বাবার কাজ ছিল এক রং মিস্ত্রির জোগাড়ের। একটু আলসে টাইপের লোক ছিল বলেই বোধহয় সারাজীবন ওই হেল্পার-ই রয়ে গেল, মিস্ত্রি আর হতে পারল না! সঙ্গে ছিল বাংলুর নেশা। কতদিন রাতে বাবার মদ গিলে ফেরা নিয়ে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া লেগে যেত। মদখেকো বাবাকে তখন খুব ভয় করত টুম্পার। লাল চোখ আর টলন্ত দেহ দেখলেই চৌকির তলায় লুকোত টুম্পা।

আর এখন? হাসি পেল টুম্পার। তারকেশ্বর নৌশাদের মতো লোকেদের মৌজের প্রথম শর্তই আকণ্ঠ পান। আর তারপর? গা-টা কেমন পাক দিয়ে উঠল, সশব্দে ওয়াক তুলল সে। জগন্নাথ তাড়াতাড়ি জলের বোতল এগিয়ে দিল….

—কী হল মাইজি?

টুম্পা এক ঢোক জল খেয়েই তাড়া লাগায়, ‘চলো চলো জগন্নাথ! আরও কিছু দেখব যে!”

জিরাফ, গণ্ডার, হাতি খোলা জমিতে পর পর নানান পশুর মেলা দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে যায় টুম্পা! সবচেয়ে মজা লাগে জলের মস্ত চৌবাচ্চায় গলা অবধি ডোবা জলহস্তি দেখে। আরও কতক্ষণ কেটে যেত এভাবেই কে জানে, ঠিক তখনই মোবাইলটা ঝনঝন করে বেজে ওঠে।

—অউর কিতনা ঘুমোগি টুম্পা? জলদি আও! তারকেশ্বর শর্মার ধাতানিতে সম্বিত ফেরার পর টুম্পা হনহন করে ফিরতে থাকে নির্দিষ্ট আইসক্রিম কর্নারের দিকে। টুম্পাকে দেখতে পেয়েই হই হই করে ওঠে নৌশাদ, ‘আরে জগন্নাথ তুম কেয়া জঙ্গল মে মঙ্গল করনে লাগে থে?’

বিশ্রী একটা ইঙ্গিতে জগন্নাথ নামক প্রৌঢ় গাইডটির চোখ—মুখ লাল হয়ে ওঠে। লজ্জায় তাকাতে পারে না টুম্পা। নৌশাদের অবাধ্য হাত টুম্পার অফ শোল্ডার টপের ভিতর অবাধে ঘুরতে থাকে। জগন্নাথ টাকাটা নিয়ে দ্রুত হেঁটে চলে যায়। একবারের জন্যেও টুম্পার দিকে ফিরে তাকায় না। সমবেত হাসির দমকে টুম্পার চোখ অকারণে ঝাপসা হয়ে আসে। এতক্ষণ লোকটা যে তাকে মাইজি ডাকছিল সেটা মনে পড়তেই টুম্পা অন্যমনস্ক হয়ে যায়, ভাবে আজ নিশ্চয়ই লোকটা বাড়ি গিয়ে বউকে বলবে আজ একটা বাজারু অউরতের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

স্করপিও-তে উঠে এককোণে চুপ করে বসে টুম্পা। সারাটা রাস্তা নৌশাদের অসভ্যতা মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। স্টেশনে ঢুকতে বেশ দেরি হয়ে যায়। কোনওক্রমে খাবারের প্যাকেট আর প্রাপ্য টাকার খামটা হাতব্যাগে ঢুকিয়ে ট্রলিটা ঠেলে সাত নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ায় টুম্পা পুনম আর দীপ্তি। দীপ্তি, প্রথম মুখ খোলে,

শালা! চুতিয়া লোগ একদম দম নিকাল লিয়া। পুনম হেসে ওঠে!

—এ কি তোর নিজের মরদ পেয়েছিস নাকি যে হাত বুলিয়ে ছেড়ে দেবে?

—কী রে টুম্পা? ক্যায়সা লাগা তুঝে? পহলিবার চার চার মর্দকে সাথ!

টুম্পা বিরক্তি চেপে পুনমের কথা ঘুরিয়ে দেয়। ‘জলের বোতল নিবি না? ট্রেনে জল তেষ্টা পেলে।”

—আরে! জল উল সব ট্রেনে দিবে, খানাও।

—তাহলে ওরা যে প্যাকেট দিল খাবারের?

—ওটা তো কনট্রাক্ট মে ছিল! দিবে না?

ভুবনেশ্বর থেকে ‘দুরন্ত’ মেল-এ উঠল টুম্পারা। ফেরার পথটা তিনটে ভাড়া করা মেয়েমানুষকে পার্টি শুধু ট্রেনে তুলে দেবে এমনই কথা ছিল এজেন্টের সঙ্গে। নিজেরা ফিরবে সড়কপথে। ফার্স্ট ক্লাস এসির টিকিটগুলো বড়ো এলোমেলো পড়েছে। ছিটকে গেছে টুম্পা, দীপ্তি আর পুনমের কাছ থেকে। কাঁধের ব্যাগটা সামলে ছোট্ট ট্রলিটা ঠেলে টুম্পা এই প্রথমবার এসির কাঁচঘেরা কম্পার্টমেন্টে উঠল। পুনমরা থাকলে বোধহয় এতটা ভয় ভয় করত না। আসলে, আগে যে ক’বার বাইরে এসেছে ক্লায়েন্টের সঙ্গে— সবই ওই মন্দারমণি, তারাপীঠ কিংবা গাদিয়াড়া।

একটা টাটাসুমোয় বা লোকাল ট্রেনে চিড়েচ্যাপটা হতে হতে যাওয়া এবং ফেরা। পথে বাদাম চিপস আর লদকালদকী! বহু কষ্টে টিকিট মিলিয়ে নিজের সিট খুঁজে পেল টুম্পা। সাইড লোয়ার বার্থ। লং স্কার্টের উপর স্লিভলেস কুর্তি, পায়ে ফুটের দোকানের কারুকাজ করা নাগরা, ঠোঁটে চড়া মেকআপ আর বোকা বোকা চাউনি দেখেই কি উলটো দিকের সিটের লোকটা মুখ ঘুরিয়ে নিল?

হাতে ধরা তন্দুরি রুটি আর চিকেন চাপের ফয়েল প্যাকটা সিটের উপর রেখে, বাবু হয়ে বসে টুম্পা। কিন্তু এই ট্রেনের হাল হকিকৎ কিছুই তো জানা নেই, কী করবে ও?

সামনের পরিবারটির খাওয়াদাওয়া শেষ। সালোয়ার কামিজ পরা মহিলা বাচ্চাটাকে নিয়ে বাথরুম যাচ্ছে বোধহয়। টুম্পা ব্যাগ ট্যাগ ফেলে পিছু নেয়। কাচের দরজা ঠেলে বেসিনে মুখ ধুচ্ছে মহিলা। বাচ্চা মেয়েটি তিতলির বয়সি হবে, কী সুন্দর ব্রাশ করছে নিজে নিজে। টুম্পা ফিসফিস করে মহিলাটিকে জিজ্ঞাসা করে, বাথরুমটা কি ওই দিকে?

বাথরুম সেরে সিটে ফিরেই টুম্পা টের পায় খিদেয় বত্রিশ নাড়ি পাক দিচ্ছে। ফয়েল প্যাক খুলে রুটির গোছা হাতে নেয়। না! লোকগুলো দিলদরিয়া আছে! পাঁচটা রুটি, একপ্লেট কষা মাংস একটা বেশ বড়ো পান্তুয়া— গপগপ করে চিবোতে থাকে টুম্পা। খেয়ে দেয়ে প্যাকেটটা ছুঁড়ে দেয় সিটের তলায়, সামনের লোকটা ভুরু কুঁচকে তাকায় একবার। বউটা আর বাচ্চাটা উপরের সিটে উঠে ঘুমিয়ে পড়েছে। একটু আগে লোকটা পরিপাটি করে বিছানা পেতে দিল।

টুম্পা খেতে খেতে বুঝে নিল ওকেও ওই ভাবেই বিছানা বালিশ প্যাকেট থেকে বের করে নিতে হবে। ব্যাগ থেকে তুলো আর ক্লিনজার বার করে মুখটা ঘসে ঘসে পরিষ্কার করে টুম্পা, তারপর ব্যাগ হাতড়ে খামটা টেনে বার করে। পঁচিশ হাজার টাকা! তিন রাতের রোজগার! চোখ বুজে হিসেব করতে থাকে টুম্পা— তিনমাসের বাড়ি ভাড়া নয় হাজার, মাসের সওদা বাবদ গোপালদা পাবে ছয় হাজার। বাকি দশ হাজার এখন হাতের পাঁচ! গোটা মাসটা এতেই চালাতে হবে, কবে আবার ডাক আসবে জানে না টুম্পা!

মা বলে, সময় থাকতে গুছিয়ে নে! গতর আর ক’দিন? পলাশের সঙ্গে সম্পর্কটা তাই মায়ের চোখে অপরাধ ঠেকে! ভাবতে বসলে কূল পায় না টুম্পা। মা তো এককালে ছাপোষা গৃহবধূ ছিল, দুই মেয়ে আর সবেধন নীলমণি ছেলেকে নিয়ে টেনেটুনে সংসার চালাত। মনে আছে, মোড়ের মাথার মস্ত মাঠটায় শিবরাত্তিরের সময় টানা পাঁচদিন ধরে সিনেমা দেখানো চলত। শম্পা আর টুম্পা বাবাকে জপিয়ে কায়দা করে ঠিক বিকেল হলেই সেজেগুজে রেডি হয়ে যেত। বাধ সাধত শুধু মা। চিল চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলত, কিছুতেই যেতে দেবে না মেয়েদের!

শম্পার সঙ্গে পাড়ার মাস্তান বরুণদার রিলেশন তো ওই সিনেমা দেখতে গিয়েই… মনে মনে দাঁতে দাঁত ঘষে টুম্পা। শালা বরুণ! কুত্তার বাচ্চা! শম্পার পেটে বাচ্চা আসতেই পালিয়েছিল! শম্পাটাও বোকার ধাড়ি ছিল, না হলে কেউ গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ে? ভাই তখন বেশ ছোটো। কতদিন বাড়ির পিছনের সেই ছোটো আমগাছটা দেখলে ডুকরে কেঁদে উঠত।

শম্পার চলে যাওয়াটা বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। হাজার হোক প্রথম সন্তান তো! বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মানুষটা কেমন যেন অসুস্থ হয়ে পড়ল। চলাফেরা করতে পারে না। হাত পা কাঁপে। খালি মাথা ঘোরায়। প্রাইভেট কোম্পানি কতদিন এমন অথর্ব লোককে বসে বসে পুষবে? তাই চাকরিটাও একদিন নট হয়ে গেল। তারপর তো একদিন গোটা মানুষটাই ছাই হয়ে গেল। মাকে তখন প্রচুর লড়াই করতে হয়েছিল। লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করে ছেলে আর মেয়েকে বড়ো করেছিল।

টুম্পার বিয়ের পরপরই ভাইটা লোকাল বাসের কনডাক্টরি ধরল, সেই সঙ্গে বোতল। বিয়েও করল একটা। নিম্নি মেয়েটা বিহারী হতে পারে, তবে খুব একটা খারাপ নয়। মা যদি ওই হেগো কাপড় ছাড়া, এঁটো-সকড়ি— এসব নিয়ে বাওয়াল না করত!

ছেলের বাড়ি থেকে লাথি খেয়ে মা এখন মেয়ের ঘাড়ে এসে জুটেছে। যাক বাবা! টুম্পার তাতে অবশ্য সুবিধে-ই হয়েছে। মেয়েটাকে মা-বুড়ির জিম্মায় রাখতে না পারলে এ ধান্দা চালানো মুশকিল হতো টুম্পার। পলাশকে বিয়ে করলে হয়তো সব সমস্যার সমাধান হতে পারত, কিন্তু টুম্পা তা চায় না। একবার যখন বর মরেছে, ফের বিয়ে করলে আবার যে ছাড়ানকাটান হবে না, তার গ্যারান্টি কী? তার চেয়ে এই ভালো। টুম্পা কারওর বোঝা নয়! গতর খাটিয়ে খায়! মাঝে মাঝে নিজেকে নোংরা মেয়েলোক বলে মনে হয় বটে, তবে সে আর কতক্ষণ? হাতে নোট থাকলে দুনিয়াটা পায়ের তলায় থাকে, একথা জেনে গেছে টুম্পা।

হঠাৎ চটক ভাঙল টুম্পার, সামনের সিটের লোকটা কী যেন একটা বলছে। কৌতূহলী চোখে তাকায় টুম্পা। তো বউ-বাচ্চা ঘুমোতেই লাইনের মেয়েছেলেকে হিড়িক দিচ্ছে নাকি মালটা?

—দিদি, বলছি কী আলোটা একটু নেভাবেন? আমার বাচ্চা চোখে আলো লাগলে একদম ঘুমোতে পারে না। ওর মায়েরও সেই একই সমস্যা।

টুম্পার মনটা কেমন যেন হঠাৎ ভালো হয়ে যায়। পরম ভরসার গলায় বলে, ‘দাদা, আমি না আলোর সুইচটা ঠিক বুঝতে পারছি না, আপনি একটু বন্ধ করে দেবেন?” লোকটা এগিয়ে এসে সুইচ অফ করে দিতেই টুক করে নিভে যায় রাতবাতি।

রাতের ট্রেন ঝমঝম করে চলতে থাকে। কাচের জানলার বাইরে চোখ রাখে টুম্পা। আধো অন্ধকার, আধো আলোর খেলা দেখতে দেখতে ক্লান্ত দু’চোখের পাতা জড়িয়ে আসে। গায়ের চাদরটা ভালো করে টেনে নিতে নিতে একটা গোটা স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে পড়ে টুম্পা।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...