‘বেলাশেষে’ ছবিটা যারা দেখেছেন, তারা অবাক হয়ে ভেবেছেন প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছোনো ওই দম্পতি, বিবাহ বিচ্ছেদের কথা কীভাবে ভাবলেন! কিন্তু বাস্তবে আমাদের সমাজে ভাঙন বাড়ছে। বিশেষ করে দাম্পত্যে। শুধু সদ্য বিয়ে হওয়া যুগলদের মধ্যেই না, এ ঘটনা এখন ২৫ বছর পার করে দেওয়া দম্পতিদের ক্ষেত্রেও একইরকম সত্যি।

এক সত্য ঘটনায় দেখেছি, মধ্য চল্লিশের এক গৃহবধূকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে। ঘটনাটা অত্যন্ত চমকপ্রদ। খুব কম বয়সে বিয়ে হয়ে স্বামীর ঘরে আসা এই মহিলা, প্রথম থেকেই তাঁর মদ্যপ স্বামীর নির্যাতনের শিকার। তাঁর পরিবারের অর্থাৎ বাপের বাড়ির অবস্থা এমন ছিল না যে, তারা মেয়েকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। ফলে স্বল্প শিক্ষিত এই মহিলা দিনের পর দিন মুখ বুজে এই নির্যাতন সহ্য করতে থাকেন। স্বামীর কামনার ফলস্বরূপ তিনি দুই সন্তানের জননীও হন। এরপর হঠাৎই এক দুঃসাহসী পদক্ষেপ নেন এই নারী, বিয়ের দশ বছরের মাথায়। তিনি নিজে গিয়ে বন্ধ্যাত্বকরণ করিয়ে আসেন। স্বামী জানতে পারলে তার উপর অত্যাচার করেন। স্বামী ক্রমশ ধর্ষক হয়ে ওঠেন, তাঁর পৌরুষত্বে ঘা লাগায়। কিন্তু সত্যিই নারীটির কিছু করার ছিল না। দুটি ছোটো ছোটো সন্তানকে মানুষ করাই তাঁর ব্রত হয়ে দাঁড়াল। সন্তানদের অস্বচ্ছলতার ও অনিশ্চয়তার জীবনে একেবারেই ঠেলতে চাননি ওই মহিলা।

দিন অতিবাহিত হল। সন্তান-সন্ততি বড়ো হল। তারা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর, এবার ঘুরে দাঁড়ালেন মহিলা। দীর্ঘ ২৫ বছরের এই নির্যাতনের দাম্পত্য থেকে নিজেকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্তে, বিবাহবিচ্ছেদের মামলা করলেন তিনি। এও এক জীবন– এও এক দাম্পত্য।

এমন ঘটনা নতুন নয়। তবে সবক্ষেত্রেই যে মেয়েরা যন্ত্রণার শিকার, তা নয়। পুরুষদের ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা ঘটতে পারে। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে স্ত্রী-র সন্দেহবাতিক সহ্য করার পর, আর পেরে না উঠে ডিভোর্স দিলেন, এমনই একজন পুরুষের কথাও জেনেছি।

দাম্পত্যের শুরুতে বোঝা যায়নি যে তাঁর স্ত্রী মানসিক বিকারগ্রস্ত। প্রথম প্রথম উনি ভাবতেন এটা নিছক পজেসিভনেস। স্বামী বাড়ি থেকে দফতরে রওনা হওয়া মাত্রই, স্ত্রী ফোন করে খোঁজ নেওয়া শুরু করতেন, স্বামী কোথায়, সঙ্গে কে আছে ইত্যাদি। প্রায় প্রতিদিনই বায়না ধরতেন কিছু কিনে আনার জন্য। স্বামী সেটা কিনে এনে দিলেও স্ত্রীর সন্দেহ, সঙ্গে কে ছিল এটা কেনার সময়? স্বামীর সমস্ত বন্ধুর স্ত্রী, স্বামীর মহিলা সহকর্মী, প্রতেককেই তিনি সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করলেন। স্বামীর বোঝানোতে প্রথম প্রথম বুঝতেন, কান্নাকাটি করতেন, সাময়িক শুধরোতেন। কিন্তু আবার কিছুদিন পর থেকেই তার সন্দেহের উপসর্গ শুরু হতো।

দলবেঁধে কোথাও বেড়াতে গিয়েও স্বামীর শান্তি নেই। দলের কোনও না কোনও মহিলাকে নিয়ে টুর-এর মধ্যপথেই তার স্ত্রী প্রকাশ্যেই ঝামেলা অশান্তি শুরু করতেন।

এভাবেই ধৈর্য ধরে ভদ্রলোক ২৫-টি বছর কাটিয়ে, অবশেষে নিজের চাকরি থেকে ইস্তফা দিলেন এবং ঘোষণা করলেন তিনি বিবাহবিচ্ছেদ চান।

দুটি নর-নারীর সম্পর্ক একটি সরু সুতোয় বাঁধা থাকে। সে বন্ধন দৃঢ় হওয়া ভালো কিন্তু দমবদ্ধ করা নয়। এই ভারসাম্যটাই রক্ষা করতে পারেন না বহু দম্পতি। কেউ কেউ শিশুদের প্রতি অবিচার করে আগেই বিবাহ বিচ্ছিন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কেউ আবার যন্ত্রণা সহ্য করেন বাচ্চারা বড়ো হওয়ার অপেক্ষায়। অনেক সময় বাচ্চাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়– সে কার সঙ্গে থাকবে, বাবা নাকি মা।

কী কারণ এরকম বিচ্ছেদের, এমন একটা প্রশ্ন সবার মনেই আসা স্বাভাবিক। কখনও অতিরিক্ত পজেসিভনেস, কখনও সন্দেহ, কখনও স্বেচ্ছাচার বা দাম্পত্যে তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি– কারণ যাই হোক, সম্পর্কটা যখন কলুষিত হয়ে যায়, তখন আর সেটাকে টেনে হিঁচড়ে বহন করার কোনও যৌক্তিকতা নেই। বস্তুত একটি মানুষ যখন তার পার্টনারকে ভালোবাসে, তার মধ্যে এই বিশ্বাস জন্মায় যে, প্রতিদানে সে একইরকমের ভালোবাসা ফেরত পাবে। এর অন্যথা হলেই সেটা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পরিস্থিতি ক্রমশ অসহনীয় হয়ে ওঠে। একজন চায় তার চাহিদাপূরণ হোক, পরিস্থিতি তার ইচ্ছানুগ হোক, আর অন্য জন চায় এই পরিস্থিতি থেকে নিষ্ক্রমণের পথ। দাম্পত্যের দৈর্ঘ্য কোনও রেখাপাতই করে না কারও মনে।

সিলভার লাইন সেপারেশন-এর প্রবণতা বাড়ছে

লেখক পাউলো কোয়েলহোর মতে, যদি বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েই থাকেন, তাহলে পুরনো-কে মন থেকে বিদায় জানানো উচিত। না হলে এই ব্যথা সারাজীবন আপনাকে আনন্দের হদিশ পেতে দেবে না।

একটি রিপোর্টে দেখা গেছে ভারতে, এই ধরনের দীর্ঘ সময়ের দাম্পত্য কাটানো যুগলদের বিবাহবিচ্ছেদের হার গত ১২ বছরে দ্বিগুন হয়ে গেছে। সত্যি কথা বলতে কী, বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেওয়া কোনও অপরাধ নয়।

যে-দাম্পত্য রোজকার অশান্তিতে অসহনীয় হয়ে উঠেছে, নিত্য তাতে দগ্ধানোর চেয়ে, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ভালো।

 Spending quality time even afterSeparation

সমাজ সিলভার সেপারেশন

দাম্পত্যের সিলভার জুবিলি পালন করার বদলে যখন সিলভার সেপারেশন-এর মুখোমুখি হতে হয়, তখন স্বাভাবিক ভাবেই জীবনের উপর একটা বড়োসড়ো ধাক্বা লাগে। সমাজ স্বাভাবিক ভাবে এটা গ্রহণ করে না। অন্যদিকে ছেলেমেয়েরা ততদিনে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে অথবা নিজেদের সামাজিক পরিচয় গড়ে নিয়েছে। তাদেরও সামাজিক জীবনে প্রভাব ফেলবে এই সিদ্ধান্ত। কিন্তু এসব সত্ত্বেও যদি আপনি মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকেন এই সিদ্ধান্ত নিতে, তাহলে দেরি করবেন না।

অনেক পরিবারেই এই ঘটনা ঘটছে। সব ক্ষেত্রেই যে সন্তানদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে এই সিদ্ধান্তে –এমন নয়। তাই নিজেকে যন্ত্রণা মুক্ত করতে যদি এই সিদ্ধান্ত নিতেই হয়, তাহলে সমাজের ভয় না পেয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নতুন করে বাঁচার কথা ভাবুন। আর বিচ্ছেদ মানেই যে মুখ দেখাদেখি বন্ধ করবেন দীর্ঘ দিনের সঙ্গীর সঙ্গে, তা-ই বা কেন হবে? সুস্থ একটা বন্ধুত্ব না হয় বজায় থাক৷ এতে সম্পর্কে একটা সমীহ বজায় থাকবে৷বিবাহ বিচ্ছেদের পরেও মাঝে মাঝে গোটা পরিবার মিলিত হোন৷ খানিকটা ভালো সময় কাটান তিক্ততা ভুলে৷ এতে আপনার সন্তান সন্ততিরাও ভালো থাকবে৷ দূরে থাকলেও পারস্পরিক সম্পর্ক সুস্থ ও সুন্দর হবে৷

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...