জীবন কাকে, কখন, কোন পথে চালিত করে কেউ বলতে পারে না। তাই, মানুষকেও নদীর মতো হঠাৎ-ই গতিপথ পরিবর্তন করতে হয় অনেক সময়। কিন্তু সেই পথ বাধাহীন হয় না সবার জন্য। তবুও যারা সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে সাহস নিয়ে এগিয়ে যান গন্তব্যের দিকে, তারা-ই একসময় বিজয়-পতাকা ওড়াতে পারেন। আর তারা-ই অন্যকে প্রেরণা জোগান, সমাজকে আলোকিত করেন। তানিয়া, টুম্পা, দেবযানী এবং প্রতিমাও তাই আমাদের গর্ব। ওদের সাফল্য প্রেরণাদায়ক। ওদের ‘অন্যতমা’ সম্মানলাভ তাই যথার্থ স্বীকৃতি।
‘অন্যতমা’ এই চারজন নারী অর্থাৎ তানিয়া সান্যাল, টুম্পা দাস, দেবযানী মুখোপাধ্যায় এবং প্রতিমা পোদ্দার-এর সঙ্গে আলাপ করাল ‘আভা সার্জি সেন্টার’। কলকাতা-র অন্যতম এই আইভিএফ এবং গাইনিকোলজি সেন্টার সম্প্রতি দক্ষিণ কলকাতা-র এক অভিজাত হোটেলে এঁদেরকে সম্মান জানাল আনুষ্ঠানিক ভাবে। সম্মান জানালেন ‘আভা সার্জি সেন্টার’-এর ফাউন্ডার ও চিফ কনসালটেন্ট ডা. বাণী কুমার মিত্র এবং ডিরেক্টর ও চিফ এমব্রায়োলজিস্ট ডা. কঙ্কণ দাস মিত্র।
যাঁরা সেদিন সম্মানজ্ঞাপন অনুষ্ঠানের মঞ্চে আলো ছড়ালেন, সেই চারজন নজির গড়েছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে। ২০১৮ সালে অ্যাভিয়েশন ফিমেল ফায়ার ফাইটার হিসাবে AAI-তে যোগদান করে, তানিয়া সান্যাল ইতিহাস তৈরি করেন এবং পরে কলকাতার ফায়ার সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে AAI-এর প্রথম মহিলা প্রশিক্ষক হন। দিল্লি ফায়ার ট্রেনিং সেন্টারের ১০০+ পুরুষের মধ্যে তিনিই একমাত্র মহিলা, যিনি পাঁচ মাসের কষ্টকর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এবং প্রশিক্ষক ও সহকর্মীদের কাছ থেকে সম্মান পেয়ে তিনি অভিভূত।
টুম্পা দাস এমন একজন পেশাদার, যিনি শ্মশানে শবদাহের কাজ করে নজির গড়েছেন। টুম্পা প্রথমে হতে চেয়েছিলেন নার্স এবং সেই অনুযায়ী কেরিয়ার গড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বল্প বেতন ও পরবর্তীকালে তাঁর বাবার মৃত্যুর কারণে তিনি ১৯ বছর বয়সে শ্মশানে শবদাহ থেকে শুরু করে যাবতীয় নথির কাজ শুরু করেন। দশ বছরের মধ্যে তিনি ৫০০০-এরও বেশি মানুষের শবদাহ করেছেন।
দেবযানী মুখোপাধ্যায় আবার এমন একজন সামাজিক উদ্যোক্তা, যিনি গৃহিণীদের সফল উদ্যোক্তা এবং আর্থিক ভাবে স্বাধীন হওয়ার দীর্ঘকালীন স্বপ্ন পূরণে সহায়তা করেছেন। তাঁর উদ্যোগে গড়ে ওঠা ‘নানিঘর’-এর মাধ্যমে ৫০০+ মহিলা ক্ষমতায়িত হয়েছেন। দেবযানী বিশ্বাস করেন যে, প্রতিটি মহিলার উন্নতির সুযোগ প্রাপ্য।
বাংলার প্রথম মহিলা বাস চালক প্রতিমা পোদ্দারও নজর কাড়েন মঞ্চে। তিনি জানিয়েছেন, প্রথমে বাস কন্ডাক্টর হিসেবে কাজ করতেন তিনি। তারপর এক দুর্ঘটনায় স্বামীর মৃত্যুর পর, সংসারের পুরো দায়ভার নিতে হয় তাঁকে। তাই উপার্জন বাড়িয়ে, সন্তানদের মুখে অন্ন জোগানোর তাগিদে গাড়ি চালানো শুরু করেন প্রতিমা। ঐতিহ্যগত ভাবে পুরুষ শাসিত পেশায় তিনি প্রকৃতপক্ষে নারীদের জন্য একজন আদর্শ হয়ে উঠেছেন। কলকাতার গণপরিবহন ক্ষেত্রে তাঁর ধারণা পরিবর্তন এবং নারীর ক্ষমতায়নে তাঁর সাহস, ব্যতিক্রমী অবদান রেখেছে সমাজে।
সাহস এবং প্রগতিশীল চেতনার এক স্মরণীয় উদযাপনে, চারজন ব্যতিক্রমী নারীকে তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে যুগান্তকারী অবদানের জন্য সম্মানিত করা হয়েছে। ‘অন্যতমা – অন্য নারীর গল্প’ শিরোনামে আয়োজিত এই পুরস্কার প্রদান মঞ্চে, ‘আভা সার্জি সেন্টার’-এর পক্ষ থেকে ‘অন্যতমা’-দের হাতে মেমেন্টো তুলে দেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ, ভূমি ও ভূমি সংস্কার, শরণার্থী ও পুনর্বাসন প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এবং গায়িকা ঊষা উত্থুপ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন সুরভি মিত্র এবং অভিনেত্রী গার্গী রায় চৌধুরি।