আজকের সমাজে সমাজবিরোধীর সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়তে বাড়তে প্রায় মহামারীর রূপ নিতে চলেছে। অন্যান্য সমাজবিরোধী কার্যকলাপ ছাড়াও যৌন হেনস্থার ব্যাপারটা প্রায়শই পথেঘাটে, খবরের কাগজে, টিভির পর্দায় চোখে পড়ছে। সম্প্রতি বর্ষবরণের সন্ধিক্ষণে বেঙ্গালুরুর মতো শহরে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আজও মেয়েরা কোথাও নিরাপদ নয়। বাড়ির একান্ত নিরিবিলিতেই হোক অথবা রাস্তায় জনবহুল পরিবেশই হোক না কেন–যৌনতার শিকার হতে হচ্ছে সমানে মেয়েদের।

বাচ্চারাও বাদ যাচ্ছে না এই অসামাজিক কার্যকলাপ থেকে। চাইল্ড অ্যাবিউজ-এর সংখ্যা বাড়ছে। বাচ্চারা দেশের ভবিষ্যৎ অথচ অভিভাবকেরা আজ এতটাই ব্যস্ত নিজেদের জীবন নিয়ে যে, সন্তানদের জন্য প্রয়োজনীয় সময়টুকু পর্যন্ত তারা দিতে পারেন না। আজ চাইল্ড অ্যাবিউজ-এর এত ঘটনা চোখের সামনে আসছে, লোকে অনেক বেশি এখন সচেতন হচ্ছেন এবং দেখা যাচ্ছে এর বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটছে পরিবারেরই কোনও সদস্যের দ্বারা অথবা বন্ধুবান্ধবদের দ্বারা।

সামাজিক প্রাণী হিসেবে মানুষ এখন এই নিয়ে অনেক বেশি সচেতন। আমাদের বাচ্চাদের যৌন হেনস্থার হাত থেকে বাঁচাতে, পদক্ষেপ নেওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। এটা মাথায় রেখেই, বাচ্চাকে সুরক্ষা দিতে ১০টি উপায় এখানে জানানো হচ্ছে। যথাযথ কমিউনিকেশন এবং এই ১০টি সতর্কতার সাহায্য নিয়ে আপনি আপনার বাচ্চাকে যৌন শিকারের হাত থেকে বাঁচাতে পারবেন।

১) বাচ্চার সঙ্গে কথা বলুন

বাচ্চাকে নিয়মিত আপনার সঙ্গে সব কথা শেয়ার করার জন্য উৎসাহ দিন। সন্তান, ছেলেই হোক কিংবা মেয়ে তার দৈনন্দিন কার্যকলাপ আপনার সঙ্গে ফ্রিলি শেয়ার করার জন্য ওর যথাযথ বন্ধু হয়ে উঠুন। যে-কোনও বিষয় নিয়ে কথা বলতেই যেন তারা কমফর্টেবল বোধ করে। যদি আপনার বাচ্চা, অপরের কোনও অনৈতিক ক্রিয়াকলাপের কথা আপনাকে এসে বলে, আপনার উচিত বাচ্চাকে বকাঝকা না করে অপর ব্যক্তিটির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অ্যাকশন নেওয়া।

২) বাচ্চাদের, প্রাইভেট অর্গ্যান সম্পর্কে শিক্ষিত করে তুলুন

প্রথমে হয়তো কিছুটা অসুবিধা হবে, কিন্তু শিশুকে নিজের শরীরকে চিনতে শেখান। শিশুর জননেন্দ্রিয়র সঠিক নাম শিশুর জানা দরকার। এর ফলে শিশুর পক্ষে শরীরকে বোঝাও সুবিধে হবে। মনে কোনও প্রশ্ন উঠলে জানবেন বাচ্চার মনে প্রশ্ন ওঠাটা খুব স্বাভাবিক এবং তার যথাযথ উত্তর দেওয়াটা অভিভাবকের কাজ। বাইরের লোকের কী ধরনের ব্যবহার যৌন হেনস্থা, সেটা বাচ্চাকে বুঝিয়ে বলা দরকার। শিশুকে বোঝানো উচিত যে তাদের শরীরের বিশেষ বিশেষ জায়গা যেন বাইরের লোক কখনও টাচ্ না করে। একমাত্র অভিভাবকদের সম্মতিতেই বাচ্চাদের পোশাক ছাড়ার সময় অথবা ডাক্তারের কাছে গেলে, বাইরের কেউ বাচ্চাদের স্পর্শ করতে পারে।

৩) আপনার বাচ্চাকে কথা বলতে দিন

আপনার সন্তানকে অভয় দিন যাতে কেউ তার প্রাইভেট পার্ট ছুঁলে সে নির্দ্ধিধায় আপনাকে এসে ঘটনা খুলে বলতে পারে। অথবা কোনও কিছুতেই তার অস্বস্তি হলে আপনাকে এসে বলতে যেন ভয় না পায় তা সে লোকটা যেই হোক না কেন অথবা লোকটি আপনার বাচ্চাকে যাই শিখিয়েই পাঠাক না কেন। অভয় দিন বাচ্চাকে যে, সত্যিটা খুলে বললেও কোনওরকম বিপদে তাকে পড়তে হবে না। বরং আপনার নিশ্চিত হওয়া উচিত যে সে নির্ভয়ে সবকিছু খুলে বলেছে আপনার কাছে এবং ঘটনার প্রতিকার করার দায়িত্বও আপনার নেওয়া উচিত যাতে ভবিষ্যতে বিপদের হাত থেকে তাকে বাঁচানো যায়।

৪) বাচ্চাকে ‘ব্যাড টাচ্’ এবং ‘গুড টাচ্’-এর মধ্যে পার্থক্য করতে শেখাতে হবে

বাচ্চাকে বোঝাতে হবে তার পারমিশন ছাড়া তার প্রাইভেট বডি পার্টস-এ কারও হাত দেওয়ার অধিকার নেই। তাদের বোঝাতে হবে কীভাবে তারা ‘গুড টাচ্’ এবং ‘ব্যাড টাচ্’-এর মধ্যে পার্থক্য করবে।

৫) বেছে নিন যাকে বিশ্বাস করতে পারবেন

আপনার বাচ্চার বন্ধুবান্ধব এবং তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে পরিচয় করুন। নিজে আগে শিওর হন যে তাদের বিশ্বাস করা চলে। তবেই বাচ্চাকে তাদের বাড়ি সময় কাটাতে দিন। অনেক সময় হয় যৌন হেনস্থাকারী ঘরেরই লোক, যেমন পরিবারের কেউ, আত্মীয়স্বজন অথবা বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেই কেউ অপরাধী। এমন কোনও ব্যক্তির সঙ্গে আপনার বাচ্চাকে সময় কাটাতে দেবেন না যাকে আপনি সম্পূর্ণ ভাবে বিশ্বাস করেন না।

৬) বাচ্চাকে এনকারেজ করুন, অন্যের গোপনকথাও যেন আপনার সঙ্গে শেয়ার করে

যৌন হেনস্থার মতো জঘন্য অপরাধ যারা করে, তারা বাচ্চাদের যখন নিজেদের শিকার বানায় সাধারণত গোপনীয়তা বজায় রাখার চেষ্টা করে। অপরাধ করে বাচ্চাটিকে সাবধান করে দেয়, সম্পূর্ণ ঘটনাটি সে যেন কারও কাছে প্রকাশ না করে। তারা বোঝায় বাচ্চাটির মা যদি জানতে পারে তাহলে মায়ের ক্রোধের শিকার হবে বাচ্চাটি। এই কথাগুলো বাচ্চাকে আরও ভয় পাইয়ে দেয়। সুতরাং শিশু বয়স থেকেই সন্তানকে সবসময় মনে করাতে হবে কোনও ব্যক্তি যদি তাকে কোনও কথা গোপন করতে বলে বিশেষ করে নিজের মা-বাবার কাছে, সেটা অগ্রাহ্য করতে। কারণ ওইটুকু শিশুকে বোঝাতে হবে, মা-বাবার কাছে ‘গোপন কথা’ বলে কিছু নেই।

৭) শিশুর ব্যবহারে পরিবর্তন হয়েছে কিনা লক্ষ্য রাখুন

শিশুর ব্যবহারে হঠাৎ পরিবর্তন দেখলেই সাবধান হন। হতে পারে আপনার সন্তানের সঙ্গে খারাপ কিছু ঘটেছে অথবা ঘটছে। ছেলেই হোক অথবা মেয়ে সন্তান, সে যদি সমানে স্কুল যেতে না চায়, টিউশন ক্লাসে অথবা বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে যেতে না চায় অথবা শোওয়ার অভ্যাস বদলে যায়, খাওয়াদাওয়া, বদমেজাজি হয়ে ওঠে এবং অদ্ভুত ব্যবহার করতে থাকে, তাহলে ব্যাপারটা এড়িয়ে যাবেন না। বাচ্চাকে কোনও কিছু করতে জোর করবেন না। বরং কাছে বসিয়ে, আদর করে তার ব্যবহারের পরিবর্তনের কারণটা জিজ্ঞেস করুন।

৮) যৌন নিগ্রহ বুঝতে পারলে অ্যাকশন নিন

আপনি যদি সন্দেহ করেন, আপনার বাচ্চাকে যৌন হেনস্থা করা হচ্ছে তাহলে সন্তানের সঙ্গে কথা বলুন এবং যথোচিত অ্যাকশন নিন। আপনি আপনার এলাকার পুলিশের সাহায্যও নিতে পারেন দোষীকে খুঁজে বার করার জন্য। সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ-এর ক্ষেত্রে পুলিশের আলাদা বিভাগ রয়েছে যাদের কাজই হল ইনভেস্টিগেট করে দোষীকে খুঁজে বার করে, প্রয়োজনীয় অ্যাকশন নেওয়া।

৯) অত্যাচারিত বাচ্চাদের জন্য থেরাপির ব্যবস্থা

যৌন হেনস্থার শিকার বাচ্চাদের জন্য উপযুক্ত থেরাপির ব্যবস্থা রাখা উচিত। স্কুল নির্ভর মেন্টাল হেল্থ প্রোগ্রামগুলো এমন হওয়া উচিত যে, বাচ্চাদের এই ধরনের প্রয়োজনে থেরাপিস্ট সবসময় অ্যাভেলেবল থাকবে। বাচ্চাকে কখনও ফিল করতে দেবেন না যে এটা তাদেরই ভুল। সবসময় তাদের আনন্দে রাখবার চেষ্টা করবেন এবং বোঝাবেন এই ধরনের ঘটনা ঘটে থাকলেও তাদের এতে কোনও দোষ নেই।

১০) সাহায্যের হাত বাড়ান

সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ-এর মতো অপরাধ যারা করে এবং যারা এর শিকার হয়, তাদের উপর নানা রিসার্চ ওয়ার্ক করা হয় এবং হচ্ছেও। কীভাবে এই অপরাধ বন্ধ করা যাবে, কেন এই অপরাধ প্রবণতা এবং কী এর চিকিৎসা অত্যাচারী এবং অত্যাচারিত উভয়ের, এই নিয়ে সব দেশেই বহু রিসার্চ করা হচ্ছে। যারা এই উভয় ধরনের ঘটনায় চিকিৎসার দায়িত্বে রয়েছেন তারা প্রপার ট্রেন্ড হওয়া বাঞ্ছনীয় এবং আধুনিক মেথড সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকাটা খুবই জরুরি। তাহলেই নতুন অপরাধ হবে না এবং যারা অলরেডি এই অপরাধের শিকার তারাও খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবেন। নিজের সন্তানকে প্রাপ্য গুরুত্ব দিন এবং তার খেয়াল রাখুন। নিজেদের অভিজ্ঞতা মা-বাবার সঙ্গে শেয়ার করতে তারা যেন কোনওভাবেই জড়তা বোধ না করে। এই প্রয়োজনীয় টিপস মনে রাখলে সন্তানকে যৌন হেনস্থার হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব হবে এবং তার শৈশবকে নিরাপদ করতে পারবেন।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...