( ২১ )
হোটেলে ফিরতে ইচ্ছা করছে না। সমুদ্রের ধারে এসে দাঁড়াই। ফোন করে মাকে বলি, আমি এসে গেছি। একটু পরে হোটেলে ফিরছি।
শোন, আমরা মন্দিরে আরতি দেখছিলাম। ফিরে ফোন করব। ঠাম্মার জর্দাটা কিনে নিস।
ঠিক আছে।
একটা চেয়ার ভাড়া নিয়ে বসলাম। চাঁদ উঠেছে। ঢেউয়ের মাথায় মাথায় রুপোলি আলো থিক থিক করছে। সমুদ্র এখন আর অত ভয়াল নয়। কফিওয়ালা আসতে কফি নিলাম। এই বিশাল জলরাশির সামনে নিজের তুচ্ছতা আবার প্রমাণিত হল। আর হিমেল হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। ঠিক তখনই ডলির ফোন এল।
তুই কোথায়?
সমুদ্রের ধারে।
চলে আয়, আমি হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে।
চেয়ারটা জমা দিয়ে হাঁটতে লাগলাম।
হলুদ চুড়িদার পরে ডলি দাঁড়িয়ে আছে। ডান কাঁধে ঝুলছে চামড়ার ব্যাগ। কাছে যেতেই হাসল।
আয়।
কী ব্যাপার?
মায়ের দুটো ওষুধ কিনতে হবে। চল, তোর সঙ্গে যাই। আমার বাঁ হাতটা জড়িয়ে ধরল।
ভিড়ের মধ্যে দিয়ে হাঁটছি পরস্পরের শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে। চুড়িদারে ওকে ঠিক ছোটোবেলার মতো লাগছে। আমার হাতটা চেপে ধরা। মাঝে মাঝে মাথাটা আমার কাঁধে ঘষে দিচ্ছে। বললাম, ছাতিমতলা মনে পড়ে?
হুঁ-উ-উ…
মন্দির?
হুঁ-উ-উ…
আমাদের শেষ দেখা হওয়ার দিনটা?
আমার হাতে খিমচি কেটে বলল, শেষ দেখা তো হয়নি হাঁদারাম।
হাসতে হাসতে হেঁট হয়ে বলি, হ্যাঁ। আজই তো আবার দেখা হল।
হবে হবে। উইলফোর্সটা কাজে লাগাতে হয়। অত রাগ অভিমান ঠিক নয়।
ওকে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হল। বললাম, একটা হামি খাব?
ইশ্-স-স! এখানে এসব বলতে আছে? জগন্নাথ দেবের পীঠস্থান।
দুজনেই হা হা হি হি করে হেসে উঠি। দোকান দেখতে পাচ্ছি না, নাকি দেখছি না!
কথাটা বলতেই ডলি বলল, শুধু ওষুধ কেনাটাই আমার উদ্দেশ্য কি?
তবে?
তুই যেন কেমন। চিরটাকাল ভীষণ ইনট্রোভার্ট। মনের কথা খুলে বলতে কি তোর প্রেস্টিজ হ্যাম্পার হয়?
তা নয়।
তা নয় মানে? আমার সামনে থমকে দাঁড়ায় ডলি।
হ্যাঁ। অনেকটা তাই। যা বলতে চাই তা না, বলি অন্য কথা। যা বলতে চাই না তাই বলে ফেলি।
হাঁটতে হাঁটতে আমার হাতটা দোলাতে দোলাতে বলল, জীবন অনেক বড়ো! জীবন বাস্তব। স্বপ্ন নয়।
হোটেলে ফিরে বললাম, ডলিরা এসেছে।
জর্দার কৌটোটা দেখতে দেখতে ঠাম্মা বলে, আসতে বললি না?
আসবে।
মা ঠাম্মার মেরুন শালটা ভাঁজ করতে করতে বলল, বিদেশে এসে চেনা লোক পেলে কত ভালো লাগে!
ছোলা মটরের প্যাকেটগুলো টেবিলে নামিয়ে রেখে বলি, পুরি বিদেশ নাকি?
ওই হল। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় আসা…
মানি ব্যাগ থেকে এক টুকরো মানি রিসিট বার করে তার পিছনেই লিখতে শুরু করি—
গাড়িটা ছুটছে। ছুটেই যাচ্ছে…
কতগুলো লেভেল ক্রসিং পার হলাম
জানি না।
ধবলগিরি বুদ্ধমূর্তির সামনে
বালির স্ট্যান্ডে জ্বলছে অজস্র
মোমবাতি আগরবাতি।
কারা জ্বালিয়েছে জানি না।
কী উদ্দেশ্যে তাও জানি না।
যে পূজারিণী আমাকে টেনে আবার
লেভেল ক্রসিংয়ে সামনে দাঁড় করাল
হে তথাগত
আমায় শিখিয়ে দাও উত্তরণের পথ।
খাওয়াদাওয়ার পর মায়ের শালটা জড়িয়ে ব্যালকনিতে বসলাম। হু হু হাওয়ায় বেশ শীত করছে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের ঢেউ আরও বেড়েছে। পাড়ের কাছে আছাড় মারছে।
ডলি জানতে চাইছিল আর কবিতা লিখি কিনা। হ্যাঁ বলতেই মেয়েটি কৌতূহল বেরিয়ে এল।
কাকে নিয়ে লিখিস?
অনেককে। অনেক কিছু নিয়ে। বয়স বেড়েছে। অবজেক্ট পালটেছে।
আর আমাকে নিয়ে
সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলি, একদিন বাড়িতে আসিস, শোনাব।
কাল ওকে কবিতাটা শোনাব। শোনাব মনের আপত্কালীন দরজায় ধাক্কার শব্দ। ভোরের মিছিল, দুরন্ত শৈশব আর অশান্ত হাওয়ার গান। আমরা জানি। উইন্ডস্ক্রিনে বৃষ্টির ফোঁটার মতো নয়। আছি ছাতিমতলার বৃষ্টিতে, ভাঙা মসজিদের অলিন্দে ভিজে সপসপে হয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বসেছিলাম। এমনিই। তবুও মনে হচ্ছিল ডলি ফোন করতে পারে। হলও তাই।
কী রে, ঘুমোচ্ছিস?
না। সমুদ্র দেখছি। তুই?
আমি সমুদ্র দেখতে পাচ্ছি না। মায়েরের ঘর থেকে দেখা যায়। আমি আকাশ দেখছি। ছোট্ট একটু আকাশ। কত তারা!
তিস্তাকে যে-ভিডিও গেমটা কিনে দিয়েছিস সেটা ও মাথার কাছে নিয়ে শুয়েছে। ঘরে নীল আলো। এখন রাত্রি প্রায় বারোটা। সব রুমেই আলো জ্বলছে। ওরা ঘুমোবে কখন বলতে পারিস?
ওরা ঘুমোবে না। খুনসুটি কিংবা ঝগড়া করবে। এই করতে করতে সারা রাত কেটে যাবে। তারপর ওরা মন্দিরে যাবে। মুক্তির প্রার্থনা করবে।
তুই ঠিক ফিলজফারদের মতো কথা বলছিস।
তখন বললি না জীবনটা বাস্তব। স্বপ্ন নয়। প্রতিটা রুমেই সমস্যা আছে। রাত গভীর হলে তারা সমাধানের পথ খোঁজে।
( ২২ )
তিস্তা এতক্ষণ বালি দিয়ে মন্দির, পিরামিড তৈরি করছিল। এবার মেতেছে ঝিনুক কুড়োনোয়। ছোটো বড়ো মাঝারি সাইজের বিভিন্ন আকৃতির ঝিনুক কুড়িয়ে এনে রাখছে চেয়ারে। কাকু-কাকিমা, মা ঠাম্মা সবাই এতক্ষণ এখানে ছিল। বহুদিন পর দেখা হওয়ায় সকলেই একেবারে খুশিতে আপ্লুত হয়ে উঠেছিল।
ঠাম্মার কথায়, সবই ভগবানের দয়া। কাকিমার কথায়, এখানে দেখা হওয়াটা নির্দিষ্ট ছিল। সবাই যেন এক পারিবারিক সম্মেলনে মেতে উঠেছিল। সকলে হাঁটতে হাঁটতে গেল স্বর্গদ্বারের দিকে। সন্ধ্যার কালো ছায়া নেমে এসেছে সমুদ্রের ওপর। দূর আকাশে এক ফালি চাঁদ ভাসছে। হ্যালোজেনের আলোয় উদ্ভাসিত তটভমি।
ডলি বলছিল, তোকে ওর এত পছন্দ যে মায়েরের সঙ্গে গেলই না।
ঠিক তখনই তিস্তা বালি মাখা হাতে চারটে ঝিনুক এনে আমাদের দেখিয়ে বলল, অ্যানাদার ডিজাইন। আমরা কিছু বলার আগেই আবার দৌড়ে গেল।
অনেকটা দূর চলে গেছে। ডেকে আনি।
ও ঠিক ফিরে আসবে।
নিশ্চিন্ত ডলি ওর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ঢেউ দেখতে লাগল।
ঝিনুক না খুঁজে হঠাৎই দৌড়ে দৌড়ে আসছে তিস্তা। ঘাড় বেঁকিয়ে দেখে ডলি।
কী হল সোনা?
মা, ঘোড়ায় চড়ব। আঙুল তুলে দেখায়। দূরে ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে পা ঠুকছে। মাথা নাড়াচ্ছে।
আমরা উঠে গেলাম ঘোড়ার কাছে। লোকে লোকারণ্য সি-বিচ। অজস্র হকার, শাঁখের শব্দ আর সমুদ্রের উদ্দামতায় এক অনন্য পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এক পার্থিব উত্তাপে সবাই মগ্ন। সমস্ত বিষণ্ণতা উদ্বেগ অনুচ্ছ্বাস সরিয়ে বলি, একটা গান শোনাবি?
চেয়ারে এসে বসতে বসতে ডলি বলল, বহু দিন গাইনি। তুই বললি বলেই আজ ভীষণ গাইতে ইচ্ছা করছে।
গা তবে।
ডলি সমুদ্রের দিকে মুখ করে চোখ বুজে গাইছে এ বেলা ডাক পড়েছে কোন্খানে/ ফাগুনের ক্লান্ত ক্ষণের শেষ গানে…।
সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরিই হল। মা ঠাম্মার চান হয়ে গেছে। আজ সবাই জগন্নাথ দেবের মন্দিরে যাব। সেদিন মন্দিরটা ভালো করে ঘোরা হয়নি। আমরা সবাই খুব ক্লান্ত ছিলাম। কাল রাতে ভোগ দিতে এসে পান্ডা বলে গেছে আজ সকালে নিয়ে গিয়ে সব ঘুরিয়ে দেখাবে।
ঠাম্মা বলল, আর কত ঘুমোবি? ওঠ। চান করে নে। আটটা বাজে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে গামছায় চুল ঝাড়তে ঝাড়তে ঠাম্মা বলে, নটায় পান্ডা আসবে।
আমি কম্বল সরিয়ে চাদরটা গায়ে দিয়ে ব্রাশ-পেস্ট নিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। বালুকাবেলার দৃশ্যই অন্যরকম। হাজার হাজার মানুষ। আকাশে গ্যাস বেলুন উড়ছে। নীলাকাশ। রোদ্দুরে ঝলমল চারদিক। সমুদ্রের জল রুপালি মাছের মতো চিক চিক করছে। মৃদু ঢেউ স্বশব্দে এসে পড়ছে বালির ওপর। সাদা টুপি মাথায় নুলিয়াদের কী ব্যস্ততা! কানে দুল পরে সাঁই সাঁই করে বাইক চালিয়ে যাচ্ছে ছেলেরা।
বাইক চালিয়ে হোটেলের সামনে এসে পান্ডা চিত্কার করে বলল, আধ ঘণ্টা পরে আসছি।
কী গলার জোর! তিনতলা থেকেও ওর কথা স্পষ্ট বুঝতে পারি। হাত তুলে বলি, ঠিক আছে। বাইক ঘুরিয়ে ধুতি পরা গায়ে উড়নি জড়ানো পান্ডা নিমেষে মিলিয়ে গেল।
স্নান সেরে ফ্রেশ হতে আমার ঠিক পঁচিশ মিনিট লাগল। চুল আঁচড়াচ্ছিলাম। দরজায় ঠক ঠক শব্দ হতে মা বলল, দেখ তো।
দরজা খুলেই দেখি ডলিরা দাঁড়িয়ে আমার হাতে বাক্সটা দিয়ে তিস্তা বলল, আমার হ্যাপি বার্থ ডে…
বাক্সটা টেবিলে রেখে বলে, আমার সেভেন্থ।
আরিঃব্বাস! আমরা সবাই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠি।
কেক কাটা হবে কখন?
ইভিনিং-এ।
আমার কাছ থেকে টেনে নিয়ে মা ওকে আদর করতে থাকে।
ঠাম্মা বলল, আমরা মন্দিরে যাচ্ছি। তোমরাও চলো। ওর নামে পুজো দিতে হবে।
সবাই রাজি।
প্রায় সাড়ে নটার সময় পান্ডা এল। ঠিক একই স্টাইলে বাইকে বসে মুখ তুলে চিত্কার করে বলল, মন্দিরের সামনে চলে আসুন। আমি থাকব।
ওর মতো চ্যাঁচাতে পারি না। হাতের ইশারায় যাচ্ছি দেখালাম। গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করেনি। হুশ করে উধাও হয়ে গেল।
মন্দিরের চাতালে দাঁড়িয়ে পান্ডা বলল, মন্দিরের ইতিহাসটা একটু জেনে নিন। তাঁকে ঘিরে আমরা গোল হয়ে দাঁড়ালাম।
বাংলা উচ্চারণে উড়িয়া টান মিশিয়ে সে বলে, সত্যযুগে অবন্তীরাজ সূর্যবংশীয় ইন্দ্রদু্যম্ন এই মন্দির গড়েন। শিল্পের দেবতা বিশ্বকর্মা সূত্রধরের বেশে বিগ্রহ গড়তে আসেন। রুদ্ধদ্বার কক্ষে একুশ দিনে বিগ্রহ সম্পূর্ণ হওয়ার কথা। এই কদিন কেউ আসবেন না এই শর্তে রাজা রাজি হতে সূত্রধর বিগ্রহ গড়া শুরু করেন। কিন্তু অধৈর্য রানির তর সয় না। শর্ত ভেঙে বারো দিনের মাথায় দরজা খোলেন রানি। দেখেন সূত্রধর উধাও, দেববিগ্রহ অসম্পূর্ণ। হাত পা তখনও হয়নি। রাজা সেই অসম্পূর্ণ বিগ্রহই প্রতিষ্ঠা করেন।
পান্ডা একটু থেমে মন্দিরটা দেখে নিয়ে বলে, পৌরাণিক যুগের সেই মন্দির ধ্বংসাবস্থায় রাজা যযাতি কেশরী নতুন করে মন্দির গড়েন। ১১৯৮-এ রাজা অনঙ্গভীমদেব যে মন্দির দেখছেন তা গড়েন।
( ২৩ )
ট্রেন লেট ছিল। বাড়ি আসতে সাড়ে এগারোটা বেজে গেল। রোদ্দুরের তাপ বেশি। সকলের চোখে মুখে ট্রেন জার্নির ছাপ স্পষ্ট। ক্লান্তি ফুটে উঠছে হাঁটাচলায়। চির পরিচিত বাড়িঘর-বাগান-উঠোন সবই যেন কেমন কেমন লাগছে। ঠিক যেন বাসা বদল।
লাগেজ-টাগেজ ঘরে ঢুকিয়ে ব্যাগ নিয়ে বাজার করতে বেরোচ্ছিলাম। ঠাম্মা বলল, সবই নিবি। পেঁয়াজ ছাড়া ঘরে কিছু নেই।
মুদিখানার কিছু?
সে সব আছে। মা ফ্যান চালাতে চালাতে বলল, মাছ-টাছ আনিস না। অত রাঁধার সময় নেই। আলু ভাতে আর ভাত করব।
ঠাম্মা বলে, সেই ভালো।
মা ঠাম্মা দুজনেই রান্নাঘরে ব্যস্ত। স্নান সেরে নিলাম। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। দুচোখ জড়িয়ে আসছে। জানলার ধারে চেয়ার টেনে বসলাম। পাগলটা ঢুকে পড়েছে বাড়িতে। পিঠে ঝোলাটা নেই। কোথায় রেখে এসেছে কে জানে!
লোকটা হাঁক দিল ও ঠাকমা!
আর জ্বালিও না বাবা। যাও। শরীর আর বইছে না। রান্নাঘর থেকে ঠাম্মা বলে।
ও ঠাকমা! লোকটা আবার ডাকে।
মা বলে, এখনও রান্নাবাড়া কিছু হয়নি। অন্যদিন খেও।
লোকটা মাঝে মাঝে আসে। কিছু খেয়ে যায়। আজ তো রান্নাই হয়নি এখনও।
মায়ের কথাগুলোই আমি বলি, অন্যদিন এসো। আজ একটু আগেই ফিরেছি।
দাড়ি গোঁফের ভেতর দিয়ে পাগলটা পিট পিট করে আমাকে দেখে। হাতের লাঠিটা মাটিতে পিটতে পিটতে বলে, সবই মায়া। শুধু মায়া। ঢেউ আর ঢেউ… বলতে বলতে বেরিয়ে গেল।
লোকটা দার্শনিক নাকি! এই ভাবে কথা বলছে! ওকি জানে আমরা বেড়াতে গেছিলাম। সমুদ্র দেখেছি! সেই ঘোর এখনও কাটেনি। লোকটা ঠিক পাগল নয়, আমার মনে হয় সেয়ানা পাগল।
ঘুম থেকে উঠতে উঠতে প্রায় সন্ধে হয়ে এল। সবাই মিলে বসে চা খাচ্ছিলাম। টিভিটা চালাতে যেতেই মা বলে, থাক। এখন আর চালাতে হবে না।
বুঝলাম সবাই ক্লান্ত এখনও। একটা যেন ঘোরের মধ্যে আছি আমরা। কী যেন ঘটে গেছে। সেকি বিষাদ! সেকি মায়া। সব চুপচাপ। বসন্তের হাওয়া ভেসে আসে জানলা গলে। আশপাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসে শাঁখের শব্দ। আমরা বসে থাকি।
হঠাৎ ঠাম্মা বলে, কাল এই সময় আমরা সব গোছগাছ করছিলাম।
মা বলে, নীল বড়ো চিরুনিটা বোধ হয় ফেলে এসেছি!
পেটের কাছে চাপড় মেরে ঠাম্মা বলে, ওখানে এত মশা ছিল না।
মা বলে, লিকু্ইডটা জ্বেলে দে না বাবা। বড্ড মশা! একটু বসা যায় না।
আমি প্লাগে মেশিনটা লাগিয়ে সুইচ অন করি। জ্বলে না।
মা বলে, তার এপাশেরটা। সুইচ ভুলে গেলি বেড়িয়ে এসে?
এবার মেশিনটা জ্বলে ওঠে।
ঠাম্মা বলে, পিকুনের পুজোর ছুটিতে চলো বউমা কাশী ঘুরে আসি। ট্রেন ভাড়া আমি দেব।
মা বলে, হোটেল ভাড়া আমি দেব। বাকি খরচ তোর।
বিষাদ-মায়া-শূন্যতা সব সরে গিয়ে আনন্দে ভাসছে ঘরটা। এটাই প্রথম বেড়ানো কিংবা শেষ বেড়ানো নয়। ওরা যেভাবে বলছে, আমার বুকে ঢেউ ওঠে। সামান্য ব্যাপারেই যে আমরা এত খুশি হতে পারি জানা ছিল না।
তোমরা দেবে কেন? এখন থেকেই যদি কিছু কিছু জমাই তো মোটেই সমস্যা হবে না।
তখন দেখা যাবে। মা উঠে সন্ধে দিতে গেল।
ঠাম্মার সই কিছুদিন আগে বেনারস গেছিল, সেই বর্ণনা দিতে লাগল।
মা শাঁখ বাজাচ্ছে। ঠাম্মা গলায় কাপড় দিয়ে দুহাত কপালে তুলে ঈশ্বরকে প্রণাম জানাচ্ছে।
বুকটা হু হু করে ওঠে। কাল সন্ধ্যাতেও সমুদ্রতীরে শঙ্খধ্বনি শুনেছি অজস্রবার। পুরুষ বা মহিলারা ব্যাগে শাঁখ নিয়ে বাজাতে বাজাতে বিক্রি করছিল বালিতে বালিতে হাঁটতে হাঁটতে। কী সুন্দর বাজাচ্ছিল। শঙ্খধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠছিল। শিরশিরে হাওয়া বইছিল চারপাশে। মনে হচ্ছিল ডানা থাকলে সমুদ্রের বুকে নীল জ্যোত্স্নায় উড়ে বেড়াতাম।
টেবিলের ওপর পড়েছিল ফোনটা। বেজে উঠল। তুলে দেখি ডলির ফোন।
ফিরেছিস?
গলাটা কেশে পরিষ্কার করে বলি, হ্যাঁ।
কখন?
এগারোটায়।
কী করছিস?
কিছু নয়।
চলে আয় আমাদের ফ্ল্যাটে। মুড়ি আর সিঙাড়া খাব।
ঠিক আছে, যাচ্ছি।
ডলি ফোন অফ করে দেয়।
কোথায় যাবি? ঠাম্মা প্রশ্ন করে।
ডলিদের ওখানে। সিঙাড়া খেতে।
আমাদেরও দুটো এনে দিয়ে যা। বললি বলে ইচ্ছে করছে।
নতুন ফ্ল্যাট। ঝকঝক করছে। দেয়ালে আলাদা আলাদা রং। নতুন সোফা। সেন্টার টেবিল। টিভির পাশে ফ্লাওয়ার ভাসে আর্টিফিসিয়াল ফুল। দরজায় ঝুলছে ঝিনুকের মালা। জানলার ধারে মাঝারি অ্যাকোরিয়ামে খেলে বেড়াচ্ছে গোল্ডফিশ, অঞ্জেল, ব্ল্যাক মলি, সোর্ডটেল। কী সুন্দর একটা গন্ধ চারপাশে। হয় ধূপ, না হলে রুমফ্রেশনার।
তিস্তা ঝাঁপিয়ে এসে কোলে উঠে পড়ল।
আঠাশটা গেম খেলেছি।
ভেরি গুড।
ক্যারাম খেলবে?
ডলি বলে, আজ নয়। এই তো আঙ্কেল এল।
তাহলে তোমার ফোনটা দাও। গেম আছে তো?
ইয়ে ম্যাম। পকেট থেকে ফোনটা ঝট করে ওকে দিই।
সোফায় সামনা-সামনি দুজনে বসে তিস্তাকে দেখিয়ে ডলিকে বললাম, ভেরি সুইট!
ডলি হেসে মুখ নীচু করে বুকের ওপর হাত দুটো আড়াআড়ি রাখল।
সামনে পা ছড়িয়ে বললাম, এখনও ঘোর কাটছে না। তোর?
আরে আমাদেরও তাই। চোখ বুজলেই দেখি সমুদ্র আর হলুদ বালি। শুধু ঘুম পাচ্ছে। ঘুম যেন আর কাটছে না। আমার দিকে তাকিয়ে বলে, পরশু দিন ট্রেনে উঠেই মনটা খুব খারাপ লাগছিল।
কেন?
বারবার ধবলগিরির কথা মনে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল কী যেন ফেলে এলাম।
খুব নীচু স্বরে বলি, ধবলগিরিতে না গেলে তোর সঙ্গে দেখাই হতো না। বারবার ঘটনাটা স্বপ্ন বলেই মনে হচ্ছে।
মৌসুমী কাকিমা ট্রেতে তিনটে বোল-এ মুড়ি আর প্লেটে সিঙাড়া নিয়ে এলেন।
তিনটে কেন? ট্রেটার অদ্ভুত ডিজাইন দেখতে দেখতে প্রশ্ন করি।
ডলি বলে, বাবা বন্ধুর বাড়ি গেছে। আর তিস্তাকে একটু আগে কর্নফ্লেক্স খাওয়ালাম।
খেতে খেতে জমে উঠল আড্ডা। আড্ডার নির্দিষ্ট কোনও পথ ছিল না। নানান পথেই হেঁটে বেড়াচ্ছে আড্ডা। আমার মন-কেমন ব্যাপারটা কেটে গেল। কথা বলতে বলতে খেতে খেতে সবাই হাসিতে হাসিতে গড়িয়ে পড়ছি। তিস্তা মুখ ফিরিয়ে আমাদের দেখছে।
কাকিমা মুড়ি শেষ করে কফি করতে গেলেন।
ডলি, তোর সমরকাকুদের মাঠ মন্দির আর ঝিলের কথা মনে পড়ে? লাফিয়ে ওঠে ডলি।
পড়বে না মানে? আরামবাগে গিয়ে কী যে মন খারাপ লাগত, তোকে বোঝাতে পারব না। যার সঙ্গেই পরিচয় হতো তাকেই বলতাম আমাদের কথা।
যাবি একদিন?
কবে বল?
কাল সন্ধেবেলায়? সকালে আমার কলেজ আছে। রাতে পড়ানো নেই।
চল। যাব…। ডলির চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
আমি ছাতিম ফুলের গন্ধ পাই। বুনোঝোপের সোঁদা গন্ধ ভেসে বেড়ায় আমার পাশে পাশে। দূর থেকে কে যেন ডাকছে, পিকুন! পি-ক-উ-ন….
কে ডাকছে! বাসব নাকি জয়ন্ত। মনে হচ্ছে রাইমা। না না অমিতা। দুচোখ বন্ধ করে কণ্ঠস্বরটা চিনতে চেষ্টা করি।
ডলি ডাকে, পিকুন! পিকুন! শরীর খারাপ লাগছে?
চোখ মেলে বলি, যাবি এখন? ও যেন প্রস্তুত হয়ে ছিল।
চল, এখনই চল।
( ২৪ )
রেশন দোকানের পাশের পথে না গিয়ে একটু ঘুরে আমরা চার্চের সামনের রাস্তা দিয়ে ঢুকলাম। পথের দুপাশের প্রাচীন বাড়িগুলো যেমন ছিল তেমনই আছে। বুকটা ধুপ ধুপ করছে। চেনা পথ চেনা বাড়ি লাইটপোস্ট সব কেমন অচেনা হয়ে গেছিল। বটগাছটাও ঠিক তেমনই আছে। পুরোনো পাড়াটাকে নতুন করে দেখছি। কী যে আনন্দ হচ্ছে! নিঃশব্দ বাড়িগুলো থেকে টিভি সিরিয়ালের শব্দ ভেসে আসছে।
ডলিও দুপাশ দেখতে দেখতে হাঁটছে। বললাম, অবাক হচ্ছিস?
একটুও না। শৈশবটাকে দেখতে পাচ্ছি। এই পথ দিয়ে তো রোজ স্কুলে যেতাম। সিংহীদের বাড়ি যেমন ছিল তেমনই আছে। খালি জানলায় কুকুরটা নেই। দেখলেই ঘেউ ঘেউ করে চ্যাঁচাত।
খানিকটা এগোতেই দেখলাম মন্দিরের সামনে অনেকগুলো বাড়ি হয়েছে। থমকে দাঁড়িয়ে ডলি বলল, সে কী রে?
মাথা নীচু করে বলি, হ্যাঁ। বদলে গেছে।
মন্দিরটার পাশ দিয়ে যেতে যেতে পায়ে গতি কমে গেল। ঝোপঝাড়ে প্রায় ঢেকে ফেলেছে শিব মন্দিরটা। জায়গাটাও অনেক ছোটো হয়ে এসেছে বাড়ি হওয়ায়। মাঠটাও ছোটো হয়ে গেছে। এক পাশে ফ্ল্যাট তৈরি হয়েছে। মাটির রাস্তা পিচের হয়েছে। সমরকাকুর বাড়িতে আলোর রোশনাই আর নেই। উঁচু পাঁচিলের দেয়ালে লেখা আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে ভোট দেওয়ার আহ্বান। প্লাস্টার খসা দেয়ালে আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখাগুলি এখনও উজ্জ্বল।
ডলির পা স্লথ হল। বলল, ফিরে চল। ছেলেবেলাটাকে খুঁজে পাচ্ছি না। ডুকরে ওঠা স্বর ওর।
ওর মাথায় হাত দিয়ে বলি, আর একটু চল। ঝিলের ধারে যাই।
আমরা ঝিলের ধারে এসে দাঁড়াই। পর পর ধোপাদের পাটাতন এখনও রয়েছে। ঝিলের জলে তেচোখা মাছ ভেসে বেড়াচ্ছে। ধোপাদের দড়ি বাঁশের মাথায় মাথায় ঝুলছে। ঝিলের ও পারে পাকা বাড়ি থেকে ইলেকট্রিকের আলো এসে জলে পড়েছে।
হঠাৎ ডলি আমার হাতটা ধরে বলল, ওই দেখ, ছাতিমগাছটা! আমরা দৌড়ে যাই।
গাছে হাত বোলাতে বোলাতে ডলি বলে, গাছটা এখনও ঠিক রয়েছে।
আমরা দুজনে গাছের দুপাশে পিঠ রেখে দাঁড়াই। দুই চোখ বুজে শৈশব কৈশোরটাকে খুঁজতে চেষ্টা করি।
বলি, এখানে তোর ক্লিপ হারিয়ে গেছিল। ডলি বলে, সুমিতা খুঁজে পেয়েছিল। আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, তোর জামার বোতাম হারিয়ে গেছিল।
ঠাম্মা বসিয়ে দিয়েছিল।
ঝিনুকে সঞ্জনার পা কেটে গেছিল।
আমরা শিয়ালকাঁটার হলুদ রস লাগিয়ে দিয়েছিলাম।
এখানে আমরা এলাটিন বেলাটিন খেলতাম।
তুই কোনওদিন আমার দলে পড়িসনি।
আর তুই রোজ আমাকে চাইতিস।
তুই চাইতিস না?
কী জানি! ডলি পেছন থেকে আমার হাতটা ধরে।
ওর নরম আঙুলগুলো আঙুলে জড়িয়ে বলি, এখানে তুই আমায় কাঁদিয়েছিলি।
আমি কাঁদিনি?
আমি ঘুরে ডলির সামনে গিয়ে দাঁড়াই।
কোথায় যেন পাখি ডেকে ওঠে। ঝিলের জলে মাছ ঘাই মারে। একটা ছোটো ডিঙি দোল খায় ওপারে। শিরশিরে হাওয়া বইছে। মানুষ চলাচল বেড়েছে। আগে এত মানুষ যেত না। সাইকেল বাইক সবই যাচ্ছে। এলাকাটার বেশ গুরুত্ব বেড়েছে মনে হচ্ছে।
আমরা ঝিলের জলের দিকে তাকিয়ে শৈশব কৈশোরকে খোঁজার চেষ্টা করছি যেন। কচুরিপানা ভাসছে জলে। দেখতে দেখতে বলি, ভেলায় চড়ার কথা তোর মনে পড়ে?
আমার আঙুলগুলোয় চাপ দিয়ে ডলি বলে, পড়বে না আবার! কী যে ভয় করত! খালি মনে হতো এবার পড়ে যাব, পড়ে যাব।
অমিতা তোকে ধরে থাকত।
হ্যাঁ। সমরকাকু সিগারেট খেতে খেতে আমাদের দেখতেন।
জানিস, অমিতা সু্যইসাইড করেছে।
কী বলছিস!
হ্যাঁ। ডলি অদ্ভুত ভাবে চুপ। কিছু ভাবছে।
আমার ফোন বেজে উঠল। পকেট থেকে বার করে দেখি চন্দ্রিমার ফোন।
হ্যালো, বলো।
স্যার, কাল আমি পড়তে যাব না।
কেন?
স্যার, বনগাঁ যাব মেজকাকার বাড়ি।
ঠিক আছে।
থ্যাংক যু স্যার। লাইন কেটে গেল।
পাশের অশ্বত্থ গাছের বসন্তের ঝরাপাতা ঘুরতে ঘুরতে পড়ছে। ছুপছুপ শব্দ হচ্ছে। ডলির চুল থেকে হালকা সুবাস ভেসে আসছে। এখন আর বয়েজ কাট করে না। স্টেপ কাট। কপালে টিপ পরে না। চুলের গোড়ায় সামান্য সিঁদুরের দাগ। অনেক প্রশ্নই মনে জেগে ওঠে। হার্ট হতে পারে ভেবে কিছু বলি না।
এভাবেই অনন্ত সময় কেটে যায়। ডলি বলল, আর কাকু?
বোধহয় এখানে নেই।
চল, ফেরা যাক। অনেকটা রাত্রি হল।
চল।
ডলি আমার সামনে মুখ তুলে প্রশ্ন করে, আবার কবে দেখা হবে?
ওর তেলতেলে গোল মুখ চকচক করছে। ধনুকের মতো চওড়া ভ্রুর তলায় ঝকঝক করছে দুটি আয়ত হরিণী চোখ।
রবিবার সন্ধ্যায় আবার আসব। এখানে বসে মুড়ি চানাচুর খাব আর গল্প করব।
ঠিক আছে। মুড়ি চানাচুর। একটু আমতেল দিয়ে টিফিন কৌটোয় ভরে আনব।
আমরা হাঁটতে লাগলাম।
ডলি বলল, আমরা উলটো রাস্তা দিয়ে ফিরব। রেশন দোকানের পাশ দিয়ে বেরোব।
চল।
সমরকাকুর বাড়ির পাঁচিলের পাশ দিয়ে হাঁটছি। কত জায়গায় চুন সুড়কির পলেস্তারা খসে ইট বেরিয়ে এসেছে। আমরা একটু দূরত্ব রেখে হাঁটছি। কেউ কোনও কথা বলছি না। কী ভাবছি জানি না। কেন কথা বলছি না তাও জানি না।
একটু এগোতেই কীসের যেন একটা হইচই ভেসে এল। থমকে দাঁড়িয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। ডান দিকে টার্ন নিতেই দেখলাম কয়েকটা লরি দাঁড়িয়ে অনেক মানুষজন গাড়িগুলোকে ঘিরে দাঁড়িয়ে
ডলি বলল, ফিরে চল।
বললাম, চল না, ব্যাপারটা কী দেখি।
এগোতে এগোতে দেখলাম ঝিলের এপাশটা অনেকখানি ভরাট হয়ে গেছে।
ডলি অবাক হয়ে বলে, সে কী রে! ঝিল বোজাচ্ছে?
তাই মনে হচ্ছে।
অনেক লোকের কথাকাটাকাটির মধ্যে আমরা লরিগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওরা চিত্কার করছে আমরা হতে দেব না। মাটি ফেলা চলবে না। ওসব দাদাগিরি হাঠাও। সব লরি আটকে রাখব। আগুন জ্বালিয়ে দেব।
ডলি আমার হাত টেনে ধরে বলল, পিকুন, যাস না।
দাঁড়া, ব্যাপারটা বুঝতে দে। ডলি আমার গা ঘেঁসে দাঁড়ায়।
একটি ২০-২২ বছরের ছেলে এসে বলে, পিকুনদা, আপনারা চলে যান। দাঁড়াবেন না।
কেন? কী হয়েছে?
ঝিল বুজিয়ে ফ্ল্যাট হবে।
ক্রমশ…