মহা ঝামেলায় পড়লাম তো। এই বাবু, কী হয়েছে রে? কীসের সমস্যা তোর? উত্তর দে। দিদির বিয়ে বয়স হয়েছে। নিজের লেখাপড়ায় মন না দিয়ে কী করছিস তুই?
না মা তোমরা কেউ বুঝতে পারছ না। ঋজুদা ভালো নয়..।
কী, যত বড়ো মুখ না তত বড়ো কথা…। হাত তুলে তেড়ে আসে পায়েল।
শান্ত হ মাপু দাঁড়া আমি দেখছি। পায়েলকে আটকায় ওর মা।
বল কেন ভালো নয় বল, চুপ করে থাকবি না, উত্তর দে।
রাগে, লজ্জায়, ঘেন্নায়, কষ্টে ও একটা শব্দও করতে পারছিল না। কীভাবে বলবে, কীভাবে বোঝাবে ওদের? যারা সত্যি সত্যি কিছু বুঝতে চায় না। নিজের দিদি হয়ে এই কথাটা দিদি ওকে বলতে পারল…? একটুও বাধল না?
দরজার কাছে বাবা এসে দাঁড়িয়েছিল। কস্তুরী আবারও পিছিয়ে পড়ছিল। নিজেকে গুটিয়ে ফেলছিল। দেখছিল চারপাশের মানুষগুলো ওর দিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে আঙুল তুলে। ওর কোনও উত্তর দেওয়ার নেই। ওর আর কিছুই বোঝাবার নেই।
পাগলের মতো চিত্কার করে কাঁদছিল ওর দিদি। মা-বাপি ক্রমাগত সান্ত্বনা দিচ্ছিল। ঝাপসা হয়ে আসা চারপাশটা থেকে কয়েকটা কথা আগুনের মতো বুকে এসে বিঁধছিল।
এই সবকিছু ঘটেছে দিদুনের জন্য। সেই ছোট্ট থেকে সুন্দরী সুন্দরী করে ওর মাথাটা খেয়েছে। খুব বলেছিল না কালো বলে আমার বিয়ে হবে না। দ্যাখো নিজের আদরের নাতনির কী হয়? কে উদ্ধার করে ওকে? চাকরি যে জোটাবে সে কলমের ক্ষমতাও তো নেই। বছর বছর গাড্ডা খাচ্ছে। এত অপমান হবার পর আমি আর ঋজুকে এখানে নিয়ে আসতে পারব না। ভেবে নাও তোমরা কী করবে। বাইরে আমরা দেখা করলে ভালো দেখাবে সেটা?
আহা শান্ত হ, মা। আমি দেখছি কী করা যায়। দেখা করবি না কেন? নিশ্চয়ই দেখা করবি আমাদের ঘরে বসবি তোরা। বাবু কী বলেছে ঋজু তো আর শোনেনি। জানেও না। আমি দেখব ও এলে বাবু যাতে তোদের কাছাকাছি না আসতে পারে। ঠিক আছে? তুই চুপ কর। কাঁদিস না, কাল তোর পরীক্ষা আছে। পায়েলের গায়ে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কথাগুলো বলছিল ওর বাপি, মা। কস্তুরী বুঝতে পারছিল পায়েলের কথায় ওর কষ্টের চেয়ে পায়েলের কষ্টটাই বাপি, মায়ের কাছে বেশি কষ্টের।
সময় ঝড়ের বেগে এগিয়ে যাচ্ছিল। সময়ে সঙ্গে সঙ্গে কস্তুরীর চারপাশের পরিস্থিতিও যেন হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিল। খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল অন্তত একটা অবলম্বন ধরে নিজের অস্তিত্বটাকে মাথা তুলে দাঁড় করানোর। ঋজুদা বাড়িতে আগের মতোই আসছিল। কিন্তু ওর আদর যত্ন যেন আগের থেকে বেড়ে গেছিল আরও অনেকটা। বাপি-মা দিদির মেলামেশার জন্য নিজেদের ঘর ছেড়ে দিয়েছিল। কস্তুরী জানতে চাইত না, বুঝতেও চাইত না। তাও ওর দিদি প্রায়ই ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে নিজেদের ভালোবাসার কথা বলত! বাপি মা-ও যে ওদের দুজনের বিয়ে কথা পাকা করছিল, খাওয়ার টেবিলের আলোচনায় কানে আসত।
সাত বছরের বড়ো হলেও ছোটোবেলায় দিদির সঙ্গে কস্তুরীর সম্পর্কটা অনেকটা
মা-মেয়ে মতো ছিল। মামাবাড়ি থেকে ফেরার পর কস্তুরীকে স্কুলে তৈরি করা, খেতে বসে গল্প করা কখনও এর ওর স্কুলের সুখের দুঃখের অনুভতি ভাগ করত ওরা। পায়েল আর কস্তুরী শুধু দুইবোন নয়, ছিল একে অপরের পরিপূরক। সেই দিদি বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এভাবে পালটে গেল কেন? কী কারণে?
বরাবর দেখে এসেছে কস্তুরীর মা বেশিরভাগ সময়ই নিজের অসুস্থতা, নিজের আরাম নিয়ে সময় কাটাতে ভালোবাসে। একটু কাজ করেই হাঁপিয়ে যায়। শুয়ে বসে টিভি দেখতেই তিনি অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ। আর ঠিক সেই কারণেই কস্তুরীর জন্মের পরেই নিজের কাছে না রেখে ওকে বড়ো করার জন্য নিজের মায়ের কাছে পাঠানো। বয়স হলেও দিম্মামা শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে যথেষ্ট সক্ষম হওয়ায় ছোট্ট কস্তুরীকে কোলে পিঠে করে বড়োও করে তুলেছিলেন।