বাড়িতে যা হয় মাঝেমধ্যে টুকটাক বন্ধুদের বলে কস্তুরী। কিন্তু প্রভাস স্যারের বাড়ির ঘটনাটা কী করে বলবে? এ যে একান্তই ওর লজ্জা। ওর পরিবারের লজ্জা।

ওই দ্যাখ, অনিমাদি এসেছেন। এবার হয়তো বোর্ড টাঙানো হবে। আঙুল দেখায় পম্পা।

পম্মা, সোমা স্কুলের বাকি মেয়েদের অভিভাবকেরা একটু একটু করে এগোতে থাকে স্কুলের মধ্যে। অল্পক্ষণের মধ্যেই ভিড় জমে যায় ভালোই। রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে। ঠেলাঠেলির মধ্যে থেকে একটু একটু করে কেউ সামান্য মুখ ভার কেউ আবার বেজায় হাসি ফুটিয়ে বেরিয়ে আসে। এগোতে গিয়ে যেন পেছন দিকে অসম্ভব টান মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, কেউ যেন ওর পা দুটোকে আটকে দিয়েছে মেঝের সঙ্গে।

এদিক ওদিক থেকে অস্পষ্ট কানে আসছিল, সাযে্সের শঙ্খমালা প্রথম হয়েছে, আর আর্টসে হয়তো মৃত্তিকা।

কেউ কেউ সটান খাতা রিভিউ করাতে দেওয়ার কথাও বলছিল অসন্তোষের সঙ্গে। নোটিশ বোর্ডের বেশ অনেকটা কাছে এসে গেছিল ও। উঁচু উঁচু মাথাগুলোর পাশ থেকে আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে একের পর এক দেখছিল নামগুলো…।

লাল কালির দাগ। সেকেন্ড ডিভিশন। একটা বিষয়ে পাসমার্ক না থাকায় সেটাকে সম্ভবত ফোর্থ সাবজেক্ট করে দেওয়া হয়েছে। হয়তো ইংলিশ…। খুব খারাপ পরীক্ষা হয়েছিল। এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল। ফল তো ভুল কিছু আসেনি। পারেনি। কস্তুরী পারেনি। এই না-পারার জন্য কি একাই ও দায়ী? কোথাও না কোথাও বাবা-মা-দিদিও কি দায়ী নয়? এখন ও মাথা তুলে দাঁড়াবে কোথায়? কোথায়?

হই হই করে ওকে ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছিল বাকিরা। স্কুলের মাঠের গা ঘেঁষে একতাল লাল রং নিয়ে ডুবে যাচ্ছিল দিনের সূর্য‌্যটা। এই সূর্য‌্যটাই কি রোজ সকালে ওঠে? আলোয় ভরিয়ে দেয় পৃথিবীটাকে। যা ডুবে যায়, মিলে যায়, মিশে যায় তা কি কখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে? নতুন করে সবকিছু শুরু করতে পারে? তাই তো যে হারিয়ে যায়, হেরে যায় সে কখনও কোনওদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। গোটা পৃথিবী ভুল জানে।

সূর্য‌্য এক নয়, অনেক। অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল সবুজ ঘাস, হলুদ বিল্ডিংয়ে স্কুলটা।

সেই ঝটফটে লেজের পাখিগুলো একে একে পিড়িক পিড়িক করে ডাক দিয়ে ঢুকে পড়ছিল ঝাঁকড়া কদম গাছটার ডালটার মধ্যে। টিফিনের একটুকরো খেতে আসত যে শালিখটা সেটাও নিশ্চয়ই এতক্ষণে ওর ছানাদের নিয়ে বাসায় ফিরে গেছে।

ওকে কি কেউ ডাকল! কে ডাকবে?

কস্তুরী আর পেছন ফিরে তাকায়নি। ওইতো বাচ্চা ছেলেটা ঠিক যেভাবে তার মায়ের হাত ধরে নেমে যাচ্ছিল নীচে। একটা, দুটো, তিনটে…। পরপর অনেকগুলো ধাপ। কস্তুরীও নামতে থাকে একেকটা ধাপ বেয়ে গা কাঁটা দিচ্ছে। কি প্রচন্ড শীত শীত করছে। এই জায়গাটাই কী ঠান্ডা? নাকি ওর মাঝে মাঝে যে শীতটা করে তেমনিই হচ্ছে। কিছু একটা হবে হয়তো। বাচ্চাটা ওর মায়ের হাত ধরে নাচতে নাচতে এগোচ্ছে। ছোট্ট হাতদুটো নরম বাঁধনে ধরে রেখেছে ওর মা। ঝিমঝিমে একটা ভালোলাগা ঘুরে বেড়াচ্ছে কস্তুরীর শরীর জুড়ে। শীত শীত ব্যাপারটা আরও খানিকটা জাপটে ধরে ওকে। হালকা হয়ে আসা শরীরটা যেন ভেসে যেতে চাইছে। বাচ্চাটা ওর থেকে হাত চারেক দূরে।

ও কী রবি? রবিকে মনে আছে? হ্যাঁ রবিকে মনে আছে কস্তুরীর। সেই যে ছোটোবেলায় দিম্মামায়ের পাশের বাড়ির রবি-র মায়ের কোলে জড়ো হয়ে বসত ও। একবাটি সুজি দুধ খেত। দুধ ওর বরাবরই অপছন্দের। কিন্তু রবির মায়ের হাতের সুজি দুধের স্বাদটা যেন আজও ভুলতে পারে না। খুব ইচ্ছে করছে খেতে…।

মনে হচ্ছে ওই দুধ দুধ গন্ধটা যেন ওরই চারপাশে ঘোরাফেরা করছে। খিদে পাচ্ছে ভীষণ। কস্তুরী তো এখন খেতে পারবে না। এগিয়ে যায় ও। মনে পড়ছে হিংসুটে রবিটা ওকে বারবার নামাতে চাইত ওর মায়ের কোল থেকে। ও নামতে চাইত না। কান্না জুড়ত। রবির মা-ও ওকে নামতে দিত না, উলটে কস্তুরীকে মুখ ভরে চুমু খেয়ে রবিকে বকত। বলতো একদম হিংসুটেপনা যেন না করে রবি।

Tags:
COMMENT