কিছু যদি না মনে করিস, আমি কিন্তু আজীবন ফাঁকা। একবার চান্স দিবি নাকি?

তুই থামবি ব্রত। হাতে চাপড় মারে রিমলি।

কেসটা তো এখনও ক্লিয়ার হল না। ঠিক দাগা দেবার কারণটা কী শুনি? ব্রত বলে।

পুরো সাইকো। আবার ফিল্মিও বলতে পারিস। প্রায় টানা তিনবছর কপোত-কপোতি চিঠি-চাপাটি করেছে জমিয়ে অশরীরী নাকি ভাইয়ের হাত দিয়ে চিঠি পাঠাত কস্তুরীকে। দেখাসাক্ষাত্ খুবই কম। কীভাবে প্রথম আলাপ সেকথাও কস্তুরী চেপে যায় বারবার। ব্যাপারটা যখন একটু মেন ট্র‌্যাকে ঢুকে পড়েছে হ্যান্ডেল কস্তুরীকে কী লিখেছে জানিস?

কী?

আকাশটা আজ বড়োই নীল/ আজ আমায় পিছু ডেকো না/ যে-রং তোমার চোখে শামিল/ সে চোখ ভিজিয়ে দিও না…। —সুর করে বলে রিমলি।

আহা অঞ্জন দত্ত পুরো। বাল। সরি কস্তুরী কিছু মনে করিস না ভাই। এতদিন ঝুলে ঝুলে কী আতা খাচ্ছিল। ব্রত জিজ্ঞাসা করে।

আতা খাচ্ছিল না ছিঁড়ছিল জানি না। আমার তো মনে হয় মালটা ঘ্যাম নিচ্ছে। কস্তুরী যদি একটু ঘ্যাম নেয় তাহলেই আবার লাইনে চলে আসবে। ছেলেদের চেনা আছে আমার।

কটা রে রিমলি?

মানে?

কটা ছেলেকে চিনিস তুই?

এবার দাঁত কেলালে সত্যি চড়িয়ে দেব ব্রত।

ওরা চার পাঁচজন নিজেদের মধ্যে মজা করছিল। কস্তুরী দেখছিল, উঠতে চেয়ে উঠে যেতে পারেনি। মনের থেকে অনেকটা দূরে সরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু যত সরে যেতে চাইছিল ততই যেন মনের ভীরু দেয়াল উগরে বারবার কষ্টগুলো ঠেলে উঠছিল। বু কী কোনওদিন ওর হবে না? ও বাঁচবে কী করে? একঝাঁক প্রশ্ন মৌমাছির ঝাঁকের মতো ঘুরপাক খাচ্ছিল।

দেখা মাত্র দু-তিনবারই হয়েছে। তাও মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য, পার্ক স্ট্রিটের কাছে এলিয়ট পার্কে। শেষ যেদিন দেখা হয় সেদিনই ঘটে ঘটনাটা। এদিকে বাড়ি থেকে একনাগাড়ে মা, বাপি বিয়ের কথা বলে চলেছে। কস্তুরীকে ফোর্সও করেছে। ও একথা সেকথা বলে অনেকবার এড়িয়ে গেছে। চেষ্টা করেছে পাশ কাটিয়ে ব্যাপারটা যদি একটু ডিলে করা যায়। কিন্তু পারছে না। দিদি তো রয়েছেই ওদের উস্কে দেবার জন্য। এভাবে আর কতদিন আটকে রাখবে? তাই বলেই ফেলেছিল, বুকে। হুম ঠিক এভাবেই ডাকে মানুষটাকে।

এই কটা বছর ঘোরের মতো কেটেছে। উঠতে, বসতে, খেতে, পরতে একটা এমন সময় যায়নি যেখানে মনে পড়েনি ওর কথা। বু ভাইয়ের হাত দিয়ে যেদিনই চিঠি পাঠিয়ে দেখা করার কথা বলত। কী যে ভালো লাগত। নিজেকে বারবার চিমটি কেটে দেখত। সত্যি কিনা। ঠিক কটায় কোথায় দেখা হবে চিঠিতেই লেখা ছিল। সবার চোখ এড়িয়ে নিজেদের যতটা সম্ভব আড়াল করে সেদিন বেরিয়ে পড়েছিল ওরা দুজন। ওকে ছুঁতে পারেনি কস্তুরী। তবু পায়ে পায়ে পার্কের বেঞ্চে বসা, কাছাকাছি থেকে শরীরী ওম নিতে চেয়ে বাধো বাধো ঠেকার মধ্যেও যে অদ্ভত একটা আকর্ষণ ছিল সেই সমস্ত দিনের মাত্র কয়েক ঘন্টাতেই বুঝতে পারত। কত গল্প, কত হাসি, দ্রুত কেটে যেত সময়। কথায় কথায় নিজের ভালোলাগা, পছন্দ-অপছন্দের সঙ্গে সঙ্গে জেনে নিত প্রিয় মানুষেরটাও। অদ্ভত ভাবে চমকে উঠেছিল এই দেখে যে, শুধু মনের মিল নয়, ওদের দুজনের ব্যক্তিগত মিল-অমিলগুলোও বড্ড কাছাকাছি, পাশাপাশি। যেন কেউ যত্ন করে ওদের দুজনের ভালোলাগা মন্দলাগাগুলো সাজিয়ে রেখেছে। বড়ো নিশ্চিন্ত একটা আমেজ দুহাতে জড়িয়ে ধরত ওকে এতদিন পর। মনে হতো, জীবনের কালো কিছু পাতাকে কেউ হয়তো ইরেজার দিয়ে একের পর এক মুছে দিচ্ছে।

তবে কথায় আছে না, স্বপ্ন হল অসীম। সেটা কমে না, বেড়েই চলে। লাগামছাড়া কথায় এগলি-ওগলি ঘুরতে ঘুরতে কস্তুরী বলেছিল ওর পরিবারের কথা। বাপির কথা। মায়ের কথা। দিদির কথা। কলেজের থার্ড ইয়ারের পরীক্ষাটা দেওয়ার অপেক্ষা শুধু, সবাই যে কীভাবে অন্য জায়গায় পাঠানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে বলতে বলতে গলা বুজে আসছিল। এসবের মাঝে কখন যে ঝুঁকে পড়া মাথাটা ওর কাঁধে হেলে পড়েছিল নিজেও বুঝতে পারেনি।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হচ্ছিল। কমলা লালচে আলোটা পার্কের বিপরীতে শহরের গগনচুম্বী অফিসটার ছাদ ছুঁয়ে নেমে যাচ্ছিল কোন অসীমে। এতদিনের আটকে রাখা ভাবনাগুলো সুস্থির কোনও পথের দিশা পেয়ে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল সেই আলো নিভে আসা আকাশটার দিকে। একবার, একটিবারের জন্যও মনে হয়নি কী হবে, কী ঘটতে চলেছে। হাতে হাত রেখেই খানিকটা নির্ভাবনায় বেরিয়ে এসেছিল পার্ক থেকে।

একটা সপ্তাহ কী দিন পনেরো হবে— একটা চিঠি পায়। সামান্য কয়েকটা গানের লাইন। কী অর্থ বুঝতে পারেনি। আজও বুঝতে পারেনি। যে-চিঠি তিল তিল করে তিনটে বছর স্বপ্ন দেখিয়েছিল, স্বপ্ন ভেঙে টুকরো টুকরো করতে সেই চিঠিরই সময় লেগেছিল মাত্র কয়েক সেকেন্ড। কস্তুরী কী উত্তর দেবে এর? ফোনের পর ফোন করেছে ওদের ল্যান্ডলাইনে। প্রতিবারই নয় মা, নয় ওদের বাড়ির অন্য কেউ ফোন রিসিভ করায় কথা বলতে পারেনি। আচ্ছা বু কী একবারের জন্যও জানতে চায় না ওর মনের অবস্থাটা? একবারের জন্যও কী মন কেমন করে না ওর জন্য? তাহলে কি ভালোবাসাটা একতরফাই ছিল? নাহ তা কী করে হয়? এতদিনের চিঠির কথাগুলো কি মিথ্যে?

বাড়িতে নিজেকে লুকিয়ে রাখলেও বন্ধুদের কাছে এসে আর পারেনি। সবটা বলে ফেলেছিল বান্ধবীকে। সত্যি কি নিজে হালকা হতে পেরেছে? পারেনি। আর হয়তো কোনওদিন পারবেও না। কিন্তু জানতে তো পারবে ঠিক কেন ও এমন করল? কস্তুরী জানে বু ওর থেকে মাত্র দেড় বছরের বড়ো। ঠিক এই সময়ে চাকরি পাওয়াটা যে কতটা লড়াই সাপেক্ষ সেটাও জানে। কিন্তু বাড়িতে যদি কিছু একটা অঘটন ঘটে তাহলে সেটাকে আটকাবে কী করে?

ওহো কস্তুরী তুই এত ভাবছিস কেন? তোর অশরীরীকে বল একবার আমাদের সঙ্গে শরীরী হয়ে দেখা করতে, আমরা মালটাকে পুরো নেড়ে ঘেঁটে দেব। বন্ধুদের মধ্যে কেউ একটা বলছিল।

ঘড়িতে প্রায় পাঁচটা বেজে গেছিল। এক পা এক পা করে ক্লাসরুম ফাঁকা হচ্ছিল। ওকেও উঠতে হবে। বাড়ি যেতে হবে। সত্যি কি ওটা ওর বাড়ি? নিজের কণাটুকু ওখানে আর অবশিষ্ট নেই। প্রতি মুহূর্তে মনে হয় ওকে নিঃস্ব করে দেওয়াই যেন প্রধান লক্ষ্য রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলোর।

Tags:
COMMENT