ওষুধ

আপনি পায়রা ভালোবাসেন খুব, তাই না?

একটু দূরে বসে ছেলেটি মেয়েটিকে প্রশ্ন করে। উত্তরের আশায় হয়তো তারই দিকে তাকিয়ে স্টেশন চত্বর একা বিকেলের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছাউনির ওপর দিয়ে সূর্যের আভাটুকু ক্ষীণ হয়ে আসছে ক্রমশ…

সরি?

না, এই যে আপনি পায়রাগুলোকে খাবার দিচ্ছিলেন, তাই জিজ্ঞেস করলাম। আপনি হয়তো পায়রা ভালোবাসেন।

হ্যাঁ তা ভালোবাসি। কিন্তু আপনি কে?

এই কথা বলে মেয়েটি ছেলেটির দিকে ঘোরে, তারপর সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে।

আমি কেউ না। ধরুন আমি একজন অজানা মানুষ। যে আপনার মতোই এই প্ল্যাটফর্মে একা বসে আছে।

মেয়েটি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে তাই আপনি চলে এলেন কথা বলতে?

না তা নয়। আমিও তো একাই বসেছিলাম। ভাবলাম আপনিও একা, আমিও একা। যাই হয়তো আলাপ হয়ে ভালো লাগবে! যাইহোক আমার নাম ঋষি।

মেয়েটি মজার ছলে বলে ওহ ধন্যবাদ ঋষিবাবু। তবে আমি আমার নাম বলতে একেবারেই আগ্রহী নই।

রেললাইনের দিকে তাকিয়ে ঋষি বলে কাউকে রিসিভ করতে এসেছেন?

অনেকক্ষণ ধরে ভাবতে ভাবতে মেয়েটি বলে আমি কি আপনাকে চিনি? না আমাকে বলুন, আমি কি এর আগে কখনও আপনার মুখোমুখি হয়েছি?

অবশ্যই। বেশ কয়েকবার। কিন্তু আপনি আমাকে দেখেছেন কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারব না। কারণ যতবারই দেখেছি আপনি খুব তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেছেন।

মেয়েটি এবার একটু আগ্রহ নিয়ে ছেলেটির দিকে ঘুরে বসে। কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে যেন তার চোখগুলি পড়ে ফেলতে চেষ্টা করে। তারপর ঘাড় নেড়ে বলে না মনে পড়ছে না।

সেটাই স্বাভাবিক…

আচ্ছা বলুন আমাকে শেষ কবে, কখন দেখেছেন?

ওহ! সেটা তো বেশ এক ঘটনা ছিল। নিউ লাইফ কফি শপ্-এ আপনি আমার সামনের সিটেই পেছন ফিরে বসেছিলেন। ধরে নিলাম কফিই খাচ্ছিলেন।

ওহ, আপনিই সেইজন যিনি…

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই ঋষি উত্তর দেয় হ্যাঁ আমি-ই সেই যে আপনার পড়ে থাকা পার্সটা নেওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলাম।

মেয়েটি লজ্জায় জিভ কাটে। তারপর ঘাড় নাড়ায়। লজ্জা নিয়ে বলে দেখুন আমি ভীষণ ভাবে দুঃখিত। সেদিন আপনাকে একটা ধন্যবাদও বলে আসতে পারিনি। আসলে…।

আসলে কী? পাত্তা দিতে চাননি? আজকের মতো?

এ বাবা না না! আসলে ওইদিন একটু সমস্যার মধ্যে ছিলাম। এক বান্ধবীর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎই একটা দরকার পড়ে যাওয়ায়, বেরিয়ে আসতে হয়েছিল তাড়াহুড়ো করে। আমার অবশ্যই ধন্যবাদ জানিয়ে আসা উচিত ছিল। পরে আপশোশ করেছি।

আচ্ছা ঠিক আছে। এটা কোনও ব্যাপার না। এটা সবার সঙ্গেই হয়। খারাপ ভাবার কিছু নেই। তাহলে তো আমরা আলাপ করতেই পারি? আমি মানুষটা অতটাও খারাপ নই!

 

( ২ )

হাই! ব্যস্ত নাকি? আমি ঋষি।

মেসেজের শব্দ পেয়ে হাত থেকে চিরুনিটা নামিয়ে রাখে উর্বি। তারপর গুছিয়ে বসে বিছানার উপর। উত্তর পাঠায় প্রথমত খুব ব্যস্ত না। দ্বিতীয়ত আপনার নাম্বার আমার সেভ করা আছে। তাই আপনি ঋষি না হয়ে মণি হতে পারবেন না, হা হা।

মেসেজটা করার পরেই যেন উর্বির মুখে এক প্রকার অজানা হাসি নেমে আসতে শুরু করে। একমনে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে।

ঋষি লেখে আজকে আপনাকে দেখলাম বাজারে একটা বইখাতার দোকানে দাঁড়িয়েছিলেন। আমি কি ঠিক বলছি?

হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কোথায় ছিলেন? আর ডাকলেন না-ই বা কেন?

কেউ একজন সঙ্গে ছিল বোধহয়। তাই আর কী। আর আমি যাচ্ছিলাম ওইদিক দিয়ে একটু কাজে।

তা ভালোই করেছেন না ডেকে। এক বান্ধবী ছিল। এই দিক দিয়ে না ডেকে বুদ্ধির পরিচয় দিলেন।

বুদ্ধি আছে বলছেন তাহলে?

সেটা তো আরও কিছুদিন গেলেই বুঝতে পারব।

বেশ অপেক্ষায় রইলাম।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে উর্বি বলে আজকে হরিণ দেখতে যাবেন?

হরিণ? কোথায় পেলেন তাকে? আপনি সঙ্গে গেলে অবশ্য যাওয়াই যায়।

উর্বি একটু শ্বাস ফেলে। তারপর বলে স্টেশনের পাশে চিড়িয়াখানাটা আছে না? ওখানে…

ওদিকে ঋষি একটু অবাক হয়ে উঠে বসে। মাথার চুল ঠিক করে। তারপর বলে এত সহজে দেখা করতে চাইছেন, বিশ্বাসই হচ্ছে না এখনও।

না না, তা নয়। আপনি আপনার মতো একা যাবেন, আমার সঙ্গে যেতে বলিনি। আমি আপনার সঙ্গে যাব কখন বললাম?

ঋষি একটু মৃদু হাসে। আশেপাশে তাকায়। উত্তর দেয় তাহলে আপনি? আপনি কার সঙ্গে যাবেন?

আমার এক বান্ধবী এল না ওইদিন! ষ্টেশনে যাকে আনতে গিয়েছিলাম। ও যাবে আমার সঙ্গে।

বেশ যান! ভালো করে ঘুরুন।

আপনি?

ঋষি মাথা নাড়ে তারপর উত্তর দেয় আমি ওসব ঝামেলার মধ্যে নেই। আপনারা দুজনেই ঘুরুন। আমি মাঝখানে গিয়ে কেন ঝামেলা পাকাতে যাব বলুন তো? এটা কি উচিত হবে?

উর্বি কোনও উত্তর দেয় না। ফোনটা হাত থেকে নামিয়ে রাখে। তারপর আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়।

 

( ৩ )

কয়েকদিন কেটে যায়। মাঝে তেমন আর কথা হয়নি খুব বেশি।

একদিন বিকেলে ঋষি ঘরে বসে মাউথ অর্গানটিকে পরিষ্কার করছিল। ফোনটা শব্দ করল। মেসেজ এসেছে।

ঋষি ফোনটা খুলে দেখে অচেনা একটি নম্বর থেকে মেসেজ আপনি সম্ভবত ঋষি। আমি উর্বির বান্ধবী। ও একটু সমস্যার মধ্যে আছে। ওর তেমন আর কোনও বন্ধুকে আমি চিনি না। আপনার নাম শুনেছি, তাই আপনার সঙ্গেই যোগাযোগ করছি!

ঋষি হাত থেকে যন্ত্রটা নামিয়ে রেখে গম্ভীর হয়ে কিছু মুহূর্ত ফোনটা ধরে থাকে, তারপর উত্তর দেয় কী সমস্যা হয়েছে?

সমস্যা তো অনেক কিছু! আপনি একবার ফোন করতে পারলে খুব ভালো হতো। আপনি যদি ফ্রি থাকেন আমি ফোন করি?

ঋষি মেসেজের উত্তর না দিয়ে সোজা কল করে।

বেশ কিছুক্ষণ ধরে ঋষিকে গম্ভীর দেখায়। চিন্তিত মনে হয়। কিছুক্ষণ কথা বলার পর ফোন রেখে চুপ হয়ে বসে থাকে। তারপর কী ভেবে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে যায়।

কিছুটা সময় কেটে গেছে। ঋষি উর্বির বাড়ির সামনে এসে বান্ধবীটিকে মেসেজ করে আমি নীচে আছি।

মেসেজ পেয়ে সে নীচে আসে, ঋষিকে উর্বির ঘরে নিয়ে যায়। তারপর উর্বিকে বলে ঠিক আছে আমি একটু বাইরের দিকে যাচ্ছি কিছু লাগলে ফোন করে দিস কেমন?

উর্বি শুয়েছিল তখন। শুয়ে শুয়ে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলে।

ঋষি ঘরের একটা কোণ থেকে একটি চেয়ার টেনে উর্বির কাছাকাছি যায়। তারপর চোখাচোখি হয়ে বসে। কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলে এই শরীরে হঠাৎ করে সিগারেট খাওয়ার কী এমন দরকার ছিল? নিজের শরীরটাকে আপনিই তো ভালো চেনেন।

উর্বি মাথা তুলে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে। তারপর উত্তর দেয় ও এমন কিছু না। দুদিন গেলেই ঠিক হয়ে যাবে। আপনাকে শুধু শুধু কষ্ট করে ডেকে আনল। আমার খুব খারাপ লাগছে।

চলে যাব তাহলে?

মাথা নীচু করে ছিল উর্বি। একটু ঘাড় ঘুরিয়ে নিয়ে বলে আমি কি তাই বলেছি? এসেই যখন গেছেন, একটু না হয় থেকে যান।

আপনি এখানে একা থাকেন, বলেননি তো কোনওদিন?

বলার মতো পরিস্থিতি আসেনি তাই হয়তো…

হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে ওষুধটা নিতে যায় উর্বি। ঋষি থামিয়ে দেয়, উঠে গিয়ে গেলাসে জল ভরে, ওষুধ আর জল নিয়ে সামনে ধরে।

প্রথমবার সিগারেট খেয়ে তাহলে ঘায়েল হলেন। কী মনে হচ্ছে? কেমন লাগল? আর নিশ্চয় ওদিকে পা বাড়াবেন না!

ভালোই লেগেছে। প্রথমবার বলেই কষ্ট হল। পরের বার থেকে আর হবে না।

 

পরের বার মানে? আপনি আবার খাবেন?

উর্বি অবাক হয়ে ঋষির মুখের দিকে তাকায়। তারপর বলে খাওয়ার জন্যই তো ধরলাম।

ঋষি কোনও উত্তর দেয় না। শুধু বলে ওষুধটা খেয়ে নিন।

উর্বি ওষুধ খায়। ঋষি আবার বলে আইসক্রিমও খেয়েছিলেন শুনলাম।

উর্বি উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে। হয়তো না বলার উপায় নেই বলেই নীরব থাকতে চায়।

ঋষি উত্তর না পেয়ে জানতে চায় জ্বরটা শেষ কখন মেপেছিলেন? কাশিটা খুব হচ্ছে?

জ্বর এই মাত্র মেপেছি। কমের দিকে। কাশিটা কমছে না।

সিগারেটটা আর খাবেন না। এটা অনুরোধ হিসেবেই নিন, প্লিজ আর খাবেন না এইসব। আপনার শরীর এসব নিতে পারবে না। আর কী-ই বা দরকার এই সবের?

উর্বি কথাগুলো শুনল নাকি বোঝা গেলো না। ঋষির কথা শেষ হওয়া মাত্র সে বলে ঠান্ডাটা ভীষণই লেগেছে মনে হচ্ছে। হয়তো কদিন ভোগাবে।

তারপর কথা শেষ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে।

ঋষি ওর এমন অবস্থা দেখে বলে ঠিক আছে ওষুধটা খেলেন, একটু রেস্ট নিন। আমি বাইরে গিয়ে বসছি।

উঠতে যাবে এমন সময় উর্বি হাত বাড়িয়ে ঋষির হাতটা ধরে নেয়। তারপর বলে এখানেই বসুন কোথাও যেতে হবে না। পকেটের যন্ত্রটি বাজান না একটু শুনি।

ঋষি খেয়াল করে, আসার সময় মাউথ অর্গানটা রেখে আসা হয়নি। বুক পকেট থেকে সেটা হাতে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

 

পরের দিন সকাল।

উর্বি মেসেজ করে জানায়, বাড়ি থেকে আনতে এসেছে। একটু পরেই ওরা এখানে পৌঁছে যাবে। তারপর বাড়ি। বেশ কিছুদিনের জন্য শহর থেকে দূরে। অবশ্য সুস্থ হলেই ফেরা যাবে। মেসেজটি পড়তে ঋষির একটু দেরি হয়ে গেল বোধহয়। মেসেজটি খুলে দেখল ঘণ্টাখানেক আগে পাঠানো। সে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই রেডি হয়ে নেয়।

সমস্ত কিছু সেরে যখন উর্বির বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছোল, গলিতে ঢোকার মুখে দেখল একটি গাড়ি বেরিয়ে বড়ো রাস্তার দিকে চলে গেল। ঋষি খেয়াল করল না। কোনও শব্দও কানে এল না।

উর্বির রুমের সামনেটায় ওর বান্ধবী দাঁড়িয়েছিল। ঋষিকে দেখে বলে ও তো এই বেরিয়ে গেল গো। আর একটু আগে এলে দেখা হয়ে যেত।

ঋষি পেছন ফিরে তাকায়। দেখে রাস্তাটা তখন ফাঁকা হয়ে আছে। সবকিছুই ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে কিনা, সে সেটা অনুভব করতে পারল না। শুধু বলল কিছু বলে গেছে?

মেয়েটি একটি ছোট্ট কাগজ হাতে দিয়ে বলে এই কাগজের টুকরোটুকু তোমাকে দিতে বলে গেছে। আর বলল তো কিছুদিনের মধ্যেই ফিরে আসবে।

কাগজটা হাতে নিয়ে সামনের বাড়িটাকে উপর-নীচ একবার দেখে নিয়ে ঋষি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর নিজের বাড়ির দিকে পা বাড়িয়ে রাস্তায় মিলিয়ে গেল।

অভিনয়ের পরে

মাঝরাতে ঘুম ভাঙতেই বিপ্লবের মনে পড়ল আজকের রাতটাই শেষ, তারপর থেকে পুরো একা। আচ্ছা পুরোপুরি একার জীবনটা ঠিক কেমন কাটবে? আদৌ কি কাটাতে পারবে ও? কথাটা ভাবতেই হাসি পেল। স্রেফ বোকা বোকা ভাবনা। পারলেও কাটাতে হবে, না পারলেও। আচ্ছা ঈশানীও কি একই কথা ভাবছে এখন? নাকি ঘুমোচ্ছে? ইচ্ছে থাকলেও জানার উপায় নেই। যদিও ঈশানী আর বিপ্লবের মধ্যে দূরত্ব মাত্র একটা দেয়ালের। কিন্তু সেই দেয়াল যতটা না দৃশ্যত তার থেকে অনেক বেশি অদৃশ্য।

বিপ্লব আর ঈশানীর আজ একসঙ্গে থাকার শেষ রাত। অবশ্য একসঙ্গে থাকা শব্দটা না বলে বরং এক ছাদের নীচে থাকার শেষ রাত্তির বলাই ভালো। কারণ একসঙ্গে থাকার রাত্তিরগুলো শেষ হয়ে গিয়েছিল প্রায় মাস চারেক আগে। কিংবা আরও একটু আগে থেকেই। সেই যবে থেকে অশান্তি শুরু হয়েছিল। সেইসব দিনগুলো ঝগড়া, অশান্তি, কান্নার সন্ধে, রাতগুলো…। উফফফ…!

কথাটা মনে হতেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল বিপ্লব। শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না। জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। এখন মার্চ মাসের শুরু। ভরা বসন্তকাল। শেষ রাতের দিকে শীত এসে জানলার পাশে দাঁড়ায়। এখনও সে কিছুটা রয়ে গেছে সেই খবর দিতে। কাচের শার্সির ওপারে ঘন অন্ধকার আর শিরশিরে ঠান্ডা দাঁড়িয়ে। বিপ্লবের ইচ্ছে হল কাচের জানলাটা খুলে সেই অন্ধকার আর শীতলতা গায়ে মাখতে। খুলতে গিয়েও খুলল না।

থাক। অনেকদিন আগে, অনেক অনেক দিন আগে- এমনই একটা ঘন মাঝরাতে আদর শেষ করে আদিম ভাবে ও আর ঈশানী এসে দাঁড়িয়েছিল এই জানলাটার সামনে। এমন অন্ধকার ছিল বাইরেটা। ঈশানী কাচের জানলা খুলে দিতেই ঠান্ডা নরম হাওয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরেছিল ওদের দুজনকে। তারপর প্রায় ভোররাত পর্যন্ত দুজন দুজনকে ওইভাবে জড়িয়ে থেকে পরস্পরের শরীরের ওম নিয়েছিল। মনে হয় যেন গত জন্মের কথা…। একটা জীবনের মধ্যেই মানুষের কতগুলো জন্ম যে লুকিয়ে থাকে…

জানলার সামনে থেকে সরে এল বিপ্লব। মন খারাপ লাগছে। কেমন যেন এলোমেলো লাগছে সব। আবার পুরোটা ভাবতে চেষ্টা করতে শুরু করল। সত্যিই কি ওর কোনও দোষ ছিল? ছিল হয়তো কিংবা ছিল না। আর ভেবে লাভ নেই। সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে।

তারপরেও আরেকবার ভাবার চেষ্টা করতে থাকল। আজ থেকে বেশ কিছু বছর আগের কথা। ছয় বছর। কম্পিটিটিভ এক্সামের ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে দুজনের পরিচয়। পরিচয় গড়িয়ে বছর দুয়েকের প্রেম। প্রেম গড়িয়ে চার বছর আগে বিয়ে। ততদিনে বিপ্লবের সরকারি ব্যাংকে চাকরি। গড়িয়াতে টু বিএইচকে ফ্ল্যাট নেওয়া। ঈশানীর সরকারি চাকরি পাওয়ার যে খুব ইচ্ছে ছিল তা নয়। সরকারি চাকুরে বাবার জোরাজুরিতে ভর্তি হয়েছিল ঠিকই কিন্তু মনপ্রাণ পড়ে থাকত গ্রুপ থিয়েটারে। ছোটোবেলা থেকে শখ। কলকাতার একটা নামকরা গ্রুপে ছিল। মাঝে মাঝে টুকটাক টিভি সিরিয়ালেও কাজ করেছে। বিয়ের আগে ঈশানী বারবার একটাই শর্ত রেখেছিল বিপ্লবের কাছে, আমার বাবার মতো তুমিও বলবে না তো অভিনয় করা, গ্রুপ করা ছেড়ে দিতে?

আমি তো ভাবছি আমিও তোমাদের গ্রুপে ভিড়ে যাব। আরেকটু বেশি সময় থাকতে পারব তোমার সঙ্গে। তখন হেসে বলত বিপ্লব।

কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই যখন আবার পুরোদমে নিজের অভিনয় জগতে ফিরে গেল ঈশানী, তখন থেকেই একটু একটু করে মনের অনেক ভেতরে একটা ক্ষোভ জমতে শুরু হয়েছিল বিপ্লবের। জমতে জমতে পাথর, পাথর জমে পাহাড়। দিন নেই রাত নেই রিহার্সাল। তারপর আজ বাঁকুড়াতে শো তো কাল আকাদেমি, বাড়ি ফেরার কোনও সময়ের ঠিক নেই। দিন রাত সব এক। ক্ষোভটা একসময় প্রকাশ পেতে শুরু করল।

ঈশানী প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করো, সংসারটা এইভাবে চললে কিন্তু একদিন সব ভেসে যাবে।

কী চাইছ তুমি, আমি সব ছেড়ে দিই?

তা বলছি না। কিন্তু একটু কম করলে কি হয় না?

না হয় না। এটা আমার প্রফেশন। আর তা ছাড়া বিয়ের আগে থেকেই তুমি কিন্তু সব জানতে।

হ্যাঁ জানতাম, কিন্তু এতটাও জানতাম না, তাহলে…

কী তাহলে?

কিছু না।

দিনে দিনে অসহ্য হতে শুরু করল। তীব্রতা বাড়তে বাড়তে একটা সময়ে দুজনেই বুঝল এই সম্পর্কটার আর কোনও অর্থ নেই। শুধুমাত্রই এক ছাদের নীচে থাকা। দুজনের শোবার ঘর আলাদা হয়ে গিয়েছিল আগেই। মন আলাদা হয়েছিল তারও অনেক আগে। তবু সামাজিক ভাবে থাকতে থাকতে একসময় দুজনেই বুঝল দিনের পর দিন এই অভিনয়ের কোনও মানে হয় না। এতে কষ্ট আরও বাড়ে। সুতরাং পাকাপাকি ভাবে আলাদা হয়ে যাওয়াই সততা।

সেই সিদ্ধান্তের আজই শেষ দিন। শেষ রাত। নিজের জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নিয়েছে ঈশানী। আর বহুদিন পর আজ সারাটা দিন পরস্পর দুজনের সঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবেই কথা বলেছে।

সকাল হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকল বিপ্লব।

কলিংবেলটা ননস্টপ বাজছে। এত সকালে আবার কে এল? রান্নার মাসিকে আজ আসতে বারণ করে দিয়েছিল বিপ্লব। যদিও সে সবই জানে তবু চোখের সামনে বাড়ির বউ চলে যাচ্ছে সেটা দেখাতে চায়নি ও। তাই রান্নার লোক, কাজের মাসি আজ দুজনেরই ছুটির দিন। তাহলে কে?

বিপ্লব দরজাটা খুলল। আর খুলতেই চূড়ান্ত বিস্ময়। সমীরণ! তাও আবার একা নয়, সঙ্গে ওর স্ত্রী, সায়ন্তনী।

কী রে ভূত দেখছিস নাকি? সর, ভেতরে ঢুকব। একগাল হেসে বলল সমীরণ। বিপ্লবের অনেকদিনের বন্ধু।

বিপ্লব খানিকটা হতভম্ব হয়ে দরজাটা খুলতেই হইহই করে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল সমীরণ, তারপর ওর সেই স্বভাবসিদ্ধ বাজখাঁই গলায় কোথায় তোর বউ? ডাক ওকে। বলে নিজেই ডাকতে শুরু করল, ঈশানী ও ঈশানী গেলে কই? আমরা এসে গেছি। এমন ভাবে বলল যেন ওর আসার কথা আগে থেকেই বলে রাখা ছিল। সমীরণটা চিরকালই এমন। হুল্লোড়বাজ। ধীরে সুস্থে কিছু করতে পারে না। সবকিছুতেই হইহই। অবশ্য ওর এই স্বভাবের জন্যই সেই কলেজ লাইফ থেকে ও খুব জনপ্রিয় ছিল। একডাকে চিনত সকলে। কলেজের সোশাল কিংবা প্রিন্সিপাল ঘেরাও, অ্যানুয়াল ফেস্ট কিংবা ইউনিয়নের চাঁদা তোলা– সব কিছুতেই এগিয়ে ছিল সমীরণ। দারুণ মজাদার, দেখতে সুন্দর বলে মেয়েদেরও নয়নের মণি ছিল ও। তবে প্রেমে অ্যালার্জি ছিল ওর। বক্তব্য ছিল ওসব লাইনে আমি নেই ভাই। প্রেমে বহুত টাইম দিতে হয়। আর আমার কাছে নো টাইম ফর দ্যাট।

সত্যি সত্যিই অনেক অফার আসা সত্ত্বেও কোনও প্রপোজাল অ্যাকসেপ্ট করেনি কখনও। বরং একেকটা মেয়ের অফার নিয়ে রীতিমতো মজা করত, অপদস্থ করত তাকে। তাতেই মজা পেত।

বন্ধুরা বলত এই যে তুই এত লোভনীয় অফার হেলায় হারাচ্ছিস একদিন এর জন্য তোকে পস্তাতে হবে দেখিস। মেয়েদের দীর্ঘশ্বাসের ফল কিন্তু মারাত্মক।

শুনে হো হো করে হাসত সমীরণ।

সেই সমীরণও একদিন বিয়ে করল এবং রীতিমতো সম্বন্ধ করেই ঢাকঢোল পিটিয়ে বিয়ে করল। সমীরণ চাকরি করত একটা বেসরকারি স্কুলে। ইংরেজি পড়াত। আর ওর স্ত্রী গভর্নমেন্ট স্কুলের ইতিহাসের টিচার। সত্যি বলতে সমীরণের বউকে মোটেও সুন্দর দেখতে নয়। অন্তত সমীরণের পাশে তো একেবারেই বেমানান। তাই নিয়ে বিপ্লব আর ওর বন্ধুরা মিলে বিস্তর আলোচনা করেছে। কানাঘুষোয় যেটা জানা গিয়েছিল যে সমীরণ নাকি কিছু একটা কেসে ফেঁসে গিয়েই বিয়েটা করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু সেটা সকলের কাছে গোপন রেখেছিল বলেই কেউ সরাসরি ওর কাছ থেকে কিছু জানতে পারেনি। তাও এইসবই প্রায় বছর তিনেক আগের কথা।

তারপর প্রায় বছর খানেক হয়ে গেল সমীরণ আচমকা ডুব। কারও সঙ্গে যোগাযোগ নেই। যদিও বন্ধুদের মধ্যে বিয়ের পরেও সব থেকে বেশি যোগাযোগ রাখত ওই। ওর মাধ্যমেই বাকি বন্ধুদের হালহকিকত জানা যেত। সেই সমীরণই যখন আচমকা সকলের সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় বন্ধ করে দিল তাই নিয়েও অল্পবিস্তর আলোচনা হয়েছিল বন্ধুদের মধ্যে। তারপর যা হয় আর কি। কিছুদিনের মধ্যেই আবার যে যার জগতে। ভুলেই গেছিল সকলে। বিপ্লবও।

সেই সমীরণ আজ আবার সামনে। তবে প্রথমে দেখেই একবারে চিনতে পারেনি বিপ্লব। একটু সময় লেগে গেছিল। সেই সুন্দর চেহারাটা একেবারে ফুলে বেগুন। মুখটাও ফুলে ঢোল। চোখের তলায় কোলেস্টেরলের কোলবালিশ। শুধু যেন বাইরের হইহই-টাই রয়ে গেছে। আসল সমীরণ গেছে হারিয়ে। অবশ্য এমনটা না-ও হতে পারে, পুরোটাই বিপ্লবের ভ্রম। পৃথিবীর দুখী মানুষেরা বাকি সকলকেই দুখী দেখতে চায়।

কিন্তু তার থেকেও বড়ো সমস্যা হল এই আজকের দিনে সমীরণের সস্ত্রীক চলে আসা। হতচ্ছাড়াকে এতদিন পর আজই আসতে হল! একটু পরেই হয়তো ও সব জেনে যাবে। তারপর কী করবে কে জানে! আচ্ছা মুশকিল তো। পুরো অকওয়ার্ড সিচুয়েশন।

কোথায় রে তোর বউ কোথায় লুকোল, শিগগির ডাক। আর তুই চটপট বাজারে যা। ভালো করে বাজার করবি। আজ আমরা কিন্তু দুপুরটা এখানেই কাটাব। যাব সেই বিকেলে।

সে তো খুবই ভালো কথা, কিন্তু আগে একটা ফোন তো করতে পারতিস।

হুঁ পারতাম। বাট করিনি। এমনকী তোর এখান থেকে সন্ধেবেলায় যাব আরেকজনের বাড়িতে। রাত্রে ওর ফ্ল্যাটেই থাকব। ওদেরও কিছু বলিনি। গিয়ে ব্যাটাদের চমকে দেব। তবে কাদের কাদের বাড়ি যাব জিজ্ঞেস করিস না। বলব না। পরে সব জানবি।

তা এমন প্ল্যানের কারণ? জিজ্ঞেস করল বিপ্লব।

ধীরে বৎস ধীরে, সব বলে দিলে কী করে হবে? বললাম তো সব ক্রমশ জানবি। আরে ও ঈশানী তুমি গেলে কই? হ্যাঁ রে তোর বউ বাড়িতে নেই?

হুঁ আছে তো। ওর ঘরে… বলেই থমকে গেল বিপ্লব।

ওর ঘরে মানে? তোরা কি আলাদা আলাদা ঘরে থাকিস নাকি?

আরে না না মানে অন্য ঘরে।

দাঁড়াও আমি ডাকছি, কোনদিকে ঘরটা? জিজ্ঞেস করল সায়ন্তনী।

অ্যাঁ…

আরে ঘরটা বলো। অ্যাঁ, কি?

বাধ্য হয়ে আঙুল তুলে বিপ্লব ওর ঘরের পাশের বন্ধ দরজাটা দেখাল।

দরজার সামনে গিয়ে টোকা দেওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তেই দরজা খুলে বেরিয়ে এল ঈশানী। একেবারে ঠিক সময় বুঝেই বেরিয়েছে। বিপ্লব টেনশনে ছিল ঈশানীর রিয়্যাকশনটা ঠিক কেমন হবে। হয়তো খারাপ কিছু, সকলকে অপ্রস্তুত করে দেওয়ার মতো কিছু। কিন্তু না, একেবারে স্টেজের মতোই নিখুঁত অভিনয় করল। দরজা খুলেই একগাল হাসি দিয়ে বলল, ওরেব্বাবা এত সকাল সকাল অতিথির আগমন যে। ব্যাপার কি?

এই একটু হনিমুনে বেরিয়েছি দুজনে। বলে সায়ন্তনীর হাত ধরল সমীরণ। দেখে এক মুহূর্তের জন্য বুকের ভেতরটা অকারণে চিড়িক করে উঠল বিপ্লবের। আর এক পলকের মধ্যে চোখাচোখি হল ঈশানীর সঙ্গে। দেখে মনে হল না ঈশানীর মধ্যে ওই দৃশ্যের কারণে কোনও ভাবান্তর হয়েছে।

খুব ভালো করেছিস। কিন্তু চেহারাটার এমন অবস্থা করলি কী করে?

সঙ্গদোষে ভাই। বলেই সায়ন্তনীর দিকে তাকাল সমীরণ। দুপুরে কী খাওয়াবি বল?

বিপ্লব অকূলপাথারে পড়ল। কি বলবে ভেবে পেল না। ঈশানী কি এখনই বেরিয়ে যাবে? ভাবতে ভাবতেই দেখল সায়ন্তনী ঈশানীর ঘরের দিকে এগোচ্ছে। তোমাদের বাড়িতে সেই একবারই এসেছিলাম বিয়ের পর। ওর কাছে শুনেছি তোমরাও এখনও আমাদের মতো ঝাড়া হাত পা? তা ফ্যামিলি প্ল্যানিং আর কতদিন?

সায়ন্তনীর কথা শুনে সামান্য হাসল ঈশানী। উত্তর দিল, দেখি কতদিন।

এই, তোমরা কোথাও বেরোনোর প্ল্যান করছিলে নাকি? সায়ন্তনীর কথায় চমকে উঠল বিপ্লব।

কেন?

ঘরে বড়ো বড়ো বাক্স রাখা দেখছি খাটের উপর।

হ্যাঁ একটু বেরোনোর ছিল। ভাবলেশহীনভাবে উত্তর দিল ঈশানী।

এবাবা তাহলে তো সত্যিই ভুল দিনে চলে এসেছি। পরে একদিন… বলে থামল সায়ন্তনী।

অন্যদিনে কি আর আসার সুযোগ পেতাম আমরা, বলে জোর করে হাসল সমীরণ।

আরে বাবা কোনও ব্যাপার না। আমরা দুজনে কোথাও যাচ্ছিলাম না। আমারই একা এক জায়গায় যাওয়ার ছিল। সেটা বিকেলে গেলেও চলবে।

একা? মানে? এই এত বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে একা একা নিরুদ্দেশে যাচ্ছিলে কোথায়? ঈশানীকে জিজ্ঞেস করল সায়ন্তনী।

সায়ন্তনীর প্রশ্নে বিপ্লব কাঠের পুতুলের মতো স্থির হয়ে থাকল। এর কী উত্তর দেবে ঈশানী, তার অপেক্ষা করতে থাকল।

কিছু না, একটা শো আছে, সেই কারণেই। বিকেলে বেরোলেও হবে।

নাহ্, অভিনয়টা সত্যিই নিখুঁত পারে ঈশানী। কী অবলীলায় বলতে পারল এত বড়ো মিথ্যাটা, কিন্তু একটা ব্যাপারে ও মনে মনে অবাক হচ্ছিল যে, সমীরণ যেহেতু ওর বন্ধু তাই ওর কাছে নিজের পরিবারের দৈন্য লুকানোর একটা দায় আছে, কিন্তু ঈশানীর সেই দায় নেই, এমনকী ওদের দুজনের সঙ্গে কোনও ঘনিষ্ঠতাও নেই কোনওকালে। তাহলে এই লুকোচুরি কেন? নেহাতই সৌজন্য? আশ্চর্য!

যা যা ব্যাটা জমিয়ে বাজার করে নিয়ে আয়। বলল সমীরণ।

হ্যাঁ যাচ্ছি। তুই যাবি সঙ্গে?

খেপেছিস? আমি আজ বউ ছাড়া এক মুহূর্তও থাকছি না।

কেন রে আজ ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি নাকি তোর?

উঁহু। তার থেকেও বড়ো ব্যাপার। পরে জানবি। এখন যা বেরো। আমরা তিনজনে মিলে একটু গল্প করি।

কিচেনে ঢুকে বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে বিপ্লব ভাবল আজ সকালটা কেমন হওয়ার ছিল আর কেমন হতে চলেছে। সমীরণরা না আসলে হয়তো এতক্ষণে ঈশানী চলেও যেত। কিন্তু বদলে যেটা হল তা আরও ঘাঁটা কেস। পুরো একটা জগাখিচুড়ি সিচুয়েশন। ব্যাগটা হাতে নিয়ে ফিরতেই চমকে উঠল বিপ্লব। সামনে ঈশানী দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুজনে মুখোমুখি হল। দুজনেই চুপ।

কিছু বলবে?

তোমার বন্ধু চিংড়ি খেতে চাইছে সেটাই বলতে এলাম।

আচ্ছা। বলে একটু থেমে বিপ্লব বলল, সরি, আমি আসলে জানতাম না ওরা এইভাবে চলে আসবে।

ইটস ওকে।

তোমার প্রবলেম হচ্ছে বুঝতে পারছি।

আমি বিকেলে যাব।

থ্যাংকস, মুখ থেকে বেরিয়ে গেল বিপ্লবের। যেভাবে মানুষ পরিচিত কিংবা স্বল্প পরিচিত মানুষের কাছ থেকে উপকার পেলে বলে ওঠে, সেইভাবেই বলল।

তার উত্তর দিল না ঈশানী। সমীরণ আর সায়ন্তনী এখন ড্রয়িংরুমে বসে। ওদের গলার শব্দ আসছে। এই সাতসকালে অন্যের বাড়ি এসে এত ফুর্তির কী আছে ভেবে পেল না বিপ্লব।

ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে এল। অন্যমনস্ক ভাবেই বাজার করছিল আর বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল অনেক পুরোনো দিনগুলোর কথা। ঈশানীর কথা, সমীরণের কথা, কলেজ জীবনের সেই দিনগুলো। অনেক অনেক কথা। সব কেমন যেন হয়ে গেল জীবনটার।

ঈশানীর সঙ্গে অশান্তি খুব বেশিদিন এগোয়নি। আসলে ওদের দুজনেরই লড়াই ঝগড়া এইসব করতে রুচিতে বাধে। তবে দুজনেই বুঝতে পারছিল, হচ্ছে না, এইভাবে আর খুব বেশিদিন নয়। আর বেশিদূর এগোনো যাবে না। কিন্তু সেই কথাটা কে কবে বলবে তাই নিয়ে ভাবতে ভাবতেই একদিন ছুটির দিন সকালে ঈশানী নিজেই দায়িত্ব নিয়ে বলেছিল বিপ্লবকে। তোমার সঙ্গে আমার একটু কথা আছে।

কী কথা শোনার আগেই বুঝে গিয়েছিল বিপ্লব। যেভাবে বোঝা যায়। তবু বসেছিল, শুনেছিল সবটা। তারপর বলেছিল ওকে। আমার কোনও আপত্তি নেই।

আপাতত ডিভোর্স নয়, তবে সেপারেশন। ঈশানী ওর গ্রুপেরই একটি মেয়ের সঙ্গে তার মেসে রুম শেয়ার করে থাকবে।

সেই আলোচনা হয়েছে প্রায় দিন দশেক আগে। হ্যাঁ ঠিক দশ দিন আগেই।

বাজার থেকে বাড়িতে আসতেই হাউ হাউ করে উঠল সমীরণ। কী রে এত দেরি! আমরা তো ভাবলাম বাজার করতে গিয়ে পালালি বুঝি। যা চিপকুস তুই। বলে নিজেই হো হো করে হেসে উঠল। বিপ্লব সামান্য হেসে বলল নাহ্, কোথায় আর পালাব? আমার পালানোর কোনও জায়গা নেই। বলে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে কিচেনে ঢুকল। ওর পিছনে আসল ঈশানী। ওকে দেখে বিপ্লব নীচু গলায় বলল, সরি, তোমায় খুব প্রবলেমে ফেলে দিলাম। রান্নার লোকও আজ আসবে না।

ইটস ওকে। তুমি ওদের কাছে গিয়ে বসো, আমি সামলে নিচ্ছি। বিপ্লব অবাক হচ্ছিল, এই মেয়েটাই আজ চলে যাচ্ছিল, হয়তো… হয়তো না, সত্যিই চলে যাবে চিরকালের জন্য বিপ্লবকে ছেড়ে, অথচ এত ক্যাজুয়াল রয়েছে কী করে। কই বিপ্লব তো এমন সহজ হতে পারছে না, বারবার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে। আচ্ছা এমনটা কি ঈশানীও ভাবছে? না নিশ্চয়ই ভাবছে না। বিপ্লব কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঈশানীকে, পারল না।

কিচেনের সামনে এসে দাঁড়াল সায়ন্তনী। কী ব্যাপার কত্তা-গিন্নিতে কি ফুসুর ফুসুর হচ্ছে? যান আপনি বন্ধুর সঙ্গে গপ্পো করুন গে আমরা এদিকটা দেখছি।

নাহ্ গুজুর গুজুর আর কি?

থাক আর লজ্জা পেতে হবে না। কতদিন বিয়ে হল যে এখনও ফিসফিসে প্রেমের কথা ফুরোল না? মুচকি হেসে বলল সায়ন্তনী।

উত্তর দিল না বিপ্লব। ঈশানীও কিছু বলল না। ম্লান হেসে সরে এল বিপ্লব। সমীরণের কাছে গেল। সামনে যেতেই কথার ফুলঝুরি শুরু।

সারাদিন কেটে গেল গল্পে, খাওয়াদাওয়া, পুরোনো সব কথায়। বিপ্লব যেন সত্যিই কখন ভুলে গেল আজ সকালে কী ঘটতে চলেছিল কিংবা ওরা চলে যাওয়ার পর কী ঘটবে। সমীরণ আর সায়ন্তনীর কারণেই হয়তো বিপ্লব বা ঈশানী কেউই খুব বেশিক্ষণ চুপ বা গম্ভীর থাকতে পারেনি। বিপ্লব অবাক হচ্ছিল বিয়ের এত বছর পরেও ওদের দুজনের মধ্যে কী গভীর বন্ধুত্ব, প্রেম। একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলে কিংবা খুনসুটি করে যেন সদ্য বিয়ে হয়েছে কয়েকদিন আগে। এমনও হয়?

কথায় কথায় দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধে। বাইরে রোদ্দুর ঢলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবের বুকের ভেতরেও মেঘ জমা হচ্ছিল। অস্থির হয়ে উঠছিল মনটা। অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। ওর আর ঈশানীর মধ্যে এমন আর কিছু নেই যার জন্য একসঙ্গে থেকে যাওয়া যায়। তাহলে? ঈশানীর মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল বিপ্লব। ওরও কি এমন কিছু হচ্ছে। কিন্তু কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। আগাগোড়া নিখুঁত অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছিল ঈশানী।

একসময় উঠে দাঁড়াল সমীরণ। না রে আর না, ঢের গপ্পো হল, এবার উঠি, নইলে বাকি ব্যাটাদের জ্বালানো হবে না।

এখনই চলে যাবি? ফস করে মুখ থেকে বেরিয়ে এল বিপ্লবের।

হ্যাঁ আর দেরি করলে পৌঁছোতে পারব না। আজই যেতে হবে। আর তো সুযোগ হবে না ভাই। বলেই হো হো করে হেসে উঠল সমীরণ। বলল আমরা দুজনেই, যে রেটে ব্যস্ত থাকি। দুজনের ভালো করে কথা বলারই ভাগ্য হয় না, বেরোনো তো দূরের কথা।

তোদের দেখে কিন্তু সেটা মনে হয় না। বলল বিপ্লব।

আর দেখে কি কিছু মনে হয় রে ভাই। এই যেমন তোদের দুজনকে বাইরে থেকে দেখে কেউ বলবে… বলে পজ দিল সমীরণ।

ধক করে উঠল বিপ্লবের বুক। জেনে গেছে সব! কে বলল? কী করে বুঝল।

আরে ভাই সব বোঝা যায়, হাঁ করে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে কী হবে? এমন অমর প্রেম তোদের পুরো চিরদিনই তুমি যে আমার… বলেই আবার হাসি।

তাড়া দিল সায়ন্তনী। অনেক ইয়ার্কি হয়েছে এবার চলো।

ওক্বে স্যার গুডনাইট। থ্যাংক ইউ ম্যাম। দারুণ লাঞ্চ হল। আজীবন মনে রাখব। ঈশানীর দিকে তাকিয়ে বলল সমীরণ।

আবার আসবেন দুজনে। সামান্য হেসে বলল ঈশানী।

দেখা যাক। চললাম তাহলে।

চলে গেল দুজন। বিপ্লব আর ঈশানী আবার একা। এক মুহূর্ত পরস্পর দুজনের মুখের দিকে তাকাল তারপর ঈশানী নিঃশব্দে চলে গেল ওর ঘরের দিকে। এবার বোধহয় ও-ও বেরোবে।

ফোন বাজছে বিপ্লবের। হাতে মোবাইলটা তুলে নিয়ে দেখল অরূপের ফোন। অরূপও ওদের গ্রুপের বন্ধু। নাম্বার আছে ঠিকই যোগাযোগ খুব কম। আজ হঠাৎ!

হ্যাঁ অরূপ বল।

হ্যাঁ রে তোদের বাড়িতে কি সমীরণ আর ওর বউ এসেছিল?

হ্যাঁ এই তো বেরোল। কেন?

আশ্চর্য চিজ তো ওরা!

কেন কী হয়েছে?

আজ ভোর পাঁচটার সময় ওরা দুজন আচমকা আমাদের বাড়ি এসেছিল। ঘুম থেকে টেনে তুলে প্রায় ঘন্টা খানেক ছিল দুজনে। চা খেয়ে তারপর বিদায় নিয়েছে। বলে আজ নাকি ওরা দুজন মিলে সব পুরোনো বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি ঘুরবে। কিন্তু কাদের বাড়ি যাবে কিছুতেই বলেনি।

হ্যাঁ আমাকেও তাই বলেছে। কিন্তু ব্যাপার কী?

আরে ব্যাপারটা অদ্ভুত। ওরা চলে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর আমার ড্রয়িংরুমে সোফার কোণে একটা ছোটো ভাঁজ করা কাগজ পাই। খুলে দেখি, চিঠি। সমীরণের। সেখানে লিখেছে আজ নাকি ও আর সায়ন্তনীর একসঙ্গে থাকার শেষ দিন। মানে দুজনে সেপারেট হয়ে যাচ্ছে। তাই শেষবারের মতো দুজনে বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি ঘুরবে। আমি একবার শুনেছিলাম যে ওদের মধ্যে ঠিক বনিবনা হচ্ছে না। সে ঝামেলা ওদের বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু তাই বলে এতদিন পরে এমন অদ্ভুত প্ল্যান… ওরা কি পাগল নাকি?… এসবের মানে কি? চিঠিটা পেয়েই আমি অনেকবার ফোনে ট্রাই নিয়েছিলাম কল করার, কিন্তু ফোন সুইচ্ড অফ…

কথা আর কানে আসছিল না বিপ্লবের। ধপ ধপ করে শব্দ হচ্ছিল ভেতরে। ফোনটা কেটে দিল বিপ্লব। ঈশানী খুব ধীরে ধীরে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। একহাতে ওর বড়ো বাক্স আর অন্য হাতে একটা খোলা কাগজ।

তোমার বন্ধুর চিঠি। আমার ঘরের খাটে রেখে গিয়েছে, বলে কাগজটা বাড়িয়ে দিল ঈশানী।

চিঠি নিতে এগিয়ে এল না বিপ্লব। একভাবে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ঘরের মাঝখানে।

কাগজটা খুব যত্নে ড্রয়িংরুমের সেন্টার টেবিলের ওপর রাখল ঈশানী। তারপর নিজের বাক্স সমেত পা ঘষে ঘষে এগোল মেইন গেটের দিকে। ভাঙা গলায়, সাবধানে থেকো বলে, ছিটকিনি নামিয়ে দরজা খুলে বেরোতে যাবে, পিছন থেকে বিপ্লব খুব নীচু গলায় বলে উঠল, ঈশানী।

উঁ।

বলছি …. যে তোমার কাছে  … মানে … আর সামান্য একটু সময় হবে?

ঈশানী উত্তর দিল না। তাকাল বিপ্লবের দিকে, তাকিয়েই রইল। আর নেহাত যান্ত্রিক কারণেই আবার বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা ….

ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট

পিয়ানোটা নিয়ে বসে পড়ে রোজ অফিস ফেরত অবিনাশ। তথ্য-প্রযুক্তি ইঞ্জিনিয়র, চাকরি সূত্রে তার এখন হায়দরাবাদে পোস্টিং। সংসার নিয়ে মেতেছে দিব্যি। বাচ্চা মেয়ে মৌপিয়া বড়ো দুষ্টু হয়েছে। বয়সটাই দুষ্টুমির। অবিনাশের স্ত্রী, মনামিও হায়দরাবাদে এসে একটা চাকরি জুটিয়ে নিয়েছে। পাড়ার মধ্যেই ছোটোখাটো নার্সারি স্কুলে কর্মরতা। বাচ্চাটাকে দেখভালের জন্য ঘরে একজন মাসি রেখেছে।

মৌপিয়ার সারাদিন কাটে মাসির সঙ্গে। মাসি তদারকি করে ছোট্ট মেয়েটার। খেলনার পাহাড় ঘরময়। বাবা-মা সারাটা দিন বাইরে। তাই মাসির সঙ্গে পরিপাটি করে পুতুলের সংসার পেতেছে মৌপিয়া। খুব একটা কান্নাকাটি করে না সে এখন। সয়ে গিয়েছে সব। পুতুল, খেলনা, গাড়ি আরও কত আধুনিক রকমারি খেলনাপাতি। কোনওটি মা পুতুল, কোনওটি বাবা পুতুল। পুতুলের যত্নআত্তির শেষ নেই মৌপিয়ার।

এদিকে কাজ থেকে বাড়ি ফিরে শ্রান্ত-ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দেয় অবিনাশ। অফিসে কাজের চাপ প্রচণ্ড। রাতেও তাকে নিয়ম করে অফিসের কিছু কাজ সারতে হয়। এমন রুটিনেই বাঁধা তার জীবন। মৌপিয়ার যত আবদার বাবার কাছে। মা স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরে সংসারের কাজেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

অবিনাশ কখন মৌপিয়ার খেলনার দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। মৌপিয়া নাড়িয়ে দিলে সম্বিৎ ফেরে অবিনাশের। চেনা রুটিনটা বেশ বদলে গিয়েছে এখন। মনামি তো সংসার নিয়ে ব্যস্ত। ইদানীং কেমন যেন মনমরা অবিনাশ। মনে পড়ে যায় গাঁয়ে বিস্তৃত উঠোন, পথ-মাঠ-ঘাট, সব কিছু। গ্রামীণ জীবন আজও তাকে টানে। কোনও কিছু মনামির নজর এড়ায় না। আসলে এইভাবে কখনও ঘরবন্দি হতে হবে ভাবেনি অবিনাশ। সে ঘরবন্দি হওয়ার ছেলেও না।

দুনিয়াজুড়ে এখন চলছে লকডাউন। আমাদের দেশেও। হায়দরাবাদ শহরেও প্রথম দিকেই এমন ভয়ঙ্কর করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিয়েছিল। কিন্তু অফিস কাছারি খোলা ছিল। তবে এখন সর্বত্র বন্ধের চেহারা। তাই মৌপিয়ার সঙ্গেই সারাটা দিন কেটে যায় অবিনাশের। এতগুলো দিন এইভাবে বন্দিদশা আর ভালো লাগছে না অবিনাশের। কাজের মাসিও ইদানীং আসে না। সারাটা দিন তার অবসর। বিকালে ফ্ল্যাটের ছাদে ফ্যামিলি নিয়ে একটু সময় কাটায়। ব্যস, তারপর সেই ঘরবন্দি জীবনযন্ত্রণা!

শৈশব থেকে পুরুলিয়ার গ্রামের বাড়িতে হই হই করে কেটেছে দিনগুলো। স্কুল, কলেজ, হোস্টেল আনন্দ তো ছিলই কিন্তু এইভাবে জেলবন্দির মতো বন্দি হতে হবে ভাবেনি কখনও। ভ্রমণপিপাসু অবিনাশের যন্ত্রণাটা তাই অন্যরকম। লকডাউন তার কাছে অভিশাপের মতো। সারাটা দিন মোবাইল নিয়ে খুটখাট আর কত ভালো লাগে!

কখনও মেয়ে খেলনা আর খেলার সাথি হয়। ভাবতে থাকে অনেক পুরোনো কথা। কী দারুণ সংসারের আদলে পুতুলের সংসার গড়েছে মৌপিয়া। সামনের এক ফালি বারান্দায় রোদ চুঁইয়ে পড়ে। সাতসকালে পাখিদের আনাগোনা। অথচ এমন ছিল না গত মাসেও। পাখিগুলো বেশ সাহসী হয়েছে মনে হয়। মৌপিয়া পাখির ঝাঁকের খুব কাছে এসে যায় কখনও। বেশ রংবেরঙের পাখিগুলো। পাখিদের কিচিরমিচির ঘরের পরিবেশটা অন্যরকম করে দেয়।

নিস্তবদ্ধতার মধ্যে শব্দ শোনা যায়। সামনের মেইন রোড ধরে যানবাহনের রেষারেষি নেই, নেই ভোঁ ভোঁ আওয়াজ। এসব নিয়ে এক একটা দিন কাটছে ছোট্ট দু-কামরার ঘরে অবিনাশদের। এসব কিছুই নজর এড়ায় না অবিনাশের। এর মধ্যে স্ত্রী মনামি এসে বলে, জানো নার্সারি স্কুল এই মাস থেকে মাইনে দিতে পারবে না। এসব নিয়ে কিছুক্ষণ কথা হয় তাদের। যদিও তাতে কিছু যায় আসে না অবিনাশের। লকডাউন কবে শিথিল হবে, আবার পৃথিবী সুন্দর হবে এমনটাই ভাবতে থাকে সে।

সকলের প্রাতরাশ রেডি করে ডাইনিং টেবিলে রাখল মনামি। তাকে বেশ মনমরা লাগছে আজ। আনমনা হয়ে টেবিলে সকালের লুচি-তরকারি খাওয়ার প্রস্তুতি চলছে অবিনাশদের। এদিকে বাঁ হাতে ধরা মোবাইলে একটা নোটিফিকেশন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। টাচ করতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল অরুণিমা চৌধুরী। অ্যাকসেপ্ট করবে কিনা ভাবছে অবিনাশ। খুব চেনা নামটা। এক অজানা আনন্দে বুক ভরে গেল তার।

এমন আনন্দ কখনও সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় না। অবিনাশ মেয়ের সঙ্গে খেলায় মেতে ওঠে। সত্যিই তার বাল্যবন্ধুর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। মেয়ের সঙ্গে খেলতে খেলতে এক ঝলক খুশির শীতল বাতাস যেন তাকে ছুঁয়ে যায়। মেসেঞ্জারে একটা ওয়েলকাম মেসেজ ছেড়ে মৌপিয়ার সঙ্গে ফের খেলতে থাকে অবিনাশ।

মনে পড়ে যায় সেই ছোটোবেলায় পুরুলিয়ার গ্রামের বাড়ির স্মৃতিকথা। অবিনাশ সেই সময় কারও সঙ্গে খুব একটা মিশত না। ঘরবন্দি সবসময়। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেছে সবে। একটা সময় খুব বেয়াড়া ছিল অবিনাশ। পাড়াশুদ্ধ তটস্থ থাকত সকলে। উৎসব অনুষ্ঠান নিয়ে পাড়াটা মাতিয়ে রাখত। চাঁদার জুলুম ছিল না, তবে অবিনাশের আবদার ছিল। সকলে তাকে স্নেহ করত।

কী দারুণ কথা বলতে পারত অবিনাশ। মুহূর্তে পরকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা ছিল তার। মাধ্যামিকে একটা সম্মানজনক ফল করেছে। যদিও আশানুরূপ হয়নি। তাতে কী, ফল বেরনোর পর থেকেই বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনো শুরু করে দিয়েছে। বেশ সিরিয়াস এখন অবিনাশ। অবিনাশকে স্কুলের টিচাররাও স্নেহ করতেন। নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা ছিল অসম্ভব।

অবিনাশের পরম বন্ধু ছিল অরুণিমা। চৌধুরী বাড়ির একমাত্র মেয়ে তাদের একই চত্বরে বাড়ি ছিল। খেলাধুলো, খুনসুটি সবই চলত। গ্রাম্য পরিবেশের সবটুকু স্বাদ চেটেপুটে নিয়েছে তারা। খেলনাপাতি, মার্বেল, ছোটো বল নিয়ে যেমন খেলত, তেমনি হাডুডু, লুকোচুরি খেলাতেও বেশ মেতে উঠত। মাঠের ধান খামারে উঠলে শীতের বিকালে চুটিয়ে চলত এসব গ্রামীণ খেলা।

বরাবরই স্মার্ট ছিল অরুণিমা। ছেলেদের মতো হাবভাব। গ্রামের উন্মুক্ত উঠোনে দেদার ছোটাছুটি। কুমারী মেয়েরা দল বেঁধে সেঁজুতি, পুণ্যি পুকুর-এর মতো সান্ধ্যব্রত পালন করত। অরুণিমা ছিল এই সব ব্রতের লিডার। কতবার পাড়ার মেয়েরা ভাদু উৎসবে রাত জেগেছে। ভাদু গান, তসলা বা টুসু পুজোয় সবাই আনন্দ ভাগ করে নিত। জ্যোৎস্নার মতো ফুটফুটে অরুণিমা ছিল সকলের আপনজন।

স্বভাবে অবিনাশ লাজুক হলেও অরুণিমার সঙ্গে মিশত খোলামেলা। বাঁধনহারা আনন্দে তারা মেতে উঠত। তাই অনেক বন্ধুকে ভুলে গেলেও অরুণিমাকে তো আর ভুলতে পারে না অবিনাশ। এমন সব উড়ো কথা আজ তার স্মৃতি পটে হাবুডুবু খাচ্ছে। মনটা কি দারুণ আনন্দে ভরে উঠেছে। অন্তরে যেন ভালোবাসার ফল্গুধারা বয়ে চলেছে।

এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই মেয়ের পুতুল খেলার সঙ্গী অবিনাশ, তখনও দেখেনি মেসেজটা সিন করল কিনা। কিংবা ওপাশ থেকে কোনও মেসেজ এল কিনা। লকডাউনে এরকম ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট, অবিনাশের মনের মরুভূমিতে যেন আনন্দের মরুদ্যান হয়ে উঠল!

সন্দেহের বীজ

তখন প্রায় বারোটা। অতিথি-অভ্যাগত, আত্মীয়পরিজন, বন্ধুবান্ধব সকলেই জয় আর নিশার রিসেপশন পার্টি অ্যাটেন্ড করার পর, যে -যার বাড়ির পথে। বাড়িতে শুধুমাত্র বাইরের বলতে জয়ের ছোটোমাসি। সেই অর্থে বাড়িতে কেউ না থাকায় তিনিই নতুন বউকে ফুলসজ্জার ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

ফুলসজ্জার এই বিশেষ দিনটি নিয়ে সকলেই স্বপ্ন সাজিয়ে রাখে। জয়ও তার বাইরে নয়। এই মধুযামিনী নিয়ে তারও অনেক স্বপ্ন ছিল। তাই আমন্ত্রিতরা যাওয়া মাত্রই বাড়ির সকলের থেকে নজর বাঁচিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছিল জয়।

তবে হ্যাঁ অ্যারেঞ্জড ম্যারেজে একটা প্রবলেম আছে বটে, পূর্ব-পরিচিত না হওয়ায় বিয়ের প্রথম রাতে একটা অচেনা মানুষকে ফেস করা বেশ অস্বস্তিকর৷ যদিও নিশা এখন তার অগ্নিসাক্ষী করা স্ত্রী, তবুও কেমন যেন একটা অপ্রতিভতা কাজ করে। কীভাবে শুরু করবে? কী বলবে? এইরকমই কিছু ভাবতে ভাবতে ঘরে ঢুকতেই, নিশাকে অবিন্যস্ত অবস্থায় দেখে একেবারে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে পড়ে জয়। বিয়ের শাড়ি, গয়না সমস্তকিছু সারা বিছানায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, আর নিশা কোনওমতে একটা শাড়ি জড়িয়ে ঘরের কোণে একটা চেয়ারে হাত-পা গুটিয়ে বসে দরজার দিকেই দৃষ্টিনিক্ষেপ করে রয়েছে।

জয় ঘরে ঢোকা মাত্রই তার দিকে ক্রূর দৃষ্টি নিয়ে বলে ওঠে নিশা, ‘এবার কি আমার পালা? আমাকেও মেরে ফেলবে তুমি?’

একে তো ফুলসজ্জার রঙিন স্বপ্নভঙ্গ, তার ওপর নিশার এরকম আশ্চর্য কথাবার্তায় জয় চমকে ওঠে।

‘কী যা-তা বলছ ! কী হয়েছে তোমার? এরকম আচরণ কেন করছ?’ যতটা সম্ভব সপ্রতিভ হয়ে ওঠার চেষ্টা করে জয়। ‘দ্যাখো আজ আমাদের ফুলসজ্জা। একে-অপরকে ভালো করে জেনে নেওয়ার দিন। প্লিজ, এই দিনটাকে নষ্ট কোরো না। যে-কোনও নববিবাহিতই এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করে থাকে।’ পরিস্থিতি সামলানোর জন্য নিশাকে নানারকম ভাবে বোঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকে জয়।

‘এসব ছাড়ো! আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে চার-পাঁচজন মহিলা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল, আমি সব শুনেছি।’

‘কী? কী শুনেছ তুমি?’ উত্তেজিত হয়ে ওঠে জয়।

‘তারা বলছিল একজনের মৃত্যুর ছ’ সাত মাসও পূর্ণ হল না, আর একজন মরার জন্য হাজির।’

নিশার কথা শোনা মাত্রই জয়ের কাছে ছবিটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। নিশার দিকে খানিক এগিয়ে যায়। বলে, ‘আচ্ছা একথা যিনি বলছিলেন, তিনি কি খুব মোটা আর কালো? পান খান, তাই তো?’

‘হ্যাঁ, উনিই তো বলছিলেন।’

‘দ্যাখো উনি আমাদের পাড়াতেই থাকেন। আমাদের দূর-সম্পর্কের কাকি হন। কারওর ঘরের সুখশান্তিই ওনার একেবারেই সহ্য হয় না, তাই লোকের ঘরে আগুন লাগিয়ে বেড়ান। প্লিজ ট্রাস্ট মি। ওঁর কথায় কান দিও না।’

‘ঠিক আছে এটা না হয় মানলাম যে, উনি কারও সুখশান্তি দেখতে পারেন না। কিন্তু বানিয়ে বানিয়ে তো আর এত বড়ো মিথ্যে বলতে পারেন না যে, তোমরা কোনও মহিলাকে মেরে ফেলেছ। ঝেড়ে কাশো তো সে কে?’ নিশা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না জয়কে।

‘সে আর কেউ নয়, আমার বড়দার বউ। অনিতা বউদি। অনেক দিন ধরে বউদি ক্যানসারে ভুগছিল। আমরা বউদির চিকিৎসার ব্যাপারে কোনওদিন বিন্দুমাত্র অবহেলা করিনি। কিন্তু কেন জানি না হঠাৎই একদিন বউদি, দাদা আর নিজের মেয়ে তিন্নির কথা ভুলে আত্মহত্যার পথ বেছে নিল।’ বউদির কথা বলতে বলতে বেশ আনমনা হয়ে পড়ে জয়। মনটা কেমন ভারী হয়ে ওঠে ওর।

‘কোনও কিছু চূড়ান্ত পর্যায়ে না পৌঁছোলে কেউ আত্মহননের কথা ভাবে না। সুইসাইড করা এত সহজ নয়। তোমরাই এমন কিছু করেছ যাতে উনি সুইসাইড করতে বাধ্য হয়েছেন। নয়তো তোমরাই তাকে মেরে ফেলেছ। আমাকে এত বোকা ভেবো না যে, যা বোঝাবে তাই বুঝব।’ নিশার গলায় রাগ ঝড়ে পড়ল।

বারবার বোঝানো সত্ত্বেও নিশা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না– চেষ্টা করেও বিরক্তি চাপতে পারল না জয়।

‘সমস্ত কিছু কি তোমার আজই ,এখনই জানতে হবে? পরে শুনলে হবে না? আমি তো কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি না! কোথায় নতুন জীবনের শুরুটা ভালো হবে। তা না…’

কিন্তু হায়! কথায় আছে না…

অবুঝে বোঝাব কত, বুঝ নাহি মানে। 

ঢেঁকিকে বোঝাবে কত নিত্য ধান ভানে।।

কে কার কথা শোনে। নিশা তার জায়গায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সে তার ভাবনাচিন্তা থেকে এক পা-ও নড়বে না। অবশ্য শ্বশুরবাড়িতে প্রথম পা রেখেই কেউ যদি এমন কথা শোনে, তাহলে নিশার কেন, যে-কোনও মেয়ের মনেই ভীতির সঞ্চার হওয়াটাই স্বাভাবিক। এর জন্য নিশাকেও পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না। জয়ের কথা একপ্রকার উড়িয়ে দিয়েই পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে নিশা। জয়ও তার বিয়ের প্রথম রাতের তিক্ত অনুভূতি নিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়ে, সে হয়তো নিজেও টের পায় না।

সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরেও নিশা সেই একই ছন্দে। পরনে একটা সাদামাটা শাড়ি, গায়ে গয়না নেই। কোথায় নতুন বউ গয়নাগাটি পরে পরিপাটি হয়ে থাকবে, তা নয় চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।

নিশার এই আচরণ দেখে বাড়ির সকলেই কিছু না কিছু বলেছে। কিন্তু ওই! কারও কথা শোনা বোধহয় তার অভ্যেস নেই। সে তার নিজের মতো খবরের কাগজটা নিয়ে টেবিলে বসে পড়ল। পড়তে পড়তেও ফ্রন্ট পেজ-এ পণ না দিতে পারার জন্য বধূ হত্যার ঘটনা পড়া মাত্রই জয়কে দেখে কর্কশ স্বরে বলে ওঠে, ‘দ্যাখো দ্যাখো, তোমাদেরই মতো সব পাত্রপক্ষই নিজেদের নির্দোষ বলে জাহির করে। আদপে যে তোমরা কী…!’

নিশার কথা শুনে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে জয় জবাব দেয়, ‘পৃথিবীতে না জানি এমন কত ঘটনাই না ঘটে, সব ঘটনার ভিত্তি তো আর এক নয়। তোমাকে শুধু একটা কথাই বলি, অনিতা বউদির সুইসাইডের ব্যাপারে আমরা নিরপরাধ… এব্যাপারে সত্যিই আমাদের কোনও প্ররোচনা ছিল না।’

‘এখন তো তিনি আর এসে বলতে যাবেন না যে দোষ কার!’ নিশার তীর্যক মন্তব্য চলতেই থাকে।

নিশার ব্যবহারে ফেড-আপ হয়ে ওঠে জয়, ‘পুষ্পকাকি তোমার মনের মধ্যে এমন সন্দেহের বিষ ঢেলেছেন যে, আমি কেন, স্বয়ং ভগবানও তা দূর করতে পারবেন না।’

বসার ঘরেই জয় আর নিশার মধ্যে এই সমস্ত কথাবার্তা চলছিল। ঠিক সেই সময়েই জয়ের মা কোনও কারণে ঘরে ঢুকতেই তাদের কথাবার্তার কিছু অংশ শুনতে পেয়ে এগিয়ে এলেন– ‘ছাড়ো না বউমা, খবরের কাগজে কী বেরোল না বেরোল সেই নিয়ে শুধু শুধু নিজের মাথাখারাপ করা কেন বাপু। আর এসবের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কই বা কীসের!’

নিশা একেবারে ঝাঁঝিয়ে ওঠে। ‘সম্পর্ক কেন নেই? অবশ্যই আছে! কয়েকদিন আগেই তো এবাড়িতে বধূহত্যার ঘটনা ঘটেছে। অস্বীকার করতে পারেন? এখন আমাকে অনেক কিছুই ভাবনাচিন্তা করতে হবে।’

সম্ভ্রমের বদলে শ্বশুরবাড়ির মানুষজনের প্রতি নববধূর এহেন বিরূপ আচরণ, জয়ের মা তুলিকাদেবীকে বেশ দুশ্চিন্তায় ফেলল।

মায়ের কালো মুখ দেখেই জয় বুঝে গিয়েছিল তিনি কতটা চিন্তান্বিত। ঠিক সেই মুহূর্তে মাকে খানিক আশ্বস্ত করার অভিপ্রায়ে জয় বলে ওঠে ‘শোনো মা, ও এবাড়িতে আসতে না আসতেই পুষ্পকাকি তার কাজ সেরে দিয়ে গেছে। না জানি ওর মনে কী কী বিষ ঢেলেছে। এটা তারই ট্রেলার!’

তুলিকাদেবীর আর কোনওকিছুই বুঝতে বাকি রইল না। মনে মনে পুষ্প-কে তুলোধোনা করতে থাকেন তিনি। পরিস্থিতি যাতে আরও জটিল না হয়, সেই কারণে জয়, মাকে নিয়ে উপরের ঘরে চলে যায়। মা-কে বোঝানোর চেষ্টা করে যে, দু-দিন শ্বশুরঘর করতে না করতেই শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়া লোকের কানে গেলে, একটা হাস্যকর পরিবেশের সৃষ্টি হবে। সেটা লোকসমাজে বড়োই দৃষ্টিকটু হয়ে দাঁড়াবে। তাই জয়ের এই  নীরব থাকার পন্থা অবলম্বন। তার মার প্রতি নিশার এই দূর্ব্যবহার, সুন্দরী নিশাকেও একেবারে জয়ের কাছে কদর্য করে তুলছিল।

মিনিট পাঁচেক পরেই জয় উপর থেকে নেমে আসে। রাগ সামলে নিয়ে নিশাকে আবারও বোঝানোর চেষ্টা করে, ‘এভাবে কেন সিন ক্রিয়েট করছ? মার সাথে এইরকম ভাবে কথা বলাটা কি তোমার উচিত হল? দু’দিনও হয়নি তুমি এবাড়িতে এসেছ, তাতেই তুমি বাইরের লোকের কথা বিশ্বাস করে নিলে। আমাদের থেকে আগে তারা আপন হল তোমার কাছে?’

বড়োবউ তো আত্মহননের পথ বেছে নিয়ে সমাজের চোখে তাদের অপরাধী সাজিয়েই রেখেছে। তার উপর ছোটোবউয়ের এহেন অনভিপ্রেত আচরণে তুলিকাদেবী মানসিক ভাবে একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। ভেবেছিলেন যা ঘটার ঘটে গেছে। বাড়িতে নতুন বউ এলে সংসার আবার আনন্দে ভরে উঠবে। তাই খুব তাড়াতাড়িই ছোটোছেলের বিয়ের সিদ্ধান্ত  নিয়েছিলেন। মেয়েও যথেষ্ট শিক্ষিত, সুন্দরী আর ছেলেও স্টেবল– নিজের বাড়ি, গাড়ি। সেই কারণেই দু-পক্ষই বিয়েতে অমত করেনি।

সব কাজই ঠিকঠাক মিটল তারপরেই যত বিপত্তি। তুলিকাদেবী স্বপ্নেও ভাবেননি যে, এভাবে নতুন বউয়ের হাতে তাদের হেনস্থা হতে হবে। তিনি না হয় ছেলের মুখ চেয়ে সব সহ্য করে নেবেন কিন্তু ছোটোছেলে…! তার কী হবে? বড়োছেলের ঘর তো আগেই ভেঙেছে, এবার যদি ছোটোছেলের সংসারটাও…! যেন সেরকমই কিছু অশনিসংকেতের আভাস পেতে থাকেন তুলিকাদেবী।

নিজের মাথা যতই নত হোক ক্ষতি নেই, কিন্তু ছেলের ভবিষ্যৎ ভেবে আবারও একবার চেষ্টা করলেন তিনি। নিশার কাছে গিয়ে তাকে কাছে ডেকে নিলেন। ‘দ্যাখো বউমা, তুমি আমার মেয়ের মতো। আশা করি তুমি আমার কথা বুঝবে। সংসারে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা অন্যের সংসারে আগুন লাগিয়ে আনন্দ পেতে ভালোবাসে। তাই বলছি, তুমি তো যথেষ্ট শিক্ষিত বলেই জানি বউমা! লোকের কথা শুনে ভুল না বুঝে, আমার মনে হয় সব ভুলে ক’দিন মন দিয়ে সংসার করলেই আমাদের বুঝতে পারবে। তুমিও ভালো থাকবে।’

ঠিক তখনই তুলিকাদেবীর বড়োছেলের মেয়ে, বছর তিনেকের নাতনি তিন্নি কেঁদে ওঠায়, তিনি ছেলের ঘরে চলে গেলেন।

জয়ের বড়দা নিলয় আর ছোটোমাসি, বিয়ের সমস্ত জিনিসপত্রের হিসেবনিকেশ করতে সারাদিন এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে, সেভাবে কোনওদিকে কর্ণপাত করার সুযোগ ঘটেনি। তবে হ্যাঁ একেবারেই যে কিছু শোনেননি, সেটা বললেও বোধহয় ভুল হবে। সেই মুহূর্তে হয়তো চুপ থাকাটাই উচিত বলে মনে করেছেন তারা।

সন্ধেবেলা আশপাশের বেশ কয়েকজন মহিলা নিশার সঙ্গে আলাপ করার জন্য বাড়িতে আসতেই, তুলিকাদেবী তাদের আগমনবার্তা জানিয়ে বউমাকে নীচের ঘরে আসার জন্য বলে পাঠালেন। কিন্তু মনের মধ্যে কোথাও একটা ভয় ছিলই। এই বুঝি কেউ আবার কানভারী করার মতো কথা বলে বসে। তাই নিশা নীচের ঘরে আসতেই তিন্নিকে কোলে নিয়ে নিশার একদম পাশ ঘেঁষে বসে পড়লেন তুলিকাদেবী।

কিন্তু তাতেও কি আর নিন্দুকদের মুখ বন্ধ করা সম্ভব? যা আশঙ্কা করছিলেন ঠিক তা-ই হল। একজন তো মা-হারা মেয়েকে দেখে বলতেই শুরু করল, ‘আহা রে এই বয়সে মাকে ছেড়ে থাকা… অনিতা কত আদরযত্নে রাখত। দিদিমার পক্ষে কি সম্ভব? সেদিন সকালেও বারান্দায় বসে গল্পগুজব করছিল। কী জানি বাপু হঠাৎ করে কীভাবে ঘরে আগুন লেগে গেল!’

পাশে বসা আর-এক মহিলা সায় দিয়ে বলে, ‘আহা গো আমি তো নিজের চোখে দেখেছি কত কষ্ট পেয়ে পুড়ে মরেছে মেয়েটা। এবার তো সংসারের হাল ধরতে হবে নিশাকেই। নিলয়ের বাচ্চাটাকেও মাতৃস্নেহে পালন করতে হবে। নিলয়ের কি আর বিয়ে করবে!’

তুলিকাদেবী এমনিতেই যথেষ্ট চিন্তিত ছিলেন। নতুন বউয়ের সামনে পড়শিদের এহেন কথাবার্তা চাপ আরও বাড়িয়ে দেয়। অস্বস্তি এড়াতে দ্রুত জলখাবার খাইয়ে তাদের বিদায় করেন। তবে ততক্ষণে নতুন বউয়ের মন আরও ভারাক্রান্ত।

প্রতিবেশীরা চলে যাওয়ার পর জয় নীচে নেমে আসে। নিশাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে জয়ের নিজেকে হঠাৎ দোষী মনে হয়। ভাবে কোথাও ঘুরে এলে হয়তো নিশার মনটা ভালো হবে। নিশার দিকে তাকায়, ‘চলো দুজনে কোথাও ঘুরে আসি। ভালো লাগবে।’

‘এসব আদিখ্যেতা ছাড়ো, অনেক হয়েছে, এবার কি গভর্নেস-এর ডিউটিও করতে হবে?’

‘দ্যাখো, বাচ্চাকে দেখাশোনার জন্য মালতী আছে, মা আছে। দাদা তো আছেই। তোমার চিন্তার কোনও কারণ নেই, ইচ্ছা না থাকলে তিন্নি-র কোনও কিছু তুমি কোরো না। কে কী বলে গেল, আর উনি ওটাই ভেবে নিলেন।’ নিশাকে শান্ত করার চেষ্টা করে জয়।

নিশা যদিও মানতে নারাজ। গজগজ করতেই থাকে, ‘দুই ভাই-ই জল্লাদ। দেখে মনে হয় ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না।’

পরের দিন ফোনে দাদা-বউদিকে সব কথা জানায় নিশা। ছুটে আসেন দুজনেই। ক্ষোভ উগরে দেন জয়ের পরিবারের উপর।

তুলিকাদেবীকে সামনে পেয়েই বলেন, ‘আপনারা আপনাদের বড়ো বউকে পুড়িয়ে মারার খবর আমাদের কাছে লুকিয়েছেন।

আগে জানলে…।’

অভিযোগ শুনে ক্ষুব্ধ জয় কোনওমতে ক্রোধ সংবরণ করে, ‘থানায় গিয়ে খোঁজ নিন, সত্যিটা জানতে পারবেন। বউদির ক্যানসার ছিল। রোগের যন্ত্রণা আর মৃত্যুভয় থেকে বউদি ড্রিপ্রেশনে ভুগতে শুরু করে। তার থেকেই সুইসাইড। আমরা যদি মারতামই, তাহলে আপনার সামনে নয় সপরিবারে জেলে থাকতাম।’ যদিও জয় বোঝাতে ব্যর্থ।

ঘর থেকে বেরিয়ে যায় নিশার দাদা-বউদি। হঠাৎই পথে দেখা হয় এক আত্মীয়ের সাথে। যার মাধ্যমেই এই বিয়ের যোগাযোগ। দাদা-বউদির থেকে ক্ষোভের কথা শুনে তিনি আশ্বস্ত করেন, ‘জয়দের পরিবার যথেষ্ট ভদ্র। কেউ যদি আত্মহত্যা করে, ওদের দোষ কোথায়? পরিবারটিকে অনেকদিন ধরেই চিনি, অযথা রাগ করছিস। এক বউয়ের অবস্থা এমন হয়েছে বলে নিশার যে একই অবস্থা হবে তার কি কোনও মানে আছে? আর তোরা যে ডিভোর্সের কথা ভাবছিস, তারপর নিশার কী হবে ভেবে দেখেছিস?’

নিজেদের ভুল বুঝতে পারে নিশার দাদা-বউদি। ফিরে গিয়ে জয়ের মায়ের কাছে ভুল স্বীকার করে নেন। নিশাকেও বোঝায় দু’জনেই।

কিন্তু নিশা অনড়। মনে মনে ভাবে দাদা বোধহয় নিজের দায়িত্ব এড়াতেই ব্যাপারটাকে হালকাভাবে নিচ্ছে।

দাদাকে পাশে না পাওয়াটা নিশা একেবারেই মন থেকে মানতে পারে না। বড়ো একলা, নিঃসঙ্গ বোধ করে সে। মনে মনে ভাবে যদি এই দুঃসময়ে পাশে কেউ থাকত।

মনে পড়ে দিদির কথা। মেইল-এ দিদিকে সব জানায়। উত্তরে দিদি লেখে, ‘চিন্তা করিস না, আমি তোর পাশে আছি। যখনই প্রয়োজন পড়বে আমাকে ডাকবি। সতর্ক থাকিস। সে রকম সন্দেহজনক কিছু বুঝলে থানায় রিপোর্ট করবি। তোর চিঠিটা প্রমাণ হিসাবে রেখে দিলাম।’

এরপর কেটে যায় আরও বেশ কয়েকটা দিন। এরই মধ্যে নিয়মানুযায়ী অষ্টমঙ্গলা ছাড়াও বারকয়েক তারা ঘুরে এসেছে দাদার বাড়িতে। কিন্তু দুজনের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক সেইভাবে গড়ে ওঠেনি। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিশা আরও চুপচাপ হয়ে গেছে। জয় চেষ্টা করেছিল ভালোবাসা দিয়ে সবকিছু ভুলিয়ে দিতে।

কিন্তু বিধি বাম। এর মধ্যে হাজির লোন নিয়ে নতুন ঝামেলা। জয়ের বিজনেসে ঘাটতি। হঠাৎ প্রয়োজন পড়ে টাকার।

পরিচিত মহল থেকে লোন নিলে কারখানার কর্মীদের কানে খবর পৌঁছোবেই। অকারণে কর্মীরা বিব্রত হয়ে উঠবে। সেই কারণেই অন্য কোথাও থেকে ব্যবস্থা করা। সেই মুহূর্তে নিশার দাদা অমলেন্দুবাবুই এগিয়ে এসে জয়কে এই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, তার অনেক বন্ধুবান্ধবই ব্যাংক-এর সঙ্গে যুক্ত। সুতরাং লোন পেতে বিন্দুমাত্র সমস্যা হবে না। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি অমলেন্দুবাবু। বরং বিভিন্ন অছিলায় ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছেন।  বোনও কম যায় না। সে তো এমনিই কোনওদিন জয়ের ভালো চায়নি। দিবারাত্রি অকথা-কুকথা রয়েইছে। তার উপর যতদিন লোন সম্পর্কিত কথা তার কানে গেছে, নিশার মন্তব্য আরও তীক্ষ্ণ ও শাণিত হয়ে উঠেছে। ক্রমশ তিক্ততা চরমে ওঠে। বন্ধ হয়ে যায় দুজনের কথাবার্তা। নিশা ভেবে নেয় এটা বোধহয় ঝড়ের পূর্বাভাস। তারও বোধহয় দিন ঘনিয়ে এল। তাই

দিদির কথামতো সদা চোখ-কান খোলা রাখা। একটুতেই সকলকে সন্দেহ করা…।

রাত্রিতে খাওয়াদাওয়ার পর সকলে মিলে উঠোনে বসে খানিকক্ষণ আড্ডা মারার অভ্যাসটা জয়েদের একেবারে চলেই গিয়েছিল। আজ অনেকদিন পর একসঙ্গে বসে নিজেদের সুখ-দুঃখের গল্প– পরিবেশটাতেই অন্য মাত্রা যোগ করেছিল। হঠাৎই উঠোনে সকলকে একসঙ্গে বসে ধীরে ধীরে কথা বলতে দেখে, আতঙ্কে শিউরে ওঠে নিশা। দূর থেকে তাদের কথা শোনার নানারকম চেষ্টা করেও ‘টাকা’ ছাড়া আর একটি শব্দও বোধগম্য হয় না  তার।

একটা শিরশিরে ঠান্ডা অনুভূতি বয়ে যায় নিশার শিরদাঁড়া বরাবর। মনে সন্দেহের ভাবনাটা চেপে বসতে থাকে যে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তার গায়ে আগুন লাগিয়ে মেরে ফেলার প্ল্যান বানাচ্ছে সবাই মিলে।

এর থেকে বাঁচতে হলে তাকে ঘর থেকে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তারও তো উপায় নেই। মেইন গেটে অনেকক্ষণ আগেই যে তালা পড়ে গেছে। সুতরাং বাঁচতে হলে অন্য কোনও পথ খুঁজে বের করতেই হবে। অন্যথায় আজ তার মৃত্যু অনিবার্য।

মনে মনে ভাবে পাড়াপড়শিদের চেঁচিয়ে ডাকবে, কিন্তু তাদের সঙ্গেও তো সেই অর্থে খুব একটা পরিচয় হয়ে ওঠেনি নিশার। তারা তার ডাকে সাড়া দেবে কি? নাকি যে-কোনও– উপায়ে আগে ঠিক করে তাদের কথা শুনতেই হবে। সেইমতো চুপিচুপি সবার অলক্ষ্যে সিঁড়ি দিয়ে সোজা ছাদে উঠে উঠোনের দিকের কার্নিশের ধারে এগিয়ে যায় নিশা।

দোতলায় একটা ঘর আগেই ছিল। লোকজন এলে ভীষণ অসুবিধা হয়। সেকথা ভেবেই গতবছর দোতলায় আর-একটি ঘর বানাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নিলয়। সেইমতো কাজও এগোচ্ছিল। মিস্ত্রিরা সবেমাত্র উঠোনের সাইডের কার্নিশ ভাঙা শুরু করেছে কী অনিতার টেস্ট রিপোর্ট হাতে এল। সেদিন খরচের কথা ভেবে সব কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বছর গড়িয়েছে কিন্তু সেই কার্নিশ আজও মেরামত হয়নি। শুধু ইটগুলোকে থাক-থাক করে সাজিয়ে রাখা রয়েছে মাত্র।

আলো-আঁধারির মায়াজালে নিশা সামনের দিকে পা বাড়াতেই, হঠাৎই শাশুড়ির চিৎকার। নিশা তখনই বুঝতে পারে এই চিৎকারের কারণ তার পা লেগে উপর থেকে পড়া ইট। ভয় পেয়ে গিয়ে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে নিশা। নিজের ঘরের বিছানার চাদরের মধ্যে মাথা গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে। ঠিক তখনই জয় ছুটতে ছুটতে ঘরে ঢোকে, ‘নিশা ওঠো। ছাদ থেকে কীভাবে যেন একটা ইট মায়ের মাথায় পড়েছে। আমরা হাসপাতালে যাচ্ছি। তুমি ঘর পাহারা দিও।’

তুলিকাদেবী বেশ গুরুতর চোটই পেয়েছিলেন। ন’টা স্টিচও পড়েছে। আপাতত হসপিটালে আবজার্ভেশনে আছেন। নিশা মনে মনে বেশ উৎফুল্ল। ভাবল, তাকে মারার প্ল্যান বানানো, ভগবান এর ফল একেবারে হাতেনাতে দিয়েছেন। মরে গেলেও ক্ষতি হতো না।

শাশুড়ি হাসপাতালে। সুতরাং সমস্ত ঘর-সংসারের দায়িত্ব এখন তারই। তৎসত্ত্বেও তার দু-ঠোঁট এক না করার কারণ বোধহয় কোথাও একটা অনুশোচনা– তার কারণেই শাশুড়ির আজ এই অবস্থা।

এরই মধ্যে একদিন দুপুরে তিন্নির জামাকাপড় বউদির আলমারিতে রাখার সময়, নিশার চোখে পড়ে একটা ফাইল। কৌতূহলবশত ফাইলটা খুলতেই নজরে আসে অনিতা বউদির আত্মহত্যা সম্বন্ধিত ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এবং আদালতের রায় সংক্রান্ত কিছু কাগজপত্র। সঙ্গে বউদির একটা চিঠি। যার

বয়ান এরকম–

প্রিয় নিলয়,

 আমি জানি তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো। এটাও জানি যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন তুমি তোমার কর্তব্য থেকে একটুও পিছপা হবে না। কিন্তু ডাক্তারবাবু যখন আমার অন্তিম সময় বেঁধেই দিয়েছেন, তখন আমার জন্য জলের মতো টাকা খরচ করে লাভ কী। অনেক তো করেছ। ধার করে আর নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলো না। তাই বিদায় নিলাম। তিন্নির খেয়াল রেখো। নিজেরও। তিন্নিকে মায়ের অভাব বুঝতে দিও না, ওর জন্য নতুন মায়ের ব্যবস্থা কোরো।

 ইতি 

তোমার অনিতা

চিঠিটা পড়েই নিশার মাথা ঘুরে গেল। এটা কী করেছে সে– লোকের কথা শুনে নিজের জীবনের বেশ কিছু সুখের সময় নিজের হাতেই খুন করেছে সে। অমন দেবতুল্য ভাসুরকে প্রতিটি পদে পদে অপমান করেছে। স্নেহময়ী শাশুড়িকে সুয়োগ পেলেই হেনস্থা করেছে। এমনকী জয়কে বড়ো শত্রু হিসাবে দেখে এসেছে। না পেরেছে ভালো স্ত্রী হতে, না বউমা। যারা বউকে সুস্থ করতে লোকের কাছে হাত পাততেও দ্বিধা করেনি– তাদের সঙ্গে এরকম জঘন্য ব্যবহার করেছে সে। লজ্জা আর অনুশোচনার আগুনে মাটিতে মাথা কুটে মরার মতো অবস্থা হয় নিশার।

ঠিক তখনই ডোরবেল বেজে ওঠে। তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে চোখের জল মুছে উঠে ফাইলটা আলমারিতে রেখে দিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল নিশা। দরজা খুলতেই দেখল জয় দাঁড়িয়ে। ভীষণভাবে বিধবস্ত। কোনওমতে হাত-পা ধুয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিল জয়। নিশা জয়ের দিকে একগ্লাস জল বাড়িয়ে দিয়েই জিজ্ঞাসা করল, ‘মা কেমন আছেন?’

‘এখন একটু ভালো আছে। চোখ খুলেই তোমার কথা জিজ্ঞাসা করছিল। তুমি বাড়িতে একা আছো তাই চিন্তা…। নিশাকে উত্তর দিয়েই চোখ বন্ধ করা অবস্থাতেই বিড়বিড় করতে থাকে, কী করে কী হবে, কে জানে, একে বিজনেসে ঘাটতি। তার উপর… কীভাবে যে কী সামলাব! বিড়বিড় করা বন্ধ করে হঠাৎই আবার নিশাকে বলে, ‘তুমিও একটু খেয়াল রেখো। কার্নিশের ধারে যেও না কিন্তু।’

চোখ বন্ধ থাকার জন্য নিশার করুণ, জলে ভেজা, ঝাপসা দৃষ্টির দিকে খেয়াল করেনি জয়। নিজেকে একটু ধাতস্থ করে আলমারি থেকে একটা বাক্স বার করল নিশা। তারপর বলল, ‘জয় ওঠো, বেলা গড়িয়ে গেছে। খেয়ে নাও। তোমার খাওয়া হলে আমরা মাকে দেখতে যাব। ও হ্যাঁ এটা রাখো।’

বেশ আশ্চর্য হয় জয়, ‘এগুলো তো তোমার গয়না। আমাকে দিচ্ছ কেন?’

‘তুমি এগুলো বন্ধক রেখে নয় তো বিক্রি করে তোমার বিজনেসে লাগাও। দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে। আর এগুলো তো অসময়েরই সঙ্গী বলো। শুধু শুধু ঘরে রেখে কী হবে। এই বাড়িটা তো আমারও নাকি। আমার সংসারের সুখের জন্য আমি ভাবব না তো কে ভাববে।’

হঠাৎই নিশার এই পরিবর্তনে জয় অবাক। বোকার মতো কেবল নিশার দিকে তাকিয়ে রইল। আর নিশার চোখে তখন সোনার সংসারের স্বপ্ন।

জন্মদিন

অস্বস্তিটা ক্রমশ বাড়ছে । এই ক’দিন রূপসা লোকটাকে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে, তার অফিসের উলটোদিকের ফুটপাতে। তার কেবিন থেকে মাথা তুললেই যে-জানলা দিয়ে অনেকখানি আকাশ  আর গলির মোড় পর্যন্ত দেখা যায়, গত এক সপ্তাহ ধরে লোকটাকে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে রূপসা, দিনের নানা সময়ে।

লোকটার হাবেভাবে একটা কথা বেশ স্পষ্ট — সে কোনও ভাবেই ঠিক লুকিয়ে থাকতে রাজি নয়। যেন চায় রূপসা তাকে লক্ষ্য করুক। বয়স আন্দাজ সত্তর। রূপসা তার বাবাকে কোনওদিনও দেখেনি। তবে বেঁচে থাকলে হয়তো তাঁরও, এর কাছাকাছি বয়সই হতো। বাবার বয়সি এই লোকটা, তার কন্যাতুল্য একটা মেয়েকে এভাবে কেন দেখছে! কী চায় লোকটা!অস্বস্তিটা কিছুতেই তাকে কাজে মন বসাতে দেয় না। বুঝে উঠতে পারে না, অফিসের পর লোকটা তাকে ফলো করে কেন?

অফিস থেকে বেরিয়ে আজ বাসে উঠতেই লোকটাও পেছনের গেট দিয়ে উঠে পড়ল। এবার একটু খুঁটিয়ে লোকটাকে দেখার চেষ্টা করল রূপসা৷মুখ ভর্তি পাকা দাড়ি। গত সাতদিনে একবার মাত্র তাকে জামা বদলাতে দেখেছে । খুব একটা সচ্ছলতার ছাপ নেই চেহারায় ।

আজ জানালার ধারে সিট পেয়েছে রূপসা। যতটা সম্ভব লোকটার অস্তিত্ব ভুলে সে জানলার বাইরে তাকিয়ে রইল। অফিস ছুটির কলকাতা৷ ভিড় বাড়ছে বাসে৷ ঘরমুখো লোখের ভিড় পেরতিটি বাসস্টপেই৷এত লোকের ভিড়ে আদৌ কি বোঝার উপায় আছে কে কী চায়? কার কী মতলব! বরাবরই নিজের আত্মরক্ষার দায়িত্ব তাকে নিজেকেই নিতে হয়েছে। আর- পাঁচটা মেয়ের মতো, মাথার উপর বাবা থাকার সুবিধা তো সে পায়নি। মাকে যে সমস্যার কথা বলবে, সে উপায় নেই। গত তিন বছর ধরে নার্ভ-এর অসুখে, মায়ের শরীরের অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে।

কাকে বলবে সমস্যাটা? প্রবীরকাকু ! বাবার একসময়ের এই বন্ধু, নানা দুর্দিনে, বিপদে আপদে পাশে থেকেছে। তার জন্মের বছর চারেক পরেই বাবার মৃত্যু হয়েছিল। মায়ের কাছে একটাই সাদা কালো ছবি আছে, মা বাবার সঙ্গে রূপসার। তার চার বছরের জন্মদিনের। একটা সাদা ফ্রিল দেওয়া ফ্রক পরে সে বসে আছে বাবার কোলে।গাল ফোলা ফোলা, নরম নরম, ফুটফুটে রূপসা। পুরোনো হতে হতে ছবিটা জায়গায় জায়গায় বেশ ঝাপসা। মা সেটা বের করে দেখাতেও যেন অস্বস্তি বোধ করে। রূপসা বোঝে আসলে মা, বাবাকে ভুলে থাকতে চায়।

আজ তার জন্মদিন। জন্মদিন শব্দটা মাথার মধ্যে এক মুহুর্ত ঘুরপাক খেয়ে অন্য ভাবনার পরতে চাপা পড়ে গেল। তার স্টপেজ এসে গেছে। তড়িঘড়ি নামল রূপসা। দূরত্ব রেখে লোকটাও। রূপসা আড়চোখে একবার দেখে নিয়ে, গলির দিকে পা বাড়াল। লোকটা তাকে ফলো করছে। রূপসা গতি বাড়াল। লোকটাও। না ভয় পেলে চলবে না। মাঠ পেরিয়ে ক্লাবঘর। কী একটা কারণে আজ দোকানগুলোর কয়েকটা বন্ধ। ফলে রাস্তায় অন্য দিনের মতো লোকজন নেই। ক্লাব অবধি যাবে , নাকি তার আগেই একটা ব্যবস্থা করবে লোকটার? ভাবতে ভাবতে রূপসা হাঁটা থামায় ।

দূরত্ব একটু কমতেই পিছন ফিরে সরাসরি জিজ্ঞেস করে লোকটাকে, ‘কী চাই আপনার? কে আপনি? আমায় ফলো করছেন কেন?’
লোকটা একটুও অপ্রস্তুত না হয়ে, একটা স্মিত হাসি নিয়ে রূপসার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আরও কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে, খুব ধীরে ধীরে বলে, ‘আমি তোর বাবা রূপসা।’
রূপসা প্রায় থতমত খেয়ে তাকায়।
‘ কী আজেবাজে বকছেন! আমার বাবা কবে মরে ভূত হয়ে গেছে! ‘
কথাটা বলতে গিয়ে মনে খটকা লাগে, সে কি ভূত দেখছে নাকি! কী বলতে চাইছে লোকটা। নাহ, সে ঘাবড়ে গেছে, এটা একদম বুঝতে দেওয়া যাবে না। তাই একটুও জড়তা না রেখে বলে,’কী ধান্দা সত্যি করে বলুন তো? ‘ রূপসার গলায় ঝাঁঝ স্পষ্ট। ভিতু সে কোনও দিনই নয়। কিন্তু একটাই ডাউট হচ্ছে, লোকটা তার নামটা জানল কী করে! তার মানে খোঁজখবর নিয়েই এসেছে।

লোকটা এবার আরও একটু কাছে এগিয়ে এল। যেন স্ট্রিট লাইটের লালচে আলোয় ভালো করে দেখতে চায় রূপসার মুখ। না, লোকটার তাকানোর মধ্যে কোনো বদ মতলব নেই, বরং কেমন একটা মায়া মায়া ভাব আছে।সেই শান্ত দৃষ্টি নজর এড়ায় না রূপসার। কিশোরী বয়স থেকে সে অনেক রকম পুরুষের মুখ দেখেছে। কারও কারও চোখে অন্য ভাষাও পড়েছে। কিন্তু এই লোকটার চাহনি তেমন নয়।
লোকটা আবার কাতর ভাবে বলে, ‘আমি সত্যিই তোর বাবা রূপসা। আমি মারা যাইনি। পালিয়ে গিয়েছিলাম।’

এবার রূপসা যেন আর ঠিক ততটা অবিশ্বাস করতে পারে না লোকটাকে। ভিতরে একটা অদ্ভুত তোলপাড় হতে শুরু করেছে তার। সে সোজাসুজি লোকটার চোখে চোখ রাখে। কিন্তু সেই দৃষ্টির কাছে হার মেনেই যেন লোকটা চোখ নামিয়ে নেয়। তারপর  দেরে যাওয়া গলায় আবার বলতে শুরু করে, ‘হ্যাঁ তোদের ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম আমি। অন্য একজনের সঙ্গে সংসার করব বলে। কিন্তু সেই পাপের শাস্তি আমি পেয়েছি। সংসার , ব্যবসা , সব খুইয়েছি নিজেরই দোষে। আমি তোদের কাছেও অপরাধী মা। মুখ নেই তোদের সামনে এসে দাঁড়ানোর । আমি কোনও দায় দায়িত্ব নিইনি তোদের। ‘

রূপসা মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে, ‘ কিন্তু মায়ের মুখে আমি শুনেছি আমার বাবা মারা গেছে।মা কী করে বলল এত বড়ো  মিথ্যে!’
‘তোর মা আমার সম্মান বাঁচাতে তোকে মিথ্যে বলেছে মা।ভালোবাসত তো খুব৷ প্রবীর সবই জানে। ওর সঙ্গে যোগাযোগটা খুব ক্ষীণ ভাবে হলেও রয়ে গেছে এত বছর ধরে। তোদের সব খবরই আমি পাই। জানি তোর মায়ের চাকরিটা ছিল বলে তোকে বড়ো করতে পেরেছে। কিন্তু আজ আমি অনুতপ্ত রূপসা।’

কথাটা বলার পর লোকটা জামার হাতায় চোখ মোছে। রূপসার মনের ভিতর কী যেন একটা ঝড় শুরু হয়েছে। সে বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। উলটো দিকে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা, যাকে এইমাত্র বাবা বলে সে জেনেছে, তাকে আরও একবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে চায় যেন। তারপর কঠিন গলায় প্রশ্নটা করেই ফেলে– ‘এতদিন পরে কী চান আপনি? কেন এলেন? ‘
আগন্তুক এবার আবেগরুদ্ধ গলায় বলতে শুরু করে,’আমি আর বেশি দিন নেই। প্রায়শ্চিত্ত করার সময়ও হাতে নেই আর। আজ তোর জন্মদিন। তোকে একটা জিনিস দিতে চাই শুধু। এত বছর ধরে এগুলো আগলে রেখেছিলাম। আজ তোকে দিয়ে আমার ছুটি। আর কোনও দিন সামনে আসব না তোর। পারলে আমায় ক্ষমা করিস।’

লোকটা একটা খবরের কাগজে মোড়া প্যাকেট এগিয়ে দেয় রূপসার দিকে। হাতে দিয়েই হনহন করে হাঁটা দেয়। কিন্তু তার হাঁটায় যেন আর তেমন জোর নেই, কেমন যেন ঝুঁকে পড়া চেহারা । হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রূপসা তার চলে যাওয়াটা দেখে।

কখন কীভাবে একটা ঘোরের মধ্যে বাড়ি ফিরেছে , মনে পড়ে না রূপসার। এখন রাত এগারোটা। মা পাশের খাটে অঘোরে ঘুমোচ্ছে।ঘুমের ওষুধ খায় রোজই৷মায়ের দিকে আলগোছে একবার তাকিয়ে নিয়ে, টেবিল ল্যাম্পের আলোয় প্যাকেটটা খোলে রূপসা। খুলতেই বেরিয়ে আসে একটা পুরোনো ফোটোগ্রাফ । হাতে ধরা ফোটোটা আলোর কাছে ধরতেই বুঝতে পারে, এটা সেই পুরোনো সাদাকালো ছবিটারই প্রতিলিপি, যা সঙ্গোপনে রয়েছে, মায়ের ডায়ারির ভাঁজে। তবে এটা অনেকটাই পরিষ্কার। খুব যত্নে রাখা ছিল বোধহয়। প্যাকেট থেকে এবার বেরিয়ে আসে ছোট্ট একটা ফ্রক। সেই সাদা ফ্রিল দেওয়া জন্মদিনের ফ্রকটা!
কত কিছুতেই কতবার কষ্ট পেয়েছে রূপসা। কেঁদে দুঃখ ভুলেছে। কিন্তু আজ কেন এমন হচ্ছে! বুকটা ফেটে যাচ্ছে তবু  বাবা বলে একবার ডেকে উঠতে পারছে না৷ কিছুতেই পারছে না।চোখটা অসম্ভব জ্বালা করছে রূপসার। সে কাঁদতে পারছে না। মা বলে ,জন্মদিনে কাঁদতে নেই।

ফুড়ুত..

…কিন্তু দীপ্তি লোকে তো তা শুনবে না?

লোকের কথায় আমি বদার করি না মা! একটা কাজ করতে পারো! তুমিও আমার সঙ্গে যেতে পারো! ওর মুখে তো কত শুনেছি, তুমি ইন্টারস্কুল কম্পিটিশনে ব্যায়াম করতে। কত প্রাইজও…!

পাগল? সংসার ছেড়ে ওইসব? আমার কথা বাদ দাও। তুমি শৌর্যকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলে এত কথাই উঠত না।

সংসার ছাড়ার কথা কী আমি বলেছি? ফিরে এসে কথা বলছি!

বাবু জানে তুমি যাচ্ছ?

আমি আর কোনও উত্তর দিইনি। স্যান্ডেলে পা গলিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি। ফিরে এসে কথা বলছি এই একটা কথাতেই শাশুড়িমা নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছেন, সাত বছরের পুরোনো বউমা কতটা অপোজ করছে তাঁর কথা।

কী আশ্চর্য তাই না?

শৌর্যর মা-ও তো এগুলোর সঙ্গে যুঝেছেন? উনিও বোঝেন না? নাকি বুঝতে চান না?

বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতে বাচ্চা হওয়া নিয়ে ঘ্যানর ঘ্যানর, তারপর প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষকতা, বন্ধুদের বাড়ি যাওয়া, টুকটাক ফুচকা খাওয়া সবেতেই আপত্তি। পরশু যখন কাগজের বিজ্ঞাপনটা দেখে রাতে খাবার টেবিলেই কথাটা পাড়ি, জানো শৌর্য, তোমাদের বর্ণালী ক্লাব থেকে মাউন্টেনিয়ারিংয়ে জন্য তিরিশ জনের একটা উইমেন টিম যাচ্ছে। আমিও ভাবছি…

তখন কথা শেষ হওয়ার আগেই অন্য আগডুম বাগডুম কথা বলে বিষয়টা ধামাচাপা দিয়েছিল শৌর্যই।

বিয়েটা কি একটা এগ্রিমেন্ট?

আমিও বাবার একমাত্র সন্তান; বারো বছর বয়স থেকে ট্রেক করেছি অযোধ্যা, বিহারিনাথ, সান্দাকফু, সাবারগ্রাম ছাড়াও আরও অনেক। যথেষ্ট সম্ভ্রম রেখেই। কই কেউ তো আমার গায়ে হাত ছোঁয়াতে পর্যন্ত সাহস পায়নি!

অথচ সেই যে শৌর্যর মেজো মাসির বিয়েতে ওর মামাতো দাদা আমার বুক ছুঁতে এগিয়েছিল? সেফটির প্রশ্নই যদি ওঠে, তাহলে সে তো যে-কোনও জায়গাতেই হতে পারে!

শৌর্যকে বিয়ের আগেই বলেছিলাম, আমি কিন্তু ফ্রি বার্ড! পারবে তো আমাকে সামলাতে?

একদিকে ঘাড় হেলিয়ে প্রেমে লাবডুব খেতে খেতে শৌর্য দুহাতে জড়িয়ে ধরেছিল আমায়।

যে করেই হোক, আজ আমি ক্লাবের ফর্ম ফিল-আপ করবই।

 

চিটচিটে গরম; কান মাথার পেছন দিয়ে অস্বস্তিকর ঘাম গড়াচ্ছে। পা ঘষে ঘষে চলার শব্দটা কানে যেতেই সামনে তাকাই। উলোঝুলো চুল, ছেঁড়া সালোয়ার পড়া পাগলিটা হাঁটছে; চারপাশটা কেমন করে দেখছে যেন! ওর কি খিদে পেয়েছে?

আমি একটু এগোতেই চোখাচোখি হল। হাতের ইশারায় মুখে আঙুল দিয়ে কথা বলতে বারণ করে টুক করে ঢুকে পড়ল টুকাইদের বাড়িতে।

বড়ো কৌতূহল হল! ওর ফ্যাকাশে চোখদুটো যেন আকর্ষণ করছিল আমায়।

ভর দুপুর,শুনশান। টুকাইরা ঘুমোচ্ছে নির্ঘাৎ। উঠোন পেরিয়ে নিজের অজান্তেই কখন যে পাগলিটার পিছু নিয়েছি, খেয়ালই নেই।

মরচে পড়া একটা লোহার শব্দ হতেই চমকে দেখি, ও দাওয়ায় উঠেছে। খাঁচার দরজাটা খুলে ফেলেছে। লালকাঠি গলার বাচ্চা টিয়াটাকে বগলদাবা করে রাস্তার দিকে দৌড় লাগিয়েছে।

বুকটা লাফিয়ে ওঠে আমার; পিছু পিছু দৌড়োই! সে দুহাত উঁচু করে ধরে।

কিন্তু না! টিয়াটা ওড়ে না। ভীতু ভীতু চোখে পাঁচিলের উপর বসে।

খাঁচার মধ্যে থাকতে থাকতে আমরাও কি এমনই ভীতু হয়ে যাই? উড়তে ভুলে যাই! নাকি একটু একটু করে ভুলে থাকার চেষ্টা করি নিজেকে? আজ শাশুড়িমা! কাল হয়তো বা আমিও…!

দুটো শালিখ কিচমিচিয়ে ওর পাশে এসে বসে।

দুটোয় মিলে খুব করে ডানা ঝাপটায়; মাথা দুলিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে কী সব বলতে থাকে। একবার… দুবার… তিনবার চেষ্টা করে, বাচ্চা টিয়া ডানা ঝাপটে উড়ে যায় দূর আকাশে। উড়ে যায় শালিখ দুটোও।

ভীতু পাখিগুলোর সামনে যদি ডানা ঝটপট করা যায়; তাহলে কি ওরা উড়তে শিখবে? বাঁচতে শিখবে?

চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে আমার।

এক এক করে ভীতু হাতগুলোকে আমিও কি পারি না পাগলিটার মতো করে দরজা খুলে দিতে?

হাততালি দিয়ে ওঠে পাগলিটা!

দুটো হাত নেড়ে ডানার মতো করে বলে ফুড়ুউউউত…!

দেনাপাওনা  এবং …

ঘরপোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরাই। লক্ষণ দেখেই বুঝতে পারি, পরিণতি কোন দিকে যাবে। এক্ষেত্রেও আমার অনুমান মিথ্যে হওয়ার নয়। বিয়েটা এখানে হবে না। পাত্রীপক্ষের আচরণ খুব চেনা। এর আগে দু-দু’বার বিয়ে ভেঙেছে। এভাবেই। অথচ প্রথম দিকে পাত্রীপক্ষের আগ্রহ ছিল বেশি। তারপর…, জানি না কী রহস্যময় কারণে! হতে পারে পেছন থেকে কেউ কাঠি নাড়ছে। কিন্তু কে? কেন? কী তার স্বার্থ? গ্রহণযোগ্য কোনও ব্যাখ্যা এখনও পাইনি।

আমি দিব্য। এমএ, বিএড। পেশায় স্কুল শিক্ষক। বাড়ির একমাত্র ছেলে। বাবা কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী। এখনও পাঁচ বছর চাকরি আছে। শহরের ওপর মার্বেল বসানো হাল ফ্যাশনের দোতলা বাড়ি। বাড়িতে আধুনিক ভোগ্যপণ্যের সমস্ত উপকরণ। দেখতে নায়কের মতো না হলেও কুৎসিত মোটেই নই। গড় বাঙালি ছেলেদের তুলনায় যথেষ্ট লম্বা, শরীরে একফোঁটা মেদ নেই। রুচিশীল পরিপাটি পোশাকেই স্বচ্ছন্দ বোধ করি। নেশা বলতে একমাত্র সিগারেট। কথাবার্তা আচার-আচরণে যথেষ্ট বিনয়ী এবং স্বপ্রতিভ। পরিচিত মহলে ভালো ছেলে হিসেবেই জানে। মধ্যবিত্ত পরিবারের বিয়ের পাত্র হিসাবে যে একেবারেই হেলাফেলা নই, এটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি আমার আছে।

তবু বিয়ে হচ্ছে না। ভেঙে যাচ্ছে বারবার। বর্তমানে যেখানে কথাবার্তা চলছে। তাদের আচরণও বিশেষ সুবিধার মনে হচ্ছে না। মাস ছয়েক আগে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় এই সম্বন্ধটা এনেছিল। বাবা স্কুল শিক্ষক। তিন মেয়ের মধ্যে পাত্রীই বড়ো। ইংলিশে অনার্স কমপ্লিট করে বর্তমানে স্কুল সার্ভিসের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দেখতে শুনতে ভালো। একটু-আধটু গানবাজনাও জানে। আত্মীয়টির প্রাথমিক অনুরোধ ছিল, একবার যেন দেখে আসি। বিয়ে-থা কপালের ব্যাপার, যেখানে লেখা আছে সেখানেই হবে।

এক রবিবার গেলাম। দেখতে আহামরি না হলেও ফেলে দেওয়ার মতো নয়। কথাবার্তায় স্মার্ট। বাদবাকি সব যেমন বলেছিল।

মেয়ে দেখে বাড়ি ফিরতেই মা বলল, ওরা ফোন করেছিল।

– কারা?

– মেয়ের বাড়ি থেকে।

– কী বলছে?

– সামনের রবিবার আসবে।

– আসবে মানে! আমার মতামত জানার প্রয়োজন মনে করল না। পছন্দ হয়েছে কি হয়নি একবার শুনবে না! তোমরাই সব সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছ?

– আমি কখন সিদ্ধান্ত নিলাম?

– তবে যে আসতে বললে?

– বারবার আসতে চাইছে, না বলি কী করে! বলেছিলাম, ছেলে ফিরুক, কথা বলি, তারপর আপনাদের জানাব। এমন নাছোড় যে… তুইই বল, এভাবে ধরলে কাউকে না বলা যায়! আসতে চাইছে যখন আসুক। আসা মানেই তো আর বিয়ে নয়। মেয়ে কেমন দেখলি?

– মন্দ না।

– তাহলে আসুক।

এল। প্রায় দশ-বারো জন। বিভিন্ন বয়সি। দাদু-দিদিমা থেকে শুরু করে আধুনিক দাদা-বউদি, তাদের ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে। জেরায়-জেরায় জেরবার করল আমাকে। কোথায় চাকরি? চাকরির বয়স কত? পার্মানেন্ট কি না? প্রাইমারি না হাইস্কুল? স্কুলে কতজন দিদিমণি আছে? তাদের কতজন অবিবাহিত? কেন তাদের কাউকে বিয়ে করছি না? আরও অনেক প্রশ্ন। বয়স্ক দিদিমা আমার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কী যেন দেখলেন, তারপর প্রশ্ন করলেন, চশমা ছাড়া একদম দেখতে পাও না?

– পাব না কেন! চশমা অ্যালার্জির জন্যে, ধুলোয় অ্যালার্জি আছে।

– খোলো তো দেখি।

খুললাম।

চোখের সামনে তিনটে আঙুল তুলে ধরে জিজ্ঞাসা করলেন, কটা আঙুল?

ঘরসুদ্ধ সবাই হো হো করে হেসে উঠল। আমি গম্ভীর।

পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে যাচ্ছে দেখে অল্পবয়সি বউদিটি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেন– কিছু মনে করবেন না। সম্পর্কে দিদিমা হয় তো, তাই ঠাট্টা করছে।

কে জানে! সেকেলে মানুষ, তারপর গ্রামের। শুনেছি গ্রামের দিকে এই ধরনের রসিকতা চালু আছে। জোর করে সহজ হওয়ার চেষ্টা করি। খচখচানি তবু একটা থেকে যায়। এসব নারীপ্রগতির লক্ষণ নয়তো? আমাদের উত্তরসূরিরা মেয়ে দেখার নামে পাত্রীকে নানাভাবে হেনস্থা করেছে, এমনকী কাপড় উঁচু করে পায়ের গোড়ালি দেখতেও ছাড়েনি–, পরিবর্তনের যুগে হয়তো সেগুলোই বুমেরাং হয়ে আসছে। পূর্বপুরুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে আমাদের। অবশ্য আমার দায়ও কম কিছু নয়। অপরাধ প্রেম করতে না-পারা বা না-করা। আজ তাহলে এই পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না।

দেখাশোনা পর্ব শেষ হলে পাত্রীর বাবা বললেন, বড়ো ভাইরাভাইয়ের আসার কথা ছিল, শেষ মুহূর্তে বিশেষ কাজে আটকে গেছে। পরের সপ্তাহে আসবে। বিকালের দিকেই আসব আমরা। বেশি না, দু-তিন জন মাত্র। আর একটা কথা, সরাসরি আলোচনা করে নেওয়াই ভালো– বুঝতেই পারছেন আমার আর্থিক অবস্থা, একার চাকরির উপর সংসার। তিন মেয়ের একটাকেও এখনও পাত্রস্থ করতে পারিনি। জানি আপনাদের মতো ঘর পাওয়া বড়ো ভাগ্যের কথা। ছেলে আপনাদের হিরের টুকরো, এমন ছেলের জন্য কোনও মূল্যই যথেষ্ট নয়। তবু আমাকে তো আমার অবস্থা বুঝে এগোতে হবে! আপনাদের চাহিদাটা যদি একটু জানান।

– আপনি দেনাপাওনার কথা বলছেন?

– ওই আর কী, বরপণ বলুন আর…

– দেখুন দাদা, আমরা ব্যাবসা করতে বসিনি, সম্পর্ক তৈরি করতে এগোচ্ছি। এ প্রসঙ্গে আর একটি কথাও উচ্চারণ করবেন না।

– সে তো বটেই। তবে কী জানেন, আজকালকার ছেলে, বরপণ না নিক একটা আবদার তো থাকে…

– না, নেই। বাবা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন। ঘুরিয়ে নাক ধরবার পক্ষপাতী আমরা নই। আমাদের যেমন কোনও দাবি নেই, আপনারা নিজে থেকেও কিছু দেবেন না। তেমন হলে আমরা কিন্তু সব রেখে আসব। আর এ কেবল আমার একার সিদ্ধান্ত নয়, আমাদের পরিবারের সিদ্ধান্ত। প্রয়োজন হলে ছেলের সাথেও কথা বলতে পারেন।

– না না, এ কী বলছেন। আপনার কথাই যথেষ্ট।

– আর একটা কথা, আমরা কিন্তু সামনের শ্রাবণেই শুভ কাজ করতে চাই। দু’পক্ষের যখন পছন্দ, অকারণ দেরি করার কোনও অর্থ হয় না।

– শ্রাবণ! মাঝখানে মাত্র তিনটে মাস। এত অল্প সময়ে… তাছাড়া আমাদের সবাই এখনও ছেলে দেখল না। আপনারাও মাত্র একদিন গেছেন। আপনাদের আত্মীয়স্বজন…

– পাকাদেখার দিন দেখবে। আপনাদের আর যারা দেখার মতো আছে, সামনের রবিবারে পাঠিয়ে দিন। ওই দিনই সম্ভাব্য ডেট নিয়ে একটা আলোচনা হবে। আমরা কিন্তু তাড়াতাড়ি ছেলের বিয়ে দিতে চাই।

পরের রবিবার আরও সাত-আটজন এলেন।

গত সাতদিনে অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে। পাত্রীপক্ষের তরফ থেকে আমার স্কুলে যোগাযোগ করা হয়েছিল। এই নামে কেউ চাকরি করে কি না? কোন পোস্ট? কত বছর চাকরি করছে? মাইনে কত? ছেলে কেমন? আরও অনেক প্রশ্ন। প্রধানশিক্ষক সজ্জন ব্যক্তি, আমাকে স্নেহ করেন, তিনি তাঁর মতো বলেছেন। খোঁজ নেওয়া হয়েছে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন এমনকী আমার বন্ধু মহলেও। সেসব খবর ভায়া হয়ে আবার আমাদের কানে পৌঁছেছে। মা একটু ক্ষুণ্ণ হলেও আমার কিছু মনে হয়নি। নিজের সম্পর্কে আমার আত্মবিশ্বাস আছে, যেখানে ইচ্ছা খোঁজ নিক। তাছাড়া একজন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা তার কন্যাকে পাত্রস্থ করার আগে, পাত্র সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজখবর নেবেন, এটাই স্বাভাবিক। তার জায়গায় আমি থাকলে আমিও একাজ করতাম। যা দিনকাল পড়েছে…

জলযোগ পর্ব শেষ হলে আজ মা-ই প্রথম প্রসঙ্গ তুলল, আমাদের এবার কাজের কথায় আসা উচিত। দিনক্ষণ নিয়ে কিছু ভেবেছেন?

– অত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? কথায় বলে লাখ কথা না হলে বিয়ে হয় না। এসব কাজ কি তাড়াহুড়ো করে করতে আছে?

– আপনাদের প্রবলেমটা কি খুলে বলবেন?

– না না, প্রবলেম কিছু নেই। মেয়ের বিয়ের জন্যে আমি তৈরি হয়েই আছি।

– তবে? আমাদের সম্পর্কে কোনও কয়্যারি থাকলে খোলাখুলি আলোচনা করতে পারেন।

– ছিঃ ছিঃ কী বলছেন! আপনারা সজ্জন ব্যক্তি। আজকের দিনে এমন ঘর লাখে একটাও মেলে না। আর ছেলের তো কোনও তুলনাই হয় না। আজকের যুগে এমন ছেলে… মেয়ে আমার অনেক ভাগ্য করে জন্মেছে।

– তাহলে বাধাটা কোথায়?

– আসলে সেভাবে কিছু ভাবার সময় পাইনি। যাই, বাড়ি গিয়ে আলোচনা করি…

– তার মানে সিদ্ধান্তই নিতে পারেননি?

– না না, সিদ্ধান্ত পাকা। বিয়ে আমরা এখানেই দেব।

পাত্রীর বাবা সপ্তাহ খানেক সময় নিলেন সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য। একটা ভলো দিন দেখে দুপক্ষ একজায়গায় বসে আনুষ্ঠানিক ভাবে লগ্নপত্র হবে, এরকম একটা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিলেন তারা। তারপর প্রায় দু’মাস কেটে গেছে। গত দু’মাসে এক চুলও কাজ এগোয়নি। এগোয়নি কারণ, ওপ্রান্তের রহস্যময় শিথিলতা। নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ রাখলেও, বিয়ের প্রসঙ্গ তুললে একটা না একটা অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে গেছে। জানি না কেন এমন করছে। দিনে দিনে অসহ্য হয়ে উঠছে ব্যাপারটা। তাছাড়া এটা আত্মসম্মানের প্রশ্নও। অন্যের হাতের পুতুল হয়ে… এমন অবস্থায় করণীয় কাজ একটাই, না বলে দেওয়া। সেটা করাও যায়। কিন্তু গত দু’বছরে তিন-তিনটে বিয়ে ভেঙেছে, রহস্যটাও অধরা রয়ে গেছে। পাত্রীপক্ষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কেন এমন গড়িমসি করছে, সেটা না জানতে পারলে ভবিষ্যতেও…

সাম্প্রতিক ঘটনাটা নিয়ে অনেকের সাথে আলোচনা করেছি। কেউ ভালো চোখে দেখছে না। আমিও সিঁদুরে মেঘ দেখছি। হতে পারে আমাকে হাতে রেখে অন্য কোথাও চেষ্টা চালাচ্ছে। বেটার পেয়ে গেলে ‘না’ বলে দেবে। এমন মানসিকতা অনেকেরই থাকে। সেক্ষেত্রে অপমানের চূড়ান্ত হতে হবে।

মানসম্মান বাঁচাতে সিদ্ধান্ত এবার নিতেই হবে।

পরিস্থিতির জটিলতায় বাড়িসুদ্ধ মানুষ যখন দ্বিধাগ্রস্ত, আচমকা একদিন অনীকের ফোন এল। অনীক আমার ছোটোবেলার বন্ধু। পাশাপাশি পাড়ায় বাড়ি। কর্মজীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় ইদানীং সেভাবে দেখাসাক্ষাৎ না হলেও আন্তরিকতায় ঘাটতি পড়েনি।

– শালা বিয়ে করছিস, ভাবছিস জানতে পারব না। ফাঁকি দেওয়ার তালে আছিস, না?

স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই শুরু করল অনীক।

– তোকে কে বলল?

– খবরটা সত্যি কি না বল?

– এখনও ফাইনাল হয়নি। কথাবার্তা চলছে।

– কোথায়, হাবড়া?

– অনেক খবর রাখিস দেখছি, চিনিস নাকি?

– না, ট্রেনে পরিচয়। অফিস থেকে ফেরার পথে। বনগাঁয় বাড়ি শুনে বললে, মেয়ের সম্বন্ধ করছে বনগাঁয়। ছেলে স্কুলশিক্ষক। তোর নাম বলল, বললাম, চিনি। ছোটোবেলার বন্ধু। এখনও যোগাযোগ আছে কিনা জানতে চাইল। তোর সম্পর্কে অনেক কয়্যারি। অন্যান্য জায়গা থেকেও খোঁজখবর নিয়েছে। নেগেটিভ কিছু পায়নি, কথাবার্তা শুনে যেমন মনে হল। লোকটা কেমন সন্দেহবাতিক টাইপের। এক পা এগোলে, দু-পা পেছানোর মানসিকতা। বিশেষ সুবিধার মনে হল না।

– কেন কী বলছে?

– বললাম, চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারেন। এমন ছেলে আজকাল মেলে না। তো কী বলল জানিস?

– কী?

– ভয় তো সেখানেই।

– মানে!

– ঠিক এই শব্দটা আমার মুখ থেকেও বেরিয়েছিল। ভদ্রলোক বললেন, ঠান্ডা মাথায় বুঝবেন। এত ভালো ফ্যামিলি, ভালো চাকরি, তারপর একমাত্র পুত্র। খোঁজখবর নিয়ে যতটুকু জেনেছি, ছেলেও চরিত্রবান। বিয়ের বাজারে এমন একটা ছেলের ডিমান্ড কী হতে পারে আপনার ধারণা আছে?

– কেন কী চাইছে?

– না না, কিছু চায়নি। চাইলে তো সন্দেহ হতো না। বলছে কিছুই নেবে না। দিলেও রেখে আসবে। আপনিই ভাবুন…

– ঠিকই তো বলেছে। একটা শিক্ষিত, সচেতন ছেলে পণ নিয়ে বিয়ে করবে কেন? পণ দেওয়া এবং নেওয়া দুটোই বেআইনি।

– রাখুন তো আপনার আইন! ওসব সিনেমা-থিয়েটারে চলে, গল্প-উপন্যাসে মানায়। বাস্তবটা আমি জানি। মেয়ের জন্যে আজ থেকে তো চেষ্টা করছি না! আজকের দিনে এত বোকা কেউ নেই।

– আপনার কী মনে হচ্ছে?

– রহস্য কিছু নিশ্চয়ই আছে। নইলে বিয়ের জন্যে এত তাড়াহুড়ো করবে কেন? আমার আত্মীয়রাও বলছে, ধীরে এগোতে। ভালো করে খোঁজখবর নিতে…

– তো নিন না।

– নিয়েছি। অনেক নিয়েছি। ছেলে সম্পর্কে কোত্থাও এতটুকু খারাপ কিছু পাইনি।

– তাহলে তো মিটেই গেল।

– মিটে গেল কী বলছেন? সন্দেহ তো এখানেই…

– ধুর মশাই, আপনার স্ক্রু ঢিলে আছে। আমি হলে আপনার মেয়েকে কখনওই বিয়ে করতাম না।

– রাগ করবেন না, ভদ্রলোক হঠাৎ আমার হাত চেপে ধরে। বলে, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা, মাথার ঠিক নেই। ভেবে দেখুন, আমার জায়গায় আপনি হলে আপনার অবস্থাও আমার মতো হতো কিনা?

– না হতো না। আপনার মতো এত নীচু মানসিকতা আমার নয়।

– সে আপনি বলতেই পারেন। আপনার কথা আমি গায়ে মাখছি না। ভেবে দেখুন, আপাতদৃষ্টিতে আমার তা মনে হলেও বাস্তবে সেটা তো নাও হতে পারে!

– আপনার কথাবার্তা কিছু বুঝতে পারছি না।

– যদি অভয় দেন তো একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। কথাটা যেন পাঁচকান না হয়। আমাকে ছুঁয়ে কথা দিলেন কিন্তু।

– আমি নই, আপনি আমাকে ধরে আছেন।

– ওই হল, একই ব্যাপার। ভদ্রলোক আরও জোরে আমার হাতটা চেপে ধরেন। মুখটা আরও কাছে এগিয়ে এনে, গলার স্বর যথাসম্ভব খাদে নামিয়ে বলেন, আপনি ছেলের বন্ধু, আপনি জানলেও জানতে পারেন। সব খবর তো আর বাইরের মানুষ জানে না। বাইরে থেকে দেখলে মাকাল ফলও সুন্দর লাগে। না না, আপনার বন্ধুকে আমি মাকাল ফল বলছি না। আসলে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা তো, সন্দেহ হয়ই। ভদ্রলোক এবার গলার স্বর আরও নামিয়ে, আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন…

অনীক থামে একটানা কথাগুলো বলে। একটু সময় নেয় তারপর বলে, কী জিজ্ঞাসা করল জানিস?

– কী?

– ছেলে ফিজিক্যালি ফিট তো?

একটি শিশিরবিন্দু

ব্যাংকক-পাটায়া ঘুরে আসার পর মনে সুখ নেই রাতুলের, রীতিমতো দমে আছে সে। ফুটবলের মাঠে চার-পাঁচজনকে কাটিয়ে অনবদ্য শটে গোল করার পর মাঠভর্তি দর্শক যদি হাততালি না দেয় তাহলে ফুটবলারের যে-অবস্থা হয়, রাতুলের অবস্থা তার চেয়ে কম করুণ নয়।

তবে দুঃখ থাকলে দুঃখ থেকে বেরোনোর পথও আছে। সেই উদ্দেশ্যেই সে দুপুরে একটু রেস্ট নিয়ে বৈশাখীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে সমীরণদার বাড়ির উদ্দেশে। রাতুল দু’শোভাগ নিশ্চিত, কেউ হাততালি না দিলেও এই একটা লোক হাততালি দেবেই দেবে, তার দুঃখ ভুলিয়ে দেবে। সমীরণদা তার বাল্যজীবনের আইডল, ভ্রমণের আনন্দ কী সমীরণদাই তাকে প্রথম শিখিয়েছিল, তার চোখ খুলিয়েছিল।

রাতুল আর বৈশাখী দু’জনেই আইটি ফার্মে কাজ করে, সকালে নাকেমুখে গুঁজে একসঙ্গে বেরিয়ে যায়, ফিরতে ফিরতে রাত ন’টা-সাড়ে ন’টা, কাজের চাপ থাকলে কখনও কখনও তারও পর। ফলে ছুটির দিনগুলোয় বাড়ি থেকে নড়তেই ইচ্ছে করে না বৈশাখীর। সে আসতেই চাইছিল না, রাতুল এক রকম জোর করেই এনেছে তাকে, তাই মুখ সামান্য ভার তার।

রাতুল আর বৈশাখীর অফিস একই বিল্ডিংয়েই, ফ্লোরটাই শুধু যা আলাদা। বছর তিন আগে তাদের পরিচয়ের গাড়ি স্টার্ট নিয়ে সম্প্রতি বিয়ের স্টেশন পর্যন্ত পেৌঁছেছে। ব্যাংকক-পাটায়াতে তারা হানিমুন ট্রিপেই গিয়েছিল। ভ্রমণের যদি গ্রেড করতে হয়, ফরেন টুর বলে এটাকে এ গ্রেডের টুরের তকমা লাগাতেই হয়। এ গ্রেডের টুর রাতুলের জীবনে এই প্রথম। এখনও তার হ্যাংওভার কাটছে না, চোখের সামনে বেড়ানোর পর পর ছবিগুলো ভেসে যাচ্ছে, কিন্তু কাউকে শেয়ার করতে পারছে না। কোনও মানে হয়?

‘আরে মুড অফ কেন বৈশাখী? বি জোভিয়াল।’ ট্যাক্সিতে উঠে রাতুল চাগানোর চেষ্টা করল বৈশাখীকে, ‘সমীরণদার সঙ্গে তোমার তো পরিচয় নেই, আজ দেখবে কী মজার মানুষ। বিয়ের পর বউকে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় অযোধ্যাপাহাড়ে বারো কিলোমিটার দৌড় করিয়েছিল।’

বৈশাখী সচকিত হল, ‘অ্যাঁ!’

‘হুঁ, কুলির পেছন পেছন। বউদির ভয় হচ্ছিল, কুলি যদি মাল নিয়ে পালায়।’

বৈশাখীর মুখের ভার সামান্য কাটল।ড্রাইভার রাতুলকে বলে গাড়ি স্টার্ট করতে যাবে বাধা পড়ে গেল, ট্যাক্সির জানালায় মুখ বাড়িয়েছে পাশের বাড়ির রানিবউদি। একগাল হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘সেজেগুজে কপোতকপোতী কোথায় চললে?’

এসে গিয়েছে পাড়ার গেজেট! রাতুলরা হানিমুন থেকে ফেরার পর রানিবউদি এসেছিল তাদের বাড়িতে, কিন্তু তাদের ভ্রমণের গল্প শোনার চেয়ে তার কৌতূহল বেশি ছিল ওখান থেকে তারা কী গিফ্ট আইটেম এনেছে সেদিকেই। অনেক কষ্টে কম্পিউটারে বেড়ানোর কয়েকটি ছবি তাকে দেখাতে পেরেছিল বৈশাখী। তারপরেই তার মনে পড়ে যায়, শতদ্রুদার খাওয়ার টাইম হয়ে গিয়েছে, পরে এসে দেখবে বলে তড়িঘড়ি চলে যায়। রাতুল ড্রাইভারকে একমিনিট দাঁড়াতে বলে সমীরণদার কথা বলে সেকথা তুলল। ‘বউদি বললে আসবে, কই এলে না তো?’

রানিবউদি ‘যাব যাব’ বলে ফোটোর কথা পাস কাটিয়ে চলে গেল সমীরণদার কথায়, ‘সমীরণদা বছর পাঁচ আগে এপাড়া ছেড়ে রাসবিহারীর দিকে উঠে যাওয়ার পর আর একদিনও তো এদিক মাড়াল না, তার সঙ্গে হঠাৎ কী দরকার পড়ল তোমার?’

হুঁ, দরকারটা বলি, আর তুমি সারা পাড়া রাষ্ট্র করে বেড়াও! রানিবউদির বাচ্চাকাচ্চা হয়নি, এই বয়েসে হওয়ার আর চান্সও নেই, তাই শতদ্রুদা অফিস বেরিয়ে গেলে তার অঢেল সময়। রাতুল নতুন টেকনিক নিল, ঠাট্টার চালে বলল, ‘বলব না।’

‘উঁ?’

রাতুল রাগের ভান করল, ‘আগে আমাদের বাড়ি যাবে, ছবিগুলো সব দেখবে, তার পর বলব। ঠিক আছে?’

‘আচ্ছা তাই।’ রানিবউদি সারেন্ডার করে আবার সমীরণদার কথা পাড়ল, ‘সমীরণদার বিয়েতে খুব আনন্দ করেছিলাম আমরা।রাতুল সমীরণদার কাছে যাচ্ছ, আমাদের কথা বোলো, কেমন?’

‘পারব না।’ রাতুল চোখ কাঁপাল, ‘এত বড়ো একটা ট্রিপ দিয়ে এলাম, ভালো করে ছবিগুলো পর্যন্ত দেখলে না! যাও ওসব হবে-টবে না।’

রানিবউদি হেসে ফেলল, ‘বললাম তো যাব। বাবারে বাবা।’

‘বাবা-টাবা বললে শুনব না।’ রাতুল আরও শর্ত লাগাল, ‘শুধু স্টিল ফোটোগুলো দেখলে হবে না, ভিডিয়োগুলোও সব দেখতে হবে, তারপর তোমার সঙ্গে কথা।’

‘আবার ভিডিয়ো? তোমার বিয়ের ভিডিয়ো দেখতেই তো তিনদিন কাবার হয়ে গিয়েছিল, আবার বেড়ানোর? আমায় মারবে নাকি রাতুল?’ বউদি খিলখিল করে হেসে উঠল।

‘তুমি হাসছ!’ এবার সত্যি সত্যি রাগ হয়ে গেল রাতুলের, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’

‘অ্যাই দ্যাখো বোকা ছেলে, রাগ করে। ইয়ার্কিও বোঝে না!’ বউদি আস্বস্ত করল, ‘ঠিক আছে, আজ রাতেই যাব তোমাদের বাড়ি। তোমরা ফিরলেই যাব। ঠিক আছে?’

রানিবউদি কথা শেষ করে বৈশাখীকে একঝলক মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে সরে দাঁড়াল, ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করল। পাড়ার গলি পেরিয়ে গাড়ি চলে এল মেনরোডে। বৈশাখী দেখছিল রাতুলকে, মুখের গুমোটটা আবার ফিরে এসেছে তার, গম্ভীরভাবে বলল, ‘তুমি কী বলো তো, লোকে দেখবে না তবু জোর করে ফোটো দেখিয়েই ছাড়বে?’

‘কেন তাতে অসুবিধেটা কী আছে?’ রাতুল বলল, ‘আমরা কষ্ট করে এত হাজার হাজার টাকা খরচ করে বেড়িয়ে এলাম, জাস্ট ফোটোগুলো দেখবে, এটুকু হেল্প করতে পারবে না?’

‘তাদের বয়েই গেছে।’ বৈশাখীর গলায় শ্লেষ, ‘তুমি কী ব্যাংকক দেখাচ্ছ, লোকে এখন কথায় কথায় তার চেয়েও দূরে দূরে ট্রিপ দিয়ে আসছে। আমার পাশের টেবিলের মিতা সেদিন আমায় শুনিয়ে বলছিল, এখন সিঙ্গাপুর-থাইল্যান্ড ছ্যা-ছ্যা হয়ে গিয়েছে, দু’দিন পরে পুরী-দিঘার মতো অবস্থা হবে। তাই সে ঠিক করেছে, বিয়ের পরে নিউজিল্যান্ডে হানিমুন ট্রিপ দেবে। শুঁটকি মেয়ের বিয়ে হয় কিনা তারই ঠিক নেই, বলে নিউজিল্যান্ড!

রাতুল হেসে ফেলল। তারও একই অবস্থা।তাই অনেক দুঃখেই সে সমীরণদাকে সিলেক্ট করেছে।

‘তাই বলো!’ বৈশাখীর মুখখানা হাসি হাসি হয়ে এল, ‘বেড়িয়ে এসে পেট ফুলছে, তাই ছুটির দিনটা বরবাদ করে আমাকে টানতে টানতে সমীরণদার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছ? উফ্, তুমি পারোও বটে।’

‘না না ভ্যাট।’ রাতুল লজ্জা পেল, ‘ইন ফ্যাক্ট, সমীরণদার অনেক গল্প শুনেছি এক সময়। বেড়ানোর গল্প, বুঝলে, সমীরণদা বিয়ের পর দু’দিন অন্তর বউদিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ত, যেখানে যত পাহাড়-জঙ্গল ছিল একেবারে চষে ফেলত।’

‘মরেছে।’ বৈশাখী ভয় পেল, ‘আমারও সেই হাল করবে নাকি? পাহাড়-জঙ্গলে বাঘ থাকে, বিষাক্ত সাপখোপ থাকে, আমি নেই বাবা।’

‘ইয়ার্কি কোরো না তো! শোনোই না!’ রাতুল বলে চলল, ‘আমাদের তো তখন বয়েস কম, ক্লাস ফাইভ-সিক্সে পড়তাম, সমীরণদা বউদিকে নিয়ে বেড়িয়ে ফিরলেই তাদের বাড়ির ছাদে আমাদের সভা বসত। বসে বসে হাঁ করে শুনতাম তাদের বেড়ানোর গল্প। সমীরণদা এত সুন্দর করে রসিয়ে রসিয়ে গল্প বলত ভাবতে পারবে না।’

বৈশাখী হাসছে, ‘তারই পালটা দিতে যাচ্ছ বুঝি? এতদিন বসে বসে সমীরণদার গল্প শুনেছ, এবার তুমি শোনো, উঁ? পুরো বাচ্চাদের মতো হাবভাব তোমার!’

‘ধ্যাত!’

বৈশাখী থামছে না, ‘শোনো ক্রেডিট নেওয়ার জন্য তুমিও তো তোমার গডফাদারের মতো পাড়ার একটা বাচ্চা-টাচ্চা ধরে ট্রাই করতে পারতে।তাহলে আর কষ্ট করে আমাকে অতদূরে যেতে হতো না।’

‘বাচ্চারা শুনবে গল্প? এখনকার বাচ্চাদের সে অভ্যাসই হয়নি।বাড়িতেই তো দাদার একপিস ছেলে আছে জোজো। গল্প শুনবে কী, বেড়ানোর ছবিগুলো পর্যন্ত ভালো করে দেখল না, টিভির কার্টুন চ্যানেল আর কম্পিউটারের গেমস নিয়েই ব্যস্ত। দু’টো ছবি দেখতে না দেখতেই তার ধৈর্য শেষ। তার চেয়ে সমীরণদাই ভালো।’ সঙ্গে অ্যালবামগুলো এনেছে সে, ছবিগুলোও এক কপি রাইট করে এনেছে, দিয়ে আসবে, তার বিশ্বাস, সমীরণদা খুশিই হবে।

‘তুমি নিশ্চিত সমীরণদা তোমার গল্প শুনবে?’ বৈশাখী তর্ক তুলল।

‘হান্ড্রেড পারসেন্ট। সমীরণদা কী লেভেলের ভ্রমণপাগল ভাবতেই পারবে না।’ রাতুল উচ্ছ্বসিত হল, ‘শুধু ভ্রমণপাগল নয়, সমীরণদার একটা ক্লিয়ার ভ্রমণদর্শনও ছিল, প্রায়ই রবীন্দ্রনাথকে কোট করে বলত, ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু।’ ঘরের কাছে ঘোরার এত জায়গা থাকতে লোকে কেন যে দূরে দূরে যায়।’

‘ওসব এখন ব্যাকডেটেড আইডিয়া।’ বৈশাখী এক কথায় উড়িয়ে দিল কথাটা।

‘কী বলছ!’ রাতুল অবাক ও বিরক্ত।

‘রাইট। প্যাকেজ টুর আর কনডাক্টেড টুর এসে সব বদলে দিয়েছে। বাঙালি এখন সারা পৃথিবী চক্বর দিয়ে বেড়াচ্ছে, তোমার পাহাড়-জঙ্গলে বসেঞ্জথাকার পার্টি এখন কেউ নেই।’ বৈশাখী শ্লেষভরা প্রশ্ন ছুড়ল, ‘এত যে সমীরণদা সমীরণদা করছ তোমার বিয়েতেই তো এল না, উঁ?’

‘সে তো শরীর খারাপ হয়েছিল বলে আসতে পারেনি।’ রাতুল দুর্বল ব্যাখ্যা দিল, ‘ফোনে নেমতন্ন করেছিলাম তো।’

‘তাতে কী হয়েছে? এখন তো ফোনে ফোনেই নেমতন্ন করা চালু হয়ে গিয়েছে। আত্মীয়দেরও লোকে এখন ফোনেই নেমতন্ন করছে।’ বৈশাখী স্পষ্ট জানিয়ে দিল, ‘শোনো তোমাকে বলে দিচ্ছি, দিজ ইজ ফার্স্ট অ্যান্ড দিজ ইজ লাস্ট। বারবার তোমার সঙ্গে আসতে পারব না। এর পর থেকে এলে তুমি একাই আসবে, ও কে?’

‘কনডাক্টেড টুরই তোমাদের সর্বনাশ করে দিয়েছে, বুঝলে? মনটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে তোমাদের।’ রাতুল আর ক্ষোভ চেপে রাখতে পারল না, ‘তোমাকে দেখে কে বলবে এতবড়ো একটা টুর দিয়ে এলে। তোমাদের কি ইচ্ছেও হয় না কারও সঙ্গে তা শেয়ার করার? এ কী রকম বেড়ানো তোমাদের কে জানে! যাচ্ছ তো দেখবে বউদিকে!’

‘তোমার পাহাড়-জঙ্গলের বউদি?’ বৈশাখীও রেগে গেল, ‘বউদিই তোমার টেস্ট খারাপ করে দিয়েছে, তাই দার্জিলিং আর সিকিম সিকিম করে লাফাচ্ছিলে! যত্ত থার্ডগ্রেডের পাবলিক হানিমুন করতে যায় সেখানে।’

‘থার্ডগ্রেড!’ রাতুল আহত হল।

‘তাছাড়া কী? আমি জোর না করলে যেতে?’ বৈশাখী ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠল, ‘বউদি দেখাচ্ছ, জীবনে ভেবেছিলে গ্র্যান্ড প্যালেস দেখতে পাবে? কোরাল আইল্যান্ডে বোটিং করতে পারবে? কুল বার, জাজ ক্লাব, স্কাই ট্রেন কাকে বলে জানতে? মেরিন পার্ক, টাইগার জু? পাহাড়-জঙ্গলে কী আছে তোমার? ঘণ্টা!’

রাতুল স্তম্ভিত হয়ে গেল। ‘পাহাড়-জঙ্গলে কিছু নেই? কিন্তু বউদিকে দেখে কে বলবে তা? সমীরণদার সঙ্গে বেড়িয়ে আসার পরে চেহারটাই বদলে যেত বউদির। আনন্দে একেবারে কলকল করছে। পাড়ার বাচ্চাদের নাচতে নাচতে ধরে নিয়ে আসত তাদের বাড়িতে, বলত, চল গল্প শুনবি তোর সমীরণদার!’

দিনের আলোটি পড়ার অপেক্ষা, বাড়ির ছাদে গুছিয়ে বসে সমীরণদা ভ্রমণের গল্প জুড়ত, বউদি আলুরদম-লুচি করে খাওয়াত সকলকে। গল্পে গল্পে রাত গড়িয়ে যেত, এক একদিন ছাদ আলো করে চাঁদ উঠত, তখন কী যে আনন্দ, কী রোমাঞ্চ, ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে পড়ার কী যে বিপুল তৃষ্ণায় তাদের বুকটা টনটন করে উঠত বৈশাখী কী জানবে তার? ব্যাংকক-পাটায়া ঘুরলেই কি বউদির মতো আলুরদম-লুচি বানানো যায়? এখনও যেন তার টেস্ট লেগে আছে রাতুলের মুখে।

রাতুল গুম মেরে গেল।

 

 

আধঘণ্টা পরের কথা। রাতুলরা এখন দাঁড়িয়ে আছে রানি ভবানী রোডে সমীরণদার ফ্ল্যাটের গেটে। সেকেন্ড ফ্লোরের তিনশো তিন নাম্বার ফ্ল্যাট সমীরণদার, বেল বাজিয়ে অপেক্ষা করছে।রাতুলের কাঁধে লেদারের ব্যাগ, তাতে বড়ো বড়ো দু’টো অ্যালবাম, বৈশাখীর হাতে মিষ্টির প্যাকেট। দু’জনে দু’দিকে তাকিয়ে আছে।

মিনিটখানেক। আইহোলে ছায়া পড়ল, তার পর দরজা খুলে কোলাপসিবল গেট টেনে সমীরণদা বলল, ‘আয় রাতুল!’

রাতুল ঘরে এল। পিছনে বৈশাখী। দু’জনের মুখই থমথম করছে। বউদির সম্পর্কে বৈশাখীর মন্তব্য ভালোই গায়ে লেগে গিয়েছে রাতুলের। রেগেমেগে সে একবার ভেবেছিল ফিরেই যাবে, কিন্তু সমীরণদাকে কথা দেওয়া আছে বলে এসেছে।

সমীরণদার পরনে হাতাওয়ালা গেঞ্জি আর পাজামা। বৈশাখীকে দেখছিল সে, রাতুলকে শুধোল, ‘এই বুঝি তোর নতুন বউ?’

রাতুল কষ্ট করে মুখে হাসি টানল, ‘হুঁ।’

‘হুঁ কী রে? সগর্বে বল। বুকফুলিয়ে বল।’ সমীরণদা মজা করল, ‘কী নাম এর?’

‘বৈশাখী।’

‘বাহ্।’ বলতে বলতে সমীরণদার পাকা চোখে ধরা পড়ে গেল, ‘কী ব্যাপার? মুখ হাঁড়ি, আসতে আসতে ঝগড়া করেছিস নাকি দু’জনে?’

রাতুল চট করে একবার বৈশাখীকে আড়চেখে দেখে নিয়ে মাথা নাড়াল, ‘না না!’

‘লজ্জা পাচ্ছিস কেন?’ সমীরণদা আবারও ঠাট্টা জুড়ল, ‘মাঝেমাঝে ঝগড়া হওয়া ভালো, ঝগড়া বেশ স্বাস্থ্যকর অভ্যাস। বোস বোস! ঝগড়ার এখন ইন্টারভ্যাল, ঠিক আছে?’

রাতুলের মুখের গুমোট কিছুটা কাটল, বৈশাখীর দিকে চেয়ে বলল, ‘মিষ্টিটা দাও।’

বৈশাখী মিষ্টির প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে সোফায় বসে ভালো করে দেখল সমীরণদাকে। সে মনে মনে একটা আন্দাজ করেছিল, দেখল মাঝারি হাইট, মাঝারি রং, মাঝারি কাটিংয়ের মুখচোখের বাইরে একটাই একটু অন্য রকম সমীরণদার, মাথার চুলে পাক ধরতে শুরু করেছে। অথচ বেশি বয়েস নয় ভদ্রলোকের, চল্লিশের কোঠায়। ভাবতে ভাবতে তাকে চমকে দিয়ে তার পাশে বসেই রাতুল বলে উঠল, ‘কী ব্যাপার সমীরণদা, এই বয়েসে মাথার চুল পেকে গেল কী করে তোমার?’

সমীরণদা হাসল, ‘সেটা বয়েসকেই জিজ্ঞেস কর।’

রাতুলও হাসল, বলল, ‘যা-ই বলো, পাকাচুলে তোমায় ঠিক যেন মানায় না। আমাদের কাছে তোমার ইমেজই আলাদা। এই তো আসতে আসতে ওকে বলছিলাম, সমীরণদা ছিল আমাদের ছেলেবেলার হিরো।’

‘ছিল, এখন আর নেই। পাকাচুল দেখেছে যে!’ সমীরণদা বৈশাখীর দিকে ফিরল, ‘আবার মিষ্টি আনতে গেলে কেন?’

কেন আবার? হানিমুন ট্রিপের গল্প শোনানোর জন্য। কেউ শুনবে না, ঘাড়ে পড়ে শুনিয়েই ছাড়বে। বৈশাখী হাসি চেপে সুন্দর উত্তর দিল, ‘মনে করুন এটা আমাদের বিয়ের মিষ্টি।’

‘ভেরি সরি। সমীরণদা জিভ কাটল, তোমাদের বিয়েতে যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল, শরীরটা হঠাৎ করে…’

‘শুনেছি।’ বৈশাখী বলল, ‘আপনি বসুন। আপনার কথা, বউদির কথা অনেক শুনেছি ওর মুখে। আপনারা নাকি খুব বেড়াতেন, দু’দিন ছাড়া ছাড়া বেরিয়ে পড়তেন। ইন্টারেস্টিং।’

‘ওকে কি বেড়ানো বলে?’ সমীরণদা ক্রেডিটটা নিতেই চাইল না, সোফায় গুছিয়ে বসে জুড়ল, ‘এদিকে গোবরডাঙা ওদিকে লিলুয়া… এই তো দৌড় ছিল আমাদের! এখন বললে লোকে হাসবে।’

থার্ডগ্রেডের লোকের ফোর্থগ্রেডের ভ্রমণ? মুখের মতো জবাব! জ্বালাটা একটু কমল রাতুলের, চাপা শ্লেষের সুরে বৈশাখীকে শোনাল, ‘এই হল সমীরণদা, বুঝলে?’

‘বুঝলাম।’ বৈশাখীর ভুরুতে বাঁক।

‘তুমি তো আসতেই চাইছিলে না!’ রাতুল ফিরল সমীরণদার দিকে, ‘আমি বললাম চলো, সমীরণদাকে একবার দেখলেই বুঝবে কেমন মানুষ। চাঁদনী রাতে তোমার বাড়ির ছাদে বসে বেড়ানোর গল্প… উফ্, কী ফার্স্টক্লাস ছাদটা ছিল তোমাদের বাড়ির সমীরণদা, তুমি চলে এলে ওখান থেকে।’

‘হুঁ, ছাদটা রিয়েলি সুন্দর ছিল। চারপাশ খোলা, ছোট্টখাট্ট, নিরিবিলি।’ সমীরণদা অন্যমনস্ক হল, ‘এখন ভাবি ওখানে থাকলেই বোধ হয় ভালো ছিল।’

‘বলো বলো।’ রাগতাপ শেষ রাতুলের, উৎসাহে টগবগ করছে, ‘সেই যে আমাদের বেড়ানোর নেশা ধরিয়ে দিলে সমীরণদা, তার পর থেকে ভবিষ্যৎ একেবারে ঝরঝরে… বেড়িয়ে বেড়িয়ে পকেট হালকা।’

এই তো আস্তে আস্তে কী রকম টার্গেটে চলে যাচ্ছে রাতুল। মিষ্টি বেরিয়েছে, অ্যালবাম বেরোল বলে। কিন্তু পাহাড়-জঙ্গলের লোক সইতে পারবে তো? এদের পক্ষে বড্ড বেশি হাইভোল্টেজ হয়ে যাবে না তো? মিতার কথা মনে পড়ল বৈশাখীর, ঠোঁটে হাসি ফুটছে তার।

‘কী হল হাসছ যে?’ রাতুল তাকাল।

‘না না এমনি।’

‘ও’ বলে রাতুল আবার ঘুরে গেল সমীরণদার দিকে, ‘এমন নেশা ধরিয়েছ কী বলব সমীরণদা, ক’দিন আগেই হানিমুন করে এলাম, আবার মনে হচ্ছে বেরিয়ে পড়়ি।’

উফ্ আর তর সয় না। বৈশাখী তাড়াতাড়ি ‘দাঁড়াও না’ বলে রাতুলকে থামিয়ে সমীরণদার দিকে চেয়ে কথা ঘোরাল, ‘কই বউদিকে ডাকুন, আলাপটা সেরে নিই।’

সঙ্গে সঙ্গে ঘরের পরিবেশ বদলে গেল। কয়েক সেকেন্ড ফ্যালফ্যাল করে বৈশাখীর দিকে চেয়ে থেকে রাতুলের দিকে দৃষ্টি স্থির করল সমীরণদা, ‘তোরা খবর পাসনি?’

রাতুল চমকে গেল, ‘না তো।’

‘শুনিসনি কিছু?’

রাতুল দাঁড়িয়ে হাত ঘষতে ঘষতে বলল, ‘তোমার সঙ্গে তো বছরখানেক আগে লাস্ট টেলিফোনে কথা হয়েছিল, তার পর ফোন করব করব করে আর করা হয়নি।জানব কী করে?’

‘তাও তো বটে। জানবিই বা কী করে?’ সমীরণদা ভেঙে পড়ল, ‘তোর বউদি আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছে রাতুল। ছেলেকে নিয়ে আলাদা থাকে।’

রাতুল আর্তনাদ করে উঠল, ‘যাহ্।’

‘বিশ্বাস হচ্ছে না? সত্যিই রে, তোদের বউদি বোর হয়ে গিয়েছিল আমার সঙ্গে থাকতে থাকতে। শুধু বাইরে বাইরে যাত্রা করলেই কি সংসার চলে রে? সংসারটাও একটা যাত্রা, সময়ে তারও টিকিট কাটতে হয়, রিজার্ভেশন করতে হয়, ঠিকঠাক সব অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে হয়। চিরকালই তো আমি উড়নচণ্ডী রয়ে গেলাম, বদলালাম না। লোকে এখন কোথায় কোথায় চলে যাচ্ছে, আমি নাকে দড়ি দিয়ে শুধু ঝোপেঝাড়ে আর থার্ডক্লাস সব জায়গায় ঘুরিয়েই মারলাম তোদের বউদিকে।’ সমীরণদা থামল।

প্রচণ্ড একটা গুমোটে ছেয়ে গেল ঘরটা। কারও মুখে কথা নেই। রাতুল দেখছে বৈশাখীকে, বৈশাখী দেখছে রাতুলকে। দু’জনের মুখেই স্পষ্ট অবিশ্বাসের ছাপ। শুধু ঘোরাঘুরির অপরাধে বউদির মতো নারী ভ্রমণপাগল স্বামীকে ছেড়ে যায়? যেতে পারে? অ্যাবসার্ড!

কেটে গেল আরও কয়েক সেকেন্ড, তার পর সমীরণদাই নীরবতা ভাঙল, নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘ছাড় ওসব কথা, তোদের কথা বল। কোথায় হানিমুন করলি রাতুল?’

সমীরণদার এই প্রশ্নটা শোনার জন্যই তো এতদূর ছুটে আসা। কিন্তু রাতুলের মুখে কথা নেই, তীব্র অস্বস্তিতে মুখখানা ছেয়ে গিয়েছে তার, অসহায়ভাবে চেয়ে আছে বৈশাখীর দিকে। ভাবখানা এমন, আমাকে বাঁচাও।

এতক্ষণ ভ্রমণদর্শন আওড়াচ্ছিলে না? একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু? হঠাৎ রাগ হয়ে গেল বৈশাখীর, রাতুলের দিকে চেয়ে গলা চড়াল, ‘আমার দিকে তাকাচ্ছ কেন? আমি কী বলব?’

‘আহ্, এক্সাইটেড হচ্ছো কেন?’ রাতুল ব্যস্ত হল, ‘আস্তে।’

‘ইন্টারভ্যাল শেষ?’ সমীরণদা পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করল, ‘ঠিক আছে হানিমুন থাক, ঝগড়াই কর দু’জনে, আমি দেখি। তোদের বউদির সঙ্গে ভালো করে জীবনে ঝগড়াই করতে পারলাম না বলে আজ আমার এই হাল।’

বৈশাখী চুপ, কিন্তু রাতুল চুপ করে থাকতে পারল না, বলেই ফেলল, ‘বউদি সত্যিই তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে সমীরণদা?’

‘এখনও তোদের বিশ্বাস হচ্ছে না?’ সমীরণদা বিষণ্ণভাবে ঘাড় দোলাল, ‘শোন রাতুল, আমি মিথ্যেও বলছি না, একবর্ণ বাড়িয়েও বলছি না, এতবড়ো একটা পৃথিবীতে আমাকে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ানোর ব্ল্যাংকচেক দিয়ে তোদের বউদি সত্যি সত্যি চলে গেছে। কিন্তু মজাটা কী জানিস, ভদ্রমহিলা চলে যাওয়ার পর আমার বেড়ানোর ইচ্ছেটাই পার্মানেন্টলি চলে গেছে, তাই আজকাল ঘরেই বসে থাকি।’

সহানুভূতিতে মন ভরে উঠল বৈশাখীর। কী দেখতে এল তারা এখানে? কী শুনতে এল? বিচ্ছেদের তাপে মানুষটাই তো জ্বলেপুড়ে গিয়েছে, মাথার চুল পেকে গিয়েছে, উত্তপ্ত রৌদ্রকিরণে শিশিরবিন্দুর এখন শুধু উবে যাওয়ার পালা। বৈশাখীর গলাটা ব্যথা করে উঠল, ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করল, ‘কোত্থাও যান না?’

‘নাহ্। শুধু অফিস আর বাড়ি। ভালোই লাগে না কোথাও যেতে। ইচ্ছেটাই মরে গিয়েছে, বুঝলে?’ বলে একটু বিরতি, তারপর উৎসহভরা চোখে বৈশাখীদের দেখতে দেখতে সমীরণদা বলল, ‘তবে আজ তোমাদের দেখে আবার ইচ্ছেটা জেগে উঠেছে জানো? খুব ইচ্ছে করছে তোমাদের হানিমুনের টুরের গল্পটা শুনতে। বেশ গুছিয়ে বলো তো শুনি।’

‘আমি? না না ও বলবে।’ বৈশাখী চমকে উঠে রাতুলকে দেখাল।

‘আমি?’ রাতুল শিউরে উঠল।

‘হ্যাঁ বলো। বলবে বলেই তো এসেছিলে, এখন চুপ করে আছ কেন?’

রাতুল জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল, ‘থাক না সমীরণদা।’

‘থাকলে আমার চলবে কী করে রাতুল?’ সমীরণদা ছেলেমানুষের মতো হয়ে গেল, রীতিমতো বায়না জুড়ল, ‘বল না বাবা, বল না তোদের গল্প। কতকাল যে বেড়াইনি। খুব ইচ্ছে করছে শুনতে।’

রাতুল অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে ফেলল। কথা বলল না।

‘কী রে কী ভাবছিস? শুরু কর।’ অনেক দিন পরে ইচ্ছে জেগেছে সমীরণদার। গল্পের লোভে তার চোখদু’টো চকচক করছিল, রাতুলকে ঠেলা দিয়ে বলল, ‘চুপ করে থাকিস না প্লিজ। এতদিন তোদের গল্প শুনিয়েছি, তার একটা রিটার্ন দে অন্তত। কোথায় কোথায় ঘুরলি, উঁ?’

তবু মুখ ফুটল না রাতুলের, কাঠের মতো বসে রইল। লোকটা এত করে বলছে, কোনও মানে হয়? বৈশাখী আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারল না, বিরক্তিতে ফেটে পড়ল, ‘খুব তো সমীরণদা সমীরণদা করছিলে, বউদি বউদি করছিলে, এখন বলো, সমীরণদা জানতে চাইছে বলো, গুরুকে দক্ষিণা দাও। কী এনেছ বার করো?’

‘না না।’ রাতুল সিঁটিয়ে গেল একেবারে, চোরাই মাল লুকোনোর মতো করে তাড়াতাড়ি ব্যাগটা পিঠের দিকে ঠেলে দিল।

‘বুঝেছি, এ এখন বলবে না, শুনবে।’ আর রাতুলকে পীড়াপীড়ির দিকে গেল না সমীরণদা, ঘুরে গেল বৈশাখীর দিকে, চোখ ওপর নীচে করে বলল, ‘আমার কী করে এই অবস্থা হল জানার ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে ওর বুঝলে বৈশাখী? চিরকাল আমার মুখে গল্প শুনে এসেছে, হ্যাবিটটা যাবে কোথায় ব্যাটার?’

‘না না! ছি ছি!’ মুখখানা লাল হয়ে গেল রাতুলের।

‘আরে লজ্জা পাচ্ছিস কেন? সত্যি কথাটাই তো বলছি। ভাবছিস, কী এমন হল বউদি দাদাকে ছেড়ে চলেই গেল! আড়ালের আসল গল্পটা কী? বল ভাবছিস না?’

রাতুল আর্তনাদ করে উঠল, ‘না না!’

‘ভাবছিস। আমার চোখে তুই ধুলো দিবি রাতুল?’ সমীরণদা থামল, তার পর বড়ো করে শ্বাস নিয়ে গলার স্বর বদলে বলল, ‘গল্পটা বলতে পারলে ভালোই হতো বুঝলি? বুকটা একটু হালকা হতো। কিন্তু জানিসই তো, ছাদ ছাড়া আমার আবার গল্প ঠিক খোলে না। এই ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদটা বড্ড বড়ো, সব সময় লোকজনের ভিড়। ভেরি সরি রাতুল, এই গল্পটা তুই মিস করলি।’

বলতে বলতে সমীরণদা হা-হা করে হেসে উঠল।

অলিখিত প্রেম

দিন গুনছিলাম উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর। নিশ্চিত ছিলাম ভালো নম্বর নিয়ে পাস করব। ভালো কলেজে ভর্তির জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।মাঝেমাঝে গ্রামের বাড়ি থেকে ঠাকুমা আমাদের এখানে এয়ে থাকতেন৷ তখন আমার বাড়িতে সকলেই ঠাকুমার কথামতোই চলত। অন্য কারও ইচ্ছা-অনিচ্ছার পরোয়া খুব বেশি করা হতো না।

আমার কলেজ যাওয়া নিয়ে আলোচনা শুরু হতেই ঠাকুমা একদিন বাবাকে ডেকে বললেন,

-আর কত পড়াবি মেয়েকে? এর পর ভালো পাত্র পাওয়াই তো মুশকিল হয়ে যাবে। আর যদি পাওয়াও যায় মোটা পণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পারবি তো দিতে, ভেবে দেখিস।

-মা, তোমার নাতনি যখন পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে তখন পণ দেওয়ার কোনও দরকারই পড়বে না।

-মেয়েরা যতই পড়াশোনা করুক খোকা, আমাদের সমাজে পণ ছাড়া বিয়ে কখনও শুনিনি।

-তুমি চিন্তা কোরো না মা। তোমার নাতনি আরও পড়াশোনা করতে চায়। ওকে তুমি আশীর্বাদ করো ও যেন অনেক বড়ো হতে পারে। আর যদি স্কলারশিপ পেয়ে যায় তাহলে ওর পড়াশোনার পেছনেও আমাদের খরচ করতে হবে না।

-ঠিক আছে, তোদের যদি মনে হয় মুনমুনের বেশি পড়াশোনা করা উচিত, তাহলে পড়া। কিন্তু একটা কথা তোদের শুনতেই হবে, কলেজে ওকে শাড়ি পরে যেতে হবে। স্কুলের মতো স্কার্ট-ব্লাউজ বা

সালোয়ার-কামিজ পরে ওকে আমি কলেজ যেতে দেব না।

-ঠিক আছে ঠাম্মা, জিন্স, স্কার্ট এগুলো না হয় পরব না কিন্তু সালোয়ার কামিজ পরলে কী দোষ? ওটাতেও তো পুরো শরীর ঢাকা থাকে, মুনমুন ঠাম্মাকে বোঝাবার চেষ্টা করে।

-না, কলেজ যেতে হলে শাড়ি পরেই যেতে হবে।

আমার রেজাল্ট বেরোল। ভালো নম্বর থাকলেও একটুর জন্য স্কলারশিপটা মিস করলাম। ভালো কলেজেও ভর্তি হয়ে গেলাম ৷ তার কয়েকদিন পর ঠাকুমা গ্রামে ফিরে গেল৷ আমিও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরে হাঁফ ছাড়লাম৷

কলেজে পুরোদস্তুর ক্লাস শুরু হওয়ার পরেও আমার ইতিহাসের একটা বই দোকানে কিছুতেই পাওয়া গেল না। তার ফলে আমাকে এবং আমার সহপাঠীদেরও লাইব্রেরির ভরসায় থাকতে হচ্ছিল। বইয়ের জন্য লাইব্রেরিতে যখনই যেতাম, কেউ না কেউ বইটা নিয়ে পড়ছে দেখতাম কারণ আমাদের লাইব্রেরির বই বাড়িতে ইস্যু করা হতো না।

একদিন লাইব্রেরি গিয়ে দেখি যথারীতি একজন আমার আগেই বইটা নিয়ে গেছে। বিফল মনোরথ হয়ে চেয়ার নিয়ে বসতে যাব, দেখি বইটা আমার পাশের চেয়ারে বসা ছেলেটির ডেস্ক-এর উপর রাখা এবং ছেলেটির দৃষ্টি অন্য একটি বইয়ের পাতায় আটকে। আমি একটু সাহস জুগিয়ে ছেলেটির সামনে গিয়ে সরাসরি বললাম,

-এক্সকিউজ মি, আপনি কি ওই বইটা পড়ছেন? যদি এখন না পড়েন তাহলে আমাকে বইটা কিছুক্ষণের জন্য দিন প্লিজ। আমি কিছু নোটস নিয়ে আপনাকে ফেরত দিয়ে দেব।

বইটা আমার টেবিলে রাখতে রাখতেই ছেলেটি উত্তর দিল,

-শিওর, আপনি বইটা নিতে পারেন। হিস্ট্রি আমার সাবজেক্ট নয়। আমার এক বন্ধুর জন্য ওটা ইস্যু করিয়েছি। ও যতক্ষণ না আসছে আপনি বইটা রাখতে পারেন।

থ্যাংকস বলে বইটা নিয়ে নিজের চেয়ারে ফিরে আসি।

আধঘন্টা পরেই আর একটি ছেলে এসে পাশের ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করল,

-প্রসূন, আমার বইটা ইস্যু করিয়েছিস?

-পুলক, আয় বস,বই নিয়ে রেখেছি, পাশের ছেলেটি বলে ওঠে।

-তুই আসিসনি বলে ওনাকে বইটা দিয়েছি। উনি নোটস বানিয়ে কিছুক্ষণে ফেরত দিয়ে দেবেন। ইশারায় আমাকে দেখিয়ে দেয় প্রসূন নামের ছেলেটি।

আমি নোটস লেখা বন্ধ করে পুলক নামের ছেলেটির দিকে বইটা এগিয়ে দিতেই প্রসূন বলে উঠল, -আরে না না। আপনি নোটস লেখা শেষ করে নিন। কী বলিস পুলক?

আমি অস্বস্তি বোধ করতে থাকি। পাঁচ মিনিট পরেই আমি প্রসূনকে বইটা ফেরত দিয়ে দিই।

প্রসূন বলে,

-আপনি তো আমার সেকশনে পড়েন না? আপনার নাম জিজ্ঞাসা করতে পারি?

-আমার নাম মুনমুন।

আমি উঠে দাঁড়াই যাওয়ার জন্য, তখনই প্রসূন আবার বলে ওঠে,

-আমার মনে হয় আপনার নোটস নেওয়া এখনও শেষ হয়নি। আপনি এক কাজ করুন, আমাকে পেজ নম্বরটা বলে দিন। আমি আপনাকে ওই পাতাগুলো দিয়ে দিতে পারব।

আমি একটু বিরক্ত হই। রূঢ় ভাবেই জিজ্ঞাসা করি,

-আপনি কি বই থেকে পাতাগুলো ছিঁড়ে আমাকে দেবেন?

-আমাকে দেখে কি এরকম বাজে ছেলে বলে মনে হয়?

-না না, আমি ওভাবে বলতে চাইনি। সরি! কিন্তু আপনি আমাকে পাতাগুলো কীভাবে দেবেন?

-আপনি নিজের মোবাইল নম্বরটা আগে দিন। দেখবেন এক সেকেন্ডে কাজটা হয়ে গেছে।

ফোন নম্বর দিতে আমাকে ইতস্তত করতে দেখে পুলক বলে ছেলেটি এবার বলে,

-মুনমুন আমি বুঝতে পারছি, একটা অচেনা ছেলেকে কোনও মেয়ের ফোন নম্বর দিতে চাইবে না। কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন প্রসূন খুব ভালো ছেলে। ও পেজগুলোর ছবি মোবাইলে তুলে আপনার ফোনে বা মেইল-এ পাঠিয়ে দিতে পারবে। ক্লাসের অন্য মেয়েদেরকেও এই ভাবে ছবি তুলে পাঠিয়েছে। এতে ওর কোনও মতলব বা উদ্দেশ্য নেই।

আমি তত্ক্ষণাৎ নোটবুক থেকে পাতা ছিঁড়ে আমার নম্বর লিখে প্রসূনকে ধরিয়ে দিই। প্রসূন বলে,

-আপনি যদি বলেন প্রিন্ট আউট বার করেও দিতে পারব।

-না না, অত কষ্ট করতে হবে না। আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ করে দিলেই হবে, বলে মুনমুন লাইব্রেরি ছেড়ে বেরিয়ে আসে।

ওই দিনই একটু রাত করে হোয়াটস-অ্যাপে আমার দরকারের পেজগুলোর সব পেয়ে যাই প্রসূনের কাছ থেকে। ওকে একটা ধন্যবাদ জানিয়ে সঙ্গে সঙ্গে টেক্সট করে দিই। প্রসূনের উপর একটা আলগা ভালোলাগা মনের কোণায় উঁকি দিয়ে যায়।

এর পর বেশ কিছুদিন প্রসূন বা পুলক কারও সঙ্গে আমার দেখা হল না। আমাদের সেকশনও আলাদা ছিল। পুলকের স্কুটারেই প্রসূন কলেজ আসা-যাওয়া করত আর আমি যাতায়াত করতাম অটোতে।

সেদিন আমার ইতিহাসের পরীক্ষা ছিল কলেজে। সকাল থেকেই প্রচণ্ড বৃষ্টি। কোনওরকমে কলেজ পৌঁছোলাম রিকশা করে, অর্ধেক ভিজতে ভিজতে। প্রসূন সাহায্য করাতে পরীক্ষা খুবই ভালো হল। কলেজের গেটে যখন পৌঁছোলাম তখনও বৃষ্টি ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে। রিকশা স্ট্যান্ডে একটাও রিকশা নেই, হয়তো বৃষ্টির জন্য।

ধীরে ধীরে বড়ো রাস্তার দিকে এগোলাম, যদি একটা রিকশা পাওয়া যায় এই ভাবতে ভাবতে। বড়ো রাস্তাতেও জল চারদিক থইথই করছে। শাড়িটা বাঁচাতে পায়ের থেকে একটু উপরে তুলে নিয়েছিলাম। হঠাৎ-ই মনে হল আমার পিছনে পিছনে কেউ আসছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে ইচ্ছে করল না। পাশ দিয়ে মোটারবাইকে দুটি ছেলে যেতে যেতে আমার দিকে ক’টা নোংরা উক্তি ছুড়ে দিয়ে স্পিডে বেরিয়ে গেল। ঘাবড়ে গিয়ে শাড়িটা ছেড়ে দিলাম। ওই অসতর্ক মুহূর্তে কোনও ভাবে শাড়িটা পায়ে জড়িয়ে রাস্তায় পড়তে যাব পেছন থেকে সবল দুটো বাহু আমাকে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে দিল। তাকিয়ে দেখলাম প্রসূন।

আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

-আপনি আজ হেঁটে কোথায় যাচ্ছেন? আপনার বন্ধু পুলক আজ আসেনি?

-না আজ ও আমার সঙ্গে আসেনি।

আমি প্রসূনকে ইতিহাসে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ জানালাম। ও আমার সঙ্গে বড়ো রাস্তা অবধি এল। ওখানেই একটা রিকশা পেয়ে গেলাম। প্রসূনও বাড়ির রাস্তা ধরল যদিও তখনও পর্যন্ত আমি প্রসূন কোথায় থাকে জানার আগ্রহ বা চেষ্টা কিছুই প্রকাশ করিনি।

একদিন কলেজে প্রসূনের সঙ্গে লাইব্রেরিতে দেখা হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম,

– কেমন আছেন?

-খুব একটা ভালো নেই। তুমি কেমন আছ? সরি আপনি কেমন আছেন? একটু বিব্রত লাগল প্রসূনকে।

ওকে আশ্বস্ত করার জন্য বললাম,

– ইটস পারফেক্টলি ওকে। আপনি আমাকে তুমি বলতে পারেন।

-তাহলে তোমাকেও তুমি বলতে হবে যখন আমার সঙ্গে কথা বলবে। বন্ধুত্ব রাখতে গেলে আপনি বলা চলবে না। কি রাজি? প্রসূনের কথা শুনে আমি হেসে ফেলি।

প্রসূনকে যত দেখতাম ততই ওকে ভালো লাগত। অদ্ভুত ছেলে। ওকে কোনওদিন উদাস হয়ে চুপচাপ বসে থাকতে দেখিনি। সবসময় বন্ধুবান্ধব, হাসি-ঠাট্টায় মেতে থাকত। মুহূর্তের মধ্যে অপরিচিত কাউকেও আপন করে নিতে পারত। সকলের মুখে ওর প্রশংসাই শুনতাম। কলেজের ছেলেমেয়েরাও ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করার জন্য নিজেরাই এগিয়ে এসে কথা বলত। ওর প্রতি ওর বন্ধুদের শ্রদ্ধা সম্মান ভালোবাসা আমার মনেও প্রভাব ফেলতে শুরু করল। ওর প্রতি একটা অলিখিত ভালোবাসার আকর্ষণ ধীরে ধীরে আমার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে লাগল।

আমাদের মেলামেশার গণ্ডি লাইব্রেরি ছাড়িয়ে ক্যান্টিন, ক্যান্টিনের সীমা অতিক্রম করে সিনেমা হল পর্যন্ত পৌঁছোলেও সবসময় তৃতীয় কেউ সঙ্গে থাকতই। কখনও পুলক, কখনও অন্য কোনও ছেলে বা কখনও কখনও কলেজের অন্য মেয়েরাও।

প্রোপোজ করা তো অনেক দূরের ব্যাপার, ভালোবাসার একটা শব্দ প্রসূনের মুখ থেকে শোনার জন্য আমি ভিতরে ভিতরে ছটফট করে মরতাম। অন্য মেয়েদের সঙ্গে ওকে একলা কথা বলতে দেখেও ঈর্ষায় পুড়ে যেতাম। দু-তিনদিন একসঙ্গে কলেজ ছুটি থাকলে কাউকে কিছু না বলে কোথায় উধাও হয়ে যেত প্রসূন। কলেজের কেউ ওর সন্ধান দিতে পারত না।

 

সময় কারও জন্যই থেমে থাকে না। আমি গ্র্যাজুয়েশন পাস করে যাই। প্রসূনও পিসিএস কমপ্লিট করতে সফল হয়। এই আনন্দে হোটেলে আমাদের ট্রিট দেয় প্রসূন। আমি, পুলক আর প্রসূন। আমরা কেউ-ই ড্রিংক করতাম না তাই স্ন্যাকস নিয়ে সময় কাটাচ্ছিলাম। স্টেজে একটা অর্কেস্ট্রার দল হিন্দি ছবির গানের সঙ্গে সুরের মূর্ছনা তুলে একটা রোমান্টিক পরিবেশ তৈরি করে তুলেছিল- ফলে নিজেকে আমার খুব হালকা বোধ হচ্ছিল।

প্রসূনের সঙ্গে যা আমি কোনওদিন করিনি, সেটাই হঠাৎ করে বসলাম। আমার অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করে জিজ্ঞেস করে বসলাম,

-আচ্ছা প্রসূন, তুমি কাউকে ভালোবাসো? কে তোমার সেই ভালোবাসার পাত্রী?

হঠাৎ-ই গম্ভীর হয়ে উঠল প্রসূন। বলল,

-আমার কথা ছাড়ো, তুমি কবে বিয়ে করছ বলো? বিয়েতে আমাকে ডাকতে ভুলো না কিন্তু।

প্রসূনের উত্তর শুনে আমি একটু দমে গেলাম। আমার মন বলছিল ভালো চাকরি পেয়ে প্রসূন নিশ্চই আমার সঙ্গে নতুন সংসার পাতার কথা ভাবছে।

সেদিনের দেখাই আমাদের শেষ দেখা। এরপর আর ওর সঙ্গে কোনও কথা হয়নি। অন্য বন্ধুদের কাছে শুনলাম রাজ্য সরকারের অধীনে প্রসূন বড়ো চাকরি করছে। অন্য কোনও শহরে ওর পোস্টিং। আমার মা-বাবাও আমার জন্য পাত্রর খোঁজ চালাচ্ছিলেন। পুলক একই শহরে থাকাতে মাঝেমধ্যে ওর সঙ্গে দেখা হতো।

একদিন একসঙ্গে কফি খেতে খেতে পুলককে প্রসূনের কথা জিজ্ঞেস করলাম। পুলক বলল,

– মুনমুন তুমি প্রসূনকে দেখে মনে করো যে ও খুব আনন্দে রয়েছে। শুধু তুমি কেন সকলেই তাই মনে করে ওর মুখের হাসি দেখে। কিন্তু আসলে ও খুব চাপা স্বভাবের ছেলে। নিজের কষ্ট ও কারও সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে না। আমি ওর এত বন্ধু, আমাকেও ওর নিজের সম্পর্কে কিছুই কখনও বলেনি। কিন্তু হঠাৎ-ই কয়েকদিন আগে আমি ওর সম্পর্কে সবকিছু জানতে পারি।

-কেন এমন কী কথা যা প্রসূন কাউকে বলতে পারেনি, উদগ্রীব হয়ে উঠি আমি।

একটু চুপ করে থাকল পুলক, তারপরেই বলতে লাগল,

-কয়েকদিন আগে প্রসূন ওর গ্রামে হঠাৎই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল। আমি যেদিন ওর গ্রামে গিয়ে পৌঁছোই, দেখি একটা জরুরি কাজের জন্য ওকে শহরে চলে যেতে হয়েছে। ওর বাড়িতে তখন শুধু ওর বৃদ্ধা মা আর পাঁচ বছরের মেয়ে ছিল।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি,

-মেয়ে!

-হ্যাঁ

-প্রসূনের মেয়ে ওর মায়ের কাছেই থাকে৷ শুনলাম ক্লাস টুয়েলভ-এ পড়তেই প্রসূনের বিয়ে হয়ে যায়। বাবার মৃত্যুর পর মায়ের শরীরও ভেঙে পড়ে। মায়ের দেখাশোনার জন্য ভরসা করতে পারবে এমন কেউই বাড়িতে ছিল না। গ্রামের সকলের পরামর্শে ওর মা ওই বয়সেই প্রসূনের বিয়ে দিয়ে দেন। দুবছর পর মেয়ের জন্ম। সবই ঠিকঠাক ছিল, হঠাৎই কাউকে কিছু না বলে প্রসূনের বউ সব ছেড়ে এমনকী কোলের শিশুটিকে পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে কোথায় চলে যায়।

-কিন্তু কেন? আমি আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করি।

একটু থেমে পুলক আবার বলা শুরু করে,

-প্রসূনের মা বললেন, মেয়েটির নাকি গ্রামে থাকা একেবারে অপছন্দের ছিল। শহরে থাকতে চাইত। প্রসূন বলেছিল, শহরে যতদিন না ওর চাকরি হচ্ছে ততদিন ওকে গ্রামেই থাকতে হবে। কিন্তু প্রসূনের কথা মেনে নিতে মেয়েটি মোটেই রাজি ছিল না। তাই মেয়েকেও ছেড়ে দিয়ে ও চলে যায়। মেয়েটি নাকি আবার বিয়ে করে ফেলেছে। কয়েকদিন পর প্রসূন, মা আর মেয়েকে শহরে নিজের কাছে নিয়ে চলে যাবে।

আমি চুপ করে রইলাম। মনে মনে খালি বলছিলাম, এত বড়ো একটা ঘটনা প্রসূন কী করে চেপে রাখতে পারল!

 

সময়টা বর্ষাকাল। পুলকের সঙ্গে আবার পাঁচ-ছদিন কথা হয়নি। তিনদিন ধরে ক্রমাগত অঝোরে বৃষ্টি পড়ে চলেছে। খবরে জানতে পারলাম রাজ্যের অবস্থা ভযংকর। বন্যার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। জল ক্রমাগত বাড়তে থাকার কারণে বাঁধের লকগেট খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ফলে বহু গ্রাম জলের তলায় চলে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

পুলকের ফোন এল। জানাল, প্রসূনদের গ্রাম জলে ডুবে গেছে। উদ্ধারকারীরা প্রসূনের মা-কে বাঁচাতে পারেনি কিন্তু মেয়েকে উদ্ধার করে বন্যাত্রাণ শিবিরে নিয়ে আসা হয়েছে কিন্তু ও খুবই অসুস্থ। পুলক কিছুক্ষণ পরেই ওই শিবিরের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে।

আমি কোনও কিছু চিন্তা না করেই বলে ফেললাম,

– পুলক আমিও তোমার সঙ্গে যাব।

ও একটু ইতস্তত করে বলল,

– কিন্তু ওখানে তো তোমার খুব কষ্ট হবে।

-না, কোনও কষ্ট হবে না। তুমি আমাকে নিয়ে যেতে না চাইলে পরিষ্কার বলে দাও। আমি একাই চলে যেতে পারব।

-ঠিক আছে, তৈরি থেকো আমি আসছি।

বাড়িতে বন্ধুর মেয়ের অসুস্থতার খবর জানিয়ে বাবাকে রাজি করালাম পুলকের সঙ্গে আমাকে যেতে দিতে। পুলকের সঙ্গে প্রসূনের গ্রামে পৌঁছোলাম। দুদিনের আগে প্রসূন কিছুতেই এসে পৌঁছোতে পারবে না কারণ বন্যার জন্য শহরের থেকে গাড়ি সব বন্ধ আর তাছাড়াও দায়িত্ব অন্য কাউকে না সঁপে অফিস থেকে বেরোনো মুশকিল। পুলক ওকে জানিয়ে দিয়েছিল আমরা দুজন ওর মেয়ের কাছে যাচ্ছি।

ত্রাণশিবিরে প্রথমবার প্রসূনের মেয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। নাম জিজ্ঞেস করাতে ছোট্ট উত্তর পেলাম, মিনি। মিনি কলেরায় ভুগছিল। কোলে তুলে আদর করতেই আমার গলাটা জড়িয়ে ধরল। চোখদুটো যেন কীসের আশায় চকচক করে উঠল। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-তুমি কি আমার মা?

আমি চোখের জল শাড়ির আঁচলে মুছে মিনিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম,

– আমি তোমার মা নই, মায়ের মতো।

পুলক মোবাইলে আমাদের কয়েকটা ছবি তুলল। শিবিরের ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে আমরা প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং পথ্যের ব্যবস্থা করলাম। একদিনেই মিনি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠল। দুদিন পর প্রসূনও এসে পেঁছোল। তবে ও জেনে গিয়েছিল পুলক আর আমার তত্ত্বাবধানে মিনি আগের থেকে অনেক ভালো আছে।

প্রসূনকে দেখেই মিনি দৌড়ে গিয়ে বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রসূনকে দেখে মনে হচ্ছিল মেয়েকে আর কোনওদিন ও নিজের থেকে আলাদা হতে দেবে না। মিনিও বাবাকে গায়ের সব শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরল, রুদ্ধ গলায় বলল,

– এত দেরি করে কেন এলে বাবা। আমি যদি ভগবানের কাছে চলে যেতাম?

দুচোখে জল নিয়ে প্রসূন মিনির মুখ চেপে ধরল,

– মিনি এরকম বলে না,মা রে তোকে ছাড়া তোর বাবাও যে বাঁচত না। শুধু তোকে দেখার জন্যই পুলককাকু আর মুনমুন মাসি এতদূর ছুটে এসেছে।

আমরা চারজন তিনদিন ওখানে কাটালাম। এর মধ্যে জলও নেমে গেল, পরিস্থিতি আগের থেকে বেশ কিছুটা শুধরোল। পুলক বলল,

-এখন মিনির শরীর অনেকটা ভালো, আমাকে এবার ফিরতে হবে।

আমিও কপট রাগ দেখিয়ে পুলককে বললাম,

-আচ্ছা স্বার্থপর মানুষ। আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ, এখন আমাকে ফেলে দিয়ে পালাবার ধান্দা আঁটছ?

-মুনমুন, আমি তোমাকে এখানে আসতে বলিনি। তুমি নিজের ইচ্ছেতে এখানে এসেছ।

-ঠিক আছে তুমি চলে যাও। আমি একাই ফিরতে পারব।

-আরে রেগে যাচ্ছ কেন? আমি ভাবলাম তুমি আরও কটা দিন এখানে কাটিয়ে যেতে ইচ্ছুক হয়তো? পুলক জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল আমার দিকে।

আমি একবার প্রসূনের দিকে তাকালাম। ও মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। হঠাৎই চোখ তুলে আমার দিকে চাইল। চোখের ভাষায় এমন কিছু ছিল না যার জন্য আমি আরও কটাদিন গ্রামে থেকে যেতে পারি। নিজের উপরেই রাগ হল। শুধু শুধু কীসের আশা করে আমি বারবার ঠকে যাই, নিজেই বুঝে উঠতে পারি না। হতাশা গ্রাস করল আমাকে। গলায় জোর দিয়ে বললাম,

– না এখন আর এখানে আমার কী কাজ? আমি তোমার সঙ্গেই ফিরে যাব।

 

পুলকের সঙ্গে আমি ফিরে এলাম। পুলকের মুখেই শুনলাম, গ্রামের জমি বাড়ি সব বিক্রি করে পাকাপাকি ভাবে প্রসূন মেয়েকে নিয়ে শহরে চলে গেছে।

একদিন হঠাৎ প্রসূনের কাছ থেকে একটা ভিডিও ক্লিপিং এবং মেসেজ পেলাম ফোনে। ভিডিও ক্লিপিং-টা পুলক নিজের মোবাইলে তুলেছিল যখন গ্রামে মিনিকে দেখতে গিয়েছিলাম, আর ওকে বোঝাচ্ছিলাম আমি ওর মায়ের মতো। মেসেজটাতে লেখা ছিল,

– মিনি তোমাকে খুব মনে করে। মায়ের মতো থেকে ওর মা হয়ে উঠতে পারবে না? আমি তোমার উত্তরের অপেক্ষায় থাকলাম। তোমার বাড়িতেও আমি কথা বলে রেখেছি, আশা করি তুমি আমাকে নিরাশ করবে না।

এতদিন ধরে প্রসূনের মুখ থেকে আমি এটাই শোনার জন্য ব্যাকুল ছিলাম। ধীরে ধীরে সত্যি নিরাশ হয়ে পড়ছিলাম। হঠাৎ আশার একটা আলো দেখতে পেলাম। এই কথাটা বলার জন্যেও প্রসূন মিনির সাহায্য কেন নিল? নিজেও তো বলতে পারত? আমার খালি এটাই মনে হচ্ছিল কিন্তু তাও ভিতরে ভিতরে আমি খুব সুখ অনুভব করছিলাম। যেভাবেই হোক না কেন, প্রস্তাবটা প্রসূনের কাছ থেকেই এসেছে।

আমি এক মুহূর্ত দ্বিধা করলাম না, সঙ্গে সঙ্গে টেক্সট করলাম।

– এই দিনটার জন্য আমি কবে থেকে অপেক্ষা করে আছি।

লিভ-ইন রিলেশন

ঘন্টা তিনেক পর কনফারেন্স রুম থেকে মিটিং শেষ করে বের হয় আদিত্য। মোবাইলটা হাতে নিয়েই ঘাবড়ে যায়। মায়ের মোবাইল থেকে এগারোটা মিসড্ কল। তড়িঘড়ি ফোন করে। অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে আসে পরমা-র কণ্ঠস্বর। পরমা আদিত্যর ছোটোপিসি। ‘আদিত্য, ছোটোপিসি বলছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আয়। তোর মায়ের অবস্থা একেবারেই ভালো না।’ মায়ের ফোনে পিসির গলা শুনেই বুঝতে পেরেছিল আদিত্য, কিছু একটা হয়েছে। তার আশঙ্কাই ঠিক হল।

‘কী  বলছ পিসি! কী এমন হল? সব তো ঠিকই ছিল?’

‘সকালে সবে ঠাকুরঘরে ঢুকেছি, ঠিক সেই সময়তেই কাজলের ফোন.. পিসিমা তাড়াতাড়ি চলে আসুন, জেঠিমা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে। আমরা পৌঁছোনোর আগেই ক্লাব থেকে কয়েকজন ছেলে মিলে গ্রিনল্যান্ড নার্সিংহোমে ভর্তি করেছে।’

একটু শ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করে পরমা। ‘দিনকয়েক সময় নিয়ে আসিস। কখন যে কী হয়।’ বলতে বলতে আবার থেমে যায় পরমা।

‘ঠিক আছে। জানি বলতে হবে না, তবু আমি না যাওয়া অবধি মায়ের একটু খেয়াল রেখো। আর টাকাপয়সার জন্য যেন কোনওরকম ভাবে চিকিৎসা না আটকে থাকে সেটা একটু দেখে নিও। আমি গিয়ে সমস্ত ক্লিয়ার করে দেব। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসার চেষ্টা করছি।’ বলে ফোনটা কেটে দেয় আদিত্য। আর একটা ১০ ডিজিটের নাম্বার প্রেস করে ফোনটা কানে দেয় আদিত্য। ‘শ্রী, অ্যাজ আরলি অ্যাজ পসিবল আমার নামে একটা কলকাতার ফ্লাইটের টিকিট বুক করে আমাকে মেসেজ করে দাও। আমি ছুটির জন্য বসের সাথে কথা বলতে যাচ্ছি।’

‘আরে হঠাৎ কী হল সেটা তো বলবে।’ চিন্তিত শোনায় শ্রীয়ের স্বর।

‘মায়ের অবস্থা খুব খারাপ। ডাক্তার-রা প্রেডিক্ট করছেন, ইট্স অ্যা ব্রেন হেমারেজ।’ বলতে বলতেই চোখে জল চলে আসে আদিত্যর। কোনওমতে নিজেকে সামলে নেয়। ‘শ্রী প্লিজ, পরে সব বলব। তুমি টিকিট-টা কেটে আমাকে একটা কল করে দিও।’ আদিত্যর কষ্টটা ফিল করতে পারে শ্রী। মনে মনে ভাবে এ-অবস্থায় আদিকে কিছুতেই একা ছাড়া যাবে না। তার মা যে তার মনের কতটা জায়গা জুড়ে রয়েছে সেটা শ্রী ভালোমতোই জানে। আদিত্যকে সে ভালোমতো জানে ও বোঝে। আর কারও কাছে নিজেকে ধরা না দিলেও শ্রী-কে ফাঁকি দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। শ্রী-য়ের কাছে ধরা তাকে পড়তেই হবে। ভালোবাসার বন্ধনটা বোধকরি এমনই হয়। জেদ ধরে বসে, ‘আমিও সঙ্গে যাব।’ ফোনটা কেটে দিতেই যাচ্ছিল আদিত্য। শ্রীয়ের কথা শুনে থমকে গেল।

‘সব কিছু জেনেও তুমি একথা বলছ? ভুলে গেছ সবকিছু? তুমি জানো না, মা আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে কতটা আপসেট? যদি তোমাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে ওঠে, সেটাও তো মায়ের শরীরের জন্য ঠিক নয়, না। তাছাড়া আমি চাই না তোমাকে কেউ ঘৃণার চোখে দেখুক।’

আদিত্যর মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নেয় শ্রী। ‘কী যাতা বলছ বলো তো? উনি পছন্দ করেন না বলে কি এই বিপদের সময়তেও আমি ওনার কাছে থাকতে পারি না? তাছাড়া এখন এসব ভাববার সময় নয় আদি।’

‘ভেবে দ্যাখো কী করবে।’

‘ভাবার কিছু নেই। আমি যাচ্ছি এটা ফাইনাল।’

‘ঠিক আছে তাহলে তোমার যা নেওয়ার নিয়ে নিও। আমারও কয়েকটা জামাকাপড় প্যাক করে নিও। থ্যাংকস্ শ্রী, তুমি সাথে থাকলে একটু মনের জোর পাব।’

বসের সাথে কথা বলার পর সোজা এয়ারপোর্ট-এর উদ্দেশ্যে রওনা দেয় আদিত্য। পূর্বনির্ধারিত সময় মতো শ্রী-ও লাগেজ নিয়ে পৌঁছে যায় এয়ারপোর্টে। পথে যাবতীয় ফোনাফুনি সেরে নেয় আদিত্য। দিদি অন্বেষাকে মায়ের অসুস্থতার কথা জানানো থেকে শুরু করে ঘন্টায় ঘন্টায় পিসির থেকে মায়ের শরীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেওয়া চলতে থাকে।

ট্যাক্সি থেকে নেমেই শ্রী-কে দেখতে পায় আদিত্য। এয়ারপোর্টের বাইরে একটা কোণে লাগেজ হাতে দাঁড়িয়ে ছিল সে। শ্রী-কে দেখে তার দিকে এগিয়ে যায় আদিত্য। লাগেজটা নিয়ে নেয় শ্রী-র থেকে। আদিত্যর চোখেমুখে তখন বিষণ্ণতার স্পষ্ট ছাপ। চোখটা টকটকে লাল। আদি কাঁদলেই ওর চোখ-মুখের অবস্থা ঠিক এমনটাই হয় সেটা জানে শ্রী।

সান্ত্বনা দিতে ওর হাতটা চেপে ধরে বলে, ‘চিন্তা করছ কেন, আন্টি ঠিক হয়ে যাবে। এত ভেঙে পোড়ো না।’

একটু মনোবল সঞ্চয় করতে শ্রীয়ের হাতটা চেপে ধরে আদিত্য। ‘চলো চলো ঘন্টা দেড়েক পরেই ফ্লাইট। চেক-ইন করতে হবে তো।’

শ্রীয়ের সঙ্গে সম্মতি প্রকাশ করে দুজনেই ঢুকে পড়ে এয়ারপোর্টের ভেতরে। সমস্ত ফর্মালিটির পর পাশাপাশি সিটে বসে দুজনে। আদিত্য-র হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে রাখে শ্রী। আদিত্য চোখ বুঝে ফেলে। মুহূর্তেই পুরোনো স্মৃতিগুলো চোখের সামনে এসে ভিড় করে। মা অসুস্থ এটা যেন সে ভাবতেই পারে না। মা-কে তো কোনওদিন এভাবে দেখেনি সে। বরং মায়ের দৃঢ়চেতা স্বভাবই দেখে এসেছে সে। যেমন ভালোবাসা, মমত্ব উজাড় করে দিয়েছে, তেমনি প্রয়োজনে পিঠে বেত কষাতেও বাকি রাখেনি। চিরকাল মাকে এভাবেই দেখে এসেছে সে। শত বাধা-বিপত্তিতেও মায়ের চোখে জল দেখেনি। শুধু একবার বাবার মৃত্যুর সময় মাকে ভেঙে পড়তে দেখেছে সে। ব্যস সেই দিনকতক। তারপর আরও নানা স্মৃতি আনাগোনা করতে থাকে।

আদিত্য আর শ্রী লিভ-ইন করছে প্রায় বছর তিনেক। এর মাঝে বার-চারেক শ্রী-কে নিয়ে কলকাতাতে মায়ের কাছে ঘুরিয়ে নিয়ে গেছে আদিত্য। বার বার উনি ছেলেকে বুঝিয়েছেন শ্রী-কে বিয়ে করে নেওয়ার জন্য।

‘একসাথে যখন থাকছ। সংসার করছ, তাহলে বিয়ে করতে অসুবিধেটা কোথায়? কীসের ভয় তোমাদের? বাঁধা পড়ার?’ প্রত্যেক বার এই নিয়ে মায়ের সাথে বচসা বেধে যেত আদিত্যর। এবার সেটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায়। অশান্তি এমন জায়গায় পৌঁছে যায় যে, আদিত্য মুম্বই ফিরে যাবার সময় মাকে বলে যায়, এরকম করলে মায়ের সাথে সম্পর্ক রাখা নাকি তার পক্ষে মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। তার লাইফ, সে কীভাবে লিড করবে এটা একান্ত ভাবেই তার সিদ্ধান্ত। তারপর মাস ঘুরতে না ঘুরতেই এই ঘটনা ঘটে গেল। কোথাও গিয়ে তার মনে হয়েছে, মায়ের অসুস্থতার জন্য সে-ই দায়ী। অপরাধবোধ কাজ করতে থাকে তার মধ্যে। ঘন্টা তিনেকের পথ এভাবেই কেটে যায়। ফ্লাইট ল্যান্ড করার পর ট্যাক্সি নিয়ে সোজা পৌঁছে যায়

নার্সিংহোমে। রাত তখন এগারোটা। নার্সিংহোমে ঢুকেই চোখে পড়ে বেঞ্চের এককোণে মাথাটা হেলিয়ে দিয়ে বসে আছে ছোটো পিসি। আর পিসেমশাই পায়চারি করে চলেছে। তাদের দিকে এগিয়ে যায় আদিত্য। সঙ্গে শ্রী-ও এগিয়ে আসে।

‘মা,  এখন কেমন আছেন পিসেমশাই?’

‘ব্লাডপ্রেশার বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্রেন হেমারেজ হয়েছে। ৭২ ঘন্টার আগে কিছু বলা যাবে না। ডাক্তাররা তো এমনটাই বলছেন।’

আইসিইউ-তে ঢোকার পারমিশন না মেলায় দরজার কাচ দিয়েই মায়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে আদিত্য। মায়ের মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো, হাতে কতগুলো চ্যানেল করা, একটা মেশিনে কী-সব আকিঁবুঁকি রেখা ছুটে চলেছে, অথচ সাদা বিছানায় মা অচেতন হয়ে পড়ে রয়েছে। সহ্য করতে পারে না সে। পরমাকে জড়িয়ে বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।

‘ছোটোপিসি,  মা ঠিক হয়ে যাবে তো, বলো না?’

‘নিজেকে শক্ত কর আদি।’

পাশ থেকে পিসেমশাই বলে ওঠেন, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে। সারাদিন অনেক ধকল গেছে তোমাদের, যাও বাড়িতে গিয়ে একটু বিশ্রাম নাও। তোমাদের দেখেই মনে হচ্ছে তোমরা দুটিতে সারাদিন কিচ্ছুটি খাওনি। যাও যাও। আর দেরি কোরো না, সঙ্গে পিসিকেও নিয়ে যাও। সারাদিন ওইভাবেই বসে আছে, আর টেনশন করছে। ওকেও কিছু খাইয়ে দিও।’ বলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রীয়ের মাথায় স্নেহের হাত রাখেন, ‘যাও মা যাও, তুমিও যাও।’

আদিত্যর পিসেমশাই বরাবরই একটু দাপুটে স্বভাবের। ওনার কাছে কোনওকিছুই ধোপে টেকে না। আদিত্য নার্সিংহোমে থাকার জন্য  জেদ ধরেছিল ঠিকই, কিন্তু পিসেমশাইয়ের কাছে হার মানতে বাধ্য হল।

‘যা বলছি তাই শোনো। এমনিতেই আজ আর কাউকে বউদির কাছে যেতে দেবে না। যদি কিছু লাগেও তার জন্য তো আমি

রইলাম-ই। বরং কাল সকাল থেকে মায়ের কাছে থেকো। ডাক্তারের সাথেও কথা বলে নিও।’

‘কিন্তু..’ নার্সিংহোমে থাকার জন্য পিসেমশাইকে বোঝানোর চেষ্টা করে আদিত্য।

‘আর কোনও কিন্তু নেই। যাও, কাল সকাল সকালই চলে এসো।’

ইচ্ছে না থাকলেও একপ্রকার বাধ্য হয়েই বেরিয়ে যেতে হল তিনজনকে। নার্সিংহোম থেকে বাড়ির দূরত্ব খুব বেশি হলে মিনিট দশেকের। ট্যাক্সিতে মিনিট কয়েকের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে যায় তারা। দরজা খুলেই সোজা মায়ের ঘরে ঢুকে যায় আদিত্য। ঘরের আলমারি, বিছানা, আলনা, সব জায়গাতেই মায়ের পরশ অনুভব করে সে। একটু করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে। হঠাৎই চোখ আটকে যায় দেয়ালে টাঙানো মায়ের ফোটোফ্রেমটার দিকে। যেটা সে একদিন নিজে হাতে রঙ-তুলির টানে সৃষ্টি করেছিল। আর ছেলের আঁকা বলে তার মা সেটা সযত্নে বাঁধিয়ে দেয়ালে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। ছবিটা আদ্যোপান্ত ধুলোয় ঢেকে গেছে। ঠিক করে মায়ের মুখটা দেখা যাচ্ছে না। একটা চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে সেটাকেই নামানের চেষ্টা করতে থাকে আদিত্য। দেয়ালে পেরেকের সঙ্গে ফ্রেমের পিছন দিকে আটকানো তারটা এমনভাবে জড়িয়ে বাঁধা রয়েছে যে, সহজে নামিয়ে আনতে পারে না সে। খুলে আনার জন্য টান দিতে থাকে।

খাবার জন্য ডাকতে আসা ছোটোপিসির চোখ এড়ায় না পুরো ঘটনাটা। আপনা-আপনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরমা।

‘ওটা  কী করছিস আদিত্য?’

‘এই যে মায়ের ছবিটা পিসি। একেবারে ধুলো পড়ে গেছে।’

একটা বাঁকা হাসি হাসে পরমা। ‘এরকমই বোধহয় হয় রে আদি, লোক দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝে না। পড়ে গেলে তবেই বোঝে।’

পিসির খোঁচাটা বুঝতে পেরে বিরক্ত লাগে আদিত্যর।

‘কী যা-তা বলছ পিসি।’ মুহূর্তেই চোখ লাল হয়ে যায় তার।

‘খুব  কি কিছু ভুল বলছি? কী পেয়েছে বল তো মানুষটা? আজ তোদের জন্যই তো বৃন্দা বউদির এই হাল। এর জন্য তোরাই দায়ী।’ মাথা নীচু করে শুনতে থাকে আদিত্য।ঠোঁটে রা কাড়ে না সে।

পরমা তার মতো করে বলে চলে, ‘নিজের দাদা বলে বলছি না, তিনি তো সমস্ত দায়ভার তোমার মায়ের কাঁধের উপর দিয়ে পালিয়ে বেঁচেছেন। খুব যে কিছু রেখে গেছেন তাও তো বলতে পারব না। তৎসত্বেও তো তোমাদের কোনও অভাব রাখেনি তোমার মা। এক এক করে সব গয়না খুইয়েছে তোমাদের পড়াশোনার জন্য। এমনকী তোমার দিদিকে সিম্বায়োসিসে ল’ পড়ানোর জন্য বাড়িটা পর্যন্ত বন্ধক দিয়েছে। বদলে তোমরা কী করেছ, শুধু মায়ের মুখে চুনকালি মাখিয়েছ। তোমার দিদি পড়াশোনা চলাকালীন তার থেকে বাইশ বছরের বড়ো একটা মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করে বসল। আর এখন তুমি  লিভ ইন করে ওর মুখে কালি লেপছ।  একসাথে থাকবে অথচ বিয়ে করতেই যত ওজর-আপত্তি। আর কত সইবে সে। ওর কি মান-সম্মান বলে কিছু নেই? ঠিকই আছে, বউদির মরে যাওয়াই ভালো।’

কথাগুলো শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ে আদিত্য। পিসির হাত দুটো চেপে ধরে বলে ‘প্লিজ ছোটোপিসি, এভাবে বোলো না।’

‘কেন বলব না, বলতে  পারো। সমাজে মুখ দেখানোর বাকিটা কী রেখেছ তোমরা। লজ্জায় মানুষটা একেবারে একঘরে করে ফেলেছিল নিজেকে। সে-সব যাবে কোথায়? কাঁহাতক একটা মানুষ একলা থাকতে পারে, নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে? চোখ বুজলে যদি একটু শান্তি পায়।’

পিসির গলার আওয়াজ পেয়ে এক-পা এক-পা করে আদিত্যর মায়ের ঘরের সামনে এসে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে শ্রী। পিসি-ভাইপোর মাঝে কথা বলার দুঃসাহস সে দেখায় না। সেই শিক্ষাও তার নেই। তাকে একঝলক আপাদমস্তক দেখে নেয় পরমা। তারপরে আবার বলতে শুরু করে ‘বৃন্দা তো তোদের খুশিতেই খুশি থাকতে চেয়েছিল। ও চেয়েছিল তোদের চারহাত এক করে দিতে। কিন্তু তোদের মাথায় কী ওই লিভ-ইনের ভূত চেপে বসে রয়েছে। শিক্ষিত হয়েছিস, ভালো চাকরি করছিস, এখন আর মায়ের কথা শুনবি কেন? এখন যেভাবে খুশি থাক, আর কেউ বলতে আসবে না। এটা মনে রাখিস আমাদের সমাজ এখনও এতটা উদার মানসিকতার হয়নি যে, এটাকে ভালো ভাবে নেবে। কর, যা মন চায় কর।’ আদিত্য তখন পিসির হাত দুটো ধরে একেবারে মাটিতে বসে পড়েছে। চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে।

‘আমার ভুল হয়ে গেছে পিসি, মা যে এভাবে নেবে আমি বুঝতে পারিনি। শুধু ভগবান আমার মাকে সুস্থ করে দিক, মা যা বলবে আমি তাই করব। শুধু একটা সুযোগ।’

আশ মিটিয়ে বলার পর খানিকটা নরম হয় পরমা। ভাইপোর হাতটা ধরে বলে, ‘আরে ওঠ ওঠ। চল রাগের মাথায় কত কী-ই না শোনালাম তোকে। আসলে কী জানিস তো, সেই তোর মায়ের বিয়ে হয়ে আসা থেকে আমাদের বন্ধুত্ব। সারাজীবন ওকে শুধু কষ্ট পেতেই দেখলাম। আমি চাই ও একটু ভালো থাকুক রে।’ বলতে বলতে চোখ ভিজে যায় পরমার। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখটা মুছে নেয়। ‘আরে যা যা, অনেক রাত হল, তোরা দুটিতে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে খেতে চলে আয়। কিচ্ছু ভালো লাগছে না-রে, কী যে দেখব কাল…।’

চোখ মুছতে মুছতে বাথরুমের দিকে এগিয়ে যায় আদিত্য। পরমা-ও ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রীয়ের মাথায় স্নেহের হাত রেখে বলে, ‘চল, কাল আবার সকাল সকাল উঠতে হবে। মুখে কিছু দিয়ে নিবি চল।’

কারওর-ই গলা দিয়ে খাবার নামল না। শুধু প্রয়োজনের তাগিদে কোনওরকমে দু-এক গাল মুখে দিয়েই যে-যার ঘরে শুতে চলে গেল। সকলের একটাই চিন্তা, কীভাবে বৃন্দা ভালো হয়ে উঠবেন।

দিনের আলো ফোটার আগেই আদিত্য তৈরি হয়ে নিল। রুম থেকে বেরিয়ে দেখে, ছোটোপিসিও রেডি। পিসেমশাইকে নিয়েও খানিক চিন্তায় ছিলেন, ওনার যে আবার হাই-ব্লাডপ্রেশার। সারারাত জাগা। শ্রী-ও তাদের সাথে যাবার প্রস্তুতি শুরু করেছিল। বাধ সাধে আদিত্য।

‘শ্রী, তুমি দুপুরে এসো। তোমাকে দেখে যদি আবার মা উত্তেজিত হয়ে ওঠে।’ সংশয় প্রকাশ করে আদিত্য।

‘ঠিক আছে। তাহলে আন্টিকে কী খাবার দিতে হবে ডাক্তারের থেকে জেনে নিয়ে আমায় বোলো। সেইমতো বানিয়ে নেব।’

‘যা লাগে কাজলকে দিয়ে তাহলে আনিয়ে নিও।’

‘ঠিক আছে, চিন্তা কোরো না। আমি সব সামলে নেব।’

‘ওকে’, বলে বেরিয়ে যায় তারা।

দিনতিনেক পর আইসিইউ থেকে কেবিনে শিফ্ট করা হল বৃন্দাকে। এখন আউট অফ ডেঞ্জার, তবে শরীরের একটা দিক পড়ে গেছে। কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে। আদিত্যকে দেখে চোখের কোণা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু সেটা এতটাই ক্ষীণ আর অস্পষ্ট যে বোঝার উপায় নেই। এদিক-ওদিক চোখ বুলিয়ে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করেন বৃন্দা। তারপর ইশারায় শ্রীয়ের কথা জানতে চান। আদিত্য আঙুল দিয়ে দরজার বাইরের দিকে দেখিয়ে দেয়। বৃন্দার চোখ চলে যায় দরজার বাইরে থাকা শ্রীয়ের দিকে। জড়োসড়ো ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চোখের ইশারায় ডেকে নেয় শ্রীকে। আদিত্য একটু ভয় পেয়েছিল বটে, তবে মায়ের আচরণ দেখে সে খানিকটা আশ্বস্তই হয়। বুঝতে পারে শ্রীয়ের উপস্থিতিতে মা খুশিই হয়েছে।

তবে মায়ের শারীরিক অবস্থা বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল আদিত্যকে। মা-কে সবসময় কিছু না কিছু কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখেছে, সেই মায়ের এই অবস্থা মেনে নেওয়াটা তার পক্ষে কষ্টদায়ক তো বটেই। এর আগে সে কখনও এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়নি। বুঝে উঠতে পারছিল না কী করলে তার মা আবার আগের মতো হেঁটেচলে বেড়াবে।

বৃন্দার সমস্ত দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিল শ্রী। খাবার বানানো থেকে শুরু করে খাওয়ানো পর্যন্ত খুব যত্নের সঙ্গে সামলাচ্ছিল সে। কখন কী লাগে এই ভেবে সবসময় তাঁর পাশে পাশে থাকত শ্রী। বৃন্দাও আস্তে আস্তে তার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিলেন। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তাকেই খুঁজে বেড়াত বৃন্দার চোখ। পিসি, পিসেমশাই মাঝে মাঝে এসে শ্রীয়ের যত্ন দেখে খুশিই হতেন।

বিপত্তির মাঝে আর এক বিপত্তি। অফিস থেকে পত্রাঘাত। কোম্পানি তাকে ইউএসএ পাঠিয়ে দিচ্ছে। এটা আদিত্যর অনেক দিনের স্বপ্ন। ভবিষ্যৎ গড়ার এরকম সুবর্ণ সুযোগ আর সে কোনওদিনও পাবে না। এত আনন্দের খবরটাও তার কাছে আজ নিরানন্দের-ই সমান। কী করবে সে? এই অবস্থায় মাকে ফেলে যাওয়াটা তার পক্ষে সম্ভব নয়। বারবার দিদি অন্বেষাকে ফোন করছে আসার জন্য, কিন্তু তার ওই এক কথা, মা তাকে পছন্দ করে না। তাকে দেখলে মা আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। তবু সে চেষ্টা করে দেখবে।

অবশেষে আরও দু-দিন পর পুনে থেকে আদিত্যর দিদি অন্বেষা উপস্থিত। তাকে দেখে খানিক স্বস্তি পেয়েছিল আদিত্য। ‘তোকে দেখে খানিক স্বস্তি পেলাম রে দিদি। যদিও মা এখন আগের তুলনায় অনেকটাই ভালো আছে, অ্যাটেনডেন্টও রয়েছে, তবুও দেখাশোনার জন্য নিজেদের লোকজন পাশে থাকাটাও জরুরি। এতে মা-ও খানিক ভরসা পায়। তা কয়েকদিন ছুটি নিয়ে এসেছিস তো?’

‘না, না।  তুই তো জানিস আমার জব-টা কী? এখন আবার এক্সাম চলছে। হুট করে এভাবে বিনা নোটিশে ছুটি নেওয়া যায় নাকি? তবুও তো প্রিন্সিপাল-কে বলে কয়ে দিন দুয়েকের ছুটি পেয়েছি।’

বেশ হতাশ হয়ে যায় আদিত্য।

‘এবাবা আমি তো ভেবেছিলাম তুই থেকে একটু মায়ের সেবা-শুশ্রুষা করবি।’

‘জানিস-ই তো, হাসপাতালের নাম শুনলে বরাবরই আমি নার্ভাস হয়ে যাই। হাত-পা কাঁপতে থাকে আমার। এই গন্ধটা কিছুতেই নিতে পারি না।’

অন্বেষার কথা শুনে আদিত্য রীতিমতো শকড হয়ে যায়। বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে দিদির দিকে। কেমন অচেনা লাগে নিজের দিদিকে। কিছু বলার ভাষা হারিয়ে যায় তার। এদিকে ডাক্তারের সঙ্গেও কথা হয়ে গেছে। উনি বলেছেন, ‘এবারে আপনারা আপনার মা-কে বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন। তবে মনে রাখবেন নিয়মিত ফিজিয়োথেরাপি-টা মাস্ট। এখন ওনার সুস্থ হওয়াটা পুরোটাই ওনার সেরে ওঠার ইচ্ছাশক্তি আর আপনাদের সেবা শুশ্রুষা-র উপরই নির্ভর করবে।’

‘কিন্তু ডাক্তারবাবু ওনার কথাগুলোও তো এখনও জড়িয়ে যাচ্ছে, তাহলে এত তাড়াতাড়ি…’ সংশয় প্রকাশ করে আদিত্য।

‘আপনাকে তো আগেই বললাম, আমাদের যা করার আমরা করে দিয়েছি। এখন যা ওষুধ চলবে তাতে ধীরে ধীরে কাজ হবে। জেনারেলি এসব কেসগুলোতে দীর্ঘকালীন ট্রিটমেন্ট চলে। পেশেন্টের মনোবল থাকলে অনেকে কিওর হয়ে যায় আবার অনেকের…। থাক ওসব কথা।’ বলে ডাক্তারবাবু রাউন্ডে চলে যান।

সেসব নিয়েই আদিত্যর মাথায় নানারকম দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে। সেই কারণেই অন্বেষাদিকে দেখে একটু চিন্তামুক্ত হতে চেয়েছিল সে। কিন্তু উলটোটাই হল। দিদিকে আরও একবার কনভিন্স করার চেষ্টা করল আদিত্য।  ‘কোনওভাবেই কি কয়েকটা দিন ম্যানেজ করা যায় না? কয়েকটা দিন? এই মুহূর্তে আমার ইউএস যাওয়াটা ভীষণ জরুরি। আমি ওখানে জয়েন করার পরে পরেই এসে মাকে নিয়ে চলে যাব। মা-কে নিয়ে যাব তার জন্য তো আমাকে কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ। জাস্ট কয়েকটা দিন।’

‘না, কোনওভাবেই সম্ভব নয়। এক্সামের ডিউটি না থাকলে…। তাছাড়া কালই আমার ফ্লাইটের টিকিট।’ দিদির কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদিত্য। অন্বেষা কী একটা ভাবে। তারপর হুঠ করে কথা প্রসঙ্গে বলে বসে, ‘তুই তো একটা অ্যাটেনডেন্ট রাখলেই পারিস।

সে-ই তো মায়ের দেখাশোনা করতে পারে।’ অন্বেষার ভাবটা এমন যেন সে ভাইয়ের কাঁধ থেকে দায়িত্ব অনেকটা কমিয়ে দিতে পেরেছে।

‘একজন অচেনা মানুষের দায়িত্বে পুরো বাড়িতে মা একা?’ ভাবতে পারে না আদিত্য।

‘কেন সঙ্গে কাজলদিকে থাকতে বল। ও-তো বিশস্ত। অনেকদিন ধরে আমাদের বাড়িতে কাজ করছে।’

‘নিজের কেউ একজন পাশে থাকাটাও জরুরি দিদি। ওসব তুই বুঝবি না। স্পর্শ- চিকিৎসা বলেও একটা ব্যাপার আছে জানিস তো।’

‘ছাড় তো, যত সব ফালতু ব্যাপারস্যাপার। তোর যদি এতই সমস্যা তাহলে ভালো কোনও ওল্ড এজ হোমে রেখে যা। কয়েকদিনেরই তো ব্যাপার।’

‘বাঃ দিদি বাহ্, এটা তোর পক্ষেই সম্ভব। একটু বাধল না, না রে? সব ভুলে গেছিস, মা সারাজীবন আমাদের দুই ভাইবোনের জন্য কী করেছে। আর এখন যখন তার আমাদেরকে প্রয়োজন, আমরা পিঠ বাঁচাচ্ছি।’

‘আমাকে  কর্তব্য শেখাতে আসিস না। যেটা বাস্তব সেটাই বলেছি। আর কী বলছিস মা এই করেছে, সেই করেছে। হোস্টেলে রেখেছে, ফিজ দিয়েছে এই তো। এগুলোর মধ্যে নতুনত্ব কী আছে? প্রত্যেকটা বাবা-মা-ই তাই করে। আমার মা-ও তাই করেছে।’

দিদির কথাগুলো সহ্য করতে পারে না আদিত্য। ভাইবোনের মধ্যে রীতিমতো তর্কাতর্কি চলতে থাকে। রাগে ফুঁসতে থাকে আদিত্য। সে ভুলে যায় যে তার মায়ের ঘরে মায়ের চোখের সামনে এই সমস্ত ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা। কথার মাঝে শ্রী  মায়ের কেবিনে ঢুকে পড়ে। তখন আদিত্যর সম্বিৎ ফেরে। শ্রীয়ের দৃষ্টি মায়ের দিকে, কিন্তু বিষ্ফারিত চোখে চেয়ে আছে শ্রী৷ সঙ্গে সঙ্গে মায়ের দিকে ফিরে তাকাতেই চমকে ওঠে আদিত্য । মা ওঠার চেষ্টা করছে। ডান হাতটা নাড়াচাড়া করে কিছু বলার চেষ্টা করছে। দু-চোখ জলে ভেজা। মায়ের কাছে ছুটে যায় শ্রী। শান্ত করার চেষ্টা করে ওনাকে। আদিত্য বোকার মতো একই জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বুঝতে পারে কত বড়ো ভুল সে করেছে।

‘তোমাদের  মুখগুলো এরকম লাগছে কেন? আমি কি তোমাদের কথার মাঝে ঢুকে পড়লাম? মা-ই বা হঠাৎ এত উত্তেজিত হয়ে উঠল কেন?’, জানতে চায় শ্রী৷ কোনও উত্তর দিতে পারে না আদিত্য। ফ্যালফ্যাল করে কেবল মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

শ্রী, আদিত্য আর অন্বেষাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘তোমাদের তো খুশি হওয়া উচিত যে আন্টি কাল বাড়ি ফিরছে। উলটে তোমাদের মুখগুলো কেমন ফ্যাকাশে লাগছে।’

এইবার উত্তর দেয় আদিত্য। ‘ভাবছি মাকে কে দেখবে। ২২ তারিখে আমার ফ্লাইট। তার আগে দিল্লির অফিসের সমস্ত কাজ আমাকে মিটিয়ে নিতে হবে। সেইজন্য দুদিন আগে যাওয়াটা জরুরি। দিদিও থাকতে পারবে না বলছে।ওর ফ্লাইট কাল ।’

‘এই নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করার কী আছে? আমি থেকে যাচ্ছি আন্টির কাছে। আমি দেখাশোনা করব ওনার। আমি তো একটু আগেই একজন ফিজিয়োথেরাপিস্টের সঙ্গে কথা বললাম। একটা অ্যাটেনডেন্ট-এর ব্যবস্থা করে নেব, সে আমার হাতে হাতে সাহায্য করবে, তাহলেই হবে। তাছাড়া কাজলও রইল। ও-ও সাহায্য করবে।

‘আর  তোমার অফিস?’

‘আমার অসুস্থতা দেখিয়ে একটা মেল করে দিচ্ছি। মানলে ভালো, না মানলে আর কী করা যাবে। চাকরি চলে যাবার ভয়ে তো আর আন্টিকে একা ছাড়তে পারি না।’

আদিত্যর কপালে চিন্তার ভাঁজ মুহূর্তেই পরিস্কার হয়ে গেল। শ্রীয়ের এই সিদ্ধান্তে সে-যে খুব কিছু অবাক হয়েছে তা-ও নয়। কারণ সে শ্রী-কে চেনে। জানে, ও এইরকমই একটা পাগলি মেয়ে। কিন্তু অন্বেষার চোখে-মুখে বিস্ময়ের স্পষ্ট ছাপ ফুটে উঠেছে।

পরদিন কাউন্টারে বিল মিটিয়ে ডিসচার্জ পেপার নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল আদিত্য। সেই ফাঁকে শ্রী, বৃন্দার সমস্ত কাজকর্ম গুছিয়ে নিল। বৃন্দার জামাকাপড় গোছানো থেকে শুরু করে তার চুল বেঁধে দেওয়া পর্যন্ত, সমস্ত নিজে হাতে মনের মতো করে সেরে নিল। সমস্ত ফর্মালিটি পূরণের পর ওয়ার্ডবয় আর নার্সের সাহায্যে মা-কে হুইলচেয়ারে বসিয়ে গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল তারা।

বাড়ি ফেরার পর থেকেই অন্বেষাকে ভীষণ ভারাক্রান্ত লাগছিল। সবার থেকে দূরে ঘরের এক কোণে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরে বসেছিল সে। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিতে ঘরে ঢুকে, অন্বেষাকে ওই অবস্থায় দেখে প্রশ্ন করে বসে শ্রী– ‘দিদি তোমার কি মাথাব্যথা করছে নাকি? বাম দেব?’

মাথাটা তুলে জবাব দেয় অন্বেষা, ‘নারে, ঠিক আছি আমি।’ অন্বেষার চোখ দেখে ঘাবড়ে যায় শ্রী। রক্তজবার মতো লাল টকটক করছে চোখদুটো।

‘এমা  তুমি কাঁদছ? কিছু যদি মনে না করো, তোমার মনের কথা আমায় খুলে বলতে পারো। জল দেব, একটু জল খাবে?’

‘না রে, লাগবে না।’ বলে একটা দীর্ঘশ্বাস নেয় অন্বেষা।

‘জানিস আজ তোকে সব বলতে ইচ্ছে করছে। তুই ভেবে অবাক হচ্ছিস না, মেয়ে হয়ে আমি কীভাবে মায়ের সাথে এত খারাপ ব্যবহার করছি। ভাবাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি ইচ্ছা করে কিছু করছি না রে। মাকে দেখলেই না আমার ছোটোবেলার খারাপ স্মৃতিগুলো চোখের সামনে এসে পড়ে।’

‘খারাপ স্মৃতি’! একটু অবাক হয় শ্রী।

অন্বেষা তার মতো করে বলে চলে ‘মায়ের সাথে আমার এমন দুর্ব্যবহারের কারণ হল, রমেশ কাকা আর মায়ের সম্পর্ক। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই ওনার সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক। বাবার জায়গায় অন্য কেউ, এটা আমি কখনওই মানতে পারিনি। ভাবলেই এখনও গা-টা কেমন যেন রি-রি করে ওঠে। আদি তো ছোটো ছিল, সেই কারণে ও কিছু বুঝত না। আমি বুঝতাম বলে সবসময় আমাকে বকাঝকা করত। সেই কারণেই আমি পুনেতে হোস্টেলে চলে গিয়েছিলাম। থাকতে চাইনি এই পরিবেশে, বিশ্বাস কর।’

অন্বেষার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা  দেওয়ার চেষ্টা করে শ্রী। দু-চোখ দিয়ে অঝোরে জল নেমে আসে তার। কাঁদতে কাঁদতেই শ্রী-র হাতটা চেপে ধরে সে। ‘বিশ্বাস কর, শ্রী, আমি চেষ্টা করি মায়ের সাথে ভালো ব্যবহার করতে। যখন দুরে থাকি ভাবি মায়ের সাথে আর এরকম ব্যবহার করব না, কিন্তু সামনাসামনি দেখলেই সব ভাবনাচিন্তাগুলো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। তখন শত চেষ্টা করেও নিজেকে আটকাতে পারি না।’

অন্বেষার কষ্টটা খানিকটা হলেও বুঝতে পারে শ্রী। তার দিকে এক গ্লাস জল বাড়িয়ে দিয়ে ধীর কণ্ঠে বলে, ‘দিদি তোমার কষ্টটা আমি ফিল করতে পারছি। কিন্তু একটা জিনিস কখনও ভেবে দেখেছ কি? সারাজীবন কাঁহাতক একটা মানুষ একা থাকতে পারে? ওনারও তো একটা লাইফ আছে। উনি তো চাইলে আবার বিয়েও করতে পারতেন, কিন্তু তোমাদের কথা ভেবে সেটা তো করেননি। নিজের সবটুকু দিয়ে তোমাদের মানুষ করেছেন। পরিবর্তে তিনি যদি কোনও কিছু নিয়ে একটু খুশি থাকেন তাহলে ক্ষতিটা কোথায়? তোমায় শিক্ষা দিয়েছেন, ভালোভাবে মানুষ করেছেন, কোথাও কোনও খামতি রাখেননি। তাহলে তোমরা মায়ের খুশির জন্য এইটুকু কেন মানতে পারছ না। ভেবে দেখেছ কখনও? যদিও এখন আর এসব ভেবে লাভ নেই। আমি যতদূর জানি বছর দুয়েক হল রমেশকাকা নিরুদ্দেশ।’ বিষণ্ণ হয়ে ওঠে শ্রী।

শ্রী-র মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে অন্বেষা। অবলীলায় মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, ‘কী বলছিস? এসবের তো আমি কিছুই জানি না। অবশ্য কোনওদিন জানার চেষ্টাও করিনি। শুধু স্বার্থপরের মতো নিজের কথাই ভেবে এসেছি। মায়ের থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি নিজেকে।’ বলে চুপ করে যায় অন্বেষা।

শ্রী আবার বোঝায়, ‘দিদি, আজ রাতেই তো তোমার ফ্লাইট। এই যে যাবে, আবার কবে আসবে জানি না। যাও না, একটু মায়ের পাশে গিয়ে বসো না। দেখবে তোমারও ভালো লাগবে আর মায়েরও ভালো লাগবে।’

এরপর বেরোনোর আগে পর্যন্ত অন্বেষা মায়ের সাথে সুখ-দুঃখের অনেক কথা বলেছে। যাওয়ার আগে খুব শিগ্গির আসার ইচ্ছাও প্রকাশ করে গেছে।

দিনদুয়েক পরে আদিত্যও মাকে শ্রীয়ের ভরসায় রেখে ইউএস রওনা দিল। এখন বাড়ির সদস্য বলতে বৃন্দা আর শ্রী। মানসিকভাবে দৃঢ় হলেও বৃন্দা আন্টিকে নিয়ে একটু চিন্তাতেই ছিল শ্রী। কীভাবে সুস্থ হবে? কতদিন লাগবে? আদিত্য থাকতে মনের একরকম জোর ছিল, কিন্তু ও চলে যাওয়াতে এখন একটু নার্ভাস বোধ করছে। নিজের বাবাকে দীর্ঘ পাঁচ বছর পক্ষাঘাতে পড়ে থাকতে দেখেছে সে। কী যে কষ্টের আর যন্ত্রণার তা সে চাক্ষুস করেছে। তাই সে যে ভাবেই হোক, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার আন্টিকে আবার আগের মতো হেঁটে-চলে বেড়াতে দেখতে চায়। তার জন্য যা করতে হয় তাই করতে সে রাজি।

নার্সের জন্যও অপেক্ষা করত না শ্রী। আদিত্যর মাকে পট বাড়িয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে গা স্পঞ্জ করে দেওয়া, কোনও কিছুতেই তার কোনও দ্বিধা নেই, ঘেন্না নেই। অবলীলায় হাসতে হাসতে সেইসব কাজ করে সে। টাইমে ওষুধ খাওয়ানো, মাসাজ করা, এক্সারসাইজ করানো সবকিছুর মধ্যেই ভীষণ আন্তরিক ভাব।

বৃন্দা আন্টিকে সারিয়ে তোলার জন্য শ্রীর আপ্রাণ চেষ্টা সত্যিই কাজে দিয়েছিল। মাত্র দিন কুড়ির মাথাতেই হঠাৎই আন্টির বাঁ-হাতের আঙুলগুলো নড়ছে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠেছিল শ্রী। আনন্দ ভাগ করে নিয়েছিল আদিত্য এবং দিদির সঙ্গে। বাড়িতে রুটিন চেক-আপে এসে ডাক্তারও রীতিমতো আশ্চর্য হয়েছেন। ছোটোপিসি তো হাত উজাড় করে আশীর্বাদ করে গেছে তাকে।

এভাবেই কেটে যায় আরও কয়েকটা দিন। এখন বৃন্দা ডান হাতে ভর দিয়ে নিজেই বসতে পারেন। শ্রী ধরে ধরে দু-এক পা হাঁটায়ও। মাঝে মাঝে একা থাকলে পুরোনো স্মৃতিগুলো মনে পড়ে তাঁর। স্বামী মারা যাওয়ার পরে পরেই তাঁকে বিজনেস জয়েন করতে হয়েছিল। যদিও তখন ব্যাবসার সাতপাঁচ বুঝতেন না বৃন্দা। এক অর্থে প্রথম প্রথম পুরো বিজনেসটাই দেখাশোনা করতেন রমেশ।  প্রায় ভরাডুবি অবস্থা ছিল তখন ব্যাবসার৷ আস্তে আস্তে সবকিছু বুঝে নিতে সময় লেগেছিল বৃন্দার। নির্ভরতার মাঝে  কখন যে রমেশের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন, তিনিও বোধকরি নিজেও বুঝতে পারেননি। তবে বরাবরই ছেলেমেয়েদের প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন বৃন্দা। তাদের কখন কী লাগবে, কীসে ভালো থাকবে, চিরকাল এটাই তাঁর ভাবনা ছিল। এমনকী যখন ব্যাবসায় রীতিমতো টালমাটাল অবস্থা তখন যেমন জলের দরে কোম্পানি বেচে দিয়ে কর্মীদের পাওনা-গন্ডা বুঝিয়ে দিয়েছেন, তেমনি ছেলেমেয়ের পড়াশোনার ব্যাপারে কোনও কমপ্রোমাইজ করেননি। মেয়েকে পুনেতে সিম্বায়োসিস-এ ভর্তি করানোর জন্য বাড়িটাকে পর্যন্ত বন্ধক রেখেছেন। অথচ এই দুঃসময়ে ছেলে-মেয়ে কেউ নেই তার পাশে। জীবিকার প্রয়োজনে হলেও, আছে তো দূরেই।

মনে মনে হাজারো রকম প্রশ্ন ঘুরতে থাকে তাঁর। ভাবতে বাধ্য হন তাঁর রক্তের সম্পর্ক কার সাথে– আদিত্য, অন্বেষা নাকি শ্রী-য়ের সাথে। কত আন্তরিক ভাবে তাঁর সমস্ত কাজ করে দেয় শ্রী, একটুও বিরক্ত হয় না। শ্রীয়ের জন্যই তো আজ সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে। অথচ এই মেয়েকেই একদিন সে কতই না অপমান করেছে।

ভাবনায় বাধ সাধে পরমা। প্রায় রোজই একবার করে ঘুরে যায় সে। একগাল হাসি নিয়ে ঘরে ঢুকে বলে– ‘কী রে, শুনলাম দৌড়োচ্ছিস।’ কাছাকাছি বয়সের হওয়ায় পরমা বরাবরই বৃন্দাকে ‘তুই’ বলেই সম্বোধন করে।

‘হ্যাঁ, সবই শ্রী-র দৌলতে। আজও কয়েক পা হাঁটিয়েছে আমাকে।’ হেসে জবাব দেন বৃন্দা।

‘হাসপাতালে তোর অবস্থা দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম রে। ভেবেছিলাম তুই বোধহয় আর…’ চোখ জলে ভরে আসে পরমার।

পরমাকে দেখে বৃন্দারও চোখ ভিজে যায়। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘এত তাড়াতাড়ি তোমাদের ছেড়ে যাচ্ছি না বুঝেছ। এখন ছেলের বিয়ে দেব। নাতি-নাতনির মুখ দেখব। তবেই আমার যাবার পালা।’ হেসে ফেলে পরমাও।

‘যাও তো, আলমারিটা খুলে মায়ের দেওয়া বালাগুলো এনে দাও।’

‘ওটা  তো তুই তোর বউয়ের জন্য রেখেছিলিস?’

‘আরে হ্যাঁ, আগে আনো তো।’ বলে চাবির গোছাটা পরমাদির দিকে বাড়িয়ে দেন বৃন্দা।

মিনিট কয়েকের মধ্যেই বালাজোড়াটা এনে বৃন্দার হাতে দেয় পরমা। ঠিক সেই সময়তেই শ্রী চায়ের ট্রে হাতে ঘরে ঢোকে।

‘এদিকে শোন তো। কাছে বস।’ আদর করে শ্রী-কে পাশে বসান বৃন্দা।

‘এখনও তোমার খাবার বানানো হয়নি। তারপর আবার অতগুলো ওষুধ।’ বকবক করে চলে শ্রী।

বকবকানি থামাতে ধমকে দেন বৃন্দা। ‘বস তো তুই। সারাদিন শুধু কাজ। হাতটা বাড়া।’

‘কেন?’

‘আবার প্রশ্ন করে। যা বলছি তাই শোন।’

কথা মতো হাতটা বাড়াতেই বৃন্দা শ্রীয়ের হাতে বালাজোড়া পরিয়ে দেন। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শ্রী। একটাও কথা বলতে পারে না।

শ্রী-র হাত দুটো তুলে ধরে বৃন্দা বলেন– ‘কী দিদি দারুণ মানিয়েছে না?’

‘খুব মানিয়েছে। আমাদের আদিত্যর জন্য ও-ই যথার্থ।’

শ্রীয়ের চোখ জলে ভিজে আসে। তাকে বুকে টেনে নেন বৃন্দা। আর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ‘ওরে এখনই কেঁদে ভাসাচ্ছিস, জানিস তো শাশুড়িরা বউদের খুব জ্বালায়। আমি ট্র্যাডিশনের বাইরে কী করে যাব বল! আমি তো একটু হলেও জ্বালাব, তখনকার জন্য একটু বাঁচিয়ে রাখ। সামনের সপ্তাহে বাবু এসে তো আমাদের নিয়ে চলে যাবে।

তখন থেকে তো একসাথেই থাকতে হবে বল।’ বলে একসঙ্গে হেসে ওঠে সকলে।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব