সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায় তার।

এর পর থেকে প্রায়দিনই মণিকা চলে আসত ওদের বাড়ি। যে সময়টা সোমনাথ মেয়ের সঙ্গে কাটাতেন, সেই সময়টার দখল নিল মণিকা। বাবাকে ওই মহিলার সঙ্গে দেখে প্রিয়ার মনের ভিতর আগুন জ্বলে উঠত। ওর খালি মনে হতো, বাবার পাশে বসার অধিকার শুধু তার আর মায়ের আছে। সেই অধিকার আর কেউ পেতে পারে না।

নানারকম ফন্দি আঁটত সে, কী করে মণিকাকে বাবার থেকে দূরে রাখা যায়। কিন্তু ওদের প্রেমের গভীরতা প্রিয়ার মতো ওইটুকু মেয়ে ফন্দিকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে চলে যেত। কথাতেই আছে প্রেম অন্ধ। প্রিয়ার আজও মনে হয়, মণিকাকে বিয়ে করার সময় একবারের জন্যও বাবা তার কথা ভাবেননি।

বিয়ের পর মণিকার সঙ্গে ওর ছেলে অয়নও প্রিয়াদের বাড়িতেই থাকতে আরম্ভ করল। অয়নকে ছোটো ভাই হিসেবে স্বীকার করে নিলেও মণিকাকে সে মন থেকে ক্ষমা করতে পারল না। আর না তো মা হিসেবে মেনে নিল।

প্রিয়ার মনে পড়ল বিয়ের পর মণিকা যখন প্রথমবার ওদের বাড়িতে পা রাখল, প্রিয়া ঘরের এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল, দুচোখে শুধু ঘৃণা নিয়ে ।মণিকা কিন্তু আদর করে ওকে কাছে টেনে নিয়েছিল। মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলেছিল, প্রিয়া আমাদের জীবনটা একটা নদীর মতো। নদীর স্রোত কখনও পাথর ভেঙে নিজের রাস্তা তৈরি করে নেয় কখনও বা পাহাড় কেটে। আবার কখনও কাউকে আঘাত না করেই চুপচাপ নিজের গতিপথ বদলে নেয়। এর জন্য আমরা নদীকে দোষ দিতে পারি না। আমিও অনেকটা ওই নদীর মতোই। হঠাৎ তোমার জীবনে ঢুকে পড়েছি। আমি জানি তুমি আমাকে অপছন্দ করো। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমরা এখন একটাই পরিবার। আমি চেষ্টা করব পরিবারটাকে যেন ভালো রাখতে পারি।

 

প্রিয়া, এই প্রিয়া কী অতশত ভাবছিস? রিয়ার ডাকে সংবিৎ ফিরল প্রিয়ার। বন্ধুদের সঙ্গে গল্পে আবার মেতে উঠল সে।

পরের চার-পাঁচদিন খুব আনন্দে কাটল প্রিয়ার। গান শোনা, আড্ডা মারা, বন্ধুদের সঙ্গে হইহই করে কাটিয়ে দিল দিনগুলো। এই চার-পাঁচ দিনই মণিকা বা অয়ন কারওরই মুখোমুখি হতে হল না তাকে।

সপ্তাহ শেষে স্কুল ছুটি থাকায় বাড়িতে ছিল প্রিয়া। ঘুম থেকে উঠতে দেরিই হয়েছিল  উঠে বাইরের ঘরে আসতেই দেখল অয়ন তৈরি হয়ে বেরোচ্ছে। অয়নের কাছেই প্রিয়া জানতে পারল, মণিকা হাসপাতালে ভর্তি। জানার ইচ্ছা না থাকলেও সৌজন্য বজায় রাখতে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

মায়ের লাং ক্যান্সার। টার্মিনাল স্টেজ।

হোয়াট? চেঁচিয়ে উঠল প্রিয়া। এখনই ধরা পড়ল আর এর মধ্যেই টার্মিনাল স্টেজ! কী করে সম্ভব?

প্রিয়ার চোখেমুখে অবিশ্বাসের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল। তাই দেখে অয়ন বলল, শুরুতে লাং-এই ক্যান্সার ধরা পড়েছিল কিন্তু এখন ব্রেনেও ছড়িয়ে পড়েছে।

একটা শক খেল প্রিয়া। ঘটনার গতিপথ যে এরকম একটা মোড় নিতে পারে, স্বপ্নেও ভাবেনি সে। একটা ছোট্ট অপরাধবোধ গুঁড়ি মেরে যেন তার মনে জায়গা করে নিতে চাইছে। অয়নের একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে প্রিয়া বলল, অয়ন চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। বলে নিজের ঘরে ফিরে এল প্রিয়া।

আজ বুঝতে পারছিল, কেন বাবা সেদিন বলেছিলেন মণিকার চলে যাওয়ার কথা। মণিকাকে দেখার জন্য অধীর হয়ে উঠল প্রিয়া। মনে পড়ল এক একদিন এমনও গেছে, মণিকা তার কাছে এসে কত অনুনয়বিনয় করেছে, ওকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু প্রিয়াই পাষাণ হয়ে থেকেছে। অবশ্য তাতেও মণিকার দিক থেকে তার যত্নের কোনও কমতি কোনও দিনই হয়নি। মায়ের কর্তব্য মণিকা একনিষ্ঠ ভাবে পালন করে গেছে।

 

আজ মনের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করে প্রিয়া বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, আমি আজ তোমার সঙ্গে হাসপাতালে যাব মণিকাকে দেখতে। সন্ধেবেলায় হাসপাতালে গিয়ে মণিকার সঙ্গে দেখা হল না। মণিকাকে কাচের ঘরে রাখা হয়েছিল। সেখানে ভিজিটর যাওয়ার অনুমতি ছিল না।

মণিকাকে এভাবে কেন রাখা হয়েছে? প্রিয়া বাবাকে জিজ্ঞেস করল।

কেমো নেওয়ার পর মণিকার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ায়, বুকে শুরুতেই সংক্রমণ হয়েছিল। তাই, ওকে আলাদা রাখা হয়েছে। কারণ যাতে আর কোনও রকম সংক্রমণ না হয়।

কাচের ওপারে দাঁড়িয়ে মণিকার শরীরের সঙ্গে লাগানো বিভিন্ন যন্ত্র ও নলগুলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখছিল প্রিয়া। মণিকা বাবার থেকে দূরে চলে যাবে এই স্বপ্নই দেখছিল এতদিন। কিন্তু এভাবে সেটা হোক, তা কখনওই চায়নি প্রিয়া। মণিকাকে মনে মনে সে ঘৃণা করত ঠিকই কিন্তু এতটাও ঘৃণা কখনও করেনি যে, মণিকাকে এই অবস্থায দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠবে।

আজ এইখানে মণিকার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে প্রথমবার প্রিয়ার মনে হল একবার যদি সে মণিকার সামনে গিয়ে দাঁড়াবার সুযোগ পেত, তাহলে ওর হাতদুটো নিজের হাতে নিয়ে ওর চোখে চোখ রেখে বলত, মণিকা আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। প্রিয়ার চোখের জল বাঁধ মানে না।

বারবার প্রিয়ার মনে হতে থাকে, আজ এত বছর জিতে আসার পর মণিকার কাছে আজ সে সম্পূর্ণ হেরে গেছে। মণিকাকে এত কষ্ট দেওয়ার জন্য অপরাধবোধে ডুবে যায় প্রিয়া। হঠাৎ করে বয়সের থেকে অনেকটাই বড়ো গেছে বলে মন হয় নিজেকে। উপলব্ধি করে, কোনও সম্পর্ক শেষ হওয়ার মূলে সবসময় যে অন্য কোনও নারীর হাত থাকে এই ধারণা ওর সম্পূর্ণ ভুল। ওর মা-বাবার মধ্যে সম্পর্কটা ভাঙারই ছিল। তাহলে কেন ওর সবসময় মনে হয়েছে মণিকাই দোষী? প্রিয়ার নিজের কাছেও এর উত্তর অজানাই।

মণিকাও তো জানত সে প্রিয়ার নিজের মা নয়। তবুও সুখী পরিবার তৈরি করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ছিল। সেই স্বপ্ন সত্যি করার লক্ষ্যে মণিকার দিক থেকে কোনও কমতি কোনও দিনও হয়নি। অথচ ওর সমস্ত চেষ্টা চালানোটাকে ষড়যন্ত্র বলেই মনে হয়েছে প্রিয়ার। আর সে ষড়যন্ত্রকে বানচাল করে দেওয়াকেই নিজের জয় বলে ধরে এসেছে প্রিয়া।

প্রতি বছরই একটু একটু করে বয়স বেড়েছে প্রিয়ার কিন্তু কেন জানি না এই সহজ সত্যটাকে দেখেও না দেখার ভান করে এসেছে। এখন মনে হচ্ছে আর একটু সময় যদি ও হাতে পায়, তাহলে অতীতের ভুলগুলো শুধরে নিতে পারে। কিন্তু জীবন কী তাকে সেই সুযোগ দেবে? মনে মনে অস্থির হয় প্রিয়া।

এক সপ্তাহ কেমো আর রেডিয়েশন চলার জন্য মণিকাকে কাচের ঘরেই রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। শুধু প্রিয়া কেন, কারুরই ওর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি ছিল না।

এদিকে মণিকার অবস্থা শুধরোনোর বদলে আরও খারাপ হওয়া শুরু হল। ট্রিটমেন্ট কোনও কাজই করছিল না। রেডিয়েশনের জন্য সারা শরীরে জ্বলুনি অনুভব করছিল মণিকা। বাড়ির সকলে মণিকার জন্য উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছিল। শুধু অপেক্ষা, কবে মণিকাকে দেখতে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যাবে। এছাড়া আর কোনও পথও খোলা ছিল না তাদের কাছে।

তাদের আশা অনুযায়ী মণিকাকে ওয়ার্ডে শিফ্ট করা হল না। অবস্থার অবণতি হওয়াতে এবং সোমনাথের বিশেষ চেনাশোনা থাকার কারণে হাসপাতালেই বিশেষ একটা কেবিনে আলাদা করে মণিকাকে রাখার ব্যবস্থা করা হল। চব্বিশ ঘন্টা ডাক্তার আর নার্সেরও ব্যবস্থা হল। সোমনাথ আর অয়ন হাসপাতালেই শিফট করে গেলেন যাতে পালা করে মণিকার দেখাশোনা করতে পারেন।

প্রিয়া কিছুতেই মণিকার সামনাসামনি হওয়ার সাহস জোটাতে পারল না। সে বাড়িতেই থেকে গেল। বাবার কাছ থেকে জানল, আর কিছু দিনের অতিথি মণিকা।

অনেক কষ্ট করে ভয় কাটিয়ে নিজের মনকে তৈরি করল প্রিয়া। হাসপাতালে পৌঁছে দেখল মণিকার দুর্বল শরীরটা বিছানার সঙ্গে মিশে গেছে। চোখ জলে ভরে এল। তার দিকে মণিকার চোখ পড়তেই হাত তুলে কোনও রকমে ওকে কাছে ডাকল মণিকা। মেয়ে আর স্ত্রীকে রেখে সোমনাথ আর অয়ন কেবিনের বাইরে বেরিয়ে এলেন। মণিকা প্রিয়াকে ইশারা করল, তাকে খাটে বসিয়ে দিতে।

প্রিয়া ধীরে ধীরে বেডের হাতল ঘুরিয়ে বসানোর অবস্থায় নিয়ে এল। হাত দিয়ে ধরে থাকল মণিকাকে। মণিকা তাকে জড়িয়ে ধরল। প্রিয়া আর নিজেকে সামলাতে পারল না। কান্নায় ভেঙে পড়ল।

মনের ভিতর চলতে থাকা প্রতিটা সংঘর্ষ প্রিয়া চাইছিল মণিকার সঙ্গে শেযার করতে। কিন্তু হঠাৎ-ই ওর মনে হল মণিকা ওকে খুব জোরে ধরে রয়েছে। একটু চেষ্টা করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে প্রিয়ার খেযাল হল, মণিকা একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

মৃত্যু জিনিসটা যে কী, তা এর আগে কোনও দিন প্রিয়া দেখেনি। কিন্তু খারাপ কিছু আশঙ্কা করে প্রিয়া চেঁচিয়ে উঠল, ডক্টর… ডক্টর! ততক্ষণে মণিকা সকলের থেকে বিদায় নিয়েছে।

মণিকার মৃত্যুর পর সারা বাড়িটা যেন প্রিয়াকে গিলতে আসত। মা চলে যাওয়ার পরেও, এতটা একাকিত্ব কখনও বোধ করেনি প্রিয়া। ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, শুধু বাড়িটাই নয়, ওর নিজের মনের অনেকটা জুড়েও মণিকা জায়গা দখল করে নিয়েছিল।

আত্মগ্লানিতে পুড়তে লাগল প্রিয়া। ইশ যদি সুযোগ পেত তাহলে মনের কথাটা মণিকাকে বলতে পারত! যেটা শোনার জন্য মণিকা এতটা অধীর হয়ে ছিল। আদৌ কি সে শুনতে পেত? মৃত্যুপথযাত্রীর কাছে সত্যিই কি তার কথাটা কোনও গুরুত্ব পেত? প্রিয়া সবসময় শুনে এসেছে, সময় থেমে থাকে না। তাহলে কেন সে সময় থাকতে থাকতে নিজের মনের কথাটা খুলে বলতে পারল না?

নিজের উপরই ঘৃণা হল প্রিয়ার। অস্থির বোধ করল। নিঃশব্দে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। নীল আকাশে সাদা মেঘগুলো ভেলার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। মাথাটা ঘুরছে মনে হল প্রিয়ার। ভিতর থেকে একটাই শব্দ ঠেলে বেরোতে চাইছে, মণিকা… মণিকা। চীৎকার করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কেউ যেন গলাটা চেপে ধরেছে। স্বর বেরোচ্ছে না কিছুতেই প্রিয়ার গলা দিয়ে।আকাশে মেঘের ঘূর্ণায়মান গতিপথের দিকে চেয়ে সমস্ত শক্তি একত্র করে চ্যাঁচাল প্রিয়া, মণিকা প্লিজ… প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও।

কিন্তু খুব ভালো করেই জানে প্রিয়া, আজ মণিকা আর কোনও কথাই শুনবে না। আজ যে মণিকারই জয় হয়েছে।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব