সাগরদ্বীপে সংকটে

বাসস্ট্যান্ড থেকে কপিলমুনির মন্দির যাওয়ার রাস্তার মোড়টাতে গাছতলায় বসে ভিখারি বুড়ি পাশ দিয়ে যাওয়া মানুষজন দেখলেই বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠে- পাপীবেটা খাওয়ার জন্য কিছু টাকা দে, মন্দিরে গিয়ে পাপ ধুয়ে সব পুণ্য নে। সকাল হতেই প্রতিদিন সে এখানে এসে বসে থাকে শেষ বিকেল পর্যন্ত।

সত্তরের কাছাকাছি বয়সের সম্ভ্রান্ত চেহারার মানুষটাকে দেখে ঠিক ভিখারি মনে হয় না। বছর দশেক ধরে বুড়িকে এখানে বসে ভিক্ষা করতে দেখছে সবাই। পুরোনো পলিথিন বিছিয়ে তার উপর রংচটা একটা গামছা পেতে, সামনে একটা স্টিলের কানা উঁচু থালা রেখে, গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে থাকে সে। সঙ্গে আছে চেন লাগানো নাইলন কাপড়ের মাঝারি সাইজের একটা ব্যাগ, হাতলওয়ালা শক্ত একটা লাঠি আর লম্বা ডান্ডাওয়ালা বড়ো একটা ছাতা।

শক্ত লাঠিটাতে ভর দিয়ে শরীরটাকে সোজা রেখে সে চলাফেরা করে, দিন শেষে বাড়ি ফেরার সময় বড়ো ছাতাটাকে সামনের চা-দোকানে রেখে যায়। বুড়ির ভিক্ষা চাওয়ার অদ্ভুত ধরন দেখে বেশিরভাগ অপরিচিত লোকই তাকে পাগল ভাবে। যার কাছে ভিক্ষা চাইছে তাকেই কিনা পাপী বলে গাল দিচ্ছে, এ কেমন বেয়াড়াপনা বাবা! তবুও অশীতিপর বৃদ্ধার উপর দয়াপরবশ হয়ে এক-দু’টাকা বা কিছু খাবারদাবার দিয়ে যায় অনেকেই।

সৌমেন চায়ের দোকানে বসে বুড়ির কথা বলতেই, দোকানদার বলে ওঠে, ভুল ভাবছেন বাবু। বুড়ি মোটেই পাগলি নয়, দারুণ দারুণ জ্ঞানের কথা বলে। বড়ো ঘরের মানুষ। উত্তর প্রদেশে কোন একটা গ্রামে, কী যেন নামটা মনে থাকে না ছাই, সেখানে অনেক জমিজমা আছে। কী জানি কোন অভিমানে ঘর ছেড়ে এখানে বসে এই কষ্টের মধ্যে দিন গুজরান করছে।

চা শেষ করে কাপটা রেখে উঠে দাঁড়ায় সৌমেন, তাহলে তো একবার আলাপ করতেই হয় বুড়িমার সঙ্গে। মেলার রিপোর্টিং করতে এসে একটা ভালো স্টোরিও করা হয়ে যাবে। এগিয়ে যেতে গিয়ে থেমে দাঁড়ায় সৌমেন। ও হ্যাঁ, ওই বিস্কুটটা দাও তো এক প্যাকেট আর একটা সেও ভাজার প্যাকেটও দাও। কত হল?

—উনত্রিশ টাকা।

—কেন? এটা দশ আর এটা পনেরো, পঁচিশ হল।

—না। আমারা বারো আর সতেরো করে নিই।

—তোমরা তো দেখছি কম বড়ো জোচ্চোর নও! ঠিক লোকের পাল্লায় পড়লে দেখবে একদিন জেলে যাবে।

—কত পুলিশ-দারোগা খেয়ে যায়, কেউ কিছু বলে না। আপনিই দেখছি বেশি বেশি করছেন। তীর্থ করতে এসে লোকে কত কত টাকা খরচা করে। এই সিজিনে আমরাও দু-চার টাকা কামাই। আর এক-দু’টাকার জন্য আপনি এত কথা খরচা করছেন, এমন করছেন যেন…

—আমি তো আর তীর্থ করে পাপ ধোয়াতে আসিনি আর মেরে ঝেড়ে জমানো টাকা দান করতেও আসিনি। খবরের কাগজের লোক, খবর করতে এসেছি। ত্রিশ দিয়েছি, ভালোয় ভালোয় পাঁচ টাকা ফেরত দাও, নাহলে তোমাকেও খবর করে দেব।

দোকানদার খানিকটা বিরক্ত হয়ে পাঁচ টাকা ফিরিয়ে দেয়! এই নিন। জোড় হাত করে বলছি, দয়া করে এখানে আর বিরক্ত করতে আসবেন না, অন্য কোথাও চা খেয়ে নেবেন। গঙ্গাসাগরে চা-দোকানের অভাব নেই।

সৌমেন মুচকি হেসে এগিয়ে যায়। গাছতলায় বুড়ির পাশে গিয়ে বসে। বুড়ি স্বভাবসিদ্ধ ভাবে বলে ওঠে- পাপীবেটা খাওয়ার জন্য কিছু টাকা দে, মন্দিরে গিয়ে পাপ ধুয়ে সব পুণ্য নে। সৌমেন বিস্কুট আর সেও ভাজার প্যাকেট দুটো বুড়ির হাতে দেয়- নাও বুড়িমা, এগুলো খেয়ে নাও।

বুড়ি প্যাকেট খুলে একটা বিস্কুট মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে বলে- পাপীবেটা কী নাম রে তোর?

—আমি সৌমেন। তুমি তো বেশ বুড়িমা! পয়সা খরচা করে তোমার জন্য খাবার এনে দিলাম, আর আমাকেই কিনা পাপী বলে গাল দিচ্ছ!

—কী করব, এখানে তো পাপীরা সব সাগরে স্নান সেরে পাপমোচন করে পুণ্য কামাতে আসে। গঙ্গাসাগর তো পাপীর মেলা।

—তা তুমি এখানে এসেছিলে কেন?

—আমিও তো পাপীই। গাঁয়ে কত গরিব মানুষের জমির ফসল জোর করে কাটিয়ে নিয়েছি, কত লোককে ঠকিয়েছি। গাঁয়ে ঠাকুরান ছিলাম যে! জমিজমার দখলদারির লড়াইয়ে ঠাকুর যখন মারা গেল, তখন থেকে সব সম্পত্তি তো আমার হাতে। আমি হলাম ঠাকুরান। আমি কিছু বলবার আগেই লোকলস্কর-লাঠিয়াল মিলে ধরে বেঁধে আনত গরিব লোকগুলোকে। কেউ ধারের টাকা শুধতে পারেনি তো তার জমি-বাড়ির দখল নিয়ে নাও, কেউ ঠিক মতো ফসল ফলাতে পারেনি তো সবটাই কেড়ে নাও। এসব পাপ নয়তো কী? তাই ছেলের সঙ্গে এসেছিলাম পুণ্য অর্জন করতে।

সৌমেন মাঝখানে বলে ওঠে, তারপর গঙ্গাসাগরে এসে থেকেই গেলে?

বুড়ি কষ্টের হাসি হাসে। থাকলাম কী আর বাপ, ফেলে রেখে গেল! দেশ-গাঁ ছেড়ে কখনও কোথাও বেরোইনি, চার ক্লাসের বেশি লেখাপড়াও করিনি। উত্তরপ্রদেশ থেকে কত গাড়ি বদলে নদী পার হয়ে এসেছিলাম বাংলা মুলুকের এই গঙ্গাসাগরে। সে সব কি আর চিনে ফেরার উপায় ছিল! মেলার শেষে সমিতির সাহায্যে গাঁয়ে ফিরলাম যখন… একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুড়ি।

—তখন কী? আর ফেলে রেখে গেল, বলছই বা কেন?

—বলছি কি আর শুধু শুধু! গাঁয়ে ফিরে সব বুঝলাম। গঙ্গাসাগর মেলার মধ্যে বেটার হাত ধরে হাঁটছিলাম। ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ করে হাত ছেড়ে কখন যেন আলাদা হয়ে গেলাম। লাখ লাখ মানুষের ভিড়ের মাঝে বেটাকে আর দেখতেই পেলাম না, খুঁজেই পেলাম না আর তাকে। মেলার ভিড়ের লোকজন আমাকে ঠেলতে ঠেলতে কোন দিকে যে নিয়ে যাচ্ছিল কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

আমি কাঁদতে লাগলাম। পরে ঘুরতে ঘুরতে ফিরে এসে এই গাছতলাতেই এসে বসলাম। তখনও নিজের কাছে কিছু টাকা পয়সা ছিল। সে সব দিয়ে কয়েক দিন কাটিয়ে দিলাম। সে ক’দিনে চেনাজানা কারওর সঙ্গেই দেখা হল না। মেলা ভেঙে গেল। আমার মতো আরও অনেকগুলো মানুষ থেকে গেল মেলায়। কিছু লোক সমিতি বানিয়েছে, এই সব হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। তেমনই কোনও একটা সমিতির দু’জন লোক আমাকেও গাঁয়ের বাড়িতে নিয়ে গেল।

সৌমেন কথার মধ্যে বলে ওঠে, তোমার দেশ কোথায় গো বুড়িমা? কোন গ্রাম?

—এখন এই বাংলার গাছতলা। আগে ছিল উত্তর প্রদেশের দেওরিয়া জেলার বৈতালপুর গাঁ।

—তা তোমাকে যখন ওরা তোমার গ্রামে পৌঁছেই দিল তখন আবার এখানে ফিরে এলে কেন?

—গাঁয়ে ফিরে দেখি বেটা, নাতি, জ্ঞাতিরা সব মাথা মুড়িয়েছে। শ্রাদ্ধ শান্তি হয়ে গিয়েছে কয়েক দিন আগে। পাঁচ গাঁয়ে তখন আমার মরার খবর ছড়িয়ে গেছে। আমি নাকি মেলায় ডায়ারিয়ায় মারা গেছি, বেটা কাঁদতে কাঁদতে গাঁয়ে ফিরে সবাইকে সে কথাই বলেছিল। তখন জানলাম, মেলায় আমি হারাইনি। আমাকে জেনে শুনেই ফেলে রেখে গিয়েছিল! বুঝলাম সংসারে কোনও মূল্য নেই আর আমার। আমি মরেই গেছি বাড়ির সকলের কাছে। দাম শুধু আমার যত জমিজমা সম্পত্তিরই! থাক ওরা ওসব নিয়ে সমিতির লোকজনের হাতে পায়ে ধরে ওদের সঙ্গেই আবার গঙ্গাসাগরে ফিরে এলাম। ফিরে এলাম এই গাছতলায়। দশ বছর আগে।

—এভাবে থাকতে ঠাকুরানের কোনও কষ্ট হয় না?

—কষ্ট হবে কেন? কষ্টতেই তো আমি বড়ো হয়েছি, ঠাকুরান হয়ে ক’দিন না হয় আমিরি ভাবে চলেছি, এই যা। জন্ম থেকেই তো আমি আর ঠাকুরান ছিলাম না, গরিব ঘরেরই মেয়ে ছিলাম। জোর করে তুলে এনে ঠাকুর আমাকে ঠাকুরান করেছিল। সবাই অভ্যাসের দাস রে বেটা। সৌমেন প্যান্টের ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়ায়।

—মেলার কদিন গঙ্গাসাগরেই আছি। তোমার সঙ্গে আবার গল্প করতে আসব। নাও, এই টাকাটা রেখে দাও। দুপুরে আর রাতে কিছু খেয়ে নিও। সৌমেন বুড়িমার হাতে একশো টাকার নোটটা গুঁজে দেয়। গাছতলা ছেড়ে পিচ রাস্তা হয়ে সৌমেন কপিলমুনির মন্দিরের দিকে এগিয়ে যায়। মনে মনে বলে, যদিও পৌষ সংক্রান্তির পুণ্য স্নানের এখনও দু’দিন বাকি তবুও আজই মন্দিরটা দেখে নিতে হবে। কাল থেকেই পুণ্যার্থীতে ভরে যাবে গঙ্গাসাগর। সে সময় আর এদিকে এগোনো যাবে না ভিড়ের হুড়োহুড়ি ঠেলে।

কপিলমুনির মন্দিরের সামনে এসে হাত জোড় করে প্রণাম করে সৌমেন। মন্দিরের সামনে পেট ফোলা, কপালে চন্দন মাখা সেবাইতরা বেশ খোস মেজাজে বসে আছে। দুধে-ঘিয়ে পুষ্ট শরীরগুলো বাগিয়েছে বেশ। ওদের দেখে সৌমেনের মনের মধ্যে পুরোনো জ্বালা ধরা বোধটা চিন চিন করে ওঠে।

কপিলমুনির মন্দিরে যে-বিপুল টাকা-পয়সা ও অন্যান্য দান জমা পড়ে, তা সব ওরা নিয়ে চলে যায় কাশী-বেনারস। এক পয়সাও খরচ করে না এখানে। অথচ সরকার মেলার আয়োজন, মেলা ভাঙার পর সাফাইয়ে কোটি কোটি টাকা আর প্রচুর লোকবল ব্যয় করে ফি বছর। সরকার মন্দিরের দান থেকে পাওয়া আয়ের উপর ট্যাক্স বসিয়ে কিছু আয় করতেই পারে। কিন্তু কেন যে করে না, সৌমেন বুঝে উঠতে পারে না। মোটা মোটা সেবাইতগুলোকে ওর লুটেরা ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না।

( )

পরেরদিন সকালে সৌমেন আবার চায়ের দোকানে এসে বসে। ওকে বসতে দেখে, দোকানদার আগে ভাগেই বলে ওঠে চা খান। দু-দশ মিনিট বসুন। দয়া করে দর দাম করে মাথা খাবেন না। আপনাকে দেখে অন্য খদ্দেরও বায়নাক্কা শুরু করবে। সারা বছরের মধ্যে মেলার এই ক’টা দিন-ই তো রোজগারের সময়, অন্য সময় ক’জন আর নদী ভেঙে এই সাগরে আসে।

সৌমেন হাসে। ভালো করে এক কাপ চা বানাও তো। আর দুটো কেক দাও। যা দাম লেখা আছে তাই পাবে।

—ঠিক আছে, আপনার কথাই থাকল। তাহলে অন্য খদ্দের আসার আগে দামটা মিটিয়ে দিন।

সৌমেন মানি পার্স থেকে পঞ্চাশ টাকা বের করে দেয়। চায়ে চুমুক দিয়ে দোকানদারকে প্রশ্ন করে, চোর, জোচ্চোররা কি সব আসতে শুরু করেছে?

—আজ্ঞে, আপনার কথাটা ঠিকমতো বুঝলাম না!

—আরে বাবা, মেলার সময় যেসব পকেটমার, ছিঁচকে চোর, ঠগবাজ-রা আসে না? তারা কি আসতে শুরু করেছে, সেটাই জানতে চাইছিলাম।

—তা দু’চারজন এসেছে নিশ্চয়।

—তুমি চেনো কাউকে?

—উপর উপর দেখে কি লোক চেনা যায়। আর উনারা কি এসে বসে নিজের পরিচয় দিয়ে চা খাবেন এখানে? হয়তো দেখবেন গেরুয়া বসন পরা, হাতে শিঙা, কাঁধে ঝোলা, কপালে তিলক, কোনও জটাধারীই মস্ত বড়ো ঠগ বা প্যান্ট-শার্ট পরা ভদ্রলোকের পোশাকে কেউ… (বলে টেরিয়ে সৌমেনের দিকে তাকায়)।

—ঠিকই বলেছ। তবে ভাবনাটা ঠিক নয়, আমি চোর-জোচ্চোর নই। আমার এ রকম একজনের সঙ্গে পরিচয়ে দরকার। কাগজে মেলার খবরটা তাহলে একটু অন্যরকম ভাবে করা যাবে।

—দেখুন, খুঁজে বের করতে পারেন কিনা সেরকম কাউকে।

—নাহলে তোমাকেই খবর করব, বলে হেসে উঠে যায় সৌমেন। বুড়িমার কাছে এসে পা ছড়িয়ে বসে পাশে, একটা কেক এগিয়ে দেয় বুড়িমার দিকে। সৌমেনকে দেখে খুশি খুশি মুখে বলে, তোর টাকায় কাল মাছ ভাত খেলাম।

—সে কী গো, তুমি মাছ খাও? তুমি না ঠাকুরের বিধবা!

—ও সব অতীত। আমার সংসারও নেই আর সংসারের নিয়ম মানার দায়ও নেই। মন চাইল, খেয়ে নিলাম। পাপের বোঝা না হয় আর একটু বাড়ল! বলে বুড়ি ফিক ফিক করে হাসতে থাকে।

—আচ্ছা বুড়িমা, তুমি তো অনেক বছর ধরে এখানে আছো। প্রতিবছর মেলা, মেলায় বছর বছর আসা লোকজনকে দেখছ। মেলায় ঠগ-জোচ্চোর যারা আসে তাদের কাউকে চেনো?

—দু’একটার মুখ চিনি। প্রথমে তো বোঝার উপায় নেই। মেলার মধ্যে পুলিশ যখন ওদের ধরে তখন দেখেছি। চোর-বদমায়েশ, মেয়েমদ্দয় কোনও ভেদ নেই। সব্বাই আছে সে দলে।

—মেয়েরাও আছে? বেশ ইন্টারেস্টিং। এরকম একজনের সঙ্গে পরিচয় হলে বেশ হয়।

—সে বেটি এলে দেখিয়ে দেব ’খন। দেখে বড়ো ঘরেরই মনে হয়। কেন যে এমনটা করে বুঝি না। গতবছর মেলার সময় পুলিশ ওকে ধরল যখন, আমি তো থ। সেদিনই সকালে আমাকে একটা চাদর দিয়েছিল গায়ে দেওয়ার জন্য। সে যে এমন ঠগি, কে জানত! আমি তো সেদিনই সে চাদর সাগরে বিসর্জন দিয়ে দিয়েছি। বুড়ির কথা শুনে সৌমেনের মায়া হয়। হয়তো বুড়ির শীতে গায়ে দেওয়ার মতো কোনও চাদর নেই।

এত বড়োলোক ঘরের মানুষ অভিমানে কত কষ্টের মধ্যেই না দিন কাটাচ্ছে। সৌমেন আমতা আমতা করে বলে, আমার কাছে একটা চাদর আছে, কেমন ঠান্ডা পড়বে কে জানে, ভেবে নিয়ে এসেছিলাম। এবার তো ঠান্ডা তেমন পড়েনি, আমার এই জ্যাকেটের বেশি আর কিছু লাগবে না। তোমাকে চাদরটা দিলে নেবে তো? বুড়ি সৌমেনের মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

—সত্যি বলছি আমি ঠগ জোচ্চোর নই। আমি খবরের কাগজে লিখি, সৌমেন ব্যাগ ঘেঁটে দু-একটা কাগজ বের করে। এই দ্যাখো, দ্যাখো, আমার লেখা। সত্যি বলছি। বুড়ির ঠোঁটের ফাঁকে হালকা হাসির রেখা দেখা দেয়।

—খবরের কাগজে লিখিস মানলাম, বেশ ভালো। তা সব সত্যি তো লিখিস না তোরা। সেবার যখন মেলায় হুড়োহুড়িতে ভিড়ের মধ্যে পায়ের চাপে শ’খানেক লোক মরল, তোরা তা কমিয়ে বিশ জনের মরার খবর লিখলি। আমি পড়িনি, সবাই বলাবলি করছিল, শুনেছি।

—ওরকম লিখতে হয়। পুলিশ, প্রশাসন, সরকারের লোকজন সকলের থেকে আমাদের উপর অনেক চাপ থাকে। আমাদের সকলকে নিয়ে চলতে হয়, বুড়িমা ওসব তুমি বুঝবে না।

বুড়ি হাসতে হাসতে বলে, সবাই পাপী। রাজাও পাপী, প্রজাও পাপী, আমিও পাপী, তুইও পাপী।

সৌমেন উঠে দাঁড়ায়। এখন উঠি বুড়িমা। বিকেলে এসে তোমাকে চাদরটা দিয়ে যাব, গায়ে দেবে কিন্তু। আর তোমাকে বলে রাখলাম, সেই ঠগিই হোক বা অন্য কেউ, কোনও একজনকে আমার চাই। কাউকে দেখলে কিনা, বিকেলে তখন খোঁজ নিয়ে যাব। সে এলে আমার কথা বোলো। বোলো ভয়ের কিছু নেই, পুলিশের ঝামেলা হবে না, খবরের কাগজের লোক। কিছু কথা শুনব, জানব। তার সময় নষ্ট করার জন্য ন্যায্যমূল্য ধরে দেব।

 

( )

এখন বেশ লোকজনের ভিড় জমেছে। রাত পোহালেই অন্ধকার মাখা ভোর সকালে নাগা সন্ন্যাসীদের শাহি স্নানের পর সাগরে স্নান সেরে পুণ্য অর্জন করবে লাখ লাখ পুণ্যার্থী। মেলা মেলা ভাবটা একটু একটু করে জমে উঠছে। পুলিশ প্রশাসনের তৎপরতাও বেড়েছে। সৌমেন কচুবেড়িয়া ফেরিঘাটের এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে দু’চোখে খবর খুঁজছে। ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে অন করে। এলইডি স্ক্রিনে চোখ রাখে, ক্যামেরা সেটিং ঠিক করে নেয় পছন্দমতো দু’-চারটে ছবি তোলার জন্য।

ক্যামেরার লেন্সে জিন্স, টি-শার্ট পরা, কোঁকড়ানো লম্বা চুলের মেয়েটির ছবি ভেসে ওঠে। সৌমেন টেলি লেন্সের জুম চার্জ করে মেয়েটিকে ক্লোজে ধরে। বেশ সুন্দরী। বয়স আঠাশ-ত্রিশের কাছাকাছি হবে। সেও একমনে একটা দামি মিরর লেন্স ক্যামেরাতে মুভি শুট করছে। ক্যামেরা মুভমেন্ট দেখে আন্দাজ করতে পারে সৌমেন। তার ক্রস বডি সিলিং ব্যাগে রাখা স্পাইস নিউজ-এর লোগো লাগানো মাইক্রোফোনটা ব্যাগ থেকে বের হয়ে ঝুলছে। অজান্তেই ক্যামেরার শাটারে হাত পড়ে যায় সৌমেনের। ক্যামেরা ক্লিক করে ওঠে। এবার সৌমেন নিজে থেকেই আরও কয়েকটা ছবি তোলে।

সৌমেন মনে মনে ভাবে, এও তো রিপোর্টার। কলকাতার কোনও প্রেস মিট-এ তো কখনও দেখা হয়নি। প্রেস মিট-এ এলে এমন সুন্দরী মেয়েটি নিশ্চয় তার নজর এড়িয়ে যেত না। হয়তো অন্য কোনও সিটির হবে। চ্যানেলের নামটাও তেমন চেনা লাগছে না। আজকাল অবশ্য অনেক ওয়েব পোর্টাল, অনলাইন নিউজ চ্যানেল হয়েছে। সকলকে চেনা মুশকিল। আলাপ করবে ভেবে সৌমেন এগিয়ে যায়। সৌমেন কাছে যেতেই মেয়েটি ওকে লক্ষ্য করে বলে ওঠে, আই গেস, আপনিও রিপোর্টার! কোনও পেপারের না চ্যানেলের?

—আমি রিপোর্টার বুঝলেন কী করে?

—আরে বাবা, দেখলেই বোঝা যায়। মেলা শুরুর আগে থেকেই এরকম আদেখলার মতো ফটো তুলে বেড়াবে, রিপোর্টার ছাড়া আর কে?

—সত্যি, আপনার পর্যবেক্ষণ শক্তির প্রশংসা করতে হয়। আপনি কোথায় আছেন? এই স্পাইস নিউজ-এর নামটা ঠিক আমার চেনা নয়।

—না, অ্যাকচুয়ালি এটা একটা ইউকে বেসড নিউজ চ্যানেল। আমি এই হাউসের ইন্ডিয়ান করেসপনডেন্ট।

—কী ব্যাপার বলুন তো? আজকাল আমার অনেক বন্ধুর মুখেই ইউকে-র কথা শুনছি। বলছে একটু বোল্ড কনটেন্ট-সহ শর্ট ডিউরেশনের ফিল্ম বানিয়ে আউট রাইট সেল করে ডলারে বেশ ভালো পেমেন্টও নাকি পাচ্ছে।

—তাই নাকি! আই হ্যাভ নো নলেজ অ্যাবাউট দ্যাট। আই অ্যাম ডাইরেক্টলি লিঙ্কড উইথ দ্য চ্যানেল। মাই ইন্টারেস্ট ইজ স্ট্রিক্টলি ইন ডকুমেন্ট্রি অ্যান্ড নিউজ।

—আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে ভালোই হল, বিদেশের একটা লিংক পাওয়া গেল।

—আমারও। আমার সঙ্গে একজনের আসার কথা ছিল, হঠাৎ সে অসুস্থ হয়ে পড়ল। আই ডিসাইডেড টু কাম অ্যালোন। বাট ফেসিং লট অফ প্রবলেমস। দেখুন না, মাইক্রোফোনটা কাঁধে ঝুলিয়ে রেখেছি। কারও ইন্টারভিউ নিতে পারছি না। আপনি আমার সঙ্গে থাকুন না প্লিজ, হোপ কিছুটা হেল্প পাব।

সৌমেন গম্ভীর ভাবে মেয়েটির দিকে ফিরে তাকায়। মেয়েটি কিছু ভুল বলে ফেলেছে মনে করে বলে ওঠে, সরি, কিছু মনে করবেন না। মানে বলতে চাইছিলাম, আপনি এগ্রি করলে আপনার সঙ্গে সঙ্গে আমিও ঘুরব। সৌমেন হাসে।

—ঠিক আছে, সেটা কোনও প্রবলেম হবে না। পরে বোঝাপড়া করে নেওয়া যাবে, কে কার সঙ্গে ঘুরবে। কিন্তু দু’জনের পরিচয়টাই তো হল না। সেটা আগে সেরে নেওয়া যাক। আমি সৌমেন বোস। নতুন দিন পত্রিকার ইন হাউস জার্নালিস্ট, বাড়ি কলকাতায়। মেয়েটি হাসি মুখে ডান হাতটা সৌমেনের দিকে এগিয়ে দেয়।

—জয়ী সেন। জন্ম দিল্লিতে, আন্ডার গ্রাজুয়েশন ইন্ডিয়াতে, দেন হায়ার স্টাডিজ ইউকে-তে। আপাতত কয়েক মাস এখন কলকাতাতেই থাকব। পেযিং গেস্ট থাকি। সৌমেন হাত বাড়িয়ে জয়ীর সঙ্গে হাত মেলায়।

—চলুন ভিড় বাড়ার আগে যতটা বেশি কভার করা যায়। জয়ী ন্যাকামি করে বলে,

—আমার আপনি-টাপনি ভালো লাগে না। নাউ উই আর ফ্রেন্ডস। সে মি তুমি।

—ওকে। সমুদ্রের দিকটায় গিয়েছ কি? আমি অবশ্য আগে একবার ঘুরে এসেছি। চলো এখন ওদিকটা কভার করে আসি।

—দেন, আমরা মেলায় আসা লোকজনের জন্য সরকারের করা অ্যামেনিটিসগুলো কভার করব।

কচুবেড়িয়া স্ট্যান্ড থেকে ট্রেকারে উঠবে বলে দু’জনে একসঙ্গে এগিয়ে যায়, হাঁটতে হাঁটতে খুচরো আলাপচারিতা করে। সৌমেন জানায়, সে প্রেসের লোকজনের জন্য নির্দিষ্ট টেন্টে আছে। জয়ী একটা হোটেল রুম বুক করে রেখেছিল অনেক আগেই। তাই তার ঠিকানা ওই হোটেলটিই। ট্রেকার থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে সৌমেন জয়ীকে গঙ্গাসাগর মেলার মাহাত্ম্য ও অতীত লোককথা শোনায়।

—গঙ্গা নদী ও বঙ্গোপসাগর এখানে মিলিত হয়েছে বলে এই জায়গার নাম হয়েছে গঙ্গাসাগর। কুম্ভ মেলার পর গঙ্গাসাগর মেলা দ্বিতীয় বৃহত্তম হিন্দু মেলা। কথিত আছে ইক্ষাকু বংসের রাজা সাগর, অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেন। ভীত হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র যজ্ঞের ঘোড়া চুরি করে কপিলমুনির আশ্রমের কাছে পাতালে লুকিয়ে রাখেন। রাজার ষাট হাজার সন্তান ঘোড়া খুঁজতে খুঁজতে কপিলমুনির আশ্রমে এসে ঘোড়া খুঁজে পেলে, কপিলমুনিকে দোষী সাব্যস্ত করে। কপিলমুনি রেগে গিয়ে অভিশাপ দিলে তারা ভস্মীভূত হয়। পরে সাগর রাজবংশের উত্তরপুরুষ ভাগীরথ মহাদেবকে তুষ্ট করে পতিতপাবনী গঙ্গাকে স্বর্গ থেকে মর্তে নিয়ে আসেন। গঙ্গার ধারায় ভস্মীভূত সেই সন্তানরা পুনর্জীবন লাভ করে সশরীরে স্বর্গে ফিরে যান। আর এই কারণেই হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসীদের কাছে এটি একটি পবিত্র তীর্থক্ষেত্র।

এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে বেশ বেলা হয়েছে। কপিলমুনির মন্দিরের পাশের সমুদ্র এলাকাটা প্রায় পুরোটাই কভার করা হয়ে গেছে। দু’জনে একটা ছোটো হোটেলে বসে দুপুরের খাওয়া সেরে নেয়। জয়ীই পেমেন্ট করে। প্রায় জোর করেই জয়ী, সৌমেনের মানিপার্স পকেটে ঢুকিয়ে দেয়। খাওয়া-দাওয়ার পর জয়ী বলে, সাধু-সন্তদের কিছু বাইটস নিয়ে নিলে হয় না? আর সম্ভব হলে দু’-এক জনের ইন্টারভিউ।

সৌমেন রসিকতা করে, যে-কোনও সাধু হলেই হবে, না নাগা সন্ন্যাসী চাই? জয়ীও চটপট উত্তর দেয়, লেটার ইজ বেটার।

ওরা দু’জনে সাধু সন্তদের আস্তানার দিকে পা বাড়ায়। নানান বেশের সাধু-সন্তের ছড়াছড়ি। নাগা সন্ন্যাসীদের কাছে যাওয়ায় বেশ কড়াকড়ি। এখানে বেশ কয়েকজন বিদেশি পর্যটককেও দেখতে পায় সৌমেন। জয়ী ওদের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা একজন মধ্যবয়সি বিদেশি ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ জমায়। সেও সুন্দরী মহিলার সঙ্গে গল্প করতে বেশ ইন্টারেস্টেড হয়ে পড়েছে। জয়ী, সৌমেনের সঙ্গে সেও সঙ্গী হয়ে যায়।

ভদ্রলোক আমেরিকা থেকে এসেছেন, সাগরের সব থেকে বড়ো হোটেলে উঠেছেন। সন্ধ্যা নেমে আসতে ভদ্রলোক নমস্কার জানিয়ে বিদায় নেন, যাওয়ার সময় জয়ীর হাতে নিজের একটা ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দিয়ে যান। জয়ী বলে, ইউ মাস্ট কাম অ্যাট আরলি মর্নিং টু টেক অ্যা হোলি ডিপ। ইটস আওয়ার বিলিফ দ্যাট ইফ ওয়ান টেকস দিস বাথ, গড উইল সেভ হিম ফ্রম অল ইভিলস। আই উইল রিমাইন্ড ইউ ইন আরলি মর্নিং।

—থ্যাংক ইউ। উই উইল মিট টুমরো। বাই। ভদ্রলোক এগিয়ে যান।

সৌমেন একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে, জয়ীর যেচে পড়ে ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ জমানোতে, ওর জন্য বেশি বেশি ইন্টারেস্ট দেখানোতে।

জয়ী বলে ওঠে, দ্য গাই ইজ রিয়েলি অ্যা জেন্টেলম্যান, অলসো হ্যান্ডসাম। আজ দিনটা বেশ ভালো। ভালো ভালো লোকজনের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে। প্রথমে তুমি, দেন হি।

সৌমেন রুষ্ট ভাবে জবাব দেয়, এখনও দিন শেষ হতে বেশ কিছু সময় বাকি। দ্যাখো, আরও কেউ আসে কিনা, আরও কাউকে পাও কিনা।

জয়ী, সৌমেনের ট্যারা কথা অগ্রাহ্য করে চুপচাপ হেঁটে চলে। দু’জনে এগিয়ে গিয়ে গাঁজার ছিলিমে লম্বা টান দিতে থাকা সাধুবাবার কাছে গিয়ে বসে পড়ে। সৌমেন হাত জোড় করে প্রণাম করে। জয়ী ক্যামেরা অন করে, বাইটস নেওয়ার জন্য। সৌমেনের হাতে ধরা মাইক্রোফোন।

—প্রণাম বাবাজি।

—সুখী ভব।

সৌমেন প্রশ্ন করে, বাবাজি আপনে হমে আশীর্বাদ দিয়া সুখী ভব। কৃপয়া হমে সমঝাইয়ে সুখ কা মতলব কেয়া হ্যায়, কেয়া চিজ হ্যায় ও?

—মন কা চাহত যব পার্থিব বস্তু রূপ সে আধ্যাত্মিকতা কা ঔর চল পড়তা হ্যায়, তব হোতা হ্যায় সুখ সে পহচান।

—তব কেয়া ইস মনুষ্য জীবন কা বিনাশ হোনে সে হি মিলতা হ্যায় সুখ?

—মুরখ। পহলে ইস পৃথ্বী পর বিরাজমান সারে বস্তু কা আস্বাদন লে। উসকে বাদ ভালা বুরা কা বিচার সে মন কো সারে বুরা চিজ সে মুক্ত কর লেনা। তব হি মিলেগা সুখ।

—এ তো বড়া হি কঠিন কাম। ইতনা বড়া পৃথ্বী, ইতনা কুছ দেখনা হ্যায়, সমঝনা হ্যায়, ইসসে তো পুরা জীবনহি বীত যায়েগা। লাগতা হ্যায় ইস জনম মে হমে সুখ কা দিশাহি নহি মিলেগা।

—শুদ্ধ মন আউর তেজ দিমাগ সে কাম লে বেটা, সময় পর রাজ কর পায়েগা। তব আসানি সে সুখ ভি মিল যায়েগা।

কথাটা সৌমেনের বেশ মনে ধরেছে। গড় হয়ে সাধুবাবার পায়ে মাথা ঠোকে। সৌমেনের দেখাদেখি জয়ীও সাধুবাবার চরণ স্পর্শ করে। সাধুবাবাজি দু’জনের মাথায় আশীর্বাদের হাত রাখে।

( )

পৌষ সংক্রান্তির মহা পুণ্যলগ্নে স্নানের জন্য গঙ্গাসাগর তীরে লাখো মানুষের ভিড় জমেছে। পৌষের কনকনে ঠান্ডা, কুয়াশার আচ্ছাদন উপেক্ষা করে পুণ্যস্নানের জন্য সবাই উদগ্রীব। নাগা সন্ন্যাসীরা স্নান সেরে উঠলেই সকলে সাগরের জলে ডুব দেবে ইহজগতে জমানো পাপ ধুয়ে ফেলার জন্য। ভিড় সামলাতে প্রশাসনের তরফ থেকে যথেষ্ট ব্যবস্থা করা হয়েছে। জায়গায় জায়গায় দেওয়া হয়েছে বাঁশের রেলিং। মাইকে নানান সতর্কতামূলক ঘোষণা চলছে।

সৌমেন ভোর রাত্রে উঠে প্রেসের লোকেদের সঙ্গে একটা ভালো পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু মনটা জয়ীর জন্য উশখুশ করছে। তারও তো সকালে আসার কথা ছিল কিন্তু কাল রাত্রি থেকে আর যোগাযোগ হয়নি। সৌমেন কাল রাত্রে একবার আর আজ সকালেও একবার ফোন করেছিল, মোবাইল অফ ছিল তখন। সৌমেনের জোড়া চোখ এদিক ওদিক জয়ীকে খুঁজতে থাকে।

মাইকে ঘোষণা হল, নাগা সন্ন্যাসীরা স্নান করতে আসছে। তাদের জন্য রাস্তা খালি করে দিতে অনুরোধ জানানো হচ্ছে। গায়ে ভষ্ম মেখে, লম্বা জটা ঝুলিয়ে শ’দুয়েক নাগা সন্ন্যাসী জয় গঙ্গা মাইয়া কী জয়। জয় কপিলমুনির জয় ধবনি-সহ দৌড়োতে দৌড়োতে এগিয়ে যায় সাগরের দিকে। তাদের সঙ্গী সাথিরা জোরে জোরে শিঙা ফুঁকছে।

সাগরের জলে ডুব দিয়ে নাগা সন্ন্যাসীরা মাথা তুলে লম্বা জটা ঘুরিয়ে সাগরের জল ছিটিয়ে দিচ্ছে চারিদিকে। শঙ্খ, শিঙা ধ্বনিতে এক পুণ্য মুহূর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এ এক অপরূপ অভিজ্ঞতা। সৌমেন তার ক্যামেরায় যত বেশি সম্ভব ফটো তুলতে থাকে। ডিজিটাল ক্যামেরায় দু’-চারটে ভিডিও ক্লিপিংসও তুলে রাখে। কোনও কারণে জয়ী না এসে থাকলে, ওই ক্লিপিংসগুলো জয়ীকে দিয়ে দেবে। ওর কাজে লাগবে।

এখন সকালের আলো বেশ উজ্জ্বল হয়েছে। পুণ্য স্নানের পরে ভিড়ও ধীরে ধীরে পাতলা হচ্ছে। সৌমেন পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে চেনা চায়ের দোকানটায় বসে। চা-বিস্কুটের অর্ডার দেয়। বুড়িমা এই সকালেই গাছতলায় এসে বসেছে। সৌমেনের দেওয়া চাদরটায় মুড়ি দিয়ে সে জবুথবু হয়ে বসে আছে।

দূর থেকে সৌমেন-কে দেখতে পেয়ে ডাকে, বেটা, ও খবরি বেটা, এদিকে শুনে যা, কথা আছে। বুড়িমার ডাক শুনে একটা প্লেটে করে দু’-কাপ চা আর দু-প্যাকেট বিস্কুট নিয়ে সৌমেন বুড়িমার কাছে গিয়ে বসে। বুড়িমার দিকে এক কাপ চা আর এক প্যাকেট বিস্কুট এগিয়ে দেয়।

—নাও গরম চা খেতে খেতে বলো, কী বলছিলে। সকালের ঠান্ডাটা বেশ জমিয়ে পড়েছে।

সৌমেনের দিকে তাকিয়ে বুড়িমা বলে, খবর চাইছিলি না? খবর আছে। সেই বিটি এবারও মেলায় এসেছে। কালকে সন্ধেতে দেখলাম। একজন ফর্সা মতো লোকের সঙ্গে হাত ধরে ঘুরছিল। আমার কাছে এসে বলল, ওর বন্ধুকে নিয়ে পুজো দিতে এসেছে। সেই বন্ধুর বিদেশে অনেক বড়ো ব্যাবসা, তাকে নাকি বিয়ে করবে। কয়েক দিন পরেই বিদেশ চলে যাচ্ছে, তাই বিদেশ যাওয়ার আগে পুজো দিতে এসেছে। এখন নাকি সে ভালো হয়ে গিয়েছে, চুরি বাটপাড়ির সব খারাপ কাজ ছেড়ে দিয়েছে। যত কথা নিজে থেকে ওই বেটিই বলল। ওর সঙ্গের ছেলেটা কোনও কথাই বলছিল না। আমাদের কথা সে বুঝতে পারছিল কিনা সেটাই বুঝতে পারলাম না।

—যাঃ। আমার সঙ্গে তাহলে আর দেখা হল না। বড়ো আপশোশ, সামনা সামনি বসে একবার কথা বলতে পারলাম না। সে যাক, তুমি যা গল্প শোনালে তাতেই আমার গল্পে টুইস্ট এসে যাবে।

—তুই একবার সন্ধের দিকে ঘুরে যাস, হয়তো সে বেটির সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। বলছিল দু’-এক দিন এখানেই থাকবে।

সৌমেন চিন্তায় পড়ে যায়। আজই তার ফেরবার কথা ছিল কিন্তু বুড়িমা যা বলল তাতে তো আজকের দিনটা থাকতেই হয়। এমন একটা স্পেসিমেন-কে চাক্ষুস দেখার সুয়োগ হাতছাড়া করা উচিত নয়। সৌমেন মাথা চুলকে বলে, আজ তো আমার ফেরার কথা ছিল, তুমি বলছ যখন আজকের দিনটা থেকেই যাই।

সৌমেনের ফিরে যাওয়ার কথা শুনে বুড়িমা মুখ তুলে বিষণ্ণ ভাবে সৌমেনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনের গোপন কোণে জেগে ওঠা ব্যথা চেপে রেখে জড়িয়ে আসা গলায় বলে, আজই চলে যেতি না? যাবি তো বটেই, আজ নয়তো কাল তো যাবিই। আমারই খেয়াল ছিল না। ক’দিন পরে মেলা ভেঙে যাবে, একে একে সবাই ফিরে যাবে। আমি আবার একা একা বসে থাকব এই গাছতলায়। গুটিকতক লোক আসা যাওয়ার পথে যা দেবে তাতেই দিন চলবে। দিন চলে যায়, পেটও ভরে কিন্তু আমার সময় শেষ হতে চায় না।

বুড়িমা যেন আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছে। সৌমেনও এই দু’দিনে বুড়িমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। সৌমেন সহসা বুড়িমার হাত দুটো ধরে অনুরোধ করে, বুড়িমা, তুমি আমার সঙ্গে যাবে? বাড়িতে আমার মা আছে, তোমার মেয়ের মতো। তার কাছে থাকবে, দু’জনে মিলে গল্প করবে। দেখবে তোমার কোনও অসুবিধা হবে না।

—না রে বেটা, আমি আর সংসারের জালে জড়াতে চাই না। দশ বছর এখানে আছি, তোর মতো এমন করে কেউ কখনও বলেনি। তবুও আমি পারব না। আমার এই ভালো।

বুড়িমার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। সৌমেন বুড়িমার মাথাটা বুকের মধ্যে টেনে নেয়।

—আমি আবার আসব। শুধু তোমার জন্য।

( )

জয়ীর সঙ্গে যে-বিদেশি ভদ্রলোকের পরিচয় হয়েছিল তার নাম পিটার স্যামুয়েল। আমেরিকার নিউইয়র্ক-এ থাকে। হলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে লাইন প্রোডিউসারের কাজ করে। হলিউড প্রোডাকশন-এর জন্য এর আগেও ভারতে বেশ কয়েকবার এসেছে। দিল্লি, আগ্রা, মুম্বই, হায়দরাবাদে শুটিং করেছে। এবার প্রোডোকশনের কাজে কলকাতায় এসেছিল। কলকাতায় এসে গঙ্গাসাগর মেলার ব্যাপারে জানতে পারে। তাই এই বিশেষ উৎসবে শামিল হওয়ার সুয়োগটা ছাড়তে চায়নি।

আমেরিকায় বসে কলকাতার দুর্গাপুজো আর বইমেলার খবর আগেই জানত। কিন্তু গঙ্গাসাগর মেলাটা নতুন জানা। লক্ষ লক্ষ মানুষ বিশ্বাস আর আবেগভরে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসে এই শান্ত সরল ছোট্ট সাগরদ্বীপে। কয়েক দিনের জন্য অচেনা জাঁকজমকে সেজে ওঠে জায়গাটা, তারপর আবার সেই আয়লা, আমফান, যশের ঘা মাখা গতানুগতিক জীবনযাপন।

জয়ীর সঙ্গে পরিচয়ের সময় পিটার যে-ভিজিটিং কার্ড দিয়েছিল, সেখান থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে জয়ী ফোন করে পিটারের হোটেলে এসেছে দেখা করার জন্য। পিটারের রুমে বসে গল্প করতে করতে জানতে পারে, সে অ্যাট প্রেজেন্ট সিঙ্গল, হলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত, পয়সাকড়িও আছে বেশ ভালো মতো। জয়ী তখনই প্ল্যান সাজিয়ে ফেলে। পিটারের সঙ্গে সে নিউইয়র্ক যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে।

জয়ীর ইংল্যান্ডের টেলিভিশন জার্নালিস্ট পরিচয়টা, পিটারের মধ্যেও ইন্টারেস্ট জাগিয়েছে। দু’জনে একসঙ্গে বসে ড্রিংক করে আর ভবিষ্যতে কী কী করবে স্বপ্নজাল বুনতে থাকে। জয়ী সে রাত্রিতে পিটারের হোটেলেই থেকে যায়। হঠাৎ করে সম্পর্কটা যেন অনেক গভীর হয়ে গেল। এই সম্পর্কটা গড়ার জন্য জয়ীর উৎসাহ আর আত্মকেন্দ্রিকতাটাই বেশি কাজ করেছে। আর পিটারের পক্ষে একজন ভিনদেশি সুন্দরীর মায়াবী ডাক ফেরানো মুশকিলই ছিল। তাই রাত্রিটুকু জয়ীর ইচ্ছাতেই চলতে হয়েছে পিটারকে।

সকালবেলা দু’জনের ঘুম ভেঙ্গেছে দেরিতে, ভোর সকালে সাগরে স্নান করে পুণ্য অর্জনের উপদেশটা পিটার আর পালন করতে পারল না। পিটারের আগে ঘুম ভেঙে উঠে গোছগাছ করে জয়ী বেরিয়ে পড়েছে হোটেল থেকে। যাওয়ার সময় পিটারকে কিছু বলে যায়নি। ঘুম থেকে উঠে জয়ীকে না দেখে গতরাত্রির ঘটনাটা স্বপ্ন বলে মনে হয় পিটারের। অনেকক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকে সে। এক এক করে পর পর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মনে করার চেষ্টা করে। না স্বপ্ন নয়, সে তো সত্যিই ছিল। রাত্রিতে একটু বেশি নেশা করেছিল ঠিকই কিন্তু আগের পরের সব ঘটনা পিটারের মনে পড়ে যাচ্ছে। তাহলে জয়ী গেল কোথায়?

পিটার মোবাইল তুলে জয়ীকে ফোন করে। ফোন অফ। পিটার বিছানা ছেড়ে উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয়। শার্ট প্যান্ট পরে বাইরে বের হওয়ার জন্য রেডি হতে গিয়ে লক্ষ্য করে বেড সাইড টেবিলে রাখা পার্সটা নেই। পিটার টেবিলের ড্রয়ার খুলে দেখে, বেডের উপর ছড়ানো ব্ল্যাংকেট, পিলো সরিয়ে একবার দেখে নেয়। কিন্তু পার্সটা কোথাও খুঁজে পায় না। ওর মধ্যে হাজার ত্রিশেক টাকা, পাঁচশো ডলার আর দুটো ডেবিট কার্ড ছিল। পিটার দরজা বন্ধ করে রিসেপশনে এসে দাঁড়ায়। সেখানে তার টাকা পয়সা হারানোর কথা জানায়।

কয়েকজন তো অচেনা মহিলার সঙ্গে রাত কাটানোর জন্য পিটারকেই দায়ী করে। পিটারের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত একজন হোটেলকর্মী তাকে নিয়ে গঙ্গাসাগরের অস্থায়ী থানায় এসে সব জানায়। ডিউটি অফিসার এমন ঘটনায় বেশ অস্বস্তিতে পড়েছেন। এমনিতে নানান চোর-জোচ্চোর সামলানোর অভিজ্ঞতা আছে তাঁর কিন্তু এভাবে কোনও মহিলা যে, মেলার মধ্যে বন্ধুত্ব পাতিয়ে এক বিদেশি পর্যটকের কাছ থেকে টাকা পয়সা, ডেবিট কার্ড হাতিয়ে নেবে, সেটা তো কল্পনার মধ্যেই ছিল না।

পুলিশ অফিসার মিঃ সোম কেস ডায়ারি নোট করেন। একটা ভারী ঝামেলা মাথায় এসে পড়ল। বিদেশি পর্যটক, তাও আবার অ্যামেরিকার। এবার অ্যামেরিকান এমব্যাসি থেকেও চাপ আসবে। চুপচাপ বসে থাকবার উপায় নেই, কিছু একটা করতেই হবে। মিঃ সোম, পিটারের কাছে মহিলার কোনও ছবি আছে কিনা জানতে চান। পিটার সেরকম কোনও সাহায্য করতে পারল না।

একটা ছবি পাওয়া গেলে সেটা মেলায় উপস্থিত সব পুলিশের কাছে পাঠানো যেত। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে মিঃ সোমের কপালটা ঠান্ডার মধ্যেও ঘেমে উঠেছে। তিনি পিটারকে আশ্বস্ত করেন, তাকে কলকাতা পর্যন্ত পৌঁছোনোর ব্যবস্থা পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে করবেন। কথাবার্তার মধ্যেই পিটারের ফোনে ব্যাংক ট্রাঞ্জাকশনের মেসেজ আসতে থাকে।

জয়ী ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে এটিএম থেকে আরও বেশ কিছু টাকা তুলে নিয়েছে। ডেবিট কার্ডের সিক্রেট পিন নাম্বারটা নতুন। মুখস্থ হয়নি বলে পার্স-এই একটা ছোট্ট চিরকুটে লিখে রেখেছিল সে। মোবাইলে ক্যাশ উইথড্রলের মেসেজগুলো পেয়ে পিটার নিজের উপর রেগেমেগে দেয়ালে সজোরে ঘুসি মারে।

খবরটা এর-ওর মাধ্যমে সৌমেনের কাছেও পৌঁছেছে। আঁখো দেখা হাল জানবার জন্য সে তড়িঘড়ি থানায় এসে উপস্থিত হয়। উৎসাহী লোকের বেশ ভিড় জমেছে। এক ফরেনারের টাকা, পয়সা, ডেবিট কার্ড চুরি হয়েছে, তার মধ্যে আবার মেয়েঘটিত ব্যাপার জড়িত, এমন রসালো খবরে লোকে মজা তো কুড়োবেই।

সেখানে পৌঁছে সৌমেন হতবাক, এ ফরেনার তো তার চেনা, পিটার। সামনে না এগিয়ে ও দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। জয়ী কি জানে খবরটা! সৌমেন চুপি চুপি সেখানকার দু’-চারটে ছবি তুলে নেয়। সে ছবির মধ্যে পিটারও আছে। তার খবরের মধ্যে এই খবরটাও জায়গা করে নেবে। কিন্তু এত সব খবর জয়ীকে দেওয়া যাচ্ছে না বলে সৌমেনের মনটা উশখুশ করছে। দু’দিন ধরে তার ফোন অফ, মেলাতেও কোথাও দেখা গেল না। থানা ঘুরে সৌমেন আবার বুড়িমার কাছে আসে।

—কিছুক্ষণ আগেই তো এখান থেকে গেল, আবার ফিরে এল কেন? বুড়িমা জানতে চায় সৌমেনের কাছে। সৌমেন সংক্ষেপে সব ঘটনা বুড়িমাকে জানায়।

বুড়িমা সৌমেনকে বলে, সে ছেলেটার কোনও ফোটো তুলেছিস? সৌমেন মাথা নাড়িয়ে জানায়, হ্যাঁ।

—দেখা তো একবার সে বেটাকে।

সৌমেন ক্যামেরা বুড়িমার সামনে এনে ডিজিটাল স্ক্রিনে এক এক করে পিটারের ছবিগুলো দেখায়। বলে, একে আমি আগে থেকেই চিনতাম। একজন মহিলা সাংবাদিকের সঙ্গে মেলার ফটো তোলার সময় এর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল।

বুড়িমা চোখ কুঁচকে ঝুঁকে পড়ে ছবিগুলো ভালো করে দেখে উত্তেজনায় চেঁচিয়ে ওঠে, এই বেটাই তো ওই বেটির সঙ্গে সন্ধেবেলা হাত ধরাধরি করে ঘুরছিল। ও বেটি বলল এ তার বন্ধু, কিছুদিন পরে বিয়ে এক সঙ্গে পুজো দিতে এসেছে। এ নিশ্চয় ওই বেটির কাজ। এতক্ষণে সাগর ছেড়ে নিশ্চয় পালিয়েছে ও।

সৌমেন মাথা চাপড়ায়, যাঃ। এ যাত্রায় ভাগ্যে তার ঠগিনির সঙ্গে চাক্ষুস আলাপের সুয়োগটা আর হল না।

বুড়িমা সান্ত্বনা দেয়, দেখা হয়নি তো বেঁচে গেছিস। নয়তো দেখতি কখন তোকেও রাম ঠকান ঠকিয়ে গিয়েছে। ভাবছি, কী মিথ্যুক মেয়ে রে বাবা! আমার সঙ্গেও না কত মিথ্যে বলে গেল। সে নাকি সব খারাপ কাজ ছেড়ে ছুড়ে এখন ভালো হয়ে গিয়েছে। এই ভালোর নমুনা? তা হলে খারাপটা কী? সৌমেন বুড়িমার কাছ ঘেঁসে বসে।

—ছাড়ো ওই ঠগিনির কথা। তুমি আমার সঙ্গে যে-মেয়ে খবরি ঘুরছিল সে কেমন দেখতে জানতে চাইছিলে না? দেখবে?

বুড়িমা উৎফুল্ল হয়ে সৌমেনের মুখের কাছে মুখ নিয়ে আসে, কই সে? আমাকে দেখাবি বলে সঙ্গে নিয়ে এসেছিস তাকে?

—না গো না। কাল থেকে তো আমিই খুঁজে পাচ্ছি না তাকে। তবে তার ফটো আছে ক্যামেরাতে, দেখাতে পারি। দেখবে?

বুড়িমা উৎসুক হয়- দেখা দেখা, তাই দেখা। দেখি, তোর সেই খবরি কত সুন্দরী। সৌমেন ক্যামেরা ঘেঁটে ফেরিঘাটে তোলা জয়ীর ফটোগুলো দেখায় বুড়িমাকে।

ক্যামেরার স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে বুড়িমা করুণ ভাবে তাকায় সৌমেনের দিকে, শীর্ণ কোমল দু’হাতে আদর মাখিয়ে সে দু’হাত দিয়ে আলতো করে ধরে সৌমেনের মুখটা। সৌমেনের অবাক হওয়া চোখে চোখ রেখে বলে, বেটি তোকেও ঠকিয়েছে রে। ঠগিনির সঙ্গে দেখা হল না বলে আফশোস করছিলি তো! দেখা তো তোর আগেই হয়েছে। ঠগিনির ছল তুই ধরতেই পারিসনি। যে-ঠগিনি, সেই তোর খবরি মেয়ে বন্ধু।

বিশ্বাস ভাঙার আঘাতে সৌমেনের মুখটা কেমন যেন করুণ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। চোখের সামনে দিয়ে গত দু’দিনে ঘটা ঘটনাগুলো মুহূর্তে দ্রুতগতির সিনেমার ফ্রেমের মতো পার হয়ে যায়। সৌমেন আবাক হয়ে ভাবে, মানুষ মিথ্যের মুখোশ পরে এমন সহজ স্বাভাবিক অভিনয়টা করে কী করে? তারা কি সত্যিই মানুষ, নাকি হৃদয়হীন অন্য কিছু? ভালোবাসা, সুখ, দুঃখের তাপ কিছুই কি লাগে না তাদের বুকে!

পুলিশ নিশ্চয়ই এখন হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই ঠগিনিকে। সৌমেন ভাবে, সে কি পুলিশের কাছে গিয়ে বলবে সেও ঠকেছে ওই ঠগিনির কাছে, ক্যামেরা খুলে দেখিয়ে দেবে ঠগিনির আসল চেহারাটা। তখন তাকেও হয়তো সম্মুখীন হতে হবে অনেকগুলো অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখে। তবুও সৌমেন ক্যামেরা ব্যাগে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

বুড়িমা অভিজ্ঞতার কষ্টিপাথরে মন ঝালিয়ে নিয়ে বলে, থানায় যাচ্ছিস তো, ওই বেটিকে ধরিয়ে দিবি বলে? যাচ্ছিস যা, আটকাব না। মন যাতে শান্তি পায় তাই কর। তবে কি, যার মনটাই ভরে গিয়েছে ছলনায় তাকে সত্যের সাথে জুড়বি কেমন করে? এ যে সত্য-মিথ্যা, পাপ-পুণ্যের হিসাবের সংকট।

সৌমেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে, মনে মনে ধিক্কার দেয় নিজেকেই। সাগরদ্বীপে খবর করতে এসে সে নিজেই খবরের অংশ হয়ে গেল।

অনাহূত

আজ মনটা বেশ ফুরফুরে। আকাশে-বাতাসে উৎসবের আমেজ। রাতের চোখজুড়ানো আলোর রোশনাইয়ের রেশ চোখেমুখে লেগে রয়েছে। ছেলেমেয়ে দুটোর স্কুলও ছুটি। আনন্দ করে দিনটা কাটানো যাবে। গেলও তাই। বিকেলে হঠাৎ ভাই ফোনে জানাল, এবার সে ভাইফোঁটায় আসতে পারবে না। অফিস থেকে নাকি ছুটি পায়নি। মুহুর্তেই মনটা কেমন যেন ভার হয়ে গেল। হুট করে ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে অতদূর যাওয়াও তো সম্ভব নয় আমার পক্ষে। গুম হয়েই বসেছিলাম। সাত-পাঁচ ভাবছি, এমন সময় সাহেবের বায়না মা ব্রেডরোল বানিয়ে দাও। অগত্যা সবকিছু ভুলে রান্নাঘরে ছুটলাম।

ঠিক সেই সময় তনুর আওয়াজ কানে ভেসে এল, ‘মা রামলাল জেঠু এসেছে।’ মনে হল ওনাকে বসতে বলে তনু কোথাও পালাল।

‘ওফ্, বোর করতে চলে এসেছে।’ কথাটা নিজেকে শুনিয়েই যেন বলল, এমন ভাব করে সাহেব দৌড়ে সোজা পড়ার ঘরে গিয়ে বই নিয়ে বসে পড়ল।

উনি এতটাই ‘বোরিং’ যে বাচ্চারাও ওনার সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করে। সন্দীপও অফিস থেকে ফেরেনি।

ব্রেডরোল বানাবার পুর তৈরি করছিলাম। তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে রান্নাঘর থেকে বেরোব কী, উনিই রান্নাঘরে হাজির। এদিক-ওদিক দেখে জোরে একটা নিশ্বাস টেনে বললেন, ‘বাহ্। দারুণ গন্ধ। মনে হচ্ছে আজ স্পেশাল কিছু হচ্ছে ?’

‘হ্যাঁ, বাচ্চাদের আবদার আর কী!’

‘আজ তাহলে সন্ধের জলখাবারটা ভালোই জুটবে, কী বলো কাকলি। আমিও তো ওদের মতোই বাচ্চা নাকি।’ বলেই এমন ভাবে হাসতে শুরু করলেন যেন আমি ওনার খাস ইয়ার দোস্ত।

আর কোনও পথ না দেখে কড়া চাপিয়ে ব্রেডরোল বানাতে শুরু করলাম। ততক্ষণে উনি সাহেবের ঘরে পৌঁছে গেছেন। ‘আচ্ছা সাহেববাবা পড়াশোনা করছে। তাহলে তো ডিসটার্ব করা যাবে না’ বলে বাইরে বেরিয়ে সোফায় বসেই উচ্চস্বরে শ্যামা

সংগীত ধরলেন ‘শ্যামা মা কী আমার কালো রে, শ্যামা মা কী আমার কালো…’।

ওনার হাত থেকে বাঁচতে সাহেবের এই ধারালো অস্ত্র বরাবরের মতো এবারেও সফল। খাবারের প্লেট ওনার হাতে ধরিয়ে, নিজেকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করতে শুরু করলাম ওনার ‘জরুরি’ কথা শোনার জন্য। ওনার গ্রাম, খেতখামার, পঞ্চায়েত নিয়ে– সেই ঘ্যারঘ্যারে রেকর্ড আবার বাজতে শুরু করল। এই নিয়ে সাহেবও কম ঠাট্টাতামাশা করে না। কখনও কখনও বলেই বসে, ‘তা জেঠু সবকিছু যখন এতই মিস করো, তাহলে সেখানে গিয়েই থাকলে পারো। অনর্থক এখানে পড়ে আছো কেন?’

‘অপারগই বলতে পারো আমায়। খেতখামার, ঘরবাড়ি কিছুই তো আর নেই। তাই গ্রাম ছেড়ে চলে এলাম এখানে। নতুন করে পড়াশোনা শুরু করলাম। বড়ো হওয়ার মনোবাসনা তো ছিলই, মাথাটা সাহায্য করল। ইঞ্জিনিয়র হয়ে গেলাম।’

মাথাটাও সাহায্য করল শুনে সাহেবের সে কী হাসি। একা বসে ওনার কথা শুনতে শুনতে সাহেবের টিপ্পনিগুলো মনে পড়ে গেল। অজান্তেই কখন ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটে উঠেছে নিজেও বুঝতে পারিনি। মনে হয়, রামলালবাবু তখন ওনার পিতার মৃত্যু নিয়ে কিছু বলছিলেন, যা এর আগে বহুবার শুনিয়েছিলেন। মৃত্যুপ্রসঙ্গ চলাকালীন এমন অযাচিত হাসি তিনি বোধহয় মন থেকে মানতে পারেননি। হঠাৎ-ই ওনার থমথমে মুখ দেখে বুঝতে পেরে সংযত হলাম।

‘সন্দীপ তো এখনও এল না। ভাবছিলাম ওর সাথে বসে এককাপ চা খাব।’

বুঝলাম চা না খেয়ে উনি এক পা-ও নড়বেন না। কাজেই চুপচাপ চা বানিয়ে এনে দিলাম। এক-দেড় ঘন্টা বাদে যখন গেলেন তখন মাথাটা বেশ ধরে গেছে। সাহেবের ঘরে গিয়ে দেখলাম হাতটা গালে দিয়ে বসে কী যেন ভাবছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী রে গালে হাত দিয়ে আকাশপাতাল কী ভাবছিস।’

দার্শনিকের মতো জবাব দিল, ‘জানো মা, জেঠুর বাড়িতে আসার একটা ভালো দিকও আছে।’ বলেই বইটা হাতে নিয়ে দেখিয়ে দিল, ‘দ্যাখো এই কঠিন চ্যাপ্টারটা মুখস্ত হয়ে গেল।’

মাথাটা এত ধরেছিল যে ওর কথায় কোনও প্রতিক্রিয়াও করতে পারলাম না। গিয়ে শুয়ে পড়লাম। খানিক পরে সন্দীপ ফিরতেই সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল ওর উপর। ‘কেমন লোকেদের সঙ্গে আত্মীয়তা তোমার? যাকে কেউ পাত্তা দেয় না, সে যখন-তখন কথা নেই বার্তা নেই বাড়ি বয়ে চলে আসে।’

‘রামলালদা এসেছিল বুঝি?’ মৃদুস্বরে প্রশ্ন করে সন্দীপ।

‘তাছাড়া আর কে! দেড় ঘন্টা ধরে বসে ছিল। ভব্যতা-টব্যতা কিছু জানে না। চা-জলখাবার খেল তবে গেল এখান থেকে।’

‘আর ক’টা দিনের-ই তো ব্যাপার কাকলি। তারপর তো ওর বউ-বাচ্চা চলে আসবে। তখন দেখবে যাওয়া-আসা এমনিই কমে যাবে। একা থাকে। যদি একটু চা-জলখাবার খায়, তাতে কী এমন ক্ষতি বলো তো!’

‘হ্যাঁ, তা তো বলবেই। নিজেকে সহ্য করতে হলে বুঝতে।’ গজগজ করতে করতে গ্যাস অন করলাম।

‘জেঠু চলে গেছে?’ ঘরে ঢুকেই প্রশ্ন করল তনু।

‘আমার তো ভয় হচ্ছিল ফিরেও যদি দেখি জেঠু আছে। তাহলে তো সেই একই গল্প আবার শোনাবে।’

এগারো বছরের ছোট্ট তনুও বুঝে গেছে একঘেয়ে জিনিসটা কী! ভোপাল থেকে বদলি হয়ে যখন নতুন এসেছিলেন, তখন সাহেব আর তনু ওনার কোল ঘেঁষে বসে পড়ত গল্প শোনার জন্য। আর এখন দেখলেই দৌড়োয়। ছেলের পড়াশোনার জন্য রামলালবাবুর স্ত্রী ভোপালেই থেকে গেছেন। পড়াশোনা শেষ হলে এবার ফিরবেন। ততদিন এই মহাশয়কে সহ্য করতে হবে।

আমাদের পড়শি মধুলিকারও জবাব নেই। যখনই আসবে খোঁচা ওকে দিতেই হবে। ‘কী কাকলি আজ রামলালবাবু আসেননি।’ ভাবটা এমন যেন উনি রোজ আসেন।

তারপর বলবে, ‘তুমিও পারো। এরকম একটা লোককে কী করে আশকারা দাও কে জানে। দেখলেই গাঁইয়া ভূত মনে হয়। মাথায় চপচপে তেল। টেরিকাটা সিঁথি। পোশাক-আশাকেরও কোনও ছিরিছাঁদ নেই। সন্দীপদা যে কী করে ওনার বন্ধু হলেন…।’

একদিন সন্ধ্যাবেলা সিরিয়াল দেখতে বসেছি। দারুণ ক্লাইম্যাক্স। বাড়ির মুখরা বড়োবউ ঝগড়ার সময় শাশুড়িকে ছোটোলোক বাড়ির মেয়ে বলে বসেছে। সেই নিয়েই ড্রামা বেশ জমে উঠেছে। এমন সময় কলিংবেল-এর আওয়াজ। একবার ভাবলাম, দূর সিনটা দেখে তারপরই যাব। পরমুহূর্তেই মনে হল, যদি সেরকম কেউ হয় তাহলে কিছু মনে করতে পারে। একপ্রকার বিরক্ত হয়ে দরজা খুলতে গেলাম। দরজা খুলে দেখি, রামলালবাবু। রাগে গা-টা জ্বলছিল। তার উপর ঘরে ঢুকেই লাটসাহেব বলে বসলেন, ‘কাকলি এক কাপ চা হবে নাকি?’

কোনওমতে রাগ সংবরণ করে বললাম, ‘চা যে শেষ হয়ে গেছে দাদা।’

‘চা শেষ হয়ে গেছে কী বলছ! কালই তো অফিস থেকে ফেরার পথে মোড়ের মাথার টি-জংশন থেকে আড়াইশো চা কিনল সন্দীপ। মোড়ের মাথাতেই দেখা হল ওর সঙ্গে। আমিও তো সঙ্গে গেলাম।’ বেশ আশ্চর্য হয়েই বলে গেলেন উনি।

ক্ষণিকের জন্য হকচকিয়ে গেলেও আগেই মনস্থির করেছিলাম আজ কোনও মতেই ওনাকে এন্টারটেইন করব না। বললাম, ‘হ্যাঁ, দেখেছেন ঠিকই। চা কিনেছে বটে, তবে সে চা আর বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছোয়নি। পথেই হোঁচট খেয়ে সব পড়ে গেছে।’

‘ওঃ তাই। সকালে তো দেখা হল, কই কিছু বলল না-তো সন্দীপ। কোথাও লাগে-টাগেনি তো?’ উদ্বেগ প্রকাশ করলেন রামলালবাবু। উত্তেজিত হয়েই বললাম, ‘এতে আর বলার কী আছে। কিছু হলে তো জানতেনই।’

মাথাটা নাড়িয়ে বললেন, ‘তা বটে। ঠিক আছে কাকলি তাহলে আমি নিয়ে আসছি।’

প্রত্যুত্তরে বললাম, ‘না না, আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না। আসলে আমারও একটু বেরোনোর আছে।’

এই ঘটনার পরে উনি যতবার এসেছেন, আমার থেকে এরকম ব্যবহারই পেয়েছেন। প্রথম প্রথম এজন্য আমারও খারাপ লাগত। পরে মনে হল, যাকে আমি পছন্দই করি না, তার সাথে সদ্ব্যবহার কীসের। তেল চপচপে মাথার, পান চিবোনো ওই লাল দাঁতের নির্লজ্জ হাসি, দেখলেই গা-টা রিরি করে উঠত। সম্ভবত উনিও বুঝতে পেরেছিলেন। আসা-যাওয়াও অনেক কমিয়ে দিয়েছিলেন। মাঝেমধ্যে সন্দীপ জোর করে ধরে নিয়ে আসত। চা-জলখাবার খেয়ে চলে যেতেন। এতে অবশ্য আমি ভীষণ আশ্বস্ত হয়েছিলাম।

সেদিন স্নান সেরে জামাকাপড় ধুচ্ছি। কলিংবেলটা ক্রমাগত বেজেই যাচ্ছে। সমানে চিৎকার করছি আসছি আসছি তৎসত্ত্বেও আগন্তুকের কানে ঢুকছে না।

দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখি, রামলালবাবু। দরদর করে ঘামছেন। দরজা বন্ধ করতে করতে বললাম, ‘সন্দীপ বাড়িতে নেই৷’ উনি ইশারা করে কিছু বলতে চাইছিলেন দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম।

‘কাকলি বাচ্চারা কোথায়?’

‘স্কুল ছাড়া কোথায় থাকবে এসময়ে?’

কোনও জবাব না দিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, ‘তুমি এক্ষুনি আমার সাথে চলো। সন্দীপের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।’

শোনা মাত্র মাথাটা ঘুরে গেল। চারিদিকে কেবল অন্ধকার মনে হল। উনি কোনওমতে আমাকে ঘরে এনে বসালেন। এক গ্লাস জল দিয়ে বললেন, ‘ভয় পেয়ো না, মারাত্মক কিছু হয়নি।’ জানি না কেন ওনার কথা ঠিক বিশ্বাস হল না। অতি বড়ো দুঃসংবাদ

দেওয়ার সময়ও,সান্ত্বনা দিতে লোকে এসব বলে। মনটা বড়ো কু-গাইতে থাকল।

কোনওমতে নিজেকে সামলে নিয়ে ছুটলাম হাসপাতালে। রামলালবাবুই তালা লাগালেন। আমার যেন সমস্ত শক্তি ফুরিয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রের মতো কী যে করছি আমি নিজেই জানি না।

‘একটা বাচ্চা ছুটতে ছুটতে হঠাৎই সন্দীপের স্কুটারের কাছে চলে এসেছিল। বাচ্চাটাকে বাঁচাতে গিয়েই যত বিপত্তি। ব্যালেন্স রাখতে না পেরে ও-ই স্কুটার থেকে পড়ে গেল। সেইসময়ই পাশ দিয়ে একটা ট্যাক্সি এসে ধাক্বা মারে। উঠে দাঁড়াতে পারছিল না।’ শুনে আমার গাল বেয়ে ঝরঝর করে জল নেমে আসছিল। মনের মধ্যে তোলপাড় হচ্ছিল।

‘ওই অবস্থাতেই ১০-১৫ মিনিট পড়েছিল সন্দীপ। লোক জড়ো হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু কেউ এগিয়ে এসে সাহায্য করেনি।। ভাগ্য ভালো, সেই সময় আমি ওই পথ দিয়েই যাচ্ছিলাম। নয়তো…’

ওনার কথাও ঠিক করে কানে আসছিল না। শুধু উপরওয়ালার উদ্দেশ্যে একটা প্রার্থনাই করে চলেছি, ‘ভগবান সন্দীপ যেন ঠিক থাকে, সুস্থ থাকে।’

রামলালবাবু আবারও বলে উঠলেন, ‘কাকলী, সন্দীপের সামনে কিন্তু তোমাকে শক্ত থাকতে হবে। ভেঙে পড়লে চলবে না।’ বোঝালেন ঠিকই, কিন্তু হাসপাতালের বেডে ওকে শুয়ে থাকতে দেখেই চোখ ফেটে জল চলে এল।

এমন সময় সন্দীপের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক নার্স জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনিই কী ওনার স্ত্রী? ডাক্তারবাবু পেশেন্টের বাড়ির লোকদের খুঁজছিলেন।’

চোখের জল মুছতে মুছতে সম্মতি প্রকাশ করলাম, ‘হ্যাঁ।’

‘দেখুন ভয়ের কিছু নেই। তবে ওনার বাঁ-পায়ের কন্ডিশন তেমন ভালো নয়। এখুনি অপারেশন করতে হবে।’

ডাক্তারের অভয়বাণী শুনে নিশ্চিন্ত হতে পারলাম না। মনের মধ্যে ওঠা হাজারও আশঙ্কা থেকে নিষ্কৃতি পেলাম না। রামলালবাবুর হাতে প্রেসক্রিপশন দিয়ে ওষুধগুলো আনার জন্য বলে গেল নার্স।

খানিক পরেই ওর জ্ঞান ফিরে এল।

‘কাকলি।’

‘এই তো আমি। তোমার পাশেই আছি।’ সন্দীপের কাঁধে  হাত রেখে বললাম।

তারপরেই ছটফট করতে লাগল, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে।’

‘সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ভয় পেয়ো না।’ বলেই ছুটে গেলাম নার্সের কাছে। উনি এসে যন্ত্রণার ইঞ্জেকশন দিয়ে গেলেন। তার খানিক পরেই সন্দীপ ঘুমিয়ে পড়ল।

‘কাকলি, এই নাও ওষুধগুলো রাখো। আর হ্যাঁ এই ফলগুলোও। ডাক্তার বললে দিও। আমি দেখি অফিসে বলে ওর জন্য টাকাপয়সার কিছু ব্যবস্থা করতে পারি কিনা।’ বলেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন।

বাচ্চাদের কথা একদমই খেয়াল ছিল না। রামলালবাবু যাওয়ার বেশ খানিকক্ষণ পর মনে পড়ল। তাড়াহুড়োতে ওদের কথা মনেই হয়নি। এতক্ষণে তো দুজনেই স্কুল থেকে চলে এসেছে। ঘরে তালা দেখে কোথায় যাবে, কী করবে? ভাবতে পারছিলাম না। মনে পড়ে গেল মধুলিকার কথা। তাইতো ওকেও তো ফোন করে বাচ্চাদের রাখতে বলতে পারি। দেরি না করে নাম্বার ডায়াল করলাম। ফোনে সমস্ত কিছু জানালাম ওকে।

‘ওহ্ তাই। খুবই দুঃখের খবর। বেশি চোট আঘাত পায়নি তো?’

‘বাঁ-পা গুরুতর জখম হয়েছে অপারেশন করতে হবে।’

‘আহা-রে, আমাদের কোনও সাহায্য লাগবে না তো?’

ও ‘না’ এর উপর এমন জোর দিয়ে বলল যে, কান্না পেয়ে গেল।

‘যদি বাচ্চারা এলে একটু দেখতে,’ বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে ওকে বলব, বাচ্চাদের একটা রাত ওর বাড়িতে রাখতে।

‘তুমি চিন্তা কোরো না, ওরা ফিরলেই আমি জানিয়ে দেব যে তোমরা মেডিকিওর হাসপাতালে আছো,’ বলেই ফোনটা রেখে দিল। আর কোনও কিছু বলার সুযোগই দিল না।

পাগলের মতো কেবিনের মধ্যেই ছটফট করতে শুরু করলাম। এ অবস্থায় সন্দীপকে একা ছেড়ে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? এরা তো যখন-তখন ওষুধের জন্য প্রেসক্রিপশন ধরাচ্ছে। এরপর ওটি। কিন্তু বাচ্চারা! আবার পরমুহূর্তেই মনে হল, না ওরা যথেষ্ট বুদ্ধিমান, নিজেদের ঠিক সামলে নিতে পারবে। ঘরে তালা দেখে নিশ্চয়ই একবার পাশের কাউকে জিজ্ঞাসা করবে। পরক্ষণেই মনে হল, আচ্ছা আচ্ছা লোক এ-রকম খবর শুনলে ঘাবড়ে যায়, সেখানে ওরা তো শিশু। ইশ্ এই বিপদের সময় যদি ভাইটা কাছে থাকত। অন্তত পাশে দাঁড়ানোর মতো…। কারওর একটা গলার অস্ফুট স্বরে ভাবনায় ভাটা পড়ল। পিছন ফিরে দেখি রামলালবাবু।

‘সাহেব আর তনুকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসেছি। খাবারও বেড়ে দিয়ে এসেছি। সাহেববাবা আসার জন্য বায়না ধরেছিল। কোনওমতে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তবে আসতে পারলাম।’

মনে পড়ে যাচ্ছিল, কথায় কথায় রামলালবাবুকে নিয়ে সাহেবের ব্যঙ্গ, ওনার চলনবলন সবকিছু নকল করে দেখানো, ওঁকে এড়িয়ে চলা। লজ্জায় মনে মনে কুঁকড়ে গেলাম।

কৃতজ্ঞতাভরা স্বরে বললাম, ‘দাদা, আপনি যে আমার কী উপকার করলেন, আপনি জানেন না। বাচ্চাদের কথা ভেবে খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছিল।’ বলেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।

‘ছি ছি, এভাবে বোলো না। এ তো আমার কর্তব্য।’ বলেই আমার হাতে একটা মোটা খাম ধরিয়ে দিলেন। বললেন, ‘টাকাটা রাখো। আপাতত যা পারলাম জোগাড় করেছি। অপারেশনটা তো হোক। পরে না হয় অফিসে একটা বন্দোবস্ত…।’

চোখ দুটো ভিজে গেল আমার। টাকাটা হাতে নিয়ে ছুটলাম হাসপাতালের অ্যাকাউন্টস্ ডেস্ক-এ।

অপারেশন শেষে সন্দীপকে বেডে দেওয়ার পর রামলালবাবু আমায় বললেন, ‘এবার বাড়ি যাও। বাচ্চারা অনেকক্ষণ একা আছে। আমি এখান থেকে এক পাও নড়ব না, চিন্তা কোরো না। যাও।’

বাড়ি ফিরে দেখলাম তনু কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে, আর সাহেব গালে হাত দিয়ে বিছানার এককোণে বসে রয়েছে। চোখদুটো লাল। আমাকে দেখামাত্রই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল। কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল, ‘বাবা কেমন আছে মা? বাবা ঠিক হয়ে যাবে তো?’

বললাম, ‘বোকা ছেলে, বাবা কেন ঠিক হবে না?’

‘দেখিসনি সাহাকাকুর যখন পা ভেঙে গিয়েছিল, ডাক্তার কেমন প্লাস্টার করে দিয়েছিল। সাহাকাকু এখন ঠিক হয়ে গেছে না, ঠিক আগের মতোই? বাবাও খুব শিগগিরিই ঠিক হয়ে যাবে।’

‘তবে যে মধুমাসি বলে গেল বাবার বড়ো অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। খুব বিপদ!’ সহজভাবে বলে গেল সাহেব।

‘না না। মধুমাসি তাহলে ভুল শুনেছে।’

মধুলিকার আচরণ এটাই শেখাল যে বন্ধুবেশী এরকম প্রতিবেশীর থেকে দূরে থাকাই ভালো। যারা কোনও কাজেই আসে না।

পরের দিন গোটা পাড়ায় সাহেবের বাবার অ্যাক্সিডেন্টের খবরটা ছড়িয়ে পড়ল। হাসপাতালে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছি ঠিক তখনই এক এক করে পাড়ার পাঁচ-সাত জন বউ হাজির। এক একজনের, এক এক রকমের কথা। ‘বাচ্চাকে কী করে ছেড়ে দেয় মানুষ? আমাদের দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থাও তো খুব খারাপ।  সবই অদৃষ্ট।’ জোরকদমে আলোচনা আর সহানুভূতির ঝড় বইতেই থাকল। কেউ আর যাবার নাম করে না। রামলালবাবুই এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচালেন আমাকে। ঘরে ঢুকেই বললেন, ‘কাকলি রেডি তো? চলো, দেরি হয়ে যাবে যে।’

আমিও তৎপর হয়ে উঠে পড়লাম, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন, চলুন।’

আমার সঙ্গে সঙ্গে তারাও উঠে পড়ল। যেতে যেতে শান্তাদি বলে গেলেন, ‘দ্যাখো রামলালবাবু তো যথাসাধ্য করছেনই। তবুও যদি প্রয়োজন পড়ে বোলো।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ বলব।’ আরও দু-তিনটে গলা শুনলাম। রামলালবাবুর স্কুটারে চেপে আমি আর তনু হাসপাতালে পৌঁছোলাম। বিকেলে সন্দীপের বন্ধুবান্ধব, অফিস কলিগরা এল দেখতে। সবাইয়ের একই কথা,কিছু দরকার লাগলে বোলো। ভেবে অবাক হয়ে যাই, দরকার হলে কেন, কেউ কি এগিয়ে এসে বলতে পারে না, নিঃসংকোচে বলো কী দরকার! একমাত্র রামলালবাবু ছাড়া। ওনাকে তো কোনও কথা বলতেই হয়নি। তার আগেই উনি বুঝেশুনে সব কাজ করে নেন। যেন সত্যিই বন্ধু নয়, সন্দীপ ওনার মায়ের পেটের ভাই। একটা দিনও রাত্তিরে উনি আমাকে হাসপাতালে থাকতে দেননি, সবসময় ছেলেমেয়ের দোহাই দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

অন্যান্য দিনের মতোই সেদিনও রামলালবাবু ফল, ওষুধপত্র নিয়ে আসার পরে কিছু টাকা দিতে গিয়েছিলাম। তাইতেই উনি ভীষণ রেগে গেলেন। ‘আমি তো তোমাদের কোনও দিন পর ভাবিনি কাকলি। তাহলে এসব কথা উঠছে কেন?’

ওনার কথা শুনে অতীতের ঘটা একটা ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমি-ই তাচ্ছিল্য করে বলতাম, ‘সাহেববাবা, সাহেববাবা করে একেবারে গলে পড়ছে। রোজ রোজ আমাদের বাড়িতে ভালোমন্দ গিলে যাচ্ছে, অথচ বাচ্চাগুলোর জন্য একটা চকোলেট নিয়ে আসতেও ইচ্ছে হয় না, নীচ মানসিকতা।

আজ উনি আমাদের জন্য যা করছেন, অতি নিকটাত্মীয় হলেও বোধহয় এমনটা সম্ভবপর হতো না। নিজের ভাইকেও তো দেখলাম, অফিসের দোহাই দিয়ে কাটিয়ে দিল। আর অন্যান্য আত্মীয়দের তো কথাই আলাদা। কেউ নিয়মরক্ষা করতে মুখটা দেখিয়ে গেল মাত্র। আবার কেউ কেউ তো ফোনেই দায়িত্ব সেরে দিয়েছে।

রামলালবাবু যাওয়ার পর সন্দীপ বেশ ভাবুক হয়ে ওঠে। ‘সত্যি রামলালদা যদি না থাকত, কী হতো কে জানে। ও না থাকলে হয়তো হাসপাতাল পর্যন্তই পৌঁছোনো হতো না আমার।’ একটা চাপা শ্বাস নিয়ে চুপ করে যায় সন্দীপ।

ওনার সম্পর্কে বলার মতো ভাষা সত্যিই আমার জানা নেই। ওনাকে কী ভেবেছিলাম, আর উনি আসলে কী…। সত্যিই অসময়ে না পড়লে মানুষ চেনা বড়ো দায়। আজ অকপটে স্বীকার করতে বাধা নেই, উনিই আমাদের পরম বন্ধু।

অথচ ওই মানুষটাকে নিয়েই কতবার দ্বন্দ্ব বেধেছে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। বারবার প্রশ্ন তুলেছি ওদের বন্ধুত্ব নিয়ে। আর জবাবে বারংবার একই উত্তর পেয়েছি, ‘মানুষ চিনতে আমার ভুল হয় না কাকলি। ও এত সহজসরল বলেই তোমরা ওকে উপেক্ষা করো। আজ পর্যন্ত কোনও কিছুর জন্য ঈর্ষা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা প্রতিহিংসার মনোভাব দেখিনি ওর মধ্যে।’

সন্দীপের কথাটা যে কতটা সত্যি, আজ আমি বুঝতে পারি। নয়তো আমার এত খারাপ ব্যবহার করা সত্ত্বেও…।

সন্দীপ আগের তুলনায় অনেকটা ভালো হতে ছুটি দিলেন ডাক্তার। পায়ে প্লাস্টার নিয়ে আরও মাস তিনেক কাটাতে হবে তাকে। রামলালবাবু ট্যাক্সি ডেকে বাড়ি পৌঁছে দিলেন আমাদের। তারপর নিজে অফিস চলে গেলেন। অফিস ফেরত সোজা এলেন আমাদের বাড়িতে।

‘এখন কেমন?’ ঢুকেই ঠিক আগের ভঙ্গিতেই প্রশ্ন করলেন আমাকে।

‘ঠিক আছে। আসুন।’

তনুও খেলতে যাচ্ছিল। রামলালবাবুকে দেখে আজ আর বেরোল না। সাহেব বই নিয়ে বসেছিল। ওনাকে দেখে উঠে এল। সবাইকে কাছে পেয়ে রামলালবাবু আবার পুরোনো ফর্মে। সেই ওনার ছোটোবেলার ঘটনা, খেতখামার, জমি, বাড়ি, গ্রামের হাজারও কথা। তবে আজ শ্রোতাবর্গ অনেক বড়ো। প্রতিবেশীদের দু-একজনও এসেছে সন্দীপ-কে দেখতে। সবাই মন দিয়ে ওনার কথা শুনছিলাম। আর ভাবছিলাম, সত্যিই তো জীবনে কতই না কষ্ট পেয়েছেন উনি। বাবার মৃত্যুর পর কাকারা জোর করে জমি-জিরেত কেড়ে নিয়ে পথে বসিয়েছিল ওনাকে। সেই জায়গা থেকে আজকের হরদয়াল ইন্ডাস্ট্রির ইঞ্জিনিয়ারের সফর কতটা সংঘর্ষের সেটা ভেবেই ওনার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যাচ্ছিল আমার।

‘জেঠু তুমি বলেই পেরেছ। সমস্ত বাধা অতিক্রম করে পড়াশোনা শিখেছ, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছ। আমি তো এখনও মায়ের বকা না খেলে বই হাতে করি না।’ ছেলের মুখে একথা শুনে আমি বেশ অবাক।

‘সময় সব কিছু শিখিয়ে দেয় সাহেববাবা।’

সন্দীপ আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। হয়তো আমার মনের অবস্থা আঁচ করতে পারছিল। পরিস্থিতিটাও বেশ গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। কিছুক্ষণের জন্য সব নিস্তব্ধ। কারও মুখে যেন বাক্যি সরছে না। সবাইকে চুপ থাকতে দেখে রামলালবাবু ভাবলেন, ওনার কথায় আমরা বুঝি বোর ফিল করছি। তাই তিনি ওঠার উপক্রম করলেন। ঠিক সেই সময়েই মুখ দিয়ে অকপটে বেরিয়ে গেল, ‘বসুন না দাদা। এক্ষুনি বাড়ি ফিরে কী করবেন? আমি আপনার জন্য তাড়াতাড়ি কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে আনছি।’

সখী

যে-গন্ধটা আসছে, সেটা খুব খারাপ গন্ধ। ঠাকুরের আসনের জুঁই-চন্দনের গন্ধ ছাপিয়েও এই গন্ধটা আসে। এই গন্ধে এখনও লোভ হয়। ইলিশ মাছের গন্ধ। মরণ! ইলিশ মাছ হচ্ছে আজ।

ছত্রিশ বছর ধরে ইলিশ খাচ্ছেন না তারাসুন্দরী। উনি গত হয়েছেন ছত্রিশ বছর হ’ল। কোনও মাছই তো খাচ্ছিলেন না, নিউমোনিয়া হবার পর খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন, ডাক্তার বলল চিকেন সুপ খেতে হবে। তারাসুন্দরী বলেছিলেন, ছি-ছি-ছি, মুরগির ঝোল? বিধবার মুখেও আনতে নেইকো। ডাক্তার বলেছিল, তবে শিঙিমাছের ঝোল খান। সেটাও খেতে চাননি, বলেছিলেন, এসব খেতে পারব না, আঁশটে গন্ধ লাগবে, এতদিন ওসব খাইনি, বমি হয়ে যাবে। ডাক্তার বলেছিল, বমি হবে না। হলে আমি আছি।

কই, আঁশটে গন্ধ লাগেনি তো, ভালোই লেগেছিল বেশ। মাছগুলো ঝোলের ভিতরে চটকে মিশিয়ে দিয়েছিল, বেশ বুঝতে পারছিলেন তারাসুন্দরী। কিন্তু ভালো লাগাটা কাউকে বুঝতে দেননি। দিতে নেই। চামচে করে সুপ খাইয়ে দিচ্ছিল ছেলে বউ, আর প্রতিবার মুখ বিকৃত করেছেন।

তারপরও, জ্বরজারি হলে একটু শিঙিমাছের সুপ খেয়েছেন। নাতনিটা বলেছে নিয়মভঙ্গ যখন হয়েই গেছে ঠাম্মা, রোজই একটু মাছ খাও। শরীর ঠিক থাকবে। একশো বছর টেনে দেবে।

একশো বছর টেনে দেবে কথাটা যে একটা খোঁচা মারা কথা এটা কি বোঝেন না তারাসুন্দরী? বেশ বোঝেন। বাড়ি সারাইয়ের সময় রাজমিস্ত্রিকে বড়ো বউমা বলেছে, ওটা শুনেছেন তারাসুন্দরী, শুনে ফেলেছেন– বাড়ি ভেঙে যাবে, খসে পড়ে যাবে, উনি থাকবেন। উনি মানে কে, সে কি বুঝতে অসুবিধা হয়? মাছ আর খান না। জ্বরজারি হলেও না।

ইলিশ হচ্ছে। গন্ধটা ম’ ম’ করছে। উনি খুব ইলিশ আনতেন। দু’ হাতে দুটো ঝুলিয়ে আনতেন বর্ষার দিনে। তখন তো মাছ কাটিয়ে আনত না আজকালকার মতো, নিজে মাছ কাটতেন। কালোজিরে কাঁচালংকার পাতলা ঝোল– কাঁচা কুমড়ো দিয়ে, সরষেবাটা আর সরষের তেল মাখিয়ে, কাঁচালংকা চিরে দিয়ে টিফিনবাটিতে ভাতের হাঁড়িতে রেখে দিয়ে ভাপা, নারকেলবাটা দিয়ে লাউপাতায় মুড়ে… কত কী…। ওনার শ্রাদ্ধে ছেলেরা ইলিশ খাইয়েছিল– উনি ভালোবাসতেন বলে। তারাসুন্দরী মরে গেলে ওর মৎস্যমুখীতেও হয়তো ইলিশ করবে ছেলেরা। আত্মা কি স্বাদ পায়?

কে জানে?

বলহরি শব্দ শুনলেন যেন তারাসুন্দরী। তখন বারান্দায় ছিলেন। কানের ছিপিটা চেপে ধরলেন। বলহরি। ইলিশ মাছের গন্ধের ভিতরে একটা মরণ চলে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। মালতী বলল, দত্ত-বাড়ির দিদিমা চলে গেলেন। তারাসুন্দরী বললেন– একটু জোরেই, বউমারা যেন শুনতে পায়– এমন দিন আমার কবে আসবে রে মালতী?

মালতী বলল, অমন কথা বোলো না দিদিমা। আমার খুব রাগ ধরে যায়…।

তারাসুন্দরী বললেন, নিরুপমাও চলে গেল। আমার চেয়ে কত ছোটো। ও ঠাকুর, আমাকেও তুলে নাও। জোরেই বললেন, ভগবান শুনতে পান বা না পান, বউমারা যেন শুনতে পায়।

()

এই বাড়িটাকে দারোগা-বাড়ি বলেই সবাই জানে। তারাসুন্দরীর স্বামী ছিলেন ব্রিটিশ আমলের দারোগা। পাড়ায় ছিল খুব প্রতিপত্তি। পাড়ার ক্লাবটার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তারাসুন্দরীর স্বামী শ্রীকান্ত মজুমদার। পাড়ার যে-বারোয়ারি দুর্গাপূজার হীরকজয়ন্তী না কী যেন হচ্ছে এবছর, ৬০ বছর, এই পুজোটাও শুরু করেছিলেন শ্রীকান্ত দারোগা। নবোদয় সঙেঘর ক্লাব ঘরে শ্রীকান্ত মজুমদারের ছবি আছে। বাড়িতে যে-ছবিটা আছে, তার চেয়েও যত্নে আছে। মালা পড়ে। নেতাজি, গান্ধিজিদের সঙ্গে এক লাইনেই নাকি ছবিটা আছে। এক ডাকাতের কাছ থেকে বেলেঘাটা খালপাড়ের কাছে ছ’কাঠা জমি সস্তায় কিনে নিয়েছিলেন শ্রীকান্ত দারোগা। তিনতলা বাড়ি। প্রতি তলায় পাঁচ-ছ’টা করে ঘর। একতলায় দুটো ঘর রেখে বাকি ঘর ভাড়া দেওয়া আছে।

দোতলায় বড়ো ছেলে, তিনতলায় ছোটো ছেলে। মেয়েরা কেউ এলে তিনতলায় থাকে। ওদের আলাদা ঘর রাখা আছে। মূল রান্নাবান্না দোতলাতেই, যদিও ছেলেদের আলাদা আলাদা ছোটো কিচেন আছে। বন্ধুবান্ধব এলে বা শ্বশুরবাড়ির কেউ এলে ওখানে টুকটাক ‘স্পেশাল’ হয়। ছেলেরা আলাদা আলাদা ফ্ল্যাট কিনে ফেলেছে কিন্তু এ বাড়ি ছাড়েনি। ছাড়বে কেন? যতটা ছড়িয়ে থাকা যায়। দুটো নারকেলগাছও আছে, পেয়ারাগাছ, কাঁঠালগাছ। পাখিটাখি আসে। নীচের জমিতে শেড করে গাড়িও রেখেছে। প্রোমোটাররা প্রস্তাব দিয়েছে। এখন জমির দাম আগুন। দুই ছেলেই প্রোমোটারদের জমিটা প্রোমোটিং করার পক্ষে, এ নিয়ে কারওর মতবিরোধ নেই। মতভেদটা হ’ল মা কোথায় থাকবেন। সুতরাং মা যতদিন আছেন, ততদিন মুলতুবি। কিন্তু উনি যাচ্ছেন না তো। বয়েস তো হয়েছে। বয়সের কূলকিনারা নেই। কী করে থাকবে, তারাসুন্দরীর তো কোনও বার্থ সার্টিফিকেট নেই, অ্যাডমিট কার্ডও নেই। জন্ম সালটা কী করে জানা যাবে? তবে শ্রীকান্ত মজুমদারের পেনশনের বইতে তারাসুন্দরীর বয়েস লেখা আছে, হিসেব করলে দাঁড়ায় ৯৭ বছর চলছে। সুগার নেই, প্রেশার নেই, কিডনির গন্ডগোল নেই, চোখেও মোটামুটি দেখতে পান। কানে কম শুনছিলেন, হিয়ারিং এড দেওয়া হয়েছে। হাঁটতে চলতে একটু অসুবিধে, ধরে ধরে হাঁটাতে হয়, স্নান করার পর গা মুছিয়ে দিতে হয়, কাপড়টা পরিয়ে দিতে হয়। কিছুতেই ম্যাক্সি পরবেন না, বলেন শুধু সেমিজ পরে চলা যায়? লজ্জা করে না বুঝি? এইজন্য আয়া রাখা আছে। বেলা দশটা নাগাদ আসে, স্নান করিয়ে গা মুছিয়ে, চুল আঁচড়ে দেয়, দুপুরের খাবারটা দিয়ে যায়। নিজে হাতেই খেতে পারেন এখনও তারাসুন্দরী। এখন যে-আয়াটি আছে, গত সাত বছর ধরে, মালতী, দুপুরবেলা গা, হাত-পা টিপে দেয়, সন্ধেবেলা টিভি খুলে সিরিয়াল দেখায়, তারাসুন্দরী সিরিয়ালের ঘটনাগুলির খেই হারিয়ে ফেললে মালতী ধরিয়ে দেয়– ওই তো ও হ’ল রাশির ছোটো বোন, বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছিল, ওর বরটা খুব পাজি, আবার ফিরে এসেছে…। ওই চাপ দাড়িওলা ছোঁড়াটা কে, আর্য? জিজ্ঞাসা করলে বলে চিনতে পারছ না দিদিমা? ওই-যে গো, মেজোবউটা ওর বিয়ের গয়নাগুলো সব তুলে দিয়েছিল যাকে, ওর সোয়ামিকে কিচ্ছুটি বলেনি। ওই লোকটা দুপুর দুপুর আসত… ও হ’ল গে মেজোবউটার… ইয়ে…।

মেজোবউয়ের নাং? বুঝেছি।

নাং শব্দটা শুনে মালতী তারাসুন্দরীর গায়ে ছোট্ট করে একটা কনুই খোঁচা দেয়।

যা গল্পগাছা হয়, মালতীর সঙ্গেই তো হয়।

বুচুর বাবার না ইয়া বড়ো গোঁফ ছিল, আর নস্যি নিত। গোঁফে নস্যি লেগে থাকত। আমার নাকের কাছে ওর গোঁফ গেলে হাঁচি হতো আমার। রাতের বেলা হেঁচে ফেলতুম, কী লজ্জা, কী লজ্জা…। আজকাল ওসব ল্যাটা নেই। ব্যাটাছেলেরা কেউ মোটা গোঁফও রাখে না, নস্যিও নেয় না।

বুচুর বাবা না বডিজ কিনে আনল। বলল, এটা পরবে, মেমরা পরে, বডি ঠিক থাকবে। আমি তো পরতেই পারিনে, আমাদের কালে তো ওসব ছিল না। বড়োজোর সেমিজ। উনি বললেন, এই দ্যাখো পিছনে টেপা বোতাম আছে। উনি বললেন, পরিয়ে দেব নাকি? কী লজ্জা

কী লজ্জা।

মালতীর তো বাড় বেড়ে গিয়েছিল, বলে– দাদু কী করে জানল ওসব কী করে পরতে হয়?

তারাসুন্দরীও কনুই দিয়ে খোঁচা মারে মালতীর গায়ে। হাসে, গোলাপি আভার মাড়ি ঝলকে ওঠে। বলে, সে কথা তো ভাবিনি তখন, ভাবতাম দারোগারা সব জানে। তবে ব্যাটাছেলে বলে কতা। পুরুষজাতি ভোমরা জাতি। ফুলে ফুলে মধু খায়। কে জানে ওর দু’একটা নাং ছিল কিনা? হ্যাঁরে, তোর সোয়ামির ওসব নেই তো? মালতী বলে, আরে ধুস, আমার সোয়ামি তো ঠুঁটো জগন্নাথ। হাত কই যে ওসব করবে?

সে কী রে, হাত নেই? দু’হাতই নেই?

দুটো না, একটা হাত নেই। বোমা বাঁধতে গিয়ে বাস্ট করে একটা হাত কনুই থেকে খুলে গেল।

জেনেশুনে বিয়ে দিল তোকে ওর সঙ্গে?

না, সে তো বিয়ের পর। বিয়ের আগে কলের মিস্তিরি ছিল। এখন কী করবে ও? এক হাতে কী হয় বলো? ঠোঙাও বানানো যায় না। মস্তানি তো করত না যে, হাতকাটা ভজন বলে এখনও কাজকম্ম করবে, তোলা তুলবে।

মস্তানি করত না তো বোমা বাঁধতে গেল কেন?

টাকার লোভে গো দিদিমা। পেটো বাঁধার কাজটা জানত। কী করে শিখেছিল কে জানে? ইলিকশনের আগে ওকে ধরে নিয়ে গেল। ব্যস, হয়ে গেল। এখন কী করবে বলো, তরিতরকারি বেচতে গেলেও তো দুটো হাত লাগে। পাল্লা ধরতে হয়।

এখন কী করে?

কী আর করবে, গাঁজার পুরিয়া বেচত, পুলিশ ধরল। মাসে মাসে টাকা দিতে বলল, বলল পোষাবেনে। এখন রাতের বেলা বাজার পাহারা দেয়, রাতে ঘুরে ঘুরে পিরিপ পিরিপ বাঁশি বাজায়। ক’পয়সাই বা পায়। তুমি ভালো থাকো গো দিদিমা, যেন রাতে তোমার কাছে না থাকতে হয়। বাড়িতে মেয়েটা আছে, একা ফেলে রাখতে পারব না।

এসব কথাবার্তা অনেক আগেকার। তারাসুন্দরী মালতীর মনের কথা জানে। মালতীও তারাসুন্দরীর। যখন ওর স্বামী ভজন হাতকাটা ভজা হয়ে ফিরে এল, তারপর মালতী বুদ্ধি করে হাসপাতালে গিয়ে নাড়ি কাটিয়ে এসেছিল, যেন আর বাচ্চা না হয়।

মালতীর মেয়ের বয়স তখন সাত, ছেলেটা পাঁচ। ছেলেটাও নেই। পাগলা কুকুর কামড়েছিল রাস্তায়। ও এখন মেয়ে অন্ত। ফ্রিজ থেকে চকোলেট চুরি করে মালতীকে দিয়েছে কত দিন– তোর মেয়েকে দিস। বড়োবউমা বুঝেছিল হয়তো, নইলে হঠাৎ একদিন বড়োর ঘরের ছোটো নাতনিটা ইয়া বড়ো একটা ক্যাডবেরি নিয়ে এসে কেন বলবে নাও ঠাম্মা, তুমি চকোলেট খেতে ভালোবাসো, এটা খেয়ো, মেয়েটা মুচকি মুচকি হাসছিল– ঠিক দেখেছিলেন তারাসুন্দরী। চকোলেট নেব বেশ করব– মনে মনে বলেছিলেন তারা। চাইলে কি মেয়েটাকে দিবি তোরা? বলবি আদেখলেপনা। চকোলেট খেতে পারি না? নিজের টাকায় খাব। কতগুলো করে পেনশন পাই। স্বামীর চাকরির পেনশন। যখন বিছানায় ছিলেন উনি, বলেছিলেন তো, যা টাকা রেখে গেলুম, তোমার কোনও কষ্ট হবে না। তা ছাড়া পেনশনের টাকা যা পাবে, হেসেখেলে দিব্যি চলে যাবে। ওরম অলক্ষুণে কথা বোলো না– মুখ চাপা দিয়েছিলেন তারাসুন্দরী। ক্যানসার ছিল কিনা, উনি তো জানতেন। বলেছিলেন কোনও কষ্ট কোরো না, মাথার চুল ফেলো না, মাছ খেয়ো, কোনও দোষ নেই। জীবনমরণ তো ভগবানের হাতে। ওনাকে নিয়েছেন, আমাকে নিচ্ছেন না তো আমি কী করব?

কত টাকা পেনশন পান তারাসুন্দরী জানেন না।

ছেলেরা বলত সই করো, করে দিতেন। পনেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। তখন একটু একটু লেখাপড়া জানতেন। উনিই চিঠি লেখা শিখিয়েছিলেন, বই এনে দিতেন সতীর পতি, আজব কুটুম৷ রতিবিলাস ও দাম্পত্যলীলা বইটা এনে বলেছিলেন, চুপি চুপি পড়বে। যখন বদলি হয়ে মালদা গেলেন, কত চিঠি লিখেছেন তারাসুন্দরী। ইতি তোমার আদরিণী তারা, ইতি তোমার বিরহিণী তারা, ইতি তোমার প্রেম কাঙালিনি তারা। এখন আর সই করতে পারেন না। হাত কাঁপে। বেশ কিছুদিন হল টিপসই দেন। কতবার জিগ্যেস করেছেন, হ্যাঁরে, আমার পেনশন এখন কত রে? ওরা ঠিক মতো বলে না। কখনও বলে তোমার আয়ার খরচ মোটামুটি হয়ে যায়। কখনও বলে তা দিয়ে তোমার কী হবে? তোমার যা লাগবে বোলো, পেনশনের টাকা আর কত, ছেলেরা আছি কী করতে?

কিন্তু তারাসুন্দরী জানেন ওঁর পেনশন ভালোই। টিভিতেও পেনশন বাড়ার কথা শুনেছেন। একটা সিরিয়ালেও একজন বিধবার মুখে বলতে শুনেছেন– তোমাদের খাই না পরি? নিরামিষ খেতে কত লাগে? তোমাদের ওই মুখে মাখার লোশনের মধ্যে জেনো, আমার পেনশনের টাকাও আছে।

যখন ছোটো নাতনি চুকচুকি ক্যাডবেরিটা এনে তারাসুন্দরীর হাতে দিয়েছিল, নাও ঠাম্মা, চকোলেট ভালোবাসো, খেয়ো…। তারাসুন্দরীও শুনিয়ে দিয়েছিলেন– ফ্রিজ থেকে নিয়েছিলাম তো একটা, খেতে সাধ হয়েছিল। দিস, মাঝে মাঝে দিবি, কেমন? দু’এক বার দিয়েছে তারপর। একবার দু’জনে মিলে ভেঙে খেয়েছে। চকোলেট রস লালা দু’জনের মুখের ভিতরে। ওরা হেসেছিল হিহি, হিহি, শিশুদের মতো। সেদিন টিভিতে গান হচ্ছিল পরান, না ছাইড়া যাইও রে…। মালতী বলেছিল, তুই ছাইড়া গেলে পরান চকোলেট দিমু কারে…? হিহি, হিহি। মালতী ক’দিন আগে রাস্তার আলুকাবলি নিয়ে এল। একটা একটা করে কাঠি দিয়ে খাইয়ে দিচ্ছিল তারাসুন্দরীকে। তারা বলছিলেন এটা দিল চুকচুকি, এটা দিল ফুলটুসি, এটা দিল বাবুই…।

এরা ওঁর নাতি-নাতনিরা।

তারাসুন্দরীর প্রথম দুটো সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। তারপর বড়োছেলে। ছোটোবেলায় ওর কান ফুঁড়ে দিয়েছিল তারাসুন্দরীর শাশুড়ি, যেন নজর না লাগে। পাঁচ আনায় বেচেও দিয়েছিল কাকে যেন, তাই বড়োছেলের নাম পাঁচকড়ি।

সবাই পাঁচুবাবু বলে ডাকে। পঁচাত্তরের উপর বয়স। ওর সন্তান হয়েছিল বেশি বয়সে। তারপর দুই মেয়ের পর ছেলে। ছোটোছেলে প্রফেসর। এই সবে রিটায়ার করল। ওদের ঘরেই সব চুকচুকি-ফুলটুসি-বাবুই-পুঁচকুরা। ওদের সঙ্গে আর কথাবার্তা তেমন হয় না।

রাত করে খেতে আসে ওরা, অত রাত অবধি জেগে থাকেন না তারাসুন্দরী। আগে খাওয়ার টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেন।বলতেন, পাঁচুকে আর একটু ছ্যাঁচড়া দাও বউমা, চুকচুকি ফুলটুসিদের বলতেন, এত কম খেলে মাথা ঘুরে পড়ে যাবি যে…। এখনও পয়লা বোশেখে বাটির উপর জল ঢেলে বাঁহাতের কেড়ো আঙুলে জল কেটে কেটে ফাঁড়া কাটান তারাসুন্দরী– যা কেটে যা পাঁচুর ফাঁড়া, যা কেটে যা নাড়ুর ফাঁড়া, যা কেটে যা বড়োবউমার ফাঁড়া…।

গন্ধটা আসছে, ইলিশ মাছের। জোরে শ্বাস টানলেন তারাসুন্দরী। তারপর বললেন– মালতী… দরজাটা বন্ধ কর।

()

এক রোববার সকালে নবোদয় সংঘ থেকে কয়েকজন ছেলেছোকরা দারোগা-বাড়িতে এল। বলল, এবছরের পুজোটা একটু ধুমধাম করে হবে। হীরক জয়ন্তী হচ্ছে।

সাংসারিক কথাবার্তা বড়োছেলে খুব একটা বলে না। ছোটোছেলে নাড়ুই বলে। ভালো নাম মানবেন্দ্র। বলল সে না হয় চাঁদাটা একটু বাড়িয়ে দেব এবার…।

ক্লাবের ছেলেরা বলল, না, চাঁদা নয়, সে জন্য আসিনি। আমরা এবার আপনাদের মা-কে সংবর্ধনা দেব। এ পাড়ায় তো উনিই সর্বজ্যেষ্ঠ। আপনাদের বাবা এই ক্লাব এবং দুর্গাপূজা পত্তন করেছিলেন। উনি নেই, ওঁর সহধর্মিণীকেই আমরা সংবর্ধনা দেব। উদ্বোধনটাও ওনাকে দিয়ে করাব ভাবছিলাম, কিন্তু অনেকে বলল, হীরক জয়ন্তী বলে কথা, সিনেমা আর্টিস্ট আনতে। কুহু-কেকা-কে রাজি করিয়েছি, সোর্স বেরুল, পঞ্চাশ হাজারে হয়ে যাবে।

কুহু-কেকা কারা?

কুহু-কেকা জানেন না? দুই বোন। নাচও করে। ধ্যাত্তেরিকা, খুকুমণি, মুচুমুচু এসব সিনেমায় অভিনয় করেছে। সিরিয়ালও করে। কুহু-কেকার সঙ্গে দিদিমার ছবি তুলে ক্লাব ঘরে রেখে দেব।

কিন্তু মা যাবেন কী করে? ওঁর তো শরীর ভালো নেই…। ছোটোছেলে বলে।

ভালোই তো আছে। বারান্দায় তো দেখি ওনাকে। বসে থাকেন।

সে নয় বসেন, কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারবেন না, তোমাদের স্টেজেও ওঠা সম্ভব নয়…।

ওসব আমাদের উপর ছেড়ে দিন। একদম স্ট্রেচারে শুইয়ে সিধে স্টেজে নিয়ে বসিয়ে দেব। আপনারা শুধু ভালো দেখে একটা গরদের শাড়ি পরিয়ে রাখবেন, ব্যস। আর যদি দুটো একটা কথা বলতে পারেন তবে তো আরও ভালো।

আরে ধুর, একশো বছর বয়েস হ’তে চলল এখন। বক্তৃতা-টক্তৃতা দিতে পারে নাকি?

দিদিমা খালি বলবেন তোমাদের সব্বাইকে আশীর্বাদ করি… ব্যস। তা হলেই হবে। আরে এই পাড়ায় পুরোনো লোক বলতে এখন কজনই বা আছে? সব তো উটকো লোকে ভরে গেল। দারোগা-বাড়ি, রায় ভিলা, নস্করদের বাড়ি… ব্যস। রায় ভিলা তো এবার প্রোমোটিং হবে শুনছি। হ্যাঁ, বলে রাখি, আপনাদের বাড়িটা যদি প্রোমোটিং করেন, আগে আমাকে বলবেন কিন্তু,… ক্লাবের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি বলল।

না, এসব ভাবছি না… অন্তত মা যতদিন আছেন…।

আরে, দিদিমা আর ক’দিন। আগেভাগেই ঠিক করতে হয়। কাগজপত্রগুলো দিয়ে রাখতে পারেন। কিছুটা অ্যাডভান্সও দিয়ে রাখতে পারি…।

অন্য একজন, সম্ভবত সেক্রেটারি বলল, অ্যাই দিলীপ, তোকে নিয়ে পারা যায় না। কী জন্য এসেছিস? বাড়িটার বায়না নিতে নাকি দিদিমার জন্য?

দিলীপ নামের ছেলেটি বলল, ওই আর কী। দিদিমার কথা হতে হতেই তো দিদিমার বাড়িটার কথা এল। থাকগে দিদিমার সংবর্ধনা, ফাইনাল তো?

ছোটোছেলে বলে, মা কে সংবর্ধনা দিচ্ছ বলে গাদাখানেক চাঁদা চেয়ে বোসো না আবার।

জিভ কাটে ছেলেটা। বলে, কী যে বলেন। মাছের তেলে মাছ ভাজব ভাবছেন কেন? মিটিং-এ পাস হয়েছে এটা। আপনারা যদি বলেন, কথার কথা বলছি, এক পয়সাও চাঁদা দেব না, তা হলেও দিদিমাকে সংবর্ধনা দেব। দিদিমার মাথায় মুকুট পরাব, গায়ে চাদর পরাব। আর নস্কর বাড়ির ভুজঙ্গ নস্কর দিদিমা সম্পর্কে বলবেন। উনি দারোগাদাদুর বাড়ি আসতেন, বলছিলেন আমাদের। দিদিমা তালের বড়া ভাজতেন, পাড়ার সবাই সেই তালের বড়া খেতে আসতেন, অষ্টমীর খিচুড়িও নাকি নিজে হাতে রান্না করতেন– ওইসব বলবেন, আর আপনাদের ফ্যামিলির কেউ ওঁর সম্পর্কে দু’চার কথা বলবেন। আমাদের উদ্বোধন কিন্তু পঞ্চমীর দিন হবে। আর হ্যাঁ, একটা কথা, জরুরি কথা। আপনাদের ফ্যামিলির কেউ যদি দিদিমা সম্পর্কে বলেন, তখন কায়দা করে একটা লাইন ঢুকিয়ে দেবেন– যে উনি রামগোপাল জাদু মলম ব্যবহার করতেন। যে-কোনও ফোঁড়া, পোড়া, কাটাছেঁড়ায় অব্যর্থ। ওরাই আমাদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটা স্পনসর করছে কিনা…।

(৪)

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। সকাল থেকে জেল্লা দেওয়া জরি-রোদ্দুর। সকাল থেকেই ঢাক বাজছে। মালতী সাবান মাখিয়ে স্নান করিয়ে দিয়েছে তারাসুন্দরীকে। বিকেলে ফাংশন।

ছোটোছেলে এল ঘরে। বলল মা, একটা বক্তৃতা দিতে হবে তো, কী বলবে ঠিক করেছ?

কী বলব বলে দে না বাবা…।

বোলো দুনিয়ায় কত কী দেখলে। এত কিছু দেখতে পেলে, টিভি, মোবাইল, মেয়েরা সব বিদ্বান হচ্ছে, এসব কথা বোলো, আর এ বাড়িতে ছেলেদের কাছে ভালোই আছো, এটাও বোলো… ভালো আছো তো, না কী?

হ্যাঁ বাবা, খুব ভালো আছি।

সেটা বোলো। আর বোলো সবার ভালো হোক, সবাই ভালো থাকো, এই আর কী।

ছোটোছেলে মানবেন্দ্রবাবু তো প্রফেসর, ইকোনমিক্স পড়ান। প্রবন্ধ লেখেন। খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারেন।

বাড়িতে আজ অতিথি। বিয়ে হয়ে যাওয়া নাতনি এসেছে ওর বর নিয়ে, মেয়ের ঘরের নাতিটাও নাতবউ নিয়ে এসেছে সংবর্ধনা দেখবে বলে। দুপুরে ইলিশ মাছের গন্ধ, আবার।সারা ঘরে। উঃ অসহ্য। দোর দিয়ে দে মালতী।

বন্ধ দোর ঠেলে নাতি আসে, নাতনি আসে, বলে, কার মতো সাজবে? ঐশ্বরিয়া রাই, নাকি বিদ্যা বালন? অন্য কেউ বলে– না, না, দিদিমাদের যুগে ছিল নার্গিস, মধুবালা…।

তারাসুন্দরীর বেশ ভালো লাগছে। এতদিন বাঁচা হল বলেই তো এসব দেখা হচ্ছে। স্টেজে উঠে এই বয়সে মাইকে বলা… বাপরে…। বুক একটু ধুকপুক করছে নাকি? না-না, ও কিছু না।

মালতী সুন্দর করে গরদের শাড়ি পরিয়ে দিল, মুখে ক্রিম ঘষে দিল। নাতনিগুলো দেখতে এল। একজন ফেস পাউডারের পাফ ঘষে দিল। একজন ভ্রূ আঁকার পেনসিল দিয়ে ভ্রূ এঁকে দিল, কেউ একজন লিপস্টিক বাগিয়ে ধরতেই তারাসুন্দরী সদ্য আঁকা ভ্রূ কুঁচকে

বললেন, আমাকে সং সাজাবি নাকি, সং? কী পেয়েছিস? আমি দারোগার বউ।

ওমনি কোরাস হিহি। একটুখানি দেবই দেব।

হালকা করে, হালকা করে।

স্ট্রেচার নয়, চেয়ারে বসিয়েই নামানো গেল। প্যান্ডেল পর্যন্ত গাড়িতে, তারপর চেয়ারে বসিয়ে মঞ্চে। তারাসুন্দরী কানের ছিপিটা ভালো করে চেপে ধরলেন।

হাততালি হ’ল। কুহু-কেকাও এল, আরও অনেক বেশি জোরে হাততালি, অনেকক্ষণ ধরে। কুহু-কেকা নীচু হয়ে তারাসুন্দরীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল, এবার আরও অনেক বেশিক্ষণ ধরে হাততালি হল।

ক্লাব সম্পাদক তাঁর ভাষণে কুহু-কেকার উপস্থিতির জন্য গৌরব প্রকাশ করলেন।

এই ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকান্ত মজুমদার, ভীম নস্কর, লালবিহারী রায় এদের স্মরণ করা হল এবং এ পল্লীর সবচেয়ে প্রবীণা মহিলা, যিনি এই অঞ্চলটির অভিভাবিকা, ছাতার মতো, বটগাছের মতো, তাঁকে সংবর্ধনা দিতে পেরে ধন্য। এবং সত্যিসত্যি মাথায় একটা মুকুট পরিয়ে দেওয়া হল। দেখে মনে হচ্ছে রুপোর। বিশ্বসুন্দরীদের এরকম পরানো হয়। পরিয়ে দিল কুহু, চাদর পরাল কেকা। ভুজঙ্গ নস্কর আসতে পারেননি, অসুস্থ, তাই তারাসুন্দরী সম্পর্কে বলতে বলা হল মানবেন্দ্র মজুমদারকে।

মানবেন্দ্রবাবু তাঁর ভাষণে, ভারতে ষাটোর্দ্ধ জনসংখ্যা কত? শতকরা হার, প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব, চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি এবং শেষকালে মা মানেই ভরসা, মায়েরা থাকা মানে শ্বাশ্বত মূল্যবোধগুলি বেঁচে থাকা এই বলে বক্তৃতা শেষ করলেন। জাদু মলম বলতে ভুলে গেলেন।

এবারে তারাসুন্দরীর মুখের সামনে মাইক ধরা হ’ল। উনি প্রথমেই হাসলেন, হাসির শব্দ শুনল সবাই। বললেন খুব আনন্দ হচ্ছে বাবা। ক্লাবের সেক্রেটরি বলল– নিজের কথা কিছু বলুন। কী খেতে ভালোবাসেন, কী করে সময় কাটান, কাটা ফোঁড়া ব্যথা হলে রাম গোপালের জাদু মলম ব্যবহার করেন ওই সব বলুন।

তারাসুন্দরী বললেন, আমি কী বলব বাবা, এসব মালতী বলবে।

মালতী… এই মালতী, একবার আয় না মা…।

মালতী সেজেগুজেই এসেছিল, যতটা সম্ভব। কী আতান্তরে পড়ল ও।

এবার কুহু নিজে মাইক নিয়ে ডাকল– মালতী নামে কে আছেন, স্টেজে চলে আসুন।

মালতী গেল। স্টেজের উপর। মাথা চুলকোচ্ছে। সামনে মাইক। কুহু বলল, বলো মালতীদি, বলো।

মালতী জানে প্রথমে কী বলতে হয়। বলল, আপনাদের সবাইকে নমস্কার। আমি দিদিমার দেখাশুনো করি। আমার স্বামীর হাত নেই। নেতাদের ভোটে জেতাতে গিয়ে হাত চলে গেছে। এই দিদিমা সেই হাত দিয়েছে। হাত মানে তো দুটো ভাত। মানুষ বাঁচালেই মানুষ বাঁচে। একা একা বাঁচা যায় নাকো। দিদিমা বেঁচে আছে বলেই আমি স্বামী, মেয়ে নিয়ে বেঁচে আছি। মেয়েটা এলেবেন কেলাশে পড়ছে। দিদিমা বেঁচে থাকলে বিএ পাশ করাব। দিদিমা কী খায় কী বলব। নিরমিষ্যি খায়…। আর কিছু মাথায় আসছে না। খুব আস্তে করে বলেই ফেলল, আর নিজের কামনা, বাসনা…। সবাই শুনতে পেল না। শব্দটা জড়ানো ছিল।

()

বাড়ির সবাই ফাংশন দেখবে। কুহু-কেকা একটু নাচবে। তারপর আরও আছে। ব্যান্ডের গান।

ওরা সবাই ফাংশন দেখবে। তারাসুন্দরীকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হ’ল। মালতীও গেল সঙ্গে। বাড়িতে শুধু মালতী আর তারাসুন্দরী। ওরা কেউ ফিরলে মালতী ওর ঘরে যাবে।

তারাসুন্দরী বললেন, তুই সবচেয়ে ভালো বলেছিস মালতী। একদম মনের কথা। আমার ছেলেটা যে কী বলল কিছুই বুঝতে পারলুম নে।

মালতী ঘর ছেড়ে বাইরে যায়। রান্নাঘরে ঢোকে।

প্লেটে করে এক টুকরো ইলিশ মাছ নিয়ে আসে। দরজাটা বন্ধ করে। অনেকটা বাতাস টেনে নেয় বুকে, তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, দিদিমা ইলিশ, আজ উৎসবের দিন। এটা

তোমার জন্য।

তারাসুন্দরী বলেন ওমা, কী অলুক্ষুণে কথা। বলিস কী। আমি এসব খাই নাকি?

মালতী বলে– অলুক্ষুণে কথা কেন? দারোগাদাদু তো বলেই গেছিলেন মাছ খেয়ো। আমাকে বলেছ তো সে কথা। কেউ দেখবে না। আমি কাঁটা বেছে খাইয়ে দিয়ে পেলেট পরিষ্কার করে দেব। কেউ জানবে না। শুধু তুমি আর আমি।

তারাসুন্দরী মাছের টুকরোটার দিকে চেয়ে থাকেন। সোনালি বরণ। বলেন ভয় করছে।

কীসের ভয় দিদিমা?

জানি না।

ধুর। খাও তো, এটাই তোমার

সংবর্ধনা। হাঁ করো।

তারাসুন্দরী বলেন, তা হলে ওনার মুখে ছুঁইয়ে পেসাদি করে দে।

দেয়ালে গোঁফওলা একটা লোক।তারাসুন্দরীর গোলাপি মাড়ি পদ্ম হয়ে ফুটে ওঠে।

ব্যথার বর্ণমালা

তিরিশ বছর পর সেই সেন্টেনারি বিল্ডিংয়ে সিঁড়িতেই বসে পড়লাম আমি। রাই আজই এই কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে প্রথম ক্লাসে এল। আমি বাংলা পড়েছি বলে নয়, রাই ওর নিজের পছন্দেই বাংলা পড়ছে। আমি একপ্রকার জোর করেই ওর সঙ্গী হয়েছি। বলেছি, চল না, তোকে ইউনিভার্সিটির গেটে এগিয়ে দিয়ে আমি অফিস যাব ’খন। আমার আজ অত তাড়া নেই। রাই বলেছে, তুমি চাপ নিচ্ছ কেন আমি কি কচি খুকি নাকি?

আসলে আমি এসেছি এক অমোঘ টানে। তিরিশ বছর আগে আমিও যে বাংলা পড়তে এসেছিলাম এখানে। এই আশুতোষ বিল্ডিংয়ে আমাদের ক্লাস ছিল। সবই প্রায় একইরকম আছে। শুধু শাড়িতে সজ্জিত দীপারা হারিয়ে গেছে। এ যুগের দীপারা স্কিন টাইট জিন্সে আর টাইট টপে, লেগিংস আর কুর্তিতে বেশি স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল। ওদের ভিড়ে সালোয়ারে শোভিত দীপাও আছে কয়েকজন। আমার মেয়ে রাই-ও তাদের দলে।

রাইকে আমার ছাত্রাবস্থার সব গল্পই বলেছি। তবে দীপার কথা রাই জানে না। রাইয়ের মা কেয়াকেও বলিনি। বলব কী? সে বড়ো ব্যথার অধ্যায়। আমার জীবনের সেই করুণ কাহিনি শুনিয়ে মেয়ের করুণা কুড়োতে চাইনি আমি।

বললে কেয়া, দীপার কথা তুলে উঠতে বসতে খোঁচা দিতে ছাড়ত না। সে আমার বুকের অতলে ঘুমিয়ে থাকা গভীর গোপন ইতিবৃত্ত। সত্যি বলতে কী, তিরিশ বছর আগের এই বাংলা ডিপার্টমেন্টের সেই অপরূপা দীপাই আজ আমাকে এখানে টেনে এনে বসিয়ে দিল। রাই হাত নেড়ে আশুতোষ বিল্ডিংয়ে ঢুকে উঠে গেল। আর আমি এক মর্মান্তিক স্মৃতির ভারে বসে পড়লাম সেন্টেনারি বিল্ডিংয়ের সিঁড়িতে।

দুই হাঁটুতে দুই কনুই ঠেকিয়ে দুই হাতের বেষ্টনিতে মাথা নত করে কপালের ভার ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজলাম। কী আশ্চর্য! চোখ বুজতেই আমার চোখের সামনে স্পষ্ট দৃশ্যমান হল তিরিশ বছর আগের এক রোববারের দুপুর। সেই আউট্রাম ঘাটে। একেবারে চলচ্চিত্রের মতো ঘটনা পরম্পরা! আমার হৃৎপিণ্ড কাঁপিয়ে দিয়ে দীপা বলল, চল নৌকো চড়ি। দীপা উঠে দাঁড়িয়ে শাড়ির পাটে খানিক আঙুল চালিয়ে নিয়ে ফের বলল, নে ওঠ।

নৌকো চড়বি কী রে? প্রশান্ত আসবে না? সত্যিই যেন ব্যাপারটা আমার অবাক লাগল। আসলে এর চেয়ে সুখের আর কী হতে পারে? না ঠিক সুখ বলা যায় কি? একটা খুশির হাওয়ায় ভেতরটা দুলে উঠেছিল নৌকো চড়ার কথা শোনামাত্র। সস্তার সুখ আমি চাইনে। বড়ো কথা যখন জানিই দীপার প্রেমিক আছে।

দুপুর দুপুর ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে আউট্রামের জলপুলিশ অফিসের কাছাকাছি গঙ্গামুখী কাঠের বেঞ্চিতে বসে আছি, আমি আর দীপা। প্রশান্ত এল না। তার জন্যে দীপার খুব একটা এল-গেল বলে মনে হল না। কেন কে জানে? কথা দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের দু-দুটো ঘন্টা পরেও ওর প্রেমিক এল না। তা নিয়ে দীপার উদ্বেগ তো ছাড়, সামান্য ভাবনা হল বলেও বোঝা যায়নি। তার ওপর নৌকো চড়তে চায় শুনে সত্যিই অবাক লাগল আমার!

কথার ফাঁকে আমিই বলেছি, কী হল তোর প্রশান্তর? এটুকু নেহাতই সৌজন্য। যার অনারে আসা সে-ই এল না। এ নিয়ে আমার যেন বড়ো আফশোশ হচ্ছিল। বুকে হাত দিয়ে বলতে গেলেই তো সত্যিটা ফাঁস হয়ে যাবে। পারব সত্যিটাকে ঢেকে দিতে? আসলে প্রশান্ত না আসুক, মনেপ্রাণে আমি সেটাই যে চাই, দীপাকে কি তা বুঝতে দেওয়া যায়?

দীপার সঙ্গে আজকে এই মুহূর্তগুলোর পুরোপুরি আনকোরা স্বাদ আমার। এর আগে কি কোনওদিন ভাবতে পেরেছি যে, এমন একটা দিনও আসতে পারে? দীপা আমার এত কাছাকাছি ঘন্টা দুয়েক বসার পরেও একান্ত নিভৃতে নৌকোতেও না জানি আরও কতক্ষণ থাকবে। তবে? বোকার মতো আমি এটা কী করে চাই যে প্রশান্ত এসে এই অনন্য মুহূর্তগুলো কেড়ে নিক? আর আমি বাঁয়ে চলে যাই।

দীপা না জানলেও এটা তো ঠিক যে, দীপার কাছে থাকলে আমি সব ভুলে যাই স্মৃতি বিস্মৃতির পরোয়া করি না। তাছাড়া কোন পুরুষই বা না চায় দীপার মতো ষোলোকলা পূর্ণ নারীর সঙ্গে দিনের চার-পাঁচ ঘন্টার আপস সান্নিধ্য? উপরি পাওনার মোহ যখন মানুষের সহজাত, তখন তো কোনও প্রশ্নই আসে না। অনেকে আদর্শের কথা বললেও আমি অত আদর্শবান হতে পারিনে।

সমরের মুখে শুনেছিলাম কথাটা প্রথম। বিশ্বাস হয়নি। তারপর এর-ওর মুখে গোপন মূল্যবান খবরের মতো ছড়াতে দেখে সেদিন দুপুরের দিকে সোজা চলে গেলুম বুবুনদিদের বাড়ি।

বুবুনদির বাবা নেই। তবে পৈতৃক ভিটেবাড়ি অর্থাৎ ঠাকুরদার আমলের মোটা মোটা থাম্বা দেওয়া অদ্ভুত বাড়িতে অনেকগুলি ঘর। এখন সব ভাড়া দেওয়া আছে। তবু বুবুনদির নিজস্ব একটা আলাদা ঘর আছে। সে ঘরে সচরাচর কেউ আসে না। বুবুনদির ছোটো ভাই বা বোনেরা, মাসিমা, কেউই।

মোমের আদলে ছিপছিপে গড়নের বুবুনদি। বিলুদার সঙ্গে বুবুনদির সম্পর্কের কথা কারুরই যেমন অজানা ছিল না, তেমনি কারুরই জানতে বাকি নেই, সেই সম্পর্ক ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। কেন? জানতে চেয়েছি। বুবুনদি বলেনি কিছুই। তবে সমরের মুখে যা শুনেছি, তার সত্যি-মিথ্যে আমাকে জানতে হবে। গিয়ে দেখি বুবুনদি বাড়ি নেই। খানিক আগেই বেরিয়েছে কোথায়। মাসিমা বললেন জানি না।

কথা না বাড়িয়ে গিয়ে বুবুনদির ঘরে টান টান হয়ে শুয়ে থাকলাম। বুবুনদির ঘরের সব আসবাবে, বিছানায় একটা বহু ব্যবহারের ছাপ। সারা সংসারেই একটা অস্বচ্ছলতার অনাবিল ছবি ফুটে ওঠে। বুবুনদির বাবা বেঁচে থাকতে তাদেরই এই চত্বরের সবচেয়ে অবস্থাপন্ন বলে মনে হয়েছে। একটা বিদেশি ফার্মের স্টেনো ছিলেন বুবুনদির বাবা। আমি ইংরেজি নিয়ে আসতাম এ বাড়ি।

কেউ জানত না, তখন আমার মনে হয়েছে বুবুনদির মধ্যে একটা অলক্ষ্য মাতৃত্ব আছে। বুবুনদির কাছে নিরাপদ মনে হয়েছে, সে যা-ই ঘটুক না কেন। সেই আমারই মধ্যে কখন যে ধীরে ধীরে কামনার রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল! বুঝলাম সেদিন, যেদিন অনাবশ্যক ভাবে বুবুনদিকে জড়িয়ে ধরে গলার কণ্ঠায় চুমু খেয়ে বসলাম। কিছু বলেনি সেদিন বুবুনদি আমায়। আর তার জন্যেই আমার বাড় বেড়ে গেল। একটা পাপবোধ ভেতরে ভেতরে দানা বেঁধে উঠতে লাগল।

বুবুনদির কাছে গেলেই সেই একই ভাবনায় কেঁপে উঠত বুকের ভেতরটা। সেরকম একদিন আরও। হুট করে জড়িয়ে ধরে বুবুনদির বুকের রেখায় অনবরত চুমু খেতে লাগলাম। এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বুবুনদি বলেছিল, অসভ্য কোথাকার! এভাবে কেউ দিদিকে আদর করে? লজ্জায় অপমানে বিপন্ন ফেরারির মতো পালিয়ে এসেছি সেদিন।

ছোটো বোন শিলুকে দিয়ে খবর পাঠালেও বুবুনদির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারিনি। প্রাণ খুলে সেই থেকে বুবুনদি বলে আর ডাকতে পারিনি। ভাবলে নিজের ওপর ঘৃণায় গা শিরশির করে ওঠে। কলজে চুঁইয়ে অনবরত ঘৃণার ঘাম নেমে আসে। সেই বুবুনদিকে নিয়ে এমন একটা ভযংকর কথা এ-মুখ সে-মুখ হচ্ছে। বুবুনদির কাছেই তার সত্যিটুকু জেনে নিতে হবে। বুবুনদির বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে আচ্ছন্নের মতো ঘুম এসে যাচ্ছিল।

সন্ধের পর বুবুনদি এল। আলোর সুইচ চেপে দিয়ে আমাকে দেখে বলল, কখন এসেছিস? আমি সে কথাকে পাশ কাটিয়ে গেলাম।

—সরাসরি বললাম, তোমাকে নিয়ে কীসব কথা চালাচালি হচ্ছে খবর রাখো?

ভাবলেশহীন বুবুনদি বলল, আমি জানি। যা শুনেছিস সব সত্যি।

—তার মানে? সহসা আর কোনও কথা বেরোল না আমার মুখ থেকে।

বুবুনদিই বলল, আবার তুই জানতে চেয়েছিলি না, তোর বিলুদা কেন আসে না? এজন্যই আসে না। তারপর স্বগতোক্তির মতো বলল, ইডিওলজি ধুয়ে জল খাই আর এত বড়ো সংসারটা ডুবে যাক।

—তাই বলে তুমি ছবি আঁকিয়েদের সামনে ওভাবে…

—চুপ কর, হালকা ধমকে উঠেছিল বুবুনদি। দেহ ভাঙতে রাস্তায় বেরোলে খুশি হতিস?

বাঁচার জন্য বুবুনদি কোনও কিছুরই তোয়াক্কা করেনি। তাকে নিরাবরণ দাঁড়াতে হয় ছবি আঁকিয়েদের সামনে। দীপার সামনে এলেও আমি ওই সব ছেঁদো আদর্শের তোয়াক্কা করি না। করি না বলেই অন্যের প্রেমিকা জেনেও নিছক আদর্শের জন্য দীপার সঙ্গে একই মন নিয়ে মেলামেশাতে পিছপা হই না। হওয়ার সাধ্যিও নেই আমার। কেবল দীপার চোখ দুটো যেন এক অমোঘ শাসনে বেঁধে রাখে আমার সম্পূর্ণ সত্তাকে। কেন? তা জানিনে।

—কী হল ওঠ! নৌকায় চড়ার জন্য এবারে তাড়া দেখিয়ে আমার হাতে হেঁচকা টান দিয়ে আমায় দাঁড় করাল দীপা।

—আমি বললাম, হঠাৎ ক্ষেপে গেলি কেন নৌকোয় চড়ার জন্য?

—তুই আয় তো বলেই, দীপা খেয়াঘাটের দিকে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল। আমিও পিছু নিলাম। আবারও বললাম, তোর প্রশান্ত তাহলে এলই না।

—ধুর, ছাড় তো ওর কথা। নিজের প্রেমিক সম্পর্কে এত নিস্পৃহতা, উদাসীনতা কারও থাকতে পারে? দীপাকে না দেখলে বিশ্বাস হতো না আমার।

দীপার পেছন পেছন আমি খেয়াঘাটের সিঁড়ি ভাঙছিলাম। পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দীপা জিজ্ঞেস করল, এর আগে নৌকো চড়েছিস কোনওদিন?

আমি বললাম, না।

—কেন চড়িসনি!

—বা রে! আমরা তো নর্থ বেঙ্গলেই ছিলাম বেশি।

সিঁড়ি শেষ হতেই প্যাচপ্যাচে কাদার ওপর জোড়া জোড়া ইট পাতা, এক হাত মতো ফারাকে ফারাকে।

—দীপা বলল, আমার হাতটা একটু ধর। আমি চট করে ধরে ফেললাম হাতটা। সাবধানে পায়ে পায়ে এগোতে থাকলাম।

দীপাকে আজ আমি যেন নতুন করে চিনছি। আবিষ্কার করছি। মাঝে মাঝেই দীপা আমার শূন্যবুক ভরে দিয়ে তাকিয়েছে। দীপা এত অদ্ভুত তাকাতে পারে? ছেলেমানুষের মতো আমার মনে হয়েছে দীপাকে যদি আমি নিজের করে পাই, আর ও যদি আমার দিকে এভাবে তাকায়, তাহলে সাতজন্ম আমার ক্ষিদেই পাবে না!

এখনও পর্য‌ন্ত খুব একটা হইচই কথার ফুলঝুরি উড়িয়েছে, তা না। অল্পস্বল্প যে দু-চার কথা বলেছে আর ছেলেমানুষি হেসেছে, তাতে আমার মনে হয়েছে, দীপাকে এখন আমি অনেক শক্ত কথাও অবলীলায় বলে দিয়ে স্টেডি থাকতে পারব, মুখ থুবড়ে পড়ার ভয় নেই কোনও। শক্ত কথা বলতে তো ওই একটাই কথা আমার মনে ঘুরপাক খায়। তা হল, দীপা আমার মধ্যেই প্রশান্তকে খুঁজে নিক না।

—এসব ভাবা খুবই অন্যায়। বুঝি সেটা। দীপা ঘুণাক্ষরেও টের পেলে কেলোর একশেষ হবে। বলবে, তলে তলে তুই এতটা উত্তীয়!

—এতটার কী আছে? তোকে ভালো লাগে, তোকে ভালোবাসি, ব্যস। মোদ্দা কথা, তোকে ছাড়া আমি  সিনেমার হেমামালিনীকেও কল্পনা করতে পারব না।

—কল্পনা করতে পারব না, আবদার আর কি! কুমির তোমার জলকে নেমেছি, ছেলেখেলা যেন।

—কোনও কিছুই ছেলেখেলা নয়। বস্তুত, দীপার প্রেমিক আছে, ভেবে নিজেকে সচেতন করে গুটিয়ে নেওয়ার আগেই তো ভরাডুবি হয়ে গেছে। ছেলেখেলা তো দীপাই করেছে গোড়া থেকে। নইলে প্রথম দিন করিডোরে অপরিচিতের দিকে ওভাবে কেউ তাকায়? প্রাণান্ত ইশারা করে কেউ হাসে ওভাবে? অন্তত নিজের একজন প্রেমিক যখন আছে! আমার বুকে কার্তিকের হিম জমাট বেঁধে আছে সেই থেকে। দীপার জন্যই তো। দীপা ছাড়া অন্য কারুর তোপে কি সে হিম ছাড়বে বুক থেকে?

মেয়েদের মধ্যে সুমিতার সঙ্গেই প্রথম আলাপ হয়েছিল। সুমিতাই দীপাকে ডেকে পরিচয় করিয়েছিল আমার সঙ্গে। দু’চার কথা বিনিময় হয়েছে সবে, তখুনি অসীম এসে সুমিতাকে ডেকে নিল। সুমিতা চলে গেলেও দীপা যাওয়ার কোনও লক্ষণই দেখাল না যখন, তখন আমিই বা কী করে হুট করে চলে আসি? দীপার মতো মেয়ে সামনে দাঁড়ালে অনেক আচ্ছা আচ্ছা কলিজাও শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে। তবু সৌজন্যের খাতিরে কিছু একটা বলে তো আমাকে রেহাই পেতে হবে।

সহসা ওর দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে বলতে গেলাম, আপনাকে আগেই দেখেছি। কিন্তু কথা শেষ হওয়ার আগেই সে হাসি বিপন্ন ম্লান হয়ে ঠোঁটের আগায় ঝুলে পড়ল। দীপা দমকে হঠাৎ এমন ভাবে হেসে উঠল, মনে হল কাচের জার মেঝেয় পড়ে ভেঙে চৌচির হল। আমার অস্বাভাবিক ভেতরটা কি ও বুঝতে পারল? এভাবে হেসে উঠল যে!

দীপার ফর্সা দুপাটি দাঁত এক হতেই সে বলল, আমাকে আপনি কেন? সংকোচের কাঁটা সরে গেল অনেকটা।

—সহসা বললাম, এখানে সবাই তুই-তুকারি করে। আমি চট করে কাউকে তুই বলতে পারি না। আমার আসে না।

দীপা বলল, আমাকে তুমি তুমিই বলো।

—তার মানে? তুমি বলবে আর আমি বাধ্য শিশুর মতো তোমার কথাকে শিরোধার্য করে তোমাকে তুমি তুমি করে তোমার ওপর আমার দুর্বলতাকে সাড়ম্বরে জানান দিই আর কী!

আমার মনের ভেতরে কেন জানি এসব বুদবুদের মতো ভেসে উঠতেই আমি বলে বসলাম, এখানে সবাই যখন তুই বলতে পারে, তখন আমাকেও তো চেষ্টা করে পারতে হবে। কথাগুলোকে এমন ধীরে-সুস্থে বললাম, যেন দীপার মতো অমন ডানাকাটা পরি গোছের একটা সুন্দরী মেয়েকেও মনে হতে থাকে, কই তেমন তো কিছু দেখলাম না আমার চোখে! এমনই উন্নাসিক ভাবে তাকাতে গেলাম ওর দিকে। কিন্তু সত্যিকারের আগুনে কি আর শিশির ভেবে হাত রাখা যায়?

আমার দিকে দীপার অদ্ভুত প্রগল্ভ চাউনি দেখে একটা তীব্র সুখ যন্ত্রণার আকারে বুকের রক্তে আঘাত করতেই সারাৎসার রক্ত নুয়ে পড়ছিল। তখনও কি জানতাম, এই দীপার একজন প্রেমিক আছে?

মেয়েদের চোখে আমি নাকি মুখচোরা গোছের। একথা বহুবার আমার কানে এসেছে। সুমিতা, দীপা ওরাও তাই ভেবেছে নিশ্চয়ই। তবে যে-অর্থে ওরা আমায় মুখচোরা ভাবে, সেদিক দিয়ে কারুর চাইতে কম যাই না আমি। তবু চট করে কারুর সঙ্গে তেমন ভাবে জমিয়ে নিতে পারি না।

সেই আমার সঙ্গে দীপার মতো সপ্রতিভ চরিত্রের মেয়ের পরিচয় হওয়াটা নিতান্তই দৈবাৎ। আরও বেশি দৈবাৎ ঘটনাটা ঘটে গেল ফ্রেশার্স ওয়েলকামের দিন। কাউকে জানাইনি কথাটা। আগের দিন ঠিক করে ফেললাম মনে মনে। বলেও ফেলতে পারতাম। কিন্তু তুষার, অসীম, সুমিতার সঙ্গে দীপাও ছিল। রহস্যময় ভাবে কথাটা তাই চেপে গেলাম বেমালুম।

এখানে আমার এ বিষয়ে কেউ জানে না কিছু। তাই সামান্যও ধারণা বা আঁচ করতে পারেনি কেউ। সে নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনও কথাও ওঠেনি। তলে তলে ব্যবস্থা পাকা করেছি আমি একা। দীপা না থাকলে হয়তো শেষ পর্য‌ন্ত কাউকে না কাউকে বলেই ফেলতাম কথাটা। প্রথমদিন আলাপের পর দীপার সঙ্গে আমার আর কোনও কথাই হয়নি বলতে গেলে।

ইউনিভার্সিটিতে সবার সামনে মাঝেমধ্যে আমার সুপ্ত বাকপটুতার আত্মপ্রকাশ ঘটলেও, দীপা এসে গেলেই আমার ক বর্ণ কথাও নিতান্তই মূল্যহীন মনে হয়েছে। কেবলই মনে হয়েছে, যা বলেছি সে তো হাজার হাজার লোকের মুখের কথা। দীপাকে আমি এমন কথা শোনাই, যা শুনে দীপা চমকে যাবে। সম্পূর্ণ আলাদা গোছের, সম্পূর্ণ আনকোরা, দারুণ মূল্যবান, অথচ সহজ হৃদয়গ্রাহী। যে-কথা এর আগে কেউ বলেনি। এসব ভেবে বাকহীন জড়ের মতো সবার কথার মধ্যে বসে থেকেছি। মাঝেমধ্যে দু-চার কথায় সায় দিয়েছি। দীপার সঙ্গে সরাসরি কোনও কথা হয়নি। ও-ও বলেনি। আমিও সহসা পারিনি কিছু বলতে।

পরদিন নবীন বরণে এসেছি অনেক আগে থেকেই। তখনও কাউকে বলিনি কিছু। কাউকে বলে ফেললে হয়তো ভেতরটা অনেক হালকা হয়ে যেত। তবু সবাইকে চমকে দেওয়ার একটা তীব্র স্পৃহা কাজ করল মনে মনে। টেনশনটা সেজন্যই বাড়ছিল আরও বেশি। যতই সময় এগিয়ে আসতে লাগল, ততই কী হয়! কী হয়! ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছিল।

তখন অনেকেই এসে পড়েছে। দীপাও এই এল। হালকা আকাশি রঙের ফিনফিনে হাওয়ার মতো পাতলা গোছের শাড়িটায় কালচে বুটি। এই শাড়িটার জন্য দীপার শরীরের প্রভা আরও বেশি ফুটেছে নাকি? দু-একটা বিশেষ তারা যেমন আকাশে কখনও সখনও দেখা যায়।

সুমিতা, সোনালি, তুষার, বিমল ওরা এদিক ওদিক যাচ্ছে আসছে, কলকল করছে। আমিই কখনও ওদের কাছ থেকে খাপছাড়া হয়ে একা হয়ে যাচ্ছি। কেবলই মনে হচ্ছে শরীরে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হচ্ছে না। সুমিতার কখন এলির উত্তর দিতে গিয়ে তখন অস্পষ্ট গলা ক্ষীণ কেঁপে গেছিল। এখন হাত নেড়ে ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না।

দীপাকে আজ যে-সারপ্রাইজ দেব, সেটা ওর পছন্দসই হবে কিনা তা নিয়ে যত ভয় ও সংশয়। একজনের গান আরেকজনের কাছে কান্না মনে হতে পারে। আবার কারও কান্না কারও কাছে গানের মতো মনে হতে পারে।

একসময় এমন ছিল, বুবুনদিকে আমার যখন তখন চমকে দিতে ইচ্ছে করত। শুধু মনে হতো, নতুন আরও নতুন ভাবে চমকে দিই বুবুনদিকে। তখন জানতাম না, পৃথিবীতে চমকে ওঠার মতো কোনও টাটকা ঘটনা আর নেই। সব ঘটনার রংই বিবর্ণ ফিকে হয়ে গেছে। নতুন করে রং চড়ালেও তাতে আর কোনও রোমাঞ্চ নেই।

বুবুনদি তুমি জানো না। তোমাকে চমকে দেওয়ার জন্যে আমি তোমার ঘরে খাটের নীচে গিয়ে লুকিয়ে ছিলাম। বিলুদা এসেছিল তোমার ঘরে। তোমার সঙ্গে বিলুদাকে সেদিন ভালো দেখিনি আমি। লোকটা ভালো ছিল না। তুমি ভালো থেকো। ভালোবাসা নিও।

সেন্টেনারি হলে সবাই ঢুকে পড়েছে। আমি ঢোকার মুখে টেনশন কাটাতে সিগারেটে ঘনঘন টান দিচ্ছিলাম। দীপা তুমি কখনওই জানতে পারবে না, তোমাকে শুধুমাত্র তোমাকে একটা ছোট্ট সারপ্রাইজ দেবার জন্য আমার ভেতরে এখন কী ভয়াবহ ভূমিকম্পে ধস পেয়ে যাচ্ছে সব। সিগারেটটাকে টোকা দিয়ে ছুড়ে চোখ ফেরাতেই দেখি দীপা। তন্ত্রীতে কোথায় আকস্মিক বাধাপ্রাপ্ত রক্তের বেগ ধুন্ধুমার ঘটিয়ে দিচ্ছে সারা শরীর জুড়ে। আমি চোখ ফেরালাম।

দীপা ওর অদ্ভুত চাউনিতে হাসির আলো ছড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে এল আমার দিকে। এসেই বলল, এখানে একা। কী করছিস? তুই নাকি গান গাইছিস? কাউকে বলিসনি তো তুই গান জানিস! ইউনিয়নের শ্যামসুন্দরদা বলল, তোমাদের বাংলার উত্তীয় গান গাইবে। সত্যি?

—আমি হ্যাঁ বুঝিয়ে মাথা নাড়লাম। ভেতরটা তখনই আমার নিস্তরঙ্গ স্বাভাবিক হয়ে গেল। দীপা বলল, চ, ভেতরে আয়। আমি দীপার সঙ্গে ভেতরে গেলাম।

 

দুই

যেমন দৈবাৎ পরিচয় হয়েছিল, তেমনই দৈবাৎ ঘনিষ্ঠতাও হয়ে গেল দীপার সঙ্গে সেই ফ্রেশার্স ওয়েলকামের দিন থেকে। দীপা যেখানে, সেখানে আমি। আমি যেখানে দীপা সেখানে। বাংলার সবাই আমাদের নিয়ে নানা কথা ছুড়ে দিতে লাগল। দীপা ভ্রূক্ষেপ করত না। আমি মাঝে মাঝে রাগ দেখাতাম। এমন ভাব দেখাতাম যে, এখনই একটা রিভলবার পেলে ছয়ঘোরা করে একেকটার বুকে সিঁধিয়ে দিতাম। সেটা শুধুই আলগা, বাইরের। ভেতরে ভেতরে দারুণ ইচ্ছে করত, গিয়ে সবার পিঠ চাপড়ে বলি, সাবাশ বচ্চে, আউর বোলো, চিলহা চিলহা কর বোলো। সারি দুনিয়া কো মালুম করা দো, দীপাকে সাথ মেরা কেয়া সিলসিলা।

একটা ছোট্ট কথাই শুধু বলা হয়নি দীপাকে। কীভাবে বলব? কী কথা দিয়ে শুরু করে আসল কথার দ্বীপে গিয়ে দাঁড়াব? কীভাবে সাজিয়ে বললে দীপার সবচেয়ে বেশি পছন্দ হবে, ভেতরে ভেতরে এই নাট্যরঙ্গের ডামাডোলেই আর বলা হয়নি কিছুই। দীপার মতো মেয়ে আগ বাড়িয়ে কোনওদিনই একথা বলবে না। এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমাকেই বলতে হবে।

আবার মনে হয়েছে, সব শুনে দীপা যদি বলে, না রে উত্তীয়, এ আমি চাইনি। আমি বন্ধুত্ব চেয়েছি। তুই আমাকে ভুল ভেবেছিস। এসব নেহাতই প্রেমিক মনের অহেতুক ভয়। দীপা আমাকেই ভালোবাসে। একথা আমি চোখ বুজে বাঁহাতে লিখে দিলেও একটা বর্ণেরও হেরফের হবে না। আমি হলফ করে বলতে পারি। কত কথা মনে হয়েছে বলব। দীপার কাছে যেতেই মনে হয়েছে, কথা নেই কোনও। বস্তুত, কোনও কথা থাকে না, সেটাই স্বাভাবিক মনে হয়েছে বারবার।

রবিঠাকুরের গান পছন্দ করে দীপা। কেবলই মনে হয়েছে দীপাকে একটা রেয়ার গান শোনাই। দীপার সঙ্গে আমার রুচি ও পছন্দের আদ্যোপান্ত মিল। কোনও কবিতা ভালো লেগে গেলে মুখস্থ করে ফেলেছি। দীপাকে শুনিয়েছি। ও খুশি হয়েছে। খুব সহজে খুশি না হওয়াটাই যেন দীপার বিশেষত্ব। কিন্তু যখন মনে হয়েছে, দীপা সত্যিই মুগ্ধ হয়েছে, তখন সুখের যন্ত্রণায় বুকের ভেতরটা ভরে গেছে।

দীপা আমার ছোটোখাটো, খুচখাচ সব ব্যাপারেই নজর রেখেছে। একটুতেই ডাক দিয়েছে। চোখ পাকিয়ে শাসনের ধরন নিয়েছে। তখন আরও বেশি করে আমার মনে হয়েছে, দীপা তুই আমার। একচেটিয়া সুখের আধিপত্য নিয়ে বিশ্ব সংসারে আমি একাই এসেছি। তার মূলে তুই।

কিন্তু, রামেন্দ্রসুন্দরের ওপর বইটা যেদিন হারিয়ে ফেললাম, দীপা সেদিন আমায়, তুই একটা যা তা, ইরেসপন্সিবল কোথাকার এসব মুখের ওপর বলে দিয়েছে। কারও কাছ থেকে যেন চেয়ে এনেছিল বইটা। তারপর ক্লাসে আমার কাছে দিয়ে বলেছিল, তোর কাছে রাখ। রেখেছিলাম। তবে ভাবতে পারিনি বইটা হারিয়ে যাবে।

আমায় সঙ্গে করে দীপা গোটা ক্লাস রুম, ক্যান্টিন, করিডোর, লাইব্রেরি, যেখানে যেখানে গেছি তখনও পর্য‌ন্ত, সব জায়গায় খুঁজেছে। আগ বাড়িয়ে একে তাকে জিজ্ঞেস করেছে। তত বেশি করে রেগে গেছে আমার ওপর। বারবার ওর মুখে শুনতে হয়েছে, তুই একটা কী রে? এত ইরেসপন্সিবল! সামান্য একটা বই দায়িত্বে রাখতে পারলি না?শুনে লজ্জায়, অপমানে আমার কর্ণমূল আরক্তিম হয়ে উঠেছিল।

দীপাকে কোন মুখে কী বলব? কিছু বলার থাকে আর? দীপা আর কোনওদিন আমার কাছে আর কিছু রাখতে দেবে না। কোথায় হারালাম বইটা, কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। মনেই ছিল না। দীপা চাইতেই তখন মনে পড়ল।

আজ যাওয়ার সময় দীপা আমায় ডাকল না। সব দিন ডাকতে হয় না। সঙ্গে থাকি, যাই বাসস্টপ পর্যন্ত। বাস এলে দীপা উঠে যায়। আমি হ্যারিসন রোড ধরে হাঁটা শুরু করি। নিজের প্রতি একটা মিহি ঘৃণা, একটা তাচ্ছিল্য শরীরময় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল। দীপার কাছে আমি ছোটো হয়ে যাই, দীপা আমাকে অপদার্থ ভাবুক, তা কি মনের ভুলেও ভেবেছি? বরং মনে মনে উলটোটাই চেয়েছি। সাবলীল সুপুরুষের সবক’টা গুণ খুঁজে পাক দীপা আমার মধ্যে। আবিষ্কার করুক এক অনন্য নবীনকে।

দীপার কী দোষ? ওকে তো বইটার জন্য অন্যের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে। জবাবদিহি করতে হবে। সে তো আমারই জন্য। দীপা কারও কাছে সহজে ছোটো হওয়ার মেয়ে নয়। সেখানে যদি যার বই সে দু’কথা বলার সুযোগ পেয়ে যায়, আর দীপাকে তা শুনতে হয়, তাহলে কল্পনাতীত কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে। দীপা আমাকে আরও যা মুখে আসবে বলে দেবে। কথা বন্ধ করে দেবে। না দীপা তুই কথা বন্ধ করে দিস না। আমার কথা তো ছোঁয়াচ পেয়ে উজ্জ্বলতা পায়, তুই বুঝিস না?

পরদিন ইউনিভার্সিটি এসেছি। ভয়ে ভয়ে গা আড়াল করে থাকতে ইচ্ছে করছিল। দীপার চোখের আড়ালে আড়ালে থাকতে চাই। পারলাম না। দীপা আমার কাছে এসে বসল। দীপার মুখোমুখি অপরাধীর মতো বসেছিলাম। তাকাতে পারছিলাম না ওর দিকে। আমি অপার অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। দীপা ওর ডান হাতের তর্জনী দিয়ে আমার গ্রীবা ঘুরিয়ে আনল। বলল, আমার ওপর তুই রাগ করছিস না রে? তাকা আমার দিকে।

আমি অপলক তাকিয়ে থাকলাম দীপার চোখে। পর্যাপ্ত অভিমানে ক্রমে দু’চোখ জলে ভার হয়ে এল আমার। আমি অস্পষ্ট কাঁপা গলায় বললাম, কই না তো।

দীপা এবার ঝুঁকে এল আমার কানের কাছে। তারপর পরম গোপনীয়তার সতর্কতায় ফিসফিস করে বলল, কাল মেট্রোতে ম্যাটিনির দুটো টিকিট কেটে রাখিস। আমি ঠিক সময়মতো চলে যাব।

দীপা বলেছে, স্টুডিওটার সামনে দাঁড়াস। এদিক ওদিক যাস না কোথাও। অন্য কোথাও যাইনি আমি। টিকিট দুটো কেটেও নিয়েছি। শীতের রোদ। তবু বেশ কড়া। তা হোক। তবু নড়িনি। আমি অনেক আগেই এসে পড়েছি। দীপার আসার এখনও অনেক দেরি।

ধারবাহী জনস্রোত, ফুটপাতে হকারদের চিৎকার, ডবল ডেকারের পেছন থেকে কালো ধোঁয়া ছেড়ে মোড় নেওয়া, অনন্তকাল ধরে বয়ে চলা দ্রুতগতি যানগুলোকে আমার তীক্ষ্ণ নজর ছেঁকে ধরছিল। এদিকে আমার বাঁহাতের কবজিতে সময় এগিয়ে মেট্রোর ম্যাটিনিকে ছুঁয়ে ফেলতে চাইছে। আনমনা গালে হাতের প্রলেপ দিতে গিয়ে মনে পড়ল, তাড়াহুড়োয় দাড়িটা কাটা হয়নি। গালভরা খোঁচা খোঁচা দাড়ি রয়ে গেছে। কালো মুখে এই দাড়ি দীপার কাছে মোটেই নয়ন সুখকর হবে না।

দীপা কেন আসছে না? আমি তো স্টুডিওর সামনে থেকে একচুলও নড়িনি। চোখে রোদ পড়ছে। তবু সানগ্লাসটা নামিয়ে রেখেছি। খালি চোখেই দীপাকে দূর থেকে লক্ষ্য করতে সুবিধে হবে।

হলের বাইরে দর্শকদের ভিড় পাতলা হয়ে গেছে। শো শুরু হওয়ার পরেও ঠায় একঘণ্টা অপেক্ষা করেছি। একটার পর একট সিগারেট খেয়েছি। দীপা আসেনি। চোখের শিরা বুক থেকে রক্ত টেনে জড়ো করছিল। একটুতেই ঝরে পড়বে বুঝতে পেরে অতি সন্তর্পণে ঢোক গিলে গিলে বুকের রক্ত বুকে ফেরাতে চেয়েছি।

দীপা এল না কেন? কী এমন ঘটতে পারে যার জন্য এল না? সিনেমা দেখার কথা তো দীপাই বলেছে। আমি তো বলতে যাইনি। তোষামোদ করতে যাইনি। তোকে যেতেই হবে এমন মাথার দিব্যি দিয়ে তো রাজি করাইনি। তুই তো নিজেই গদগদ হয়ে বললি। নাকি বই হারিয়ে ফেলার প্রতিশোধ নিল? আর আমাকে একটা নিরেট গবেট ভেবে পুরোটাই কৌতুক করে মজা পেতে চাইল দীপা?

দীপার শরীরে কি মহম্মদ বিন তুঘলকের রক্ত আছে? এসব সবই আমার রাগের মাথার ভাবনা। কেন-না দীপা আসেনি বলে কিন্তু ওর ওপরে রাগের চেয়ে অভিমানই হচ্ছে বেশি। যাকে ভালোবাসা যায়, তাকে অনাবশ্যক রূঢ় কথা বলা, মাঝেমধ্যে তাকেই শত্রু প্রতিপন্ন করার পেছনে একটা সূক্ষ্ম তৃপ্তি আছে। আর কারও না থাক, আমার আছে। রাগের মুহূর্তে হাবিজাবি মনে আসে। আসলে দীপাকে আমি খুব ভালো চিনেছি। বই হারিয়ে ফেলার প্রতিশোধ নেবে, এত নীচু মন ওর না। ও হয়তো কোনও কারণে আটকে গেছে।

দীপা আবার ভুলে যায়নি তো? ভুল তো মানুষেরই হয়। আমারও তো মনের ভুলে বইটা গেল। কিন্তু সিনেমার কথা দীপা যখন খেয়ালে বা কথার কথায় বলেনি, তখন ভুলে যায় কী করে? বড়ো কথা, নিজে থেকে ওভাবে কথাটা বলে কেউ ভুলে যেতে পারে? সদ্য সদ্য কালকের বলা কথা আজই ভুলে যাওয়ার মতো ভুলো মন দীপার না। নিশ্চয়ই কোনও বড়ো কারণে আসতে পারেনি। এসব ভেবে সান্ত্বনা পেতে ইচ্ছে করল না। ভেতরে ভেতরে কেবলই দীপার ওপর তীব্র রাগ ফুঁসে উঠছিল। কাল ইউনিভার্সিটিতে এসে দীপা নিশ্চয়ই কোনও মোক্ষম কারণ দেখাবে।

—মেয়েদের কত অসুবিধে, কত রকম ট্রাবল ফেস করতে হয় তুই তার কী বুঝবি? হেনাতেনা সাতসতেরো অনেক কথাই বলবে, বোঝাতে চাইবে। যত যাই বলুক, বোঝাতে চাক, আমি কোনও কথাই বিশ্বাস করি না মুখের ওপর বলে দেব। নিজেই সিনেমা দেখার কথা বলে, আমাকে উসকে দিয়ে না আসার জন্য দরকার হলে দীপার মুখের ওপর আরও রূঢ় কথা বলে দিতে আমার একটুও বাধবে না।

—আমি তোকে চিনি না, কোনওদিন তোর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। যার কথার দাম নেই, তার সব কিছুই মূল্যহীন। বাঃ বেশ জব্বর শিক্ষা দিলি ভাই। আরও কুকথা মুখে যা আসবে বলে দেব। অত ছাড়াছাড়ি নেই। অবশ্য দীপা এনিয়ে ন্যাকা গাওনা গাইতে এলে তবেই শোনাব। নিজে থেকে ঘটা করে এসব শোনাতে যাওয়ার কোনও ঠেকা নেই আমার। তার চেয়ে দীপা আসেনি তার জন্য আমার কষ্ট হয়েছে খুব, আমি ভীষণ রেগে গেছি, সাড়ম্বরে এসব জানান দেওয়াটাই বেশি বোকামি হবে। বরং এমন ভাব দেখাব যে, তুই আসিসনি আরে তাতে কী হয়েছে? আমি একজন অস্ট্রেলিয়ান মহিলাকে নিয়ে দিব্যি দেখেছি। তুই ভাবিস কী আমায়?

দীপার সঙ্গে চোখাচোখি হলে প্রথমটায় এমন ভাব দেখাতে হবে যেন এই প্রথম দেখছি মেয়েটিকে। তারপর ও তেমন উৎসাহ দেখালে, দেখাবে নিশ্চয়ই। তখনই সেই ভাবটা আনতে হবে, আরে এ তো আমাদের বাংলারই সেই মেয়েটা না? ব্যস তার বেশি কেরামতি দেখানোর দরকার নেই। ভেতরে ভেতরে এমনই একটা সতর্কীকরণ নিয়ে পরদিন ইউনিভার্সিটিতে ঢুকলাম।

—আমি জানতাম, দেখা হলে দীপা প্রথমেই বলবে, এই এই কারণে কাল সিনেমায় যেতে পারিনি রে। তুই নিশ্চয়ই এসেছিলিস? শুধু শুধু তোকে কষ্ট দিলাম। আমিও সেয়ানা ঘুঘুর মতো চরম নির্লিপ্ততায় ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করব, কী ব্যাপার বল তো? কীসের কষ্ট?

দীপা তখন নিশ্চয়ই বলবে, ওই যে কাল তোকে সিনেমার কথা বলে যেতে পারলাম না।

—আরে হ্যাঁ। সত্যিই তো তুই বলেছিলি! কী কাণ্ড দেখ, আমি তো ভুলেই মেরেছি। ভাগ্যিস তুই যাসনি। গেলে কী কেলেঙ্কারি হতো বলতো? মুহূর্তে ভাবলাম, এইটেই সেরা মেডিসিন। দীপাকে এই ক্যাপসুলই গিলিয়ে দেব।

—কী ব্যাপার? দীপা কি আসেনি নাকি? নাহ, পরপর তিনটে ক্লাসে দীপাকে দেখলাম না। একবার ভাবলাম, জিজ্ঞেস করি সুমিতাকে। আবার ভাবলাম, না, কানাকানি হবে। তুষার, বিমল যদি জানতে পারে, আমি দীপার বিরহে কাতর, তাহলে আর রক্ষে নেই।

সুমিতাকে আলাদা করে ডেকে দীপার কথা জিজ্ঞেস করা যায় না? কিছু জানে নাকি ও? না তা হয় না। সুমিতা বলবে, তা একথা জিজ্ঞেস করার জন্য তুই আমায় ক্যান্টিনের জমাটি আড্ডা থেকে ডেকে আনলি? আবার ফিরে গিয়ে মালা, কণাকে বলবে। মালা, কণা বলবে তুষার আর বিমলকে। ব্যস, তবে তো হয়ে গেল।

দীপার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হওয়ার পর থেকে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে থেকেও তখনই আমি একা হয়ে গেছি। তা আজ ধ্রুব সত্যির মতো বুঝে গেলাম। আরও বিলক্ষণ বুঝে গেলাম, এই ইউনিভার্সিটির জগতে সবার চাইতে দীপার চোখে আমি সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু কাল সিনেমায় এল না, আজ ক্লাসে এল না। কেবলই মনে হচ্ছে, দীপা আসেনি, আজ ছুটির দিনে আমরা সবাই না জেনে এসে পড়েছি। নিজেকে ভীষণ একা আর নিঃসঙ্গ অসহায় মনে হচ্ছে।

দীপা আমার এক কপর্দকও ধরে ফেলেছে। আমি তোর কাছে ধরা পড়ে গেছি রে দীপা, সে কথা আর নতুন করে কোনও ভাবেই বুঝতে হবে না। তুই এসে দেখে যা! সিনেমায় না আসার জন্য দীপার ওপর আমার সমস্ত রাগ, ক্ষোভ, অনুযোগ, অভিমান গলে জল হয়ে কঠিন কষ্ট হয়ে বুকের রক্তে মিশে গেছে।

কাল ইউনিভার্সিটিতে এসে দীপাকে না দেখা পর্য‌ন্ত আমি একটাও স্বাভাবিক নিঃশ্বাস নিতে পারব কিনা সে নিয়ে ভয় তো ছিলই। আবার সম্ভবপর আতঙ্কে আঁতকেও উঠেছি, কালও যদি দীপা না আসে?

আজ সাতদিন হয়ে গেল দীপা আসছে না। সাতদিন দীপাকে দেখি না। মনে হচ্ছে কত যুগ! দীপার মুখটা অচেনা হয়ে যাবে না তো? পেছন থেকে ইতিহাসের সেই মেয়েটাকে দেখে চমকে উঠেছি। দীপা না? ভুল ভেঙে গেছে। সবাই কি আর দীপা হয়? না সব দীপার জন্য আমি সাতদিন ধরে অস্থিরতায় কষ্ট পাচ্ছি? ট্রামে, বাসে, ট্রেনে রাস্তায় বিপুল জনস্রোতে কত হাজার হাজার দীপা হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিক্ষণে। সেই দীপাদের দলে ইউনিভার্সিটির বাংলার দীপা নেই। থাকতে পারে না। থাকলে সে আমার চোখকে ফাঁকি দিয়ে মিলিয়ে যাবে, অত সস্তা না।

দীপার সঙ্গে এই সাতদিনে একবার তো দেখা হতে পারত। ইউনিভার্সিটি না এলেও কি কোনও কাজে রাস্তায় বেরোয়? নিদেনপক্ষে মাথা ধরার ট্যাবলেট আনতে যাচ্ছি বলেও তো একবার বিকেলে বেরোতে পারে। রাস্তার মধ্যে আচমকা উত্তীয় বলে ডেকে ছুট্টে কাছে এসে তো বলতে পারত, এই অসুবিধে তাই ক্লাসে যাচ্ছি না রে। তুই খুব একা হয়ে গেছিস না রে? একি তুই কাঁদছিস!

একা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কেবলই আঁতকে পেছন ফিরে তাকিয়েছি। দীপা ডাকল না? দীপা ডাকে না। আজ সাতদিন দীপার ডাক শুনিনি। অনেক রাত পর্য‌ন্ত শুয়ে শুয়ে দীপাকেই ভেবেছি শুধু। ঈশ্বরকে ডেকেছি মনে মনে দীপাকে যেন ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখি।

দীপাকে স্বপ্নে দেখিনি। দীপার আসার সময় পেরিয়ে গেছে জেনেও দীপার বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থেকেছি। ফেরার পথেও দীপার বাসস্টপে এসে দাঁড়িয়েছি। দীপার বাস এলেই উঠে গেছি। গিয়ে নেমেছি হরিশ মুখার্জি রোডে। ঠিকানা জানি না। তাই গোটা হরিশ মুখার্জি রোডে চক্কর দিয়েছি, কোনও বাড়ির জানালা থেকে বা ঝুলবারান্দা থেকে দীপা আমাকে দেখে ফেলতেও তো পারে। উত্তীয় বলে ডেকে বলতেও তো পারে, তুই এখানে? এইটে আমাদের বাড়ি। ডানদিকে গেট ঠেলে ঢোক। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আয়।

ইউনিভার্সিটির গেটের কাছে ফুচকাওয়ালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছি। দীপা এর কাছে ফুচকা খায়। ক্লাসে বসে শুধু মনে হয়, এই তো আমি বসে আছি, এই বুঝি পেছন থেকে দীপা এসে আচমকা পিঠে হাত রাখল। এই বুঝি মায়াবী চোখ পাকিয়ে বলল, এখনও রাগ পড়েনি? একি! কী বোকা রে! তুই কাঁদছিস?

ক্লাসের ভেতর সুমিতা, মালা, কণা, সোনালি, তুষার, বিমল সবার সঙ্গে আমিও বসেছিলাম। সুমিতা গাইছিল, তুষার বেঞ্চে তাল ঠুকছিল। আমি আস্তে উঠে বেরিয়ে এলাম। তারপর নেহাতই পায়চারি করার ঢঙে অন্য একটা ফাঁকা ক্লাসে ঢুকে পড়লাম। বুক কাঁপতে লাগল অনর্থক ভয়ে কেউ লুকিয়ে আমায় লক্ষ্য করছে না তো? এদিক ওদিক তটস্থ চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে ব্ল্যাক বোর্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর পকেট থেকে একটা চক বার করলাম। হাত কাঁপছিল। তবুও লিখলাম, দীপা, তুই আসছিস না কেন রে? লিখেই মুছে ফেললাম।

ক্লাস থেকে বেরিয়ে এসে মুখের, গলার ঘাম মুছে ফেললাম। অস্বাভাবিক মাথা, কপালের দু’পাশের শিরায় যন্ত্রণা ঢিপঢিপ করতে লাগল। চোখে জ্বালা জ্বালা ভাব। কান্না ছাড়াও এক ধরনের জল বেরিয়ে আসছিল চোখ থেকে। কাউকে কিছু না বলে রাস্তায় নেমে এলাম। দীপার বাসস্টপ হয়ে আর হরিশ মুখার্জি রোডে যাওয়ার সাহস হল না। আচ্ছন্নের মতো এক অন্য মাদকতায় বেধড়ক মাতালের মতো টলতে টলতে সোজা বাড়ি চলে এলাম।

সকালের দিকে অরুণ ডাক্তার এসে দেখে প্রেসক্রিপশন করে গেছে। চিনিদা গাদাখানেক ট্যাবলেট, ক্যাপসুল নিয়ে এসেছে। ডান হাতের ফাঁড়া আজ কেটে গেছে। টাকুদা কাল আসবে বাঁহাতে সূচ ফোটাবে। আজ তেরো দিনের দিন জ্বর নেই। তবে দাঁড়ালে বুক কাঁপে। পা কাঁপে। জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখি মনে হয়, হাঃ! পালটে গেছে সব কিছু। বাইরের জল, হাওয়া, আলো সব পালটে গেছে। অনেক দেখা পুরোনো জিনিসও নতুন আঃ কী সুন্দর!

দীপাকে দেখলে নতুন মনে হবে। দীপা তোকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে। তোকে কতদিন দেখিনি রে। তুই সাতদিন এলি না কেন? তোকে অনেক খুঁজেছি। এখন আমার অসুখ। সেদিনই দুপুরের পরে দীপাকে স্বপ্নে দেখলাম। জ্বরের ঘোরে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। দেখলাম দীপার সারা শরীর সবুজ। সারা গায়ে নক্ষত্র ফুটে আছে। সবুজ নক্ষত্র। আকাশ থেকে মেঘ সরিয়ে দীপা নেমে আসছে। বৃষ্টিতে ভিজলে যেমন শরীর থেকে টপটপ করে জল ঝরে পড়ে, তেমনই দীপার শরীর থেকে নক্ষত্র ঝরে পড়ছে।

—আমি চেঁচিয়ে বললাম, দীপা আমি এখানে, এই এখানে। আমাকে দেখতে পাচ্ছিস?

দীপা নেমে এসে আমার কপালে, গলার কাছে হাত রাখল। বলল, তোকেই তো দেখতে এলাম। কেমন আছিস?

—ভালো, এখন ভালো আছি। তুই এতদিন কোথায় ছিলি? রোজ আসবি তো?

—আসব, রোজ আসব।

ঘুম ভেঙে যেতে দেখি, সত্যি সত্যিই দীপা এসেছে। তবে ওর শরীর সবুজ না। যেমন ছিল তেমনই। সঙ্গে সুমিতাও এসেছে। আমার বিছানার কাছে ওরা বসে আছে। আমি চোখ খুলতেই দীপা বলল, কী? কেমন সারপ্রাইজ দিলাম? দেখলি তো চলে এলাম সোজা। স্টেশনে নেমে জিজ্ঞেস করতেই বাড়ি পেয়ে গেলাম। কলেজের কাছে বাড়ি, তা তো জানতামই। তোর মুখে শুনেছি অনেকবার।

সুমিতা বলল, আমরা তো অবাক দু’সপ্তাহ তোর কোনও পাত্তা নেই। তাই আজ যাই কাল যাই করে চলেই এলাম।

দীপা সোজা আমার বাড়ি চলে আসতে পারে! বিস্ময়ে মুখে কথা ফুটল না সহসা আমার। দীপা কাছে এসে আমার রোগা বুকে হাত রাখল। তারপর কপালে। অল্প ঘাম হচ্ছিল তখন। দীপা বলল, এই তো ঘাম দিচ্ছে। জ্বর নেই আর। আমি অসহায় হাসলাম শুধু।

মা এ ঘরে ওদের জন্য চা, লুচি তরকারি জলখাবার এনে দিল। চা খেতে খেতে দীপা বলল, ঠিক দু’সপ্তাহ পর তেইশ তারিখ আমরা বিকেসির নেতৃত্বে আমাদের বাংলার দশজন শান্তিনিকেতনে যাচ্ছি। তুইও যাচ্ছিস আমাদের সঙ্গে। ততদিনে আমি শরীরে ভালোমতো জুত পেয়ে গেলাম।

 

তিন

বিকেল বিকেল পৌঁছোলাম শান্তিনিকেতনে। স্টেশনে নেমে রিকশা নিলাম। বেশ শীত পড়ে গেছে। আমি আর বিমল উঠলাম একটা রিকশায়। তুষারটা ঠিক ঝোপ বুঝে নিয়ে কণার পাশে গিয়ে উঠে বসেছে। দু’জন অধ্যাপক এক রিকশায়। সোনালি, মালা, মিত্রা, অসীম, চঞ্চল ওরাও সুবিধে মতো ভাগাভাগি করে চেপেছে। দীপা আর সুমিতা একটা রিকশায়।

কয়েক মিনিটের পথ স্টেশন থেকে টুরিস্ট লজ। এটুকু পথেই রিকশাওয়ালারা নিজেদের মধ্যে রেস শুরু করে দিল। দীপার রিকশা আমাদের আগে আগে যাচ্ছিল। আমি দু’চার হিড়িক দিতেই আমাদের কম বয়সি সারথি ছাড়িয়ে গেল দীপাদের রথ। ঢালাও পিচের রাস্তা মোড় নিল। খানিকটা রাঙামাটির মোরাম বিছানো রাস্তা পেরিয়ে এসে উঠলাম লজে।

জানলা খুলতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। বহু দূর পর্য‌ন্ত মাঠ, ধানখেত। ধান কাটা হয়ে গেছে। ধানের গোড়া পড়ে আছে। নানান গাছগাছালি, খেজুর গাছের মাথায় সন্ধের অন্ধকার ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো এসে লটকে যাচ্ছে। শীতের ফিনফিনে হাওয়া আসছিল দেখে জানালা বন্ধ করে দিলাম। মেয়েটা এসে তাড়া লাগাল। চলো চলো বেরিয়ে পড়ি, বেড়িয়ে আসি। ওরা একেবারে সেজেগুজে রেডি।

একটা সবজে অদ্ভুত সুন্দর শাড়ি পরেছে দীপা। বলল, কী রে উত্তীয়, তুই বেরুবি না? গড়িমসি করছিস যে! তুষার, বিমল ওরাও ঝটপট তৈরি হয়ে নিল। ওরাও তাড়া লাগাল, চ’ চ’ নে ওঠ। শেষে ফিরতে রাত হয়ে যাবে।

অগত্যা বেরতেই হল। দু’জন স্যার ঘরে বসে জমিয়ে নিয়েছেন। বললেন, বেশি দেরি কোরো না তোমরা।

লাল কাঁকুড়ে মাটির পথ। দুপাশে বিস্তৃত মাঠ। মাঠের বুক চিরেও রাস্তা গেছে। চাঁদের আবছা আলোয় বেশ ভালোই ঠাহর হচ্ছে। মনে মনে বললাম, এই তো সেই রবিঠাকুরের গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ। বাড়ি-ঘরগুলো বেশ ছিমছাম সাজানো। সব বাড়ির সামনেই এক চিলতে ফুলের বাগান। আলাদা রুচির ছাপ। আমরা সবাই হাত ধরাধরি করে হাঁটতে লাগলাম।

দীপার বাঁ হাত ধরেছে সুমিতা। ডান হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, উত্তীয়, ধরবি তো ধর। নইলে কাউকেই দেব না ধরতে। মুহুর্তে বিদ্যুতের বেগে দীপার হাতটা ধরে ফেললাম।

দীপার নরম পেলব হাতটা স্পর্শে মনে হল, দীপা আমায় কোনও কষ্টই দেয়নি। যেটুকু কষ্ট বলে মনে হয়েছে, সেটুকু এই সুখ, আনন্দের অঙ্কুর ছিল। আমি তখনও জানতাম না, দীপার প্রেমিক আছে। জানলাম তখন, যখন তুষার পাশ থেকে টিপ্পনী কাটল। বলল, একবারে হাত ধরে গদগদ ! আর কত ঝোলাবি ব্যাটাকে?

শুনে দীপা রেগে গেল। বলল, আর যাই বল, উত্তীয়কে নিয়ে এসব আমি সহ্য করব না। সে রকম মন নিয়ে ওর সঙ্গে আমি মিশি না। ও শুধুই আমার বন্ধু। তার চেয়ে বড়ো কথা অনেক আগে থেকেই আমি প্রেম করি। আমার প্রেমিক আছে।

কথাটা শোনা মাত্র আমার বুকের রক্ত ছলাৎ করে পিছলে গেল বীভৎস যন্ত্রণায়। কাউকে বুঝতে দিলাম না। দীপার হাত থেকে আমার হাত তখনই আলগা ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। দু’হাতে নিজের বুক চেপে ধরলাম। ভেতরে অসহ্য যন্ত্রণা। কাছেপিঠে বুবুনদি নেই। বুবুনদি এখান থেকে বহু দূরে আছে এখন। তবু চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল, বুবুনদি তোমাকে এখন একটা দারুণ সারপ্রাইজ দিতে পারি। আমি যে-মেয়েটিকে ভালোবেসেছি, তার একজন প্রেমিক আছে।

চার

ঘন্টা হিসেবে নৌকা চুক্তি করল দীপা। বেলা পড়ে এসেছে। নিরুত্তাপ রোদের জন্য বেশ ভালো লাগছিল। দূরে কোনও খেয়াঘাটের লঞ্চের ভোঁ শব্দটা যেন জল সাঁতরে এদিকে ভেসে আসছিল। হাওয়া এসে জলের বুক ছুঁয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। নৌকা ছেড়ে যেতেই সিগারেট জ্বালালাম একটা। আজকের নায়ক আমি। আমি  উত্তীয় সেন। স্বপ্নের ঘোরের মতো তাবত দৃশ্যপট ছেয়ে থাকল। আমার চোখের সামনে সিগারেটের ধোঁয়া মুখ ছাড়া হয়ে বাতাসে মিশেই যেন নাচের মুদ্রায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।

পরদিন ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে দীপার সঙ্গে বাসস্টপে যেতে যেতে দীপা বলল, কাল একবার আসবি তুই?

—কেন? কাল তো রোববার!

—বলছি তো সেজন্যই।

—মানে? মানে কাল প্রশান্ত আসবে।

—অ! তোর ইয়ে কিন্তু তাতে আমি কেন?

—তোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব, ভালো হবে।

—তাই? তা আসছে কোথায়?

—আউট্রামে তিনটের মধ্যে আসবে। তুই দুটোর সময় কফি হাউসের সামনে থাকবি। আমি ওখানেই তোকে খুঁজব, তারপর যাব ’খন।

—তা তোর প্রশান্ত আসছে, তাতে আমার কী? আমি কীসের আনন্দে ছুটির দিন দুপুরবেলা ছুটে আসব? ওর সঙ্গে পরিচয় না করলেই বা আমার কী আসবে যাবে?

—না না এসব বলিনি দীপাকে। এসব কথা আমার মনের মধ্যে একমুহূর্ত চড়ুইয়ে ঝাঁকের মতো কিচিরমিচির করে উঠেছিল। দীপার ওপর এখন অনীহা ভাব দেখালে ধরা পড়ে যাব আরও বেশি করে।

দীপা উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল। তখনই নৌকা দু’পাশে বেশ জোরে দুলে উঠল। বেসামাল হচ্ছিল দীপা। একপাশে কাত হতেই হাত বাড়িয়ে ধরে ফেললাম ওকে।

হ্যাঁ! দীপা এখন আমার বুকে পরম নির্ভরতায় মুখ রেখে, চোখ বুজে বড়ো বড়ো করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। গলায় একটা অদ্ভুত আদুরে সুর এনে দীপা বলল, আমার চোখ খুলতে ভয় করছে। যদি জলে পড়ে যেতাম?

—বাঃ রে! আমি আছি, মাঝিরাও আছে। দীপাকে এমনভাবে ব্যাপারটা বোঝাতে চাইলাম, যেন তুই জলে পড়ে গেলে জলের তলা থেকেও তোকে তুলে আনতে পারি আমি। আসলে আমি যে সাঁতারই জানি না, সেকথা দীপার সঙ্গে এই শঙ্খবেলার মুহূর্তে মনে না আসাই ভালো।

সূর্যটা অস্ত যাবে এক্ষুনি। পশ্চিম আকাশটা যেন রক্ত রঙের আবির মেখে হাসছে।

—দীপা বলল, কী চার্মিং তাই না রে।

—তার চেয়ে আর বেশি কোথায়?

এর বেশি বললে বাড়াবাড়ি হবে। দীপা বন্ধু ভাবে আমায়। সে জন্যই তো প্রশান্তর সঙ্গে পরিচয় করাতে চায়। কিন্তু আশ্চর্য প্রশান্ত এল না। জানি তো এখন আর প্রশান্ত আসছেই না। তাই নির্ভয়ে আরও একবার দীপাকে প্রশান্তর কথা জিজ্ঞেস করাই যায়। যার অনারে আসা, মাঝেমধ্যে তার জন্য একটু আধটু আফশোশ না দেখালে দীপা যদি আমাকে নির্লজ্জ ভাবে? যদি ধরতে পেরে যায় আমার ভেতরটা?

—কী রে তোর প্রশান্ত যে শেষ পর্য‌ন্ত এলই না। ঠিক মতো বলছিলি তো? লুকিয়ে কখন চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। জ্যোৎস্না তখনও পরিষ্কার হয়নি।

দীপা আমার কানের কাছে সেই একই রকম ভাবে ঝুঁকে এল। তারপর সেই একইরকম ভাবে পরম গোপনীয়তায় ওষ্ঠ ও অধর ডুবিয়ে দিয়ে বলল, তুই এত বোকা কেন? আমার প্রশান্ত বলে কেউ নেই রে। আমি তো তোকেই…। তারপর আর কোনও কথা বেরোলো না দীপার মুখ থেকে। ওর উষ্ণ নিঃশ্বাসের ঝড়ে সাঁই সাঁই সুখের বিদ্যুৎ খেলে গেল আমার তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে।

দীপা এবার আমার মুখোমুখি বসল। বলল, তোকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছিলাম। আসলে তুই যে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসিস, আমি অনেক আগেই তা বুঝতে পেরেছি। তাই পরীক্ষা করে দেখলাম, প্রশান্তর কথা বললেও তুই আসিস কিনা। আমি জানতামই যে তুই না করবি না। আর না এসে থাকতেও পারবি না।

—তার মানে? দীপা আমার সব কিছু ধরে ফেলেছে? এত সহজেই আমার ভেতরটা ও আঁচ করতে পেরেছে? আমার চালাকি সব ধরে ফেলেছে নাকি? নইলে আমার ওপর এমন অন্ধ ধারণা হয় কী করে?

মুহূর্তে ভেবে নিলাম, আমি তোর সব ধারণা পালটে দেব রে দীপা। আমি তোকে সত্যিই পাগলের মতো ভালোবেসেছি। তোর জন্য আমার কষ্ট হয়েছে। তবু সে সব এখন আমি উপেক্ষাও করতে পারি। হ্যাঁ এই মুহূর্তে আমার অন্তরাত্মা আমাকে সেই শলাই দিচ্ছে।

—আমি সহসা বলেই ফেললাম, তোর ধারণাটা পুরোপুরি ভুল রে দীপা। তুই শুধুই বন্ধু আমার। আসলে আমার একজন প্রেমিকা আছে। তোকে বলিনি কোনওদিন…

রাই এসে আমার চুল ঘেঁটে দিয়ে বলল, বাবা, তুমি এখনও এখানে বসে আছো? অফিস গেলে না?

রাইয়ের সাড়া পেয়ে আমি মাথা তুলতে পারছিলাম না। তিরিশ বছর আগের সেই দীপা আমাকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিচ্ছিল না।

শেষ মানেই প্রশ্ন

রজতের মনটা বেশ খুশি খুশি। কয়েকদিন আগে থেকেই প্রায় সব কিছু গোছানো হয়ে গেছে, এবার যা আছে শুধুই টুকটাক। তবে হাসপাতালের কাজগুলোই বাকি। অফিসে বসে বসেই ল্যাপটপে নিজের মেলটা একবার চেক করে নার্সিংহোমের সাইটে গিয়ে সব কিছু দেখে নিল। যাক নামটা না লিখলেও বাকি সব কিছু লিখে দিয়েছে।

একবার ওদের ম্যানেজারকে ফোন করতে হবে, শুক্রবার আর শনির বিকালটা এখানে বসবে না। বাড়ির আর একটু কাছে আরেকটা নার্সিংহোমেও কথা হয়েছে, সকালে ওখানে বসবে, সেই সঙ্গে ওই দু’দিনের বিকালটাও। সকালেই অদিতির সাথে কথা হয়েছে। কথায় কথায় বলেছে, তাহলে ডাক্তারবাবু গ্রামের মায়া শেষ? একটু থতমত খেলেও উত্তর দেবার চেষ্টা করেছে, তা কেন হবে? কাজ করলাম তো, এবার তো একটু নিজের কথা ভাবতে হবে। তাছাড়া মা আছে, তুমিও আছো।

—আমি! হাসালে।

—কেন?

—বাদ দাও, কলেজ আছে।

আর কথা না বাড়িয়ে রজত মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে নেয়, সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। কিছু সময় পর একবার মাকে ফোন করবার জন্য মোবাইলটা বের করতে যাবে এমন সময়, সেন্টারের একজন এএনএম সিস্টার মহুয়া ম্যাডাম রুমের দরজাটা খুলে জিজ্ঞেস করলেন, স্যার আসব?

রজত ঘাড় তুলে বলে, ও হ্যাঁ আসুন, কী ব্যাপার?

—একটা পেশেন্ট এসেছে, ইনজুরি আছে।

মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতেই রজত বলে, মেল না ফিমেল?

—আদিবাসীদের মেয়ে

একটু চমকে উঠল রজত। নামে হেল্থ সেন্টার হলেও এটা আসলে একটা গ্রামের ছোটো হাসপাতাল, তবে গ্রামের কয়েকজন প্রভাবশালী মানুষের জন্য প্রতিদিন চব্বিশ ঘন্টাই ডাক্তার থাকেন। এখন যেমন রজত আছে। তবে সেভাবে তো আদিবাসীরা এই সেন্টারে ডাক্তার দেখাতে খুব একটা আসে না। জিজ্ঞেস করল, লোকাল?

—সম্ভবত না, বাইরের।

কিছুটা পরিষ্কার হল। এই গ্রামে বাইরের রাজ্য থেকে অনেক আদিবাসী চাষবাসের কাজ করতে আসে। তাদেরই কেউ এসেছে হয়তো। জিজ্ঞেস করল, ছোটো না বড়ো? গৌতম নেই? কিছু ফুটলে বা কাটলে স্টিচ করে দিতে বলো।

গৌতম এই হেল্থ সেন্টারের গ্রুপ ডি কর্মী হলেও কিছু কিছু কাজ দারুণ শিখে নিয়েছে, যা স্টিচ করছে বড়ো কম্পাউন্ডারকেও হার মানাবে। কয়েকদিন আগেই এক মন্ত্রী সপরিবারে পাশের রাস্তা দিয়ে যাবার সময় কোনও কারণে মন্ত্রীর স্ত্রী একটু অসুস্থ হয়ে সন্ধেবেলা এই হাসপাতালে আসতে বাধ্য হন। গৌতম যেভাবে তাকে তাড়াতাড়ি সুস্থ করে দেয়, তা একরকম অবিশ্বাস্য। গৌতমের খুব নামও হয়, সেদিন আবার রজত কোনও একটা মিটিং-এ কলকাতায় ছিল।

স্বভাবতই গৌতম নেই শুনে মেজাজটা একটু বিগড়ে গেল রজতের। একটু ঝাঁঝিয়ে বলে উঠল, তাহলে নতুন ডাক্তারবাবুকে বলুন৷ আমার তো আজকের দিনটাই….।

—স্যার উনি তো স্কুল হেল্থের ডিউটিতে গেছেন।

—ও তাই তো, এখনও ফেরেননি?

—না, স্কুলটাতে অনেক স্টুডেন্ট। আমি ওই গ্রামের সেকেন্ড এএনএমকে ফোন করেছিলাম, হাইস্কুল- এমনিতেই দু’দিন লাগবে। তার মধ্যে উঁচু ক্লাসের কিছু স্টুডেন্টের কাউন্সেলিং আছে।

—তাহলে আপনিই ড্রেসিং করে ছেড়ে দিন।

শেষের কথাগুলো শুনেই এএনএম ম্যাডাম একটু বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন, স্যার, সেটা পারলে তো কোনও সমস্যাই ছিল না, মেয়েটির ভ্যাজাইনাল পেনিট্রেশন হয়েছে।

শেষের কথাগুলো শুনেই রজত একটু চমকে ওঠেন, পেনিট্রেশন! আপনি ভুল বলছেন না তো?

মহুয়া ম্যাডাম একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলে উঠলেন, স্যার জেনিটাল পার্টে ভালো রকমের ইনজুরি, তলপেটে রক্তের সাথে আরও কিছু থাকতে পারে।

—থাকলেও কিছু করবার নেই। আমার হাতে তো কিছু নেই। বিএমওএইচ, সেখান থেকে সিএমওএইচের কানে খবর যাবার আগেও অন্য খবর হয়ে যাবে। মেয়েটার সেন্স আছে?

—সেন্স আছে, তবে খুব টেনস্ড, কেমন যেন গুটিয়ে আছে।

—সেটাই স্বাভাবিক, বয়স কত?

—এগারো বারো।

একটা লম্বা শ্বাস ফেলে রজতবাবু এবার উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, চলুন।

রজত এই গ্রামে বছর দুই পোস্টিং পেয়েছে। বাইরের রাজ্য থেকে মাস্টার ডিগ্রি করে আসার পর বাবার কথামতো এই সরকারি চাকরি নিয়ে কিছু অভিজ্ঞতা তো হয়েছেই কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। আশেপাশের বেশ কয়েকটা গ্রাম থেকে পেশেন্ট আসে, ভিড় হয়। কয়েকটা পলিটিক্যাল ঝামেলা হয়েছে। মাথা ফাটা, হাত ভাঙা এসব বেশ কমন ব্যাপার। কিন্তু এই রকম ঘটনা তো এখানে কোনও দিন শোনেনি।

রজত আর সময় নষ্ট না করে ছোটো অপারেশন থিয়েটারের দিকে পা বাড়ায়। অবশ্য কয়েকটা ল্যানসেট, মসকিউটো ফরসেপ আর কয়েকটা নিডল হোল্ডার থাকলেই যদি কোনও ঘরকে অপারেশন থিয়েটার বলা যায়!

 

( )

জানলার ওপাশেই আস্তে আস্তে বিকেল নামছে। নিজের অফিসের চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে একটু দূরে মাঠগুলোতে চোখ আটকে গেল। এবছর ভালো জল দিয়েছে। কয়েকদিন আগেই গ্রামের একটা লোককে ডেকে পাঠাতে হয়েছিল। ব্যাটা কিছুতেই তার মেয়েটাকে বড়ো হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল না। কিশোরী মেয়ে কয়েক মাস ধরে সাইকেল বন্ধ। রজত সিস্টের সন্দেহ করছিল। কিন্তু ডেকে ধমকাতেই লোকটি কীরকম অদ্ভুত ভাবে বলে উঠল, সবই তো বুঝলাম ডাক্তারবাবু কিন্তু লিয়ে ট কে যাবেক, উয়ার মা তো যেতি পারবেক নাই। আমি ইখন তো যাব নাই, বোরোর জল দিছে, রোয়া টো হয়ি যাক। না হলে তো লেবারগুলো পালাবেক।

—কিন্তু তার আগে তোমার মেয়ের সমস্যা তো আরও বাড়বে, এটা নিয়ে টানা চার মাস হল।

—ডাক্তারবাবু আপনি কী বুঝবেন? কেউ যদি জেনে যায় বিটিটর মেয়েলি কোনও রোগ আছে, বিয়ে হবেক নাই। আপনিই দেখে ওষুধ দেন।

তখনই ধমকায় রজত। কয়েকদিনের মধ্যে যদি বড়ো হাসপাতালে না নিয়ে যাও তবে আমি নিজেই গ্রামের সবাইকে বলে দেব।

এই লেবারগুলোই খুব সমস্যার। বাইরের রাজ্য থেকে এসে এখানে চাষের কাজ করে। সকাল সকাল ওরা মাঠে কাজে নেমে পড়ে। সবাই নাকি ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসে। শাড়ির উপর একটা জামা পরে মাঠে নেমে ধান পোঁতে, কাটে, ঝাড়ে, মাথায় করে নিয়ে যায়। কাজ করতে করতেই কোনও এক পাশে বসে নিজেদের দুধের ছেলে-মেয়েকে দুধ খাওয়ায়।

এদের পুরুষগুলোকে মদ খেয়ে বিভিন্ন জায়গায় শুয়ে থাকতেও দেখা যায়। তবে হেল্থ সেন্টারের সিস্টার দিদিমণিদের ওরা এলেই একটু রাগ হয়। রজতকে সোজাসুজি কিছু না বললেও নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে, ওই এল, এবার কথায় কথায় ওষুধ দাও, না হলে প্যাড দাও। এদের আবার একটা দিলে মন ভরে না।

—কিন্তু এইরকম সমস্যা তো কোনও দিন হয়নি। নাকি বলেনি?

অদিতি অবশ্য সব কিছু শুনে বেশ গম্ভীর ভাবে বলে, ব্যাপারটা কিন্তু খুব গোলমেলে। আমি কয়েকদিন আগে একটা খবর পড়ছিলাম, একটা পুরো হাসপাতাল নাকি এইরকম একটা ঘটনার জন্য ভেঙে তছনছ করে দেয়। ওদের কারওর নাম বেরিয়ে গেছিল। তুমি কিন্তু সাবধানে থাকবে।

সেই সময় অতটা পাত্তা না দিলেও পরে মাথায় কথাগুলো নাড়াচাড়া করবার সময় একটু অন্যরকম লাগল। তবে বিএমওএইচ স্যার সব শুনে খুব একটা পাত্তা না দিয়ে বলেন, শুনুন, একটা অফ দ্যা রেকর্ড কথা বলি– এ দেশে এই ধরনের ঘটনা যত হয় সব যদি ব্যবস্থা করতে হয়, তবে আমাদের অন্য কোনও কাজ আর করতে হবে না। তার থেকে ট্রিটমেন্ট করে ছেড়ে দিন।

কথাগুলো রজতের ভালো লাগেনি। একটু জোর দিয়ে বলেও ছিল, এটা কী করে হবে স্যার? ফুল পেনিট্রেশন, মনে হচ্ছে সিমেন লেগে আছে, বিভিন্ন জায়গায় ইনজুরি আছে, এটা তো ঠিক কথা নয়।

বিএমওএইচ স্যার সব কিছু শুনে বলেন, আপনি এক কাজ করুন মেডিকেল কলেজে রেফার করে দিন, ওরা প্রয়োজন পড়লে ফরেনসিকও করতে পারবে।

কথাগুলো ঠিকই বলেছেন কিন্তু তার জন্য তো একটু থানাতেও খবর দিতে হবে। বিরক্তিকর অবস্থা, শেষ দিন, আর যত উটকো ঝামেলা। থানাতে ফোন করবার আগেই একবার গৌতমের সাথে কথা বলা দরকার। কিন্তু গৌতমকে ফোন করতেই ওদিক থেকে শুনল, হ্যাঁ দাদা আপনাকেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম। আমাকে আজ রাতে একটু বাড়ি যেতে হবে, ফোন এসেছিল। বাবার শরীরটা ভালো নেই, আমি আমার এক বন্ধুকে ফোন করেছি, তাও একটু যেতে হবে। আপনি কোনও চিন্তা করবেন না, আমি কাল সকালের মধ্যে ফিরে আসব।

রজত আর কোনও কথা বলতে পারে না। গৌতমের বাড়িটা কাছেই এটা ওর কাছে একটা সুবিধা। কিন্তু অফিসিয়ালি তো এই সেন্টারের…।

এবার মাথা ব্যথা করছে। আর কোনও উপায় নেই, আবার সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। থানাতে ফোন করে একটা ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু অফিসার ফোন ধরেই বলে উঠলেন, শুনুন ডাক্তারবাবু, দুটো গাড়ি, একটা ডেপুটেশনে গেছে আরেকটা পেট্রোলিং-এ। তবে ওটাও…। ঠিক আছে, বুঝতেই তো পারছেন অনেকটা দূর, তাও দেখছি।

পুলিশ দেখবার আগেই অবশ্য পঞ্চায়েত অফিস থেকে প্রধান সাহেব ফোন করলেন, ডাক্তারবাবু, পুলিশ-ফুলিশ কেন টানছেন, কী এমন হয়েছে, ওসব ছোটোখাটো ব্যাপারে পুলিশ এলে গ্রামের বদনাম হবে। আপনারা শহরের লোক কী বুঝবেন!

—কিন্তু ওটা তো ছোটোখাটো ব্যাপার নয়, গ্রামের কাজ করতে আসা একটা আদিবাসী মেয়েকে আপনাদের গ্রামের কেউ বা কয়েকজন মিলে রেপ করেছে। মেয়েটার সারা শরীরে কাটার দাগ, সিমেনের চিহ্ণ, সেটা কীভাবে ছোটো ঘটনা হবে?

মুচকি হাসলেন প্রধান সাহেব। ডাক্তারবাবু, ওরা আসে ঠিকই কিন্তু শুধুমাত্র আমাদের গ্রামেই তো ওরা কাজ করে না, আশেপাশে চল্লিশটা গ্রামে ওরা কাজ করে। আপনি কি গ্রামের সব ছেলেদের বীর্য পরীক্ষা করে বেড়াবেন?

—তা কেন ওই মেয়েটি তো লোকটিকে চেনে, দেখেওছে।

—ধরুন মেয়েটি দেখেনি, ধরুন চেনে না, ধরুন মেয়েটি চোখে কম দেখে, অথবা মেয়েটি বলবে না। আপনি কীভাবে সব কিছু ম্যানেজ করবেন? তাছাড়া ডাক্তারবাবু আরেকটা কথা বলি, আপনি মাত্র এই কয়েক বছর আছেন, কেউ কিছু ঝামেলা ঝঞ্ঝাট করে না। কিন্তু আজ করবে না বলেই যে, কাল করবে না এটা তো কেউ বলতে পারে না। করতেই পারে, ধরুন কোনও একটা ওষুধ খুঁজতে এল আপনার সেন্টার দিতে পারল না। গ্রামের লোক একটু বোঝে কম, ভেঙে দিল সব। কীই বা করতে পারবেন বলুন। তারপর দেখুন পেশেন্ট আসে, তাদের মধ্যে কেউ যদি বড়ো কোনও জায়গায় অথবা ধরুন আমার কাছেই এসে বলে, ডাক্তারবাবু এক্কেবারে ভালো নয়, শরীরে খুব বেশি হাত দেয়। তখন তো সেই পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে আমাকে আপনার সেন্টারে যেতে হবে।

তখন কথাগুলো শুনে সাময়িক একটু ভয় লাগলেও অদিতিকে ফোন করে কথাগুলো বলবার পর, তার কথা শুনে একটু ভরসা পায় রজত, জোর পায়।

গ্রামের কয়েকজনকে ফোন করে গাড়ির ব্যবস্থা করতে বলে। প্রথমে সবাই শুনে গাড়ি দিতে রাজি হলেও, পরে একে একে সবাই জবাব দিতে আরম্ভ করে। রজত সেন্টারের সিস্টারদের সাথে কথা বলে সবাইকে বোঝানোর কথা বলে। ফোনে সবাই সব কিছু শুনে হ্যাঁ হ্যাঁ বললেও কিছুক্ষণ পরেই কেউ আবার ফোন করে কোনও একটা বাহানা করে, কেউ আবার আর কোনও জবাবই দেয় না। রজতের খারাপ লাগে, ভয় লাগে। মেয়েটার কিছু হয়ে যাবে না তো?

বিকাল গড়িয়ে সন্ধের মুখে সিস্টার মহুয়াদি এসে বলেন, স্যার মেয়েটা একটু ঠিক হলেও কেমন একটা আওয়াজ করছে, উঠতে পারছে না। কিন্তু মা বাবার সাথে দেখা করবার কথা বলছে।

এবার রজত একটু শান্তি পায়। কিন্তু কে বা কারা মেয়েটার ওরকম অবস্থা করল সেটা তো জানতে হবে। যেমন করে হোক বড়ো হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু নিয়ে যাবে কীভাবে? একটু পরেই সন্ধে নামবে, পঁচিশ-ত্রিশ কিলোমিটার রাস্তা, কীভাবে যাবে?

রজত কিছুক্ষণ বসেই একজন সিস্টারকে ডেকে বলল, ম্যাডাম, আপনার বাড়িতে একবার ফোন করে জানিয়ে দিন, অবশ্য আপনার যদি কোনও আপত্তি না থাকে তো।

—ঠিক বুঝলাম না।

একটা লম্বা শ্বাস ছাড়ে রজত। যদি আপত্তি না থাকে আমি মেয়েটিকে আমার বাইকে বড়ো হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। ওকে মাঝে বসাব, আপনি পিছনে বসবেন।

—কিন্তু স্যার মেয়েটি তো বাড়ি যাবার জন্যে বায়না করছে, ওর বাবা-মাও এসেছে। ওরা আবার বলছে কালকেই ওদের দেশে ফিরে যাবে, আমরা যেন মেয়েটাকে ছেড়ে দিই।

—ছেড়ে দিই!

—হ্যাঁ স্যার, খুব কান্নাকাটি করছে। আপনার সাথেও দেখা করবার জন্যে খুব জোর করছে। আমি কোনওরকমে ঠেকিয়ে রেখেছি।

—সবই বুঝলাম। কিন্তু একে যদি না নিয়ে যাই, আমার পরে যারা আসবে তাদের সমস্যা হবে আরও বেশি।

কথাগুলো বলে রজত আবার কিছু সময় চুপ করে থেকে বলে, ভ্যালিয়াম জাতীয় কিছু ইঞ্জেকশন আছে? পুশ করে দিন। তারপর পিছনের দরজা দিয়ে…।

 

( )

এবার শান্তি হল রজতের। মেয়েটিকে ভর্তি করা গেল, ট্রিটমেন্ট আরম্ভ হল। হাসপাতালের বাইরের একটা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে রজত সিস্টারকে বলে উঠল, ম্যাডাম দু’জনে যেতে ভয় করবে না তো?

—কীসের ভয়?

—এই এতটা রাস্তা বাইকে আমার সাথে যেতে হবে তো।

সিস্টার কোনও জবাব না দিয়ে হেসে ওঠেন। রজত তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, মহুয়া ম্যাডাম, কাল ফার্স্ট হাফে কিছু ওষুধ ড্যামেজ দেখাবেন, তার মধ্যে কয়েকটা ভ্যালিয়াম ইঞ্জেকশনও দেবেন। আর ডিসপোসাল সিরিঞ্জটা একটু ধুয়ে নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলবেন।

চারদিকে তখন অন্ধকার, মহুয়া ম্যাডাম রজত স্যারের কথাগুলো শুনে তার মুখের দিকে তাকান।

রজতের মুখ তখন সিগারেটের ধোঁয়ায় অস্পষ্ট।

দু’টি ভিন্নস্বাদের গল্প

ব্যাবসা-বৃত্ত

ইন্টারভিউ দিতে দিতে ক্লান্ত হতাশ সমীর। কী-ই বা করবে, ওকে তো মালিকপক্ষ জানিয়ে দিয়েছে যে, সামনের মাসেই ইস্তফা দিতে হবে।

বাজোরিয়া ড্রাগস-এ সেল্সম্যান-এর চাকরিটা ওর অনেকদিনের। তবে এই কোম্পানিতে ওর খুব সুনাম, বিশ্বস্ত কর্মচারী হিসাবে। মার্কেট থেকে অর্ডার তোলার ব্যাপারে সমীর এক নম্বর। ওর কাজে খুশি হয়ে ওকে অতিরিক্ত দায়িত্ত্ব দিয়েছিল মার্কেট থেকে বকেয়া টাকা কালেকশানের। ও অনেক অনেক টাকা মার্কেট থেকে কালেক্ট করে আনত সময় মতো মালিকপক্ষের হয়ে, তার জন্য ইনসেনটিভও পেত। সব মিলিয়ে ভালোই রোজগার হতো।

অলক মুখার্জি, মুখার্জি এন্টারপ্রাইজের মালিক। ওষুধেরই ব্যাবসা। এই মার্কেটেই অফিস। সমীরের একদম ছোটোবেলার বন্ধু। দুই পরিবারের মধ্যে যথেষ্টই ভালোবাসা, আসা-যাওয়া। অলকেরও প্রথমে ছোটো ব্যাবসা ছিল, এখন ব্যাবসা বৃদ্ধি ঘটেছে।

সমীরের চিন্তা বাড়ছে চাকরি নিয়ে ইদানীং সে লক্ষ্য করছিল মিঃ বাজোরিয়া ওর হাতে আর টাকা পয়সা ছাড়ছে না। ক্রমেই ও মনমরা হয়ে যাচ্ছিল। ওর স্ত্রী একদিন বলল, তুমি অলকদাকে বলে দেখতে পারো তো একবার।

ব্যস চাকরিও হয়ে গেল বলা মাত্র। শুধু অলক বলল, দ্যাখ তোকে অত টাকা এখুনি দিতে পারব না। তোকে একটা বুদ্ধি দিতে পারি বাড়তি উপার্জনের। তুই চাকরি ছাড়ার সময় যে-প্রভিডেন্ট ফান্ড আর গ্র্যাচুইটির টাকা পাবি, সেটা একসাথে করে আমার কোম্পানিতে ইনভেস্ট করতে পারিস- তোকে আমি ব্যাংকের থেকে অনেকটাই বেশি সুদ দেব মাসে মাসে। তাতে তোর মাস গেলে আয় বাড়বে আবার আসল টাকাটাও খরচা হবে না, সুরক্ষিত থাকবে।

মুখার্জি এন্টারপ্রাইজের অর্ডার বাড়তে লাগল মার্কেটে আর বাজোরিয়ার কমতে থাকল।

একদিন পুরোনো অফিসের দুলালবাবুর সঙ্গে দেখা। দুলালবাবু ফস করে বলে বসলেন- এখন তো আমি রিটায়ার্ড, তাই নির্ভয়ে বলতে পারি, যত নষ্টের মূল আপনার ওই বন্ধুটি, অলক মুখার্জি। একদিন এসে বাজোরিয়ার কাছে ঢেলে নিন্দে করে গেছে আপনার। বলল, আপনি নাকি খুব ড্রিংক করেন, আপনার হাতে টাকাপয়সা না ছাড়তে।

ব্যস! সমীর অঙ্কটা চট করে ধরে ফেলল। ওর মার্কেট পপুলারিটি আর সেল্সম্যানশিপ স্কিল কাজে লাগিয়ে অলকের নিজের ব্যাবসা বৃদ্ধি, তাই বাজোরিয়া ইন্ডাসট্রিজ থেকে সমীরকে ভাঙিয়ে নেওয়ার সুযোগটা ও চট করে লুফে নেয়৷ ও যাতে চাকরি ছাড়তে না পারে, তাই নিজের কোম্পানিতেই বাড়তি উপার্জনের নামে ওর টাকাটাই কায়দা করে আটকে রাখে।

সমীর ড্রিংক করে না, তবে ওর আজ মনে হল, যদি ড্রিংক করে বন্ধুর এই প্রতারণা ভুলতে পারত!

  গল্প  :   দেবারতি ভট্টাচার্য

 

অন্তর্দৃষ্টি

 

Antardrishti story in bangla

 

ই-বুকের বর্ষা সংখ্যার জন্য সোমনাথের কাছে জমা পড়েছে প্রচুর কবিতা। এগুলো দেখা হয়ে গেলে যাবে এডিটিং-এ। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় রাতের নিস্তব্ধতাকে সঙ্গী করে সে পড়ে চলেছে কবিতাগুলো। মোটামুটি লেখাগুলো ভালোই, যেটুকু বাদ দিচ্ছে তা ওই ব্যাকরণগত ত্রুটি ও যতি চিহ্নের জন্য।

এর মধ্যেই মোবাইলে মেসেজের টুংটাং, লেখা এখনও জমা পড়ছে। ফোন নাম্বারও দেওয়া আছে, কোনও সমস্যায় ফোন করার জন্য। একটা লেখা সে সরিয়ে রেখেছে, কান্না নামের এই কবিতাটার আয়তন পরিসীমা সীমার লাইনের বাইরে হওয়ায়। সামান্য কমালে লেখাটা ঠিক হতো।

কিন্তু এভাবে সংশোধনের নিয়ম তো প্রকাশনা সংস্থার নেই। এসে যাওয়া মেসেজগুলো চেক করে দেখল, একই নাম্বার থেকে এসেছে, যে কান্না কবিতাটা জমা দিয়েছে। কথার ভিড়ে বাকি কবিতাগুলো হারিয়ে না যায়, সে সন্ত্রস্ত হল! অনুরোধ জানাল ফোন করার জন্য যদি কান্না কবিতাটাকে কোনও ভাবে নিয়মে আনা যায়। এদিকে ও-প্রান্ত থেকে ফোন তো ধরলই না, উলটে একের পর এক মেসেজ আসতে থাকল।

সোমনাথ ক্লান্ত হয়ে নিজের কাজে মন দিল। কৌতূহল বশত কান্না কবিতাটার প্রেরকের ঠিকানাটা দেখতে গিয়ে দেখল, ডেফ অ্যান্ড ডাম্ব হোম দমদম। এতক্ষণে সে বুঝতে পারল ফোন না ধরার কারণটা। হোয়াটস্অ্যাপে লিখল তোমার কবিতাটা ষোলো লাইনে করে দাও, তাহলে ছাপবার অসুবিধে হবে না, ভালো থেকো।

ও-প্রান্ত থেকে একটা সুন্দর স্মাইলি এল। ওই স্মাইলির আড়ালে সোমনাথ তার নির্বাক পৃথিবীর হাসিখুশি মুখটা দেখতে পেল।

              গল্প  : সুতপা রায়

মুশকিল আসান

সুচিত্রা কিছুতেই মনের আনন্দ গলার স্বরে লুকিয়ে রাখতে পারছিল না সেটা ফোনের মধ্যেও বুঝতে পারছিলেন সুনন্দাদেবী।

কী বউমা, এত সকালে তোমার ফোন? কোনও ভালো খবর আছে বুঝি? সুনন্দা উৎসুক কণ্ঠে ফোনের ওপারে থাকা সুচিত্রাকে প্রশ্ন করলেন।

হ্যাঁ মা, তুমি এবার ঠাকুমা হতে চলেছ।

বউমা, সত্যি বলছ? সত্যিই আমি এবার ঠাকুমা হব? আমি ভাবতে পারছি না, সকাল সকাল এরকম একটা আনন্দের খবর আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। কবে থেকে এই খবরটা শুনব বলে বসে আছি। সকালবেলাতেই তুমি আমার মন ভালো করে দিলে। ভালো থাকো, সুখে থাকো। সুনন্দাদেবী আশীর্বাদ দেওয়ার ভঙ্গিতে বউমাকে বললেন।

হ্যাঁ মা…, আশ্বাস দিল সুচিত্রা।

আমি জানি নাতি আসতে চলেছে আমার। তা তোমার মা-কে খবরটা জানিয়েছ? উনিও শুনে খুব খুশি হবেন। সুনন্দা মনে করান বউমাকে।

না! তোমার সঙ্গে কথা বলেই মা-কে ফোন করব। কিন্তু একটা কথা বলো তো, নাতি-ই যে আসতে চলেছে সে ব্যাপারে তুমি এত নিশ্চিত কী করে হলে? নাতনিও তো আসতে পারে। হেসে উত্তর করে সুচিত্রা।

না না, আমি জানি আমার ঘরে প্রথম নাতিই আসবে, আসতেই হবে। কিন্তু বউমা তুমি নিজের যত্ন করবে। ভারী ওজনদার জিনিস এখন একদম তুলবে না। তোমার কাজের মেয়েটা ঠিকঠাক আসছে তো? সুনন্দার চিন্তা ওনার গলার আওয়াজেও প্রকাশ পায়।

তুমি একদম চিন্তা কোরো না। রীণা রোজই কাজে আসছে। এখন ছুটি নেওয়াটাও ওর অনেক কমেছে। শাশুড়িকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে সুচিত্রা কথাগুলো বলে।

এখন ওকে একেবারেই ছুটি দিও না। এই সময় তোমার বিশ্রাম করাটা খুব দরকার। বিশেষ করে শুরুর সময়টা এবং শেষের তিনটে মাস খুবই সাবধান।

হ্যাঁ মা, আমি জানি। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। আমি নিজের খেয়াল অবশ্যই রাখব। বলে সুচিত্রা ফোন কেটে দিল।

আগের দিনই সুচিত্রা সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়েছে নিজের প্রেগন্যান্সি সম্পর্কে। সকালে অজয় অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পর নিজের পরিচিত গাইনির কাছে গিয়ে একবার পরীক্ষা করিয়ে কনফার্ম হয়ে, অজয়কে ফোনে ব্যাপারটা জানিয়েছে।

আজকে তাই সকালে উঠেই প্রথমে শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলার পর মা-কে ফোন করল সুচিত্রা।

মা, একটা ভালো খবর দিতে চাই।

ভালো খবর? আমার দিদা হওয়ার খবর নাকি? অনিমা নিজের মনেই মুচকি হাসলেন।

তুমি কী করে জানলে আমি এই খবরটা দিতেই ফোন করেছি? অন্য খবরও তো হতে পারত। এই যেমন অজয়ের প্রোমোশন…, চুপ করে যায় সুচিত্রা।

শোন চিত্রা, আমি তোর মা। তোর গলা শুনেই বুঝেছি কী ভালো খবর তুই দিতে চলেছিস। আমি প্রচণ্ড খুশি হয়েছি। ভাবতে পারছি না আমার সেই ছোট্টা চিত্রা আজ তারই মতো সুন্দর একটা মেয়ের মা হতে চলেছে। দেখবি তোর মেয়ে নিজের দিদার মতোই বুদ্ধিমতী এবং তোর মতো সুন্দরী হবে। গর্বিত কণ্ঠে অনিমা বলেন।

মা, তোমারও না সবেতে বাড়াবাড়ি। তুমি কী করে এতখানি শিয়োর হচ্ছ যে তোমার নাতনিই হবে? কপট ধমক দেয় সুচিত্রা নিজের মা-কে।

চিত্রা, আমার মন বলছে দেখিস। আর আমিও চাই তোর ফুটফুটে একটা মেয়ে হোক। এখন ফোন রাখ, আমি তোর বাবাকে সুখবরটা দিয়ে আসি।

 

প্রেগন্যান্সির প্রথম দেড়-দু’মাস সুচিত্রার শরীর প্রায়শই খারাপ থাকত। বমি ভাব, খাবার দেখলেই অনিচ্ছা, অরুচি, মাথা ঘোরা এসব লেগেই থাকত। এই সময়টা অজয় ছুটি নিয়ে প্রায়শই বাড়িতে থেকে যেত সুচিত্রার খেয়াল রাখার জন্য। কাজের মেয়েটিও যথেষ্ট খেয়াল রাখত বউদির।

এরপর আস্তে আস্তে সুচিত্রার শরীর নতুন পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে শুরু করল। তখন সুচিত্রা নিজেই নিজের যত্ন নিতে তৎপর হল যাতে অজয়ের উপর বেশি চাপ না পড়ে। ও যখন পাঁচ মাসের গর্ভবতী তখন একদিন বারান্দায় চেয়ারে বসে প্রকৃতির শোভায় নিজেকে মগ্ন করে রেখেছিল সুচিত্রা। হঠাৎ-ই গাড়ির আওয়াজে চোখ চলে গেল ফ্ল্যাটের মূল ফটকের বাইরে। দেখল মা গাড়ি থেকে নামছেন। সঙ্গে ব্যাগ এবং মাটিতে নামানো একটি সুটকেস। তার মানে সুচিত্রা বুঝল মা ওর কাছে থাকতেই এসেছেন। রীণাকে ডেকে তাড়াতাড়ি মায়ের কাছে পাঠাল সুচিত্রা, সুটকেসটা নিয়ে মা-কে সঙ্গে করে আনার জন্য।

রীণার সঙ্গে অনিমা ফ্ল্যাটে ঢুকে এলে আনন্দে মা-কে জড়িয়ে ধরল সুচিত্রা। মা, তুমি কী করে আসতে পারলে? তোমার ক্লাস নেওয়ার কী হবে? তুমি এখানে থাকলে কলেজের ক্লাস কী করে নেবে? প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুলল মা-কে সুচিত্রা।

দাঁড়া দাঁড়া একটু বসতে দে, তারপর তোর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। বলে অনিমাদেবী হাঁফাতে থাকেন। শেষ তিনদিন নিজের সংসার গুছিয়ে প্ল্যান করতে গিয়ে নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় পর্যন্ত পাননি। মেয়ের কাছে পৌঁছে এখন নিশ্চিন্ত বোধ করছেন। একটু জিরিয়ে নিয়ে মেয়েকে সম্বোধন করে বললেন, ওদের ক্লাস নিতে কোনও অসুবিধে হবে না। এখন তো সব ক্লাস অনলাইনেই হচ্ছে। তাই ভাবলাম, এই সময়টা চিত্রা তোর কাছে থাকাটা খুব দরকার। সুচিত্রা আনন্দে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল।

খুব ভালো করেছ মা এখানে চলে এসে। অজয় অফিস চলে গেলে আমার একটু ভয় ভয়ই করে। খালি মনে হয় কোনও একটা এমারজেন্সি হলে কী করব। রীণা যদিও অজয় আসা অবধি আমার কাছেই এখন থাকছে। অজয় ফিরলে তবে ও বাড়ি যায়।

সন্ধেবেলায় অজয় বাড়ি ফিরে শাশুড়িকে দেখে খুব খুশি হল। সারাদিন বাইরে কাজে থাকতে হয়, সুতরাং সুচিত্রা-কে নিয়ে ওর দুশ্চিন্তা লেগেই থাকে। শাশুড়ি এসে যাওয়াতে ও খুব নিশ্চিন্ত বোধ করল। সুচিত্রারও আনন্দের কোনও শেষ ছিল না। ও জানত মা ওর কাছে থাকা মানে রোজ মায়ের হাতের খাবার খাওয়া যাবে।

মা আসার পর ১০ দিন দেখতে দেখতে কেটে গেল। অনিমাদেবী গর্ভবতী মেয়ের জন্য প্রয়োজনীয় নানা ধরনের খাবার বানাতেন। সুচিত্রা যখন তাঁর গর্ভে তখনকার গল্প শোনাতেন। মেয়ের শরীর ভালো রাখতে কিছু কিছু কাজও মেয়েকে দিয়ে করাতেন। সুচিত্রার দিনগুলো ভালো ভাবেই কাটতে লাগল। অনিমাদেবী নিজে যথেষ্ট শিক্ষিতা। কলেজের লেকচারার, ফলে ডিসিপ্লিন মেনে চলতেন নিজেও এবং আশা করতেন অন্যরাও সেটা মেনে চলবে। সুচিত্রার চরিত্র যদিও মায়ের বিপরীত, তবু মা-মেয়ের ভালোবাসার বন্ধনে কোনও খামতি অনিমাদেবী রাখেননি। দিনগুলো বেশ কাটতে লাগল।

সময় কেটে যাচ্ছিল। সুচিত্রার শরীর ভারী হয়ে উঠল। আগের মতো লাফালাফি করে কাজ করতে আর পারে না। কিন্তু মা সঙ্গে থাকাতে কোনও দুশ্চিন্তা হতো না। অনিমাদেবীও মেয়ের বিশ্রামের পুরো খেয়াল রাখতেন।

এরই মধ্যে একদিন অজয়ের মা ছেলেকে ফোন করলেন বউমার খোঁজ নিতে। অজয়, আমি আসছি তোদের ওখানে। নাতিকে দেখার জন্য মন ছটফট করছে।

কিন্তু মা, তোমার নাতি এখন কোথায় এসেছে? কৌতুকের ভঙ্গিতে অজয় বলে।

দূর পাগল ছেলে… এখন আসেনি ঠিকই কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তো আসতে চলেছে। গর্ভে থাকা অবস্থায় যদি নাতির সেবা না করি তাহলে ও-ই বা কেন আমাকে ঠাম্মা বলে মেনে নেবে? যা, ফোন রাখ আমাকে প্যাকিং করতে হবে। বলে ফোন কেটে দিলেন সুনন্দা।

 

সপ্তাহের শেষে সুনন্দা ছেলের বাড়ি পৌঁছোলে অনিমাদেবী আর সুচিত্রা স্বাগত জানাল ওনাকে। অজয়ের মা-ও অনিমাদেবীকে জড়িয়ে ধরলেন, ভালোই হল অনিমা, তোমার সঙ্গে কয়েকটা দিন কাটাতে পারব।

উপরে উপরে দুই বেয়ানের ভাব-ভালোবাসার কথা হলেও ভিতরে ভিতরে দুজনেরই মনে প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা। তার প্রমাণ পাওয়া যেতে লাগল কিছুদিন পর থেকেই।

অনিমাদেবীর বরাবরই অভ্যাস ভোর পাঁচটায় উঠে পড়া। সুচিত্রার কাছে আসা থেকেই মেয়েকে নিয়ে ভোরবেলা সামনের পার্কে আধঘন্টা হেঁটে আসতেন। সুচিত্রারও ভালো লাগত। সারাদিনটা খুব ফ্রেশ মনে হতো নিজেকে। সুনন্দাও কয়েকদিন এসব দেখে অনিমাদেবীর আগেই ভোরে উঠে পড়া শুরু করলেন। সুচিত্রাকে ডেকে তুলে কয়েকটা প্রয়োজনীয় আসন শিখিয়ে বলে দিলেন, ভোরবেলায় বাইরে হাঁটার বদলে আসনগুলো করলেই সুচিত্রার এই অবস্থায় বেশি উপকার হবে। এদিকে অনিমাদেবীও মেয়েকে জোর করতেন পার্কে হাঁটার জন্য।

সুচিত্রার হতো মুশকিল, কার কথা শুনবে সিদ্ধান্ত নিতে পারত না। এদিকে অনিমাদেবীও বেয়ানের এই দখলদারি অপছন্দ করতে শুরু করলেন। একদিন ধৈর্য হারিয়ে একটু রূঢ় ভাবেই বলে ফেললেন, বেয়ান, চিত্রা তো আমার মেয়ে আমি ওকে এই ভোরেই হাঁটতে নিয়ে যাব। আপনি বরং ওর আসন করার সময়টা বদলে দিন।

সুনন্দাও দমবার পাত্রী নন, কঠোর স্বরেই বললেন, কিন্তু অনিমা তুমিও বুঝতে চাইছ না, আসন করার এটাই উপযুক্ত সময়। আমিও অজয় পেটে থাকতে শাশুড়িমায়ের কথামতো যোগব্যায়াম করতাম। এর ফল তো তুমি দেখতেই পাচ্ছ! হেলদি ছেলে জন্মেছে, আজ যে-তোমার জামাই। বাধ্য হয়ে সে এবারের মতো অনিমাদেবীকে রণে ভঙ্গ দিতেই হয়।

সুচিত্রার মুখে সব শুনে অজয় নিজের মা-কে বোঝাল, মা সকালেই বরং সুচিত্রা পার্কে হেঁটে আসুক কারণ তখন পার্ক ফাঁকা থাকে। তুমি বিকেলে সুচিত্রাকে দিয়ে আসনগুলো করিও। বিকেলে ওর ভরপুর এনার্জিও থাকে। দুই বেয়ানের সম্পর্ক ভালো রাখার এই প্রয়াসে অজয় তখনকার মতো জয়ী হলেও, জয়ের আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হল না।

অনিমাদেবী সুচিত্রাকে যেটাই করতে বলতেন, অজয়ের মা ঠিক বিপরীত একটা কিছুর উপদেশ দিতেন। অথচ দুজনেই সুচিত্রার ভালোর জন্য বললেও উদ্দেশ্য একে অপরকে নীচু করা এবং নিজেকে উপরে রাখা। সুচিত্রা আর অজয়ের মনে হতো কয়েকদিনের মধ্যেই হয়তো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। কিন্তু কিছুদিন পরেই বুঝতে পারল, এটা ঠিক হওয়ার নয়। এই প্রতিযোগিতা চলতেই থাকবে।

একদিন অনিমা মেয়ের জন্য বিট-গাজরের জুস করে সকাল সকাল মেয়ের সামনে রাখলেন। চিত্রা এটা খেয়ে নে। এটা খুব উপকারী।

সঙ্গে সঙ্গে সুনন্দাদেবী এগিয়ে এসে বলে উঠলেন, বউমা, ওসব জুস-টুস খেয়ে কিছু হবে না। সকালবেলায় বেদানা, আপেল এগুলো চিবিয়ে খাও। এতে ফাইবারও যেমন আছে তেমনি শরীরও এর থেকে শক্তি পাবে। এছাড়া রক্ত বাড়াতেও সাহায্য করবে।

দুজনের কাণ্ড দেখে সুচিত্রা হতচকিত হয়ে গেল। দুজনের হাত থেকেই জিনিসগুলো নিয়ে পাশে টেবিলে নামিয়ে রাখল। দুজনের উদ্দেশ্যেই বলল, ঠিক আছে এগুলো সবকটাই আমার খুব পছন্দের। জুস, ফল সব আমি খেয়ে নেব কিন্তু একটু পরে। আমার একটু শুতে ইচ্ছে করছে, তোমরা দুজন যাও না, বাইরে থেকে একটু হেঁটে এসো।

ওদের বাইরে পাঠিয়ে সুচিত্রা লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে অজয়কে ডাকল। পাশের ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে অজয় বলল, এ তো মহা মুশকিল হল চিত্রা। সকাল থেকে দুজনে মিলে তোমার পিছনে পড়ে যায়। এদিকে রাত বারোটার আগে ঘর ছেড়ে যায়ও না। আমাদের নিজেদের পার্সোনাল টাইম বলে কিছু আর রইল না।

পুরো আমার মনের কথা বলেছ অজয়। যে-কোনও ছোটো ছোটো ব্যাপার নিয়ে এদের তর্ক-বিতর্ক লেগেই থাকে। আমার মা লেকচারার বলে মনে করেন ওনার নলেজ সবথেকে বেশি। আর এদিকে তোমার মায়ের ধারণা হল তোমাকে যেহেতু ভালো ভাবে মানুষ করেছেন, তাই ওনার সব পরামর্শ শুনতে আমরা বাধ্য।

সত্যি চিত্রা, তোমার সঙ্গে দুটো ভালোবাসার কথা বলব সে উপায় পর্যন্ত আমাদের নেই। বুঝতে পারছি না নিজেকে সেরা প্রতিপন্ন করার চক্করে এদের ঠান্ডাযুদ্ধে আর কতদিন আমাদের মানসিক শান্তি ভঙ্গ হবে?

মাঝেমধ্যে দুই বেয়ানের মধ্যে তর্কের বিষয় হয়ে উঠত সুচিত্রার ভবিষ্যৎ শিশু। ছেলে হবে না মেয়ে তাই নিয়ে দুজনের অমত সুচিত্রা এবং অজয়কে তিষ্ঠতে পর্যন্ত দিত না। সারাটা দিন হয় সুচিত্রা নয়তো অজয়কে ওদের দুজনের সঙ্গে সঙ্গে থাকতে হতো। বেচারা নিজেদের মধ্যে অবসর যাপন করার সময় পর্যন্ত পেত না ওরা।

একদিন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে অজয় সুচিত্রাকে বলল, চিত্রা এবার আমাদের কিছু ভাবতে হবে। এটা একটা বড়ো সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন করেই হোক এর একটা সমাধান বার করতেই হবে।

একটা কৌশল করলে কেমন হয়? আমি বলছি কী করতে হবে। বলে অজয়ের কানে কানে সুচিত্রা কিছু বলতেই, অজয়ের ঠোঁটে হাসি খেলে যায়।

পরের দিন সকাল সকাল জলখাবারের টেবিলে সকলে বসে কথা হচ্ছে, তার মাঝেই অনিমাদেবীর মোবাইলটা বেজে ওঠে। সুচিত্রা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালে অনিমা ইশারায় জানান, সুচিত্রার বাবা ফোন করেছেন।

হ্যালো, এত সকালে ফোন করেছ? সব ঠিক আছে তো? অনিমাদেবীকে চিন্তিত দেখায়।

না, তোমার কথা খুব মনে হচ্ছিল। সুচিত্রার বাবার গলা ভেসে আসে।

এরই মধ্যে এমন কী হল যে, আমার কথা এত মনে পড়ছে? এই তো ক’দিন হল এসেছি। কপট রাগত স্বরে অনিমা স্বামীকে বলেন।

এই তো নয় ম্যাডাম, দু’মাস কেটে গেছে সে খেয়াল আছে? অনিমা, গত রোববার থেকে আমার শরীরটা খুব খারাপ।

সে কী! কী হয়েছে? আগে ফোন করোনি কেন? অনিমা চিন্তিত হয়ে ওঠেন।

হঠাৎ ব্লাডপ্রেশার হাই হয়ে মাথা ঘুরে বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলাম। ডান পায়ে হাঁটুতে খুব লেগেছে। হাঁটাচলা করতে পারছি না। বাড়িতে ছেলে, বউমা আছে ঠিকই কিন্তু বউমাকে দিয়ে তো সব কাজ করানো যায় না। ছেলে একটা লাঠি কিনে এনে দিয়েছে কিন্তু তোমার কাঁধের ভর আমাকে সাহস জোগাতে পারবে। আমি ভিতরে ভিতরে খুব ভেঙে পড়ছি।

এত কিছু হয়ে গেছে তোমরা আমাকে কিছু জানাওনি? সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে দিলে আমি তখনই চলে আসতাম। চোখে জল চলে আসে অনিমাদেবীর।

ঠিক আছে অনিমা। আমি অজয়কে তোমার টিকিট কাটতে বলে দিয়েছি। তুমি শুধু এখানে চলে এসো। তাহলেই আমি তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠব।

চিন্তা কোরো না, কালকেই আমি রওনা দিচ্ছি। আমি তো চিত্রার জন্যই এখানে আটকে ছিলাম, চিত্রার দিকে তাকিয়ে অনিমাদেবী বললেন।

চিত্রার শাশুড়িমা তো আছেন ওখানে। কিছুদিন উনিই দেখাশোনা করুন ওদের বউমার। আর তুমি আমার দেখাশোনা করো। বলে কৌতুকের হাসি খেলে যায় সুচিত্রার বাবার ঠোঁটে।

স্বামীর কথা শুনে অনিমাদেবী হেসে ফেলেন, তুমি আর বদলালে না। আচ্ছা আমি আসছি।

অজয় টিকিট সেদিনই কেটে নিয়ে এল। পরের দিন অনিমাদেবী মেয়েকে নানা পরামর্শ দিয়ে নিজের বাড়ি ফিরে গেলেন। সুচিত্রা আর অজয় হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

সুচিত্রার মা চলে যাওয়াতে বাড়িতেও শান্তি ফিরে এল। শাশুড়ি যতটা প্রয়োজন ততটাই মাথা গলাতেন। অজয়রাও নিজেদের জন্য সময় বার করে একসঙ্গে কাটাতে লাগল।

একমাস এভাবেই কেটে গেল। সুচিত্রার তখন আট মাস চলছে। ধীরে ধীরে কোনওরকম পরিশ্রম করা মুশকিল হয়ে উঠতে লাগল সুচিত্রার পক্ষে। রীণা বাড়ির সব কাজই করে দেয়। সুনন্দাদেবীর কাজ হল, খালি বউমার খেয়াল রাখা।

সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। একদিন অনিমাদেবী মেয়েকে ফোন করে জানালেন, চিত্রা এখন তোর বাবা সম্পূর্ণ সুস্থ। আমি দু’তিন দিনে তোর কাছে আসছি। এই সময় তোর পাশে থাকাটা খুব দরকার।

কিন্তু মা, আমি ভালো আছি। তোমার এভাবে তাড়াহুড়ো করে আসার কোনও দরকার নেই।

কে বলল, দরকার নেই। এটা তোর প্রথম প্রেগন্যান্সি, আমার তোর কাছে থাকাটা খুব দরকার। তোর শাশুড়ি যে কতটা করছেন আমি খুব বুঝতে পারছি। তোকে আর তোর ভাইকে আমি জন্ম দিয়েছি। আমি জানি এসময় মেয়েরা তাদের মা-কে পাশে চায়। নে, এখন ফোন রাখ। জিনিসপত্র গোছাতে হবে যাওয়ার জন্য।

ফোন রেখে সুচিত্রা শোওয়ার ঘরে এসে আশঙ্কিত গলায় বলল, এবার কী হবে অজয়? আবার সেই মহাভারতের যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে!

কী হয়েছে সেটা তো বলো। অজয় সুচিত্রার ঘাবড়ে যাওয়ার কারণটা জানতে চায়।

মা আবার এখানে আসছে। বাবা পায়ের চোট লাগার অভিনয় আর কতদিনই বা চালাতে পারে। এক মাসের মধ্যেই আমাদের সব কৌশল ভেস্তে গেল। সুচিত্রাকে খুবই হতাশ লাগছিল।

সান্ত্বনা দেওয়ার স্বরে অজয় বলল, কোনও কিছুই বৃথা হয় না চিত্রা। দ্যাখো ওই কৌশলই এবার আমাকে আমার মায়ের উপরে প্রয়োগ করতে হবে। তুমি বিশ্রাম করো, আমি কিছু একটা ভাবছি।

 

পরের দিন অজয় নিজের মায়ের ঘরে ঢুকে মা-কে বলল, মা তোমার মনে আছে গতবছর দেরাদুনে আয়োজিত টপ বিজনেস উইমেন সামিটে তোমার যাওয়ার কথা ছিল। তুমি ওখানে ওয়ার্কশপ এবং সেমিনারে অংশ নিতে খুব আগ্রহী ছিলে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে অরোরা আন্টির শরীর খারাপ হয়ে পড়াতে তোমরা দু’জনে যেতে পারোনি।

হ্যাঁ, মনে আছে। সিমির শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিল সেবার। ওকে ছেড়ে আমার একা যাওয়ার কোনও ইচ্ছে ছিল না। আমাদের প্ল্যান ক্যান্সেল করতে হয়েছিল।

তাই জন্য বলছি, এবারে অরোরা আন্টি ফুল ফর্মে রয়েছেন। উনি রিজার্ভেশন করাতে যাচ্ছেন। তুমি বলো তোমার কী প্ল্যান?

না রে অজয়, এবার আমি যেতে পারব না। আমার নাতি আসতে চলেছে। পরের বছর বরং প্ল্যান করব। নিঃশ্বাস ছাড়েন সুনন্দদেবী।

কিন্তু মা, আন্টি বলছিলেন পরের বছর উনি ইংল্যান্ডে যাবেন ছেলের কাছে। ওই সময় থাকবেন না। সুতরাং তোমার এটাই সুযোগ। আর নাতির চিন্তা কেন করছ? তোমার অনুপস্থিতিতে চিত্রার মা ওর দেখাশোনা করে নেবেন। দু’তিনদিনের মধ্যেই উনি চলে আসবেন।

কিন্তু অজয়…।

কোনও কিন্তু নয় মা। বেশি চিন্তা কোরো না শুধু প্ল্যানিং-এ লেগে পড়ো। দ্বিতীয়বার এই সুযোগ আর পাবে না। বেশ জোরের সঙ্গেই বলে অজয়।

তাহলে সিমিকে বলে দে আমারও রিজার্ভেশন যেন করে, বলে নিজের জিনিসপত্র এক জায়গায় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সুনন্দা।

অজয় আর সুচিত্রা স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। যতদিনে অজয়ের মা ফিরবেন, ততদিনে সুচিত্রার সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়ে যাবে। সুতরাং সুচিত্রাকে আর দুই মায়ের মধ্যে পড়ে বলির পাঁঠা হতে হবে না।

 

তফাত শুধু চোখে

জানলার বাইরে একটা দোয়েল শিস দিচ্ছে অনবরত। সেটা কানে আসতেই ভেঙে গেল ঘুমটা। মোবাইলে টাইম দেখে লাফিয়ে উঠলাম। সাড়ে ন’টা বেজে গিয়েছে! দশটা থেকে আমার মিটিং!

মাস চারেক হল কলকাতা শহরে এসেছি একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে আদতে উত্তরবঙ্গের বাসিন্দা। দক্ষিণ কলকাতার এক এলিট পাড়ায়, কোম্পানি থেকে দেওয়া হয়েছে দু’কামরার ফ্ল্যাট। সারাদিন কাজের চাপ থাকে বিস্তর। সকালে নাকে-মুখে গুঁজে বেরিয়ে যাই, ফিরি রাতে। প্রতিবেশীদের সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই আমার। চিনিও না সেভাবে কাউকে। শুধু আবাসনের সেক্রেটারির সঙ্গে পরিচয় আছে একটু-আধটু।

গত তিনদিন যাবৎ সম্পূর্ণ ঘরবন্দি। প্যান্ডেমিকের ভয়ে সারা দেশে চলছে লকডাউন। অফিসেরও ঝাঁপ বন্ধ। শুরু হয়েছে ওয়ার্ক ফ্রম হোম। একটু পরেই গুগল-এ মিট করতে হবে এক জাঁদরেল ক্লায়েন্টকে। ঝটপট ফ্রেশ হয়ে রাতের ট্র্যাক প্যান্টের উপরেই পরে ফেললাম একটা আয়রন করা শার্ট। গলায় ঝোলালাম টাই। কফি মাগ হাতে নিয়ে অন করলাম ল্যাপটপ।

পাক্কা এক ঘণ্টা চলল মিটিং। আপাতত কিছুক্ষণ বিরতি, তারপর আবার বসতে হবে কাজ নিয়ে ঘরদোর সাফ-সুতরো করতে হবে এরই মাঝে। ব্যবস্থা করতে হবে খাবারেরও। একজন মাঝবয়সি মহিলা এসে সকালে ঝাড়পোঁছ, রান্না এসব করে দিয়ে যেতেন। কিন্তু কোভিডের কল্যাণে তাঁর আসা বন্ধ। অগত্যা সব কাজ সামলাতে হবে আমাকেই। মা-বাবা অনেক করে বলেছিল বাড়ি ফিরে যেতে। কিন্তু আমিই যাইনি ইচ্ছে করে। ভেবেছিলাম কয়েকটা দিন একাকিত্বের স্বাদ নেব। নিজের সঙ্গে সময় কাটাব কিছুটা।

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম ব্যালকনিতে। আমাদের বিল্ডিং-এর উলটো দিকেই আছে একটা দোতলা বাড়ি। ছাদের উপর সারি সারি টব সাজানো। ফুটে আছে রং-বেরঙের ফুল। হাতে একটা খুরপি জাতীয় কিছু নিয়ে একটা মেয়ে টবে মাটি দিচ্ছে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিলাম আমি। মেয়েটা একমনে তার কাজ করছে। হ্যাংলার মতো দাঁড়িয়ে আছি ভেবে বিরক্ত লাগল নিজেরই। ঢুকে গেলাম ঘরে। ভাণ্ডারে খাবার বাড়ন্ত। অতএব ছুটতে হল পাড়ার মুদিখানায়। ভাগ্যিস সেটা খোলা ছিল।

(২)

–দাদা যা দরকার বেশি করে নিয়ে যান। এই লকডাউন এত সহজে উঠবে না মনে হয়।

–হুম, তাই তো দেখছি।

–সব মাল প্রায় শেষের পথে। গণপতির দিব্যি দাদা এই ক’দিন যা ব্যাবসা করেছি, সারা জিন্দেগিতে তা করিনি। পাবলিক এমন করছিল যেন করানো ভাইরাস গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে, এখুনি এসে অ্যাটাক করবে। যে যত পারো জিনিস কিনে দৌড় লাগাও ঘরে। কথাটা বলেই একটা ফিচেল হাসি হাসল দোকানদার শ্যামাচরণ।

তার দোকানের পাশেই ফাঁকা জায়গায় কিছু আনাজপাতি আর মুরগির ডিম-মাংস নিয়ে বসেছে আরও দু’জন। মোটামুটি হপ্তাখানেকের রসদ কিনে, একটা সিগারেট ধরিয়ে গল্প শুনছিলাম শ্যামাচরণের। রাস্তাঘাট ফাঁকা। সিগারেটে লম্বা টান দিতেই নজরে এল মেয়েটা। একটু আগে ছাদের উপর দেখেছিলাম যাকে। শ্যামাচরণের দোকানের দিকেই এগিয়ে আসছে।

একটা ব্যাগ আর লিস্ট শ্যামাচরণের হাতে ধরিয়ে সে দাঁড়িয়ে রইল আমার পাশে। আমি আড় চোখে দেখছিলাম তাকে। গায়ে রং বেশ চাপা। পিঠ পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে কোঁকড়ানো চুল। নাক মুখ ঢাকা পড়েছে মাস্ক-এ। সেও তাকাল আমার দিকে। কী অসম্ভব গভীর দুটো চোখ! কালো কুচকুচে মণি, বড়ো বড়ো আঁখিপল্লব! কালো হরিণ-চোখ বোধহয় একেই বলে। জিনিসগুলো নিয়ে চলে গেল সে। আমিও আধপোড়া সিগারেটটা ফেলে, পা বাড়ালাম বাড়ির দিকে।

সারাদিন কাজের ফাঁকে বহুবার মনে পড়েছে মেয়েটার কথা, তার দুটো গভীর কালো চোখের কথা। আমার আঠাশ বছরের জীবনে বহু মেয়েকে দেখেছি আমি। দু’একজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশিনি যে, তাও নয়। কিন্তু কোনও মেয়ের চোখে এতখানি গভীরতা কখনও দেখিনি আমি।

বেশ কদিন কেটে গেল লকডাউন-এর। একা থাকার যন্ত্রণাটা এখন টের পাচ্ছি ভালো রকম। ঘরের কাজ, অফিসের ভিডিও চ্যাট, অ্যাসাইনমেন্ট একসঙ্গে সামলাতে নাভিশ্বাস উঠেছে প্রায়। দুপুরে একটা ওয়েবসিরিজ দেখতে দেখতে তন্দ্রা মতো এসেছিল। হঠাৎ শুনলাম কলিং বেলের শব্দ। একটু অবাক হলাম, এই সময় আবার কে এল? দরজাটা খুলেই থতমত খেয়ে গেলাম একদম! সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই মেয়েটা, যাকে প্রায়ই দেখি উলটোদিকের বাড়ির ছাদে। যার রহস্যময় দু’টো চোখ বুকে জ্বালা ধরিয়েছে আমার। পরনে একটা শ্যাওলা সবুজ লং ফ্রক। সেই চাপা রং, কোঁকড়ানো চুল। আজও মুখের বেশির ভাগ অংশ ঢেকে আছে মাস্ক-এ। শুধু দেখা যাচ্ছে চোখ দুটো।

একটু থমকালাম আমি। নাহ্, চোখ দুটো তো অতটা কালো নয়, সেদিন যতটা মনে হয়েছিল! গভীরও নয় তেমন। একটু খয়েরি আভা আছে। খেলে বেড়াচ্ছে চপলতা। তবে কি আমারই দেখার ভুল? আমাকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকতে দেখে সে বলল, কী দেখছেন অমন হাঁ করে? জীবনে কখনও মেয়ে দেখেননি?

এমন মন্তব্য শুনে বিব্রত হলাম আমি। সঙ্গে থাকা দু’জন মহিলাও হাসলেন মুখ টিপে। মেয়েটা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, আমরা নব দিগন্ত এনজিও থেকে আসছি। লকডাউন-এ বিপদে পড়া দুঃস্থ মানুষদের হাতে খাবার, ওষুধ তুলে দিচ্ছি আমরা। আপনার কাছে এসেছিলাম কিছু সাহায্যের আশায়। আমাদের ক্ষমতা সীমিত। আপনারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে, আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছোতে পারব।

অলরেডি ইমেজে গ্যামাক্সিন পড়েছে। সেটা যাতে আর না ছড়ায় তাই একটা কড়কড়ে পাঁচশো টাকার নোট এনে তুলে দিলাম তার হাতে। সে টাকা নিয়ে চলে গেল হাসি মুখে কিন্তু আমার মনের খচখচানিটা রয়ে গেল রাতভর।

আজকাল ব্যালকনিতে দাঁড়াতেও সংকোচ হয়। কী জানি যদি সে মনে করে তাকে দেখার জন্যেই দাঁড়িয়ে থাকি ওখানে। তারও পর আবার আছে চোখের রহস্য! এতটা ভুল কীভাবে দেখলাম আমি?

ক’দিন পর এক রবিবারের বিকেলে শ্যামাচরণের দোকান থেকে টুকটাক জিনিস নিয়ে ফিরছি, এমন সময় শুনি একটা মেয়ের কণ্ঠ, এই যে শুনছেন? একটু আসবেন এদিকে? পেছন ফিরে দেখি সেই মেয়েটা। আজ মুখে মাস্ক নেই, তাই তার ঈষৎ টিকালো নাক, পুরু ঠোঁট আমার নজর এড়াল না।

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে ডাকছেন?

চেহারায় অবাঙালি ছাপ থাকলেও স্পষ্ট বাংলায় উত্তর দিল সে, হ্যাঁ, আপনাকে। আমার নাম জুলি। সেদিন যে-ডোনেশন দিয়েছিলেন তার রসিদটা আপনাকে দেওয়া হয়নি। যদি একটু আসেন, তাহলে দিয়ে দেব।

রসিদের কোনও প্রয়োজন ছিল না। নিছক কৌতূহলের বশে এগিয়ে গেলাম। বাড়ির সামনের ছোট্ট সবুজ লনে বেতের চেয়ারে বসে আছেন একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ভদ্রলোক। হাতে বিদেশি জার্নাল।

মিঃ রঙ্গনাথন, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি আমলা। আমার উত্তরবঙ্গে বাড়ি শুনে হাসিমুখে বললেন, তোমার মতো আমিও পরিযায়ী। জন্ম কেরলের কোদিনহি গ্রামে। চাকরিসূত্রে এসেছিলাম কলকাতায়, থেকে গেলাম পাকাপাকি।

কোদিনহি নামটা কোথায় যেন শুনেছি, বেশ চেনা চেনা লাগছে। আমি আর জুলি বসেছিলাম মুখোমুখি। চা পানের অনুরোধ ফেলতে না পেরে গল্প শুনছিলাম রঙ্গনাথনের। কথার মাঝে চায়ের ট্রে হাতে আমার সামনে এসে দাঁড়াল একজন। তাকে দেখেই আমার চক্ষু একেবারে চড়কগাছ!

রঙ্গনাথন প্রসন্নমুখে বললেন, জুলিকে তো তুমি চেনো! এ আমার আর এক মেয়ে মিলি।

ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের পেটের ভেতরে যেভাবে ঢুকে গিয়েছিল হাইজ্যাক করা এরোপ্লেন, ঠিক সেভাবেই কী একটা যেন ঢুকল আমার ভেতরেও। কেঁপে গেলাম আপাদমস্তক। ইয়েস! মনে পড়েছে, কেরালার কোদিনহি গ্রাম, খবরের কাগজে পড়েছিলাম, কোনও এক অজানা কারণে পৃথিবীর মধ্যে সব থেকে বেশি যমজ সন্তানের জন্ম দেয় ওই গ্রামের মানুষ।

আকাশ ছেয়ে গিয়েছে কালো মেঘে। শুরু হয়েছে এলোমেলো হাওয়া। আমি একবার মিলিকে দেখছি, একবার জুলিকে। হুবহু এক চেহারা। তফাত শুধু চোখে।

মধ্যস্তর

ইদানীং আমার কোনও নিমন্ত্রণ বাড়ি যেতে ভালো লাগে না। সব বিষয় ভালোলাগার বোধহয় একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে। সেই সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলেই বিষয়গুলো অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। আমার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। চল্লিশ বছরের দোরগোড়ায় এসে আর আড্ডা হই-হুল্লোড় সবই কেমন যেন ফ্যাকাশে লাগে। আমার সঙ্গে বড়োই বেমানান যেন এগুলো। এই কারণে গত দশ বছরে আমার বিরুদ্ধে দুটো দল তৈরি হয়েছে। এক দল হল আমার গুটিকয়েক আত্মীয়স্বজন। অপর দল হল আমার কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব।

প্রথম দলের মুখে আমার বিরুদ্ধে শুনেই থাকবেন যে, আমি নাকি বড়োই অসামাজিক বা আনসোশ্যাল। এই অভিযোগের বিরুদ্ধে আমার অবশ্য কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। এর কারণ আমার তর্ক-বিতর্ক করতে ভালো লাগে না। তাই আমি নির্বিকার।

দ্বিতীয় দলের আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ এই যে, আমার প্রেমিকা আমার জীবন থেকে চলে যাবার পর এই দুরবস্থা। দেবদাসের মতো হাল আমার। আমার শূন্য জীবন আর কোনওদিন পূর্ণ হবে না এই বিশ্বাস তাদের। দ্বিতীয় দল অর্থাৎ ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের এই কথার উত্তর দেওয়াই যায়।

গত দশ বছরের আমি, আর এখনকার আমি-র মধ্যে অনেক তফাত। আমার ছন্নছাড়া জীবন থেকে, বেহিসেবি আদর অগ্রাহ্য করে প্রেমিকা যেদিন বারো বছরের সযত্নে লালিত ভালোবাসার সম্পর্ক থেকে মুক্ত হয়ে, আমায় মুক্ত করে চলে যায়- সেদিনের পর থেকে ভাগ্যদেবী আমার উপর সুপ্রসন্ন হন।

আমার জীবনে সাফল্যের গাড়িটা বেশ স্পিডেই চলতে থাকে। ব্যাংক ম্যানেজারের চাকরি, কলকাতায় ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাট, বত্রিশ বছর বয়সেই লেখক হিসাবে বিপুল জনপ্রিয়তা, চারচাকা গাড়ি– এই সবই আমার সাফল্যের ইঙ্গিতবাহী। শূন্য জীবন বলতে আমার বন্ধুবান্ধব যদি একাকিত্বকে খোঁটা দেয়, তাহলে বলতেই হয় ব্যস্ত জীবনে সে পূর্ণতার এই মুহূর্তে আমার বিশেষ প্রয়োজন নেই। শৃঙ্খলহীন জীবনের স্বাদ আমি পেয়েছি। দশ বছর ধরে নতুন স্বাদে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি।

যাইহোক আজ নিমন্ত্রণ রক্ষাটা আমার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। নিমন্ত্রণ নিয়ে পূর্বে আমার ভালো-মন্দ যাই অনুভতি থাকুক না কেন, সেটা এখানে ঠিক প্রযোজ্য নয়। আমার বন্ধুর তালিকায় চার বছর হল একটি নতুন বন্ধু নাম লিখিয়েছে। আমার উপস্থিতি বন্ধুটির কাছে যত না বন্ধু হিসাবে, তার চেয়ে ঢের বেশি জীবনদাতা হিসাবে। আমার কৃপায় জীবন লাভকারী বন্ধুটির নাম বিপুল মিত্র।

 

আমি আর আমার এক বন্ধু চার বছর আগে উত্তরাখণ্ড বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমাদের দেরাদুন যাওয়ারও কথা ছিল। চার দিনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু জায়গা ঘোরা আমাদের শেষ হয়েছিল। যেদিন আমাদের উত্তরাখণ্ড থেকে ফিরে যাবার কথা, সেদিন তুমুল বৃষ্টিতে ভযংকর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হই আমরা।

আমি এবং আমার বন্ধু যমুনোত্রী থেকে সতেরো-আঠারো কিলোমিটার দূরে হনুমানচট্টিতে ছিলাম। পাঁচদিনের লাগাতার বৃষ্টিতে প্রবল ধ্বস, ভযংকর প্লাবন হয় উত্তরাখণ্ডে। এই বিপর্যয়ে প্রায় সব রাস্তাই বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমরাও অন্য সকলের মতো আটকে পড়ি হনুমানচট্টিতে। ছয়দিনের দিন বৃষ্টি কমলে আমার বন্ধু খাবারের সন্ধানে ঘরের বাইরে বেরিয়ে খবর পায় যে, হনুমানচট্টি থেকে ত্রিশ-বত্রিশ কিলোমিটার দূরে বারকোট থেকে কিছু গাড়ি যাবার অনুমতি মিলেছে। ত্রিশ-বত্রিশ কিলোমিটার হেঁটে যদি আমরা সেখানে পৌঁছোতে পারি তাহলে একটা সুরাহা হবে।

আমি ভাবলাম যে এই একটা সুযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এখান থেকে বেরোতে হবে। মেঘের অবস্থা ভালো নয়। বৃষ্টি থেমেছে ঠিকই। কিন্তু যে-কোনও মুহূর্তে আবার নামতে পারে। আমি আমার বন্ধুর সঙ্গে বারকোট যাবার উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করলাম। প্রাণের দায়ে নিরলস যাত্রা শুরু করলাম আমরা। সংকীর্ণ চড়াই-উতরাই পথ। ধ্বস নামার ফলে রাস্তার বিপজ্জনক অবস্থা। যে-কোনও মুহূর্তে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। রাস্তা থেকে পা হড়কে পড়লে সোজা ভয়ানক সুন্দরী যমুনার জলে সলিল-সমাধি হয়ে যেতেই পারে। কারণ রাস্তা থেকে দেড়শ ফুট নীচে উদ্দাম খরস্রোতে বইছে যমুনা। উন্মত্তপ্রায় রূপ তার বৃষ্টির জলে ফুলে ফেঁপে।

আমার বন্ধুর সঙ্গে আমি সন্তর্পণে প্রায় পনেরো কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে এলাম। আমরা সেখানে এসে যা দেখলাম, তাতে টাগরা শুকিয়ে এল। মূল রাস্তা (যে রাস্তায় আমরা হাঁটছিলাম) ধসের ফলে কমপক্ষে এক কিলোমিটার ভেঙে যমুনার জলে মিশেছে। নীচে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম দেড়শো ফুট তলায় রাস্তা ভাঙার নুড়ি-পাথর-বালি ইত্যাদি পড়ে যমুনার উপর নরম একটা পথ তৈরি হয়েছে। ওই পথ ধরে এক কিলোমিটার হেঁটে আবার দেড়শ ফুট খাড়াই পথ উঠে মূল রাস্তায় পৌঁছোতে হবে আমাদের।

অন্য সকলের দেখাদেখি আমি নীচে নামতে শুরু করলাম। আমার রোগা শরীরকে নিয়ে আমি নুড়ি-পাথরের গায়ে হালকা চাপ দিয়ে নীচে নেমে এলাম। যমুনার জলের গর্জন আমার কানে এল। দু-একটা জলের স্রোত এসে লাগল আমার পায়ে আমার বন্ধু উপর থেকে লাগেজগুলো নীচে ফেলে দিল। আমি কোনওরকমে লাগেজগুলো পা দিয়ে আটকালাম। ভারী লাগেজ নিয়ে তার পক্ষে নামা কোনও ভাবেই সম্ভব ছিল না। বন্ধুও ধীরে ধীরে নেমে এল।

বন্ধুর ঠিক পেছনেই একটি গোলগাল, মোটাসোটা লোক নামছিল। অনেকটা ঢালু রাস্তা সে পেরিয়ে এসেছিল। তিন ফুটের মতো তার নামতে বাকি ছিল। এমন সময় নীচে প্রবহমান যমুনাকে দেখতে গিয়ে পা হড়কে তার শরীরের অর্ধেকাংশ পড়ল যমুনার জলে। যমুনার স্রোতে লোকটি তলিয়ে যাচ্ছিল। সে হেল্প হেল্প বলে
চিৎকার করায়, আমি আমার প্রাণপণ শক্তি দিয়ে তাকে উদ্ধার করি। উদ্ধার করেই ক্ষান্ত হই না, বাকি রাস্তাও তার খেয়াল রাখি। লোকটি আমার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। আমার সেই নতুন বন্ধু বিপুল মিত্র।

আজ বিপুল মিত্রের বাড়িতে তার বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আমার নিমন্ত্রণ। সল্টলেকে বিপুল মিত্রের বাড়ি। আমার ফ্ল্যাট আবার সাউথ সিটিতে। বিপুল পেশায় উকিল। নামজাদা উকিল এবং ডাক্তারদের নাকি কোনও সময় থাকে না। আমি একথা বহুকাল আগে শুনেছিলাম। কিন্তু বিপুলের তো নাম ও সময় দুই-ই আছে দেখছি! তাই এই বয়সেও আমোদ-আহ্লাদ সে করতে পারে। আমার থেকে বিপুল বয়সে কমপক্ষে সাত-আট বছরের বড়ো হবেই।

আমার তো বিপুলের মতো সৌভাগ্য নেই। সারা দিন-রাত কোনও না কোনও কাজে ব্যস্ত থাকি। কাজের চাপে অবসর যেটুকু পাই সেটুকু সময় আমোদ-আহ্লাদ আর পোষায় না। বিপুলের বাড়ি যাবার তাড়ায় বিকাল থেকে সমস্ত কাজ থেকে নিজেকে মুক্ত করেছি।

বিবাহবার্ষিকীর পার্টিতে যাবার জন্য জমকালো সাজে আমি নিজেকে সুসজ্জিত করলাম। সাদা শার্ট, নীল ব্লেজারে আমি আমার নরম শরীরকে বন্দি করলাম। টাকাপয়সা হওয়ায় আমার চেহারায় পূর্বের দৈন্যদশা নেই। বরং স্লিম শরীরে বেশ একটা জৌলুস আছে। গায়ের রং ফরসা। উচ্চতা ভালো। এই সব মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে নায়কদের থেকে আমি কোনও অংশে কম নই অভিনয়-গুণ ছাড়া! আমি নিজে ভালো ড্রাইভিং জানা সত্ত্বেও স্টেটাস মেইনটেন করতে ড্রাইভার সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে করে সন্ধ্যায় হাজির হলাম বিপুলের ডাকে।

আমি যখন পৌঁছোলাম পার্টিতে বিপুলের কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব আসতে শুরু করেছে। আমি ভিতরে ঢুকতেই একটা উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলাম। বিপুল ওর বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। ব্যাংক ম্যানেজার হিসাবে কেউ এখানে না চিনলেও, লেখক হিসাবে আমাকে অনেকেই চেনে দেখলাম। ফলে কিছু সই খরচ করতেই হল। আমার বুকের ছাতিটা গর্বে একটু চওড়াই মনে হল! বিপুলের কিছু আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেও আলাপ হল।

এর পর বিপুল আমাকে নিয়ে গেল বিবাহবার্ষিকী অনুষ্ঠানের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে যে রয়েছে, তার সঙ্গে আলাপ করাতে। সে হল বিপুলের স্ত্রী। বিপুল তার স্ত্রীর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে আমাকে বলল আমার বন্ধু সুনন্দ সেন। হি ইজ অ্যা পপুলার রাইটার। বিপুল আমাদের দুজনকে কথা বলতে বলে অন্যদিকে চলে গেল।

দীপান্বিতাকে সৌজন্যবশত আমি মুখ নীচু করেই বললাম নমস্কার।

দীপান্বিতা নরম গলায় বলল, বিপুলকে উত্তরাখণ্ডে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ। আমি শুনেছি সব।

আমি বললাম এটা তো আমার কর্তব্য। যদি মানুষ হয়ে মানুষের উপকার না করি তাহলে কীসের মানুষ! বিপুলের জায়গায় যে-কেউ থাকলে আমি একই কাজ করতাম।

বিপুল আমার আর দীপান্বিতার কথার মাঝে এসে বলল সত্যিই তুমি আমার জীবনদাতা। দীপান্বিতাকে বিপুল বলল দেখো, স্পেশাল খাতির কোরো।

কথাটা শেষ করে এই প্রথম আমি দীপান্বিতার দিকে তাকালাম। বহু পরিচিত এক মুখ। তবু কেমন যেন অচেনা। দীপান্বিতা অপূর্ব সুন্দরী, শিক্ষিতা। দুধের মতো গায়ে রং। মাঝারি উচ্চতা। দামি লাল গাউনে পরির মতো লাগছিল দীপান্বিতাকে। যত সুন্দরী মেয়েই হোক না কেন, মেক-আপ ছাড়া সাজ বোধহয় মেয়েদের ধাতে নেই। দীপান্বিতাও তার ব্যতিক্রম নয়। কমপ্যাক্ট, ব্লাশার, আই লাইনার, মাসকারা এসব কৃত্রিম উপাদানের সাহায্যে সে নিজেকে আরও মোহময়ী করে তুলেছে। নিশ্চয়ই শহরের কোনও নামি বিউটিশিয়ান তাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে এই বিশেষ দিনটিতে। বাদামি রঙের ঘন স্ট্রেট চুল পিঠ ছুঁয়ে শেষ হয়েছে। এই কৃতিত্বও বোধ হয় বিউটিশিয়ানের।

দীপান্বিতা বিপুলকে বলল তুমি কোনও চিন্তা কোরো না। উনি কেন, এখানে আমন্ত্রিত কোনও ব্যক্তির যত্নের কোনও ত্রুটি হবে না। আমি ভাবলাম যে আমি এবং অন্য আমন্ত্রিত অতিথি দীপান্বিতার কাছে আজ এক! হয়তো এই মুহূর্তে তাই। পূর্বের কথা বাদ রেখে ওর তো এটা মনে করা উচিত ছিল যে আমি তার স্বামীর জীবনদাতা। দীপান্বিতার মনুষ্যত্বের উপরেও কি মেক-আপ পড়েছে! সময় তার সত্তায় হয়তো স্তরে স্তরে মেক-আপের দ্বারা সরল মানসিকতাকে চাপা দিয়েছে। রং মেখে ভালোই অভিনয়ে মেতেছে দীপান্বিতা।

আমিও কিছু কম যাই না। দীপান্বিতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় না করতে পারি, ওর কথার উত্তরে কথা চালিয়ে যেতেই পারি। নায়কোচিত চেহারা আমার, আগেই বলেছি। আমি সহাস্যে বিপুলকে বললাম এত বড়ো আয়োজন করেছ তুমি। ত্রুটির কথা ভাবছ কেন! আর তাছাড়া আমি তো নিজের লোকের মতো।

দীপান্বিতা চুপ করে বসেছিল এতক্ষণ। আমার কথা ঘুরিয়ে দিয়ে সে বলল কেমন আছেন আপনি?

দীপান্বিতার এই কথাটা যেন তিরের ফলার মতো বিঁধল আমার বুকে। আপনি সম্বোধনটাও বড়ো ভারী লাগে বইতে। দীপান্বিতা আমায় এতদিন পর আপনি সম্বোধনে জর্জরিত করবে ভাবিনি। আমি পাতলা হেসে উত্তর দিলাম ভালো। বেশ ভালো।

দীপান্বিতা ঠোঁট উলটে বলল তা শুনলাম আজকাল আপনি সাউথ সিটিতে থাকছেন।

আমি বললাম হ্যাঁ, ওখানে একটা ফ্ল্যাট নিয়েছি।

দীপান্বিতা কেমন যেন তাচ্ছিল্যের সুরে বলল ওয়াইফ জোটেনি বুঝি? আপনার ঘর, সংসার আর কি!

এই কথাটা আমাকে আঘাত দিল। সত্যিই তো আমি একা। ছেলেদের বোধ হয় মেক-আপ ঠিক সহ্য হয় না। দীপান্বিতার মতো আমি যদি মেক-আপ দিয়ে আমার অতীতকে ঢেকে দিতে পারতাম, তাহলে এই বর্তমানটা কত ভালো হতো। তা আর পারলাম কোথায়! আঘাতের পর আঘাত হয়তো আমার জন্য পড়ে আছে এই দিনে। আমি নীচু গলায় বললাম আমি একা। একা থাকতেই পছন্দ করি।

আমার কথায় বিপুল হেসে বলল একা থাকা ভালো। স্বাধীনতাটাকে বড়ো বেশি এনজয় করা যায়। আমি সংক্ষেপে বললাম একদম তাই।

দীপান্বিতা হঠাৎই শশব্যস্ত হয়ে বিপুলকে বলল চলো ওদিকে। এক জায়গায় বসে থাকার সময় আছে আজ! তোমার অন্য সব বন্ধুদের অ্যাটেন্ড করতে হবে তো! কী ভাববে বলো তো তোমার বন্ধুরা! এতটা সময় কেটে গেল। ওরা ভাববে নিমন্ত্রণ করে বিপুল পাত্তাই দিচ্ছে না।

বিপুল আমাকে বলল সুনন্দ, এটা নিজের বাড়ি মনে করে দেখেশুনে নিও। খাবার খেতে শুরু করেছে অনেকেই। তুমিও খেয়ে নিতে পারো। আমরা ওদিকে যাচ্ছি। কিছু প্রয়োজন হলে জানিও। দীপান্বিতা বিপুলের ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে আমার সামনে দিয়ে চলে গেল।

আমার কাছ থেকে দীপান্বিতা বিদায় নেবার পর আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। বিপুল আমায় প্রয়োজনের কথা জানাতে বলল। দীপান্বিতার দেওয়া এই আঘাতটা আমার খুব প্রয়োজন ছিল। বারো বছরের সম্পর্ক ভাঙার আঘাত আমি সহ্য করে নিয়েছিলাম। কিন্তু দীপান্বিতার এই আঘাতটা অসহনীয় লাগল আমার।

আগে আমি ছিলাম। দীপান্বিতাও ছিল। এখন আমিও আছি। দীপান্বিতাও আছে। শুধু আমার হাতে সুসময় নেই। দীপান্বিতার উপর আমার আজ কোনও অধিকার নেই। দীপান্বিতাকে চাইলেও আজ আমি ছুঁতে পারব না। দূরের নক্ষত্রের মতো সে বিপুলের ঘরে জ্বলছে। দীপান্বিতা আপনি সম্বোধনে আমাকে আমার জায়গাটা আজ বুঝিয়ে দিয়েছে।

দীপান্বিতাকে ঘিরে নানা ভাবনায় আমি নিমজ্জিত ছিলাম। এমন সময় একটি ছেলে ট্রেতে বিদেশি মদ নিয়ে এসে আমায় বলল স্যার, কিছু লাগবে? আমি স্মিত হেসে বললাম লাগবে। অনেকগুলো গ্লাস লাগবে।

ছেলেটি বলল নিন স্যার। ছেলেটিকে দাঁড় করিয়ে আমি এক চুমুকে ছটা গ্লাস এক এক করে শেষ করলাম। ছেলেটি সঙ্কুচিত মুখে বলল স্যার, এটা হার্ড ড্রিংক। এত খেয়ে ফেললেন। অভ্যাস না থাকলে বাড়ি ফিরতে অসুবিধা হবে।

ছেলেটির কথা শুনে ভাবলাম, আমার জীবনে একসময় অনেক কিছুই অভ্যাস ছিল না। আমি নিজে চিরকাল মদকে ঘেন্না করেছি। জীবনে কখনও ছুঁইনি। আজ ছুঁলাম। আমার অতীতকে ধুয়েমুছে সাফ করে দিতে এটার প্রয়োজন ছিল। দীপান্বিতার সঙ্গে কোনও পুরুষকে দেখা আমার অভ্যাস ছিল না। আজ অভ্যেস হল সেটা। মদকে অভ্যাসে পরিণত করতে বোধহয় এত বেশি যন্ত্রণা হবে না। ছেলেটি আমার কাছ থেকে বিদায় নিল।

আমি নতুন অভ্যাসের বশবর্তী হয়ে খিদে তেষ্টাই ভুলে গেলাম। চলতে গিয়ে পা টলমল করায় আমি বুঝলাম নেশাটা ভালোই হয়েছে। বিপুলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে টলমল পায়ে আমি গাড়ির কাছে পৌঁছোলাম। ড্রাইভার বেচারা আমারই অপেক্ষায় বসে আছে। গাড়িতে ওঠার আগে আমি বিপুলের বাড়ির ঝলমলে আলোর দিকে ঢুলুঢুলু চোখে একবার তাকিয়ে শূন্যের বুকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। আমার ড্রাইভার আমাকে বলল স্যার, উঠুন গাড়িতে। রাত হয়েছে। পৌনে এগারোটা বাজে।

আমার ঘোলাটে দুচোখের কোণে একটু জল এসেছিল। আমি তা নিয়ন্ত্রণ করে গাড়িতে উঠতে যাব এমন সময় কেউ একটা সাদা হাত এগিয়ে দিয়ে বলল এক্সকিউজ মি। ওয়ান অটোগ্রাফ প্লিজ। আমি ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম দীপান্বিতা মিত্র, বিপুল মিত্রের সুন্দরী স্ত্রী। আমি বুক পকেট থেকে আমার কম দামি পেন বার করে দীপান্বিতার দামি নরম হাতের তালুতে কোনওরকমে নিজের নামটা লিখলাম সুনন্দ সেন। আমার পেন সার্থক হল দীপান্বিতার স্পর্শ পেয়ে।

আমাকে দীপান্বিতা বলল মদ খাওয়া তোমার অভ্যাস ছিল না। ইদানীং নামযশ করে স্ট্যাটাস বজায় রাখতে খাচ্ছ বুঝি! এটাকে অভ্যাস করে ফেলো না যেন। ভালো জিনিস তো নয়। আমি মুখ নীচু করে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।

দীপান্বিতার মুখ থেকে বহুদিন পর তুমি সম্বোধনে, ওর কাছে আসায় আমার নেশা কিছুটা কেটে গিয়েছিল। আমি অভিমানী গলায় বললাম সময় বদলালে মানুষও বদলায়। কাকে অভ্যাসে রাখব কাকে অবকাশে, তা নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

দীপান্বিতা আমার কথা শেষ হতেই ঝড়ের বেগে অপ্রত্যাশিত ভাবে আমার গালে চুমু খেল। হালকা আলো-আঁধারি পরিবেশে ওর মুখে একটা অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠে মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। তারপর ও ছুটতে ছুটতে আলোর ভিড়ে কোথায় হারিয়ে গেল। আমার গালে এত বছর পর দীপান্বিতার দেওয়া লাল লিপস্টিকের ছাপটা চিরস্থায়ী ক্ষতর মতো রয়ে গেল। সেই অলিখিত মুহূর্তের সাক্ষী একমাত্র আমার বিশ্বস্ত ড্রাইভার। আঘাতের পর আঘাত, ক্ষতর উপর ক্ষত নিয়ে আমি গাড়িতে উঠলাম!

প্রহেলিকা

( এক )

মেয়েটা আজও এসেছে। ওর ব্যাগ থেকে একে একে বার করে ফেলছে জাংক জুয়েলারি, নেলপলিশ, লিপস্টিক আর শিফনের সুন্দর সুন্দর স্কার্ফ। কমবয়সী টিচাররা হামলে পড়েছে সে সব কেনার জন্য। মেয়েটা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, এমনিতেই কম কথা বলে। অহনা স্টাফরুমে ঢুকে জলের বোতল খুলে ঢকঢক করে কিছুটা জল খেল, ইলেভেনের ক্লাসে এত মেয়ের মধ্যে চিৎকার করে গলা শুকিয়ে গেছে। বড়দিকে বলতে হবে ইলেভেন, টুয়েভ-এর ক্লাস দুটিতে মাইক্রোফোনের ব্যবস্থা করতে।

জলের বোতল নামিয়ে রাখতেই মেয়েটার সঙ্গে চোখাচোখি হল। মেয়েটা অন্যদিনের মতোই তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অদ্ভুত সেই দৃষ্টি। মেয়েটাকে এই জন্যই তার অপছন্দ এত। আর কারুকে না, শুধু তার দিকেই তাকিয়ে থাকে এইভাবে। প্রথমবার, অহনা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হেসেছিল। মেয়েটি কিন্তু না হেসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল শুধু। একটু পরে অহনার মুখের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছিল।

লোপা লাফাতে লাফাতে এল, এই অহনাদি, স্কার্ফটা বেশ সুন্দর না? বেগুনির উপর সাদা ফুল ছাপ। হ্যাঁ দেখতে বেশ সুন্দর, আর দামটাও রিজনেবল। অহনার ইচ্ছা করে পিয়ার জন্য গোটা দুই স্কার্ফ নিতে। কিন্তু না, এই মেয়েটার কাছে সে একটাও জিনিস কিনবে না। ওকে দেখলেই তার আপাদমস্তক জ্বলে ওঠে।

তুমি এবার অনেকদিন পরে এলে, সব খবর ভালো তো? আভাদির কথায় মেয়েটি বলে, পরীক্ষা নিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলাম।

কী সাবজেক্ট যেন তোমার?

মিউজিক নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করছি, সেকেন্ড ইয়ার।

মেয়েটিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে অহনা। খুব রোগা, কাগজের মতো ফর্সা। সাজগোজও কেমন অদ্ভুত! নীল রঙের কাজল আর রানি রঙের লিপস্টিক ওর কাগজের মতো ফর্সা শরীরে একটা বিভীষিকা বুনে দিচ্ছে। মেয়েটা কি বোঝে না, ওকে এইরকম সাজে জঘন্য লাগে!

লোপা কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতেই থাকে, অহনাদি, কানের দুলগুলো দেখেছ, সব তোমার টাইপ, এসব জিনিস একমাত্র তুমিই ক্যারি করতে পারবে। অহনার দম বন্ধ হয়ে আসে। লোপা তাকে তোষামোদ করে বলছে না। আসলে এই চুয়াল্লিশেও অহনা হাঁটুর বয়সী মেয়েদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জিতে যাবার মতো স্টাইলিশ। অন্য সময় হলে এই প্রশংসাগুলো এনজয় করত সে। কিন্তু একটু আগেই লোপার কথা শুনে মেয়েটার ঠোঁটের রেখা যে-ভাবে বেঁকে উঠল, তা দেখেই অহনার মাথায় রক্ত উঠে গেছে। মেয়েটার বড্ড অহংকার, একদিন টিফিনের সময় অহনা সবার জন্য খাবার অর্ডার করেছিল, পিয়ার জন্মদিন উপলক্ষ্যে। নিজে প্লেট সাজিয়ে মেয়েটার হাতে তুলে দিতে গিয়েছিল, মেয়েটা অবহেলা ভরে সেসব সরিয়ে রেখে বিক্রিবাটা সেরে ওড়নার ঝাপটা তুলে গর্বিত ভঙ্গিতে বেরিয়ে গিয়েছিল, আর অহনার সারা শরীর চিড়বিড় করে উঠেছিল।

( দুই )

কী রে আবার বেরিয়েছিলি তুই দুপুরে?

গাঢ় সবুজ রঙের নেলপলিশের শিশিটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল মেহুলী। বাবার কথা শুনে একবার তাকিয়ে আবার শিশিটাতে মন দিল।

উত্তর দিচ্ছিস না যে, মালতী বলছিল তুই নাকি কলেজ বাংক করলি শরীর খারাপের বাহানায়, তারপর ব্যাগ নিয়ে কোথায় বেরিয়ে গিয়েছিলি! তোর ব্যাগে ওইসব হাবিজাবি সাজগোজের জিনিস কেন? কোথায় যাস ওসব নিয়ে?

টেবিলের উপর ঠকাস করে নেলপলিশের শিশিটা নামিয়ে রাখে মেহুলী। চিৎকার করে ডাকে মালতীকে, তোমায় না মটরশুঁটির কচুরি আর আলুরদম বানাতে বলেছিলাম? বাপির আর আমার দুজনেরই প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। মালতীকে বেশি ডাকাডাকি করতে হয় না, বড়ো ট্রেতে করে সে খাবার সাজিয়ে নিয়ে আসে। মেয়ের রকমসকম দেখে শ্যামল হেসে ওঠে। খাওয়াদাওয়ার মাঝে মেয়ের সঙ্গে টুকটাক কথা হয়, মেয়ের পড়াশানোর খবর নেয় শ্যামল। কিন্তু মাঝে মাঝেই ব্যাগ ভর্তি জিনিস নিয়ে মেয়েটা কোথায় যে যায়, থই পায় না শ্যামল।

( তিন )

অহনা ভাবে মেয়েটা অনেকদিন আসে না আর। লোপারা বলছিল কবে ম্যাট ফিনিশ লিপস্টিকের অর্ডার নিয়ে গেছে, এখনও এল না। কিছুদিন আগেই তো পরীক্ষা শেষ হয়েছে বলল, তাহলে কি মেয়েটা অসুখে পড়ল! অহনা দেখে মেয়েটার ওই কর্কশ অভিব্যক্তিই তার মনে বেশ ছাপ ফেলে গেছে। নিজের অজান্তেই বলে বসল, ফোন করে একটা খবর নিতে পারিস তো! তা কী আর করা হয়নি, সিমটা খুলে রেখেছে মেয়ে৷ অহনা আর কথা বাড়ায় না। লাস্ট পিরিয়ডে পড়াতে পড়াতেই দেখতে পায় কালো মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে আকাশ। মেয়েরা উশখুশ করছে। পড়াতে পড়াতে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যায় অহনা।

অহনা বড়ো রাস্তা অবধি পৌঁছোনোর আগেই মুষলধারায় বৃষ্টি নামল। কোনওরকমে একটা ভর্তি অটোতে নিজেকে ছুড়ে দিল। কুড়ি মিনিটের রাস্তা পৌঁছোনোর আগেই ভিজে চুপচুপে হয়ে যাবে। মাঝপথে গিয়ে অটোচালক জানিয়ে দিল রাস্তায় জল জমেছে, ইঞ্জিনে জল ঢুকে যাবে, সে আর যাবে না। সহযাত্রীরা যে যার মতো ব্যবস্থা করে নিয়েছে। অহনা আশেপাশে তাকিয়ে দেখে একটাও শেড নেই, অগত্যা ছোটো ছাতাটি ভরসা করে দাঁড়িয়ে থাকে। হাওয়ার দাপটে ছাতার অবস্থাও শোচনীয়। সেই মুহূর্তেই একটা গাড়ি ব্রেক কষে তার সামনেই দাঁড়াল।

-আপনি?

– উঠে আসুন প্লিজ, এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজলে তো বিপদ বাধাবেন।

চমকে তাকায় অহনা, সেই মেয়েটা, নামটা কিছুতেই মনে করতে পারে না।

আরেকবার বলতেই অহনা মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর পাশের সিটে বসে পড়ল। মেয়েটাকে অসহ্য লাগলেও তীব্র একটা আকর্ষণও যে বোধ করে সে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু ঝোলা-কাঁধের সেলস গার্ল মেয়েটা আর দামি গাড়ি ড্রাইভ করা মেয়েটাকে ঠিক মেলাতে পারে না অহনা। লক্ষ্য করে দেখে মেয়েটার ঠোঁট দুটো তাচ্ছিল্যে কেমন বেঁকে গেছে।

সামনেই আমার বাড়ি, গা মাথা মুছে নিয়ে কফি খেতে খেতে বৃষ্টি থেমে যাবে। অহনা জিজ্ঞেস করল, তুমি… মেয়েটি মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ আমিই আপনাদের স্কুলে যাই, ওটা বাপিকে লুকিয়ে পকেট মানির জন্য করি।

শুকনো তোয়ালেতে গা মাথা ভালো করে মুছে নেয় অহনা। মেয়েটি কিন্তু একবারও শাড়িটা পালটাবার কথা বলল না। কফির কাপ হাতে অহনা ঘুরে ঘুরে দেখছিল ইন্ডোর প্ল্যান্ট-এর কর্নারটা। মেয়েটির মুখোমুখি হতে জিজ্ঞেস করল, তোমার মা কি বাড়িতে নেই? স্থির দৃষ্টিতে অহনার মুখের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে মেয়েটি বলে, আসুন আমার সঙ্গে।

অহনা এখন বড়োসড়ো একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে৷ মেয়েটির মায়ের ছবি। ছাইছাই রঙা শাড়ি, রানি কালারের ব্লাউজ, রানি কালারের লিপস্টিক আর নীল কাজলরেখা। অত্যন্ত রোগা আর কাগজের মতো সাদা মুখ। ফটোতে শুকনো একটা মালা ঝুলছে।

মেয়েটি চিৎকার করে বলে ওঠে,

-মালতী মাসি কতদিন মায়ের ছবির মালাটা বদলাওনি, কাল একটা নতুন মালা কিনে এনো।

অহনা বেরিয়ে আসে। মেয়েটি বলে, আমার নাম টুপুর, এটাই মনে হয় জিজ্ঞেস করছিলেন তখন? সেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেয়েটা। অহনা পালিয়ে বাঁচে।

 

গভীর রাত্রে সুদীপের পাশ থেকে উঠে আসে অহনা। পুরোনো বইয়ের ভাঁজ থেকে একটা ছবি বার করে। ছাইছাই শাড়ি, রানি ব্লাউজ, রানি লিপস্টিক আর নীল কাজল পরা অহনা। টুপুর আর শ্যামলের কাছে সে মৃত। একরত্তি মেয়েটাকে ছেড়ে আসার বদলা এভাবে নিল টুপুর! গলার কাছে কষ্টটা দলা পাকিয়ে যায়।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব