অবশেষে সিকিম যাওয়ার সময় হয়ে এল। সাতদিনের প্রোগ্রাম। ধ্রুব নম্রতা এবং আশাকে সঙ্গে নিয়ে রাতের ট্রেনে পাড়ি দিল সিকিমের উদ্দেশ্যে। ট্রেন থেকে সকালে শিলিগুড়িতে নেমে গাড়িতে প্রায় ছয় ঘণ্টার জার্নি। ধ্রুব অবশ্য সব আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিল। ছয় ঘণ্টা জার্নির পর ধ্রুবরা গ্যাংটকের হোটেলে পৌঁছাল। ধ্রুব এবং আশার মেজাজ ফুরফুরে হলেও নম্রতার মুড বেশ অফ। সেটা ধ্রুবর দৃষ্টি এড়ায়নি। নম্রতা-রা একদিন গ্যাংটকে থাকার পর লাচেন এবং লাচুং-এর উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

সারাদিন ঘুরে বেড়িয়ে লাচুং-এর হোটেলে দ্বিতীয় দিন রাত্রে ধ্রুব নম্রতার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করল। আশা বাচ্চা মেয়ে সারাদিন বেড়ানোর ফলে তার শরীর ক্লান্ত ছিল। বিছানায় শুতেই সে বেঘোরে ঘুমিয়ে পড়ল। রাতের খাবার খেয়ে নম্রতা হোটেলের ঘরের লাগোয়া বারান্দায় নীরবে দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবছিল। পাহাড়ের বুকে তারাগুলো জোনাকির মতো জ্বলছে। রাত্রের নিস্তব্ধতায় পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনার জলের শব্দ, নীচে খরস্রোতে বয়ে চলা লাচুং নদীর শব্দ যেন শান্ত মনকে উত্তাল করে তুলছে। বরফাবৃত উত্তুঙ্গ হিমালয়, রাতের প্রশান্ত আকাশকে যেন চুম্বন করতে চাইছে। ধ্রুব বিছানা ছেড়ে নম্রতাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, এত ঠান্ডায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছো কেন? ঘরে শোবে চলো।

—তুমি শুয়ে পড়ো। অযথা সময় নষ্ট কোরো না।

—সময় নষ্ট! এই প্রথমবার আমি সময়ে সদ্ব্যবহার করছি। তোমাকে একা ফেলে আমি ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যেতে পারব না তা তুমি ভালো করেই জানো। তোমাকে আমি ভালোবাসি।

ধ্রুবর হাত ছাড়িয়ে একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে নম্রতা উদাস কণ্ঠে বলল, ভালোবাসার সংজ্ঞাটা যে ঠিক কি সেটাই আমি এখনও বুঝে উঠতে পারি না। কেউ আমাকে সত্যিই ভালোবাসতে পারে সে বিশ্বাসও আমি করি না।

—তার মানে তুমি বিশ্বাস করো না যে আমি তোমাকে ভালোবাসি। তাই তো! আমাকে আমার ভালোবাসার প্রমাণ দিতে কী করতে হবে তাই বলো।

—আমি তোমাকে কিছু প্রমাণ দিতে বলছি না। যার প্রমাণ দেবার কথা, সে তো বিনা প্রমাণেই অনেক কিছু প্রমাণ করে দিয়ে গেল।

ধ্রুব নম্রতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার দুটো হাত জড়িয়ে ধরে বলল, কী হয়েছে তোমার! আমার সঙ্গে কি কিছু শেয়ার করা যায় না! আমি কি এতটাই তোমার অযোগ্য স্বামী হিসেবে! আচ্ছা নম্রতা, স্বামী হিসাবে নয়, বন্ধু হিসাবে তো তুমি আমাকে তোমার মনের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা শেয়ার করতেই পার। বিয়ে হওয়ার পর থেকে আমি বুঝি তুমি কষ্ট পাচ্ছো কোনও কারণে। তোমার অতীত আমি কোনওদিন জানতে চাইনি। আজ বড়ো জানতে ইচ্ছে করছে। আমাদের একটা মেয়ে আছে। তার কথা ভেবে আমাদের দাম্পত্যের দূরত্ব ঘোচাতে হবে নম্রতা। আমি আর পারছি না।

ধ্রুবর কথা নম্রতা এড়িয়ে গিয়ে বলল, রাত অনেক হল। চলো ঘরে।

ধ্রুব বলল, তুমি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছ!

নম্রতা বলল, এড়িয়ে যাচ্ছি না। এসব কথা বলার সময় এটা নয়। আর তাছাড়া তুমি কি আশার মতো বাচ্চা নাকি! আমি আশার জন্য এখানে বেড়াতে এসেছি। বিয়ে এত বছর পর সিকিমে এসে আমরা নিজেদের নিয়ে আলোচনা করতে আসিনি। আফটার অল, আমি এসব নিয়ে কখনও ভাবিনি। দাম্পত্য, প্রেম, ভালোবাসা আমি তোমার থেকে কিছু চাইছি না। এই সহজ কথাটা বুঝতে এত সময় লাগছে কেন! আমি এই পৃথিবীতে কারওর কাছে কিছু প্রত্যাশা করি না। প্রত্যাশা বড়ো আঘাত দেয়। কথা শেষ করে নম্রতা বিছানায় চলে গেল।

ধ্রুব কিছুক্ষণ পর বিছানায় নীরবে নম্রতার পাশে শুয়ে পড়ল। পাশে শুয়ে সে টের পেল নম্রতা চোখের জলে বালিশ ভেজাচ্ছে। মাঝে মাঝে নম্রতা কাঁদতে কাঁদতে ফুঁপিয়ে উঠছে। স্ত্রীর চোখের জলের কারণ খুঁজে না পাওয়ায় স্বামী হিসাবে ধ্রুবর নিজেকে বড়ো অসহায় মনে হল।

নতুন সকাল আসে নতুন একটা দিনের সূচনা করতে। রাতের সব কালিমাকে এক নিমেষে মুছে দিয়ে জীবনকে আলোকিত করতে। পাহাড়ি সূর্যটাও নম্রতার রাতের মলিন মুখটাকে তার রাঙা আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে। নম্রতার সারা মুখে ছড়িয়ে আছে স্নিগ্ধতার মাধুর্য। বারান্দায় কফি মগ হাতে নিয়ে সে, আশার সঙ্গে গল্পে মশগুল। রাত্রের নম্রতার সঙ্গে এই মানুষটার আকাশ-পাতাল তফাত। ধ্রুব মাঝেমাঝে আশা এবং নম্রতাকে তাড়া লাগাতে থাকে তৈরি হওয়ার জন্য। আধ ঘণ্টার মধ্যেই তারা লাচেনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবে। নির্দিষ্ট সময়মতো ড্রাইভার এসে হাজির।

পাহাড়ি সর্পিল পথ বেয়ে গাড়ি লাচুং ছেড়ে ছুটল লাচেনের উদ্দেশ্যে। চোপতা উপত্যকা, কালাপাহাড় দেখিয়ে ধ্রুবদের গাড়ির ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে চলল গুরুদোংমার লেকের পথে। গাড়ি যত পাহাড়ের উপর উঠতে থাকল চোখে পড়ল শুধু সোনালি ধূসর পাহাড়। গাছপালা প্রায় নেই বললেই চলে। ভারতীয় সেনাদের এলাকা অতিক্রম করে গাড়ি ছুটল গুরুদোংমার লেকের দিকে। একদিকে নীচে পাহাড়ের গা বেয়ে লাচেন নদী খরস্রোতে বয়ে চলেছে অন্যদিকে রুক্ষ বিস্তৃত প্রান্তর।

উন্নতশির পাহাড়ের মাথায় সাদা বরফের মুকুট যেন আলাদা শোভাবর্ধন করছে। পাহাড়ি রাস্তার দুধারে মনে হচ্ছে কেউ যেন বরফের গুঁড়ো ছিটিয়ে রেখেছে। গাড়ির চাকা বরফ গুঁড়ো করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে। অদূরে পাহাড়ের গা থেকে নেমে আসা ঝরনার জল বরফে জমাট বেঁধে যেন থমকে গেছে।

আশা বাবা-মার সঙ্গে এই বেড়াতে আসাটা খুব উপভোগ করছে। নম্রতার বর্তমান কখনও কখনও তার অতীতকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। ধ্রুব নম্রতার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করতে চাইলেও পারছে না। নম্রতার ক্ষণে ক্ষণে মুড অফ হয়ে যাচ্ছে। বিস্তীর্ণ পাহাড়ি পথ পিছনে ফেলে গাড়ি এসে পৌঁছোল গুরুদোংমার লেকে। লেকে ঘুরতে ঘুরতে নম্রতার অন্যমনস্কতার জন্য একজন লোকের সঙ্গে জোরে ধাক্কা লাগল। নম্রতার সঙ্গে ধাক্কা লাগায় লোকটির হাত থেকে জলের বোতলটা ছিটকে পড়ে গেল। নম্রতা বোতল তাড়াহুড়ো করে কুড়িয়ে লোকটির হাতে তুলে দিয়ে বলল, সরি। আমি আসলে বুঝতে পারিনি।

নম্রতা লোকটির চোখের দিকে তাকাতেই তার মাথায় তুলে রাখা রোদচশমা চোখে পড়ে ভারিক্কি গলায় বলল, ইটস ওকে। সাবধানে চলবেন তো। কথা শেষ করে লোকটি ঝড়ের গতিতে গাড়িতে ওঠার জন্য পা বাড়াল। লোকটির চোখ, হাঁটাচলা, ওই ভারী কণ্ঠস্বর নম্রতার খুব পরিচিত মনে হল।

লোকটির পিছন পিছন ছুটতে ছুটতে সে ডাকল, এই যে শুনছেন। একটু দাঁড়ান। নম্রতাকে ছুটতে দেখে ধ্রুব সামনে এসে দাঁড়াল।

ধ্রুব বলল, কাকে ডাকছ তুমি? কে ছিল?

নম্রতা ব্যাকুল গলায় বলল, আরে ওই যে ভদ্রলোক। যার সঙ্গে আমার একটু আগে ধাক্কা লাগল। ধাক্কা খেয়ে ওনার হাতে জলের বোতল পড়ে গেল।

ধ্রুব ভদ্রলোককে দেখতে না পেয়ে বলল, কেউ তো নেই ওখানে দুটো গাড়ি ছাড়া। আমাদের মতোই টুরিস্টদের গাড়ি হবে। তাড়াহুড়ো করে ভদ্রলোক ততক্ষণে গাড়ি নিয়ে ওখান থেকে কেটে পড়েছে।

আশা মায়ের হাতটা নাড়িয়ে বলল, মাম্মা, তুমি কি কাউকে খুঁজছ?

নম্রতা আনমনা হয়ে বলল, না। না তো।

ধ্রুব বলল, চলো। আমরা গাড়ির কাছে যাই। ড্রাইভার আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...