পালামপুর

আগুনরাঙা প্রহর গুনছে মগডালে বসে থাকা টিয়াপাখির দল। হোটেলে আসা ইস্তক ওদের বেলা শেষের ডাক জানান দিচ্ছে, আর মাত্র কিছুক্ষণ। ঘন সবুজের আবডালে কুসুমরাঙা থালা থেকে দিন ফুরোনোর রং ছড়িয়ে পড়ছে। ধৌলাধারের রুক্ষ শরীর আগুন ছোঁয়াচে স্বপ্নময়। টিয়ার ঝাঁকের ট্যাঁট্যাঁ-টুকু ছাড়া, আর দ্বিতীয় কোনও শব্দ নেই পালামপুরের বুকে। বাহারি কেয়ারি করা সবুজ ছিটোনো, হিমাচল পর্যটনের ‘দ্য টি বাড’ হোটেলের বিলাসী বারান্দায় বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছি। মনে হচ্ছে সমস্ত জগৎ-সংসার বুঝি তার সব কাজ সমাপ্ত করে আমার সঙ্গে বসেছে দুদণ্ড জিরোবার জন্য। ঝুপঝুপ সন্ধে নামল চুপচুপিয়ে। টিয়াগুলো কোথায় যে লুকোল কে জানে?

আজ বেশ ক্লান্ত। সেই কোন সকালে বেরিয়েছি ধরমশালা থেকে। অনেকটা রাস্তা পার করে চামুণ্ডা মন্দির দর্শন সারলাম। ছিমছাম সুন্দর মন্দিরে কারুকলার বাহুল্য না থাকলেও, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা মন কাড়ে। পূজার্থীরা পুজো দিয়ে শান্তি পান। সেখানেই এক বৈষ্ণো ধাবাতে দুপুরে আহার সারি। খানিকটা আড়মোড়া, দু’চারটে ক্লান্তির হাই, তারপরেই বিল্লুভাইয়ের গাড়িতে স্টার্ট। অনেকটা পথ পেরিয়ে মালান। সেখান থেকে বাঁ-হাতে বেঁকে আরও কিছুটা দূরে নিরিবিলি Palampur। রাস্তা যতই পালামপুর ছুঁইছুঁই করবে, প্রকৃতির হৃদয় নিংড়োনো রূপ ততই এপাশ-ওপাশ চারপাশ ঘিরে ধরবে। দেখবেন পিচসড়কটা চা-বাগনের লাবণ্য ছুঁয়ে ধৌলাধারের বুকে চড়ে বসেছে। সেখানেই আসর বিছানো শান্তির এই ঠাঁই পুলুম, মানে লট্স অফ ওয়াটার। পুলুমই কালে কালে পালামপুর। যদিও এর অতীত নাম ত্রিগার্ত। কাংড়া উপত্যকা এখানে এসেই ধৌলাধারে মিশেছে। কম ভ্রমণার্থীরাই এখানে আসেন। যারা আসেন তারা প্রেমে পড়ে যান। কোজাগরীর দুদিন বাদে পালামপুরে এসেছি। পাশের ঘরেই একজোড়া হানিমুন কাপল। কাল করবাচৌত। দুদিন ধরে ভুবনভরে আলো বিলিয়ে চাঁদটা আজ লুকিয়ে পড়েছে। কাল চাঁদ উঠলে ওদের ব্রত উদযাপন।

গতকাল বিকেল ফুরোতেই যেসব টিয়ার দল পাশের গাছ ছেড়ে কুলায় ফিরেছিল, তারাই আজ সকাল হতেই আবার কলরবে মাতিয়ে তুলেছে পালামপুরের সবুজ দুনিয়া। একজন মগডালে বসে ট্যাঁট্যাঁ করলেই অন্যজন ডানা ঝাপটে কোন কোটর থেকে উড়ে এসে পাশের ডালে বসে। লাল ঠোঁটের কচি সবুজ পাখিগুলোর অবুঝ রঙ্গ বেশ লাগছে। কয়েকটাকে লেন্স-এ ধরবার চেষ্টা করলাম। হাই জুমে ধরাও দিল।

কলকাতায় অট্টালিকার গলি গলে প্রাতর্ভ্রমণ আর হয়ে ওঠে না। সময় থাকলেও ইচ্ছে করে না। কিন্তু ঘুমচোখ খোলা থেকেই মনটা কেমন যেন যাই যাই করছে। বারান্দায় দাঁড়াতেই বুঝলাম, প্রকৃতির আহ্বান, এড়ায় কার সাধ্যি? সুতরাং ভ্রমণব্রত উদ্যাপনে বেরিয়ে পড়লাম সক্বাল সক্বাল। পায়ে পায়ে নিঝুম সকালের আলতো আদর। নরম ঠান্ডার রেশ সারা গায়ে এক অদ্ভুত মাদকতা আনছে। শান্ত শীতল পাহাড়ি বাতাস শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। মাথার ওপর উঁচু উঁচু গাছগুলোর সবুজ চাঁদোয়া ছিঁড়ে আকাশখানার অনধিকার প্রবেশ।

রাস্তাটা বাঁক নিতেই ভরা সবুজের উজান ঠেলে সূর্যের প্রথম আলোয় ঝলমল করছে আকাশচুম্বী গিরিচূড়া। দিগন্তজোড়া বক্ষ প্রসারিত করে চোখের উপর দাঁড়িয়ে আছে ধৌলাধার। কেটে আনা কাঠের স্তূপ ঘাড়ে-মাথায় বোঝাই করে, ঠিকরে আসা রোদ্দুর গায়ে মেখে হেঁটে চলেছে স্থানীয় মানুষ। রাস্তার দুপাশে চা-বাগানের ঢাল সংসার। মাঝে তার সিঁথির মতো পথ কাটা। সবুজের ঠাসবুনোটের আগল ঠেলে স্কুল পড়ুয়ার দল গুটিগুটি পায়ে চলছে বিদ্যালয়ের দিকে। গায়ে তাদের ঘনসবুজ পোশাক মিশে গেছে চা-পাতার কচি লাবণ্যে। আধকুঁজো মহিলা পিঠের ঝোলায় বাচ্চা বেঁধে চা-গাছের পরিচর্যায় মগ্ন। কেউ বা হাতে কাটারি নিয়ে আগাছা সাফ করে চলেছে। অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত এই সাফাই করে চা-বাগিচা বাঁচিয়ে রাখা হয়। তারপর আবার শুরু হয় চায়ের চাষ। তখন রূপঢালা সবুজের লালিত্যে পালামপুর মোহময়ী হয়ে ওঠে। সেই ঊনিশ শতকের ব্রিটিশ আমল থেকে পালামপুরের চায়ের খ্যাতি। দেশ থেকে দেশান্তরে চায়ের চালান হয় রমরমা।

আশেপাশে বেশ কয়েকটা দোকান আছে। প্রায় সবধরনের জিনিসই মেলে এই পাহাড়পুরীতে। মাত্রা কিছুটা গেলেই নেউগাল ক্যাফে। এটাও হিমাচল পর্যটনের। ঠিক হল আজকের জলখাবারটা সেখানেই হবে। কাছেই নেউগাল বা বুণ্ডল নদীর শরীর ঘেঁষা নেউগাল খাদ। বর্ষায় বড়ো বড়ো নুড়ি-পাথর পাহাড়ের ওপর থেকে নদীর বুকে আছড়ে পড়ে। উচ্ছল নদীর চেহারাই যায় বদলে। প্রাচীন বুণ্ডলামাতার মন্দির আছে এখানেই। হোটেলে স্নান সেরে নেউগালের দরজা ঠেলে সেঁধিয়ে পড়ি। সত্যি কথা বলতে কী, হিমাচলি সুগন্ধি বাসমতী চালের ভাত ছাড়া আর অন্য কোনও রান্নাই তেমন একটা জুতসই নয়। এখানে কেউ, বিশেষ করে বাঙালি পর্যটক যদি শখ করেও বিরিয়ানি খান, তাহলে তাঁর সারাজীবনের জন্য বিরিয়ানি খাওয়ার ইচ্ছেটাই ঘুচে যেতে পারে। অন্তত আমার তো ঘুচেছে। অতএব, সে ব্যাপারে সাবধান!

এ হেন শৈলগহনের শুধু রূপের আর্তি মনকাড়ে তাই-ই নয়, শরীর-স্বাস্থ্য চাঙ্গা রাখতেও এর জুড়ি মেলা ভার। তাই ইচ্ছে করেই এক-পা দু-পা হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর পর্যন্ত চলে যেতে মন্দ লাগে না। এর কিছুটা গেলেই বিন্ধ্যবাসিনীর মন্দির। তারপর আরও র কিলোমিটার, চোখে পড়বে জাখনিমাতার মন্দির। পাইন-ওক-দেওদারের বেড়া আর মাথার উপর নীল আকাশের চাঁদোয়ার নীচে ত্রিকোনাকৃতির চূড়াবিশিষ্ট সাধারণ এক মন্দির। পরিবেশের মাহাত্ম্যগুণে মন্দিরের আকর্ষণও বেড়েছে।

Palampur থেকে কিছুটা গেলেই কাংড়া উপত্যকার শেষপ্রান্তে হিমাচলের আর-এক তীর্থ বৈজনাথ। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন প্রকৃতির শরীর ঠান্ডা থাকলেও ভোটের আগুনে হিমাচলি বাজার বেশ গরম। চতুর্দিকে পোস্টার-পতাকায় ছয়লাপ। হোটেলের কাছ ঘেঁষেই একটা শর্টকাট রাস্তা নেমেছে নিমাথার চক পর্যন্ত। ব্যস, ওই অবধিই। গাড়ি নড়েও না চড়েও না। নাঃ! অবস্থাাবিশেষে যা পার্ক স্ট্রিট তা-ই পালামপুর। আধঘণ্টাটাক জ্যাম-গুঁতোনোর পর ইনোভা ছুটল বৈজনাথের দিকে। উইন্ডস্ক্রিণে ছায়া-রোদ্দুরের গান, আমরা এমনি এসে ভেসে যাই। কোলাহল ছাড়িয়ে মন এখন দেদার বেদুইন।

মন্দিরের কাছ বরাবর আসতেই আবার নাগরিক জটলা। আসলে বাস স্ট্যান্ডের কাছেই এই মন্দিরচত্বর। গাড়ি থামিয়ে খানিকটা হাঁটাপথ। পুজোর সামগ্রী হাতে হাঁকডাক এড়িয়ে মন্দিরে ঢুকি। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে কেয়ারি সবুজের রং গায়ে মেখে বহু মানুষই ভিড় করছেন এই দেবদেউলের চাতালে। সঙ্গে বাঁদরের দলও ইতিউতি লাফিয়ে বেড়াচ্ছে ইচ্ছেমতো। এখানের আস্তিকের চোখ খোঁজে দেবাদিদেবের দর্শন, আর নাস্তিকরা নাগারি শৈলিতে মজে যান।

নামটা আসলে বৈদ্যনাথ। অর্থাৎ শিব এখানে চিকিৎসক। লক্ষ লক্ষ ভক্তপ্রাণের ভক্তির জোয়ারে বাবা বৈদ্যনাথ কখন যেন বৈজনাথ হয়ে গেছেন। ঠিক এই সময়ে কেউ যদি বলেন এই মন্দির পাণ্ডবভ্রাতাদের তৈরি, তখনই ইতিহাস কিন্তু তার সর্বাঙ্গের ধুলো ঝেড়ে তেড়ে তর্ক জুড়বে। দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম এই বৈদ্যনাথ। অতএব তর্কের পাট তাকেই তোলা থাক। একঝলকে মন্দিরটাকে দেখলে ওড়িশার মন্দিরের কথা মনে পড়ে। দেবালয় ঘিরে ধৌলাধার আর আশাপুর রেঞ্জের শৈলতরঙ্গ। অনেকটা নীচে বিনোয়া নদী। সকাল কিম্বা বিকেল অথবা তুষার ঝরার সময়ে অসাধারণ বৈজনাথের ভিউ। প্রতিটি শৃঙ্গ তখন বরফের চাদরে আষ্টেপৃষ্টে জড়ানো। নাঃ, সে দৃশ্য এবারকার মতো কল্পনা করা সার। তবু যা দেখছি, তার থেকে চোখ ফিরিয়ে মন্দিরগর্ভে শুধু দেবদর্শন করা মানে আসল দেবতাকে ফেলে কেবল পাথরের মূর্তি নিয়ে বালখিল্য করা। দেবঘরের সারা দেহে সামান্য ছেনি-হাতুড়ির ঠুকঠাকে কী অসামান্য সব ভাস্কর্য-শিল্পকলা! দেখে আশ্চর্য হতে হয়।

ফেরার পথে আর-এক কাণ্ড। সাধে কী বলে বাঁদরের বাঁদরামো! কেয়ারি সবুজের বুকে কী নিশ্চিন্তেই হেলেদুলে গপ্প জুড়েছিল শাড়ি-চুড়িদার পরিহিত একদল মেয়ে। ও মা! কোত্থেকে দুটো হুমদো হনুমান ওদের মধ্যে দুটির ওড়না ধরে টানাটানি শুরু করল। চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে দলের সকলে যে যেদিকে পারল দৌড় মারল। কিন্তু একজনের ওড়না রইল পূর্ব পুরুষের হাতে। সেও ওড়না দেবে না আর নাতনিও তার ওড়না গায়ে জড়িয়েই মন্দির থেকে বেরোবে। বেশ খানিকক্ষণ তুইও নাছোড় অবস্থা চলার পর, হনুমানটির বোধহয় মায়া হল। সবজে গালিচার বুকেই ফেলে গেল গোলাপি ওড়নাখানা। নাতনিও সুযোগ বুঝে ইতিউতি চেয়ে টুকুস করে ওড়না তুলে ছুট। এদিকে নাটকের পর্দা পড়তেই মন্দির হালকা। বাবা বৈজনাথকে দেখতেও লোকজন এতক্ষণ ভিড় করেনি। সবই তাঁর লীলা।

বৈজনাথ দর্শন সেরে ফিরে আসি পালামপুর। দ্বিপ্রাহরিক আহারের পর কাছের সৌরভ বনবিহার ঘুরে আসি। সবুজভরা পাহাড়চেরা রাস্তা। মাঝেমধ্যে পাঁচ-ছ’টা বাড়ির সারি। একটা জায়গায় এসে রাস্তা ভাগ হয়ে গেছে। একটি পাহাড় বেয়ে উপরের দিকে উঠেছে আর-একটি নেমে গেছে বুণ্ডলা নদীর কাছে। দ্বিতীয় পথটাই আমাদের। চলতে চলতে হঠাৎই দুটি দোকান সংলগ্ন এক বিরাট বাঁধানো চত্বর। পাশেই ব্রিজ ঝুলছে। নদী পেরিয়ে এপাহাড় থেকে ওই পাহাড়। পায়ের নীচে নুড়ি-পাথরের আনাচেকানাচে বুণ্ডলার বয়ে চলা। চলার মাঝে চড়া পড়ে জলের ধারা ভাগ হয়েছে কোথাও কোথাও।

এপাহাড়ে আসতেই শরীরে চকিতে ঝিরঝিরে কাঁপুনি। এখানে রোদ চুরি হয়ে গেছে কিছু আগেই। অথচ ও পাহাড়ে এখনও রোদেলা আভাস। উঁচু রাস্তাটা নিচুতে নেমে গেছে বুণ্ডলার পাশটিতে। সামনেই বনের হাতছানি। তবে টিকিট কাটতে হবে। মাথাপিছু দশ দিয়ে লোহার গেটটা পেরিয়ে অরণ্যের আলিঙ্গন। কতদিন জঙ্গলে যাওয়া হয়নি। ভাবতেই পারিনি পাহাড়পুরীতে এসে এমন একখানা জঙ্গুলে পরিবেশ পাব। জঙ্গল কেটে সরু বাঁধানো পথ। হরেক ফুলের জলসা এখানে-সেখানে। যদি বলি পার্ক, তবে ফস করে কলকাতার নিক্বো কিংবা নলবনের ছবি ভেসে ওঠে। কিন্তু এ এক্বেবারেই তেমনটি নয়। এখানে মানুষের হাতের ছোঁয়া থাকলেও পর্যটকের বাড়াবাড়ি ভিড়-এর বনজ সৌন্দর্যকে এখনও ধবংস হতে দেয়নি।ঞ্জতাই নির্জন গাছের ছায়ায় গা এলিয়ে ভেসে গেলে, প্রকৃতির আদিম রসের খানিকটা স্বাদ এখনও মেলে।

কিছুটা এগিয়েই দেখি একদল স্কুলের ছেলেপিলে লাল সোয়েটার পরে খেলায় মত্ত। আরও খানিকটা ভিতর ঢুকলেই প্রস্তরমর্মরে এক শহিদের মূর্তি। ইনি কারগিল যুদ্ধের সৈনিক সৌরভ কালিয়া। এনার স্মৃতিতেই হিমাচল সরকার এই বনসাম্রাজ্যের নামকরণ করেছেন। তারপর হাজারও মাছের খেলাঘর ছোট্ট ঝিলটা পেরোলেই, অরণ্য আরও গভীর করে ঘিরে ধরে। পথে পথে পাথর ছড়ানো। আর সেসব পাথরের আকার নেহাতই ক্ষুদ্র নয়। কোনওটা কোমর ছাড়িয়ে বুক ছুঁইছুঁই। কানের পাশে নদীর গর্জন। এই জঙ্গলের পাঁজর ফুঁড়েই দুদ্দাড় বেগে ছুটে চলছে বুণ্ডলা।

বনবিহারের আর-একদিকে বোটিংয়ের দারুণ ব্যবস্থা। জলের বুকে রঙিন সেতু। তারই তলা দিয়ে হংসমুখী তরণিতে চেপে জলবিলাস। গরমকালে সকাল ১০ টা থেকে রাত ৮টা, আর শীতে সকাল সাড়ে ৬টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত নৌকাবিহার করা যায়। পাশেই ক্যাফে মোনাল। মোনাল এখানকার রাষ্ট্রীয় পাখি। ইচ্ছে হলে চুপচাপ চায়ে চুমুক দিয়ে বনের বুকে পাতা চেয়ার-টেবিলে জমানো যায় বৈকালিক আসর। সঙ্গ দেবে নানা নাম না-জানা পাখিদের কলতান।কোনওটা কিচকিচিয়ে যাবে, কোনওটা পাখা ঝাপটে নিরিবিলি মগ্নতাকে চুরমার করার চেষ্টা করবে আবার কোনওটা উদাস সুরে ভাসিয়ে নেবে আনমনা মনটাকে। ক্যাফে মোনালের মিউজিক সিস্টেম থেকে সুরের নস্ট্যালজিয়া ছড়িয়ে পড়ছে জলে-জঙ্গলে-আকাশে। আলোর তরঙ্গের মতো মোলায়েম সেই পরশ।

সেতু পেরিয়ে গাড়ির কাছে ফিরতে গিয়ে থমকে গেলাম ঝুলন্ত সেতুটার ওপরেই। ধৌলাধারের রং বদলাচ্ছে। পাদদেশে গেরস্থালির সবুজ আরও গাঢ় হচ্ছে। এপাশে বুণ্ডলার টলটলে কোলে কাঁচা সোনা গলছে। শ্যাওলা মাখা পাথরগুলোও সোনার জলে আধখানা শরীর ডুবিয়ে থির। নদীঘেরা পাহাড়পুরীতে নামছে আরও এক নৈঃশব্দ্যের প্রহর।

কীভাবে যাবেন

কলকাতা থেকে জম্মু তাওয়াই বা হিমগিরি এক্সপ্রেসে চাক্বিব্যাংক পৌঁছে সেখান থেকে গাড়িতে ধরমশালা হয়ে পালামপুর। অথবা পাঠানকোট থেকে ন্যারোগেজ রেলপথে পালামপুর যাওয়া যায়। বিমানে গেলে গগ্গল বিমানবন্দরে নেমে যেতে হবে সড়কপথে।

কোথায় থাকবেন

হিমাচল পর্যটনের দ্য হোটেল টি বাড। এছাড়া অজস্র বেসরকারি হোটেল আছে। রেস্ত অনুযায়ী ঘর নিতে পারেন।

গোয়া

ভারতের পঁচিশতম এবং পৃথক রাজ্য গোয়া। আকর্ষণে অন্যতম। পাহাড় আর সমুদ্রের ফাটাফাটি কম্বিনেশন। গোয়ার আকৃতি আধফালি চাঁদের মতো। এখানে বসবাস করে কোঙ্কন জাতির লোকেরা। স্বভাবে হইহুলোড়-প্রিয় গোয়ানরা, গান-বাজনায় ভরে রেখেছে গোয়ার পরিবেশকে। কাজু আর নারকেলগাছে ঘেরা তট আর সোনালি বালিয়াড়ি অচিরেই মায়াজাল বুনে দেয় পর্যটকের মনে। গোয়ায় সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখার মতো। বছরের প্রায় বেশিরভাগ সময় উৎসবে মেতে থাকে গোয়া। মিরামার বিচে নভেম্বর মাসে চলে ফুড ও কালচারাল ফেস্টিভ্যাল। তবে শুধু মিরামার বিচ-ই নয়, ১০৫ কিলোমিটার ব্যাপ্ত তটরেখায়, শ্যামল-সবুজ অনুচ্চ পাহাড়ের কোলে রয়েছে মোট ৪০টি বিচ। এরমধ্যে, উল্লেখযোগ্য কালানগুটে, আঞ্জুনা, মেনড্রেম, কান্ডোলিম, বাগা প্রভৃতি বিচ।

Goa

দেখার মতো দুটি স্পট ডোনা পাওলা ও অ্যাকোয়াডা ফোর্ট। গোয়ার মন্ডোভি নদী সংলগ্ন ঝাঁ-চকচকে রাস্তায় গাড়ি করে ঘুরে বেড়াতেও দারুণ লাগে। এছাড়া, গোয়ার লোন্ডা থেকে মারগাঁও যাত্রায় মন কেড়ে নেবে দুধসাগর জলপ্রপাত। প্রায় ৬০০ মিটার উঁচু থেকে দুধ-সাদা জল নামতে দেখবেন এই জলপ্রপাতের সামনে দাঁড়ালে। আর এসবেও যদি মন না ভরে, তাহলে দেখে নিতে পারেন মাতানচেরি প্রাসাদ, শ্রীমঙ্গেশ এবং শান্তাদূর্গা মন্দির, সে-ক্যাথেড্রাল, ওল্ড গোয়া চার্চ, চার্চ অফ্ ইমাকুলেটেড কনসেপশন, সেন কাঞ্জোন প্রভৃতি।

যদি সঙ্গিনীর সঙ্গে জঙ্গল দর্শনের আনন্দ উপভোগ করতে চান, তাহলে সোজা চলে যান দুধসাগর জলপ্রপাত লাগোয়া ‘মহাবীর ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি’-তে। তবে যেখানেই যান আর যা-ই দেখুন না কেন, গোয়া ভ্রমণকে ভাগ করে নিন তিনভাগে। ওল্ড গোয়া দেখে যান নর্থ গোয়ায় এবং সবশেষে সাউথ গোয়া ঘুরে বাড়ি ফিরুন। আর হ্যাঁ, গোয়া ভ্রমণে সি-ফুড ছাড়াও, দেশি-বিদেশি নানারকম খাবারের স্বাদ নিতে ভুলবেন না।

কীভাবে যাবেন

হাওড়া থেকে এলটিটি জ্ঞানেশ্বরী সুপার এক্সপ্রেস-এ লোকমান্য তিলক নেমে, ওখান থেকে কোঙ্কন রেলে গোয়া পৌঁছোন। যেতে পারেন আকাশপথেও। দমদম বিমানবন্দর থেকে রওনা দিয়ে নামুন ভাস্কো-ডা-গামার ডাবোলিম-এ। ওখান থেকে বাস কিংবা ট্যাক্সিতে পৌঁছোন গোয়া।

যোগাযোগঃ  গোয়া টুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন

দূরভাষঃ ০৮৩২-২২২৬৫১৫/ ০৮৩২-২৪৩৮৭৫০-৫১-৫২.

E-mail : goatourism@dataone.in

 

 

ডাক দিল ডালহৌসি

জায়গাটায় পা রাখা মাত্র বুঝতে বাকি থাকে না, ব্রিটিশ শাসনকালে কেন সাহেবরা ডালহৌসির এমন অনুরাগী হয়ে গিয়েছিলেন। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি-র এই পাহাড়ি উপত্যকা এতটাই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল যে, তিনি এটিকে অবসরযাপনের হিলস্টেশন-এ পরিণত করতে দারুণ উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। একদিকে পীর পাঞ্জালের সঙ্গবদ্ধ সারি, অন্যদিকে ধৌলাধার পাহাড়ের নিশ্ছিদ্র প্রহরা— এমন মায়াময় ল্যান্ডস্কেপ-ই তো পর্যটকদের চিরকাল টেনে আনে।

সবুজ মখমলি ঘাসের উপত্যকায় দাঁড়িয়ে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে নিতে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিন। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেই দেখা যাবে রবি, বিয়াস আর চাক্বি নদীর নীল জলধারা। উপত্যকা জুড়ে দেওদার, চির, কয়াল প্রভৃতি গাছের ঘন সবুজ আলিঙ্গন। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে অবস্থিত এই হিলস্টেশন, এক আকর্ষণীয় হলিডে ডেস্টিনেশন। হাজার চারেক লোকের বাস এই শহরে। চাম্বা জেলার অন্তর্গত এই জায়গাটি বছরের যে-কোনও সময়ই আলাদা আলাদা সৌন্দর্য নিয়ে ধরা দেয় পর্যটকের চোখে।

অন্যান্য পাহাড়ি শহরের মতো এখানেও সর্পিল পথ বেয়ে বেশ খানিকটা চড়াই পথে পৌঁছোনো যায় উপত্যকায়। পাইনের জঙ্গলের অপূর্ব শামিয়ানা ভেদ করে সূর্যের লুকোচুরি খেলা। লোভ সামলাতে পারবেন না আপনার ডিএসএলআর-এর লেন্স-এ সেই সৌন্দর্যকে ভরে নেওয়ার।

ডালহৌসিতে বিলাসবৈভবে যারা থাকতে চান, তারা বেছে নেন পাহাড়ের ঢালের সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত ‘আমোদ রিসর্ট’। এই রিসর্ট-এর ঘরের দেয়ালে মাটির আস্তরণ, যাতে অভ্যন্তর গরম থাকে। রিসর্ট তৈরির সময় বৃক্ষ নিধন না হওয়ায়, গাছে ঘেরা নিরিবিলি রিসর্ট আর সেই সঙ্গে অপূর্ব এক নার্সারি।

সর্পিল পথ পেরিয়ে চলে যান শহরের প্রাণ কেন্দ্র গান্ধিচক-এ, যেটি ঘিরে গড়ে উঠেছে শহরের বসতি। নানা মানের হোটেল, বাজার, গাড়ির টার্মিনাস, বেশ কিছু ছোটো-বড়ো খাবারের দোকান নিয়ে সরগরম অঞ্চল। ব্রিটিশ শাসনের সময় রিট্রিট প্যারেড-এর জন্য বাছা হয়েছিল এই স্থানটিকে। সুভাষচন্দ্র বসুর একটি মূর্তি স্থাপিত আছে সুভাষ চকের মাঝখানে। এটিও একটি টুরিস্ট পয়েন্ট। জিপিও স্কোয়ার একটি ছোটো চার্চ— সবমিলে ভারি নিরালার ঠাঁই ডালহৌসি। একদিন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন পঞ্চপুলা দেখতে। এখানে দেখা মিলবে একটি পাহাড়ি ঝরনার। পঞ্চপুলা থেকে এক কিলোমিটার দূরে সাতধারা বা সপ্তধারা। ঝরনায় জল গড়িয়ে পড়ছে পাহাড় বেয়ে।

ডালহৌসি থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ডেনকুণ্ড। এখান থেকে চিনাব আর রবি নদীর সঙ্গম দেখা যায়। এখানেই কালাটপ নামের একটি প্রাণী সংরক্ষণ বন আছে।

ডালহৌসি এসে অবশ্যই একটা দিন রাখুন খাজিয়ারের জন্য। খাজিয়ারে হর্স রাইডিং, ট্রেকিং, প্যারা গ্লাইডিং জরবিং প্রভৃতি অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস-এ অংশ নিতে পারেন। তবে অবশ্যই গাইড নেবেন সঙ্গে। প্যারাগ্লাইডিং-এর অনন্য অভিজ্ঞতা সারা জীবনের সঞ্চয় হয়ে থাকবে।

একদিন বেড়িয়ে আসতে পারেন ডালহৌসি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে চাম্বায়। ধৌলাধার আর পঙ্গিধর শিখরের বেষ্টনিতে এক অপূর্ব নিসর্গের মাঝে অবস্থিত চাম্বা। চাম্বাকে মন্দির নগরীও বলা হয়। প্রচুর ছোটো-বড়ো মন্দির ঘুরে দেখতে পারেন, আর আছে একটি প্রাচীন অট্টালিকা রংমহল। চাম্বার হস্তশিল্পও সংগ্রহে রাখার মতো। যদি পুজোর ছুটিতে ভ্রমণের প্ল্যান করেন, তাহলে অবশ্যই ঘুরে আসুন ডালহৌসি আর চাম্বা।

ডুয়ার্স-এর ডাকে

‘হুজ্জতে বঙ্গাল’– কথাটা মোগল আমলের। ঠিক কোন সম্রাটের আমলে প্রচলিত হয়, তা জানা যায় না, তবে বাঙালির হুজুগে জাতি হিসাবে প্রসিদ্ধি বেশ কয়েক শতাব্দীর। কিন্তু ‘রম্যাণি বীক্ষ’ যাদের আরাধ্য তাদের কাছে ভ্রমণের নেশা শুধুই হুজুগ হতে পারে না। এখন সংসারী মানুষের ভ্রমণসূচী শুধু কর্মস্থল নয়, অনেক বেশি নির্ধারণ করে সন্তানের স্কুল। তাই এবারের পুজোর ছুটিতে আমাদের গন্তব্য হল ডুয়ার্স।

অনেক সময় লক্ষ্যের চেয়ে উপলক্ষ্য বড়ো হয়ে দাঁড়ায় দুরারোগ্য ভ্রমণের নেশায় আক্রান্ত মানুষের কাছে। তাই আমার জীবনসঙ্গীর শিলিগুড়িতে বদলি হওয়ায় তার পেশাদারি ও আমাদের সাংসারিক জীবনে অনেকটাই ঝক্বি নেমে এলেও, সবুজ ঘেরা বন সংলগ্ন ক্যাম্পের মধ্যে কোয়ার্টারে আমি মাঝেমধ্যে গিয়েও থাকতে পারব, আর সঙ্গে পাব ডুয়ার্সের বন, সিকিম বা দার্জিলিং-এর পাহাড়ে বেড়ানো, সান্দাক ফু ট্রেকিং-এর সুযোগ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি স্বপ্নের তোড়ে ঝক্বিটাকেও শাপে বর মনে হল।

পুজোর ছুটিতে বক্সা, জলদাপাড়া ছুঁয়ে অরণ্য-বিহারের সিলেবাস মোটামুটি সম্পূর্ণ করলাম। সেই সঙ্গে জুড়ে দিলাম কোচবিহারের কিছুটা ঐতিহাসিক সফর। অবশ্য আমাদের শালুগড়া মিলিটারি ক্যাম্প-এর এক পাশেই জঙ্গল। কপাল ভালো থাকলে হাতি, চিতা, বুনো শুয়োর, বাইসন এসবের দেখা মিলতে পারে। ওখানকার বাসিন্দারা অবশ্য উক্ত প্রাণীগুলোর একটারও মুখোমুখি হওয়া সৌভাগ্য মনে করে না বরং আতঙ্কে থাকে। তবে আমি ও আমার কন্যা যতবারই গেছি গরু ও বাঁদর ছাড়া আর কিছু পাইনি। তাই এক বন থেকে উজিয়ে আরও আরও বনের দিকে যাত্রা।

ইংরেজির ডুয়ার্স নামটাই সর্বাধিক প্রচলিত। অথচ এর উৎপত্তি বাংলার ‘দুয়ার’ শব্দ থেকে, যে-শব্দটি একই অর্থে অসমিয়া, নেপালি, হিন্দি, মৈথিলি, ভোজপুরি, মগধি ও তেলুগু ভাষাতেও প্রচলিত। এই দুয়ার বা দরজা, হিমালয় পর্বতের প্রবেশদ্বার নাকি বিশেষ করে ভুটান যাওয়ার প্রবেশপথ (ভুটান থেকে সমতলের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের ১৮টি প্রণালী এই অঞ্চলে) তা নিয়ে একাধিক মত থাকতে পারে, তবে স্বর্গের দুয়ার বললে বোধহয় অতিশয়োক্তি হবে না। নেপাল ও উত্তর ভারতের ‘তরাই’ অঞ্চলের সমতুল্য বাংলার ডুয়ার্স। ৮,৮০০ বর্গ কিলোমিটারের বিস্তীর্ণ এই সমভূমিকে শঙ্কোষ নদী পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত ‘পশ্চিম ডুয়ার্স’ ও অসমের অন্তর্গত ‘পূর্ব ডুয়ার্স’-এ ভাগ করেছে।

একসময় কোচ রাজবংশের কামতা রাজ্যের অধীন এই অঞ্চলটির দখল নিয়ে ভুটানের সঙ্গে একাধিক সংঘর্ষ হয়েছে। ব্রিটিশ সরকার ভুটানের কাছ থেকে ১৮৬৫ সালে ডুয়ার্স পুনরুদ্ধার করার পর পূর্ব ভাগ জুড়ে যায় অসমের গোয়ালপাড়া জেলায় আর পশ্চিম ডুয়ার্স কালক্রমে ১৮৬৯ সালে জলপাইগুড়ি জেলা হিসাবে পরিচিত হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৪৯  সালে পশ্চিমবঙ্গ অঙ্গরাজ্যের একটি জেলা হিসাবে জলপাইগুড়ির অন্তর্ভুক্তি ঘটে। খানিকটা এই ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখেই হয়তো আমার ভ্রমণসূচীতে নিসর্গ দর্শনের পাশাপাশি ইতিহাস দর্শনটা শামিল ছিল। কুচবিহার, ডুয়ার্স এবং ভুটানের ফুন্টশোলিং শহরটা ঘুরে নেওয়ার পর আবিষ্কার করলাম গন্তব্য বাছাই একদিক দিয়ে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছে। এবারের সংক্ষিপ্ত সফরসূচিটাই জানাচ্ছি।

তাশিগোমাং স্তূপঃ প্রথম দিন বিকেলটা বরাদ্দ ছিল শিলিগুড়ির পুজো মণ্ডপগুলোর উদ্দেশ্যে। মাঝারি ভিড় অথচ জমজমাট আলো ঝলমল অসাধারণ মণ্ডপসজ্জায় ঘুরে বেড়ানোয় ক্লান্তি জাগে না, কারণ যানজটে আটকে ভিড়ে ফেঁসে নাকাল হতে হয় না। দুপুরে খাওয়ার পর বেরিয়ে নেমে পড়লাম একটি তিব্বতি বৌদ্ধ স্তূপ তথা বিহারে। এটা আসলে মূল ভ্রমণসূচীর বাইরে। আমাদের সেবক মিলিটারি স্টেশন থেকে বাজার যাওয়ার পথে ৩ কিলোমিটারের মধ্যে একটা খুচরো আউটিং। শিলিগুড়ি শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে এই ছোটো স্তূপটির কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিচিতি আছে। তিব্বতি লামা কালু রিনপোচে ১৯৯৬ সালে এটির প্রতিষ্ঠা করেন। এটির রক্ষণাবেক্ষণ করছে ড্রোডন কুনছব চোডি বুদ্ধিস্ট অ্যাসোসিয়েশন। জনৈক লামার কাছে এর বিষয় নানা তথ্য সংগ্রহ করলাম। নিজের কার্ডও দিল। দেখলাম ইংরেজিতে কথা বলার সময় হিন্দি বা বাংলা জানে না কথাটা জানানোয় বেশ দম্ভ ও তাচ্ছিল্য ছিল।

কোচবিহারঃ

গাড়ি নিয়ে প্রথমে ডেলো যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু পুজোর মধ্যে কোনও গাড়ি পেলাম না, বদলে তৎকালে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসের টিকিট পেয়ে গেছি আগের দিনই। অনেক চেষ্টায় সকালে শিলিগুড়ি স্টেশনে ছেড়ে দেওয়ার মতো একটা বাহন পাওয়া গেল। ভোর ৫.৩০-এ চারজন গেলাম নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে। ৭.১৫-য় উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস। বাগান, বাঁশবনের পরিচিত দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে আধো ঘুম আধো জাগরণে পেৌঁছে গেলাম নিউ কুচবিহার স্টেশনে সকাল ১০.১০  নাগাদ। একটা অটো প্রথমে ৮০০ টাকা হাঁকলেও পরে অন্য প্রতিযোগীদের কোটেশন অনুযায়ী ৬০০ টাকায় রাজবাড়ি-সহ অন্যান্য দ্রষ্টব্য স্থান দেখাতে রাজি হল। ভুটানের সঙ্গে সম্পর্কটা খুব মধুর ছিল না। ইংরেজ সরকারকেও যুদ্ধ করতে হয়েছে ভুটানের কবল থেকে বাংলার এই তরাই অঞ্চলকে মুক্ত রাখতে। ১৭৭২-১৭৭৩ সালে কোচবিহার ভুটান দ্বারা আক্রান্ত হয়। তাদের প্রতিহত করতে ৫ এপ্রিল ১৭৭৩-তে কোচবিহার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে সামরিক চুক্তি করে এবং ভুটানের দখলদারি মুক্ত হয়ে কোম্পানির অধীনে করদ রাজ্যে পরিণত হয়। স্বাধীনতার পর আগস্ট ১৯৪৯ পর্যন্ত কোচবিহার ভারত ভূখণ্ড বেষ্টিত রাজ্য ছিল। শেষ রাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ চুক্তি সাক্ষর করে ২০ আগস্ট ১৯৪৯ সালে কোচবিহারকে ভারতের অন্তর্ভূক্ত করেন।

কোচরাজপ্রাসাদঃ  ১৮৮৭ সালে রাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ এই বিশাল প্রাসাদটি নির্মাণ করান বৃটেনের ‘বাকিংহাম প্যালেস’-এর অনুকরণে। প্রাসাদটির নাম ‘ভিক্টর জুবিলি প্যালেস’। উত্তর-দক্ষিণে ১২০ মিটার দৈর্ঘ্য ও পূর্ব-পশ্চিমে ৯০ মিটার প্রস্থের মোট ৪৭৬৮ বর্গ মিটারের এই বিশাল অট্টালিকা আমার চোখে ভারতের অন্যান্য রাজপ্রাসাদের তুলনায় খানিক সাদামাটা মনে হল। কিন্তু এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব সাদামাটা নয়। মহারাজ নৃপেন্দ্র নারায়ণ কেশব চন্দ্র সেনের কন্যাকে বিয়ে করেন যার ফলশ্রুতিতে কোচবিহারে নবজাগরণ বা রেনেসাঁ এসেছিল মনে করা হয়। নৃপেন্দ্র নারায়ণকে আধুনিক কোচবিহারের রূপকার বলা হয়। বাগানটা শীতকালে নানা মরশুমি ফুলে সেজে থাকে। পুজোর ছুটি বলে স্থানীয় মানুষেরও ভিড় ছিল। প্রাসাদটি আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-র তত্ত্বাবধানে এবং এর অধিকাংশটা জুড়েই অফিস। কিয়দংশে আছে সংগ্রহশালা। সপ্তদশ থেকে একাদশ শতকের নানা পাথরের মূর্তি। লেপচা, ভুটিয়া, রাভা, রাজবংশী, মেচ, গোর্খা, টোটো ইত্যাদি উত্তরবঙ্গীয় উপজাতির সাংস্কৃতিক চিত্র, বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, মুদ্রা, শীলমোহর, পোশাক এবং অবশ্যই রাজা-রানিদের ছবির সংগ্রহ দেখলাম। ভুটানের সরকারি মোহর ও অন্যান্য নিদর্শন ছিল।

মদনমোহন মন্দিরঃ  রাজবাড়ি থেকে গেলাম মদনমোহন বাড়ি। কোচবিহার জেলা শহরেই এই মন্দির। ১৮৮৫-১৮৮৯-এর মধ্যে নৃপেন্দ্র নারায়ণের উদ্যোগে নির্মিত এই মন্দিরে মা কালী, মা তারা, মা ভবাণী এবং অবশ্যই মদনমোহনের বিগ্রহের নিত্য পুজো হয়। পুজোর ভিড়েও বেশ শান্ত মনোরম পরিবেশ। মন্দির সংলগ্ন আনন্দময়ী ধর্মশালা। কোচবিহার দেবত্র ট্রাস্ট বোর্ডের অধীনে মোট ২৭টি মন্দিরের প্রধান এটি। বাকি মন্দিরগুলোর তালিকাও এখানে দেওয়া আছে। এখানে এসে বাকি দর্শনীয় জায়গাগুলোর সন্ধান পেয়ে অটোওয়ালাকে বাড়তি ৮০ টাকা দিয়ে ঝটপট বুড়ি ছুঁইয়ে দিতে রাজি করালাম।

সাগর দিঘিঃ  একদিকে কোচবিহার পুরসভা আর এক দিকে নিউ কালেক্টোরেট বিল্ডিং-এর প্রতিবেশে এই হ্রদটি ভারি মনোরম। প্রাসাদ, মন্দির ইত্যাদি দেখার একঘেয়েমি কেটে যায় সাগর দিঘির পাড়ে এলে।

ব্রাহ্ম মন্দিরঃ  নৃপেন্দ্র নারায়ণের উদ্যোগে ১৮৬০-৮০-র মধ্যে নির্মিত ব্রাহ্ম মন্দির। গোটা জেলা ও শহর জুড়ে যেখানে হিন্দু মন্দিরের প্রাবল্য, সেখানে এই মন্দিরটি ঐতিহাসিক তাৎপর্যের জন্যই দর্শনীয়। রোমান স্থাপত্যের নিদর্শন এই মন্দির ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে কোচবিহারের বৈষ্ণবীয় হিন্দু সমাজের সহাবস্থানের সাক্ষ্য।

বড়োদেবী মন্দিরঃ  দেবীবাড়ি অঞ্চলে এই দুর্গা মন্দিরটি ইউরোপিয়ান স্থাপত্য শৈলীর নিদর্শন। দুর্গা পুজোর সময় বলে মস্ত মেলা বসেছিল।

ডাঙ্গার আই মন্দিরঃ  কোচবিহার শহরের গুঞ্জাবাড়িতে এই মন্দিরটি তৈরি করান শিবেন্দ্র নারায়ণের স্ত্রী কামেশ্বরী দেবী। সময়কাল ১৮৩৯-৪৭ সাল। এটা মদনমোহনের মাসির বাড়ি। আমরা অটো থেকে নামলাম না। আরও বহু জায়গায় যেতে হবে।

বাণেশ্বরঃ  শহর থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তরে গিয়ে পেলাম বাণেশ্বর শিব মন্দির। শিবলিঙ্গটি গর্ভগৃহের মেঝের ১০ ফুট নীচে। কাছাকাছি আছে অর্ধনারীশ্বর মন্দির। এখানে একটি জলাশয়ে কচ্ছপ প্রজনন ক্ষেত্র (টার্টেল নেস্টিং বিচ) আছে। আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার দুটি কচ্ছপ সংরক্ষণ সংস্থার অর্থানুকুল্যের কথা লেখা আছে। কচ্ছপকে ‘মোহন’ বলে উল্লেখ করা আছে হয়তো বিষ্ণুর কূর্ম অবতারের প্রেক্ষিতে।

সিদ্ধেশ্বরীঃ  বাণেশ্বর থেকে আরও ২ কিলোমিটার ভেতরে গেলাম সিদ্ধেশ্বরী মন্দির দেখতে। কোচবিহার শহর থেকে প্রায় ১১ কিমি দূরে এই মন্দির তৈরি করিয়েছিলেন মহারাজ হরেন্দ্র নারায়ণ ১৮৩০ সালে। পুরোহিতের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, দেবত্র বোর্ডের অধীনস্থ মন্দির ও ধর্মশালা বেনারসেও রয়েছে। জায়গাটাকে মন্দিরের বদলে গৃহস্থের শান্ত প্রাঙ্গণ বলে মনে হয়। মন্দির প্রাঙ্গণে একটি বৃক্ষ পবিত্র বৃক্ষ হিসাবে রক্ষিত। কাছাকাছি ধলগুড়িতে আছে সটিরহাট হ্যাচারি।

সারা কোচবিহার জলপাইগুড়ি জেলার মূল রাস্তা এমনকী গলিগুলোও অধিকাংশ অত্যন্ত স্বাস্থ্যবান। শুধু এই সিদ্ধেশ্বরী যাওয়ার রাস্তাটাই এখনও পাকা নয়, তবে কাজ চলছে। চাকচিক্যহীন মন্দিরগুলো কেবল ঐতিহাসিক কারণে আর ভ্রমণকাহিনি লেখার জন্য সিলেবাস কমপ্লিট করার কারণে দ্রষ্টব্য। আমাদের ক্লান্তই লাগছিল। তবু বুড়ি ছুঁতে চললাম দিনহাটা স্টেশনের দিকে কামতেশ্বরীর উদ্দেশ্যে। রাস্তায় এক জায়গায় দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম।

সিদ্ধিনাথ মন্দিরঃ  রাস্তায় পড়ল সিদ্ধিনাথ মন্দির। এটি আরও পুরোনো– ১৭৯৯-১৮৪৩-এর মধ্যে মহারাজ শিবেন্দ্র নারায়ণ দ্বারা নির্মাণ শুরু হয়ে শেষ হয় হরেন্দ্র নারায়ণের আমলে। টেরাকোটার এই মন্দিরটির পাঁচটি গম্বুজাকৃতি চূড়া।

কামতেশ্বরী মন্দিরঃ  দিনহাটা স্টেশন থেকে আরও ৮ কিমি যেতে হল। ১৬৬৫ সালে নির্মিত হয়েছিল মূল মন্দিরটি মহারাজ প্রাণ নারায়ণের রাজত্বকালে। সেটি ধবংস হয়ে যাওয়ায় দেবী কামতেশ্বরীর জন্য মন্দির পুনর্নিমাণ করা হয়।

ভেবেছিলাম সেদিনই শিলিগুড়ি ফিরব। কিন্তু ভ্রমণসূচী শেষ করে শহরে ফিরতে সন্ধে পেরিয়ে গেল। বাধ্য হয়ে রাজবাড়ির ঠিক মুখোমুখি মহারানি প্যালেস হোটেলে রাত্রিবাস করতে হল। কথা ছিল ২০ তারিখটা বিশ্রাম নেব আর অষ্টমীর অঞ্জলি দেব। ২১ তারিখে জলদাপাড়া আর বক্সা দেখার জন্য বিন্নাগুড়ি ক্যান্টনমেন্টের ইন্সপেকশন বাংলো বুক করা ছিল।

বিন্নাগুড়ি-জলদাপাড়াঃ

টানা গাড়ি যেহেতু পাওয়া গেল না, তাই জলপাইগুড়ির উত্তর-পূর্ব দিকে বক্সার জঙ্গল দেখার জন্য আবার ট্রেনই ভরসা। হুট করে হোটেল রিসর্টও পাওয়া মুশকিল হবে। তাই আমরা জলদাপাড়া ও বক্সা দেখেছিলাম বিন্নাগুড়িকে কেন্দ্র করে। জলদাপাড়া বা বক্সা ভ্রমণের জন্য বিন্নাগুড়ি যাওয়া মোটেই জরুরি নয়। গিয়েছিলাম বিন্নাগুড়ি ক্যান্টনমেন্টে ওর বন্ধু থাকে বলে। শুরুতেই বাধা। সকালবেলা ট্রেন ধরব, পুজোর মরশুমে চড়া দরেও কোনও গাড়ি ভাড়া পাওয়া গেল না। রাতে প্রবল বৃষ্টি। অগত্যা ওর অফিসের এক কর্মীর গাড়িতে সকাল ৬টায় শিলিগুড়ি স্টেশন। ৭.৩০-এর শিলিগুড়ি-বামনহাট প্যাসেঞ্জার ধরে বিন্নাগুড়ি। স্টেশনে গাড়ি নিয়ে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছিল আমাদের সম্পূর্ণ অজানা বন্ধুর বন্ধু। এমইএস-এর ইন্সপেকশন বাংলো-তে থাকা।

দুপুরে খেয়ে ওর বন্ধু জেমস্-এর সৌজন্যে পাওয়া একটা মারুতি এস্টিম নিয়ে বেরোলাম জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের উদ্দেশে। জলদাপাড়ায় হাতি সাফারির সময় সকাল ৯টা থেকে দুপুর ৩ টে। ১৫ জুন থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর প্রবেশ নিষেধ। হাতির পিঠে চড়ে জল জঙ্গল পেরিয়ে ওয়াচ টাওয়ার পর্যন্ত। এইটুকু যাত্রায় কয়েকটা পাখি, নেউল, বাঁদর আর হরিণ ছাড়া অন্য কোনও পশু চোখে পড়ল না। তবে ওয়াচ টাওয়ার থেকে গণ্ডার, বাইসন এবং দূরে চিতা দেখা গেল। এই চিতা চা বাগানের ত্রাস, না চাইতে হানা দিয়ে প্রলয় ঘটায়। আর আমরা দেখতে এসেছি দেখে কত ভাও খাচ্ছে। আর যে হাতিটার পিঠে চড়ছিলাম সে ছাড়া কোনও বুনো হাতি তো সামনে এল না, দূরেও দেখা গেল না। ১৪১ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত এই বনভূমি দিয়ে বয়ে গেছে তোর্সা নদী। জলদাপাড়ার সুপারস্টার একশৃঙ্গ গণ্ডার। তাছাড়া স্বমহিমায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হাতি, বুনো শুয়োর, চিতাবাঘ, সম্বর হরিণ, বার্কিং ডিয়ার, হগ ডিয়ার ইত্যাদি আছে। আর আছে ৩৫০ প্রজাতির পাখি। মেছো ঈগল আর ধনেশ চোখে পড়ল। সাপেরা এখন শীতঘুমে।

প্রবেশমূল্যঃ  ২৫ টাকা (ভারতীয়) ও ১০০ টাকা (বিদেশি)। হাতি সাফারিঃ ১৪০ টাকা মাথাপিছু। জিপ সাফারিঃ  ৪৫০ টাকা। অন্য গাড়িঃ  ৫০-২০০ টাকা। গাইডঃ ১০০ টাকা গাড়ি পিছু। ক্যামেরাঃ  ২৫ টাকা (স্থির) ও ২৫০ টাকা (ভিডিও)। মাদারিহাটে ওয়াইল্ডলাইফ ওয়ার্ডেন্স অফিস থেকে সাফারির পারমিট করাতে হয়।

দক্ষিণ খয়েরবাড়ি প্রকৃতি উদ্যানঃ  ফেরার পথে এই উদ্যান দেখতে গেলাম। রাস্তা থেকে অনেক ভেতরে। রাস্তাও পাথুরে এবড়ো খেবড়ো। ভেতরে পার্কে সার্কাস থেকে উদ্ধার করে পুনর্বাসন দেওয়া কয়েকটা বাঘ ও চিতাবাঘ। ডাব খেলাম। বিশেষ কিছু দেখার নেই।

গোসাইঘাটা ইকো পার্কঃ  পশ্চিমবঙ্গ সরকার পরিচালিত এই ইকোপার্কে সময়াভাবে আর ঢুকিনি।

এই দুই জায়গায় নতুন কিছু দেখার মতো পেলাম না, তবে বন ও চা বাগানের যুগলবন্দিটা সারা পথ তাড়া করে বেড়ালেও একঘেয়ে লাগে না। ডুয়ার্সের এই বিশেষত্বই পর্যটকদের টানে সবচেয়ে বেশি। বন্যজন্তুর দেখা মিলুক না মিলুক, ছায়াতরুর পায়ের নীচে ঘন সবুজ চা গাছের সারি চিরে মসৃণ রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটলে মনে হয়, এই পথ যেন সত্যি না শেষ হয়।

বক্সা জাতীয় উদ্যান ও অভয়ারণ্যঃ ২২.১০-এ বিন্নাগুড়ি ক্যান্টনমেন্ট থেকে আগের দিনের গাড়িটা নিয়ে গেলাম জয়ন্তী জঙ্গলে ঢোকার পারমিট করাতে। বক্সা জঙ্গলের অন্তর্ভুক্ত জয়ন্তী জায়গাটাই খুব সুন্দর। প্রবেশের জন্য জন প্রতি ১৭০ টাকা প্রবেশমূল্য ও গাড়ির জন্য আলাদা টাকা দিতে হল। ভিডিও ক্যামেরা হলে তার বাড়তি শুল্ক। এমনি ক্যামেরারও নাকি চার্জ আছে, তবে মোবাইলে ক্যামেরা থাকলে কিছু বলার নেই। ‘ডিফেন্স’ লেখা গাড়ি বলে ছাড় হল না। জয়ন্তী নদীর নামে শহরের নাম। বেশিরভাগ পর্যটক রাজাভাতখাওয়া থেকেই পারমিট করায়। আমরা ওদিকটা যাইনি।

জয়ন্তী থেকে ১৩ কিমি হেঁটে ‘মহাকাল’ গুহা পেরিয়ে বক্সা যাওয়ার রোমাঞ্চই আলাদা। ‘মহাকাল’ একটা স্ট্যালেগমাইট ও স্ট্যালেগটাইট জাতীয় চূনাপাথর দিয়ে প্রাকৃতিক উপায়ে সাজানো গুহা। একগাদা ত্রিশূল পতাকা লাগিয়ে গুহাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বারোটা বাজানো হয়েছে। চাইলে সাঁওতালবাড়ি থেকে ৩.৯ কিলোমিটার ট্রেক করে বক্সা যাওয়া যায়। সময় লাগে প্রায় ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট। তা ছাড়াও বেশ কয়েকটা ট্রেকিং রুট আছে যেমন ‘রোভার্স পয়েন্ট’ পর্যন্ত হাঁটা। পদব্রজে চলার জন্যও অনুমতিপত্র নিতে হয়। ‘পদসংখ্যা পথ ট্রেক’ যা বক্সা কেল্লা থেকে আদমা হয়ে রাইমাতুং পর্যন্ত গেছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ট্রেক রুট। অনেককে হাঁটতে দেখলাম। এর জন্য বন বিভাগের গেস্টহাউস বা বন সংলগ্ন হোটেলে থেকে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে হয়। হেঁটে ডুপকা গ্রামেও যাওয়া যায় যেখানে ‘পুকরি মারি’ নামে একটা পুকুর আছে। শিঙি মাগুরে কিলবিল করা জলাশয়টা হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় সম্প্রদায়ের কাছে পবিত্র। ডুপকা গ্রামের ডুপকা উপজাতির মানুষরা আসলে ভুটান থেকে আগত মহাযানপন্থী বৌদ্ধ সম্প্রদায়। ‘ডুকপা’ কথাটা ‘ড্রুকপা’ শব্দ থেকে এসেছে।

যাইহোক, বাঘের সন্ধানে সুন্দরবন থেকে বক্সা। নোনা জল থেকে পাহাড়ি অরণ্য দাপিয়ে বেড়ানো ডোরাকাটা। উত্তর দিকে ভুটান-ভারতের আন্তর্জাতিক সীমানা বরাবর ছুটেছে সিনচুলা পর্বত, পূর্ব সীমান্ত ছুঁয়েছে অসম রাজ্য আর দক্ষিণে রয়েছে ৩১ নং জাতীয় সড়ক। বক্সা পাহাড়ের গায়ে বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প তৈরি হয়েছিল ১৯৮৩-তে ভারতের ১৫তম বাঘ সংরক্ষণ কেন্দ্র হিসাবে। পরে ১৯৯১ সালে বক্সা অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হয় ৩১৪.৫২ বর্গ কিলোমিটার যার মধ্যে ১১৭.১০ বর্গ কিলোমিটার বক্সা জাতীয় উদ্যান। তরাইয়ের নিজস্ব বাস্তুতন্ত্র। তবে ডুয়ার্সের অন্যান্য অরণ্য থেকে এর ফারাক এর পাহাড়ি ভূ-প্রকৃতিতে।

উত্তরে প্রায় লাগায়ো ভুটানের ফিপসু বন্য প্রাণী অভয়রাণ্য আর পূর্বে মানস জাতীয় উদ্যান। ফলে বক্সার জঙ্গল এশিয় হাতিরা ভুটান ভারত পারাপারের পথ হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। এই সংরক্ষিত বনাঞ্চলকে মূলত পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে ভাগ করা হয়। বাঘ ছাড়াও এশিয় হাতি, গউর, বুনো মোষ, বুনো শুয়োর, সম্বর হরিণ, সিভেট, চিতাবাঘ, জংলি কুকুর, প্যাঙ্গোলিন, কালো ভালুক, লাল জংলি মোরগ, চার প্রজাতির ধনেশ-সহ ২৮৪ ধরনের পাখি এই বনের অন্যতম আকর্ষণ যদিও তেনাদের সাক্ষাৎ পাওয়া বিরল সৌভাগ্যের। আমরা গাড়িতে যেতে যেতে অবশ্য যে পাখিগুলো দেখলাম তার মধ্যে ধনেশ আর বুলবুল ছাড়া আর কাউকে চিনতে পারলাম না। শালিক আর বকও ছিল। কিন্তু ওগুলো তো দ্রষ্টব্যের মধ্যে পড়ে না। তবে বনের বন্য সৌন্দর্য, বন্য প্রাণী অদর্শনের হতাশা মিটিয়ে দিল। এমনিতে অক্টোবর থেকে মার্চ হল ঘোরার সময়। পুজোর সময় বর্ষাস্নাত বনের সবুজ দারুণ মায়াবী।

ওয়াচ টাওয়ারে উঠে দু-তিনটে হাতি ও কয়েকটা হরিণকে তিড়িং-বিড়িং করে একটু দেখা দিয়েই মিলিয়ে যেতে দেখে তেমন রোমাঞ্চ হল না। গেলাম ঐতিহাসিক বক্সা কেল্লা দেখতে যা ব্রিটিশ ভারত ভুটানের কাছে ১৮৬৫ সালে যুদ্ধে জিতে নিয়েছিল। এই কেল্লা অবশ্য পরবর্তী কালে পরাধীন ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কয়েদ করে রাখার কাজেও ব্যহূত হয়েছে। এই অরণ্যে ‘মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ’ শিব মন্দির আছে যেখানে শিব চতুর্দশীর দিন ১০,০০০ ভক্ত জমায়েত হয়। সেটাও বুড়ি ছুঁয়ে নিলাম। শাল, শিমুল, চম্পা, গরম, চিক্রাসি কোনটা কোন গাছ ঠাওর করে উঠতে না পারলেও, গাছের ছায়ায় ঘুরে বেড়াতে দারুণ লাগছিল। আর গাছ বেয়ে যাদের উঠতে দেখলাম প্রথমটায় বুঝতে পারিনি ওরা কারা। একটু লক্ষ্য করতে দেখলাম ওরা প্রকাণ্ড কাঠবেড়ালি। অনেক প্রজাতির সাপও রয়েছে যাদের সঙ্গে মোলাকাতের খুব একটা ইচ্ছা ছিল না আমার সহ পর্যটকদের। কিন্তু জঙ্গলের সুপার স্টার রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের দেখা পেলাম না।

বর্ষার পর পুজোর সময়টা এমনিতেই বন্য জন্তু দেখার জন্য প্রশস্ত নয়। বরং শুনলাম বেশ উদ্বেগজনক খবর। খাতায় কলমে ব্যাঘ্র সংরক্ষণ ক্ষেত্রতে যত সংখ্যক বাঘ থাকার কথা বাস্তবে সংখ্যাটা তার ধারে কাছেও নেই। চোরা শিকারটা উন্মুক্ত গোপনীয়তা। কোনও ফরেস্ট অফিসার নিজের কোয়ার্টার থেকে বাঘের ডাক শুনতে পেলে সভয়ে বুঝতে পারেন অন্তত একটা হলেও আছে। বক্সা পোস্ট অফিসও দ্রষ্টব্য কারণ এখনও নাকি এখানে রানারদের দ্বারা চিঠি বিতরণ করা হয়। ওটা অবশ্য আমাদের দেখা হল না।

সব দোষ চোরা শিকারের নয়। ভুটান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি নদীগুলো এত পলি বয়ে এনে তরাই অঞ্চলে বিছিয় দেয়, যে বন্যা একটা লাগাতার সমস্যা। এর ফলে এমন অনেক প্রাণীও বিলুপ্তির পথে যারা শিকারিদের কাছে ততটা জনপ্রিয় নয়। তাছাড়া চোরাচালানকারী এমনকী অসম থেকে উগ্রবাদীরা ঢুকে গাছপালা কেটে নিয়ে জায়গাটা নষ্ট করছে।

বিন্নাগুড়ি ফিরতে রাত হয়ে গেল। নেহাত রান্নার বালাই নেই। সন্ধে থেকে ইনস্পেকশন বাংলোর ডাইনিং-এ কিছু বন্ধু তাদের পরিবারকে নিয়ে ছোটো আড্ডা ও নৈশাহার-এর জমায়েতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা স্ন্যাক্স পানীয়র পর্ব পার করে পেৌঁছোনোয় সরাসরি খাবার টেবিলেই বসতে হল। ওর বন্ধু জেমস-এর অনুরোধ রেখে পরের দিনটাও থাকা গেল না। আমাদের কলকাতা ফেরার টিকিট কাটা রয়েছে। ভদ্রলোক খুব উৎসাহিত হয়ে নিজেদের ক্যান্টনমেন্ট ঘুরিয়ে দেখাতে চাইছিলেন। অবশ্য এই ক্যান্টনমেন্টের চেয়ে ওর বর্তমান দফতর তথা আবাসস্থল যে মিলিটারি ক্যাম্পে তা অনেক অনেক গুণ সুন্দর।

সকালে বামনহাটা-শিলিগুড়ি ইন্টারসিটি ধরে ফেরা। যাদের আরও দূরে ফিরতে হবে, তারা নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন যাবেন অথবা বাস স্টপ। ফেরার পথে যথারীতি রেস্তোরাঁ থেকে দুপুরের খাবার কিনে নেওয়া।

সেবক মিলিটারি স্টেশন ঢুকেই শুনলাম বুনো হাতির একটা ছোটো দঙ্গল এসে অনেক অনর্থ করে গেছে। হায় রে। হায় রে বক্সাদুয়ার, হায় রে জলদাপাড়া, হায় রে উজিয়ে ঘোরা!

সঙ্গের সহায়ঃ ছাতা, ওষুধ, যথেষ্ট শীতবস্ত্র, ক্রিম, লোশন, সানস্ক্রিণ লোশন আর ভুটান যেতে হলে অবশ্যই নিজের ছবি ও পরিচয়পত্র। ভুটানের জন্য মুদ্রা পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। সর্বত্র ভারতীয় টাকা চলে ও বিনিময় একই।

যাত্রার উপায়ঃ  বিমানে বাগডোগরা হয়ে যেতেই পারেন। তবে কলকাতা থেকে নিউ জলপাইগুড়ির অজস্র ট্রেন। শিয়ালদা থেকে দার্জিলিং মেল, পদাতিক, উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস, কাঞ্চনকন্যা, কাঞ্চনজঙঘা, হাটেবাজারে ইত্যাদি। কলকাতা স্টেশন থেকে গরিব রথ, কলকাতা হলদিবাড়ি, কলকাতা-ডিব্রুগড় ইত্যাদি। হাওড়া থেকে শতাব্দী, তিস্তা-তোর্সা, হাওড়া-এনজেপি এসি এক্সপ্রেস (সপ্তাহে দু’দিন), গুয়াহাটি এক্সপ্রেস, হাওড়া-কাটিহার এক্সপ্রেস, কর্মভূমি ইত্যাদি। মরশুমে এত ট্রেনেও টিকিটের আকাল পড়ে যায়। তাছাড়া ধর্মতলা থেকে রাজ্য সরকারের রকেট, ও বিভিন্ন প্রাইভেট ভলভো ছাড়ে শিলিগুড়িগামী। আসানসোল, অন্ডাল ও বোলপুর থেকেও এনজেপি-র ট্রেন আছে।

সাতদিনে মণিপুর ও নাগাল্যান্ড

আমাদের ১৩ জনের দলটি যখন সরাইঘাট এক্সপ্রেসে গুয়াহাটি পৌঁছোল সকাল ১০টা নাগাদ, তখনও জানতাম না ‘১৩’ এতটা ‘লাকি’ এবং এতটা ‘আনলাকি’ সংখ্যা হতে পারে। রিটায়ারিং রুমে স্নান সেরে চা খেয়ে ফ্রেশ হলাম কিন্তু ২-টোর বাসে সিট নেই, অতএব ৬-টার বাসে রওনা হতে হবে। কী আর করা অগত্যা বাসস্ট্যান্ডের ওয়েটিং রুমে বসে থাকা। তখন তো জানি না আরও কত বসে থাকা আছে কপালে। অবশেষে প্রতীক্ষিত সময় এল, বাসে ওঠা হল।

ঠিক ৬-টায় বাস ছাড়ল। তখন আঁধার নেমেছে আকাশে। তাছাড়া মেঘও দখল নিয়েছে সেখানে। পূর্ণিমার রাত হওয়া সত্ত্বেও চাঁদ হারিয়ে গেছে মেঘ নগরীতে। সাড়ে ন-টা নাগাদ একটা ধাবার সামনে বাস থামল। আমরা নৈশভোজে বসলাম, কিন্তু খাদ্যদ্রব্য মুখে তোলার মতো নয়। জায়গাটির নাম জাখলবান্ধা। এখানে প্রচুর নারকেল বিক্রি হচ্ছে, বাসওয়ালারা অনেক নারকেল কিনলেন। তারপর সেগুলি বাসের মাথায় তোলা হল। ১০টা নাগাদ আবার বাস ছাড়ল। সবে চোখ লেগেছে, বাস গেল দাঁড়িয়ে– ঘড়িতে তখন সাড়ে এগারোটা। শোনা গেল পথে কী যেন গোলমাল হয়েছে। বাস থেকে নামলাম পূর্ণচাঁদের আশায়। কিন্তু চাঁদ তখনও নিখোঁজ।

আধো ঘুমে আধো জাগরণে রাত তিনটে নাগাদ আবার বাস চলল। ঘুমিয়ে পড়েছি, হঠাৎ বাস থেমে গেল। সামনের পথে নাকি কারফিউ চলছে। ঘড়িতে ৪-টে, ভোরের আলো ফুটি-ফুটি, বাস থেকে নেমে দেখি বাস-লরি-গাড়ির বিশাল লাইন। জায়গাটির নাম রংগাজার্স। ব্যাপার খানিক জানা গেল। অসমের দুটো ট্রাইবের মধ্যে মারামারি হয়েছে। তাই কারফিউ জারি হয়েছে। অতএব এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধৈর্যের পরীক্ষা দেওয়া।

যাইহোক, এখানে একটা দোকানে পুরি-তরকারি আর চা খাওয়া হল। তারপর ১০টা নাগাদ বাস ছাড়ল। পথের দুধারে শুধু সবুজের আন্তরিকতা, চা বাগানের সবুজ, তারপর শুরু হল নরম সবুজ শষ্যখেত। খেত শেষ হতে শুরু হল অরণ্য। গভীর বন– কার্বিআংলং। কিছুদূর যাবার পর পথের ওপর একটা বোর্ডে দেখলাম লেখা আছে ‘গরম পানি’। শুনলাম এখানে হট স্প্রিং আছে। আর কিছুটা এগিয়ে আবার দাঁড়িয়ে গেল বাস। আমরা মানসিক ভাবে এবার সত্যিই ভেঙে পড়লাম। কী জানি কি হয়। অবশেষে প্রায় ঘন্টা খানেক পর বাস ছাড়ল। খানিকক্ষণ চলার পর দেখলাম একটা নদীর ধারে খুন হওয়া মৃতদেহগুলির, পুলিশ পাহারায় সৎকার করা হচ্ছে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল, মানুষের হিংসার বলি আর কত হবে কে জানে! যাই হোক, পথে আর বাস থামেনি।

১২টা নাগাদ ডিমাপুর পৌঁছোলাম। বেশ বড়ো শহর। শহর ছাড়িয়ে আবার সবুজ চিরে পথ, ভালো লাগছে এই পথ চলা। ১টা নাগাদ এক জায়গায় থামা হল লাঞ্চের জন্য। হোটেলের নাম মণিপুর রাইস হোটেল। মাছটা খুব সুস্বাদু ছিল। আবার চলা, ৪টে নাগাদ নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমায় পৌঁছোলাম। পাহাড়ের ওপর বেশ বড়ো শহর। হঠাৎ মেঘের দখলে চলে গেল আকাশ আর সঙ্গে সঙ্গে আঁধার ঘনাল। রাত্রি ৭-্৩০ মিঃ নাগাদ মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলে পৌঁছোলাম।

ডিম্বাকৃতি এই উপত্যকার আয়তন প্রায় ২,২৫০ বর্গ কিমি। বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক বিস্ময় এই উপত্যকা। অনেকে বলেন পূর্ব ভারতের সুইজারল্যান্ড হল মণিপুর। সত্যিই মণিপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়। দীর্ঘকাল ধরে স্বাধীন ছিল এই রাজ্য। ১৮৯১ সালে ব্রিটিশের হাতে শেষ স্বাধীন রাজা টিকেন্দ্রজিতের ফাঁসির পর, মণিপুর ব্রিটিশের দখলে চলে যায়। মণিপুরি নৃত্য আজ ভারত ছাড়িয়ে আবিশ্ব নৃত্য রসিকদের মনোরঞ্জন করে চলেছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ এই নৃত্যধারাকে নিজের রচিত নৃত্যনাট্যে ব্যবহার করেছেন। আর সারা পৃথিবীর খেলাধূলার দরবারে পোলো খেলাটিও উপহার দিয়েছে এই মণিপুর।

ইম্ফলে টাম্ফা হোটেলে ওঠা হল। তারপর ঘর পেয়ে হাতমুখ ধুয়ে নৈশভোজ সারতে একটা দোকানে গেলাম। না, কোনও কিছু মুখে দেওয়া গেল না। ফিরে এসে ক্লান্ত দেহকে বিছানায় ফেলে দেওয়া।

পরের দিন সাড়ে পাঁচটায় বিছানা ত্যাগ। ৫ টাকা দিয়ে এক বালতি গরম জল পাওয়া গেল। দু’দিন পর স্নান সেরে, তৈরি হওয়া। তারপর তিন বন্ধুতে মিলে কাছাকাছি একটু প্রাতর্ভ্রমণ সেরে এলাম। ৮-টা নাগাদ ব্রেকফাস্ট সেরে ৯টার সময় দুটো মারুতি ভ্যানে চেপে আমাদের দল রওনা হল উত্তর-পূর্ব ভারতের বৃহত্তম লেক ‘লোকতাক’-এর উদ্দেশ্যে। শহর ছাড়াতেই সবুজের মাখামাখি। পথের দুধারে ইউক্যালিপটাস গাছের সারি আমাদের গার্ড অব অনার জানাল। তরুবীথি ছাড়িয়ে কচি ধানের নরম সবুজ আর পাকা ধানের হলুদ মিলেমিশে দিগন্ত বিস্তৃত খেত। আকাশ নিবিড় নীল, তাতে সাদা মেঘের কারুকাজ। খেত পেরিয়ে টিলা পাহাড়ের সারি। অসাধারণ লাগছে এই পথচলা। এইবার আমাদের পথের বাঁদিকে পড়ল ইম্ফলের এয়ারপোর্ট, পড়ল বিষ্ণুপুর (২৭ কিমি) তারপর ফুবালা (৪০ কিমি) হয়ে পৌঁছে গেলাম লোকতাক লেকের কাছে। গাড়ি থেকে যখন নামলাম তখন ঘড়িতে সাড়ে এগারোটা বাজে। লেকের পূর্ণরূপ দেখতে সেন্দ্রা দ্বীপের টিলার ওপর ভিউপয়েন্টে উঠলাম। দু-চোখ ভরে দেখলাম দিগন্ত প্রসারিত জলরাশি আর তার উপর গোলাকৃতি ভাসমান দ্বীপরাজি। নীল আকাশ আর সাদা মেঘ জলে ছবি আঁকছে। আশ্চর্য সুন্দর লাগছে। লেকের জলে ভাসমান দ্বীপের ওপরে নির্মিত রেস্টুেরেন্টে বসে চা খেতে খেতে চারিদিকের মনোরম দৃশ্য চোখ কেড়ে নিল। এত ভালো লাগছিল যে ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। লেকের ওপর ভাসমান বুললামজো ন্যাশনাল পার্ক বলা হয়, যেখানে নাচুনে হরিণের বাস। কিন্তু এখন সেখানে যেতে দেওয়া হয় না। এই পার্কের খ্যাতি বিশ্বজোড়া।

এবার যাওয়া হল মৈরাং-এর আইএনএ মিউজিয়াম দেখতে। নেতাজির মূর্তি এবং সেই ঐতিহাসিক বেদি যেখানে ১৯৪৪ সালে ১৪ এপ্রিল পরাধীন ভারতের মাটিতে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে আজাদ হিন্দ বাহিনী। মিউজিয়ামে আইএনএ এবং নেতাজির নানা ছবি, তাঁর ব্যবহৃৎ কিছু জিনিস, যুদ্ধে ব্যবহৃৎ কিছু গুলি-বন্দুক-ছোরা প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্র সাজানো রয়েছে। মিউজিয়াম দেখা শেষ করে, মৈরাং শহরের কাছেই বনদেবতা যানজিং-এর মন্দির দেখতে গেলাম। মণিপুরের লোকগাথার অমর দুই চরিত্র খাম্বা ও থেইরিকে নিয়ে রচিত প্রেমগীতি আর নৃত্যশৈলীর উৎপত্তি এই মৈরাং থেকে।

এবার গন্তব্য বিষ্ণুপুর। এখানকার থানার পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে ১৪৬৭-এ নির্মিত প্রাচীন বিষ্ণুমন্দিরের দিকে। মন্দির দর্শন করলাম, সুন্দর মন্দির স্থাপত্য কিন্তু দেবতা দর্শন হল না। কারণ মন্দিরের দ্বার ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। এবার দেখা হলো লৌকিপাত ইকোপার্ক এবং সামনে বিষ্ণুপুরের ডিসি-র অফিস। জায়গাটি খুব সুন্দর। এরপর পথে পড়ল ‘ইন্ডিয়ান পিস মেমোরিয়াল’। নামকল বাজার ছাড়িয়ে দেখা যায় এই স্মৃতিসৌধটি যা জাপানি সহযোগিতায় নির্মিত হয়েছে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে নিহত সৈনিকদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। পথে আসতে আসতে দেখলাম একদল সাদা ধুতি পরা ও সাদা চাদর গায়ে লোক, বাস থেকে নেমে একটি বাড়ির দিকে সদলবলে যাচ্ছে, মনে হল বরযাত্রী। দেখে বেশ ভালো লাগল।

এবার এয়ারপোর্ট রোডের উপর ইসকন মন্দির দেখতে গেলাম। মন্দির নির্মাণ এখন সম্পূর্ণ হয়নি। যেটুকু দেখলাম খুব সুন্দর স্থাপত্যই নির্মিত হচ্ছে। রাধা গোবিন্দর বিগ্রহ অপরূপ সুন্দর। সব দেখা শেষ করে ৫টার সময় পথের একটা দোকানে কফি খেয়ে হোটেলে ফিরলাম। কারণ সন্ধ্যার পর এখানে কেউ বাইরে বার হয় না।

পরের দিন ভোর ৫টার মধ্যেই উঠে পড়লাম। গরমজলও পাওয়া গেল। অতএব স্নান সেরে তৈরি হয়ে হাঁটতে বেরিয়ে পড়লাম। প্রধান সড়ক ছেড়ে অপ্রশস্ত পথ ধরলাম। চোখে পড়ল পর্বতারোহণ সংস্থার শিক্ষাকেন্দ্র, যুব আবাস। তারপর খোমান লামপাক স্টেডিয়ামের বিশাল কম্পাউন্ডের প্রাচীর ধরে পরিক্রমা করলাম, প্রায় ৫-৬ কিলোমিটার পথ। গেটের কাছে এসে দেখলাম অনেক ছেলেমেয়ে শরীরচর্চা ও সাইক্লিং করছে। কাছেই একটি সুন্দর চার্চ দেখলাম আর দেখা হল একটি রাধাগোবিন্দ জীউয়ের প্রাচীন মন্দির। রাধাগোবিন্দের মূর্তি দুটি অপরূপ। তারপর ইম্ফল নদীর ধার ধরে খানিক হেঁটে, নদীর উপর কাঠের সাঁকো পেরিয়ে হোটেল মুখো। তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে অটোতে ওঠা হল। শহরের দ্রষ্টব্য দেখার অভিলাষে। প্রথমেই যাওয়া হল গোবিন্দজির মন্দির। এটি মণিপুরের বিখ্যাত মন্দির। মন্দিরের বিশাল প্রাঙ্গন। প্রাচীন তো বটেই, স্থাপত্যও খুব সুন্দর। সর্বত্র, একটি শুচি-স্নিগ্ধতা বিরাজ করছে। রাধাগোবিন্দজির মূর্তি অনুপম মাধুর্যে ভরা। পাশের মন্দিরে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রাদেবীর মূর্তি বিরাজ করছে। এখানকার দেবতার নৈবেদ্য দেবার ব্যবস্থাটি বেশ অভিনব। কলাপাতাকে গোল করে কেটে তার চারপাশেও পাতাকে কেটে ডিজাইন করে ফল মিষ্টি দেওয়া হয়। ফলও সুন্দর করে কাটা, তার সঙ্গে টাটকা দুটি চাঁপা ও একটি জবাফুল। সত্যিই প্রসাদ পেয়ে মন, মাধুর্যের স্পর্শে ভরে উঠল।

মন্দিরের সামনে মণিপুরি শৈলীতে নির্মিত বিশাল বাঁশের কাজের নাটমণ্ডপ, শুধু ঐতিহ্যবাহী নয়, অসাধারণ এর শিল্পশ্রী। গোলাপি মেখলা আর সাদা চাদরে সজ্জিত মণিপুরি মহিলারা বসে আছেন মন্দিরের চাতালে। চারিদিকে পবিত্রময় শান্তি বিরাজ করছে। মন্দির প্রাঙ্গনের মধ্যেই বিশাল উঁচু ঘন্টাঘর। আর দেখলাম রাধাকুণ্ড, শ্যামকুণ্ড, গোপেশ্বর মহাদেব মন্দির। সবই মন্দিরের প্রাঙ্গনের মধ্যেই। মন্দির দেখে মন পূর্ণ হয়ে উঠল। মণিপুরিরা বেশির ভাগই গোবিন্দজির ভক্ত অর্থাৎ বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের লোক।

মন্দিরের কাছেই মণিপুর রাজপ্রাসাদ। সে রাজাও নেই, সেই রমরমাও নেই। তবু ভালো লাগল রাজাদের স্মৃতি বিজড়িত এই প্রাচীন রাজপ্রাসাদ দেখতে। ভিতরে প্রবেশের অনুমতি নেই, সামনে থেকে দেখেই ফিরতে হল। এবার গেলাম মহাবলী মন্দির দেখতে। হনুমানজির প্রাচীন মন্দির। মূর্তিটি শুধু সুন্দরই নয় খুব অভিনব, মন্দিরের স্থাপত্য শৈলীও সুন্দর। তবে মন্দিরঅঙ্গন বানরে পূর্ণ। চলাফেলা করতে একটু যেন ভয় পাচ্ছিলাম বানরের জন্য।

এরপর যাওয়া হল মণিপুর স্টেট মিউজিয়াম দেখতে। প্রাণীতত্ত্ব, ছবি, পোশাক, মণিপুরিদের নানা স্ট্যাচু। তাছাড়াও মণিপুরি জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় নানান সংগ্রহ। মিউজিয়ামের সামনেই একটি পার্কের মধ্যে শেষ স্বাধীন রাজা টিকেন্দ্রজিতের স্মৃতিসৌধ। এইখানেই নাকি তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। এরপর দেখলাম ঐতিহাসিক কাংলা ফোর্ট। টিকেন্দ্রজিৎকে ক্ষমতাচ্যুত করে একদা যার দখল নেয় ইংরেজরা। স্বাধীনতার পর অসম রাইফেলস্-এর হাতে যায় এই কেল্লা। মনোরমার ঘটনার পর অসম রাইফেলস্কে উচ্ছেদ করা হয় এখান থেকে। আজও চিত্রাঙ্গদার দেশের বীর রমণীদের প্রতিবাদ যথাযথ মূল্য পায়।

এবার যাওয়া হল খৈরম্বন্ধ বাজারে। শুরু হল প্রবল বৃষ্টি। বিশাল বাজারে নানা রকমের পণ্যসামগ্রী কিন্তু দেখা সম্ভব হল না। বৃষ্টির জন্য ফিরে আসতে বাধ্য হলাম হোটেলে। দুপুরে লাঞ্চ করে এখানকার ওয়ার সিমেট্রি দেখতে গেলাম। এখানকার রাস্তাঘাটের অবস্থা বড়োই শোচনীয়। বৃষ্টি পড়ে জলে কাদায় করুণ দশা। যাই হোক, হোটেলের কাছেই, হেঁটেই পৌঁছে গেলাম। সবুজ লনে শুয়ে আছে সবুজ প্রাণগুলি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বলি, বেশির ভাগের বয়সই চ্প্ত-এর নীচে। মানুষের অমানবিকতায় লজ্জা মিশ্রিত দুঃখবোধে মন বিষণ্ণ হল। সত্যিই, মানুষের কলঙ্ক এই যুদ্ধবৃত্তি, থামবে কি কখনও? একে মেঘে ঢাকা আকাশ, তায় ভারতের একেবারে পূর্বপ্রান্ত, তাড়াতাড়ি অন্ধকার নেমে এল। ফেরা হল হোটেলে।

পরদিন বাসে করে নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমায় যাওয়া হবে। সকাল সকাল বাস ছাড়ল, কিন্তু কিছুদূর গিয়েই বাস থেমে গেল। বাসের ড্রাইভার আর হেল্পার নাকি এখন খাওয়াদাওয়া করবে। ঘন্টা খানেকের ওপরে লাগিয়ে দিল। আবার খানিক চলা, তারপর বাস আবার থামল, আমরা লাঞ্চ করলাম। কিছুক্ষণ চলার পর হঠাৎ বাস থেমে গেল, কী ব্যাপার– না, খারাপ হয়েছে। আবার এক ঘন্টা। এই ভাবে অনেক সময় নষ্ট হল। প্রায় সাড়ে চারটে নাগাদ কোহিমায় পৌঁছোলাম। সামান্যক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নেমে এল আর সঙ্গে সঙ্গে এখানকার দোকানপাটও সব বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের এখানকার হোটেলটি বেশ ভালো। ঘরগুলি বেশ বড়ো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। খাবারদাবারও বেশ ভালো। নাম হলিডে ইন। ঘরের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে চমক লাগানো মুগ্ধতায় শুধু চেয়ে রইলাম, পাহাড়ি কোহিমা তখন আলোর মালায় সেজে উঠেছে।

পরের দিন ভোরে উঠে তৈরি হওয়া গেল। কোহিমার পথে প্রাতর্ভ্রমণে বার হলাম। পাহাড়ি পথে চারিদিকের বৃষ্টিধোয়া সবুজের আন্তরিকতায় পথ চলতে খুব ভালো লাগছিল। এখানে প্রচুর চার্চ এবং চার্চগুলি বেশ দর্শনীয়। কিছুক্ষণ হাঁটার পর মধ্যে অনেকগুলি চার্চ দেখলাম। নাগারা বেশির ভাগই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। হোটেলে ফিরে দেখি সবাই তৈরি হয়ে গেছেন। তাড়াতাড়ি ডাইনিং হলে গিয়ে ব্রেকফাস্ট সারলাম। তারপর দুটো সুমো ভাড়া করে প্রথমে যাওয়া হল এখানকার নিউ সেক্রেটারিয়েট ভবন দেখতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম সেখানে। ওয়েল গার্ডেড জায়গা। কিছুদূর থেকে দেখা হল। এর কাছেই নাগা নেতা ফিজোর সমাধি। সেটিও দেখা হল।

এরপর যাওয়া হল এখানকার ওয়ার সিমেট্রি দেখতে। শান্ত পরিবেশ বাতাসে বিষণ্ণতার প্রলেপ, বিমর্ষ মনে ফিরে আসা। এরপর যাওয়া হল এখানকার জু দেখতে। জু-তে দুটি মিথুন আর একটি গাউর দেখলাম। তারপর যাওয়া হলো এখানকার রোমান ক্যাথিড্রাল দেখতে। বিশাল গির্জা, অভিনব স্থাপত্য। এবার লাঞ্চের জন্য একটা দোকানে দাঁড়ানো হল। লাঞ্চের পর যাওয়া হল কিসামা গ্রামে নাগাদের কুটিরের নানা ধরনের মডেল দেখতে। এখানে একটা নাগাদের মডেল গ্রাম করা হয়েছে। একটা টিলার ওপরে নাগাদের নানা ডিজাইনের কুটিরের সারি। অভিনব দর্শন কুটিরশ্রেণি। আমরা ঘুরে ঘুরে সব দেখলাম। আজ ওদের উৎসব, তাই অনেকেই এসেছেন এখানে পিকনিক করতে। বিরিয়ানির সুগন্ধে বাতাস ম-ম করছে। ক্রমে গোধূলিলগনে মেঘে আকাশ ঢাকল। আমরাও হোটেলমুখো হলাম।

পরের দিন ভোরবেলাতেই উঠে পড়লাম। স্নান সেরে তৈরি হওয়া গেল। তারপর ব্রেকফাস্ট সেরে নাগা গ্রাম ওখার উদ্দেশে রওনা হলাম। পথের দু-ধারের দৃশ্য চক্ষু কাড়া। কখনও বনভূমি, কখনও খেতের সবুজের ছয়লাপ। কখনও গ্রাম, গঞ্জ, মাঝে মাঝে মানুষজনের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। তবে খুব কম। প্রায় ১২টা নাগাদ ওখানে পৌঁছোলাম।

আকাশ ঘন মেঘে ঢাকা। ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে। তবুও গাড়ি থেকে নামা হল ছাতা মাথায় দিয়ে। সত্যিই বড়ো মনোরম দৃশ্য। পাহাড়ের ওপর থেকে নীচে অবধি কাঁচাপাকা ধানখেতের বর্ণবৈচিত্র্য। পাহাড়ের গায়ে গ্রামের ঘরবাড়ি, সব মিলিয়ে নিমেষহারা সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। আমরা অপলক মুগ্ধতায় অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। বৃষ্টি না হলে এখানে বেশ খানিকক্ষণ বসে থাকলে ভালো লাগত। কিন্তু কপালমন্দ, তা হবার নয়, আমরা একটা দোকানে (বাড়ির মধ্যেই দোকান) লাঞ্চের অর্ডার দিলাম, ভাত ডাল আর ডিমের ঝোল। তারপর গেলাম এখানকার প্রাচীন চার্চ দেখতে, বেশ বড়ো চার্চ এবং স্থাপত্যও খুব সুন্দর। ফিরে এসে লাঞ্চ খাওয়া হল। অপূর্ব রান্না হয়েছে। হোটেল মালিকের বাচ্চা দুটি খুব উৎসাহ এবং আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের পরিবেশন করে খাওয়াল। দেশি ডিম, দারুন স্বাদ। দোকানের মালিক এবং তাঁর পরিবার আমাদের এমনভাবে বিদায় জানালেন যেন আমরা তাঁদের আত্মীয়। আন্তরিক ব্যবহারে মুগ্ধ হলাম।

পথে আমরা একটি নাগা রিসর্ট দেখলাম। জায়গাটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন কাড়ে। সারি সারি নাগা কুটিরের সার, ভিতরে আধুনিক ব্যবস্থা। নানা রঙের ফুলে সাজানো বাগান। আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। পশ্চিম আকাশে শুরু হল রঙের বন্যা। অস্তরাগের সে এক অনন্যসাধারণ মোহময়ী বর্ণালি। পলকহারা চেয়ে থাকা– ভাষায় বর্ণনা করা যায় না এই দৃশ্যের রূপমাধুরী, শুধু অন্তরের উপলব্ধি। ক্রমে আধাঁর নামে। দূর থেকে দেখা যায় কোহিমার আলো। আরও খানিক এগিয়ে কোহিমার আলোর চুম্কি পরা নববধূ সাজ দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম হোটেলে।

পরের দিন সকালে গাড়িতে করে আমরা ডিমাপুরে এলাম। পথের দুধারের দৃশ্য অতি মনোরম, সবুজ স্নিগ্ধতায় ভরা। লাঞ্চ সেরে আমরা ট্রেনে উঠলাম। গৌহাটিতে একটি হোটেলে রাত কাটিয়ে পরের দিন ভোরে কামরূপ এক্সপ্রেস ধরা হল। শেষ হল আমাদের সফর। মণিপুর নাগাল্যান্ডের অনুপম সৌন্দর্যের সঙ্গে, মনে রয়ে গেল ওখা গ্রামের সেই হোটেলের বাচ্চাদের হাসিমাখা কচিমুখের অকৃত্রিম আপ্যায়ন। যাত্রা শুরুর আনলাকি থার্টিন শেষে লাকি হয়ে উঠল।

হিলস্টেশন ওয়েনাড

মাইসোর থেকে গুন্ডুলপেট, মুনসাঙ্গা হয়ে ওয়েনাড যাওয়াটাই সুবিধাজনক গাড়িতে গেলে। গুন্ডুলপেট থেকে একটি রাস্তা গেছে উটির দিকে, অন্যটি ওয়েনাড। ঘন সাল জঙ্গলের বুক চিরে রাস্তা। এই সফর সারাজীবন মনে থাকার মতো। এখানেই ওয়েনাড ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারির প্রবেশদ্বার। পথে যেতে যেতে হঠাৎই গাড়ি থামাতে হবে হরিণের ঝাঁক দেখে– কিংবা পথ ছেড়ে দিতে হবে গজেন্দ্রগমনে চলা হাতির দলকে।

ওয়েনাড-এ থাকার ব্যবস্থা ‘ভইথিরি মেডো’ হোমস্টে। সুন্দর সাজানো কটেজে ১০টি স্বতন্ত্র ভিলা। এখানে থাকলে চারপাশের নিসর্গ দেখে মুগ্ধ হয়ে যাবেন। চারপাশে সবুজ পাহাড়ের ঢেউ আর কাবিনি নদীর একটি শাখাকে বেড় দিয়ে উঠে আসা অরণ্যপথ। ফ্রেশ হয়েই বেরিয়ে পড়ুন লাক্বিডি পয়েন্ট-এর উদ্দেশে। ওয়েনাড-এর উচ্চতম বিন্দু। ওয়েনাডের এই স্থানটি পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বাধিক বর্ষণপ্রবণ অঞ্চল। ওই দিনই ঘুরে নিন পুকুট লেক। প্যাডেল বোটে এক মনোরম জল-সফর।

পরের দিন গোটাটাই বরাদ্দ রাখুন ওয়েনাড-এর নানা বিউটিস্পট ঘুরে দেখতে। তালিকায় অবশ্যই রাখুন বালাসুর সাগর। এটি কাবিনি নদীর একটি বাঁধ। বিশাল হ্রদটিকে ঘিরে রেখেছে নীল পাহাড়ের সারি। তার উপর এদিক ওদিক ঝুলে থাকা মেঘ, অদ্ভুত রহস্যে মুড়ে রেখেছে পাহাড়গুলিকে। একদিকে বানাসুর পিক, অন্যদিকে চেমব্রা পিক। চেমব্রা পিক-এ ট্রেকিং করে পৌঁছোনো যায় হার্ট শেপ-এর একটি স্বর্গীয় হ্রদের কোলে।

এরপর একগুচ্ছ জলপ্রপাতের সঙ্গে সাক্ষাৎ সেরে নিন। প্রথমেই সূচিপুরা ওয়াটারফল। গাড়ি থেকে নেমে চ্ কিমি হাঁটলেই এক আরণ্যক পরিবেশে দেখা মিলবে ঝরনার। ভইথিরি থেকে ৩০ কিমি দূরত্ব এই ঝরনার। মন ভরিয়ে দেবে জায়গাটা। এরপর চলুন কন্থনপারা ওয়াটার ফল্স দেখতে। পাথুরে ল্যান্ডস্কেপ আর নির্জন পরিবেশ অচিরেই মন কেড়ে নেবে।

প্ল্যান রাখুন পরদিনটা অবশ্যই কুরুভা দ্বীপ ভ্রমণের জন্য। বাঁশের ভেলায় ভেসে পড়ুন। চারপাশে জলে ঘেরা একফালি ভূমি নিয়েই কুরুভা দ্বীপ। পাথুরে ল্যান্ডস্কেপ আর জঙ্গলের ব্যাকড্রপে এক ছবির মতো স্পট পাখির কলকাকলিতে মুখর। সারাদিন কাটিয়ে আবার রাতের আস্তানা ওয়েনাড-এ ফেরা।

চতুর্থ দিনে বেরিয়ে পড়ুন এডাক্বাল গুহা দেখতে। প্রস্তরযুগের কিছু গুহাচিত্র এখনও রয়ে গেছে সেখানে। একটু খাড়াই পথ পেরিয়ে গুহায় ঢুকতে হয়। গুহা দেখে রওনা দিন মিনমুট্টি জলপ্রপাত দেখতে। ঝরনার সাড়ে তিন কিমি আগেই গাড়ি থেমে যাবে। বাকিটা হাঁটাপথ। অপূর্ব বনস্থলির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে উপভোগ করুন প্রকৃতির শ্যামল রূপ। তারপর চোখের সামনে হঠাৎই উদ্ভাসিত হবে বন্যজলপ্রপাত।

সফরের শেষ দিনে রাখুন ওয়েনাডের ‘মুথাঙ্গা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি’। জিপ সাফারির জন্য প্রস্তুত হয়ে নিন। সকাল সাতটা আর বিকেল চারটে– দু’ফায় হয় সাফারি। জিপ এগোবে গাইড ও সহযাত্রীদের নিয়ে। দলছুট হাতি, হরিণ, বানর, মালাবার জায়েন্ট স্কুইরেল প্রভৃতি দেখতে দেখতে মন ভরে যাবে এই অরণ্য সফরে। একঘন্টার এই সফর শেষে এবার ফেরার প্রস্তুতি। কেরল কন্যাকে বিদায় জানিয়ে, অজস্র স্মৃতি জমা রেখে আসুন প্রকৃতির কোলে।

ফোটো টুরে পাহাড়ি হ্রদ ভীমতাল

নৈনিতালে গিয়ে সকলেই থাকেন, ফলে ‘সিজনে’ নৈনি হ্রদের আশপাশ প্রায় কলকাতার দুর্গাপুজোর মতোই জমজমাট হয়ে যায়। আমরা তাই ঠিক করেছিলাম নৈনিতালের বদলে ভীমতালে গিয়ে থাকব। নৈঃশব্দ আর সবুজ ছায়া ঘেরা ভীমতাল, স্নিগ্ধ হ্রদটির লাবণ্য নিয়ে অপেক্ষায় ছিল আমাদের স্বাগত জানাতে।

ছবি তোলা, খাওয়া আর ঘুম। আ্য়াজেন্ডা বলতে এইটুকুই। কারণ শহুরে জীবনযাপনের একঘেয়ে ক্লান্তি, ভাইরাসের আতঙ্কে নিত্য়দিন আতঙ্কে কাটানো– এসব থেকে খানিকটা মুক্তিই খুঁজছিলাম আমরা। তাই অযথা আইটিনিরেরারি -কে অকারণ  ভারাক্রান্ত করিনি। এই যাত্রায় কোথাও ছুটে বেড়ানোর কোনও তাড়াও নেই।

প্রকৃতির কোলে রিজুভিনেশনের এমন জায়গা আর হয় না।প্ল্যান মোতাবেক তাই ভীমতালের অভ্যন্তরে একটি ছোট্ট গ্রাম জঙ্গলিয়াগাঁও-তে হোমস্টে-র ব্যবস্থা হল। এমারেল্ড ট্রেইল কটেজ আমাদের সেই অবসর যাপনের ঠাঁই। বস্তুত এটি একটি ফার্মহাউস। প্রচুর ফাঁকা জায়গা, সবজি বাগান, গোশালা নিয়ে এটির কমপাউন্ড এরিয়া।

নৈনিতাল থেকে গাড়িতে পেৌঁছে গেলাম সকালের রোদ গায়ে মেখে। সোলার প্যানেলে এখানে বিদ্যুতের ব্যবস্থা। শান্তিতে দিনতিনেক কাটানোর একেবারে আদর্শ আবাস।

Bheemtal lake

দুপুরে সুস্বাদু লাঞ্চ সেরে বাকি সময়টা আলসেমি করেই কাটিয়ে দেওয়া গেল। বাঁধাকপির ছোট্ট খেত, নানারকম ফুলের কেয়ারি ঘুরে। একটি ছিমছাম দিশি দোলনায় বসে প্রকৃতির কোলে গা ভাসিয়ে দেওয়ার এ সুযোগ ছাড়া যায় না। নানা রকম পাখির ডাকে বিকেল গড়াল সন্ধ্যায়। কম্পাউন্ড-এ ছোট্ট একটা আগুন করে, গোল হয়ে বসে বেশ রাত অবধি চলল আমাদের আড্ডা। রাতের তারারা সলমা চুমকির ওড়না বিছিয়ে দিল আকাশ জুড়ে।নক্ষত্র চেনার খেলায় কেটে গেল সময়।

ভোরে পাখির ডাককে সঙ্গী করে হাঁটতে বেরোলাম পাইন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। শুকনো পাতার মর্মরধবনি তুলে হাঁটতে হাঁটতে ফুসফুস ভরে নিলাম টাটকা অক্সিজেন। পায়ে পায়েই পথ তৈরি হয়ে গেছে পর্ণমোচি জঙ্গলে। দুচার ঘর জনবসতি পেরিয়ে, পাইন আর সিলভার ওক-এ ঘেরা জঙ্গুলে ভ্রমণ, আমাদের মতো শহুরেদের কাছে সত্যিই বোনাস।

Travel Kumaon

জঙ্গলে বসেই প্রাতরাশ সেরে, দুপুর নাগাদ ফিরে এলাম কটেজে। দুপুরের খাবার খেয়ে উঠতে উঠতেই মেঘ জমে বৃষ্টি এল ঝেঁপে। রাতে বেশ ঠান্ডা পড়বে, সতর্কতা জানাল কেয়ারটেকার।

পরদিন আমাদের ভীমতাল দেখতে যাওয়ার কথা। মেঘ কেটে গিয়ে রোদ ঝলমল আকাশ। আলুর পরোটা আর ওমলেট দিয়ে প্রাতরাশ সেরে রওনা দিলাম ভীমতালের দিকে।

নৈনিতাল থেকে ২৩ কিমি দূরে ভীমতালের অবস্থান। লেকের মাঝখানে একটি রেস্তোরাঁ। জলে গুটিকয়েক হাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ পপকর্ন খাওয়াচ্ছে তাদের। বোটের সারি দাঁড়িয়ে পাড় জুড়ে।নৌবিহার সেরে এরপর আমরা নউকুচিয়াতালের দিকে রওনা হলাম।

Destination himalayas

পাহাড়ের কোলে এও এক অসামান্য রূপসি হ্রদ। অল্প কিছু জনবসতি নিয়ে ছোট্ট জনপদ।দ্বিপ্রাহরিক আহার শেষে গাড়ি এবার এগোল সাততালের দিকে। সেখানেও বোটিং করে চারপাশের নৈসর্গিক শোভা উপভোগ করলাম আমরা।ফেরার পথে দেখে নিলাম ঘোড়াখাল মন্দির। প্রচুর ঘণ্টা নজরে এল সেখানে। বস্তুত এগুলি মনস্কামনা পূরণের ঘণ্টা।

সূর্য পশ্চিম আকাশের দিকে এগোচ্ছে দেখে ফিরতি পথ ধরলাম ভীমতালের। পরদিনই আমাদের নৈনিতাল হয়ে ঘরমুখো হতে হবে। ক্যামেরা আর স্মৃতিতে থেকে যাবে অপার্থিব সৌন্দর্যের আকর ভীমতাল।

অন্তরভেদী, ভবানী আইল্যান্ড এবং লকনাভরম

অন্তরভেদী, ভবানী আইল্যান্ড, লকনাভরম—অন্ধ্রের এই তিনটি নতুন টুরিস্ট স্পট দেখার আমন্ত্রণ এল। আমন্ত্রণ জানাল অন্ধ্রপ্রদেশের পর্যটন দফতর। তাই, ‘উঠল বাই তো অন্ধ্র যাই’-এর ঘটনা ঘটল। দিন-দুয়েকের মধ্যেই লাগেজ রেডি। তৎকালে ট্রেনের টিকিটের ব্যবস্থা করে দিলেন এপি টুরিজ্যম-এর অফিসার সৌগত সাহা। শালিমার স্টেশন থেকে বিকেল চারটে-পাঁচের সেকেন্দ্রাবাদ এসি এক্সপ্রেস ধরে রওনা দিলাম রাজামুন্দ্রির উদ্দেশে।

ষোলো ঘন্টা জার্নি শেষে সকাল আটটা পাঁচে নামলাম রাজামুন্দ্রি স্টেশনে। বিশাখাপত্তনম থেকে ট্রেনে মাত্র দু-ঘন্টার ব্যবধানে এই স্টেশনটির অবস্থান। স্টেশনের বাইরে ভিডিয়ো কোচ বাস নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন এপি টুরিজ্যমের জিএম মনোহরজি।

বাসেই সারলাম ব্রেকফাস্ট। কিছুক্ষণ বাদেই বাস এসে থামল ডিন্ডি-র কোকোনাট কান্ট্রি রিসর্ট-এ। অসংখ্য নারকেলগাছ বেষ্টিত ছায়া সুনিবিড় এই রিসর্ট-এ পা রাখামাত্রই ডাবের জল পরিবেশন করে তৃপ্ত করলেন রিসর্ট কর্মীরা।

সুইমিং পুল-এ স্নান এবং হরিথা রেস্তোরাঁয় মধ্যাহ্নভোজ সেরেই বেরিয়ে পড়লাম অন্তরভেদী বিচ এবং টেম্পল দর্শনের উদ্দেশ্যে। বড়ো রাস্তা ছেড়ে বাস চলল প্রত্যন্ত গ্রামের পথ ধরে। নারকেল পাতায় ছাওয়া বাড়ি আর বাড়ির উঠোনে জমা করা শতসহস্র নারকেলের স্তূপকে দুদিকে রেখে, এগিয়ে চলল বাস। মুগ্ধ করল সেই গ্রাম্য আবহ। ঘন্টা দুয়েক এই আবহে কাটানোর পর মন্দির দর্শন করিয়ে বাস এসে থামল অন্তরভেদী সমুদ্রসৈকতে। সমুদ্রের অসীম জলের দিকে চোখ রাখতেই আবছা দেখা গেল জাহাজের মাস্তুল। সৈকতের অদূরে অর্ধেক ডুবে থাকা এক প্রাসাদোপম বাড়ির অংশবিশেষও নজরে এল। বালিয়াড়িতে তখন অবশ্য চোখে পড়ল অন্য দৃশ্য। জেলেরা দল বেঁধে শুকনো জাল গুটিয়ে পরের দিনের মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সূর্য তখন অস্তগামী।

তারই অগ্নিভ আভা সমুদ্রের জলে পড়ে ফুটিয়ে তুলেছে অপরূপ দৃশ্য। গোধূলির সেই নরম আলো গায়ে মেখে, নিরালা সমুদ্রসৈকতে ঘুরে বেড়ালাম কয়েকঘন্টা।

রাতে হরিথা রেস্তোরাঁতেই ছিল আহারের ব্যবস্থা। ইন্ডিয়ান, সাউথ ইন্ডিয়ান, চাইনিজ সবরকম খাবারই ছিল বুফেতে। খাওয়ার পর সিদ্ধান্ত হল, রাতেই যাব বিজয়ওয়াড়ার ভবানী আইল্যান্ড-এ। কৃষ্ণা নদীর বুকে লঞ্চ ভাসিয়ে মধ্যরাতে পৌঁছালাম দ্বীপে। রাতে দ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করতে না পারলেও, এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ অনুভব করেছি।

Travelogue
Bhawani Island Of AP

সকালে ঘুম ভাঙতেই চটজলদি বিছানা ছাড়লাম। রাতে দ্বীপের সৌন্দর্যদর্শন করতে না-পারার আক্ষেপ কাটানোর উদ্দেশ্যেই এলাম বাড়ির বারান্দায়। বারান্দা থেকে ভবানী দ্বীপের প্রকৃতি অনেকটাই দৃশ্যমান। চোখ-ক্যামেরা প্যান করতেই দেখি, রোমাঞ্চকর ল্যান্ডস্কেপ। কৃষ্ণা নদী বৃত্তাকারে ঘিরে রেখেছে দ্বীপটিকে। নদী জলে টইটম্বুর। দ্বীপ বেষ্টিত ঘন সবুজ গাছগাছালিতে। গাছে-গাছে পাখিদের কলকাকলি। কাঠবেড়ালি ছুটে বেড়াচ্ছে গাছের ডালে-ডালে। এখানে-ওখানে রং ছড়িয়েছে বুনো ফুল। আর সেই লাল, সাদা, হলুদরঙা ফুলে-ফুলে বহুবর্ণ প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। হালকা হাওয়ায় দোল খাচ্ছে গাছের পাতা। নির্জন দ্বীপ, জলীয় ঠান্ডা হাওয়া, ফুলের সুগন্ধ আর পাখির কলকাকলি মিলেমিশে সে এক অদ্ভুত কাব্যিক-আবহ। এসবের মধ্যেই চা-পান পর্ব শেষ হল।

দ্বীপে বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে। তাই স্নানের জন্য গরমজল পেতে অসুবিধা হয়নি। স্নান সেরে রেস্তোরাঁয় দক্ষিণী খাবার খেয়ে ঘুরে দেখলাম দ্বীপের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। দ্বীপে প্রচুর গাছদোলনা ছাড়াও চোখে পড়ল অ্যাডভেঞ্চার পার্ক। অন্ধ্রপ্রদেশ পর্যটন দফতরের কর্মকর্তারা জানালেন, কেউ চাইলে ভবানী দ্বীপে না থেকেও, দ্বীপ ভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন। লঞ্চ-এ যাতায়াত এবং দ্বীপের অ্যাডভেঞ্চার পার্ক-এ বিনোদনের জন্য মাথাপিছু খরচ করতে হবে ২৫ টাকা। যাইহোক, দুপুরের ভোজন-পর্বটাও ছিল দারুণ উপভোগ্য। কৃষ্ণা নদীতে লঞ্চ-এ ভাসতে-ভাসতে গরমাগরম খাবারের স্বাদ নিলাম আমরা। অবশ্য এই পর্বের আগে, দ্বীপের অনতিদূরে পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত শিব-দুর্গার স্বর্ণমন্দির দর্শন করে নিয়েছিলাম।

আরও একটা রাত ভবানী দ্বীপে কাটানোর ইচ্ছে ছিল, কিন্তু শেডিউল-এ না থাকায় ইচ্ছেপূরণ হল না। তাই দুপুর দুটো নাগাদ ভবানী দ্বীপের মায়া কাটালাম।

Travelogue
Laknabharom Of AP

পরের গন্তব্য– লকনাভরম। ভবানী আইল্যান্ড থেকে আশি কিলোমিটার বাস জার্নি। যাওয়ার পথে পাথরের গায়ে কারুকার্যময় প্রখ্যাত দুই মন্দির রামাপ্পা এবং থাউজেন্ড পিলারস দেখার আনন্দ নিলাম। মন্দির চত্বরের বাইরে এসে জিভ-কে তৃপ্ত করলাম গরম কফি আর চিলি ভুট্টা দিয়ে। সেদ্ধ ভুট্টা, তেল, পেঁয়াজ, টম্যাটো এবং কাঁচালংকা দিয়ে ভাজা সুস্বাদু এই পদটি মাত্র দশ টাকায় পাওয়া যায় এই অঞ্চলে। কারণ, রাস্তার দুদিকে ভুট্টার খেতে ভরা। অবশ্য শুধু ভুট্টার খেতই নয়, লকনাভরম যাওয়ার পথে প্রচুর কাপাস তুলোর খেতও চোখে পড়েছে। ফল ফেটে তুলো বেরিয়ে সাদা ফুলে ভরা বাগিচার মতো হয়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ অঞ্চল। আর যেখানে তুলোর খেত শেষ হয়েছে, সেখান থেকেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সারিসারি তালগাছ এবং সেই গাছগুলি থেকে রস সংগ্রহের জন্য বাঁধা রয়েছে ছোটো কলসি। মুগ্ধ হয়ে এসব দেখতে দেখতেই আমাদের বাস ঢুকে পড়েছে শাল-সেগুনের জঙ্গলে।

অন্তত পনেরো কিলোমিটার ওই শুনশান জঙ্গলের বুক চিরে সন্ধে নাগাদ বাস এসে থামল লকনাভরম ফরেস্ট বাংলোর গেটের সামনে। চারিদিকে ঘন জঙ্গল আর বিশালাকার জলাশয়কে সঙ্গী করেই গড়ে উঠেছে এই পর্যটন আবাসটি।

সুন্দর সাজানো গেট দিয়ে ঢোকার সময় অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল। আদিবাসী দুই রমণী চন্দনের ফোঁটা আর গাঁদা ফুলের মালা পরিয়ে স্বাগত জানালেন। এই নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতেই গেটম্যান জানাল, অতিথিদের প্রাথমিক অভ্যর্থনার এটাই নাকি স্থানীয় রীতি। যাইহোক, গেট পেরিয়েই পা রাখলাম সাসপেনশন ব্রিজে। বিশাল জলাধারের উপর লোহার দড়ি দিয়ে ঝোলানো প্রায় দুশো মিটার দৈর্ঘের দোদুল্যমান কাঠের ব্রিজ ধরে হেঁটে পৌঁছোলাম ফরেস্ট বাংলোয়। হাঁটাপথে অন্ধকার দূর করেছিল হ্যারিকেনের আলো। যদিও চাঁদের আলোর কাছে সে আলো বড়ো ফিকে মনে হয়েছে। কিন্তু সব মিলে তৈরি হয়েছিল গা-ছম্ছম্ এক মায়াবি পরিবেশ। আর সেই পরিবেশেই ঝিঁ-ঝিঁ পোকার ডাক শুনতে শুনতে সারলাম নৈশভোজ এবং নৈশভোজের পরে কুয়াশা গায়ে মেখে বাংলোর ছাদে দাঁড়িয়ে অনুভব করেছি অদ্ভুত রোমাঞ্চ।

এমন সুন্দর জায়গায় পরের দিনটাও কাটল বেশ আনন্দে। জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো ছাড়াও, জলাধারে ছিপ ফেলে মাছ ধরার দৃশ্যও উপভোগ করলাম তারিয়ে তারিয়ে।

এবার ফেরার পালা। থুড়ি, মন খারাপের শুরু। তবে বিদায়বেলায় আমাদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এসে, এপি-র টুরিজ্যম সেক্রেটারি চন্দ্রিমা খান আবার যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে মনের ভার খানিকটা লাঘব করলেন।

ধারাবাহিক সফর-কথা পঞ্চম পর্ব

২০২০ সালের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আমরা স্বাভাবিক জীবন-যাপন থেকে বঞ্চিত হয়েছি করোনা-র কারণে। মাঝে লকডাউন কিছুটা শিথিল হলেও,এখনও পর্যন্ত আমরা প্রায় গৃহবন্দি জীবন কাটাচ্ছি। একঘেয়ে হয়ে উঠেছে জীবন।তাই এখন আমরা মুখিয়ে আছি মুক্তির স্বাদ পাওয়ার জন্য। করোনা থেকে মুক্তি পেলে বেশিরভাগ ভ্রমণপিপাসু মানুষের তাই ডানা মেলে উড়ে বেড়ানোর ইচ্ছে হবেই। কিন্তু কাছেপিঠে কোথায় যাবেন,কী দেখবেন,এই বিষয়ে যাতে আপনি দিশাহারা না হয়ে পড়েন,তারজন্য ‘গৃহশোভা’ নিল এক বিশেষ উদ্যোগ।পাঁচ দিনে পাঁচটি জনপ্রিয় স্পট-এর হদিস থাকছে এই লেখায়।আজ পড়ুন শিতলাখেত-এর রূপের কথা।

 

শিতলাখেত

উত্তরাঞ্চলের আলমোরা জেলায় এক নির্জন অনিন্দ্যসুন্দর স্পট— শিতলাখেত। রানিখেত-এর জনবহুল শহরে যারা থাকতে চান না, নিরালায় কয়েকটা দিন কাটাতে চান নিজের প্রিয়জনের সঙ্গে, তাদের জন্য শীতলাখেত এক আইডিয়াল ট্রাভেল ডেস্টিনেশন। পাইনের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ হাঁটা কিংবা শিবালিক পর্বতের মায়াময় রূপ দেখা– সারাজীবনের সঞ্চয় হয়ে থাকবে। থাকার জন্য রয়েছে কেএমভিএন-এর গেস্ট হাউস। অপূর্ব আতিথেয়তায় কাটবে আপনার নিরালাযাপনের দিনগুলি।

দেখার জায়গা কাছাকাছির মধ্যে অনেক। প্রথমেই ঘুরে নেওয়া যায় বুলাদেবীর মন্দির। অষ্টম শতাব্দীতে নির্মিত এক প্রাচীন দুর্গা মন্দির। বন্য পরিবেশে এই মন্দির অচিরেই মন কেড়ে নেয় পর্যটকের। মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য অনেকেই ঘন্টা বেঁধে আসেন দেবীর উদ্দেশ্যে। আরও দেখে নিন রানিখেত গল্ফ কোর্স, মহাকালী মন্দির এবং চৌবাটিয়া গার্ডেন।

নৈনিতাল থেকে শিতলাখেত বস্তুত চার ঘণ্টার পথ। কেএমভিএন-এ যারা থেকেছেন, তারা এক অদ্ভূত বৈভবের ছোঁয়া পাবেন ঘরগুলির আর্কিটেকচারে। লন-এ বসলে উদ্ধত পাহাড় শৃঙ্গগুলি যেন হাতের মুঠোয় ধরা দিতে চাইবে। তবে সাবধান রাত্রে খোলা জায়গায় না ঘোরাই ভালো। তেন্ডুয়া অর্থাৎ লেপার্ড এবং শেয়ালের দেখা মিলতে পারে।

চৌবাটিয়া গার্ডেন বিখ্যাত তার আলুবোখরা, আপেল, অ্যাপ্রিকট ও পিচ ফলের জন্য। উদ্যান জুড়ে অসংখ্য গাছ। ব্রিটিশ জমানায় মেয়ো সাহেব মুগ্ধ হয়েছিলেন এই গাছের আধিক্য দেখে এবং এখানে ক্যান্টনমেন্ট তৈরি করার নির্দেশ দেন। শিতলাখেত-এ থেকে, এই জায়গাগুলি বেড়ানো যায় অনায়াসেই।

—-সমাপ্ত—-

সফর-কথা শেষ পর্ব

২০২০ সালের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আমরা স্বাভাবিক জীবন-যাপন থেকে বঞ্চিত হয়েছি করোনা-র কারণে। মাঝে লকডাউন কিছুটা শিথিল হলেও,এখনও পর্যন্ত আমরা প্রায় গৃহবন্দি জীবন কাটাচ্ছি। একঘেয়ে হয়ে উঠেছে জীবন।তাই এখন আমরা মুখিয়ে আছি মুক্তির স্বাদ পাওয়ার জন্য। করোনা থেকে মুক্তি পেলে বেশিরভাগ ভ্রমণপিপাসু মানুষের তাই ডানা মেলে উড়ে বেড়ানোর ইচ্ছে হবেই। কিন্তু কাছেপিঠে কোথায় যাবেন,কী দেখবেন,এই বিষয়ে যাতে আপনি দিশাহারা না হয়ে পড়েন,তারজন্য ‘গৃহশোভা’ নিল এক বিশেষ উদ্যোগ।পাঁচ দিনে পাঁচটি জনপ্রিয় স্পট-এর হদিস থাকছে এই লেখায়। আজ পড়ুন চিকমাগালুর-এর রূপের কথা।

চিকমাগালুর

চিকমাগালুরের একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে। ভারতে এখানেই প্রথম কফি চাষ করা হয়েছিল। তুঙ্গ আর ভদ্রা দুই নদীর উৎসও পশ্চিম পর্বতমালার এই অংশেই। বাঙালি পাঠকের অচিরেই শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় মনে পড়ে যাবে। চিকমাগালুর জেলাতেই কর্ণাটক রাজ্যের উচ্চতম শিখর মূল্যায়নগিরির অবস্থান।

কন্নড ভাষায় ‘চিকমাগালুর’-এর অর্থ কনিষ্ঠ কন্যার শহর। ওই অঞ্চলের সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু ব্যক্তি রুকমঙ্গদের কনিষ্ঠা কন্যার বিবাহে এই শহরটি যৌতুক হিসাবে দেওয়া হয়েছিল। কফি গার্ডেনের মাঝে হোম স্টে, নীল টিলায় ঘেরা চারপাশ, কুয়াশা মাখা ভোর আর মায়ার রং লাগা সূর্যাস্ত– চিকমাগালুরের বৈশিষ্ট্য।

বেঙ্গালুরু থেকে বাস বা গাড়িতে সরাসরি পৌঁছোনো যায় এখানে। ঘণ্টা ছয়েক সময় লাগে। থাকার জন্য অনেক গেস্ট হাউস রয়েছে। প্লান্টার্স কোর্ট অন্যতম। লাঞ্চ সেরে কেএসআরটিসি বাস স্টপ থেকে গাড়ি বুক করে ঘুরে নিন চিকমাগালুরের দ্রষ্টব্যগুলি। প্রথমেই গাড়ি পৌঁছোবে অথিগুন্ডি। বাবা বুদানগিরি যাওয়ার পথে ছোট্ট একটি গ্রাম। এখানকার ল্যান্ডস্কেপ অসাধারণ। পথে পড়বে ছোট্ট একটা ঝরনা। বাবা বুদানগিরি পৌঁছোলে প্রকৃতি আপনাকে অভ্যর্থনা করবে হালকা এক পশলা বৃষ্টি দিয়ে। জায়গাটায় তিনটি গুহা। তিন সিদ্ধ পুরুষের স্মৃতি বিজড়িত। পর্বত চূড়াটি এক মুসলিম পির, বাবা বুদানের নামানুসারে খ্যাত। অপূর্ব নিসর্গ জায়গাটার।

দেখার আরও কিছু কিছু জায়গা রয়েছে চিকমাগালুর-এ। মুল্যায়নগিরি যাওয়ার পথে শিতলামাতা। গরমেও বেশ সুন্দর শীতল অনুভূতি হবে চিকমাগালুর-এ। শীত বস্ত্র এবং রেনকোট নিতে ভুলবেন না।

 

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব