অনেকদিন পরে সেদিন বাজারে হঠাৎই রেণুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। দুহাতে দুটো ভারী থলে। খুবই বিধবস্ত মুখচোখ। বাজার করার পরিশ্রম আর অফিসে যাওয়ার তাড়া– এই দুটো মিলেজুলেই নিশ্চয় মুখে অমন ঘর্মাক্ত ও পর্যুদস্ত ছাপটা পড়েছে।

রেণু আমাদেরই প্রতিবেশী। একই পাড়ায় আমাদের দীর্ঘকালের বসবাস। আমাদের উত্তর কলকাতার এই পাড়াগুলোয় পারস্পরিক সম্পর্কগুলো এখনও যান্ত্রিক হয়ে পড়েনি। দেখা হলে কেবল সৌজন্যের হাসি হেসে আমরা সরে পড়ি না, বরং দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলে মনের ভার হালকা করি।

রেণুর সঙ্গে আমার চেনাজানা, এ পাড়ার বিয়ে হয়ে আসার পর থেকেই। আমরা প্রায় সমবয়সি। তবে আমারও বছর দুই আগে ওর বিয়ে হয়। মফস্সলের মেয়ে। আমার মতোই। তবে খাস কলকাতায় এসেও দিব্যি মানিয়েগুছিয়ে নিয়েছে। মনে আছে, আমার বিয়ের সময় স্বেচ্ছাসেবা দেওয়ার জন্য পাড়ার যে ব্যাটেলিয়ান তৈরি ছিল, তার পুরোভাগে ছিল রেণু। হালকা পাখির মতো পায়ে কতবার তাকে একতলা-দোতলা করতে দেখেছি। খলবল করে গোটা অনুষ্ঠানবাড়িটা যেন মাতিয়ে রেখেছিল।

অতএব, প্রাণোচ্ছ্বল রেণুকে যথেষ্ট বিষণ্ণ দেখে আমি কৌতূহল চাপতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে গো?’

আমার প্রশ্নটাও শেষ হতে পায়নি, রেণু যেন উছলে পড়ল, ‘আর বোলো না কল্পনা। আমি খুব ঝামেলার মধ্যে আছি।’

‘কী ঝামেলা?’ আমি এবার সত্যি অবাক হই।

‘কী ঝামেলা, কী বলব! আমার শাশুড়ি একেবারে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছেন ভাই। হাড়মাস কয়লা হয়ে গেল। এখন অফিস করব, নাকি এইসব ঝামেলা সামলাব, তাই বুঝতে পারছি না!’

রেণুর শাশুড়ির ছবিটা তক্ষুণি চোখের সামনে ভেসে উঠল। ভদ্রমহিলা বিধবা। কিন্তু ষাটের কোঠা পেরিয়ে গিয়েও বেশ সুস্থ, সুঠাম। আর ভদ্রমহিলার ব্যাপারে সেটাই প্রথমে নজর কাড়ে।

বছরপাঁচেক আগে রেণুর স্বামী রজতদা হঠাৎ-ই তার মাকে বর্ধমানে দেশের বাড়ি থেকে শহরে নিয়ে আসেন। তখন একসঙ্গে অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছিল আসলে। তার কিছুদিন আগেই রজতদার পিতৃবিয়োগ হয়েছে। ফলে দেশের বাড়িতে তার মা একেবারেই একা হয়ে পড়েছেন। আবার এদিকেও দুই ছেলে সামান্য বড়ো হয়ে যেতে রেণু চাকরি করার তাল ঠুকছে। অর্থাৎ উভয়েরই তখন পরস্পরকে প্রয়োজন।

সেই থেকে রজতদার মা এই পাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেলেন। বর্ধমানে সকলে ওকে বড়োমা বলে ডাকত। আগেকার যৌথ পরিবারে এ ধরনের প্রথা ছিল। পাড়াতেও সেই নামটাই স্থায়ী হয়ে গেল। অন্তত দুটো ভিন্ন প্রজন্ম এখন রজতদার মাকে ওই নামেই ডাকে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘বড়ো-মার কথা বলছ? বড়ো-মা কী করেছে?’

‘সেসব নিজের চোখে না দেখলে তুমি বিশ্বাস করবে না কল্পনা,’ রেণু বলল, ‘বরং নিজেই এসে একদিন দেখে যাও। সমীরদাকেও সঙ্গে এনো। আমি চলি, আমার আবার ওদিকে অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। সব দিকেই তো বিপদ–!’

নিজের মনে গজগজ করতে করতে লম্বা পা ফেলে বাজারের বাইরে চলে গেল রেণু। আমি ওর থলে হাতে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে পড়া শরীরের চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলাম।

সংসার থাকলে তার নিজস্ব এক ব্যস্ততা থাকবেই। সেই জীবনে আমিও ব্যস্ত। ব্যস্ততা শুরু হয় ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই। মাথার পাশের বেডসাইড টেবিলের উপর মোবাইল ফোনে অ্যালার্ম দেওয়া থাকে। কেবল আমারটাতেই নয়, সমীরেরটাতেও। পাছে একবারের অ্যালার্মে পাকা ঘুম না ভাঙে, তাই এই ব্যবস্থা।

অ্যালার্ম বেজে উঠলে আমিও ধড়ফড় করে উঠে বসি। সমীর অবশ্য তারপরও আধঘণ্টা বিছানা ছাড়ে না। ওর চাই জ্যান্ত এবং প্রহারকারী অ্যালার্ম। অর্থাৎ আমি। কিচেনে সকালের ভাতটা চাপিয়ে, আঁচলে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে আমি যতক্ষণ না মশারি তুলে গলা ঝাঁঝিয়ে দুহাতে ঠেলা দিয়ে তাকে জাগাব, ততক্ষণ ওঠার নামও নেবে না সে। আমাদের ছেলেকে তামিলনাড়ুর এক আবাসিক স্কুলে দিয়েছি। ফলে কাউকে স্কুলের বাসে উঠিয়ে দেওয়ার ঝঞ্ছাট থেকে আমরা মুক্ত। কিন্তু দুজনেই অফিস যাই। ফলে সেজন্য প্রস্তুতিও নিতে সময় লাগে। শুধু সকালের খাবার তৈরি করলেই তো কাজ ফুরিয়ে যায় না। দুজনের লাঞ্চ তৈরি করে টিফিন বক্সে ভরার ব্যাপার আছে। তারই মধ্যে সবজিওলা এসে দরজায় হাঁকডাক করবে। ছুটির দিন ছাড়া বাজারে যাওয়া হয় না, ফলে এরাই ভরসা। প্রায় একই সময়ে চলে আসবে টুনির মা। সে প্রায় দশহাতে গোটা বাড়িতে দাপিয়ে বেড়ায় পরবর্তী পৌনে একঘণ্টা। একটা সাইক্লোন যেন ফোঁসফোঁস করে তোলপাড় তুলে দরজা খুলে অন্য কোনও বাড়ির দিকে উড়ে যায়। সকালটা যেন অগ্নিগর্ভ হয়ে থাকে।

এতকিছু সামলে বড়ো-মার কথাটা মন থেকে বেমালুম যেন উবে গেছিল। কোনও কোনও ছুটির দিনে বা সন্ধের অবসরে, টেলিভিশনে কোনও একঘেয়ে অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে হঠাৎ করে মনে পড়ে গেলেও শরীর জোড়া ক্লান্তি দূরতিক্রম্য হয়ে দাঁড়াত।

রেণুদের বাড়ি আমাদের গলিটার ঠিক মুখে। খুব বেশি হলে হেঁটে আমাদের বাড়ি থেকে দু-মিনিটের রাস্তা। তবু আলস্য যেন দু-পা চেপে ধরত, অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পর। রেণুকেও তারপর অনেকদিন বাজারে দেখিনি। আগে মাঝেমধ্যে সকালে অফিসযাত্রীদের বাসে ওকে দেখতে পেতাম। এখন বোধহয় রেণু অন্য কোনও ব্রাঞ্চে ট্রান্সফার হয়ে গেছে। কাজেই রুট বদল হয়ে গেছে তার।

পাকেচক্রে রেণুর কথাগুলো আমি হয়তো ভুলেই যেতাম। কিন্তু এক সন্ধ্যাবেলার একটা ঘটনা আমাকে আবার রেণু ও বড়ো-মার প্রসঙ্গ মনে পড়িয়ে দিল।

আমাদের বাড়ির কাছেই থাকে সোহিনীরা। পাশের পাড়ার মেয়ে। বিয়ে হয়ে আমাদের পাড়ার বাসিন্দা হয়। ছোটো ছোটো দুটি বাচ্চা আছে। ইংরেজিতে এমএ করার পর বাড়িতেই কিছু ছাত্রছাত্রীকে টিউশন দিত। কিন্তু দেখা হলেই বলত, ‘আমার চাকরি করার কী ভীষণ ইচ্ছা, জানো কল্পনাদি! কত অফার পাচ্ছি, ভাবতে পারবে না। কিন্তু নিতে সাহস হচ্ছে না। বাচ্চাদুটো তো ছোটো! কী করি বলো তো?’

ওর আগ্রহ আর হতাশার কথা শুনে চুপ করে থাকা ছাড়া আমার আর কিছু করার থাকত না। মেয়েদের জীবনটাই যে একছাঁচে গড়া। যেখানে আমার জীবন, সোহিনীর জীবন, আর-একটা মেয়ের জীবন মিলেমিশে একাকার।

শেষে সোহিনী নিজেই বলত, ‘ভাবছি কত তাড়াতাড়ি ছেলেদুটো একটু বড়ো হয়ে যাবে। কষ্ট করে লেখাপড়া শিখলাম, সে কি শুধু

সংসারের হেঁসেল ঠেলা আর বাচ্চাদের মানুষ করার জন্য? তুমিই বলো কল্পনাদি!’

আমি ম্লান হেসে ওকে স্ত্বান্না দিতাম, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখিস!’

তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। বাচ্চাদুটি এতদিনে নিশ্চয় একটু বড়ো হয়েছে। যদিও এখনও স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি ওদের। এইসময় হঠাৎ একদিন দুপুরে সোহিনী আমাদের বাড়িতে এল।

বেশ খুশি-খুশি দেখাচ্ছে ওকে। হাতের বড়ো ঝোলায় একটা কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে। সম্ভবত কোনও বাক্স। আমাকে ধরে, ‘কল্পনাদি, ও কল্পনাদি, সুখবর আছে’ বলে একপাক নেচে নিল সোহিনী। তারপর ঝোলা থেকে বেশ বড়োসড়ো একটা মিষ্টির প্যাকেট বের করে ঢাকনা খুলে আমার সামনে ধরে বলল, ‘নাও মিষ্টি খাও–!’

আমি নিচ্ছি না দেখে ও ফের বলল, ‘কী হল কী, নাও–!

ইতস্তত করে একটা হাতে নিই, কিন্তু আমার ভুরুর ভাঁজ মেলায় না। চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করি, ‘ব্যাপারটা কী’ আমায় খুলে বল তো! তোরা কত্তা-গিন্নিতে মিলে আবার কোনও তৃতীয় জনকে পৃথিবীতে আনার মতলব কষেছিস নাকি? পরিবার পরিকল্পনার এ যুগেও? তোদের তো সাহস খুব!’

সেইসঙ্গে আমার মেয়েলি সন্ধানী চোখ সোহিনীর শরীরে হেঁটে বেড়ায়। এখনও গর্ভধারণের কোনও চিহ্ন ওর শরীরে দৃশ্যমান নয়।

ডাইনিং টেবিলের উপর মিষ্টির প্যাকেটটা সযত্নে রেখে দিয়ে সোহিনী ঘুরে দাঁড়াল। তারপর বিচিত্র এক মুখভঙ্গি করে বলল, ‘দেখেছ? এই হচ্ছে তোমাদের মতো নিপাট হাউসওয়াইফের দোষ। ওইটা ছাড়া আর অন্য কিছু ভাবতে পারো না। হরাইজনটা আসলে ছোটো হয়ে আসে।’

বিরক্ত মুখে বললাম, ‘যা, যা, মেলা বকিসনি। কী খবর, সেটাই খোলসা করে বল ঢং না করে–!’

আমার দু-কাঁধে চাপ দিয়ে সোফায় বসিয়ে সোহিনী আদুরে গলায় বলল, ‘বলছি, বলছি দাঁড়াও।’

তারপর আমার পাশে বসে পড়ে বলল, ‘তুমি তো জানো, আমার একটাই স্বপ্ন ছিল। চাকরি করব।’

‘ও, চাকরি পেয়েছিস বুঝি?’

‘আলবত। হেঁজিপেঁজি চাকরি নয় গো। মালটিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি। ভালো মাইনে দেবে। এবার আমিও সকালবেলা নাকেমুখে কোনওরকমে গুঁজে বড়োরাস্তার দিকে ছুটব। ঠিক নটায় বাসস্ট্যান্ডে কোম্পানির বাস এসে দাঁড়াবে। এসি বাস। আমায় তুলে নিয়ে হুস করে…!’

হাতের মুদ্রায় সোহিনী ‘হুস’ করে চলে যাওয়াটা কেমন, সেটা দেখায়। নতুন প্রাণস্ফূর্তিতে ও যেন মত্ত হয়ে আছে। দু-চোখ জুড়ে স্বপ্নপূরণের আনন্দ ঝিলিক দিচ্ছে।

হঠাৎ-ই বলল, ‘জানো কল্পনাদি, চাকরিটা হয়ে যাবে বলে কনফার্মেশনটা যে-মুহূর্তে পেয়েছি, অমনি শপিং মলে গিয়ে এক্বেবারে নতুন ডিজাইনের পাঁচটা চুড়িদার-কামিজ কিনে এনেছি। শাড়ি পরে তো আর এত দৌড়ঝাঁপ করা যায় না। মাঝেমধ্যে শাড়ি পরব। অফিসের কোনও অনুষ্ঠানে। কিংবা ধরো চুড়িদার পরতে পরতে একঘেয়ে লাগলে তখন। স্বাদবদলের জন্য।’

আমি কী বলি তা শোনার জন্য একগাল হিরের টুকরো ছড়ানো হাসি নিয়ে সোহিনী আমার দিকে চেয়ে রইল।

আমি গম্ভীর স্বরে বললাম, ‘সবই তো ঠিক আছে। কিন্তু বাচ্চারা? ওদের কি প্রেপ স্কুলে ভর্তি করে দিলি, নাকি কোনও ক্রেশ?’

সোহিনী হাসি ধরে রেখে বলল, ‘ক্রেশ কেন? বড়ো-মা আছে তো!’

নামটা শুনে আমি চমকে উঠলাম। ‘বড়ো-মা? বড়ো-মা এর মধ্যে আসছে কী করে?’

সোহিনীর মুখ থেকে হাসি মুছে গেল এইবার। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ওমা, তুমি জানো না?’

আমি অবাক হওয়া মুখ দুপাশে নেড়ে জবাব দিলাম, ‘না!’

সোহিনী বোধহয় আমার চেয়েও বেশি অবাক হল।

অবিশ্বাসীর হাসি হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘সত্যিই জানো না? তুমি কী গো? তুমি কি এ পাড়ায় থাকো?’

আমার মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছিল। অনেকদিন আগে বাজারে দেখা রেণুর উদভ্রান্ত মুখটা মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল, প্রতিশ্রুতি দিয়েও শেষ পর্যন্ত রেণুদের বাড়িতে যাওয়া হয়নি ব্যস্ততার জন্য। আমি কৌতূহল দমন করে বললাম, ‘হ্যাঁ, বাজারে একদিন রেণুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ও তাড়ায় ছিল। সবটা খুলে বলতে পারল না। আমিও আর পরে জানতে চাইনি। মনে হল, বড়ো-মাকে নিয়ে ওরা খুবই ব্যতিব্যস্ত।’

‘দূর! রেণুদির কথা ছাড়ো তো! ওদের বড্ড বাড়াবাড়ি! আরে বড়ো-মা যা করছেন তাতে, আমাদের মতো মেয়েরা ওর কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে। রেণুদি এত কথা বলছে তো! রেণুদির নিজের কত সুবিধা হয়েছে বড়ো-মা এখানে থাকায়, সে-কথা কি একবারও রেণুদি স্বীকার করে?’

সোহিনী রীতিমতো ফোঁস করে ওঠে। মনে হল যেন, বড়ো-মার বিরুদ্ধে রেণুর অভিযোগ, সরাসরি সোহিনীর গায়ে গিয়েই লেগেছে। ফলে বেরিয়ে পড়েছে পাড়াতুতো রাজনীতির দাঁত-নখ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘বড়ো-মার কথাটাই বল। উনি তোকে কীভাবে…!’

সোহিনী আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘রেণুদিদের বাড়িটা তো ফাঁকাই পড়ে থাকে সারাদিন। ওরা তো কত্তাগিন্নি দুজনেই অফিসে যায়। বড়ো-মা পাড়ার বাচ্চাদের সে সময়টা সামলান। সকলেই এ-পাড়ার বা পাশের পাড়ার চাকরি করা মহিলাদের সন্তান। শুনেছি, বাচ্চাদের পাল্সটা উনি খুব ভালো বোঝেন। প্রচুর যত্নআত্যি করেন। এখন তো সকলেই বাচ্চাদের রাখার জন্য ওঁর কাছে দৌড়োচ্ছে।’

বড়ো-মার কীর্তিকলাপের কথা শুনে আমার তো চোখ কপালে উঠেছে। রেণুর অভিযোগটা তাহলে নিতান্ত অন্যায্য নয়।

সোহিনীর কথা তখনও শেষ হয়নি। সে খুব রুষ্ট মুখে বলল, ‘বড়ো-মা আর নতুন কাউকে নিচ্ছে না জানো! ডিমান্ড তো খুব! আমি নেহাত পাড়ার বউ। তাই না করতে পারল না।’

সোহিনী বেশ খানিকক্ষণ গল্প করে চলে গেল। কিন্তু আমার ভাবনায় বড়ো-মা ঢুকে পড়লেন। রেণু এবং ওর স্বামী রজত– দুজনেই ভালো চাকরি করে। বড়ো-মাকেও যে তারা অবহেলা করে, এমন নয়। তাহলে বড়ো-মার কী উদ্দেশ্য সাধিত হচ্ছে এহেন কার্যকলাপের মাধ্যমে? কী প্রমাণ করতে চান উনি? ছেলে আর বউমাকে সকলের চোখে এমন খাটো করে দেখানোর ভাবনাই বা তার মাথায় চেপে বসল কেন হঠাৎ?

সন্ধেয় সমীর বাড়ি ফিরতে ওকে প্রথমেই সোহিনীর জানানো কথাগুলো বলেছি। শুনে প্রথমে সে অবাক হল। তারপর মুখটা বিকৃত করল একটু। শেষে ভুরুতে সেই যে ভাঁজ পড়ল, সে ভাঁজ আর সিধে হল না।

খানিকক্ষণ গুম মেরে বসে থেকে সমীর বলল, ‘আমায় তুমি তো খুব চিন্তায় ফেলে দিলে কল্পনা। ছোটোবেলায় আমি আর রজত হরিহর আত্মা ছিলাম। এখনও আমাদের মধ্যে যথেষ্ট বন্ধুত্ব। তাই ওর ব্যথাটা আমার বুকে বড়ো লাগছে!’

আমি চুপ করে আছি দেখে, সমীর আমাকেই পালটা প্রশ্ন করল, ‘কী দরকার ছিল বলো তো বড়ো-মার এমন সব পাগলামো করার? এতে সমাজের সমালোচনার আঙুল যে ওরই ছেলে-বউমার দিকে উঠবে, একথা কি একবারও উনি ভাবলেন না?’

‘আমার কী মনে হয় জানো?’ আমি বলি, ‘আমাদের দুজনের একবার ওদের বাড়িতে যাওয়া উচিত। বড়ো-মাকে বোঝানো উচিত। উনি যেটা করছেন, সেটা ঠিক করছেন না। তুমি বোঝালে হয়তো উনি তার মূল্য দেবেন!’

সমীর মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল, ‘দেখা যাক।’

সেই সপ্তাহেই একদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে সমীর অন্য কোনও কারণে। সম্ভবত শরীরটা তার ভালো ছিল না সেদিন। দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়ার পর বলল, ‘চলো বড়ো-মার কাছ থেকে ঘুরে আসি।’

দুপুর দুটো বাজে। সদর দরজা খোলাই ছিল। আমরা দোতলায় উঠতেই বাচ্চাদের নানারকম গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। রেণুদের ড্রয়িংরুমের সামনে এসে দাঁড়তেই একঝলকে গোটা ছবিটা পরিষ্কার হয়ে গেল। ঘর জুড়ে দশটি প্রায় একই বয়সি বাচ্চা। কেউ ঘুমোচ্ছে। কেউ বা দুষ্টুমি করছে। খেলনা নিয়ে খেলছে কেউ। খোদ বড়ো-মা একটি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে, দুধের বোতল থেকে দুধ পান করাচ্ছেন। আর-এক মধ্যবয়সিনি অন্য বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত।

বড়ো-মাকে দেখতে অদ্ভুত লাগছে। মুখ থেকে যেন একটা জ্যোতি বের হচ্ছে। স্নেহের বিভা। আমরা থতোমতো খেয়ে দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ মুখ তুলে আমাদের দেখতে পেয়েই বড়ো-মা উদার আমন্ত্রণ জানালেন।

‘আরে, সমীর? বউমা? এসো, এসো ভিতরে এসো। বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? মালতী একে ধর। দেখিস দুধটা যেন পুরোটা খায়।’

মালতীর হাতে কোলের বাচ্চাটিকে তুলে দিয়ে বড়ো-মা উঠে দাঁড়ালেন।

‘ও হল মালতী। সাতকুলে কেউ নেই ওর। তাই জুটে গেল। একা একা এতগুলো বাচ্চাকে সামলানোর বয়স কি আর আছে?’

বড়ো-মা আমাদের ভিতরের ঘরে নিয়ে গেলেন। সমীর সোফায় বসে বলল, ‘আপনি তো রীতিমতো ক্রেশ চালু করে দিয়েছেন দেখছি বড়ো-মা!’

বড়ো-মা তৃপ্তির হাসি হাসলেন। মালতীকে ডেকে বললেন, ‘তোমার হাত খালি হলে ফ্রিজ থেকে মিষ্টি নিয়ে এসো তো মালতী!’ তারপরই আমাদের দিকে ফিরলেন, ‘খুব ভালো লাগে জানো। মনটা পবিত্র হয়ে যায়। বয়স তো হল। পরমার্থের সন্ধান করার এখনই তো প্রকৃষ্ট সময়।’

আমি জানতে চাইলাম, ‘আপনি হাঁফিয়ে পড়েন না? এতগুলো বাচ্চাকে সামলানো তো মুখের কথা নয়। তাই না?’

‘দ্যাখো, নিজের নাতি-নাতনিদের জন্যও কি কম দৗড়ঝাঁপ করেছি? এক-একটার আবদার শুনলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। এখন তবু মালতী আছে। তখন তো আমি একা। ওরা দুজন চলে যেত অফিসে, সারাদিনের মতো। এখন নিজের নাতি-নাতনি বড়ো হয়ে গেছে। তাই ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ করছি আর কী! এদেরকেই নাতি-নাতনি বানিয়ে ফেলেছি। জানো, ওদের মায়েরা বলে, বাচ্চাদের অনেকে নাকি রাতেও বায়না ধরে, বড়ো-মার কাছে শোবো। বোঝো অবস্থা!’

বড়ো-মার মুখটা একথা বলতে গিয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

সমীর জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা-মায়েরা এদের নিয়ে যায় কখন?’

‘সন্ধে ছটার মধ্যে গোটা তল্লাট ফাঁকা হয়ে যায়। মালতী সব গুছিয়ে নীচে ওর ঘরে চলে যায় বিশ্রাম করতে। রেণু আর রজতও ফিরে আসে আধঘণ্টার মধ্যে। বাচ্চারা অবশ্য তার অনেক আগেই স্কুল থেকে ফেরে।’

আমি ক্রমশ অধৈর্য হয়ে পড়ছিলাম এরকম অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা শুনে। ভাবছিলাম, কেন এতক্ষণেও আসল বক্তব্যে আসতে পারছে না সমীর। অফিসে সে সপ্তাহে দশটা মিটিং করে। তার তো মূল বক্তব্যে আসতে এত সময় লাগারই কথা নয়।

আমিই শেষে অসহিষ্ণুতাটা প্রকাশ করলাম। বললাম, ‘কিন্তু বড়ো-মা… আপনার তো এখন বিশ্রাম নেওয়ার বয়স। কী দরকার ছিল বলুন তো এসব ঝামেলা নেওয়ার? পৃথিবীতে আপনার বয়সি অনেক দুর্ভাগা নারী আছেন। যাদের ছেলেমেয়ে, বউমারা তাদের দেখে না। তারা যদি এরকম ক্রেশ খোলেন, তবু মানা যায়। তাই বলে আপনি?’

আমি একটানা ক্ষোভ উগরে দিয়ে হতাশায় মাথা নাড়ি।

তাকিয়ে দেখি, বড়ো-মার মুখ থেকে তখনও হাসি লোপ পায়নি। হ্যাঁ, ভুুরুদুটো একটু বেঁকেছে। কিন্তু ওটুকুই।

শেষে বললেন, ‘এবার তাহলে তোমায় একটা প্রশ্ন করি মা?’

আমি বিরক্ত মুখে বললাম, ‘করুন।’

‘তোমার বাবা-মা তো তোমার দাদা-বউদির সঙ্গে থাকেন। ওঁরা সুখী?’

একটা ধাক্বা লাগল ওর প্রশ্নে। মনটা নিমেষে বিষণ্ণ হয়ে গেল। আমার বৃদ্ধ বাবা ও মায়ের মুখটা ভেসে উঠল চোখের পর্দায়। ‘মা কেমন আছো’, জিজ্ঞেস করলে মা করুণ মুখটা তুলে যেভাবে বলে ‘ভালো আছি’, সেই স্তোক দেওয়ার ছবিটা মনে পড়ল। আমি জানি, মা-বাবা ভালো নেই দাদা-বউদির সংসারে। দুজনেই প্রাণপণে চেষ্টা করে চলেছেন বাস্তবের সঙ্গে আপস করার। আমি বুঝতে পারি ওরা ভালো নেই। আমরা কখনও গেলে বউদি ওদের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করার চেষ্টা করে। কিন্তু সেটা চেষ্টাই। কোনও কোনও প্রসঙ্গে, ছিটকে বের হয় বাবা-মায়ের প্রতি বউদির অশ্রদ্ধা আর নৈরাশ্য। আমরা সামনে আছি বলে বউদি দ্রুত সামলে নেয় নিজেকে, কিন্তু বাবা ও মায়ের বেদনাটা তাতে চাপা পড়ে না। বিয়ের পর সব মেয়েই বাপের বাড়ির অতিথি। অসহায় হয়ে হাত কামড়ানো ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না তখন আমার।

বাপের বাড়িতে মেয়েরা আনন্দ করতে যায়। আমি ফিরে এসে বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদি।

এই মুহূর্তে বিষণ্ণতায় আমার মনটা দ্রব হয়ে যায়। চোখদুটিও নত হয়ে আসে। মনের গভীরে কোনওমতে কান্না সামলাই।

বড়ো-মা হয়তো বোঝেন। মৃদু হেসে মাথায় হাত রাখেন। চমকে উঠে তাকাই বড়ো-মার দিকে।

শান্ত গলায় বড়ো-মা বললেন, ‘যতই লুকোনোর চেষ্টা করো, চোখের জলকে লুকোবে কী করে? বয়স্ক মানুষদের অবস্থাটা এখন এরকমই। একটা কথা বলি। তোমার নিজের উপরে যখন এরকম বৃদ্ধবৃদ্ধাদের দায় পড়বে, তখন এই চোখের জলের কথা মনে রেখো মা!’

সমীর কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু বড়ো-মা তখনই তার দিকে ফিরে বললেন, ‘আসলে কী জানো বাবা, স্বামীর উপার্জন কিংবা তার মনের উপর স্ত্রীর যতটা অধিকার, ততটা অধিকার মায়ের আর থাকে না। সেইজন্যেই আমার মনে হয়, তাদের আত্মনির্ভর হওয়াটা খুব জরুরি। আর, পরিশ্রমের কথাই যদি বলো, সেটাও অতটা গায়ে লাগে না। বাড়িতে বসে বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটানো– এই তো কাজ! অথচ দ্যাখো, আমার বউমা কত খাটাখাটনি করে–!’

বড়ো করে শ্বাস নিলেন বড়ো-মা।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর কেউ ভর্তি করতে চাইছে না বাচ্চাদের?’ ‘চাইছে তো! রোজই কত মানুষ আসে। অনেককে তো চিনিই না। এসে বলে, বড়ো-মা আমাদের বাচ্চাকেও রাখুন। মোড়ের রিকশাস্ট্যান্ডে বড়ো-মার ক্রেশে যাব বললেই, রিকশাওলা নাকি পৗঁছে দেয় এ বাড়িতে। কিন্তু আমি আর অন্য কাউকে নিতে পারব না কল্পনা। আমার তো অর্থের খুব চাহিদা নেই!’

আমরা দুজনেই প্লেট থেকে একটা করে সন্দেশ তুলে মুখে ফেলেছিলাম। মালতী দু-গ্লাস ঠান্ডা জল এনে দিল।

বড়ো-মা বললেন, ‘এবার শীতের ছুটিতে আমরা ক’জন বেড়াতে যাচ্ছি। একটা টুরিস্ট কোম্পানির সঙ্গে। তোমার বাবা-মাকেও বলো না কল্পনা। যদি ওরা আমাদের সঙ্গে যান, খুব ভালো লাগবে।’

আমি বিব্রত হওয়ার মতো চোখ করে সমীরের দিকে তাকাই। দাদা-বউদি যে মা-বাবাকে ছাড়তে রাজি হবেন না, সেকথা আমি যেমন জানি, সমীরও জানে।

তবু ও হঠাৎ বলে উঠল, ‘আমি কথা দিচ্ছি। ওরা যাবেন। আমি শিগগিরি ওদের সঙ্গে কথা বলব বড়ো-মা। আপনি পুরোনো যুগের মানুষ। কিন্তু আজ আমার চোখ খুলে দিয়েছেন।’

সমীর আবেগে আমার হাত চেপে ধরল।

——-

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...