গৃহ-অশান্তির সাক্ষী যখন নিজেদেরই সন্তান – (শেষ পর্ব)

মা বাবার সঙ্গে বাচ্চার Relationship কেমন হওয়া উচিত বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে মা বাবা নিজেদের মধ্যে কীধরনের আচরণ করছেন সেটা শিশুর বেড়ে ওঠার ওপর খুব গভীর প্রভাব ফেলে। এতে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য কেমন হবে, পড়াশোনায় সে কেমন করবে, এমনকি ভবিষ্যতে এই শিশু যেসব সম্পর্কে জড়াবে সেগুলো কেমন হতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি। কখনও সখনও বড়োদের মধ্যে কলহ এতটাই দুর্বিষহ হয়ে ওঠে যে, স্বামী-স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদের পথে পা বাড়ায়। একে অপরকে সহ্য করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। শুধু ডিভোর্সই নয়, অনেক সময় স্বামী-স্ত্রী কেউ একজন বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে যদি জড়িয়ে পড়েন, তাহলে বাড়িতে থাকা বাচ্চার উপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। কিন্তু সমস্যা হল এই পরিস্থিতি হলে বাচ্চাটি কোথায় যাবে? সে কী করবে আর না করবে বুঝে উঠতে পারে না।

কী কী কারণে বড়োদের আচরণ শিশুমনে প্রভাব ফেলে সেটা আমাদের জানতে হবে। আগেই বড়োদের নিজেদের মধ্যে ডিভোর্সের হুমকি এবং ব্যবহারে পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, বাকি কারণগুলোও এখানে আলোচনা করা হল।

আর্থিক সমস্যার প্রভাব বাচ্চার উপর

কলকাতার বাসিন্দা অলোকের চাকরি চলে যাওয়ার পর থেকে প্রায়শই বাড়িতে টাকা-পয়সা নিয়ে স্ত্রীয়ের সঙ্গে ঝগড়া চলতেই থাকত। ভালো আবাসনে ফ্ল্যাট ছিল, ছেলেমেয়েরাও ভালো কলেজে পড়ত। চাকরি যেতেই নিজের বাড়ি, ভাড়ায় দিয়ে, অল্প টাকায় বাড়ি ভাড়া করে পরিবার নিয়ে এসে উঠেছে টাকা সাশ্রয়ের জন্য। কম ফি যেখানে সেই স্কুলে বাচ্চাদের ভর্তি করে দিয়েছে। কিন্তু ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোথাও থাকতে হলে সংসারে লড়াই ঝগড়া তো হবেই।

বাড়িতে সারাদিন বসে থেকে অলোক স্ত্রীয়ের গতিবিধির উপর নজর রাখা আরম্ভ করল। স্ত্রী কী করছে, ওটা কেন করছে না ইত্যাদি বলতে আরম্ভ করল স্ত্রীকে। স্ত্রীয়েরও ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। একে তো অর্থের সমস্যা তার উপর স্বামীর এই নজরদারি। ঝগড়া এতটাই বেড়ে গেল রাগের মাথায় দু’জনেই সন্তানদের গায়ে হাত তুলতে আরম্ভ করল।

দুটি সন্তানই কৈশোর ছাড়িয়ে সবেমাত্র যৌবনে পদার্পণ করেছে। মা-বাবার কাছ থেকে টাকার খোঁটা শুনতে শুনতে বড়ো হচ্ছিল। কিন্তু ভাইবোন দু’জনে মিলে ঠিক করল নিজেদের খরচ ওরা নিজেরা চালাবে এবং বড়োদের ঝগড়ার প্রভাব নিজেদের জীবনে পড়তে দেবে না। অলোকের মেয়ে আশেপাশে বেশ কয়েকটা টিউশন জোগাড় করে নিজের হাতখরচের ব্যবস্থা করে নিল আর ছেলে একটা স্টোরে পার্ট টাইমের চাকরি জোগাড় করে নিল। এতে দুটো লাভ হল— মা-বাবার রোজের খিটমিট বন্ধ হল আর সন্তানরা আত্মনির্ভরও হতে শিখল।

বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক

অজয়কে প্রায়ই ব্যাবসার কাজে শহরের বাইরে যেতে হয়। দুটি সন্তান, মেয়ে দশম শ্রেণিতে আর ছেলে দ্বাদশ ক্লাসে। অজয়ের স্ত্রী চাকরি করে না। বাড়িতে থাকে বা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ক্লাব পার্টি করে বেড়ায় সময় কাটাবার জন্য। অজয়ের নির্দেশ ওর অনুপস্থিতিতে বাচ্চারা যেন মায়ের কথা শুনে চলে এবং মন দিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যায়।

একদিন ছেলে রাত করে পড়াশোনা শেষ করে নীচে বাগানে একটু হাঁটাহাঁটি করছিল। তখনই মা-কে এক অচেনা পুরুষের গাড়ি থেকে নামতে দেখে। তাও সবই ঠিক ছিল কিন্তু নিজের মা-কে পরপুরুষের বক্ষলগ্না হতে দেখে ও নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারে না। ছেলে চুপ করে থাকলেও এ ধরনের কথা বেশিদিন চাপা থাকে না।

কয়েকদিনের মধ্যেই পাড়াতে অজয়ের স্ত্রীকে নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। এ ফ্ল্যাট ও ফ্ল্যাট করে অজয়ের কানে এসে পৌঁছোল গুঞ্জন। শুরু হল অশান্তি। অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে স্ত্রীকে কথা বলতে দেখলেই অজয়ের মনে সন্দেহ বাসা বাঁধতে আরম্ভ করত। সংসারে অশান্তি শুরু হল। বাচ্চাদের কানেও প্রতিবেশীদের চাপা ফিসফিসানি এসে পৌঁছোত। অনেকে ওদের দেখে হাসাহাসিও করত। বাচ্চাদের খারাপ লাগত আবার মা-বাবার উপর রাগও হতো। কিন্তু ছেলের নিজের কেরিয়ার তৈরির চিন্তা ছিল, ও ভালো করেই জানত পড়াশোনা না করলে রেজাল্ট খারাপ হবে।

অজয় এবং ওর স্ত্রী মাঝেমধ্যে সন্তানদের কাছে একে অপরের নামে নিন্দে করত। ছেলে একদিন স্পষ্টই জানিয়ে দিল, ‘তোমাদের ঝগড়া নিজেদের মধ্যেই রাখো, আমাদের নিজেদের জীবন নিজেদের মতো করে চালাতে দাও। ছেলে পড়াশোনা করে সময় পেলে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে একটু ঘুরে আসত বা সিনেমা দেখতে যেত। ছোটো বোনও দাদার দেখাদেখি ওটাই করত।

নিজের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেওয়া

শো বিজনেস-এ থাকা নিহাল নিজের ক্লায়েন্টদের সঙ্গে খুব ভালো এবং সৎ ব্যবহার করত ঠিকই কিন্তু নিজের স্ত্রীয়ের সঙ্গে নয়। সবসময় নিজের সন্তানদের বয়সি মেয়েদের দ্বারা ঘিরে থাকতে ভালোবসত নিহাল এবং নিজের স্ত্রীকে অসম্মান করত। অশান্তি এতটাই চরমে পৌঁছেছিল ওদের ডিভোর্স প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গিয়েছিল। বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করা হলে ওরা জানায় মা-বাবা কারও সঙ্গে ওরা থাকতে চায় না। ওরা একলা কোথাও থাকতেও রাজি কারণ মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া ওরা সহ্য করতে পারে না।

আসলে অজয়ের সন্তানরা ওদের মা-বাবার ঝগড়া দেখতে দেখতেই বড়ো হয়েছে। তাই ওরা মা-বাবাকে কোনওদিন ভালোবাসতে পারেনি, তারাও কি সন্তানদের আদৌ ভালোবাসা দিয়েছিলেন? ঝগড়ার কারণে অনেকদিন বাড়িতে খাবার পর্যন্ত রান্না হতো না। কত উৎসবে হয়েছে, বাড়িতে যখন অতিথি এসেছে খুব এলাহি ভাবে তাদের খাতির করা হয়েছে। কিন্তু তারা চলে যাওয়ার পরেই বাড়ির পরিবেশ আবার আগের অবস্থাতেই ফিরে গেছে। বাচ্চারা এই সত্যটা অনেক আগেই উপলব্ধি করেছিল বলেই মা- বাবার সঙ্গে থাকতে তারা অস্বীকার করে।

এই প্রতিটা ঘটনায় বাচ্চারা মানসিক ভাবে মা-বাবার ঝগড়ার কারণে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে ঠিকই কিন্তু এটাও সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে বড়োদের ঝগড়ার প্রভাব কিছুতেই নিজেদের জীবনে পড়তে দেবে না। সম্পর্ককে সম্মান করাটা সকলের উচিত আর বাচ্চাদের বড়োদের ঝগড়ায় কখনও টেনে আনা উচিত নয়। বাচ্চাদেরও বড়োদের এই ঝগড়ায় নিজের মন মেজাজ এবং জীবন নষ্ট করা বাঞ্ছনীয় নয়।

এখন বাচ্চারা অনেক বেশি মানসিক ভাবে পরিণত। তারা মানে যে, মা-বাবা যদি পরিস্থিতির সঙ্গে আপস করে, Relationship  মেনটেইন করে পরিবারের ভারসাম্য বজায় রাখতে না পারে তাহলে সেই ভুলের দায়িত্ব তাদের নিজেদেরই নিতে হবে।

 

গৃহ-অশান্তির সাক্ষী যখন নিজেদেরই সন্তান – (১ম পর্ব)

বাড়ির অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বড় হয়ে ওঠে যেসব শিশুরা, যারা বাড়িতে নিত্যদিন ঝগড়া, ঝামেলা দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, মা বাবার অশান্তি, মারধর, অত্যাচার দেখে, তার মারাত্মক প্রভাব বাচ্চার পরবর্তী জীবনে পড়ে, মূলত Mental Health এবং সম্পর্কে। এই ঘটনাগুলো তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ভীষণ রকম প্রভাবিত করে। একই সঙ্গে তাদের শারীরিক ক্ষতিও করে।

অনেক ক্ষেত্রে যারা এই জিনিসগুলো দেখতে দেখতে বড় হয় বা শৈশব থেকে সহ্য করার অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায় তারা পরবর্তীকালে নিজের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একই জিনিস করে থাকে অথবা ভয়ের কারণে নতুন সম্পর্কে যেতে দ্বিধা বোধ করে। খারাপ পরিবেশে বড় হওয়ার ট্রমা দীর্ঘদিন তাদের মনের ভিতরে থেকে যায়। অনেকেই সেটা ভুলতে পারে না।

বাড়ির পরিবেশ যে শুধুমাত্র দম্পতির নিজেদের কারণেই খারাপ হয় এমন নয়, পারিপার্শ্বিক নানা ঘটনাবলীও তাদের সম্পর্ককে প্রভাবিত করে এবং মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়, Mental প্রেশার তৈরি করে।

আত্মীয়স্বজনের কারণে ডিভোর্সের হুমকি

বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা নিখিল সফটওয়্যার প্রফেশনাল। স্ত্রীয়ের সঙ্গে বাড়িতে নিত্যদিন খিটমিট লেগেই আছে। আগে অফিসে দীর্ঘ সময় কাটাবার জন্য এগুলো নিয়ে খুব একটা কেউ মাথা ঘামাত না, Mentally খুব একটা প্রভাব ফেলত না। কিন্তু করোনায় লকডাউন শুরু হলে বাড়ি থেকে যখন অফিসের কাজ করা আরম্ভ হল, তখন ঝগড়া উত্তরোত্তর বাড়তে শুরু করল। সমস্যা হল দুই সন্তানকে নিয়ে। একজন কলেজে পড়ে অপরজন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। দু’জনেই তখন বাড়ি থেকেই অনলাইনে ক্লাস করছে। সুতরাং মা-বাবার ঝগড়া হচ্ছে দু’জনের সামনেই।

ঝগড়ার কারণ অবশ্য বিশেষ কিছুই নয়। ছোটো ছোটো কাজ নিয়ে মনোমালিন্য, নিজেকে পার্টনারের থেকে সুপিরিয়র প্রমাণ করার প্রচেষ্টা এবং অপরজন যাতে মুখ বন্ধ করে তার জন্য তাকে নীচ প্রতিপন্ন করার নানা চেষ্টা৷

ঝগড়া হলেই নিখিল পুরোনো ঘটনার ঝুলি উপুড় করে ফেলত। কবে মায়ের সঙ্গে স্ত্রীয়ের ঝগড়া হয়েছে, কবে ননদকে ও বাড়িতে আসতে দেয়নি ইত্যাদি ইত্যাদি। আগে যৌথ পরিবারে ওরা ছিল যখন বাচ্চারা খুব ছোটো ছিল। শাশুড়ি-ননদের সঙ্গে নিখিলের স্ত্রী অ্যাডজাস্ট করতে না পারায় ওরা আলাদা হয়ে চলে আসে। দুটো পরিবারে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যায়।

ব্যবহারে পরিবর্তন

পাঁচ বছর আগে নিখিলের বোনের ছেলে বেঙ্গালুরুতে কলেজে চান্স পেয়েছিল। নিখিলের বোনের ইচ্ছে ছিল ছেলেকে ভাই নিখিলের কাছে রাখার। কিন্তু নিখিলের স্ত্রী রাজি হয়নি। এতে রেগে গিয়ে নিখিল স্ত্রীকে ডিভোর্সের হুমকি দেয়। সেই থেকে সম্পর্কে অবনতিই হয়েছে। রোজ ডিভোর্সের হুমকি শুনতে শুনতে নিখিলের স্ত্রী-ও মনে মনে বুঝে গেছে দাম্পত্য ওদের শেষ পর্যায় এসে ঠেকেছে। ফলে নিখিলের প্রতি ওর ব্যবহারও আমূল বদলে গেছে। দু’জনের একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা তলানিতে এসে ঠেকেছে। সুতরাং এখন ঝগড়া হওয়ার একটা কারণ রয়েছে। এতদিন ঝগড়ার কথা বাচ্চাদের কাছে চাপা থাকলেও করোনার কারণে দু’বছর বাড়িতে থেকে বাচ্চারা বুঝে গেছে মা-বাবা শুধু সম্পর্কটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে একটা প্রাণহীন কাঠামোর মতো। কাঠামোতে মাটি দিয়ে ভালোবাসার প্রলেপ পড়লেও আজ আর তার কিছু অবশিষ্ট নেই।

কলেজে পড়া ছেলে একদিন রাগত স্বরেই নিখিলকে বলল, “তুমি সবসময় মা-কে ডিভোর্স দেওয়ার হুমকি দাও। ছোটো বোনের Mental কন্ডিশন-এর উপর তোমার এই ব্যবহার কী প্রভাব ফেলছে ভেবে দেখেছ কি একবার? আমি তো বড়ো হয়ে গেছি কিন্তু বোন, বাইরের লোককে কী উত্তর দেবে?’ কথা শুনেই বোঝা যায় বয়সের তুলনায় নিখিলের ছেলে অনেক বেশি ম্যাচিওর হয়ে গেছে এবং সেই কারণেই এতটা গাম্ভীর্যপূর্ণ কথোপকথন করতে পেরেছে নিজের বাবার সঙ্গে।

একদিন তো মা-বাবার ঝগড়ায় ও রাগ সামলাতে না পেরে দু’জনকেই মুখের উপর খারাপ মানুষ বলে দিয়েছে। ওর ছোটো বোন মা-বাবার এই ঝগড়া সহ্য করতে না পেরে খাওয়ার টেবিল থেকে আধখাওয়া অবস্থায় উঠে চলে গেছে। এইসব ঘটনাই চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, বড়োদের ঝগড়ায় সন্তানরা কতটা Mental ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

 

সংসারের নিত্য কলহ কি সন্তানের শান্তির বিঘ্ন ঘটাচ্ছে?

এখন প্রায় প্রতিটা পরিবারেই কখনও সাংসারিক কারণে, কখনও ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হলে আবার কখনও পারিপার্শ্বিক বা অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কলহ লেগেই থাকে। শহরে এখন বেশিরভাগ বাড়িতেই স্বামী-স্ত্রী উভয়েই কর্মরত। এর ফলে সংসার-ধর্ম পালন করাটা প্রায়শই মুশকিল হয়ে ওঠে। আর্থিক পরিস্থিতি শোধরালেও পারিবারিক সমস্যা লেগেই থাকে। আর যেখানে আর্থিক সমস্যা থাকে সেখানে সংসার খরচ চালানো নিয়েই তৈরি হয় বড়ো সমস্যা।

কখনও সখনও কলহ এতটাই দুর্বিষহ হয়ে ওঠে যে, স্বামী-স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদের পথে পা বাড়ায়। একে অপরকে সহ্য করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। শুধু ডিভোর্সই নয়, অনেক সময় স্বামী-স্ত্রী কেউ একজন বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে যদি জড়িয়ে পড়েন, তাহলে বাড়িতে থাকা বাচ্চার উপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। কিন্তু সমস্যা হল এই পরিস্থিতি হলে বাচ্চাটি কোথায় যাবে? সে কী করবে আর না করবে বুঝে উঠতে পারে না।

মা বাবার সঙ্গে বাচ্চার সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে মা বাবা নিজেদের মধ্যে কীধরনের আচরণ করছেন সেটা শিশুর বেড়ে ওঠার ওপর খুব গভীর প্রভাব ফেলে। এতে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য কেমন হবে, পড়াশোনায় সে কেমন করবে, এমনকি ভবিষ্যতে এই শিশু যেসব সম্পর্কে জড়াবে সেগুলো কেমন হতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই ঝগড়াবিবাদ নানা রকমের হয়ে থাকে। কোনও কোনও বিতর্কের হয়তো প্রভাব শিশুর ওপর পড়েই না, এমনকি শিশুর ভবিষ্যতের জন্যে সেটা হয়তো ভালোও হতে পারে। কিন্তু মা বাবা যখন একে অপরের প্রতি ক্রুদ্ধ আচরণ করেন, চিৎকার চেঁচামেচি করেন, বা তারা একে অপরের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেন, তখনই হয়তো কিছু একটা সমস্যা দেখা দিতে পারে যেটার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়ে বাচ্চার ওপর।

বাচ্চার পরম নির্ভরতার স্থান তার বাবা মা। সেখানে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হলে সে অসহায় বোধ করে এবং বাচ্চা মাত্রই অনুকরণ প্রিয় । আপনার আচরণ আপনার কথাবার্তা তার মনে একটা স্থায়ী প্রভাব ফেলতে সক্ষম । বাচ্চাদের সামনে বাবা মা ঝগড়া করলে বাচ্চা মানসিকভাবে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভবিষ্যতে সেই বাচ্চা ধরে নেবে, মেয়েদের বিয়ের পর তার স্বামীর কাছে তিরস্কারের স্বীকার হওয়া একটা স্বাভাবিক বিষয়। সেই সঙ্গে শিশুর বাবা মায়ের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হ্রাস পায় এবং এই সহজেই অমনোযোগী হয়ে ওঠে। সুতরাং বাচ্চাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করুন, বাচ্চাকে সময় দিন এবং তার মানসিক বিকাশে সাহায্য করুন। আপনার উপরেই আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।

 

 

 

 

বাচ্চার জেদের জন্য দায়ী কি অভিভাবকেরা ?

বাচ্চাদের জেদের কারণ : অনেক কারণে এবং পরিস্থিতির নেতিবাচক ফলাফলের জন্য বাচ্চার শিশুমনে জেদ উৎপন্ন হয়। এতে শিশুর সঙ্গে তার মা-বাবাও সমান ভাবে দায়ী।

কী কী কারণে বাচ্চা জেদি হয়ে ওঠে :

মা-বাবার ব্যবহার : অভিভাবকেরা যদি বাচ্চার সঙ্গে সঠিক ব্যবহার না করেন, সবসময় তাদের বকাঝকা করতে থাকেন, মারেন অথবা তাদেরকে সময় না দেন তাহলে বাচ্চার জেদি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল। বাচ্চাদের সঙ্গে অভিভাবকদের সম্পর্ক বাচ্চার মানসিক বিকাশের উপর প্রভাব ফেলে। বাচ্চাকে এড়িয়ে গেলে অথবা ওরা যা বলতে চায় তার উপর গুরুত্ব না দিলেও শিশুরা বায়নাবাজ, জেদি হয়ে ওঠে। অভিভাবকের মন পেতে অথবা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাচ্চা stubbornness-প্রকাশের রাস্তাকেই সঠিক রাস্তা ভেবে নেয়। এছাড়াও সন্তানকে অতিরিক্ত আদর দিয়ে মাথায় চড়ালেও সে জেদি হয়ে ওঠে।

পরিবেশ : খুব ছোটো শিশুরা অনেক সময় শারীরিক সমস্যা বড়োদের বোঝাতে না পারলে, খিদে পেলে, ঘুম এসে গেলে, অথবা সকলের দৃষ্টি নিজের প্রতি আকর্ষিত করতে জেদ প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু একটু বড়ো বাচ্চারা পারিবারিক পরিবেশের কারণে, অতিরিক্ত আদরে অথবা বাড়িতে অত্যধিক শাসনের কারণে এবং অনাবশ্যক পড়াশোনার চাপে জেদি হয়ে ওঠে।

শারীরিক উৎপীড়ন : অনেক সময় ছোটোরা নিজেদের জীবনে, অপর ব্যক্তির দ্বারা শারীরিক উৎপীড়নের শিকার হয় যেটা সম্পর্কে লজ্জায়, ভয়ে সে কারও কাছে মুখ খুলতে পারে না। এমনকী মা-বাবার কাছেও ঘটনাক্রম অজানাই রয়ে যায়। এরকম ঘটনায় সন্তানের মনে ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে। এরা বাইরের লোকেদের এড়িয়ে যেতে শুরু করে, খিটখিটে মেজাজের হয়ে ওঠে, অবাধ্যতা করে। প্রতি কথায় জেদ দেখানো শুরু করে অথবা একদম চুপচাপ হয়ে যায়।

অবসাদ : স্কুলে, বন্ধুদের সঙ্গে মনোমালিন্য অথবা বাড়িতে মা-বাবার সঙ্গে মতপার্থক্যও বাচ্চাকে অবসাদের দিকে ঠেলে দেয়, বাচ্চা যার বহিঃপ্রকাশ করে তার জেদের মাধ্যমে। এরকম পরিস্থিতিতে তাদের সামলানো মাঝেমধ্যে খুবই সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

গর্ভাবস্থায় ধূমপান ও অ্যালকোহল সেবন : অনেক সময় বাচ্চার stubbornness-এর পেছনে থাকে গর্ভধারণ করার পর মায়ের অতিরিক্ত ধূমপান বা অ্যালকোহল সেবন।

জেদি বাচ্চাকে সামলাবার উপায় : বিশেষজ্ঞদের মতে জেদি শিশুরা খুবই সংবেদনশীল হয়। তার প্রতি মা-বাবার ব্যবহার কীরকম, সেই বিষয়ে বেশি স্পর্শকাতর হয়। সন্তানের সঙ্গে কথা বলার সময় টোন, বডি ল্যাংগুয়েজ এবং শব্দ চয়নের উপর বড়োদের বিশেষ ভাবে খেয়াল রাখা উচিত। সন্তান যদি ভয় বা দ্বিধা ছাড়াই অভিভাবকদের সঙ্গে কমফর্টেবল হয়ে কথা বলতে পারে, তাহলে তাদের চরিত্রের ব্যবহারের ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটতে পারে।

 

মাতৃস্নেহ সন্তানের রক্ষাকবচ

শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মা ও শিশুর মধ্যে গড়ে ওঠে এক অটুট বন্ধন, Mother’s Love সে বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে। মায়ের কোমল স্নেহের স্পর্শেই শিশু নিজেকে সব থেকে সুরক্ষিত মনে করে।

শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তার সুরক্ষার পুরো দাযিত্ব মা নিজের হাতে তুলে নেয় এবং দাযিত্ব সামলাতে সামলাতেই শিশুর প্রতিটি প্রয়োজন তার নখদর্পণে হয়ে ওঠে। নিজের উপর পূর্ণ আস্থা রেখে মা তার সন্তানকে সবদিক থেকে সুরক্ষা দিতে নিজেকে প্রস্তুত করে তোলে। স্নান করানো থেকে শুরু করে তাকে খাওয়ানো, ঘুম পারান, ব্যথায় স্নেহের প্রলেপ লাগানো সবই মা নিজের দায়িত্ব মনে করে পালন করেন। খাওয়া, ঘুম বাদ দিয়েও সর্বক্ষণের জন্য মায়ের নজর থাকে সন্তানের দেখভালের উপর। অতিরিক্ত গরমে শিশুর জাতে কষ্ট না হয় বা খেলনা নিয়ে খেলতে গিয়ে দুধের শিশু যাতে নিজের কোনও ক্ষতি না করে ফেলে তার প্রতিও থাকে মায়ের সজাগ দৃষ্টি। তাই বাচ্চাকে মানুষ করতে একজন নতুন মায়ের দরকার সর্বপ্রথম নিজের কনফিডেন্স গড়ে তোলা।

বাচ্চার ঘামাচি হলে

গরমের মরশুমে বাচ্চাদের ঘামাচির সমস্যা হয়ে থাকে। তবে সাবধানতা অবলম্বন করলে ঘামাচি রোধ করা সম্ভব।

  • গরমের সময় বাচ্চাকে ঢিলে এবং মোলায়েম সুতির পোশাক পরান। ত্বকে ফুটবে এমন কোনও পোশাক বাচ্চার জন্য বাছবেন না।
  • বাচ্চার জন্য সবধরনের ট্যালকম পাউডার উপযুক্ত নয়। খালি রাইস স্টার্চ-যুক্ত পাউডারই লাগাবেন যাতে বাচ্চাকে ফুসকুড়ি এবং র‌্যাশেজ থেকে বাঁচানো যায়।
  • যেখানে ঘামাচি হয়েছে সেখানে সারাদিনে ২ থেকে ৩ বার পরিষ্কার জল দিয়ে ধুয়ে দিন বা স্পঞ্জ করে দিন।
  • বাচ্চার জন্য অত্যন্ত সুগন্ধি সাবান বা তেল ব্যবহার করবেন না কারণ এতে কেমিক্যাল থাকে যেটা বাচ্চার স্পর্শকাতর ত্বকের ক্ষতি করতে পারে।

কনফিডেন্ট হয়ে বাচ্চার মাসাজ করুন

মা নিজের উপর বিশ্বাস রেখে নিজেই শিশুর মালিশ করতে পারেন যদি সঠিক পদ্ধতি মেনে চলেন :

  • বাচ্চার পা থেকে মালিশ শুরু করুন। হাতে তেল নিয়ে থাই থেকে মালিশ করা শুরু করে ক্রমশ নীচের দিকে নামুন।
  • বাচ্চার হাঁটু, গোড়ালি সর্বত্র মালিশ করুন। পায়ে আঙুল চক্রাকারে ঘোরান।
  • বাচ্চার হাত-বুক-পিঠ মালিশ করুন।
  • মালিশ করতে করতে বাচ্চা যদি কাঁদে, তাহলে কোলে নিয়ে বাচ্চাকে চুপ করান। দুধ খাওয়ার পর বা বাচ্চার শোওয়ার সময় মালিশ করবেন না।

খেলনার প্রতিও সজাগ দৃষ্টি রাখুন

শিশুর জন্মের পর শুধু তার মা-বাবাই নয়, সকলেই বাচ্চার জন্য খেলনা কিনে থাকেন। বাচ্চার ঘর ভরে যায় খেলনায় ঠিকই কিন্তু এর মধ্যে সব খেলনাই ভালো কোয়ালিটির হয় না। এই ক্ষেত্রে মা-কে জানতে হবে, কোন খেলনা শিশুকে দেওয়া যেতে পারে।

  • বাচ্চার খাটের সঙ্গে লাগানো যায় সেরকম ঝুলন্ত র‌্যাটল যাতে রঙিন ছোটো ছোটো হাতি, ঘোড়া, বাঘ, ভাল্লুক ইত্যাদি ঝোলানো থাকে সেটি বাচ্চাদের জন্য খুব ভালো। এটা দেখে বাচ্চা আনন্দ পায় এবং চোখের দৃষ্টির মাধ্যমে বাচ্চার কনসেনট্রেশনও বাড়ে।
  • অনেক খেলনায় ঘন্টা লাগানো থাকে। প্লাস্টিকের একটা রিং-এর মধ্যে ঘন্টাগুলো থাকে। খেলনাটা খুব নরমও হয়। হাওয়ায় যখন ঘন্টাগুলো নড়ে তখন তার থেকে মিষ্টি টুংটাং আওয়াজ হয়, যেটা শুনতে শুনতে বাচ্চা কান্না ভুলে চুপ হয়ে যায়।

এছাড়া বয়স অনুপাতে বাচ্চাদের খেলনাও নানা রকমের হয়ে থাকে। তবে খেয়াল রাখা দরকার বাচ্চার খেলনা যেন নরম হয় এবং কোনওরকম শার্প কোণ যেন না থাকে। কাপড়ের তৈরি খেলনা বা ভালো কোয়ালিটির রাবার অথবা প্লাস্টিকের তৈরি খেলনাই বাচ্চাকে দেওয়া উচিত। যেটা বাচ্চা মুখে দিলেও তার কোনওরকম ক্ষতি হবে না।

  • বাচ্চাদের হাতে খেলনা দেওয়ার আগে বড়োদের উচিত নিজেদের সেটা একবার পরীক্ষা করে নেওয়া। সঠিক মনে হলে তবেই বাচ্চার হাতে দেবেন।

বাচ্চাদের খাবার ওগরানো

  • ৩-৪ মাস পর্যন্ত বাচ্চাদের মুখ থেকে লালা পড়ে। বিশেষ করে দুধ খাওয়াবার সঙ্গে সঙ্গে মুখ থেকে দুধ ওগরাতে থাকে।
  • দুধ খাওয়াবার পরে পরেই বাচ্চার সঙ্গে খেলা করা উচিত নয় বা বাচ্চাকে বেশি নাড়ানো ঝাঁকানো উচিত নয়। দুধ খাওয়াবার পর বাচ্চাকে কাঁধে ফেলে ধীরে ধীরে পিঠ চাপড়ানো দরকার যাতে বাচ্চার তাড়াতাড়ি ঢেঁকুর ওঠে এবং এতে দুধ হজম হতেও সুবিধা হয়।
  • অনেক সময় ঠান্ডা দুধ খাওয়ালেও বাচ্চা মুখ থেকে দুধ তোলে কারণ বাচ্চার ঠান্ডা দুধ খেতে ভালো লাগে না।

মমতাময়ী মাতৃস্পর্শ

শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মা ও শিশুর মধ্যে গড়ে ওঠে এক অটুট বন্ধন, Mother’s Love সে বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে। কেমন করে যেন, শিশুও বুঝে যায় মায়ের কোমল স্পর্শেই সে সব থেকে বেশি সুরক্ষিত।

বাচ্চা কাঁদলে মা-কেই বুঝে নিতে হয় সন্তানের প্রয়োজন। বাচ্চার সুরক্ষার পুরো দাযিত্ব মা নিজের কাঁধে তুলে নেয় এবং দাযিত্ব সামলাতে সামলাতেই শিশুর প্রতিটি প্রয়োজন তার নখদর্পণে হয়ে ওঠে। নিজের উপর পূর্ণ আস্থা রেখে মা তার সন্তানকে সবদিক থেকে সুরক্ষা দিতে নিজেকে প্রস্তুত করে তোলে। বাচ্চা মানুষ করতে একজন নতুন মা কীভাবে নিজের কনফিডেন্স গড়ে তুলতে পারে, তাই আমাদের আজ আলোচ্য বিষয়।

শিশুর স্নানের সময়

অনেক সময় বাচ্চাকে প্রথমবার স্নান করাতে মা ভয় পায়। কিন্তু যদি সাবধানতা অবলম্বন করা হয় এবং স্নান করাবার সঠিক পদ্ধতি জানা থাকে, তাহলে কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। স্নান করাবার সঠিক পদ্ধতি হল :

  • বাথটাবে বাচ্চাকে স্নান করানো উচিত তবে খেয়াল রাখতে হবে টাব-এর গভীরতা যেন কম থাকে।
  • বাচ্চাকে স্নান করাবার সময় ঈষদুষ্ণ জল স্নানের জন্য ব্যবহার করুন। নিজের কনুই জলে ডুবিয়ে আগে দেখে নিন জল ঠান্ডা না গরম। জল যদি গরম না লাগে তাহলে বাচ্চাকে ওই জলে স্নান করাতে পারেন।
  • প্রথমে বাচ্চার উপর জলের ছিটে দিন। প্রথমেই মগে করে মাথায় জল না ঢেলে ধীরে ধীরে ঢালুন।
  • বাচ্চাদের জন্য তৈরি প্রোডাক্টস-ই ব্যবহার করুন বাচ্চাকে স্নান করাবার সময়। খেয়াল রাখবেন এইসব সামগ্রীতে যেন প্যারাবেনস, এসএলএস, বা এসএলইএস-এর মতো উপাদান না থাকে।
  • বাচ্চার কানে বা নাকে যাতে জল না ঢোকে তারও খেয়াল রাখতে হবে।
  • বাচ্চার মাথায় এক নাগাড়ে সোজা করে মগ থেকে জল ঢালবেন না। এতে বাচ্চার নরম মাথার তালুতে আঘাত লাগতে পারে।
  • স্নানের পর নরম তোয়ালে দিয়ে জড়িয়ে নিয়ে শিশুর ত্বক শুকিয়ে নিন। তোয়ালে দিয়ে রগড়াবেন না। ত্বক শুকিয়ে গেলে লোশন লাগিয়ে দিন।

বাচ্চা বেশি কাঁদলে

অনেক সময় বাচ্চা কাঁদতে থাকলে চুপ হতে চায় না কিছুতেই। মা-ও অনেক সময় কান্নার কারণ বুঝতে পারে না। বাচ্চা যদি ৩ মাসের থেকে ছোটো হয় তাহলে কারণ ছাড়াও বাচ্চা কাঁদতে পারে। সেই সময় বাচ্চাকে কোলে নিয়ে একটু ঘুরলেই বাচ্চা আরাম পায় এবং চুপও হয়ে যায়। কিন্তু যদি শিশুটি চুপ না করে, তাহলে বুঝতে হবে তার কোনও সমস্যা হচ্ছে। যেমন কোথাও ব্যথা করছে বা খিদে পেয়েছে অথবা ডায়াপার নোংরা হয়ে গেছে। তৎক্ষণাৎ বাচ্চার সমস্যা দূর করা বাঞ্ছনীয়।

বাচ্চার কান্নার সমস্যা দূর করতে কিছু জিনিসের খেয়াল রাখুন

  • বাচ্চার ডায়াপার সম্পূর্ণ ভিজে গেলে বাচ্চা অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। বাচ্চার ঘুমও এর ফলে ভেঙে যায়। বাচ্চা নিজের অস্বস্তি বোঝাতে কাঁদতে শুরু করে। সুতরাং মাঝে মাঝেই বাচ্চার ডায়াপার বদলে দিলেই সে শান্ত হয়ে যাবে।
  • অনেক সময় ডায়াপার অনেক্ষণ ভিজে থাকার ফলে ত্বকে র‌্যাশেজ হয়। এর কারণে জ্বালা, চুলকানির মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। সুতরাং ডায়াপার বদলাবার সময় সেটা খেয়াল রাখা একান্ত দরকার। বাচ্চার ওই অংশের ত্বক সব সময় পরিষ্কার রাখা একান্ত দরকার। এছাড়াও প্রতিবার ডায়াপার বদলাবার সময় জিংক অক্সাইড-যুক্ত ন্যাপি ক্রিম বাচ্চার ওই অংশের ত্বকে অবশ্যই লাগান।
  • ৬ থেকে ৮ মাস বয়স, বাচ্চার নতুন দাঁত বেরোবার সময়। সেটাও বাচ্চাকে সমস্যায় ফেলতে পারে।
  • অনেক ক্ষেত্রে বাচ্চা ক্লান্ত হয়ে পড়লেও মায়ের কোলের আরাম চায়। এই ক্ষেত্রে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আদর করলে এবং ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেও বাচ্চা আরাম পায় এবং চুপ করে যায়।

বাচ্চা যদি সারারাত জাগে

জন্মের পর পরই বেশিরভাগ শিশু দিনে ঘুমোয় এবং রাতে জেগে থাকে। কোনও কোনও সময় দিনে না ঘুমিয়ে বাচ্চা রাতেও ঘুমোতে চায় না। সুতরাং বাচ্চার সঙ্গে মা-বাবাকেও রাত জাগতে হয়। মা-বাবা বাচ্চাকে নিয়ে সমস্যায় পড়েন। বাচ্চার ক্ষেত্রেও সমস্যা হয়, যার ফলে সে ঠিকমতো ঘুমোতে পারে না। বাচ্চার যদি খিদে পায় অথবা অন্য কিছুর প্রয়োজন থাকে তাহলেও শিশু ঘুমোতে পারে না। সুতরাং এই বিষয়গুলির খেয়াল রাখা জরুরি—

রাতে বেশ কয়েবার উঠে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াবার দরকার পড়ে। কারণ বাচ্চা একবারে বেশি পরিমাণে দুধ খেতে পারে না। ব্রেস্টপাম্পের সাহায্যে মাতৃদুগ্ধ স্টোর করে রাখতে পারেন এবং রাতে প্রয়োজনে সেটাই বাচ্চাকে খাওয়াতে পারেন। এতে মায়েরও আরাম হবে এবং বাচ্চাও ক্ষুধার্থ থাকবে না।

  • কোনও বিশেষ খেলনা বা চাদর নিয়ে শোবার অভ্যাস যদি বাচ্চার থাকে তাহলে যতক্ষণ না সে, সেটা কাছে পাচ্ছে ততক্ষণ বাচ্চা কিছুতেই ঘুমোতে চাইবে না। সুতরাং মা-কে তা খেয়াল রাখতে হবে।
  • একটা সময় নির্দিষ্ট করে সেই সময়টাতেই বাচ্চাকে রোজ ঘুম পাড়ান। ইচ্ছেমতো সময় বদলাবেন না।
  • জ্বর, সর্দি-কাশি, পেট ব্যথা, কানে ব্যথার কারণেও বাচ্চা অনেকসময় ঘুমোতে পারে না। এগুলোও মা-কেই দেখে নিতে হবে।

যখন ভাঙল মিলন মেলা

গৌতম বুদ্ধ জনৈকা বৃদ্ধাকে বলেছিলেন, যে-ঘরে কোনও মৃত্যু নেই, দুঃখ নেই সেই ঘর থেকে একমুঠো শস্য আনলেই, তাঁর মনস্কামনা পূর্ণ হবে। অতি উৎসাহে বৃদ্ধা শস্য আনতে গেলেন কিন্তু দিনশেষে ফিরে এলেন খালি হাতে। হ্যাঁ, আমাদের জীবনের Relationship-গুলো এই দুঃখ-আনন্দ-আশা নিয়েই অতিবাহিত হয়। দুঃখ বড়োই হূদয় বিদারক। আনন্দে হূদয় উদ্বেলিত। আনন্দ-দুঃখ ব্যালেন্স করে চলাটাই জীবন। দুঃখের পাল্লা বেশি ভারী হলে জীবনধারা ম্রিয়মাণ হয়ে যায়। অবচেতনের ছাপ পড়ে শারীরবৃত্তীয় ছন্দে। মানুষ হয় নানা রোগের শিকার।

পর্ণা আর রূপা অভিন্ন হূদয় বন্ধু, সেই স্কুল-জীবন থেকে। বিয়ের পরও ওদের যোগাযোগ রয়ে গেছে। সময়স্রোতে দুজনেই মা হয়েছে। ছেলেরা বড়ো হয়েছে। আলাদা পরিবার হলেও অভিন্ন হূদয়। খুশির জোয়ার জীবনযাত্রায়। দুই পরিবার মিলে বছর দুয়েক আগে গাড়িতে করে বেড়াতে যাচ্ছিল মুর্শিদাবাদে। দিন পাঁচেক একসঙ্গে আনন্দে থাকা। রূপা ও পর্ণার স্বামী ভাগাভাগি করে গাড়ি চালাচ্ছিল। দারুণ মজা। খুব আনন্দ করে ঘোরা। পর্ণার স্বামীর অফিসের গেস্ট হাউস, বেশ আরামদায়ক। ছবি তোলা, ঐতিহাসিক স্থান, নৌকাবিহার সব কিছুই ছিল মনের মতন। লক্ষ্মীপুজোর দিন ফেরার কথা। বিকেলের দিকে প্যাক-আপ। রূপার বরের শরীরটা একটু খারাপ, জ্বর-জ্বর ভাব। সকালে রূপাকে বলেছিল, একটা ওষুধও খেয়ে নিয়েছিল। বারবার রূপাকে বলেছিল কাউকে কিছু না বলার জন্য। গাড়ির স্টিয়ারিং-এ রূপার বর, চন্দন। মাত্র একঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর কী যে হল রূপা আর কিছু জানে না।

চোখ খুলে দেখে ও শুয়ে আছে হাসপাতালে। একটু ধাতস্থ হলে উঠে বসতে গিয়ে পারল না, পাশে তাকিয়ে দেখে পর্ণা-ও শুয়ে। ওদের নড়াচড়া দেখে একজন নার্স এগিয়ে এসে যা বলল, তার সারমর্ম বড়োই নির্মম।

ওদের মারুতি ভ্যানের পিছন থেকে একটা ট্রাক ব্রেক ফেল করে একমুহূর্তে ধাক্বা মারে গাড়িতে, গাড়ি বেঁকে ঘুরে যেতেই রাস্তার অপর দিক থেকে ধেয়ে আসা একটা বাস সোজা গাড়ির পাশে ডান দিকে ধাক্বা মারে। ঘটনাস্থলে ছেলে দুটির দেহ পিষে যায়, কারণ ওরাই পিছনের সিটে ছিল। পর্ণা-রূপা মাঝের সিটে আর চন্দন-রাজু (পর্ণার বর) সামনের সিটে ছিল। গাড়ির বাঁদিকে ছিল রাজু, ওকেও বাঁচানো যায়নি, চন্দনের মাথায় হেমারেজ হয়েছে। পর্ণা মাঝে বসেছিল, ওর তেমন আঘাত লাগেনি শুধু বাঁহাতটা অনেকটা কেটে গেছে। গভীর কাটা, প্রায় বারোটা মতন সেলাই পড়েছে। রূপা ডান দিকে চন্দনের পিছনে ছিল। ওর তেমন লাগেনি তবে অ্যাক্সিডেন্টের সঙ্গে সঙ্গেই ও নাকি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।

রূপা ও পর্ণার জীবনটা যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল অকস্মাৎ। তবু রূপার চন্দন ছিল, কিন্তু পর্ণার? বেঁচে থাকার কোনও অর্থ ছিল না পর্ণার কাছে। অথচ আশ্চর্যভাবে অক্ষত ছিল রাজুর হ্যান্ডিক্যাম। ছেলের আবদারেই হ্যান্ডিক্যাম কেনা মাসদুয়েক আগে। সব ছবি আছে… মানুষগুলো কোথায়? কী নিয়ে বাঁচা? সারা জীবন এ কোন যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে চলা? পর্ণা পাথর হয়ে গিয়েছিল। রূপা-চন্দনের দুঃখ অবর্ণনীয় হলেও তবু তো দুজনে দুজনকে জড়িয়ে বেঁচে থাকতে পারবে! চোখের জল দেখে সমবেদনা জানানোর কেউ তো পাশে আছে। কিন্তু পর্ণার কিছু ছিল না। বাবা-মা মারা গেছে ছোটোবেলায়। দাদাও বিদেশে। ও একা। ভিতরে ভিতরে গুমরে ও স্থবির হয়ে যাচ্ছিল। কাঁদতে ভুলে গিয়েছিল। যন্ত্রের মতন ওর খাওয়া-শোওয়া ব্যস কোনও কাজ নেই। রাজু এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ অফিসার ছিল। ও পুরোপুরি গৃহবধূ। অর্থনৈতিক অসুবিধা কিছু ছিল না কিন্তু ছিল অনন্ত একাকীত্ব। এতো বড়ো ফ্ল্যাট, একা পর্ণা। জীবনের যন্ত্রণা কেউ বোঝে না। ওর চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু পারে না।

এ তো গেল বাহ্যিক পরিবর্তন, মানুষের আভ্যন্তরীণ পরিবর্তন সহজে চোখে পড়ে না। মনটা ভেঙে চুরচুর হয়ে যায়। জীবনের প্রতি কোনও আকর্ষণই থাকে না। মনে হয় মরে যাওয়াই শ্রেয়। ডিপ্রেশনের অন্ত থাকে না। শরীরটা বুড়িয়ে যায় অল্প বয়সেই। সব থেকে সাংঘাতিক চাপ পড়ে মনে, প্রকারন্তরে হার্ট-এ। এরকম দুঃখজনক যে-কোনও ঘটনা, পুত্র বিয়োগ, মা-বাবার মৃত্যু, বিচ্ছেদ, বিরহ-বেদনা, এ সবই মানসিক চাপ। এই চাপ যারা কাটিয়ে উঠতে পারে তারা ভাগ্যবান। মানসিক প্রতিবন্ধকতাও আজ সমাজ জীবনে এক অলঙঘনীয় সমস্যার সৃষ্টি করছে।

‘কাঁদা’ শ্রেষ্ঠ উপায় বা ওষুধ

দুঃখ কমানোর শ্রেষ্ঠ দাওয়াই হল কাঁদা। চিৎকার করে কাঁদা খুব ভালো। অনেক দুঃখানুভূতি ধীরে ধীরে পুঞ্জীভূত হয় মানুষের মস্তিষ্ক কোশে। এক বিপুল ধাক্বায় যদি তা কান্নার রূপ নিয়ে বেরিয়ে আসে তাহলে মস্তিষ্ক কোশগুলোও হালকা হয়ে যায়, মাথাধরা থেকেও দূরে রাখে। যদিও বেশিক্ষণ কাঁদলে মাথা যন্ত্রণা হয়, সেটা সাময়িক। কিন্তু ভবিষ্যতের চিরস্থায়ী মাথা যন্ত্রণার হাত থেকে পরিত্রাণ।

সদর্থক জীবনযাত্রা পজিটিভ দিনযাপন

পর্ণার কথাই ধরুন না, সে তো একেবারে একা হয়ে গিয়েছিল ওই দুর্ঘটনার পর। জীবন-নদীর মাঝখানে এসে ভরাডুবি। উথালপাথাল জলে পড়লে মানুষ যেমন নাকানিচোবানি খায়, সাঁতার না জানলে যেমন দুহাত তুলে বাঁচাও, বাঁচাও চিৎকার করে, সামনে খড়কুটো পেলে আঁকড়ে ধরে- পর্ণার অবস্থা হয়েছিল তাই। বাঁচতে হবেই, এই মন্ত্রে পর্ণা একা উঠে দাঁড়িয়েছিল, দুহাতে সামলে ছিল নিজেকেই। দূর করে দিয়েছিল হতাশা, দুঃখ। সে জানত তার পাশে কেউ নেই। সমবেদনা, সহানুভূতি জানানোর মানুষ অনেক আছে কিন্তু দুঃখের দিনে বন্ধুত্বের হাত ক’জন বাড়িয়ে দেয়।

মনকে শক্ত করে, অতীতকে অতীতে রেখে পর্ণা নিজের মনের জোরে উঠে দাঁড়িয়েছে। চাকরি নিয়েছে একটা ছোটোদের স্কুলে। দুঃখটা ভিতরেই রয়ে গেছে। রত্না খেমানি, ডিরেক্টর, সেন্টার ফর পার্সোনালিটি ডেভলপমেন্ট, পুণে, এ ধরনের মানসিক বিপর্যস্ত মানুষদের সৌজন্যে এক অমূল্য বক্তব্য রেখেছেন– ‘আশাবাদী হও, নিজের মুখোমুখি দাঁড়াও, যারা চলে গেছে তাদের স্বপ্নপূরণ করে নিজে ভালো থাকার চেষ্টা করো। তাহলে যারা নেই তারাও যেখানে আছে, ভালো থাকবে।’

মেনে নেওয়াটাই জীবন

‘ভালো মন্দ যাহাই আসুক, সত্যরে লও সহজে’ — এ শুধু কবির কথা নয়, সব মানুষের জীবনের আপ্তবাক্য হওয়া উচিত। তাই থেমে যাওয়া নয়, জীবনটাকে নতুন করে ফের সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে হবে। নিজেকে কোনও একটা ভালো লাগার কাজে ডুবিয়ে দিতে হবে। জীবনের ক্ষয়ক্ষতিগুলোকে মেনে নেওয়ার এটিই বিকল্প পথ।

লিখুন মন খুলে

মনের কথা, দুঃখের কথা বলতে না পারলে আপনমনে কাগজ-পেনকে সাথি করাই শ্রেয়। যত ইচ্ছে, যা ইচ্ছে তাই লেখা যায়। মন হালকা হয়ে যায়।

নিজেকে ব্যস্ত রাখুন

নিজেকে তো সুস্থ রাখতেই হবে, অসুস্থ শরীর মনকে আরও বেশি ডিপ্রেসড করে তোলে। তাই প্রয়োজন নিয়মিত ব্যায়াম-আসন-প্রাণায়াম। নিয়মিত ব্যায়াম-আসন শরীরকে তরতাজা রাখে আর প্রাণায়াম মেন্টাল স্ট্রেস দূর করতে অব্যর্থ। এজন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শও নেওয়া যায়। তবে যতই অপরকে বলা হোক না কেন এভাবে জীবন কাটালে, ভালো থাকবে, কার্যত তা করাটা বোধহয় ততটা সহজ নয়। নিজে যদি নিজেকে উজ্জীবিত না করতে পারা যায় তাহলে মানসিক বিপর্যস্ততা কাটিয়ে ওঠা খুবই শক্ত।

‘দুঃখ তাপে ব্যথিত চিতে, নাই বা দিলে সান্ত্বনা

দুঃখ যেন করিতে পারি জয়।’

 

শাশুড়ির সঙ্গে বিউটি পার্লারে

এক নারী অপর এক নারীর বড়ো শত্রু, একথা সেই আদিকাল থেকে শাশ্বত সত্য। সাধারণত বোন-বোন, বউ-শাশুড়ি, ননদ-ভাইয়ের বউ, এ ধরনের সম্পর্কের মধ্যে একটা ঠান্ডা লড়াই থাকে। যে-মেয়েটি যত ঠান্ডা পলিটিক্স করে সংসারে চালাতে পারবে, জিত তারই।

শাশুড়ি-বউমার সম্পর্কে বন্ধুতার সূত্রপাত করতে, বিউটি পার্লারে একসাথে যাওয়া এক সুন্দর সম্পর্কের দৃষ্টান্ত হতে পারে। শাশুড়িমায়ের দিকে আপনিও বাড়িয়ে দিন বন্ধুত্বের হাত, গৃহশোভার টিপস পড়ে।

নিজের মেয়ে সুন্দরী হোক সব মা-ই চায়। ছেলের বউ সুন্দর হোক এটাও সব মা চায়। অর্থাৎ Mother-in-law। না হোক নিজের মেয়ে, বউ তো সুন্দর হবেই। মা আর শাশুড়ির সম্পর্ক-বাঁধনে অনেক তফাত। শাশুড়ি কখনও নিজের মা হতে পারে না, এ ধারণা বদলের দিন এসেছে। এক্ষেত্রে বউয়ের ভূমিকাই প্রধান। ছেলের বউ ছেলের মায়ের মধ্যে এক প্রজন্মের তফাত। মানসিকতাও আলাদা। যদি দুজনের সখ্যতা বা অ্যাডজাস্টমেন্ট না তৈরি হয়, তাহলে সংসার হয়ে পড়ে অশান্তির পীঠস্থান। এ এক ঠান্ডা লড়াই। শাশুড়ি-মা কিন্তু কখনওই ভাবেন না তিনিও একদিন সুন্দরী বউ হয়ে এসেছিলেন নতুন সংসারে। লজ্জাবনত মুখে তিনিও শুনেছিলেন প্রশংসা ‘কি সুন্দর টুকটুকে বউ।’ আজ নিজে শাশুড়ির পদে উত্তীর্ণ হয়ে কোথায় গেল জেল্লা! স্বামী সংসার নিয়েই তিনি মত্ত। নিজের দিকে তাকাবার সময় কোথায়? বউমা যদি কান্ডারি হয়ে শাশুড়িকে বিউটি পার্লারে নিয়ে যায়, তাহলে সহজ-মধুর সম্পর্কের গুণে সংসার হয়ে উঠবে হাসিখুশিতে ভরা।

সোনালি কলকাতার মেয়ে। দেখেশুনে বাবা বিয়ে দেন হায়দরাবাদে। সেখানে শ্বশুড়বাড়ি বেশ ‘পশ’ এরিয়ায়, বানজারা হিলস। এক ছেলে, রিটায়ার্ড শ্বশুর, ইঞ্জিনিয়ার। ছেলেও তাই। বিয়ের আগেই শাশুড়িকে দেখেছে কলকাতায়। পছন্দ হয়নি খুব একটা, কেমন যেন, কয়েক ঘণ্টায় মহিলাকে উন্নাসিক মনে হয়েছে। যাইহোক সব কি আর পছন্দের হয়! বানজারা হিলসের বাড়িটি বেশ। ওঁরা এখানে গত সাত বছর আছেন, সোনালি কিছুই চেনে না। স্বামী সকালে বেরিয়ে বাড়ি আসতে সন্ধ্যা, তারপরও নিজস্ব কাজ। পারিবারিক যাওয়া আসা লেগেই আছে। সোনালি অনেক ভেবেচিন্তে শাশুড়ি মাকে বলল, ‘চলুন মা আজ পার্লারে যাই, আমি তো কিছুই চিনি না।’ মায়ের গম্ভীর জবাব ‘আমি কোনওদিন পার্লারে যাইনি, প্রয়োজনও পড়েনি। আমি যাব না।’ সোনালি হাল ছাড়ে না, ‘আমার জন্য চলুন।’ সোনালির বলার ধরন, তাকানো দেখে Mother-in-law রাজি হলেন। দুজনে মিলে দুপুরবেলা গাড়ি নিয়ে বের হল। সোনালি বেশ উত্তেজিত। মা ড্রাইভারকে হঠাৎ বললেন দাঁড়াও, ‘এই পার্লারের সামনে।’ নিজে থেকে সোনালিকে ডাকলেন, ‘এসো, এটা এখানকার নামকরা পার্লার, তুমি যাও আমি একঘণ্টা এক বন্ধুর বাড়ি থেকে ঘুরে তোমায় নিয়ে যাব’। সোনালি একটু ইতস্তত করে বলে উঠল, ‘আমি একদম নতুন, কলকাতায় মা নয়তো দিদি সবসময় সাথে থাকত, আপনি যদি থাকেন।’ একটু বিরক্ত হলেও সোনালির কথা তিনি রাখলেন। সোনালি আনন্দে পার্লারে ঢুকল। Mother-in-law একটা ম্যাগাজিন নিয়ে বসে রইলেন, সোনালি নিজের রূপচর্চা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সোনালি চেয়েছিল তার শাশুড়ি-মায়ের সাথে এক সহজ সম্পর্ক গড়ে তুলতে। সে বেশ চালাক মেয়ে। একজন বিউটিশিয়ানের সঙ্গে প্ল্যান করে তাকে সঙ্গে নিয়ে শাশুড়ির স্কিন-স্ক্রাবিং আর পেডিকিওর করার কথা বলল। বিউটিশিয়ানটি কথায় বার্তায় বেশ সপ্রতিভ। সোনালিও বেশ জোরাজুরি করল, মা করান না, দেখুন আপনার গোড়ালিটা। একটু পরিষ্কার, একটু মাসাজ, আপনি আরাম পাবেন। বয়স বাড়লে শরীর একটু আরাম চায়, শাশুড়ি-মা বউমার কথা শুনে শরীরচর্চা করালেন। দুজনে বাড়ি এল গাড়িতে। সেই গম্ভীর শাশুড়ি মা যেন উধাও। সোনালি বুঝল সে সফল। বাড়ি এসে হইচই করে সোনালি বিউটি পার্লারের কত সুখ্যাতি করল। সব শুনে শ্বশুর মশাই হাসলেন। গত ত্রিশ বছর তিনি বলে বলে যা পারেননি, বউমা মাত্র কয়েকদিনে সেই অসাধ্য সাধন করেছে। তিনি বেশ খুশি হলেন। শাশুড়ি-বউমা একসাথে পার্লারে।

মনে রাখা উচিত ‘বয়েস হয়ে গেছে, আর কী হবে,’ এই বাহানায় কখনও পার্লার এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়, বরঞ্চ বয়েস হলে শরীরের প্রতি আরও যত্নশীল হতে হয়। শরীরের অবসাদ-ক্লান্তি দূর করতে এবং চাকচিক্য বজায় রাখার আদর্শ জায়গা হল বিউটি পার্লার। সংসারের প্রতি সব দায়িত্ব পালন করার পর নিজের জন্যও কিছুটা সময় রাখা উচিত। শরীরকে অবহেলা করা কখনওই উচিত নয়। ঠিক সময়ে হেয়ার ট্রিটমেন্ট, পেডিকিওর, ম্যানিকিওর, বডি স্ক্রাবিং ইত্যাদি। নিজেকে দেখতে তরতাজা লাগলে মনও আপনাআপনি উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। কাজে উৎসাহ বাড়ে, চট করে বয়সের ছাপ চোখে মুখে ফুটে ওঠে না। সাধারণত পঁয়তাল্লিশ বছরের পরই শরীরের ত্বকের টানটান ভাব চলে যায়। সঠিক ব্যবস্থা নিতে গেলে বিউটি পার্লার যাওয়া অবশ্যই কর্তব্য।

সোনালির শাশুড়ি-মায়ের প্রয়োজন ছিল একজন সাথির। বুদ্ধিমতী সোনালি সেটা প্রথমেই বুঝতে পেরেছিল। স্বামী-ছেলে নিয়ে একা মহিলা কতদিক সামলাবেন! তাই নিজের তরতাজা বয়েসে আর কিছুই করা হয়ে ওঠেনি। বয়েস বেড়ে গেছে, ছেলেও বড়ো হয়ে গেছে, এই বয়সে বিউটি পার্লার যাওয়ার ইচ্ছেটাও উবে গেছে, বেশ তো কেটে গেল জীবনের অর্ধেক সময়। সোনালির মতো বুদ্ধিমতী মেয়েরা সম্পর্ক গড়ে তুলতে, শাশুড়ি-মা কিংবা স্থানীয় কাউকে নিয়ে অনায়াসে চলে আসে বিউটি পার্লারে। নিজে দায়িত্ব নিয়ে সুন্দর করে তোলে বয়স্ক মহিলাটিকে। এ বড়ো ব্যক্তিগত অধিকার। শাশুড়ি-মা নিজের অজান্তেই নির্ভর করেন, বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন বউমার দিকে।

মনে রাখা জরুরি

–    বয়স বাড়লে শরীরে আরও যত্নের প্রয়োজন

–    পার্লার নিয়মিত যাওয়া উচিত

–    শরীরের যত্নের ব্যাপারে আলসেমি নয়

–    তরতাজা শরীর থাকলে মনও উৎফুল্ল থাকে

–    নিয়মিত চর্চায় চট করে বয়স বোঝা যায় না

–    শরীর চর্চা এবং যত্নে শরীরে তারুণ্যতা বজায় থাকে

 

ইমোশনাল ইকোয়েশন

অভীকের তার ব্যাপারে এমন নিস্পৃহ হয়ে যাওয়ার কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না নয়না। কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, যাকে সে নিজের স্বামী বলে জেনেছে এতকাল, সে কেমন যেন অচেনা হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। নয়নার সঙ্গে কথা বলতেও যেন ইদানীং ক্লান্ত বোধ করে অভীক। নয়না আঁচ করতে পারে হয়তো ‘অন্য কেউ’ এসেছে অভীকের জীবনে।

প্রমিত-কে মন খুলে সব কথা বলা সম্ভব নয় জয়ীতার। অথচ সে বুঝতে পারছে মনে মনে যোজন দূরত্ব তৈরি হয়ে যাচ্ছে তার স্বামীর সঙ্গে। নির্ভার হওয়ার আর নির্ভর করার একটি ভিন্ন আধার খুঁজে পেয়েছে জয়ীতা। ধীরে ধীরে ওই মানুষটিই হয়ে উঠেছে তার প্রেম। কোনও যুক্তিবুদ্ধি, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করেও কূলকিনারা পায় না জয়ীতা– সে জানে না এমন কেন হল, কী করে হল, শুধু জানে আর তার পক্ষে সেই মানুষটিকে জীবন থেকে বাদ দিয়ে বাঁচা সম্ভব নয়।

প্রায়শই এই ধরনের সম্পর্ক গড়ে ওঠে আমাদের আশেপাশে, চেনাপরিচিত মহলে, এমনকী দফতরেও। ঠিক দস্তুর না হলেও এমন ঘটনা আজকাল আর বিরল নয়। সমাজতাত্ত্বিকরা একে কেতাবি পরিভাষায় কী বলবেন জানা নেই, তবে এটা ঠিক যে এ যুগের মেয়েরা, পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এখন কর্মক্ষেত্রে নিজেদের অপরিহার্য করে তুলেছেন। এই কর্মজগতের যতরকম সংঘর্ষ কিংবা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় একজন পুরুষকে, ঠিক ততটাই ফেস করেন একজন মহিলা-কর্মীও। কর্মক্ষেত্রে দীর্ঘসময় অতিবাহিত করা এবং প্রতিদিন প্রতিনিয়ত কর্মজগতের নানা ঝক্বি সামলাতে সামলাতে, কখন যে দুটি নারী-পুরুষ পরস্পরের খুব কাছাকাছি চলে আসে, কেউ জানতেও পারে না।

শুধুমাত্র শরীর একজন পুরুষ ও নারীকে বাঁধতে পারে, এমন ধারণায় যারা বিশ্বাসী– তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে খানিকটা এলোমেলো করে দিয়েই হয়তো, দফতরেই গড়ে উঠতে পারে শরীরবর্জিত এমন এক ইমোশনাল রিলেশনশিপ। একটি পুরুষ ও একজন নারী সকলের অনবধানে নিজেদের ইমোশনাল কোশেন্ট-এর সদর্থক আত্মপ্রকাশে হয়ে উঠতেই পারেন জীবনসমরের সহযোদ্ধা। খুব পার্থিব লেনদেন বা দেনাপাওনা হয়তো সেই সম্পর্কের অন্যতম শর্ত না-ও হতে পারে– তবু হয়তো সময়েরই চাহিদায় একসময় মনের সুকোমল বৃত্তিগুলি পাপড়ি মেলে, পরস্পরকে ভালোবেসে ফেলে দুটি মন। নয়নার পক্ষে হয়তো বোঝা সম্ভব নয়, ঠিক কোন যুক্তি থেকে সেই ‘অন্য মেয়েটি’ হয়ে ওঠে অভীকের সমস্ত আশা, আকাঙ্খা, ভয়, ব্যক্তিগত জীবনের নানা টানাপোড়েন শেয়ার করার একমাত্র ক্ষেত্র। ঠিক যেমন প্রমিতেরও বোঝা সম্ভব নয়, কী করে এক অন্য পুরুষ জয়ীতার জীবনের ইমোশনাল শেয়ারিং-এর এক ও একমাত্র ক্ষেত্র হয়ে ওঠে!

আসলে এরকম ঘটনা এখন এমনই এক স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে বহু মানুষের জীবনেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে, যে এই সম্পর্ককে আর অস্বীকার করার উপায় থাকছে না। হ্যাঁ অভীকের ব্যবহারে পরিবর্তন আসা অস্বাভাবিক নয়। তার ইমোশনাল শেয়ারিং অন্য একটি ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হয়ে যাচ্ছে বলেই, সে এর পুনরাবৃত্তি করতে পারছে না, বাড়ি ফিরে, নয়নার সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও। প্রমিতের থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে জয়ীতারও হয়তো অপরাধবোধ আছে মনে মনে, কিন্তু প্রমিতকে সে কবেই বা তার সহমর্মী হিসাবে পেয়েছে জীবনে, যে নিশ্চিন্তে তার আবেগের বহিঃপ্রকাশ করতে পারে। এ এক আশ্চর্য রংমিলন্তি খেলা– যার শেষটা হয়তো আদতে কারওরই জানা নেই!

এক্সট্রাম্যারিটাল ইমোশনাল ইনভলভ্মেন্ট

 দুটি নারী-পুরষের অন্তরঙ্গতার মূলে যে যৌনতা থাকতেই হবে, এমন বিধিবদ্ধ নিয়ম নেই। গভীর ইমোশনাল বন্ডিং-এ শরীর থাকতেও পারে, আবার না-ও পারে। আসলে শরীর থাকবে কী থাকবে না, সেটা নির্ভর করে এমন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া ওই দুটি মানুষেরই উপর এবং খানিকটা পরিবেশ পরিস্থিতির উপরেও। তবে শরীর থাকুক বা না থাকুক, একধরনের আবেগজনিত দায়বদ্ধতা যে দুজনের মধ্যে থাকে এ কথা নিশ্চিত। প্রথমে বন্ধুত্ব, তারপর ইমোশনাল লেভেল-এ ইন্টার্যাকশন যদি একটি সম্পর্কে পরিণতি পায় এবং সেই সম্পর্কের পরিপূরক হিসাবে যদি দুটি মানুষের সেক্সুয়াল কেমিস্ট্রি-তে একটা সাজুয্য এসেই পড়ে, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

কেন এই সমান্তরাল সম্পর্ক?

 দাম্পত্যে যখন আবেগের মূল্য পরস্পর়ের কাছে থাকে না অথবা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যেই কিছু আবেগজনিত বিষয়ে গোপনীয়তা তৈরি হয়, যখন উভয়ের মধ্যে সততা বা কমিউনিকেশনের অভাব হয়, তখনই এক্সট্রাম্যারিটাল ইনভলভ্মেন্ট-এর পক্ষে অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়।

প্রতিদিন কর্মক্ষেত্রে নিজেকে ইনভলভ্ রাখাও নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই এক ধরনের অভ্যাস। সেখানে বাস্তবিকই হাঁফ ছাড়ার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ে এমন একজন সাথির, যে হবে এক ফালি আকাশের মতো– স্বচ্ছ ও নির্মল। এমন মানুষ-কে খুঁজে পেলে এবং প্রতিদিন তার সঙ্গে খানিকটা ব্যক্তিগত সময় শেয়ার করতে করতে তৈরি হয় এক্সট্রাম্যারিটাল ইনভলভ্মেন্ট।

দাম্পত্যজীবনে স্বামী বা স্ত্রী যদি উভয়ে উভয়কে সময় না দেন, একটা অভাববোধ থেকে অন্য কারও উপর তৈরি হতে পারে একটা ইমোশনাল ডিপেন্ডেন্স– যা ক্রমে রূপান্তরিত হতে পারে একটি অ্যাফেয়ার-এ।

দু’জন সহকর্মীর অন্তরঙ্গ হওয়ার স্বপক্ষে অনেকগুলি যুক্তি কাজ করে। প্রথমত, কাজের মিল, বস-এর প্রতি দু’জনের একই ধরনের অভিযোগ থাকা, অর্থনৈতিক বিষয়গুলি ভাগ করে নেওয়ার প্রবণতা এবং উভয়েরই অসুখী দাম্পত্য।

দাম্পত্যের সঙ্গে কখন বিরোধ

 যে-কোনও ইমোশনাল অ্যাফেয়ার শুরুতে অত্যন্ত সরল ও স্বচ্ছ থাকে। কিন্তু অন্য যে-কোনও সম্পর্কের মতো এক্ষেত্রেও তৈরি হয় কিছু পারস্পরিক গোপনীয়তা, মানসিক আদানপ্রদানের স্তর। এইরকম একটা পর্যায়ে এসে বস্তুত সম্পর্কের একটি ‘ডেনজার জোন’-এ প্রবেশ করাতে হয়, যখন আশপাশের সমস্ত সম্পর্ককে এই সম্পর্কের তুলনায় তুচ্ছ মনে হতে থাকে। যদি স্বামী বা স্ত্রী এই সমান্তরাল সম্পর্কের বিষয়ে ওয়াকিবহাল হন, তাহলে সমস্যা নেই কিন্তু দাম্পত্যে দূরত্ব, বিরোধ এবং ভাঙনের পরিস্থিতি তৈরি হয় ওই দ্বিতীয় সম্পর্ক-কে আড়াল করার প্রবণতা থেকেই। ফলত দ্বিতীয় সম্পর্কটাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে বৈবাহিক সম্পর্ক শুধু অবহেলিতই হয় না, অসম্মানিতও হয়।

অনেকে মনে করে এটা একজন স্বামী বা স্ত্রী-কে শারীরিক ভাবে ঠকানোর চেয়েও খারাপ, কারণ সমান্তরাল সম্পর্ক তৈরি হলে স্বামীর তার বৈধ স্ত্রীর প্রতি কিংবা স্ত্রীর তার স্বামীর প্রতি মানসিক সততা থাকে না। যে ইনভলভ্মেন্টটা পরিবারের প্রতি থাকার কথা ছিল, সেটা অন্যত্র ব্যয় হয়ে যাওয়ার ফলে ক্রমশ পারিবারিক অ্যাটাচমেন্ট আলগা হতেঞ্জথাকে। স্বামী বা স্ত্রী উভয়ে উভয়ের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হতে থাকেন মানসিক ভাবে এবং দাম্পত্য শুধু কিছু পার্থিব প্রয়োজনে দুটি মানুষকে আটকে রাখে। অন্যদিকে আবার দাম্পত্য সম্পর্কের এই শীতলতা, স্বামী বা স্ত্রীটিকে সেই দ্বিতীয় ব্যক্তির প্রতি আরও বেশি অনুরক্ত ও নির্ভরশীল করে তোলে। এ এক অদ্ভুত আবর্ত যার মধ্যে উক্ত দুটি মানুষ ও তাদের পারিবারিক জীবন পাক খেতে থাকে।

সামাজিক দৃষ্টিকোণ

সামাজিক ভাবে সম্পর্কটি গ্রহণযোগ্য কখনও নয়। অনেকেই মনে করেন এই ধরনের সম্পর্ক গড়ে ওঠার মূলে রয়েছে একধরনের ড্রামাটিক এক্সাইটমেন্ট অনুভব করার ইচ্ছা। একদিকে নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি ধাবিত হওয়ার স্বাভাবিক ইচ্ছে, অন্যদিকে অ্যাড্রিনালিন গ্রন্থির ক্ষরণে আকৃষ্ট হওয়ার সহজাত প্রবণতা– এগুলিই ইন্ধন জোগায় এই সম্পর্ক তৈরি করতে।

কারও মতে দাম্পত্যে অপূর্ণতা নতুনতর সম্পর্ক স্থাপনে সহায়ক। যারা সম্পর্কটার মধ্যে ইনভলভ্ড, তারা আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেন, এই সম্পর্ক জীবনের একটা উদ্দেশ্য-কে স্পষ্ট করে, নির্মল আনন্দ দেয়। সেই ‘অন্য জন’ তাকে তার ভাবনার রসদ জোগায়, সেই সব কথাই শোনায় যা সে শুনতে চায়, তার দুঃসময়ে প্রবোধ দেয়, সাফল্যের অংশীদার হয়।

কেউ কেউ বলেন দাম্পত্যযাপনে এক ধরনের পৌনঃপুনিকতা রয়েছে, যা কেবল সন্তান-সন্ততিদের বড়ো করা বা সাংসারিক কাজকর্মের সীমাবদ্ধতায় চূড়ান্ত একঘেয়েমির দিকে ঠেলে দেয়। সেক্ষেত্রে কারও সমব্যথি হওয়ার ভাবনা, বা নিঃস্বার্থ সাহচয,঱ একধরনের নির্ভর চাপমুক্ত হওয়ার অনুভূতি এনে দেয়। আত্মআবিষ্কারের এ এক অপ্রতিরোধ্য অধ্যায়, যা নিজেকে কখনও নিজের কাছে পুরোনো হতে দেয় না, সামাজিক চোখরাঙানিকে তুচ্ছ করেও এক অমোঘ নেশায় ডুবে থাকার ইন্ধন জোগায়।

বয়ঃসন্ধির সমস্যায় চিন্তামুক্ত রাখুন সন্তানকে

বয়ঃসন্ধির সময়টা হল কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের সূত্রপাত। এই সময় ছেলে, মেয়ে উভয়েই মধ্যে আসে মানসিক, শারীরিক ও আচরণিক পরিবর্তন। এই সময়ে হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে কিশোর-কিশোরীদের চিন্তাভাবনারও দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়। তারা আত্মনির্ভর হয়ে উঠতে চায় কিন্তু পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে সহজে খাপ খাওয়াতে পারে না।

অভিভাবকদের উচিত সন্তানের এই মানসিক পরিবর্তনকালে বন্ধুর মতো পাশে পাশে থাকা। এই সময় ছেলে-মেয়েরা খুব অল্পতেই রেগে যায়। তাই যতটা সম্ভব খেয়াল রাখতে হবে, Puberty-র সময়কালটায় সন্তানের রাগের প্রকাশ এমন হওয়া বাঞ্ছনীয় নয় যাতে অপর কেউ মানসিক বা শারীরিক আঘাতপ্রাপ্ত হয় বা অপরের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়।

অনেক সময় দেখা যায় সমবয়সিদের অন্যায় আচরণ আপনার সন্তান মেনে নিতে পারছে না অথবা তাদের দ্বারা প্রত্যাখাত হওয়ার কারণে, সে মুষড়ে পড়ছে, নিজের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। মূল্যবোধের সঙ্গে সন্তানকে কখনও আপোস করতে দেবেন না। যুক্তি দিয়ে ওর বন্ধুদের বোঝাতে সাহায্য করুন। সন্তানকে বলুন ইতিবাচক চিন্তাভাবনা রাখে এমন মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে এবং মনের মিল যার সঙ্গে হবে তাকেই বন্ধু বানাতে।

অপরের ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, ঠাট্টা সন্তানের মনে কষ্ট দিতে পারে। কারও বলা অপমানকার শব্দ, অঙ্গভঙ্গি এই সময় ছেলে-মেয়েকে বেশি কষ্ট দেয়। তারা নিজেদের অপমানিত, অযোগ্য মনে করে। সন্তানকে এই ধরনের বিদ্রুপ করা কথায় আমল দিতে বারণ করুন, এতে আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হওয়ার ভয় থাকবে না। ঠাট্টাকে ঠাট্টা হিসেবেই নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এমনকী যার জন্য এই সমস্যা তৈরি হয়েছে তার সামনে বন্ধুত্বের হাত বাড়ানোও যেতে পারে এতে তাকে শিক্ষা দেওয়াও হবে।

বয়ঃসন্ধির Puberty সময় কোনও কাজে ব্যর্থতাও তার জন্য প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। এই সময় চট করে মন ভেঙে যায়। যেখানে সে প্রত্যেক কাজে প্রশংসা পেতে চায় সেখানে ব্যর্থতা এনে দেয় লজ্জা, অপমান। এই সময় সন্তানের পাশে থেকে ব্যর্থতার কারণ খুঁজে নিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে এবং সেটা শুধরে দেওয়ার চেষ্টা অভিভাবকদেরই করতে হবে। সন্তানকে বাস্তবভিত্তিক লক্ষ্য স্থির করতে সাহায্য করুন এবং বোঝাতে হবে জীবনে সাফল্যের সঙ্গে ব্যর্থতাও থাকবে।

প্রত্যাশা অনুসারে প্রাপ্তি না হলেও দ্বন্দ্ব, সংঘাতের সৃষ্টি হবে। মূল্যবোধের গুরুত্বের পার্থক্য, ব্যক্তিত্বের পার্থক্য, পদমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হওয়া ইত্যাদি কারণেও সংঘাতের সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং এই সময় সন্তানের উপর নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতা থেকে অভিভাবকদের নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতে হবে।

সন্তানের মানসিক অস্থিরতার স্থিতিকে প্রাধান্য দিয়ে তার সঙ্গে সব বিষয় নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করা উচিত, যুক্তি নির্ভর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। জীবনের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব রাখতে তাকে সবদিক দিয়ে সাহায্য করতে হবে। জীবনে চলার পথে কৌতুক এবং রসবোধ যেন সন্তানের জীবন থেকে হারিয়ে না যায় তার গুরুদাযিত্ব অভিভাবককেই পালন করতে হবে।

সাধারণত উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মা-বাবার বিরোধ বাধে সন্তানের অতিরিক্ত স্বাধীনতা প্রকাশে, ব্যক্তিগত খরচের আকাঙ্ক্ষায়, সম্পর্কের পছন্দ-অপছন্দ প্রকাশ করায় কিংবা আধুনিক ফ্যাশন অনুযাযী সন্তানের চালচলনে এবং জীবিকা বাছাইয়ে ক্ষেত্রে। এই বিরোধ মাঝেমধ্যে মারাত্মক রূপ নেয়, যার ফলে এই বয়সের ছেলেমেয়েরা মা-বাবাকে ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতেও দ্বিধা করে না আবার কখনও জীবন থেকেও সরিয়ে দেয় নিষ্ঠুর আঘাত হেনে অথবা নিজেরা ডুবে যায় অবসাদের গভীরে এবং যে-কোনও নেশাকে অবলম্বন করে বাঁচার রাস্তা খুঁজে নেয়।

এগুলো ছাড়াও বয়ঃসন্ধিকালে Puberty ছেলে-মেয়েরা যৌনক্ষমতাও অর্জন করে ফলে দেহের আকস্মিক পরিবর্তন তার মনোজগতের উপর প্রভাব ফেলে। তাদের উচ্চতা এবং ওজন বৃদ্ধি পায়, ঋতুস্রাব শুরু হয়, শরীর ভারী হয়, হাড় চওড়া এবং দৃঢ় হয়। দেহে চর্বির আধিক্য হতে পারে। ছেলেদের ক্ষেত্রে পেশি দৃঢ় হয়, বুক ও কাঁধ চওড়া হয়। গলার স্বর ভাঙে, দাড়ি-গোঁফ গজায়। ছেলেমেয়ে উভয়ে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে শুরু করে এইসময়।

এই সময় শিক্ষক এবং অভিভাবক উভয়কেই দাযিত্ব নিতে হবে যথাযথ শিক্ষার ব্যবস্থা করার। সন্তানের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা এবং সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা অত্যন্ত ফলপ্রসূ হতে পারে। সন্তানের জন্য পর্যাপ্ত সময় ব্যয় করতে হবে। খবরদারি এবং অহেতুক নজরদারি পরিহার করা দরকার। সন্তানের মতামতের গুরুত্ব দিন। অতিরিক্ত আদর অথবা অতিরিক্ত শাসন দুটোই এই বয়সের ছেলেমেয়েদের ক্ষতির কারণ হতে পারে।

সুতরাং অভিভাবক এবং শিক্ষকদের হতে হবে সহানুভতিশীল। দরদি এবং বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার একান্ত কাম্য। এগুলিই পারে একটি কিশোরের জীবন সাজিয়ে তুলতে। বয়ঃসন্ধি সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং নেতিবাচক মনোভাব এই সময়ে ছেলেমেয়েদের উদভ্রান্ত এবং দিশাহারা করে তুলতে পারে। ফলে তারা অবসাদ এবং হতাশার গভীরে চিরতরে নিমজ্জিত হয়ে পড়তে পারে।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব