চিরসখা হে

রত্নাবলী ওড়নাটা আর একবার ভালো করে গলায় জড়িয়ে নিল। সকালে মুখ ধোওয়ার সময় ঝাপসা ঘুমচোখে অত নজরে পড়েনি, খাওয়ার টেবিলে ঋষির মিটি মিটি হাসি দেখেই কিছু একটা সন্দেহ হয়েছিল।

– কী দেখছ অমন করে? মুখে ডিম লেগে আছে না কি?

– উঁহু। ঋষির হাসিটা আর একটু চওড়া হয়েছিল।

তখনই সন্দেহ হয়েছিল। টেবিল ছেড়ে উঠে গিয়েছিল তক্ষুনি রত্নাবলী। আয়নায় তাকাতেই চক্ষুস্থির। গলার ডান দিকে কণ্ঠার হাড়ের নীচটায় বেশ বড়োসড়ো একখানা লাল দাগ। কাল রাত্তিরে ঋষির কাণ্ড। রাগতে গিয়েও হেসে ফেলে রত্নাবলী।

– কী যে করো না। বয়েস দিনদিন কমছে না বাড়ছে?

– এটা তো সরাসর না-ইনসাফি হয়ে গেল ম্যাডামজি, বউকে আদর করার সঙ্গে বয়সের কী সম্পর্ক?

– ফিল্মি ডায়লগ মেরো না তো। রত্নাবলীর চোখে হাসি চিকচিক করে।

– আরে, ডায়লগ কোথায় মারলাম? সত্যি বলছি তো। আমি নব্বই বছর বয়সেও তোমাকে এমনি করেই আদর করব, দেখে নিও। চোখ টেপে ঋষি।

– থাক, হয়েছে। কত ক্ষমতা দেখা যাবে তখন।

– কী মুশকিল, ফিজিক্যালি কিছু করতেই হবে কে বলল, নব্বইয়ে পৌঁছে তো সবই মনে মনে। ঋষি ছাদ ফাটিয়ে হাসে। রত্নাবলী গম্ভীর থাকার ব্যর্থ চেষ্টা করে।

– তা বলে একটু খেয়াল থাকবে না? অফিস যাব কী করে বলো তো? পুপুর চোখেও তো পড়তে পারে?

– অফিসের লোক তোমার গলার দিকে তাকাবে কেন? আর তাকালেই বা কী? সবার হিংসে হবে তোমায় দেখে।

এ পাগলকে কে বোঝাবে। অগত্যা একটা দোপাট্টাকেই আচ্ছা করে গলায় পেঁচিয়ে রাখতে হচ্ছে সারাদিন ধরে। মাঝে মাঝেই হাতের আন্দাজে টেনেটুনে দেখে নিচ্ছে রত্নাবলী, জায়গামতো আছে কি না সেটা।

বেশকয়েক বছর হয়ে গেল, বিবাহসূত্রে পুনেতেই বসবাস করছে রত্নাবলীর পরিবার৷ সকাল থেকে আজ কাজের খুব চাপ চলছে রত্নাবলীর, মাথা তোলার সময়ই পাওয়া যাচ্ছে না প্রায়। গোটা পুনে কি আজই ভেঙে পড়েছে লোন নিতে? ব্যাগে রাখা মোবাইলখানা যে কতবার কত বার্তা আসার সংকেত দিয়েছে তার হিসেব নেই। একটা সময় রত্নাবলীকে বাধ্য হয়েই ফোনকে নীরব করে রাখতে হল। বার বার টিংটং, মনঃসংযোগ ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে।

রত্নাবলীর টেবিলের সামনে রীতিমত লাইন, একজন চেয়ার ছেড়ে উঠতে না উঠতেই আর একজন বসে পড়ছে। এর মধ্যেই হঠাৎ গোলমাল, কে নাকি লাইন অগ্রাহ্য করে একেবারে ম্যাডামের সামনে চলে এসেছে। রত্নাবলী তর্কাতর্কি শুনে চোখ তুলে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল।

– আরে, কিরণভাউ, তুমি এখানে? হোয়াট আ সারপ্রাইজ। এই ব্যাংকে তোমার অ্যাকাউন্ট আছে জানতাম না তো?

সদাহাস্যময় কিরণ জোশির এত গম্ভীর মুখ কেউ কখনও দেখেনি। ঋষির শুধু সহকর্মীই নয় সে। চাণক্য শ্লোক অনুসারে প্রকৃত বন্ধুর সংজ্ঞা দিতে গেলে অন্য কিছুর দরকার হবে না, এই কিরণকে দেখিয়ে দিলেই চলবে। উৎসব থেকে শ্মশানঘাটে, ঋষির সমস্ত পাগলামি হাসিমুখে সামলানোর লোক এই একজনই, কিরণ গণপত জোশি। কিন্তু আজ তার গোলগাল মুখে হাসির একটা হালকা রেখাও নেই।

– ফোন তুলছ না কেন বহিনী? মেসেজ চেক করছ না। চলো, যেতে হবে।

এই ‘বহিনী’ সম্বোধনটা কী যে মিষ্টি লাগে রত্নাবলীর। তার বাঙালি কানে সে ধরে নিয়েছিল বহিনী মানে বোনটোন কিছু হবে। ঋষির বন্ধুদের অনেকেই যে তাকে বহিনী ডাকে তাতে সে দিব্যি খুশি ছিল। কিরণই ভুল ভেঙে দিয়েছিল তার। বহিনী মানে যে বউদি সেটা কিরণের কাছেই শেখা। তা বোন, বউদি সবই চলে রত্নাবলীর। কিন্তু আজকের মতো এত গম্ভীর বিষণ্ণ মুখে কিরণ কোনওদিনও বহিনী ডাকেনি তো তাকে।

– যেতে হবে মানে? কোথায় যাব এখন? দেখছ না কী চাপে আছি।

– ওসব ছাড়ো, পরে হবে।

হঠাৎ বুকটা কেঁপে ওঠে রত্নাবলীর। – কী হয়েছে কিরণভাউ? কী বলতে এসেছ? ঋষি না পুপু, কার কী হল?

– তুমি চলো আমার সঙ্গে বহিনী, যেতে যেতে বলছি। এখানে সময় নষ্ট কোরো না।

কিরণের তাড়াহুড়োতে রত্নাবলীর আরওই সবকিছু গুলিয়ে যেতে থাকে। কোনওরকমে পাশের ডেস্কের অনিশাকে পেন্ডিং কাজগুলো হ্যান্ডওভার করে উঠে আসে সে। লাইনে দাঁড়ানো লোকগুলো সম্ভবত বুঝতে পারে একটা কিছু ঘটেছে, তারা আর বাধা দেয় না তাকে।

কিরণের পেছন পেছন লিফটের দিকে যেতে যেতে আবার কী মনে পড়ে তার, ব্যাগের মধ্যে এলোমেলো হাতড়াতে থাকে।

– চাবিটা? স্কুটারের চাবিটা?

– আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি বহিনী, স্কুটার থাক এখন এখানেই।

রত্নাবলীর বুকের ভেতর একটা অসহ্য ধকধক করতে থাকে, গলা শুকিয়ে আসে। কী ভয়ংকর সংবাদ শোনাতে এসেছে তাকে কিরণ? পুপুটার কিছু হল কি? শরীরটরির খারাপ হল হঠাৎ? কিন্তু পুপুর কিছু হলে স্কুল থেকে তাকেই তো ফোন করবে। তারপরেই তার মনে পড়ে ফোন বন্ধ করে রেখেছিল সে। ঠিক আছে, তাকে না পেলে ঋষিকে করবে। দুজনেরই নম্বর দেওয়া আছে তো স্কুলে। তাহলে? তাকেও যোগাযোগ করতে পারেনি, ঋষিকেও পায়নি? ঋষিকে ফোনে পাওয়া যায়নি? না যেতেই পারে। মিটিং-এ থাকলে ঋষি ফোন ধরে না। কিন্তু, কিরণকে কেন, কিরণকে কোথা থেকে? কিরণ একেবারে তাকে নিতে কেন চলে এল ব্যাংকে? মাথাটা কেমন যেন করে ওঠে তার।

কিরণ গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে ছিল, কোনওরকমে উঠে বসে সে। ওপাশে ঘুরে গিয়ে ড্রাইভারের আসনে কিরণ বসতে না বসতেই সে আবার জিজ্ঞাসা করে,

– কী হয়েছে কিরণভাউ? ঋষির কিছু? অ্যাক্সিডেন্ট? প্রশ্নটা করতে গিয়ে তার স্বর আটকে আসে।

– না বহিনী। অ্যাক্সিডেন্ট নয়।

– তবে?

– যতদূর মনে হয় সেরিব্রাল অ্যাটাক। স্ট্রোক।

– মনে হয় মানে? ঠিকঠাক না জানলে অত বড়ো কথাটা বলছ কেন? আর ঋষির স্ট্রোক হতে যাবে কেন? এই বয়সে? প্রেসার ফেসার কিচ্ছু নেই।

– জানি না বহিনী, আমি তো ডাক্তার নই। কিরণ গম্ভীর মুখেই জবাব দেয়। তার চোখ সামনের রাস্তায়। পুনের মাথা খারাপ করা ট্র্যাফিক কাটিয়ে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে পৌঁছোতে চেষ্টা করছিল সে।

– কী হয়েছে আমাকে একটু পরিষ্কার করে বলবে কিরণভাউ? সেই তখন থেকে কীরকম ভাসা ভাসা কথা বলে যাচ্ছ। রত্নাবলীর উদ্বেগের সঙ্গে অসন্তোষ মেশে এবার।

– বললাম তো, অফিসে স্ট্রোক মতো হয়েছিল, হাসপাতালে রিমুভ করা হয়েছে। স্টেবল আছে। কোনও প্রসিডিওর শুরু করার আগে ডাক্তার নেক্সট অফ কিনের পারমিশন চাইছেন। তুমি নিজে গিয়েই দেখবে।

স্ট্রোক? ঋষির? এখনও তো পঞ্চাশ হতে চার মাস বাকি তার, এর মধ্যেই সেরিব্রাল অ্যাটাক? মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে রত্নাবলীর।

চারিদিকে নল লাগানো অচেতন শরীরটাকে প্রথমে ঋষি বলে চিনতে পারেনি রত্নাবলী। ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটের কাচের দেয়ালের বাইরে দাঁড়িয়ে আকুল হয়ে সে খুঁজছিল ঋষিকে। চেনা মুখটাকে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়ে সে কিরণের দিকে ফেরে। কিরণের আঙুল যে-শয্যাটির দিকে দেখাচ্ছিল, তার ওপরে শোওয়ানো ঋষিকে দেখে এক পলকের জন্য রত্নাবলী টলে যায়। এই পাথরের মতো স্থির, ফ্যাকাশে, তারে-নলে-ছুঁচে-অক্সিজেন মাস্কে জর্জরিত মানুষটা ঋষি?

– তুমি যে বলেছিলে ও স্টেবল আছে? রত্নাবলীর গলা চিরে কাতর প্রশ্ন বেরিয়ে আসে।

কিরণ সামান্য কাঁধ ঝাঁকায়। – চলো, ডক্টর দেশমুখের সঙ্গে কথা বলবে।

 

(২)

অটোর পয়সা মিটিয়ে একটু দাঁড়াল রত্নাবলী। তার চারদিক দিয়ে জীবনের প্রবাহ তুমুল স্রোতে বয়ে যাচ্ছে। যে যার গন্তব্যে ছুটে যাচ্ছে তীব্রবেগে, আকাশে বাতাসে উদ্দাম প্রাণের কলরোল। এই বহমান জীবনধারার মাঝখানে রুক্ষ ঊষর দ্বীপের মতো একা রত্নাবলী। আচমকা বাজ পড়ে ঝলসে যাওয়া গাছ একটা। ধুলোয় ধোঁয়ায় পোড়া তেলের গন্ধে চোখ জ্বালা করে ওঠে তার। জোর করে একটা শ্বাস টানে সে।

সালুঙ্কে বিহারের গেট দিয়ে ঢুকতে রত্নাবলীর পা কাঁপছিল। কী যে বলবে সকাল থেকে সেটা মনে মনে হাজারবার ঝালিয়েও ঠিক করে উঠতে পারছিল না। কিন্তু এত বড়ো কথাটা এঁদের না জানালেও তো চলে না।

একতলার ফ্ল্যাটটার ভেতর থেকে খুব নীচুগ্রামে এমএস সুব্বুলক্ষ্মীর বিষ্ণু সহস্রনামম ভেসে আসছিল। কলিং বেলটায় আঙুল ছুঁইয়েও সরিয়ে নিল রত্নাবলী। ভেঙে দেবে? শেষ বিকেলের এই প্রশান্ত মগ্নতা এক নিমেষে ভেঙে দেবে সে? কিন্তু আর যে-কোনও রাস্তাও খোলা নেই তার কাছে।

দরজা খুলেই সুলোচনা হইহই করে উঠলেন।

– আরে আরে কী কাণ্ড। আজকেই যে তোর কথা ভাবছিলাম রত্না। শ্রীখণ্ড বানিয়েছি আজ। দেখেছিস, শাশুড়ি বউয়ে কী টেলিপ্যাথি?

রত্নাবলী ফিকে হেসে দরজার পাশে চটি ছাড়ে।

– ভালো আছো আই?

সুলোচনা ততক্ষণে তার পাশ দিয়ে বাইরের দিকে উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করেছেন।

– তুই একলা এলি যে বড়ো আজ? ও বুঝেছি। ঋষি অফিস থেকে সোজা আসবে বুঝি? তা বেচারা মেয়েটাকে রেখে এলি কেন? যাওয়ার সময় শ্রীখণ্ড দিয়ে দেব কৌটো করে, নিয়ে যাস কিন্তু মনে করে।

সোমপ্রকাশের বসা থেকে উঠতে একটু সময় লাগে। তবে সুলোচনার কথা সবই তাঁর কানে যাচ্ছিল। নিজের চেয়ার থেকেই জোরাল আওয়াজটা ছুড়ে দিলেন তাই।

– কে, রত্না নাকি রে?

বয়স আটাত্তরের গণ্ডি পেরোলে কী হবে, গলা সেই আগের মতোই মাঠপেরোনো।

– হ্যাঁ বাবা। আমি।

সুলোচনা এতক্ষণে খেয়াল করেছেন রত্নাবলীর চোখমুখ।

– কী হয়েছে রে তোর? এরকম দেখাচ্ছে কেন? অফিসে ঝামেলা? না আমার বাঁদর ছেলেটা কিছু বলেছে? বোস তো দেখি এখানটায়, বোস। জোর করে রত্নাবলীকে নিজের পাশে সোফায় টেনে বসান তিনি। আঙুলে করে চিবুকটা তুলে ধরেন নিজের দিকে।

– চোখমুখ এমন কালিঢালা কেন রত্না? কী হয়েছে?

রত্নাবলী আর পারে না। তার মুখ দিয়ে শুধু শ্বাসের শব্দটুকুই বেরোয়। তিনদিন ধরে জমিয়ে রাখা কান্না নিয়ে সে সুলোচনার কোলে ভেঙে পড়ে আপাদমস্তক।

সুলোচনা চমকে উঠেছিলেন প্রথমটা। তারপর কী এক অজানা আশঙ্কায় তিনিও কেঁপে যান। রত্নাবলীকে এমন করে কাঁদতে তিনি এত বছরে দেখেননি। রত্নাবলীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সুলোচনা না-বোঝা আতঙ্কে সোমপ্রকাশের দিকে তাকান।

সোমপ্রকাশ উঠে এসেছেন ততক্ষণে।

– কী হয়েছে বেটা? বলো দেখি, তোমার এই বুড়ো বাবাটাকে বলো। দেখি আমি কিছু সমাধান করতে পারি কিনা।

সুলোচনার কোলের মধ্যে হেঁচকি উঠতে থাকে রত্নাবলীর। সে শুধুই কাঁদে, যত জমানো কান্না তার ছিল।

– পুপুকে আমি কী করে বোঝাব আই।

– কী বোঝাবে? কী বলছ খুলে বলো মা। আমরাও তো কিছু বুছতে পারছি না।

এতক্ষণে মুখ তোলে রত্নাবলী। চোখ দিয়ে তার অঝোরে জল গড়াচ্ছে। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে শিউরে ওঠেন সুলোচনা। হৃৎস্পন্দন থেমে আসে যেন তাঁর। খুব অস্ফুটে, প্রায় শোনাই যায় না এমন স্বরে ফিসফিসিয়ে ওঠেন সুলোচনা,

– ঋষি।

 

(৩)

চারজনেই ওরা বসেছিল ডাক্তার দেশমুখের কেবিনে। সুলোচনা পুপুর হাত শক্ত করে ধরে রেখেছেন।

রত্নাবলীর চোখ এখন খটখটে শুকনো। সবার আগে সেই তো জেনেছিল প্রকৃত অবস্থা। সেই প্রবল ঝড়ের অভিঘাত তাকেই তো সামলাতে হয়েছিল। এখন সে অনেকটা স্থিত। জানিয়ে দিয়েছে যাঁদের যা জানাবার, এবার যা হবার হবে।

দেশমুখ নীচু, কিন্তু স্পষ্ট স্বরে কথা বলছিলেন। উনি হয়তো জানতেন না, কিংবা বুঝতে পারছিলেন না, কীভাবে ওঁর প্রত্যেকটা কথা বিষমাখানো তিরের মতো বিঁধে যাচ্ছিল ওদের চারজনের হৃদয়ে, মস্তিষ্কে। কারও ক্ষত থেকে রক্ত পড়ছিল ঝরঝরিয়ে, কেউ ক্রমশ অসাড় হয়ে যাচ্ছিল বিষের প্রভাবে।

– ব্রেইন ডেথ ব্যাপারটা আপনারা কতটুকু বোঝেন আমার ঠিক জানা নেই, তাই লেট মি এক্সপ্লেইন আ বিট। এই মুহূর্তে আমরা পেশেন্টকে লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমে রেখেছি, তাই আপনারা দেখছেন তার বুক নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে উঠছে নামছে, গায়ে হাত দিলে গরম লাগছে। আপনারা হয়তো ভাবছেন উনি কোমায় আছেন, একদিন না একদিন জ্ঞান ফিরে আসবে। আয়্যাম সরি টু সে, সেটা হবে না।

মেশিন থেকে সরিয়ে নিলে, একটা সময়ে এই ফাংশনগুলো স্লোলি থেমে যাবে। শুনতে হয়তো খুব ব্রুটাল লাগছে আপনাদের, কিন্তু দিস ইজ ফ্যাক্ট। ডাক্তারের গলা খুব নৈর্ব্যক্তিক, আবেগহীন।

– কী করে বুঝতে পারছেন আপনারা, যে ঋষি কোমায় নেই? সুলোচনা চেষ্টা করেও নিজেকে আটকাতে পারেন না। প্রশ্নটা বেরিয়েই আসে।

– অনেকগুলো টেস্ট আছে আন্টি, সে সব মেডিকেল জার্গন আপনাদের বলে লাভ নেই। তবে রেস্ট অ্যাশিওর্ড, আমরা সেগুলো সব করেই ব্রেন ডেথ অ্যানাউন্স করি।

পুপু পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে বসেছিল, চোখ নীচু করে। এখন সে একবার চোখ তুলে ডাক্তারের দিকে তাকায়। ঘন কালি তার চোখের নীচে। এই প্রথম একটা প্রশ্ন করে সে।

– কেন পাপার ব্রেন হঠাৎ ডেড হয়ে গেল আংকল? সেদিন সকালেও তো ঠিক ছিল পাপা।

পুপুর দিকে এতক্ষণ সেভাবে মনোযোগ দেননি ডাক্তার। এবার তাঁর দৃষ্টি ফর্সা রোগা কিশোরীটির দিকে ঘোরে। মুখের রেখাগুলো নরম হয়ে আসে।

– এই উত্তরটা আমাদের কাছে থাকলে আমরা তো ঈশ্বর হয়ে যেতাম মা। আমরা ডাক্তার, ডাক্তারি ভাষা বুঝি। আচমকা ব্রেনের ব্লাড ভেসেল ছিঁড়ে রক্তক্ষরণ, আর তাই থেকে মস্তিষ্কের মৃত্যু, এটুকুই বলতে পারি। কেন, ওই সময়েই কেন, তা তো বলতে পারি না মা।

পুপু আবার চোখ নামিয়ে নেয়।

– আমরা যথাসাধ্য করেছি, কিন্তু সত্যি বলতে, আর কিছু করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সোমপ্রকাশের দিকে তাকান ডাক্তার। – আপনাদের ছেলের ব্রেনের ড্যামেজ এতটাই বেশি যে সেখান থেকে আর কোনওভাবেই তাঁকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। আই অ্যাম সরি।

সোমপ্রকাশ স্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন এতক্ষণ।সিসিইউতে ঢুকতে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। ঋষির অসাড় হাতটা ছুঁয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন সোমপ্রকাশ। বেশিক্ষণ দাঁড়াতে এমনিতে কষ্ট হয় তাঁর, কিন্তু তখন বোধহয় তাঁর শরীরেও কোনও অনুভূতি ছিল না। স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন একমাত্র সন্তানের দিকে চেয়ে। একটা মোটা নল ঋষির মুখে গোঁজা, সেটা দিয়ে নিশ্বাসপ্রশ্বাস চলছে খুব সম্ভবত। আরও কত টিউব, সূঁচ সারা শরীরে যে বেঁধানো ঋষির। একটুও ব্যথা লাগছে না তাঁর ছেলেটার, নিজেকে সান্ত্বনা দেন সোমপ্রকাশ। ইঞ্জেকশনে বড়ো ভয় ছিল ঋষির, ছোটোবেলায়। বড়ো হয়েও কাটেনি সেটা। চোয়াল শক্ত করেন সোমপ্রকাশ, গলার কাছে জমতে থাকা দলাটাকে জোর করে গেলেন।

ডাক্তার দেশমুখের সব কথা কান করে শোনেননি এতক্ষণ তিনি, নিজেরই কী একটা ভাবনায় মগ্ন ছিলেন। ডাক্তারের স্বরে একটা প্রশ্নসূচক মোড় তাঁকে সচেতন করে।

– এক্সকিউজ মি। নিজের অন্যমনস্কতার জন্য লজ্জা পান সোমপ্রকাশ। – আর একবার যদি বলেন কী বলছিলেন।

– লাইফ সাপোর্ট বন্ধ করার জন্য নেক্সট অফ কিনের পারমিশন লাগবে। ম্যাডাম যদি– ডাক্তার রত্নাবলীর দিকে তাকান।

রত্নাবলী কারও দিকেই তাকায় না। তার রাতজাগা চোখ নীচু, নিজের মণিবন্ধে স্থির। হাতে কোনও গয়না পরে না সে, শুধু বাঁ হাতের অনামিকায় একটি হিরের কুচি বসানো আংটি আর বাঁ কবজিতে সোনা দিয়ে বাঁধানো লোহাটুকু ছাড়া। আংটিটা ঋষি পরিয়ে দিয়েছিল তাদের ফুলশয্যার রাতে। লোহাটা দিয়েছিলেন সুলোচনা। তাঁর বাঙালি বান্ধবীদের কাছে শিখেছিলেন এই প্রথাটি তিনি। সেই সোনায় মোড়া লৌহবলয়টিই একমনে ঘুরিয়ে যাচ্ছিল রত্নাবলী।

সুলোচনা তাকে আলতো স্পর্শ করেন। তাঁর চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল। তাঁর ওইটুকু স্পর্শেই থরথর কেঁপে ওঠে রত্নাবলী।

– আমি কী করে বলব আই, ও কথা। কী করে নিজের হাতে ঋষিকে– আকুল কান্নার দমকে কথা বন্ধ হয়ে যায় তার।

সুলোচনা এক হাতে পুপুকে ছুঁয়েছিলেন, অন্য হাতটি দিয়ে এবার রত্নাবলীকে বেড় দিয়ে নেন। তাঁরও শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছিল।

ডাক্তার কিছুটা সময় দেন ওঁদের।

সোমপ্রকাশ তাকান একবার রত্নাবলীর দিকে।

– তোমার হয়ে আমি যদি মতামতটা দিয়ে দিই মা, তুমি আপত্তি করবে না তো? তুমি না হয় সইটুকু করে দিও শুধু।

রত্নাবলী মাথা নাড়ে। সে খুব ভালো করেই জানে এই পরিস্থিতিতে কেবল একটিই অমোঘ সিদ্ধান্ত হতে পারে, কিন্তু সেটা মুখ ফুটে সে বলতে পারছিল না কিছুতেই। নিজেকে তার কেমন যেন হত্যাকারীর মতো মনে হচ্ছিল, ঋষির মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করা এক নিষ্করুণ ঘাতক।

সোমপ্রকাশ উঠে দাঁড়ান এবার। এক হাতে টেবিলের কিনারাটা চেপে ধরে সামান্য টলোমলো ভাবটা সামনে নেন।

– লাইফ সাপোর্ট খুলে দেবেন, অবশ্যই। কিন্তু আজই নয়।

– এক্সকিউজ মি স্যার, আপনি বোধহয় আমার কথাটা ঠিক বুঝতে পারেননি।

– যা বোঝার ঠিকই বুঝেছি ডক্টর, আপনিই আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা করেননি। সোমপ্রকাশের গলায় পুরোনো ইস্পাতকাঠিন্য।

– আমার ছেলের অর্গ্যানস হার্ভেস্ট করতে যেটুকু সময় লাগবে, সেই সময় পর্যন্ত লাইফ সাপোর্ট চালু রাখুন আপনারা। যা যা নিতে পারেন, লিভার, কিডনি, রেটিনা। সম্ভব হলে হার্ট, লাংস, যা যা পারবেন। একাত্তরের যুদ্ধের হাড়িকাঠে হাঁটুর নীচ থেকে একটি পা বলি দিয়ে আসা ব্রিগেডিয়ার সোমপ্রকাশ একনাথ কুলকর্ণী, মারাঠা লাইট ইনফ্যান্ট্রি, ক্র্যাচে ভর দিয়ে দাঁড়ান এবার।

– আপনি শিওর স্যার? দেশমুখ একেবারেই আশা করেননি এটা।

সোমপ্রকাশ একবার শুধু তাকালেন। সেই দৃষ্টির সামনে ডাক্তার দেশমুখের চোখ আপনা থেকেই নেমে গেল।

– ইয়েস স্যার। আমরা সব ব্যবস্থা করছি স্যার। কিছু ডকুমেন্টস্ রেডি করতে হবে, আপনাদের কনসেন্ট, সিগনেচার–

– যা বলবেন সব করা হবে। সোমপ্রকাশের টানটান শরীরটা এতক্ষণে নরম হয়।

– বেশ, আমরা ট্র্যান্সপ্লান্ট কোঅর্ডিনেশন কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করছি। কী কী রিট্রিভ করা যায় আপনাদের জানিয়ে দেব। আর ইয়ে,  থ্যাংক ইউ স্যার।

 

(৪)

এরও পরে কেটে গেছে কতগুলো দিন। ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়েছে রত্নাবলী। কী হবে শুধু শুধু। পাখিই উড়ে গেছে যখন। বিক্রিই করে দিত, সোমপ্রকাশ আটকেছেন। ভাড়া দিয়ে দিয়েছে তাই। আইটির ছেলেমেয়েতে পুনে এখন ভর্তি, একটা ঘরের জন্য হাপিত্যেশ করে মরে সব। চারটি মেয়েকে অবাধ অধিকার দিয়ে দিয়েছে থাকতে, তার একদা সাজানো নীড়ে। সালুঙ্কে বিহারেই তারা চারজন এখন। এই একসঙ্গে থাকাটা দরকার ছিল। তাদের প্রত্যেকের জন্যই।

পুপু মাঝে মাঝে এসে গা ঘেঁষে বসে আজকাল। বড়ো হচ্ছে মেয়েটা। আজও বসেছিল রত্নাবলীর কাঁধে মাথা হেলিয়ে। রত্নাবলী আস্তে আস্তে তার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছিল।

– এত চুপচাপ কেন পুপুই? মন খারাপ?

– উঁহু। মাথাটা অল্প নড়ে তার হাতের নীচে।

– তবে?

– ভাবছিলাম।

– কী ভাবছিলি পুপু?

– এই সব। এলোমেলো। পাপা ছিল, এখন নেই। কিন্তু পাপা নেই, আবার আছেও। একজন ছিল, কতজন হয়ে গেল।

রত্নাবলীর বুকের ভেতর টনটন করে ওঠে। আরও একটু কাছে টেনে নেয় সে পুপুকে।

ঋষির চোখে এখন অন্য দুজন মানুষ এই বিশাল পৃথিবীটাকে দেখছে, তার সব বর্ণ, জ্যোতি, রূপ সমেত। ঋষির হৃদয় ধকধক করছে অন্য কারও দেহের মধ্যে। আরো কী কী নিয়েছে ওরা, সব ঠিকঠাক জানেও না রত্নাবলী। শুধু জানে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে মিশে রয়েছে ঋষি এই মহাবিশ্বে অসংখ্য কণিকায়।

হারায় না, কিছুই হারায় না। তবু যেন মাঝে মাঝে বড়ো একা লাগে। পুপুর মাথায় চিবুক ঠেকিয়ে বসেছিল রত্নাবলী। একটা ঠাণ্ডা হাওয়া এসে তার সারা গা শিরশিরিয়ে দিল হঠাৎ। ওড়নাটা আরও একটু ভালো করে জড়িয়ে নিচ্ছিল রত্নাবলী, আচমকাই যেন ঋষির হাসিটা হাওয়ায় ভর করে তার কানে এসে বাজল।

– কী ম্যাডামজি, বলেছিলাম না? নব্বই পর্যন্ত হল না, সে আর কী করা। হাওয়া তার গালে আলতো আঙুল বুলিয়ে যায়।

– ঋষি? চকিতে এদিক ওদিক তাকায় রত্নাবলী। হাওয়াটা হাসতে হাসতে মিলিয়ে যায়।

সুলোচনা ডাক দেন ঘরের ভেতর থেকে।

– এবার উঠে আয় তোরা দুটো। ঠাণ্ডা লেগে যাবে।

– যাই আজ্জি।

পুপু সাড়া দেয়। রত্নাবলী বসেই থাকে চুপ করে। যদি আর একবার আসে হাওয়ার ঝলক। আরও একবার ছুঁয়ে যায় তাকে।

নিউ ইয়ার গিফ্ট

শুভেন্দু ছিলেন এয়ার ফোর্স-এর পাইলট। এয়ার ফোর্স-এর একটি প্লেন দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান, কিন্তু সংসারের আবর্তে ছেড়ে যান স্ত্রী শান্তিপ্রিয়া এবং তিন বছরের মেয়ে ঈশিতাকে। এয়ার ফোর্স-এর তরফ থেকে যখন মরদেহ বাড়িতে পাঠানো হয়, তখন শান্তি তার মেয়ে ঈশিতাকে তার কাকা ক্ষিতিমোহনবাবুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। কারণ সে চায়নি এই বয়সেই তার ছোট্ট মেয়ে জানুক, যে সে পিতৃহারা।

তারপর কেটে গেছে দু-দুটি বছর। এখন ঈশিতা বছর পাঁচেকের। অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় একটু রোগাই, দুর্বলও বটে। পাশেই এয়ার ফোর্সের স্কুলে পড়ে সে। বাবাকে ঘিরেই তার যত প্রশ্ন।

ছবিটা ধোঁয়াটে হলেও তার আজও মনে আছে বাবা যখনই বাড়ি ফিরত, নানারকমের খেলনা আনত তার জন্য। এদিকে-ওদিকে কত বেড়াতে নিয়ে যেত। কতই না গল্প শোনাত তাকে।

এখন সে একটু একটু বুঝতে শিখেছে। তাই তার প্রশ্নও বেড়েছে অনেক। যার উত্তর দিতে প্রায়ই হিমশিম খেতে হয় শান্তিকে।

এরকমই একদিন সকালে ঈশিতা তার মাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘মাম্মা পাপা আসছে না কেন? কবে আসবে?’

উত্তরে শান্তি বলল, ‘সোনাই, তোমার পাপা যে ছুটি পাচ্ছে না। তাঁর নতুন বস ভীষণ শক্ত প্রকৃতির লোক, কিছুতেই তোমার পাপার ছুটি মঞ্জুর করছেন না। তাই পাপা তার দুষ্টু সোনাইয়ের কাছে আসতে পারছে না।ছুটি পেলেই উড়ে চলে আসবে তোমার কাছে।’

ঈশিতা তার পাপার বস-এর উপর বিদ্বেষ প্রকাশ করে বলল, ‘মাম্মা, পাপার বস খুব বাজে, খুব খারাপ।’

বছর একত্রিশের শান্তি, কলকাতারই একটি মিলিটারি ক্যাম্পাসের এয়ার ফোর্স স্কুলের টিচার। ফর্সা, লম্বা ছিপছিপে চেহারা তার। দেখতেও বেশ সুন্দরী। স্বামীর মৃত্যুর পর কর্তৃপক্ষকে বহু অনুনয়-বিনয় করে মেয়ের স্কুলেই ট্রান্সফার নিয়েছে সে। শান্তির বাবা-মা চেয়েছিলেন মেয়ে আবার বিয়ে করুক। কতই বা বয়স তার। মাত্র উনত্রিশ বছরেই বিধবা হয়েছে সে। কিন্তু তার একটাই কথা। ঈশিতা খুব কম বয়সে দুভার্গ্যক্রমে তার বাবাকে হারিয়েছে, তাই সে চায় না যে ঈশিতা তার মাকেও হারাক। সে নিজের চোখে দেখেছে মা-বাবা আবার অন্যত্র বিয়ে করলে বাচ্চারা কীভাবে অবহেলিত হয়। সিঙ্গল মাদার-ই হোক বা সিঙ্গল ফাদার- কারওর একার পক্ষেই বাচ্চা মানুষ করাটা খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। সেক্ষেত্রে একজনকেই মা-বাবা দুজনেরই ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। বিশেষ করে তার পাপাকে ঘিরে ছোট্ট ঈশিতার প্রশ্নবাণ, শান্তিকে বড়োই অসহায় করে তোলে।

প্রতিদিনই ঈশিতা, তার বাবার কথা জিজ্ঞাসা করে শান্তিকে, আর শান্তিও প্রতিদিনই একইভাবে মিথ্যে আশ্বাস দিতে থাকে। কিন্তু আর কতদিনই বা লুকিয়ে রাখতে পারবে সে? তার ভয় হতে থাকে যদি হঠাৎই অন্য কারওর থেকে ঈশিতা জানতে পারে যে, তার বাবা আর কোনওদিন তার কাছে ফিরে আসবে না, তাহলে ব্যাপারটা কীভাবে নেবে ও। মেয়ে যে বাবা বলতে অজ্ঞান।

শান্তি ভাবতেও পারেনি যে, এই মিথ্যে আশ্বাস তার মেয়ের জীবনে বয়ে আনবে এক বড়ো ধরনের সমস্যা। প্রতিদিন বাবার জন্য অপেক্ষা আর দিনের শেষে আশাহত হতে হতে ডিপ্রেশনগ্রস্ত হয়ে পড়েছে ঈশিতাও। এখন সে তার একটি আলাদা পৃথিবী গড়ে নিয়েছে। কারওর সঙ্গে কথা বলে না, সবসময় চুপচাপ থাকে, খেলা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছে। এমনকী এখন তার পাপার কথাও জিজ্ঞাসা করে না। তার উপর বেশ কয়েকদিন হল, খাওয়াদাওয়াও প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। এমতাবস্থায় অসুস্থ হওয়াটাই স্বাভাবিক। হলও তাই। তার উপর ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ডা. অরুন্ধতী আচার্যও বলে গেছেন, এই মুহূর্তে তার বাবা না ফিরলে ঈশিতার সেরে ওঠাটা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। কী করে মেয়েকে সারিয়ে তুলবে ভেবে পাচ্ছিল না শান্তি। মেয়ের এই অবস্থার জন্য সে নিজেকেই দূষতে থাকে দিশেহারা হয়ে।

যখনই শান্তি খুব একাকি অনুভব করে, তখনই সোশ্যাল নেটওয়ার্ক-এ সিঙ্গল পেরেন্টদের একটি পেজ খুলে বসে। সেখানে নিসঙ্গতা কাটানোর পাশাপাশি নিজেদের প্রবলেম নিয়েও আলোচনা হয়। সেই পেজ-এ শান্তির বেশ কিছু বন্ধুও হয়েছে। তবে তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন কুশল দাস। তিনি ভারতীয়।কর্মসূত্রে ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকেন তাঁর আট বছরের ছেলে দেবের সঙ্গে। বছর চারেক আগে তাঁর স্ত্রী ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তারপর থেকে তিনিও একা। কখনও সোশ্যাল নেটওয়ার্ক আবার কখনও ওয়েব ক্যামেরায় একে অপরের সুখ-দুঃখ বিনিময় করতে করতে এখন কুশল আর শান্তি একে অপরের খুব ভালো বন্ধু।

সেদিনও শান্তি যখন ফেসবুক খুলে বসল, দেখল কুশল অনলাইন আছে।মেসেজ করেই ফেলল সে।

‘তোমাকেই দরকার ছিল আমার।’

‘কী হয়েছে? এত টেন্সড্ কেন?’

‘আমি কী করব ভেবে পাচ্ছি না। ঈশিতা ভীষণ অসুস্থ। ডাক্তার বলেছেন ওর বাবা না ফিরে এলে ও কিছুতেই সুস্থ হবে না। আমি দিশেহারা। কী করব? কোথায় যাব? কিছুই বুঝতে পারছি না। ওর এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ী। আমি রোজ মিথ্যে আশ্বাস না দিলে হয়তো আজ ও…’ বলতে থাকল শান্তি।

সমস্ত কিছু শুনে কুশল বলল, ‘দ্যাখো আমিও তোমার মতোই সিঙ্গল পেরেন্ট, সুতরাং তোমার সমস্যাটা আমি ভালো মতোই ফিল করতে পারছি, ভেঙে পোড়ো না। ওকে আবার স্বাভাবিক করে তোলার জন্য উই উইল ফাইন্ড আউট আ ওয়ে। একটু ভেবে আবার বলল, একটা পথ অবশ্য আছে, কিন্তু যদি তোমার কনসেন্ট থাকে তাহলে আমি হেল্প করতে পারি।’

‘কী সেই পথ?’ বেশ আগ্রহভরে জিজ্ঞাসা করল শান্তি।

‘তুমি ঈশিতাকে বলো ক্রিসমাসের দিন ওর বাবা বাড়িতে আসছে। আমি ক্রিসমাস-এর আগেই কলকাতায় পৌঁছে যাব। আমিই ওর বাবার পরিচয়ে ওর সঙ্গে দেখা করব।’

‘আবার একটা মিথ্যে? একটা মিথ্যে ঢাকতে আর কত মিথ্যের আশ্রয় নেব আমি।’ বলতে বলতে শান্তি কেঁদে ফেলে।

‘দ্যাখো, এই মুহূর্তে ঈশিতার রিকভার করাটাই সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট। অন্যকিছু পরে ভাবা যাবে।’ বেশ উত্তেজিত হয়েই বলল কুশল।

‘একটা জিনিস কিন্তু মনে রাখবে, ঈশিতা ওর বাবার মুখটা ভুলে গেলেও ও কিন্তু আজও মনে রেখেছে ওর বাবার শোনানো গল্পগুলোর কথা। ওর সবচেয়ে পছন্দের গল্প ছিল ‘ক্ষীরের পুতুল’। এত বছর দেশের বাইরে থেকে বাংলাটাই ঠিকমতো বলতে পারো না, হোঁচট খেতে থাকো তার উপর আবার ক্ষীরের পুতুল!’

শান্তির কথা শুনে কুশল বলল আরে চিন্তা কোরো না, আফটার অল বাঙালির ছেলে। বাংলা ভুলব কেমন করে? তবে হ্যাঁ লাস্ট বারো বছর ইউএসএ-তে থাকার ফলে একটু জড়তা চলে এসেছে। তুমি চিন্তা কোরো না ওটাও আমি ঠিক করে নেব। তুমি জানো আমি আমার ছেলেকেও বাংলা শিখিয়েছি। ও-ও বলতে পারে, তবে বোঝোই তো! আর ঈশিতার ক্ষীরের পুতুল আমি নেট-এ পড়ে নেব। ডোন্ট ওরি। যাও ঈশিতার কাছে যাও। বলো তার বাবা ক’দিন পরেই আসছে তার কাছে।’

কয়েকদিনের মধ্যেই কুশল বেশ ভালোমতোই অবন ঠাকুর-কে ঠোঁটস্থ করে ফেলল। মাঝেমধ্যে সেগুলি শান্তিকেও শোনাত।

অবশেষে সেই দিন হাজির। চব্বিশে ডিসেম্বর বিকালে বেজে উঠল ঈশিতার বাড়ির কলিংবেলটা– ঈশিতা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখল লম্বা-চওড়া চেহারার এক সান্তাক্লজ তার সামনে দাঁড়িয়ে। তাকে দেখে বেশ অবাক হল ঈশিতা। সান্তা কেন, তার মায়ের কথামতো তো এখন তার পাপার আসার কথা। তাহলে কী আবার…। মনে মনে ভাবতে থাকে ঈশিতা।

কোনও কিছু বোঝার আগেই সান্তা তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘উইশ ইউ আ মেরি ক্রিসমাস, মাই ডার্লিং! ভিতরে আসতে পারি কি? আমার কাছে তোমার জন্য দারুণ একটা গিফ্ট আছে!’ এই বলে বাড়ির ভিতরে ঢুকে সে আবার বলল, ‘এখনই আমি তোমাকে স্পেশাল গিফ্টটা দিতে চাই। কিন্তু তার জন্য একটা কন্ডিশন আছে! তোমাকে কিছুক্ষণের জন্য চোখ বন্ধ করতে হবে।’

ঈশিতা তার চোখদুটি বন্ধ করে নিল।

কুশল তাড়াতাড়ি করে সান্তার পোশাকটি খুলে দাঁড়াল ঈশিতার সামনে। একটু শ্যামলা হলেও বেশ লম্বা এবং প্রচন্ড স্মার্ট, ঠিক ঈশিতার বাবার মতোই।

‘এবার চোখ খুলতে পারো। দ্যাখো তো বাবাকে চিনতে পারো কিনা?’

ঈশিতা চোখ খুলে দেখল, সত্যিই তার বাবা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শেষবার দু’বছর আগে যখন সে তার বাবাকে দেখেছিল, তখন সে ছিল মাত্র তিন বছরের শিশু। স্বাভাবিক ভাবেই তার বাবার মুখটা মনে রাখাও তার পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং সে খুব সহজেই কুশলকে বাবা বলে মেনে নিয়েছিল। কুশল তাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, ‘ঈশিতা আমার উপর খুব রেগে আছো?’

প্রত্যুত্তরে ঈশিতা বলল, ‘হ্যাঁ, আছিই তো! তুমি আমাকে আগে দেখতে আসনি কেন? আমি তোমার সঙ্গে একটুও কথা বলব না।’

‘সরি, সোনাই। আমি যে কাজ থেকে ছুটিই পাচ্ছিলাম না। আমার বস খুব বাজে। কিছুতেই এখানে আসার জন্য ছুটি দিচ্ছিল না যে!’

ঈশিতা তার ছোট্ট ছোট্ট দুটি হাত দিয়ে কুশলের গলা জড়িয়ে ধরল। তারপর বলতে শুরু করল, ‘আই লাভ ইউ পাপা। আমি তোমাকে খুব মিস করেছি।’

ঈশিতার ছোট্ট হাতের ছোঁয়ায় আপ্লুত হয়ে উঠেছিল কুশল। তাকে কত রকমের খেলনা– বারবি সেট, ম্যাজিক সেট, জুয়েলারি সেট এবং হরেক রকমের চকোলেট দিতে দিতে বলল, ‘আমিও তোমাকে খুব মিস করেছি সোনাই।’

‘পাপা, তুমি আর আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?’ জিজ্ঞাসা করল ঈশিতা।

‘পুরো ক্রিসমাস ভ্যাকেশন-টাই তোমার সঙ্গে আমি থাকব সোনাই। তারপর তো কাজে ফিরতেই হবে। কাজ না করলে তো টাকা পাব না, আর টাকা না পেলে যে তোমাকে খেলনাও কিনে দিতে পারব না’। বলল কুশল।

‘আমার খেলনা চাই না। আমার পাপা চাই।’

প্রত্যুত্তরে কুশল বলে, ‘দ্যাখো, আমি যদি না যাই তাহলে তোমার দাদাকে কে দেখবে?’

ঈশিতা, ‘আমার দাদা?’

কুশল, ‘হ্যাঁ, তোমার দাদা দেব!’

ঈশিতা বলল, ‘ঠিক আছে, দাদাকে এখানে নিয়ে চলে এসো আমরা একসঙ্গে সবাই মিলে থাকব।’

কুশল হেসে বলে, ‘দাদাকে কাল নিয়ে আসব।’

কীভাবে যে সন্ধে গড়িয়ে রাত হয়ে গেল তা টেরও পেল না কুশল। ‘ক্ষীরের পুতুল’ শুনতে শুনতে ঈশিতাও ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঠিক তখনই ঘড়িতে প্রায় ১১টা দেখে ধড়ফড় করে উঠে পড়ল কুশল। হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিল সে। সেখানে দেব যে একা রয়েছে। যাওয়ার আগে শুধু শান্তিকে এইটুকু বলে গিয়েছিল যে, চিন্তা করতে হবে না, ঈশিতা ঘুম থেকে ওঠার আগেই সে দেবকে নিয়ে ফিরে আসবে।

পরদিন ঈশিতা ঘুম থেকে ওঠার আগেই দেবকে নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল কুশল। দেব আর ঈশিতা দুজনেই একটু ইনট্রোভার্ট প্রকৃতির। তারা একা একা থাকতেই অভ্যস্ত। ঈশিতা বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত আর দেব মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত ছিল। দেব তার বেশিরভাগ সময়টাই কাটাত স্কুল, নয়তো ডে-কেয়ার সেন্টার-এ। বন্ধুদের সঙ্গেও খেলত না। হয় কম্পিউটারে গেম নয়তো টিভি দেখেই বাকি সময়টা কাটাত সে। সেই দেবকেই ঈশিতার সঙ্গে খেলতে দেখে বেশ অবাকই হয়েছিল কুশল।

শান্তিও ভীষণ খুশি হয়ে উঠেছিল ঈশিতাকে আবার বহুদিন পরে হাসতে-খেলতে দেখে। সারাদিন ধরে তাদের খেলা আর শেষ হয় না।

এমনই একটা সময় শান্তি দেবের মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘দেব এখানে কেমন লাগছে তোমার?’

দীর্ঘদিন পরে, দেব যেন মায়ের স্পর্শ অনুভব করল।

সে বলল, ‘আমেরিকার বাড়িটা একদম ভালো নয় আন্টি, বড়ো ফাঁকা ফাঁকা।’

শুনে শান্তি বলল, ‘তোমার ভালো লাগছে এখানে? যখনই ইন্ডিয়া আসবে তখনই চলে আসবে এখানে। আচ্ছা ঠিক আছে তোমরা খেলা করো, আমি তোমাদের জন্য খাবার বানাই।’ এই বলে সে চলে যায়।

শান্তি, দেবের ফেভারিট ডিশ– লুচি, হালুয়া এবং ক্ষীর বানিয়েছিল সেদিন।

খাবারগুলি দেখে দেব শান্তিকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আন্টি, হাউ ডু ইউ নো দ্যাট দিজ আর মাই ফেভারিট ডিশেস? সরি, সরি, পাপা বেঙ্গলিতে কথা বলতে বলেছিল। তুমি কী করে জানলে যে এগুলো আমার ফেভারিট?’

শান্তি বলল, ‘আমি তোমার মায়ের মতোই। প্রত্যেক মা-ই তার বাচ্চাদের পছন্দের কথা বুঝতে পারে। বুঝলে?’

কথাগুলি শুনে দেব বেশ আপসেট হয়েই বলল, ‘ঈশিতা খুব লাকি যে ওর তোমার মতো একজন মা আছে। প্রত্যেকদিনই তুমি ওর পছন্দের কত কী খাবার বানাও। আমার তো মা নেই…!’

‘আমি তো আছি। আমি তোমার পছন্দের খাবার বানিয়ে দেব’, বলল শান্তি।

কিছুক্ষণের জন্য বাইরে গিয়েছিল কুশল। ফিরে এসে শান্তিকে বলল, ‘এক কাপ চা হলে ভালো হতো না?’

‘অফকোর্স।হোয়াই নট?’

চা খেতে খেতে শান্তি কুশলের উদ্দেশ্যে বলল, ‘জানো, এই ‘বড়োদিন’টা সত্যিই আমার মেয়ের জীবনের সবথেকে বড়ো দিন, আনন্দের দিন। ওকে গত দু’বছরে এত খুশি হতে কখনও দেখিনি। ও-ওর বাবাকে কাছে পেয়ে খুব খুশি হয়েছে। সত্যিই তোমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার মতো ভাষা আমার নেই।’

‘শান্তি লক্ষ্য করেছ, আমাদের বাচ্চারা তাদের পেরেন্ট-দের ফিরে পেয়ে কতটা খুশি হয়েছে, ওদের দেখে এখন ফিল করতে পারছি সিঙ্গল পেরেন্ট-রা একসঙ্গে কখনও বাবা-মা দুজনেরই রেসপন্সিবিলিটি ফুলফিল করতে পারে না, কোথায় একটা ফাঁক থেকেই যায়! তুমি কি জানো, আমার স্বপ্নই ছিল আমার ঈশিতার মতো ফুটফুটে একটি মেয়ের? আজ ওর সঙ্গে আমি বাবার অভিনয় করলাম। জানি না কেন একটা অন্যরকম অনুভূতি হল! একবারও মনেই হয়নি যে ও আমার মেয়ে নয়। বরং উলটোটাই মনে হচ্ছিল।’ মনের গভীরতা থেকেই এই কথাগুলি বেরিয়ে আসছিল কুশলের।

‘ঠিক তোমার মতোই, আমার সখ ছিল আর একটি পুত্রসন্তানের’ বলল শান্তি।

প্রত্যুত্তরে হঠাৎই কুশল বলে উঠল, ‘আচ্ছা আমরা কি পারি না ঈশিতা আর দেবের সত্যিকারের মা-বাবা হয়ে উঠতে?’

তারা কিছুক্ষণের জন্য ভাষা হারিয়ে ফেললেও, তাদের চোখ কিন্তু ভাষা হারায়নি।

হঠাৎই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে শান্তি বলে ওঠে, ‘সেকেন্ড ম্যারেজ-এর প্রতি আমার কোনওদিনই আস্থা ছিল না। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি ঈশিতার জীবনে তার বাবার গুরুত্ব কতটা! তোমাকে দেখি আর ভাবি, সত্যিই তুমি আর-পাঁচজনের থেকে কতটা আলাদা। আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে স্বামী হিসাবে ভাবতে বোধহয় খুব একটা খারাপ লাগবে না। কি বলো?’

দেখতে দেখতে বছরটা কেটে গেল। হল নতুন বছরের আগমন। নতুন বছর তাদের জীবনে বয়ে আনল নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন, নতুন সুখ, নতুন ভালোবাসা। শান্তির বাবা-মা এমনিতেই চেয়েছিলেন যে, তাঁদের মেয়ে আবার সংসার করুক। তাদের কথাই ছিল সমাজে একা একটি মেয়ে কখনও থাকতে পারে না। সুযোগ পেলেই কিছু লোক ছিঁড়ে খাওয়ার অভিপ্রায়ে থাকে। তৎসত্ত্বেও শান্তি দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে চায়নি শুধুমাত্র ঈশিতার জন্য। যদি নতুন বিবাহে আবদ্ধ হওয়ার পর তার অথবা তার স্বামীর দ্বারা ঈশিতা অবহেলিত হয়– সেই ভয়েই। কুশলকে দেখার পর তার চিন্তাভাবনা বদলেছে। মনের মণিকোঠায় জন্মেছে তার জন্য ভালোবাসাও।

জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহেই কুশল আর শান্তির রেজিস্ট্রি। সাক্ষী হিসাবে উপস্থিত ছিলেন শান্তির তরফ থেকে শান্তির বাবা-মা আর কুশলের তরফ থেকে আমেরিকা থেকে আগত তার দুই বন্ধু সৃঞ্জয় আর ডেভিড। আর সবথেকে বড়ো সাক্ষী দুই নিষ্পাপ শিশু। ছোট্ট একটা গেট টুগেদার পার্টি হয়েছিল সেদিন। সেদিন রাতে তারা একে-অপরের কাছে শপথ করেছিল তারা দেব আর ঈশিতাকে সমান ভাবে ট্রিট করবে। কারওর প্রতি বাড়তি স্নেহ বা বাড়তি বকাঝকা করবে না তারা।

কয়েকদিন কলকাতায় থাকার পর শান্তি আর ঈশিতা ক্যালিফোর্নিয়ায় সেটল্ড হয়ে গেল। শীতের তুষার ধবল প্রকৃতিতে কুশলের অন্তরঙ্গটা যেন শান্তির জীবনে নতুন করে উষ্ণতার সঞ্চার করল। ক্যালিফোর্নিয়ার বাড়ির জানলা দিয়ে যতদূর চোখ যায় পত্রশূণ্য গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে সে ভাবে, জীবনটা বড়ো এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল যেন। আবার সব নতুন করে শুরু করতে হবে।

দেবের স্কুলেই ভর্তি করা হল ঈশিতাকে। দেব আর ঈশিতা তাদের বাবা-মাকে একসঙ্গে পেয়ে ভীষণ খুশি। শুধু তারা কেন, শান্তি আর কুশলও বোধহয় একে-অপরের জন্যই অপেক্ষা করছিল। তারাও তাদের নতুন জীবনকে আনন্দের সঙ্গে আলিঙ্গন করল।

শান্তি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সে আর চাকরি করবে না। ঘরেই থাকবে। বাচ্চাদের স্নেহ, ভালোবাসা দিয়ে কোলে-পিঠে করে মানুষ করে তুলবে।

এভাবেই কেটে গেল ৪-টে মাস। সেদিন রোববার। শান্তি দেব আর ঈশিতাকে পড়াতে বসেছিল। টাস্ক দিয়ে তাদের স্কুলের ডায়ারি খুলে দেখল দেবের ডায়ারিতে হোম টাস্ক হিসাবে রয়েছে ‘আমার জীবনের স্মরণীয় দিন’ নিয়ে একটি প্রবন্ধ। তৎক্ষণাৎ শান্তি তাকে তার স্মরণীয় দিন নিয়ে লিখতে বলায়, সে ইংরেজিতে যা লিখল,বাংলায় তার সারমর্ম এই–

‘যেদিন আমি আমার মাকে ফিরে পেয়েছিলাম, সেদিনই আমার জীবনে সবথেকে স্মরণীয় দিন। সেই-ই হল পৃথিবীর বেস্ট মাম্মি। আমি মাকে ভীষণ ভালোবাসি। আমার মা আমাকে ভালোবাসার পাশাপাশি সবকিছুর জন্য অনুপ্রাণিত করেন। আমার ইচ্ছে সকলেই আমার মতো মা পাক।’

শান্তির চোখ জলে ভরে গেল। শান্তি উপর দিকে তাকিয়ে কপালে হাত ছুঁয়ে মনে মনে ভগবানকে ধন্যবাদ জানাতে থাকে, এত সুন্দর একটি পরিবার তাকে উপহার দেওয়ার জন্য।

বাইরের ঝকঝকে রোদে ধুয়ে যাচ্ছে সমস্ত প্রকৃতি। যতদূর সম্ভব দৃষ্টি প্রসারিত করে শান্তি। দূরের গাছগুলোর দিকে চোখ আটকাতে হঠাৎই যেন চমকে ওঠে সে। সেই পাতা ঝরে যাওয়া ন্যাড়া গাছগুলোতে হঠাৎই যেন সবুজের মায়াময় স্নিগ্ধতা। কচি পল্লবের নরম পেলব ছোঁয়াচ যেন হঠাৎই উদ্বেল করে তোলে তাকে। দুটি শিশুর নরম হাতের ছোঁয়ায় হঠাৎই বড়ো ভালোবাসতে ইচ্ছে করে জীবনটাকে।

দুটি গল্প-গাথা

এক মুঠো জীবন

নীল রঙের দরজা। তাতে আটকে রাখা চিঠির বাক্স। এক পাশে খড়খড়ি দেওয়া জানলা। বন্ধ। সবুজ রং ছিল এক সময়। এখন বিবর্ণ। সময়ের ছোপ ধরা দেয়ালের পলেস্তরা খসে পড়ছে অনেক দিন হল। তালা বন্ধ দরজার কাঠ ক্ষয়ে গেছে অনেকটাই। নতুন করে টুকরো কাঠ লাগিয়ে চেষ্টা করা হয়েছে কাঠামোটা ধরে রাখার। কিন্তু সময়টাকে ধরে রাখা যায়নি।

দেয়ালের কালশিটে দাগগুলো বলিরেখার মতোই স্পষ্ট। দুপুরের রোদ নরম চাদরের মতো জড়িয়ে আছে বাড়িটাকে। চিঠির বাক্স এখন ফাঁকাই পড়ে থাকে। চিঠি আসে না অনেক দিন। ধুলো জমেছে অনেক। পোকামাকড়ের ঘরবসতি তার এলাকা বিস্তারে ব্যস্ত। কেউ খুলেও দেখে না চিঠির বাক্স।

সে অনেক কাল আগের কথা। নিঝুম দুপুরে হঠাৎ খুলে যেত দরজা। চুড়ির মৃদু শব্দ। আধখোলা দরজার ভিতর থেকে কেউ দ্রুত হাতে তুলে নিত চিঠি। রঙিন খামে ঠিকানা লেখা। পরক্ষণেই বন্ধ হয়ে যেত দরজা। তারপর সারা দুপুর শুধুই ঠোঁটের কোণে লুকিয়ে থাকা হাসি। কোনও দিন চোখ ভরা জল। বারংবার, ফিরে ফিরে পড়া সাদা পাতার বুকে রাবীন্দ্রিক ছন্দে লেখা নীল অক্ষরের বিরহগাথা অথবা নিছকই কেজো কথায় ফিকে হয়ে যাওয়া অনুভূতিমালা।

আতরগন্ধী চিঠির ঘ্রাণে স্মৃতিমেদুর বিকেলগুলোয় বয়ে যেত বাসন্তী বাতাস। আকাশে ভেসে বেড়াত ঘুড়ি। রঙিন চিঠিগুলো যেন একটু আগেই সযত্নে রক্ষিত কারুকাজ করা বাক্সের ডালা খুলে চলে গেছে ওই সই-মেঘেদের কাছাকাছি, গোপন কথাটি বলার জন্য। হারিয়ে গেছে পোস্টকার্ড, ইনল্যান্ড বা খামে-ভরা চিঠির সুষমা।

চাইনিজ কালিতে হাতের লেখার শিল্প, অসাবধানতায় পড়ে যাওয়া দু-এক ফোঁটা কালির দাগ এখন কল্পনাতেও আসে না। এখন কাঠের তৈরি চিঠির বাক্সের বদলে ইনবক্স-এ মেসেজ আর ইমোজির মজা। তবু কেউ হয়তো এখনও বইয়ের ফাঁকে রাখা, হাতে-লেখা বিবর্ণ চিঠিটাকে মাঝে মাঝে খুলে নিয়ে পড়ে।

হয়তো তার একটা চিঠির বাক্স আজও আছে গোপন… যার রং নীল।

                                                                                                      লেখক : অয়ন সেন

 

জ্ঞানপাপী

Bengali story

পেটে অসহ্য যন্ত্রণা! যেন গত দশ বছরে পাকানো বিয়ার বেলি ছাপিয়ে নাভিকুণ্ডলী শিরাদাঁড়া-টা ছুঁয়ে ফেলবে! ইমার্জেন্সিতে স্ট্রেচার থেকে বেডে দেওয়ার পরেও মনে হচ্ছে, পৃথিবীটা ঘুরছে। আর সেই ফাঁকে দেখা দিয়ে যাচ্ছে কত মুখ। সেই ক্লাস এইটে ইস্কুলের পাট চুকিয়ে দেওয়ার সময়ে ভূগোল বই-এ জগা পড়েছিল সে কথা। কিন্তু ওই হাওড়া স্টেশনে ল্যাম্পপোস্ট-এর গায়ে কে.সি পালের নিজে হাতে লেখা, সূর্য‌ পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে এটাই সত্যি মনে হয়েছিল। কিন্তু আজ যমরাজের ডাকে প্রায় সাড়া দিতে দিতে অজস্র মাউথফুল গালি দিতে গিয়ে মনে পড়ে গেল

গ্যালিলিও… বেডে শুয়ে ভাবল গালি দিয়ে লি-ও লি-ও করে কুত্তাকে বিস্কুট খাওয়ানোর নাম করে মনে রাখত নামটা। এখনও চোখ বন্ধ করেও যেন নাগরদোলা। আজ তো মাল-ই খায়নি। তবে ওই গ্যালিলিও মালটা ঠিকই বলেছে বটে। সব ঘোরে, শুধু সূর্য এক জায়গায় খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে। সিগারেট-ও সকাল থেকে একটাই। জিভটা এত মোটা লাগছিল যে, কিছু খেতেই ইচ্ছে হচ্ছিল না।

স্ট্রেচারে করে নিয়ে আসার সময়ে শুনতে পেয়েছিল, কে একটা বলল, আরে ডা. গাঙ্গুলী লন্ডন থেকে এফআরসিএস, যেন ঈশ্বর। ভাবতে ভাবতে নার্স এসে ঠুসে দিল ইঞ্জেকশন। জগা দেখতে পায়নি তাই। নাহলে পেটের ব্যাথায় নয়, ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ দেখেই হার্টফেল করে মরে যেত। রোগ সারাতে অবশেষে সেই লন্ডনফেরত ঈশ্বর এলেন।

কী করলে ঠিক হব ডাক্তারবাবু?

মদ আর সিগারেট খাওয়া এক্কেবারে কমিয়ে দিতে হবে।

এটা বলার জন্য আপনি এত লেখাপড়া করে সময় নষ্ট করলেন? লন্ডনে ডাক্তারি শেখার খরচও নেহাত কম নয়! সকলে সুযোগও পায় না।

মা-নে?

লে হালুয়া! এটা কে না জানে! আমি দাদা কেলাস এইট পাশ, দীনবন্ধু ইস্কুল থেকে… পরশু যে-রিকশাওয়ালাটা আমাকে নিয়ে আসছিল, মাল খেয়ে টাল হয়ে গাছের গায়ে সল্লিড ধাক্কা। ওকে আমিও একই কথা বলেছি। পয়সাও নি-ই নি… আপনি লন্ডনে ডাক্তারি পাশ দিয়েছেন, আমার থেকে টাকাও নেবেন, অনেক। তাহলে এখন বলুন, মদ আর সিগারেট এই দুটোকে রেখে আমি ভালো হব আর ভালো থাকব কী করে? তবে না বুঝব আপনি ডাক্তারের ডাক্তার!

আমি পারব না।

এই কে আছিস! চ রে আমাকে বাড়ি নিয়ে চ… এর দ্বারা কিস্যু হবে না, অনেক হইচে!

ডাক্তারবাবু স্টেথো নামিয়ে রাখলেন টেবিলের ওপর।

 

 লেখক : আর্য চ্যাটার্জী

ভালো থেকো

কদমতলার মোড়ের এই ওষুধের দোকানটায় সপ্তাহে একদিন করে বসে দিগন্ত। নাগরিক জীবনে জটিলতা যত বাড়ছে, মনোরোগের চিকিৎসকের কাছে ভিড়ও বাড়ছে সেভাবে। আজ মিতুলের জন্মদিন। ষষ্ঠীকে বলা ছিল যাতে বেশি পেশেন্টের নাম না লেখে। মিতুল পুনেতে এমবিএ পড়ছে, বাড়িতে এসেছে কয়েকদিনের ছুটিতে। মা নেই, মিতুলের জীবনে বাবাই সব। এবার জন্মদিনে ঠিক হয়েছে সন্ধেবেলা বেরিয়ে পড়বে দুজনে। ডিনার করবে নিরিবিলি কোনও রেস্তোরাঁয়। সাতটার সময় শেষ পেশেন্টকে দেখে যখন উঠতে যাবে দিগন্ত, তখন ষষ্ঠী এসে বলল– স্যার, সবাইকেই কাটিয়ে দিয়েছি। কিন্তু একজনকে কিছুতেই বিদায় করতে পারলাম না। দু’ঘণ্টা থেকে মানুষটা ঠায় বসে আছে। আপনাকে না দেখিয়ে কিছুতেই যাবে না বলছে।

দিগন্তর টেবিলে কাজের জিনিসের পাশাপাশি রয়েছে একটা কাচের বোল ভর্তি ছাতিম ফুল। তার বাড়ির সামনের এক টুকরো বাগানে একটা ছাতিম গাছ আছে। দিগন্তর যেদিন যেদিন চেম্বার, সেদিন লোক দিয়ে দিগন্তর বাড়ি থেকে ছাতিম ফুল আনিয়ে রাখে ষষ্ঠী। লম্বা একটা ঘ্রাণ নিয়ে মুখটা তুলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দিগন্ত বলল– পাঠিয়ে দাও। কিন্তু মনে রেখো এটাই লাস্ট।

ষষ্ঠী চলে গেল। পর্দা সরিয়ে একটু দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে যে– মানুষটি ঘরে এল, তার গালে কয়েকদিনের দাড়ি, কপালে বলিরেখা, চোখের নীচে পুরু কালির আস্তরণ। দিগন্ত বলল– বসুন। নাম কী আপনার?

– ইয়ে, প্রণয় ঘোষ।

প্রেসক্রিপশনের পাতায় নামটা লিখতে লিখতে দিগন্ত কেজো গলায় বলল– হ্যাঁ, কী অসুবিধে বলুন।

– ইয়ে স্যার… মাসখানেক হল অদ্ভুত একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে কেউ কানের কাছে এসে ফিসফিস করে আমাকে কিছু বলছে।

– পুরুষকণ্ঠ? নাকি কোনও মহিলার গলা? চিনতে পারেন গলার স্বরটা কার?

– মনে হয় গলাটা শ্রুতির, মানে আমার স্ত্রীর। একটা কথাই শুধু শুনতে পাই। ‘ভালো থেকো’। ব্যস। ওই একটাই কথা। আর কিছু নয়।

দিগন্ত চোখ কুঁচকে দেখল পেশেন্টকে। তাকিয়ে থাকল একটুক্ষণ। কপালে দুটো বাড়তি ভাঁজ ফেলে বলল– আপনার স্ত্রী আপনার সঙ্গে একবাড়িতেই থাকেন নিশ্চয়ই?

– না স্যার, ও তিন মাস আগে এক্সপায়ার করেছে।

সাইকায়াট্রিস্টদের অনেক অদ্ভুত জিনিস শুনতে হয়। তবুও মুখটা নির্বিকার করে রাখাটাই নিয়ম। দিগন্ত তার উলটোদিকের লোকটির দিকে ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করল কয়েক সেকেন্ড। বলল– কথাটা কখন শোনেন? দিনে নাকি রাতে?

– দিন বা রাত বলে কিছু নেই স্যার। আসলে যখন কাজের মধ্যে থাকি তখন কিছু টের পাই না। কিন্তু একটু একা হলেই কানের কাছে ফিসফিস করে কেউ বলে ‘ভালো থেকো’। শব্দটা এমন ডিসটার্ব করছে যে, রাতে ঘুমোতে পারছি না।

– আপনার বাড়িতে কে কে আছেন? ছেলে-মেয়ে?

– একটাই মেয়ে। তিন্নি। পড়াশোনায় ভালো ছিল। বিয়ে করে বিদেশে থিতু হয়ে গেছে। জামাই এলাহাবাদের ছেলে।দু’জনে একই কোম্পানিতে চাকরি করে। বাড়িতে আমি একা থাকি। কাজের মাসি আছে একজন। সকালে এসে রান্না করে দিয়ে চলে যায়।

– এই সমস্যা নিয়ে আপনি কোনও ইএনটি-র কাছে গিয়েছিলেন কি?

– গিয়েছিলাম। বেশ কিছু পরীক্ষা করিয়ে ডক্টর দাশ বললেন, কানে কোনও সমস্যা নেই। উনি আপনার কাছে আসতে বললেন।

ফোন বাজল। মিতুল বিরক্ত হয়ে বলল– তোমার রোগী দেখা শেষ হয়নি এখনও?

দিগন্ত বলল– আর পাঁচ-দশ মিনিট লাগবে, তারপর বেরোচ্ছি। ফোনটা রেখে দিগন্ত বলল– আপনার স্ত্রী নেই বলছিলেন। কী হয়েছিল ওঁর?

– নিউরোলোজিক্যাল সমস্যা। বছর খানেক বেচারি খুব ভুগেছে। মাস তিনেক আগে– আমি তো বলব চলে গিয়ে বেঁচেছে শ্রুতি।

– কী ধরনের সমস্যা ছিল ওঁর?

– এমনিতে সুস্থই ছিল শ্রুতি। গতবারের আগের শীতে আমরা দুজনে জয়ন্তী গিয়েছিলাম বেড়াতে। একটা লজে উঠেছিলাম। পরদিন সকালে শুকনো নদীর খাত ধরে হাঁটতে বেরিয়ে দেখা হয়ে গেল একজন তান্ত্রিকের সঙ্গে। এক হাতে একটা সিঁদুরমাখা ত্রিশূল, অন্য হাতে একটা মালসা নিয়ে বিশাল চেহারার লোকটা হেঁটে আসছিল উলটোদিক থেকে। ওই শীতের মধ্যে খালি গা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, লাল আগুনের গোলার মতো চোখ। আমাদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। শ্রুতির দিক থেকে লোকটা চোখ সরায় না কিছুতেই।

– তারপর?

– আমার হাত শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে গেল একদিকে। কী শক্ত খরখরে হাত ওই লোকটার সেটা বলে বোঝাতে পারব না স্যার! আমাকে বলল বহুদিন ধরে সাধনসঙ্গিনী খুঁজছে সে। কিন্তু যোগ্য কাউকে পাচ্ছিল না। শ্রুতির মধ্যে সেই আধার সে দেখতে পেয়েছে। শ্রুতিই নাকি পারবে তার সাধনসঙ্গিনী হতে।

– হুম। তখন কী করলেন আপনি?

– আমার তখন হতবুদ্ধি অবস্থা। ফাঁকা এলাকা, আশেপাশে কেউ নেই যে সাহায্য চাইব। সেই তান্ত্রিকের হাত ছাড়িয়ে শ্রুতিকে টেনে নিয়ে হাঁটা দিলাম। লোকটা আচমকা হাতের মালসা থেকে সিঁদুর আর ছাইয়ের মতো কিছু একটা শ্রুতির কপালে লেপে দিল। তারপর হো হো করে হাসতে লাগল। আমরা পা চালিয়ে জায়গাটা ছেড়ে এলাম। যেন পালিয়ে বাঁচলাম ওখান থেকে। কিন্তু কী আশ্চর্য, পরদিন রাতেই ঘটল সেই অদ্ভুত ঘটনাটা।

– কী ঘটনা ঘটল?

– সারাদিন ধরে বক্সা ফোর্ট দেখা হয়েছিল সেদিন। অতটা উঁচুনীচু পথ হেঁটে হেঁটে রাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম দুজনে। শুতে শুতেই আমি ঘুমিয়ে কাদা। আমার ডায়াবেটিস আছে, রাতে বাথরুমে যেতে হয়। ভোররাতে একবার ঘুম ভেঙেছিল। কিন্তু বাথরুম থেকে ফিরে এসে যা দেখলাম তাতে আমার গায়ের সব রোম খাড়া হয়ে গেল।

– কী দেখলেন?

– দেখি ওই শীতের মধ্যে শ্রুতি উদোম গায়ে বিছানার ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। যেভাবে বাসে ট্রেনে লোক দাঁড়িয়ে থাকে সেভাবে। চোখমুখ অন্যরকম। আমি অবাক হয়ে বললাম– কী করছ? নেমে এসো! শ্রুতি অদ্ভুত হেসে অচেনা গলায় বলল– এই তো পরের স্টপেজেই নামব!

দৃশ্যটা কল্পনা করে শিহরন জাগল দিগন্তর শরীরে। তবুও মুখটাকে নির্বিকার রেখে বলল– তখন কী করলেন আপনি?

– বুঝিয়ে-সুঝিয়ে অনেক কষ্টে শান্ত করে শুইয়ে লেপ দিয়ে ঢেকে দিলাম ওকে। একটু পরে ঘুমিয়েও পড়ল ও। কিন্তু জয়ন্তী থেকে বাড়ি ফিরে আসার পর আমূল বদলে গেল শ্রুতি। কথাবার্তা একটু কেমন কেমন। সব সময়েই আনমনা। কিছু বললে চমকে চমকে ওঠে। বিড়বিড় করে একা থাকলে। শেষদিকে আমাকে চিনতে পর্যন্ত পারত না। ওই তান্ত্রিকই ওর সর্বনাশ করে দিল!

দিগন্ত আশ্বাসের স্বরে বলল– আপনি যা ভাবছেন তা নয়। আপনার স্ত্রীর যেটা হয়েছিল সেটা এক রকমের নিউরোলজিকাল ডিসওর্ডার। অনেক কারণে এটা হতে পারে। ওই তান্ত্রিকের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই। যাক গে, স্ত্রীকে ভালো জায়গায় ট্রিটমেন্ট করানো উচিত ছিল আপনার।

– ট্রিটমেন্টের কিছু বাকি রাখিনি স্যার। কিন্তু লাভ হয়নি। শেষদিকে শ্রুতি ঘরেই পায়খানা-পেচ্ছাপ করত। যখন তখন ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ত বাইরে। সে জন্য কী বলব… এমনকী ঘরে বেঁধে পর্যন্ত রাখতে হয়েছে ওকে। কোনও উপায় ছিল না আর।

– আপনার মেয়ে-জামাই সব শুনে আসেনি বিদেশ থেকে?

– ছুটে এসেছিল দু’জনে। তখন শ্রুতির বাড়াবাড়ি চলছে। কিন্তু ওদের দু’জনকে দেখলে আরও বেশি ভায়োলেন্ট হয়ে যেত শ্রুতি। তখন সিডেটিভ ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হতো ওকে। কিছুদিন থেকে ওরা একরকম পালিয়ে ফিরে গেল বিদেশে।

– কে দিত ওষুধ?

– একজন অ্যাটেনডেন্ট রাখা হয়েছিল নার্সিংহোম থেকে। মাঝবয়েসি একটা মেয়ে, তার নাম বকুল। সারাদিন থাকত। স্নান করানো থেকে খাওয়ানো-দাওয়ানো সব বকুলই করত।

– আপনার স্ত্রীর ডেথ সার্টিফিকেট কে ইস্যু করেছিল বলুন তো?

– আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ডক্টর ধৃতিমান ব্যানার্জি।

মোবাইলটা আবার বাজল। মিতুল গজগজ করতে করতে বলল– বাবা, এনাফ ইজ এনাফ। তোমার আর আসার দরকার নেই আজ। সারা রাত্তির তুমি চেম্বারেই থেকে যেও।

দিগন্ত কিছু বলার আগেই মিতুল লাইনটা কেটে দিল। অপ্রস্তুত হয়ে ফোনটা একটুক্ষণ হাতে ধরে থাকল দিগন্ত। মিতুলের রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু এখন তার মুখোমুখি বসা লোকটির মনের অন্ধকার অলিন্দে আলো ফেলছে সে। এই পেশেন্ট ছেড়ে সে এখন যাবে কী করে!

– কে ফোন করেছিল স্যার? আপনার মেয়ে নাকি?

দিগন্ত হেসে বলল– হ্যাঁ। আমারও স্ত্রী নেই। বাড়িতে আমাকে শাসন করার লোক আমার মেয়েই। আজ বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান আছে। সেজন্য তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার কথা বলে রেখেছে মেয়ে।

– যদি কিছু না মনে করেন স্যার… কী হয়েছিল আপনার স্ত্রীর?

দিগন্তর মুখে একটা ছায়া পড়েই মিলিয়ে গেল। একটা শ্বাস গোপন করে বলল– ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। রাত্রে বুকে ব্যথা হয়েছিল। হসপিটালে নিতে নিতেই সব শেষ।

– ওহ। সরি স্যার।

দিগন্তর নাকে ছাতিমের গন্ধ আসছে। তাদের বাগানের ছাতিম গাছটায় বরাবর ফুল ফোটে খুব। পারমিতার প্রিয় ছিল ছাতিমফুল। বিকেলে সেই গাছের নীচে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকত পারমিতা। মজার ব্যাপার, পারমিতা চলে যাবার পর ছাতিম ফুলের নেশা পেয়ে বসেছে দিগন্তকেও। কিছু একটা চিন্তা করে দিগন্ত বলল– আচ্ছা, হাউজ ফিজিশিয়ান ওই ডাক্তারের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ঠিক কেমন বলুন তো?

– কার কথা বলছেন, ধৃতিমান? আমরা এক পাড়াতে থাকতাম, স্কুলে দু’জনে একসঙ্গে পড়েছি। ধৃতিমান পড়াশোনায় ভালো ছিল, জয়েন্ট এনট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে ডাক্তারি লাগিয়ে দিয়েছিল। দিন দিন ডাক্তারিতে পসার করেছে, কিন্তু একটুও অহংকার নেই। এই যে শ্রুতিকে দেখতে আসত আমাদের বাড়িতে, কিছুতেই ভিজিট নিত না।

আন্দাজে একটা ঢিল ছুড়ে দেখতে ইচ্ছে করছে দিগন্তর। একটা চান্স নেবে নাকি? অনেক সময় এভাবেই কাজ হয়। একটা ট্রাই করে দেখা যেতেই পারে। দিগন্ত দৃঢ় গলায় বলল– দেখুন আমি জানি আপনার মধ্যে কোথাও একটা অপরাধবোধ কাজ করছে। সেজন্য আপনার মৃতা স্ত্রী আপনার অবচেতনে ঘুরেফিরে আসছেন। আপনি কিছু একটু লুকোচ্ছেন আমার কাছে। প্রণয় ঘোষ আকাশ থেকে পড়েছে যেন। বলল– কীসের অপরাধবোধের কথা বলছেন স্যার?

দিগন্ত তাকিয়ে আছে প্রণয় ঘোষের দিকে। যেন ভেতরটা পড়ে নিচ্ছে এমন গলায় বলল– একটা কথা বলুন, সিডেটিভের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে চিরকালের মতো কে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল আপনার স্ত্রীকে? আপনার সেই ডাক্তার বন্ধু? নাকি আপনি নিজে?

হঠাৎ ঝাঁকি খেয়ে গেলে যেমন হয়, তেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে প্রণয় ঘোষের মুখ। ঠোঁটদুটো কাঁপছে একটু একটু।আবছা গলায় বলল– ক্-কী বলছেন স্যার আপনি?

দিগন্ত নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এসেছে। প্রণয় ঘোষের পিছনে দাঁড়িয়ে পিঠে হাত রাখল আলতো করে।নরম গলায় বলল– দেখুন আমি পুলিশের লোক নই, গোয়েন্দাও নই। আপনি তো জানেন, ডাক্তারের কাছে কিছু লুকোতে নেই। আপনি নির্দ্বিধায় আমাকে সব বলতে পারেন। যা বলবেন সেটা আপনার-আমার মধ্যেই থাকবে। কিন্তু মনে রাখবেন আপনার চিকিৎসা করার জন্য আমার সব জানা জরুরি।স-অ-ব।

প্রণয়ের মুখের প্রত্যেকটা পেশি কাঁপছে। চোখের কোলে দু’-এক বিন্দু জল এসে পড়েছে। জামার হাতা দিয়ে চোখের জল মুছে নিল প্রণয়। ভেঙে পড়া গলায় বলল– শ্রুতিকে আমি কতটা ভালোবাসতাম সেটা আমিই শুধু জানি। কিন্তু চেনা মানুষটা যখন ধীরে ধীরে অন্যরকম হয়ে গেল, সে যে কী যন্ত্রণা… বিশ্বাস করুন স্যার, আর কোনও উপায় ছিল না।

দিগন্ত একটু শক্ত গলায় বলল– ইউথেনেশিয়া বা করুণামৃত্যু বিশ্বের কিছু দেশে চালু হলেও আমাদের দেশ যে এখনও অ্যাপ্রুভ করেনি, সেটা আপনার না জানা থাকলেও আপনার ডাক্তার বন্ধুটি নিশ্চয়ই জানেন। তাহলে?

প্রণয় ঘোষ অসহায় মুখ করে বলল– বিশ্বাস করুন স্যার, শ্রুতির চিকিৎসার জন্য সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে আমি অনেক খরচ করেছি। কিন্তু কিছু হচ্ছিল না। শেষ দিকে শ্রুতি অস্রাব্য গালিগালাজ করত, হাতের কাছে যা পেত ছুড়ে মারত। এই দেখুন আমার কপালের কাটা দাগ। সাঁড়াশি ছুড়ে মেরেছিল সামনে থেকে। চারটে স্টিচ পড়েছিল এখানে। একদিন ধৃতিমানের সামনে আমার গলা টিপে ধরেছিল। সেদিন ধৃতিমান বাঁচায় আমাকে। তারপর থেকে ওর হাত বেঁধে রাখা হতো।

– তার মানে এরকম একটা ফেজ যখন চলছে তখনই ডিসিশনটা নিয়েছিলেন আপনারা। তাই না?

– কথাটা প্রথম তুলেছিল তিন্নি। ও যখন এসেছিল তখন কাছ থেকে দেখেছে সব। ওকেও শ্রুতি চড়-ঘুঁসি মেরেছে, ঘরের মধ্যে পায়খানা করে ওর মুখে লেপে দিয়েছে। বিদেশে ফিরে যাবার পর কাঁদতে কাঁদতে তিন্নি আমাকে বারবার ফোন করে বলেছে কিছু একটা করতে। চূড়ান্ত কিছু।

দিগন্ত নিস্পৃহতা ডিঙিয়ে আর্দ্র স্বরে বলল– সেই রাতের কথাটা এবার মনে করুন তো। ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন?

প্রণয় ঘোষ নখ খুঁটতে খুঁটতে বলল– আগের সপ্তাহেই ডিসিশন নিয়েছিলাম আমরা। সেদিন রাতে বকুল চলে যাবার পর দশটা নাগাদ ধৃতিমান এল। একটা হাত বাঁধা, শ্রুতি তখন ঘুমোচ্ছিল। অন্য হাতে চ্যানেল করাই ছিল। সিরিঞ্জ রেডি করে আমার হাতে ধরিয়ে দিল ধৃতিমান।কীভাবে ওষুধ পুশ করতে হয় সেটা শিখিয়ে দিয়েছিল।

– তারপর?

– ধৃতিমান অপেক্ষা করছিল বাইরে। আমি ওষুধটা পুশ করে ওকে ডাকলাম। ধৃতিমান ঘরে এসে শ্রুতিকে দেখল। তারপর চলে গেল। আমি গেট বন্ধ করে দিয়ে জেগে রইলাম সারা রাত। পরদিন সকালে এসে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিয়েছিল ধৃতিমান। সকালের মধ্যেই পাড়ার জ’না পাঁচেক ছেলের সঙ্গে মরচুয়ারি ভ্যানে করে শ্মশানঘাটে নিয়ে গিয়েছিলাম বডি। এক ঘণ্টার মধ্যে দাহ করে ফেলা হয়েছিল। কেউ কিছু বুঝতে পারেনি।

দিগন্ত ভুরু তুলে বলল– আপনার স্ত্রী কি ঘুমের মধ্যেই মারা গিয়েছিলেন?

– না ঠিক তা নয়। কী হয়েছিল পুরোটা বলি। সেদিন রাতে ধৃতিমান যখন বাইরে, তখন আমি বিবেকের তাড়নায় ছটফট করছি। কিছুতেই কাজটা করে উঠতে পারছি না। এক সময় মনের সবটুকু জোর এক করে শ্রুতির হাতের চ্যানেলে সিরিঞ্জের ওষুধ পুশ করে দিলাম। শ্রুতির শান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে সব পুরোনো কথা মনে পড়ছিল। হু হু করছিল ভেতরটা। ঠিক তখনই হঠাৎ ধীরে ধীরে চোখ মেলল শ্রুতি। কী বলব স্যার, একদম স্বাভাবিক চোখের দৃষ্টি। আমার দিকে একপলক তাকিয়ে কেমন একটু হেসে বলল– ‘ভালো থেকো’।

রোম দাঁড়িয়ে গেছে দিগন্তর। বিভ্রান্ত মুখে দিগন্ত বলল– কী বললেন?

– ‘ভালো থেকো’। একদম সুস্থ মানুষের মতো করে কথাটা বলে আবার চোখ বুজে ফেলেছিল ও। তারপর থেকেই কথাটা গেঁথে গেল আমার বুকের মধ্যে।

দিগন্ত একটু ঝাঁকি খেয়েছিল। নিজেকে গুছিয়ে নিল এবার। বলল– সেদিন কী হয়েছিল আমি বুঝিয়ে বলছি। সেই চূড়ান্ত সময়ে আপনার মস্তিষ্কের নিউরনের ব্যালান্স ঠিক ছিল না। ফলে একটা হ্যালুসিনেশনের মতো হয়েছিল আপনার। সেটা খুব স্বাভাবিক। আপনি যেহেতু খুনি নন একেবারেই নর্মাল মানুষ, তাই একটা অপরাধবোধ আপনাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। আপনার স্ত্রীর মৃত্যুর পর এই যে একটু একলা হলেই কানের কাছে ‘ভালো থেকো’ শব্দটা শুনছেন, সেটা আসলে একটা অডিটরি হ্যালুসিনেশন। বিভ্রম একরকম। যা শুনছেন সবটাই আপনার কল্পনা।

প্রণয় ঘোষ একটু অবাক হয়ে বলল– কল্পনা? কী বলছেন স্যার?

দিগন্তর হাসিতে আত্মবিশ্বাসের ঝলক। ঘাড় নেড়ে বলল– হ্যাঁ, কল্পনা। এমন কেস মোটেই রেয়ার নয়। আসলে সত্যি সত্যি কিন্তু কোনও শব্দ আসছে না। আপনি ভুল শুনছেন। আপনাকে মনের জোর বাড়িয়ে এই ফেজ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে যত শিগগির সম্ভব। নইলে কিন্তু এরপর ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশনও হতে পারে।

– এর কি কোনও চিকিৎসা নেই স্যার?

– নিশ্চয়ই আছে। আগে মনোবিশ্লেষণের সাহায্যে আমরা চিকিৎসা করতাম। কিন্তু এখন অনেক ভালো ভালো ড্রাগস এসে গেছে আমাদের হাতে। খসখস করে প্রেসক্রিপশন লিখে প্রণয়ের হাতে দিয়ে দিগন্ত বলল– আমি ওষুধ লিখে দিয়েছি। আপনি পনেরো দিন বাদে আমাকে রিপোর্ট করবেন।

প্রণয়ের দেওয়া ফিজ নিতে নিতে দিগন্ত পেশাদারি গলায় বলল– ভয় পাবেন না। আপনার যা হয়েছে সেটা একরকম মানসিক রোগ। এই ধরনের পেশেন্টরা নিরানব্বই শতাংশই আর ডাক্তারের কাছে রিপোর্ট করতে ফিরে আসেন না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনিও আর আসবেন না।

প্রণয় ঘোষ চলে যাবার পর চেয়ারে বসে গা এলিয়ে দিল দিগন্ত। ষষ্ঠী উঁকি দিয়েছে দরজা ফাঁক করে। দিগন্ত শ্রান্ত গলায় বলল– এক কাপ কফির ব্যবস্থা করতে পারবে ষষ্ঠী? টায়ার্ড লাগছে একটু। কফিটা খেয়েই বেরোব।

দিগন্ত লম্বা শ্বাস নিল একবার। ছাতিম ফুলের ঘ্রাণের অনুষঙ্গে ফেলে আসা দিনগুলো ভেজা বাতাসের মতো ছুঁয়ে দিয়ে গেল যেন তাকে। সুখী দাম্পত্যই ছিল তাদের দু’জনের। কিন্তু পারমিতা আর তার মাঝখানে আচমকা এসে পড়েছিল তৃতীয় একজন। সদর হসপিটালের অ্যানিস্থেসিস্ট ডক্টর সেনাপতির স্ত্রী অদিতি।

রূপসি দু’ধরনের হয়। কোনও কোনও সুন্দরী নারীর রূপ হয় সুগন্ধি চন্দনের মতো, স্নিগ্ধ। কেউ কেউ আবার রূপের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় সব। গ্রীষ্মবনের মধ্যে এক ধরনের জ্বালা আছে। অদিতি ছিল ঠিক তেমন। তার সঙ্গে দিগন্তর আলাপ হয়েছিল একটা পার্টিতে। সাদামাটা কথা হয়েছিল একটা দুটো। তারপর থেকেই দিগন্তর দিকে একটু একটু করে ঝুঁকে পড়ল অদিতি। সাপের মতো জড়িয়ে নিল নিজের বেষ্টনীতে। ডক্টর সেনাপতি সারাদিন মদে চুর হয়ে থাকতেন। তিনি জানতেও পারলেন না তাঁর স্ত্রী কীভাবে খাদের অতলে ধীরে ধীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দিগন্তকে।

সেদিন সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে অদিতির সঙ্গে সারাটা দিন গরুমারা ফরেস্টের এক রিসর্টে কাটিয়ে এসেছিল দিগন্ত। ডক্টর সেনাপতি কিছু জানতে না পারলেও কোনও শুভানুধ্যায়ী পারমিতার কানে পেৌঁছে দিয়েছিল মুচমুচে খবরটা। সন্ধেবেলা তীব্র অশান্তি হয়েছিল দিগন্ত আর পারমিতার মধ্যে। ঝগড়াঝাঁটির পর পারমিতা থম মেরে ছিল সারাক্ষণ। দিগন্তও বউয়ের সঙ্গে কোনও কথা বলেনি। স্টাডিরুমে জার্নাল পড়ছিল অনেকক্ষণ ধরে। অনেক রাতে দিগন্ত বিছানায় এসে দেখে মিতুল ঘুমোচ্ছে অকাতরে, কিন্তু পারমিতা শোয়নি। বসে আছে বিছানায়। ঠিকরে বেরোচ্ছে চোখ। দিগন্ত সামনে যেতেই ঘরঘরে গলায় বলেছিল, বুকের মধ্যে চাপ ধরে আসছে। কষ্ট হচ্ছে খুব।

ঘুমন্ত মিতুলকে বাড়িতে তালাবন্দি করে রেখে গাড়ি চালিয়ে পারমিতাকে নিয়ে হসপিটালের দিকে যাচ্ছিল দিগন্ত। গাড়ির মধ্যেই কষ্ট বেড়ে গিয়েছিল পারমিতার। ড্রাইভিং সিটে ছিল দিগন্ত, পিছনের সিটে কোলকুঁজো হয়ে শুয়ে গোঙাচ্ছিল পারমিতা। দিগন্ত গাড়ির গতি কমিয়ে পিছন ফিরে ঝুঁকে দেখছিল বারবার। পারমিতা দিগন্তর হাত আঁকড়ে ধরেছিল শেষ সময়ে। একটা কথাই শুধু বলেছিল ফিসফিসিয়ে। ‘ভালো থেকো’। ওই একটাই কথা। তারপর চোখ বুজে ফেলেছিল চিরকালের মতো।

প্রণয় ঘোষ যতক্ষণ তার চেম্বারে ছিল দিগন্ত সারাক্ষণ চেষ্টা করেছে পেশাদারি নির্লিপ্তি বজায় রাখার। কিন্তু এই দুটো ঘটনাটার যে এমন অদ্ভুত মিল, তার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কিছুতেই থই পায়নি। প্রণয় ঘোষ জানে না, জানবেও না কোনওদিন যে, কিছুদিন ধরে সে যা শুনছে, গত দশ বছর ধরে সেটাই শুনে আসছে দিগন্ত। একটু একলা হলেই পারমিতা কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে ‘ভালো থেকো’।

দিগন্ত তার ডাক্তার বন্ধুদের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধপত্র খেয়েছে বিস্তর, কিন্তু লাভ হয়নি। পারমিতার মৃত্যুর পর অদিতি ছিটকে চলে গেছে তার নিজস্ব বৃত্তে। দিগন্ত থেকে গেছে অন্যদিকে। মিতুলের সুখস্বাচ্ছন্দ্য ঘিরে এখন আবর্তিত হয় তার ভাবনা। তবুও একটু একা হলেই তার নিজস্ব নিভৃতিতে পারমিতা চলে আসে তার কাছে। কানের কাছে মুখ নিয়ে শুধু একটা কথা বলে। ‘ভালো থেকো’।

মৃত্যুর সময় আমাদের চেতনা ক্ষীণতর পর্যায়ে চলে যায়। চরমতম মুহূর্তে চেতনার পূর্ণ অবলুপ্তি ঘটে। সমস্ত স্মৃতি লোপ পায় আর জীবের মন, বুদ্ধি, অহংকার, ইন্দ্রিয়, প্রকৃতি ও কর্মফল জীবাত্মাকে অবলম্বন করে সূক্ষ্মদেহে অব্যক্ত স্থিতিতে চলে যায়। কিন্তু দিগন্ত কিছুতেই ভেবে কূল পায় না, চেতনার ক্ষীণতম মুহূর্তে দু’জন ভিন্ন মানুষ কী করে এই একটা কথাই উচ্চারণ করেছিল! এর মধ্যে কি কোনও গভীর তাৎপর্য আছে? দুটো মৃত্যুর ক্ষেত্রেই সে আর প্রণয় ঘোষ, তারা দুজনে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ভাবে দায়ী। সেজন্য কি চরমতম সময়ে তাদের দুজনের দুর্বল হৃদয় ভুল শব্দ পৌঁছে দিয়েছিল তাদের মস্তিষ্ককে? ওই ‘ভালো থেকো’ কথাটা কি সে কারণেই শুনতে পায় তাদের অবচেতন মন?

কফির কাপটা টেবিলে রাখল দিগন্ত। কাচের পাত্র থেকে দু’হাতের অঞ্জলিতে তুলে আনল একরাশ ছাতিম ফুল। ছাতিমফুলের গন্ধের মধ্যে একটা বিধুর বিষণ্ণতা আছে। সেই বিষণ্ণতা চারিয়ে গেল তার সমস্ত শরীরে। এতদিনে দিগন্ত বুঝে গেছে যে সে নিজে শতকরা একশোভাগ মনারোগীর দলে। প্রণয় ঘোষ সেরে উঠতেও পারে কিন্তু এ জীবনে রোগমুক্তি ঘটবে না তার। কোনও নিশ্চয়তায় সে পেৌঁছোতে পারবে না কোনওদিন। ‘ভালো থেকো’ কথাটা তার রক্তের মধ্যে মিশে গেছে। বিদ্রুপের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে অহর্নিশ তারা শিরা-ধমনি জুড়ে। এভাবেই প্রত্যয়-অপ্রত্যয়ের অনিকেত দোলাচলে তাকে কাটাতে হবে সারা জীবন। তার বাকি জীবন এভাবেই উত্তীর্ণ হবে এক আদি-অন্তহীন অনিশ্চয়তায়।

সোনার বাঁশি

গ্যাসে গরম দুধ ফুটছে আর দুলাল অল্প অল্প করে ছানা কাটা পাউডার মিশিয়ে যাচ্ছে। ছানা কাটাও যে এত শক্ত কাজ কে জানত! কাল পাউডার বেশি পড়ে গেছিল, কী তেতো, কী তেতো! মুখেই তোলা গেল না। জানলায় একটা কাক এসে বসে রোজ সকালে, তার পেটেই গেল সব।

আজ তাই দুলাল খুব সাবধানে পাউডার মেশাচ্ছে। ছোট্ট সুন্দর প্লাস্টিকের কৌটোয় এই এতটুকু একটা বেগুনি চামচ, তাতে করেই তুলছে একটু একটু করে। দুধটা দানা পাকাতে শুরু করেছে। দুলাল পাউডার মেশানো বন্ধ করে। চামচটা কৌটোয় রেখে দেখে, যেটুকু পাউডার আছে তাতে এ মাসটা হেসেখেলে চলে যাবে। রান্নাঘরের লাগোয়া ছোট্ট স্টোররুম। এই জায়গাটা দুলাল রেখেছিল লিফটের জন্য। পাঁচতলা অ্যাপার্টমেন্ট। যারা চার বা পাঁচতলায় থাকবে তাদের কথা ভেবেই লিফট করতে চেয়েছিল। সবারই তো বয়স হচ্ছে। কিন্তু বউগুলো মহা বেয়াড়া। কাঁইমাঁই কাঁইমাঁই করে বলল, ‘লিফট চাই না, আমাদের কিচেনের সঙ্গে অ্যাটাচড স্টোররুম চাই।’ ব্যস্, লিফট বন্ধ। দুদিন পরেই টের পাবে মজা। মেয়েদের হাঁটু সবার আগে খারাপ হয়। এদিকে ফেসিয়াল করাবে, ওদিকে হাঁটু পালটাতে হবে। নকল হাঁটু নিয়ে সিঁড়ি ভাঙার কষ্ট বুঝবে হাড়ে হাড়ে!

সেই স্টোররুমে গিয়ে থরে থরে সাজানো ছোটো-বড়ো কৌটোর মধ্যে দুলাল চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে রইল। চাল, ডাল, আটা, ময়দা, তেল, মশলা যা আছে আরও দু’মাস চলে যাবে। বাথরুমের বক্স মিররের মধ্যেও শ্যাম্পু, সাবান, বডি অয়েল। কমোডের পেছনের তাকে বাথরুম ঘষার অ্যাসিড, ব্রাশ। তাকে এখনও সংসারের একটা ছোট্ট জিনিসও একটা স্কচ-ব্রাইট কি টুথপেস্ট – কিছু কিনতে হয়নি।

শংকরী সব সাজিয়ে রেখে গেছে। যেমন বাড়িঘর, তেমনি নিজের শরীরটাও ঘষেমেজে রাখতে পছন্দ করত। পার্লারে যাবার সময় পেত না বলে একটা মেয়ে নিয়মিত বাড়িতে এসে ফেসিয়াল, হেনা, বডি মাসাজ করে দিয়ে যেত। দুলালের পছন্দ ছিল না এসব, বিশেষ করে আদুড় গায়ে বাইরের লোককে দিয়ে বডি মাসাজ, যতই মেয়েমানুষ হোক না। শংকরী মুখ টিপে হেসে বলত, ‘যে মন্দিরে নিত্য ঘন্টা বাজিয়ে পুজো করতে যাও, সেটা ঘষেমেজে না রাখলে হবে?’ মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত ঝকঝকে রাখা যার রোজকার সাধনা ছিল, সে টের পেল না তার দেহমন্দিরে কালসাপ বাসা বেঁধেছে?

দুলাল ছানা আর দুটো ক্রিমক্র্যাকার বিস্কিট নিয়ে শোবার ঘরের লাগোয়া ব্যালকনিতে এসে বসল, এই তার সকালের ব্রেকফাস্ট। ছেলে উঠলে তাকে ডিম-টোস্ট কিংবা নুডলস করে দেবে। তবে সে দশটার আগে নয়। একটু পরে রান্নার মাসি আসবে। তাকে রান্না বুঝিয়ে দিতে হবে। এই রে, ফ্রিজ থেকে মাছ বার করে রাখা হয়নি তো। দুলাল ছানার বাটি রেখে দৌড়ে ভেতরে যায়। ইস্, একদম বরফ হয়ে আছে। মাসি এসে চ্যাঁচামেচি জুড়ে দেবে। একদিকে ভাত, অন্যদিকে মাছ ভাজতে বসিয়ে সে তরকারি কুটে নেয়। আজ মাছের বরফ গলার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হবে তাকে। দুলাল জানে, মাসি গরমজল ঢেলে দেবে মাছে, এত দামি মাছটা একদম নষ্ট হয়ে যাবে।

দুলাল দেখল আটটা কাতলার পিস একসঙ্গে জমাট বেঁধে আছে। রান্না তো হবে মাত্র দুটো। রাতে তারা বাপ-ব্যাটা রুটি তরকারি খায়। তরকারি মাসিই করে যায়। গদি থেকে ফেরার পথে দুলাল রুটি কিনে আনে। ছেলে তো অর্ধেক দিন চাইনিজ-মাইনিজ খেয়ে আসে। মাসির রান্না তরকারি তার গলা দিয়ে নামে না। এত পয়সা নষ্ট দেখে খেপে যায় দুলাল। কিন্তু এটা সত্যি, শংকরীর হাতের রান্না যে খেয়েছে, সে কাজের মাসির হাতে খাবে কী করে? সকালে তবু গরম গরম মাছের ঝোল ভাত বেরোনোর তাড়ায় খেয়ে নেওয়া যায়। ভাতের মধ্যে দুলালের জন্যে একগাদা সেদ্ধ দেওয়া থাকে– উচ্ছে, পেঁপে, ভিন্ডি, কখনও কুমড়ো। নীচের ফ্ল্যাট থেকে বাচ্চুর মা ছেলের জন্যে ভাজাভুজি দিয়ে যায় রোজই। কিন্তু রাতের খাবার গলা দিয়ে নামে না। পয়সা দিয়ে কেনা সবজি, তাই শুধু মুখেই খানিকটা খেয়ে নেয় দুলাল। বাকিটা ফেলা যায়। রুটি চারটে দুধ-কলা দিয়ে খায় শেষে।

নাঃ, দুপিস দুপিস করে মাছ আলাদা আলাদা বাক্সে তুলে রাখতে হবে। দুলাল ঠিক করে আজই ফেরার পথে কিনে আনবে চারটে ছোটো প্লাস্টিকের বাক্স। আবার কী ভেবে রান্নাঘরে যায় একবার। গ্যাসের বাঁপাশের তাকে অনেক বাসনপত্র ধুয়েমুছে রাখা। এত বাসন লাগে না বলে দেখার দরকার হয়নি। দুলাল দেখল সেখানে ছোটো ছোটো চারটে মাছ রাখার ট্রান্সপারেন্ট প্লাস্টিকের বক্স ধুয়ে রাখা আছে। তাকে এগুলোও কিনতে হবে না। স্বস্তির শ্বাস ফেলল দুলাল। বেমক্বা জলও চলে এল চোখে। একটা মানুষ চলে গিয়েও ঘরের প্রতিটি কোনাকাঞ্চিতে ছড়িয়ে আছে। এ ঘর থেকে ও ঘরে গেলেই তার সঙ্গে দেখা হয়ে যাচ্ছে দুলালের। শুধু তাকে ছুঁতে পারছে না সে। সেই বেদানার আভা ঠিকরোনো গায়ে মুখ রাখতে পারছে না।

দুলালের মনে পড়ল ব্যালকনিতে ছানা আর বিস্কিট ফেলে এসেছে। সে আবার দৌড়ে গেল। এতক্ষণে কাক সেসবের ভুষ্টিনাশ করেছে নির্ঘাত। এ শহরে পাখি বলতে শুধু কাক। এত ধুলো, ধোঁয়া, শব্দ, মোবাইল টাওয়ার– কিছুই এদের দমাতে পারে না। নাঃ, খাবার ঠিকই আছে। শুধু ধুলো পড়েছে একটু। পাঁচতলায় হাওয়া বড্ড বেশি। ছানা একটু মুখে দিয়েছে, অমনি দুলালের মনে পড়ল তরকারির সবজি গুছিয়ে আসা হয়নি, যাক, মাসি নেবে নয় গুছিয়ে। বিস্কিটে একটা কামড় বসাতেই ডোরবেল বাজল। উঃ, একটু খাওয়ারও ফুরসত নেই। মাসি এসে পড়ল নাকি এত তাড়াতাড়ি! খেতে খেতে উঠে গেলে

শংকরী খুব রাগ করত। কিছুতেই উঠতে দিত না দুলালকে খাওয়া ফেলে। নিজেই গ্যাস কমিয়ে ছুটে যেত দরজা খুলতে। আর এখন! দুলাল তার আধখাওয়া বিস্কিট আর ছানার প্লেট ডাইনিং টেবিলে রেখে দরজা খুলে দিল। না, রান্নার মাসি নয়, মানি, সেজ ভাইয়ের মেয়ে। ওরা তিনতলায় থাকে।

‘জেঠু, আমাদের কমোডের ফ্ল্যাশ কাজ করছে না!’ দুলালের মাথা চিড়িক করে উঠল রাগে। মানিকতলায় ভাড়া বাড়ি থেকে সল্টলেকের এই পাঁচতলা ফ্ল্যাটে পুরো পরিবারটিকে যে একার চেষ্টায় নিয়ে এসেছে। বহু আগে কিনে রাখা জমি। বাড়ির প্ল্যান পাকা করানো থেকে পাথর কেনা, পার্টির ছেলেদের টাকা দেওয়া থেকে বেসমেন্টে দারোয়ানের ঘর– সব ঝক্বি সামলে সে তিল তিল করে বাড়িটা তুলেছে। শুধু বাড়ি নয়, প্রতিটি ফ্ল্যাটের খাট, আলমারি, ড্রেসিংটেবিলের মতো আসবাবও দেওয়া হয়েছে যৌথ ব্যাবসা থেকে। এভাবে একতরফা পেতে পেতে বউগুলো কি তেলিয়ে গেছে। বাথরুমের মগ থেকে ফেসিয়ালের খরচ সবই বারোয়ারি খরচ থেকে আদায় করতে চায়। আক্বেল দ্যাখো, ফ্ল্যাশ কাজ করছে না তো প্লাম্বারকে ফোন কর, তা না, ভাসুরকে ডাকছে। শংকরী থাকলে নয় একটা কথা ছিল। তখন তো তাকে সংসারের কুটোটি নাড়তে হতো না। এখন দুলাল নিজের ঘর সামলাবে না ভাইয়ের বাথরুম দেখতে ছুটবে!

‘তোর বাবাকে বল প্লাম্বারকে ফোন করতে।’ বলেই দুলাল দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। আবার বেল। এবার রান্নার মাসি। রান্নার মাসি ভেতরে ঢুকে এলে দুলাল আর দরজা বন্ধ করে না। মাসি বললেও, রাঁধুনিটি যুবতি মেয়েমানুষ। পাঁচবাড়ি কাজ করেও ঢলোঢলো শরীর। তাই সে যতক্ষণ কাজ করে, ততক্ষণ দরজা খোলা রাখে দুলাল। ঘরের কাজ সারতে সারতে বারবার দরজায় চোখ রাখে। এ বাড়িতে সকাল থেকে ঘরে ঘরে বাইরের লোক কাজে ঢোকে। বেশিরভাগই কেষ্টপুরের খালপাড় থেকে। সুযোগ বুঝে কে কখন কী হাতিয়ে নেবে তার ঠিক কী। তার চোখ থেকে থেকে রান্নার মাসিকেও নজর করে। আঁচলে চাল ডাল বেঁধে নিয়ে গেলে যদিও তার কিছু করার নেই। চুপচাপ হজম করে যেতে হবে। বলতে গেলে সে উলটে কেস খেয়ে যাবে। সংসারে কেবল একা মেয়েমানুষ নয়, একা পুরুষমানুষেরও অনেক বিপদ। সেদিন যখন দেখল শাক কুটতে কুটতে মশা মেরে, সেই হাতেই শাক ধুল, তখন রান্নাঘরে একটা অল-আউট জ্বালিয়ে আসা ছাড়া তার কিছু করার ছিল না। দুলাল ফ্রিজ থেকে থোড়, উচ্ছে, পেঁপে আর বেগুন বার করে দিল।

‘থোড় চচ্চড়ি সরষে দিয়ে, উচ্ছে আর পেঁপে সেদ্ধ, বেগুন দিয়ে মাছের ঝোল।’

থোড় দেখে মাসির মুখ কালো। তার ওপর দুলাল বলল, ‘মাছের তেল আছে অনেকটা, চালের গুঁড়ো দিয়ে দাদার জন্য বড়া বানিয়ে দিও।’

মাসি খরখরে গলায় বলে, ‘চালের গুঁড়ো বার করে দিয়ে যান মেসো।’

চালের গুঁড়ো! এতদিন দরকার পড়েনি কোনও। দুলাল আবার স্টোররুমে ঢোকে। খুঁজতে হয় না বেশি। প্রতিটি কৌটোর গায়ে লেবেল সাঁটা। শংকরী নিজের হাতে বড়ো বড়ো করে লিখে আঠা দিয়ে সেঁটে রেখেছে। দুলাল লেখাটার গায়ে হাত বুলোয়। তার মাথা ঝিমঝিম করে। এইসব তো একদিন না একদিন ফুরোবেই। তখন আবার কিনে কৌটোয় কৌটোয় তুলে রাখা– এসব তো কাজের লোক দিয়ে হবে না। তাকেই করতে হবে। শংকরীর ভাঁড়ার যেন না ফুরোয়! ফুরোচ্ছেও না। সব জিনিস চাইলেই পেয়ে যাচ্ছে। এমনকী ঠাকুরের ধূপ, বাতাসা, কাটিং মিছরি পর্যন্ত এখনও কিনতে হয়নি। লক্ষ্মীবারের হত্তুকি, সুপুরি, এক টাকার কয়েন সব রাখা নিখুঁতভাবে। পিসিমা এসে পনেরো দিন ছিল, তখন সব ওলটপালট করেছিল। দুলালের সহ্য হয়নি।

শংকরী চলে যাবার পরদিনই পিসিমা চলে এসেছিল নবদ্বীপ থেকে। অন্য গোত্রের মানুষ, তার ঠাকুরসেবায় দোষ নেই। সে সময় দুলাল কোনও দিকে তাকায়নি। ওর শরীর মন কেমন অসাড় হয়ে গেছিল। মাঝে মাঝে নিজেকে ঝাঁকিয়ে নিয়ে ও জিজ্ঞেস করত ‘আমি কি বেঁচে আছি?’ কিন্তু শ্রাদ্ধের জোগাড়যন্ত্র শুরু হতেই ও আর এমন নিভৃতে থাকতে পারল না। খুঁটিনাটি কেনাকাটা, প্যান্ডেল, নেমন্তন্নের লিস্ট, কার্ডের ডিজাইন, খবরের কাগজে শোকস্তম্ভ– সব কিছুই সে ছাড়া হবে না। এমন অপদার্থ তার ভাইগুলো! নেমন্তন্নর লিস্ট করতে বসে মনে পড়ল অনেকদিন আগে যে -পুরুতঠাকুর তাদের মানিকতলার বাড়িতে পুজো করতে আসতেন, সেই ইন্দুমাধব ভট্টাচার্যির কথা। বয়স হওয়ার জন্য অনেকদিন আসতে পারেন না, বেঁচে আছেন কিনা কে জানে।

ঠাকুরের সিংহাসনের পাশে একটা ছোট্ট তেপায়া চৌকিতে রাখা লক্ষ্মীর পাঁচালির মধ্যে একটুকরো কাগজে তাঁর ঠিকানা লিখে রেখেছিল শংকরী। সেই ঠিকানাটা খুঁজতে ঠাকুরঘরে এসে দুলাল অবাক। পুবমুখে রাখা সিংহাসনটা উত্তরমুখ করে কে বসাল! সবকিছুই পরিপাটি করে রাখা কিন্তু আগের মতো কোনওটাই নয়। গঙ্গাজলের সারি সারি বোতল, ঠাকুরের একরাশ বাসন, পঞ্চপ্রদীপ, চামর– সবকিছু পিসিমা নিজের ইচ্ছেমতো, সুবিধেমতো গুছিয়ে নিয়েছে। রাগে দুলালের মাথা দপদপ করতে লাগল। এখনও শ্রাদ্ধ চোকেনি।

শংকরীর নিজের হাতে সাজানো সংসার এলোমেলো করা শুরু হয়ে গেল! সে চিৎকার করে ডাকল, ‘পিসি, ও পিসি।’ বাড়িতে থইথই করছে আত্মীয়স্বজন। বাইরের লোকও বিস্তর। তার মধ্যেই রাগে দিগ্বিদিক শূন্য দুলাল পিসিকে যা-তা শুনিয়ে দিল। পিসি কেঁদেকেটে তক্ষুনি নবদ্বীপ চলে যেতে চাইল। তখন আবার তাকে হাতে পায়ে ধরে রাখতে হল দুলালকে।

সেই পিসি সপ্তাখানেক আগে চলে গেছে। সিংহাসন আবার আগের মতো পুবমুখো করে বসানো হয়েছে। শুধু ঠাকুরের সিংহাসন নয়, আলমারি, আলনা, যেখানে যেমন ছিল সব তেমনটাই রেখে দিয়েছে দুলাল। শুধু রান্নাঘরটা পারছে না। এই পাঁচবাড়ি কাজ করা রান্নার লোকগুলো যা করে যায়। অনেক চেষ্টা করেও রান্নাঘরটা আগের মতো রাখতে পারছে না দুলাল।

অথচ শংকরী তাকে প্রতিমুহূর্তে আড়াল থেকে সাহায্য করে যাচ্ছে। এখনও অবধি চাল, ডাল, মশলা থেকে শুরু করে সাবান, ফিনাইল কিছুই কিনতে হয়নি তাকে! সব কিছু থরে থরে সাজিয়ে রেখে গেছে শংকরী।

মধুসূদনদাদার দইয়ের ভাঁড়ের মতো তার সংসারের রসদ যেন অফুরন্ত। শ্রাদ্ধের সময় প্রচুর এক টাকা, দু’টাকার কয়েনের দরকার হয়েছিল। সেগুলোও হঠাৎ একটা পুরোনো পাউডারের কৌটোয় পেয়ে গেল। একটা বেবি পাউডারের কৌটো। ছেলেমেয়েকে ছোটোবেলায় এই পাউডার মাখাত শংকরী। দুলাল কিন্তু কৌটোর মধ্যে ছেলেমেয়ের নয়, শংকরীর গায়ের গন্ধ পেল। কৌটোয় একটু তলানি পাউডার পড়ে ছিল সত্যি সত্যি। আর সেই পাউডারের গুঁড়ো গায়ে মেখে একরাশ কয়েন– এক টাকা, দু টাকা, পাঁচ টাকা, দু-একটা দশ টাকারও। সেগুলো হাতে নিয়ে দুলাল তাদের একসঙ্গে পথচলার এতগুলো বছর দেখতে পাচ্ছিল। কত বছর ধরে এগুলো সঞ্চয় করেছে শংকরী! এই সংসারের মতো, তিলে তিলে সে জমিয়ে তুলেছে খুচরোর ভাণ্ডারও।

সব আছে, শুধু সেই-ই নেই।

কয়েনগুলো পেয়ে যাবার পর থেকে জীবনটা ভারি রহস্যময় মনে হচ্ছে দুলালের। আগে এরকম কখনও হয়নি। শংকরী যখন ছিল তখন বড়োবাজারে গদিতে যাওয়া আর বাড়ি ফেরা– এর বাইরে কোনও কিছু নিয়ে ভাবার দরকার হয়নি তার। এখন মনে হচ্ছে জীবনের আনাচেকানাচে তার জন্য অনেক অজানা অপ্রত্যাশিত বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে। দুলাল বাড়িতে যতক্ষণ থাকে, এটা ঝাড়ে, ওটা ঝাড়ে, এটা টানে, ওটা খোলে আর দুরুদুরু বুকে ভাবে, এবার কী বেরোবে। শংকরী কোথায় না কোথায়, কত কী যে লুকিয়ে রেখে গেছে। ‘ও মেসো, হয়ে গেছে। ঠান্ডা হলে বাটিগুলো ঢাকা দিয়ে দেবেন। আমি ওবেলার তরকারি আলাদা বাটিতে রেখেছি। ঘাঁটাঘাঁটি করলে নষ্ট হয়ে যাবে।’

দুলাল দরজা বন্ধ করতে যায় রান্নার মাসির পেছন পেছন। হঠাৎ মাসি ঘুরে দাঁড়িয়ে ব্লাউজের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দেয়। দুলালের গলা শুকিয়ে কাঠ। হাত ঢুকোনো আর বার করে আনার ফাঁকে এক ঝলক দেখা যায় পুরুষ্ট দুই স্তনের মধ্যের গহন খাঁজ।

মহিলাটি দুলালের চোখের তাক বুঝে ঠোঁট টিপে হাসে, তারপর হাত বাড়িয়ে দুলালের হাতে দুটো একশো টাকার নোট দেয়। দুলাল হতভম্বের মতো তাকায়।

‘শুকনোলংকা খুঁজতে গিয়ে একটা কৌটোর মধ্যে পেলাম। আমরা গরিব হতে পারি, চোর নই।’

দুশো টাকা আর অপমানটুকু গিলে নিয়ে দুলাল দেখে মহিলা কেমন দপদপিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। দুলাল অসহায় ভাবে দেখে ওর চলে যাওয়া। কাল আবার আসবে তো? দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াতেই চমকে যায়। ছেলের ঘরের দরজা খোলা। বিছানায় উপুড় শোয়া ছেলে একটু উঁচু হয়ে তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বাবলু কি দেখেছে দুলাল রান্নার মাসির বুকের খাঁজের দিকে…

সে ঢোঁক গিলে বলে, ‘কী রে, দশটা বেজে গেল। ওঠ এবার। আমাকে তো সব গুছিয়ে বেরোতে হবে।’

বাবলু ওই একই ভঙ্গিতে শুয়ে শুয়ে বলে,

‘বাপি আজ রাতে আমি দীঘা যাচ্ছি।’

‘দীঘা! কেন?’

‘এমনি, ভালো লাগছে না। ইন্দ্ররা যাচ্ছে গাড়ি নিয়ে, আমাকে ধরেছে। ঘুরে আসি।’

একুশ পূর্ণ হয়নি এখনও। সামনের এপ্রিলে ওর জন্মদিন। এই প্রথম শংকরী পায়েস রাঁধবে না। ছেলে নিয়ে অশান্তির শেষ ছিল না শংকরীর। অত টাকা দিয়ে বিবিএ-তে ভর্তি করা হল, দুম করে ছেড়ে দিয়ে গাড়ির বিজনেস করবে বলে মেতে উঠল। রাত দুপুরে ফেরা, এক রাশ বন্ধু, ক্লাব, পুজো। অবশ্য এখনও ছেলের মুখ থেকে মদের গন্ধ পায়নি দুলাল। কিন্তু দীঘা! মা চলে গেছে দু ‘মাসও হয়নি।

দুলাল বিড়বিড় করে বলল ‘যা খুশি কর।’

ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। নীচ দিয়ে গাড়ি ছুটছে বিরামহীন। কোথাও কিছু অভাব, বেদনা চোখে পড়ে না। শুধু তার ঘরেই… বেআদব ছেলেকে তার ঘাড়ে ফেলে ড্যাং ড্যাং করে চলে গেল শংকরী। মনটা হুহু করে। বেরোতে ইচ্ছে করে না একেকদিন। কিন্তু ফাঁকা বাড়িতে থাকার কথা ভাবলেই আঁতকে ওঠে। গদিতে তবু পাঁচটা লোকের মুখ দেখা যায়। বাবলু তো একটু পরেই বেরিয়ে যাবে।

বাবলু চ্যাঁচায় ‘বাপি শুনে যাও।’

এতবড়ো ছেলে, একটু দুধ গরম করে নেওয়া কি ম্যাগি করা– সেটুকুও পারে না। সব বাপ করে দেবে। ছেলেকে মাথায় তুলে দিয়ে গেছে শংকরী। এখন ঠ্যালা সামলাও।

‘কী হল? ম্যাগিটা করতে পারছিস না?’

‘সে সব নয়। একেবারে ভাত খেয়ে বেরোব।’ মেঝেতে বসে ছেলে ব্যাগ গুছোচ্ছে।

‘কী হল আবার?’

‘বাপি, দ্যাখো তো, মা বলেছিল, আমার দুটো ইনার কিনেছে। দ্যাখো না প্লিজ কোথায় আছে। বাড়িরগুলো নিয়ে যাওয়া যাবে না।’

খুব ক্লান্ত লাগে দুলালের। মনে হয়, পালিয়ে যায় কোথাও। এই সংসার তাকে একটুও রেহাই দেবে না। সারাদিন সে এগুলোই করবে নাকি?

ব্যাজার মুখে শোবার ঘরে এসে আলমারি খোলে দুলাল। সব থরে থরে সাজানো। ছেলের, বাপের, শংকরীর কাপড়জামা– সব আলাদা আলাদা তাকে। এমনভাবে গুছিয়ে গেছে শংকরী যে অন্ধ মানুষও খুঁজে পেয়ে যাবে। কিন্তু দুলাল বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে আলমারি খুলে। তার মনে হয়, এই মহাসমুদ্র থেকে প্রার্থিত জিনিসটি সে খুঁজে পাবে না।

‘পেলে, বাপি?’ ছেলের চিৎকারে হুঁশ ফেরে দুলালের। গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে সে। ছেলের তাকে খুব সহজেই পেয়ে যায় প্যাকেটে নতুন দুটো ইনার। আলমারি এবার বন্ধ করলেই হয়। দুলাল তবু দাঁড়িয়ে থাকে আরও খানিকক্ষণ। হ্যাঙারে ঝোলানো শংকরীর শাড়িগুলোর ঘ্রাণ নেয়। প্রতিটা দামি শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ আর ক্লাচব্যাগ মিলিয়ে মিলিয়ে রাখা। সেজেগুজে বেরোলে মাথা ঘুরে যেত সবার। সেসময় দুলালের তাকিয়ে দেখার সময় হয়নি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলমারি বন্ধ করতে গিয়ে থমকে যায় সে। আরে, এই দামি দামি ক্লাচব্যাগগুলোর মধ্যে এই ছেঁড়া ছেঁড়া পার্সটা কেন? আবছা মনে পড়ে, বহুবছর আগে নবদ্বীপ যাবার সময় ট্রেন থেকে কিনেছিল এটা। বহুদিন দেখেনি। এটা ব্যবহার করত নাকি শংকরী?

কী মনে হতে ব্যাগটা বার করে খোলে দুলাল, অমনি তার চোখ যেন ঝলসে যায়। ব্যাগের মধ্যে অল্প কিছু খুচরো টাকা আর একটা হলুদ রসিদের মধ্যে শুয়ে এটা কী? একটা বাঁশি! সোনার বাঁশি! রসিদটা খুলে দেখে চিত্রালি জুয়েলার্সের বিল। পেড। শংকরী এত টাকা মিটিয়ে দিয়ে গেছে! চায়নি তো তার কাছে! নিজের জমানো হাতখরচ থেকেই এত টাকা মিটিয়ে দিয়ে গেছে শংকরী?

দুলাল বিছানায় ধপ্ করে বসে পড়ে। তার মনে পড়ে যাচ্ছে এবার। গোপালের জন্য একটা সোনার বাঁশি গড়িয়ে দেবার আবদার করেছিল শংকরী। চিত্রালি থেকেই বরাবর সে গয়না বানায়। সেখানে দেখে পছন্দ করে এসেছিল। শুনেই দুলাল চটে লাল। ‘অত বাড়াবাড়ি কোরো না। গোপালের সোনার বাঁশি! যত্তসব। তুমি বাঁশি গড়ালে বাকি বউরা তো সোনার সিংহাসন চেয়ে বসবে।’

আর একটাও কথা বলেনি শংকরী এ নিয়ে। কিন্তু বাঁশি সে ঠিকই গড়িয়ে রেখে গেছে। নিজের তিল তিল করে জমানো পয়সা দিয়ে শোধও করে গেছে। জন্মাষ্টমীতে হয়তো গোপালের হাতে তুলে দেবে, এমন সাধ ছিল তার। কিন্তু কালরোগ একটুও সময় দিল না। টাটা মেমোরিয়াল থেকে ঘুরে আসার এক সপ্তাহের মধ্যেই…

দু-তিনবার ডেকে সাড়া না পেয়ে এঘরে আসে বাবলু। বাবাকে ওইভাবে খাটে বসে থাকতে দেখে একটু ঘাবড়ে যায় সে।

‘কী হল, পাওনি?’

উত্তরে দুলাল ছেলের চোখের সামনে তার হাতের পাতা মেলে ধরে। সোনার বাঁশির আভায় মুহুর্তে ঘর আলো হয়ে যায়। এখন শুধু ফুঁ দেবার অপেক্ষা।

নীরবে

আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি, সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ..

ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথেই অর্ণবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল তৃয়ার। একেবারে মুখোমুখি। একমুখ দাড়ি আর ঢলঢলে পাঞ্জাবিতে বেশ অচেনাই লাগছিল তাকে। তবু তৃয়া চিনেই ফেলে, প্রায় আঠারো বছর পরেও। সেই আগের চঞ্চল, ডায়নামিক অর্ণব বদলে গেছে অনেকটাই। অবাক হয়ে লক্ষ্য করছিল তৃয়া। সেদিন দুজনে হেঁটে গিয়েছিল কিছুটা পথ। তৃয়ার মনে পড়ে যাচ্ছিল কলেজের সেই সব দামাল দিনগুলোর কথা। তখনও তো তারা হেঁটে গিয়েছিল কত কত পথ একসঙ্গে, পায়ে পা, হাতে হাত মিলিয়ে কথা ফুরোত না দুজনেরই।

অর্ণব একের পর এক সুনীল, শক্তি, কিটস, শেলি আবৃত্তি করত আর তৃয়া মুগ্ধ হয়ে শুনত। দুজনে মিলে গড়ে তুলেছিল তাদের নিজস্ব জগৎ। কখনও বা উদাত্ত গলায় গেয়ে উঠত অর্ণব –

এই তো হেথায় কুঞ্জ ছায়ায় স্বপ্ন মধুর মোহে, এই জীবনের যেকটি দিন পাব, তোমায় আমায় হেসে খেলে

খিল খিল করে হেসে উঠত তৃয়া। তারপর দুজনে সেই মধুর স্বপ্ন দেখত দুচোখ ভরে।

হাঁটতে হাঁটতে আড়চোখে অর্ণবকেই দেখছিল তৃয়া। একটু বেশিই বয়স্ক দেখাচ্ছে না! অথচ তারা তো একই বয়সি। তেমন কথা বলছে না অর্ণব আগের মতো। তৃয়াই বলে চলছে তার স্বামীর কথা, সন্তানের কথা, আরও কত কী! অর্ণবের কি কোনও গল্পই নেই?

চা খাবি? এখানে একটা আড্ডা-ঘর খুলেছে, ওই কফি হাউসের ছোটো সংস্করণ আর কি! দার্জিলিং টি-টা দারুণ বানায়। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল তৃয়া।

না রে! চা খাই না এখন আর, অল্প হাসল অর্ণব।

চা খাস না! এত নেশা ছিল! অবাক হয় তৃয়া।

সে তো কত কিছুরই নেশা ছিল, বলেই থমকাল অর্ণব।

তৃয়ার বুকের ভেতরটা হঠাৎই কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগল। অর্ণব-কে তা বুঝতে না দিয়ে হালকা গলায় বলে উঠল, হ্যাঁ রে, কিছু নেশা শেষ অবধি টানা যায় না।

আচমকা দুজনের মাঝখানে একটা নিস্তব্ধতা চলে এল। এ নীরবতা ভাঙার সাধ্য তৃয়ার অন্তত নেই।

(২)

ব্যাপার কী! ক’দিন খুব অন্যমনস্ক দেখছি। মাথায় একটা হালকা চাঁটি মারল সৈকত। চমক ভেঙে সৈকতের চোখের দিকে তাকাল তৃয়া। ওর চোখ জুড়ে কৌতুক।

তৃয়াও হেসে জবাব দিল, ভাবছি।

ভাবছ! তা কী ভাবা হচ্ছে ম্যাডাম? আমার পক্ষে না বিপক্ষে? হাসতে হাসতেই বলল সৈকত।

ছেলেটা মহা ফাজিল। বাড়িতে থাকলে সারাক্ষণ মাতিয়ে রাখে। অন্য কিছু ভাবারই অবকাশ পায় না তৃয়া।

যদি বিপক্ষে ভাবি… তৃয়া চোখ নামাল।

সে কি ম্যাডাম! পুরোনো প্রেম আবার এল কি ফিরিয়া?

সৈকত কি বুঝে নিল কিছু! তৃয়া সৈকতের এলোমেলো চুলগুলো আরও খানিকটা ঘেঁটে দিয়ে বলল, পাগল একটা!

হেসে উঠল সৈকত। তৃয়ার কপালে স্নেহ চুম্বন আঁকতে আঁকতে বলে উঠল- তুই জীবন ছাইড়া গেলে মাইনষে কইবে মরা জীবন রে..

সৈকত-কে আঁকড়ে ধরল তৃয়া, প্রবল ভাবে।

(৩)

আবার দেখা যদি হল সখা প্রাণের মাঝে আয়…

অ্যাই অর্ণব! এত হনহন করে যাচ্ছিস কোথায়?

তোর সঙ্গে পরে কথা বলছি তৃয়া, একটু ব্যস্ত আছি।

অবাক হয় তৃয়া। ঠিক অবাক অবশ্য নয়, গলাটা কেমন ব্যথা ব্যথা করছে। গত দুদিন ধরেই অর্ণব এটা করে চলেছে। যখনই ডাকছে তৃয়া, সময় নেই ওর। অথচ তৃয়া টের পাচ্ছে সমস্ত কলেজ জুড়ে অর্ণবের তীব্র উপস্থিতি। শুধু তৃয়া ডাকলেই…

অভিমান করে তৃয়া। এড়িয়ে চলারও চেষ্টা করে। পারে কি? উলটে কী এক অমোঘ টানে আরও কাছে কাছে চলে আসে অর্ণবের। তৃয়া অপেক্ষা করে ওই একটি মাত্র ডাক শোনার জন্য!

(৪)

সুখের সংসার বলতে ঠিক যা বোঝায় তৃয়ার সংসারটাও ঠিক তেমনই। তবু হঠাৎ হঠাৎ এই সুখের মধ্যিখানে অর্ণব নামের একটা কাঁটা অনবরত খোঁচাতে থাকে। তৃয়া রক্তাক্ত হয়, জখম হয় সৈকতও। অথচ এই রক্তক্ষরণ বন্ধের উপায় জানা নেই কারাওরই। সৈকতের ভালোবাসার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করার পরও, তৃয়া বুঝতে পারে কোথায় যেন কিছু শূন্যস্থান এখনও রয়ে গেছে। আজও কোনও অলস দুপুরে বা একাকী রাতে ছাদে দাঁড়ালে এক রাশ হিমেল বাতাস কোত্থেকে এসে, তৃয়ার সব কিছু উড়িয়ে নিয়ে চলে যায়। দু’গাল বেয়ে লোনা জল হু হু করে গড়িয়ে যেতে থাকে। তৃয়া আর আটকায় না তাকে। সে জানে এই শূন্যস্থান একমাত্র পূরণ করতে পারে অর্ণব। শুধু একটিবার দেখা হোক।

 

দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী ,দীর্ঘ বরষমাস…

ঝগড়া, ভুল বোঝাবুঝি, চিত্কার নাহ্ তাদের সম্পর্কের মধ্যে এগুলো কোনওদিনই অযাচিত ভাবে ঢুকে পড়েনি। শুধু তৃয়া যেদিন টের পেল অর্ণব স্বেচ্ছায় দূরে চলে যেতে চাইছে, আর পিছু ডাকেনি সে। হয়তো কেঁদেছে, তবে সে কান্নার খবর অর্ণব পায়নি। হয়তো অভিমান করেছে, মনে মনে অসম্ভব যুদ্ধ করেছে, আঁচড়ে কামড়ে দিয়েছে অর্ণবকে শুধু ধরা দেয়নি আর কিছুতেই। কোনওদিন জানতে চায়নি তৃয়া, কেন? দাঁতে দাঁত চেপে থেকে গেছে এতগুলো দিন।

বাবা-মায়ের পছন্দ করা ছেলে সৈকতকে হয়তো ভালোবেসেছে একদিন। তবু! এখনও কলেজের ওই রাস্তাগুলো দিয়ে কোনও সময় চললে অজান্তেই ঘাড় ঘোরায় তৃয়া। কেউ কি ডাকছে? ওই তো ওই ছেলেটা! অর্ণব না! ভুলতে চেয়ে কিছুতেই আর ভুলে যেতে পারেনি তৃয়া, কিছুতেই না।

আজ এতগুলো বছর পর অর্ণবকে দেখে পুরোনো সবকিছুই আবার যেন চোখের সামনে চলে আসছিল। সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে পিছিয়ে যাচ্ছিল তৃয়া… ওই তো সেদিন কলেজের সামনের সেই বিরাট খেলার মাঠে বসে তারা দুজন ভিড়, কোলাহলের মধ্যেই দুজনে দুজনাতে মগ্ন। কখনও হাতে হাত ছুঁয়ে হেঁটে যাচ্ছে চেনা-অচেনা পথ পেরিয়ে অলীক সুখের দিকে। সে হাঁটা আর আজকের হাঁটার সঙ্গে তেমন মিল খুঁজে পেল না তৃয়া। তখন হাঁটতে গিয়ে সময়ে খেয়াল থাকত না দুজনেরই। আজ বারবার হাত ঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছে তৃয়া। ছেলের ছুটি ১-টায়, সৈকতও আজ আগেই ফিরবে। আইনক্স-এ জঙ্গল বুক-এর টিকিট কাটা।

অবাক হয় সে। গলার মধ্যে সেই আঠারো বছর আগেকার কষ্ট কষ্ট ব্যথাটা আর নেই তো! অর্ণবের কথা জানতে ইচ্ছে করে তার। কী করে সে এখন? চাকরি জুটিয়েছে আদৌ? বিয়ে করেছে? অর্ণবের অদ্ভুত শীতলতার কাছে আজও তৃয়া নিজেকে খুলতে পারে না। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যায় আরও কিছুটা দূর।

তুই এখনও কবিতা লিখিস? জানতে চায় তৃয়া।

ম্লান হাসে অর্ণব, কবিতা আর ধরা দেয় না রে। হারিয়ে গেছে অক্ষর, আঠারো বছর আগে।

একদিন হারাবে অক্ষর, সেদিনও কি প্রেম থাকবে? শব্দ বদলে ভালোবাসা দেব, শুধু তুই ছুঁয়ে থাকলে মন্ত্রের মতো — উচ্চারণ করে তৃয়া।

তোর এখনও মনে আছে? এবার যেন অর্ণবের অবাক হওয়ার পালা।

ওই একটা ডায়ারিতে লিখে রেখেছিলাম, মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে, তাই হয়তো মনে আছে। চোখ নামাল তৃয়া।

অর্ণব হাসল। হয়তো বুঝে নিল শুধু এই কবিতাটিই না, অর্ণবের লেখা প্রায় সব কবিতাই হুবহু বলে দিতে পারে তৃয়া আজও।

তুই আজও গান গাস? আচমকাই জানতে চায় অর্ণব।

গা-ন! ধুর, সময় কোথায়? ছেলে যা দুষ্টু। তৃয়া হাসে। সৈকত বলে, জানিস তো! আবার শুরু করার কথা… কিন্তু!

কিন্তু কী?

আর নতুন করে কোনও কিছু শুরু করতে ইচ্ছে করে না রে। তৃয়ার গলায় সামান্য হতাশা কি ঝরে পড়ল?

অর্ণব হাসল আবার। আড়চোখে তৃয়াকে দেখল সে। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে মেয়েটা। পুরোদস্তুর সংসারি হয়ে উঠেছে। আগের চাইতে অনেক বেশি সুন্দরী আর পরিণত লাগছে তাকে। ভালো লাগল অর্ণবের। এই পরিপূর্ণতা সে কোনওদিনই দিতে পারত না তৃয়াকে, কোনওদিনই না।

ইদানীং সৈকতকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরতে মন চায় তৃয়ার। অফিসে থাকলে ঘনঘন ফোন বেজে ওঠে সৈকতের, কখন আসবে? সৈকত বুঝতে পারে আর তাদের মধ্যে কোনও কাঁটা নেই। তার অজান্তেই কে যেন সরিয়ে নিয়েছে ওটা, তাদের মাঝখান থেকে। সৈকত স্ত্রী-র কাছে কিছু জানতে চায় না। কিছু জানারও নেই তার। সৈকত শুধু জানে তারা বাঁচবে একসঙ্গে আরও দীর্ঘ দীর্ঘ বছর।

 

মম দুঃখবেদন মম সফল স্বপন তুমি ভরিবে সৌরভে..

আর বেশি দূর এগোনো যাবে না রে, ছেলেটার ছুটির আগে স্কুলের গেটের কাছে পৌঁছোতে হবে, নইলে কান্নাকাটি শুরু করে দেবে। হালকা গলায় বলে উঠল তৃয়া।

ওহ্ যাবি? তা যা, হঠাৎ যেন চমক ভাঙল অর্ণবের।

সরাসরি তৃয়া-র দিকে তাকাল অর্ণব। একটু হাসল। কিছুই তো জানতে চাইলি না?

জেনে গেছি যে! তৃয়ার গলায় হাসি ঝরে পড়ল।

কী জেনে গেছিস? জানতে চাইল অর্ণব।

সে আর তোর শুনে কাজ নেই। আমি চলি রে। খুব ভালো থাকিস। বলেই হাতটা বাড়িয়ে দিল তৃয়া।

হাত বাড়িয়ে আবার সেই পুরোনো স্পর্শ খুঁজে পেল অর্ণব। কিন্তু সেই অতীতের উষ্ণতার দেখা মিলল না। হাত ছেড়ে তৃয়া হাঁটতে শুরু করল, যেখানে তার ছেলে অপেক্ষা করছে। সৈকত-কেও হোয়াটসঅ্যাপ-এ মিস ইউ লিখে পাঠিয়ে দিল তৃয়া। হাঁটতে হাঁটতেই শুনতে পেল অর্ণব বলছে, একবার কিছু বলার সুযোগ দিতে পারতিস! তৃয়া? একবার শুনে যা…

তৃয়া এই ডাকটার জন্যই তো এতদিন অপেক্ষা করছিল। কিন্তু আজ আর কিছু শুনতেই ইচ্ছে করল না তার। তৃয়া তার হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল।

অচেনা অসুখ

আজ ক’দিন ধরেই মনটা কেমন যেন হু-হু করছে। কাগজে আজকাল এমন সব খবর বেরোয়, সদ্য যৌবনে পা দেওয়া মেয়ের মা হয়ে তাতে বুক কাঁপাই স্বাভাবিক। কোনও এক অশনিসংকেতের আভাসে বুকের ভিতরটা মাঝেমধ্যেই কেঁপে কেঁপে ওঠে। তার উপর সকাল থেকে আকাশটাও কেমন যেন মুখভার করে রয়েছে। টানাহ্যাঁচড়া করে কোনওরকমে শরীরটাকে বিছানা থেকে বাথরুম পর্যন্ত নিয়ে গেলাম। স্কুলে যেতে হবে যে। আজ আর ছাদে যেতে ইচ্ছে করল না। বারান্দাতেই ভিজে জামাকাপড় মেলতে মেলতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবার চোখ চলে গেল রাস্তার ওপাশে রায় কাকিমাদের পুরোনো আমলের সেই বিশাল বাড়িটার দিকে। অবশ্য বাড়ির সঙ্গে ‘পোড়ো’ কথাটা জুড়ে দিলেও খুব একটা ভুল বলা হবে না। একপাশ ভেঙে পড়ে গেছে। ইটগুলো যেন দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে গিলে খাওয়া চেহারা নিয়েছে। চতুর্দিকে আগাছা। বড়ো বড়ো বটের শিকড় বাড়ির দেয়াল ফাটিয়ে মাথা চারা দিয়ে উঠেছে। একটা অংশে বোধকরি নিশাচর প্রাণীরাও নির্বিঘ্নে বসবাস করছে। রাতে তাদের ডাকও কানে আসে। এই ভাঙাচোরা বাড়িটার একটা কোণাতেই কোনওরকমে বেঁচে আছেন কাকিমা।

অথচ শাশুড়ি-মার থেকে শুনেছিলাম এককালে নাকি ওই বাড়ি ছিল দেখার মতো। দুর্গাপুজোর সময় হাজারো লোকের সমাগম হতো এখানে। ফি-বছর চন্দননগরের আলোর ভেলকি, আতসবাজির রোশনাই আর সাবেকি পুজো দেখতে মানুষের ঢল নামত।

সে বছরও এক বিদেশি মহিলা এসেছিলেন পুজো নিয়ে ডকুমেন্টারি বানাবার জন্য। নাম ইলোরা ফ্লোরেন্স। আশ্চর্যের কথা, যে কাকু, কাকিমার সন্তান না হওয়া সত্ত্বেও গঞ্জনা দেওয়া দূরে থাক, এতটুকু খারাপ ব্যবহার পর্যন্ত করেননি, সেই মানুষটিই কিনা চিরতরে কাকিমাকে ছেড়ে ওই ইলোরার সঙ্গে চলে গিয়েছিলেন। তারপর আর দেশে ফেরেননি।

শাশুড়ি যতদিন বেঁচেছিলেন, ততদিন তবু গালমন্দ করারও একটা লোক ছিল। এখন একেবারে একা। এক দেওর ছিল বটে। শাশুড়ি মারা যাওয়া ইস্তক সে দেওরও এমুখো হয়নি। ডাক্তারি পড়তে গিয়ে বিদেশবিভুঁইতেই পাকাপাকি ভাবে থেকে গেছে। শুনেছি তার দুই ছেলেমেয়েই নাকি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র হয়েছে। এই অভাগির খবর নেওয়ার সময়ই বা তাদের কোথায়। আর খবর নেবেই বা কেন, যেখানে কাকুই…!

তিনকুলে আর কেউ নেই কাকিমার। তবু ওই বাড়ি আগলে পড়ে রয়েছেন। কী আশা নিয়ে মহিলা বেঁচে আছেন, ওপরওয়ালাই জানেন! বয়স প্রায় নব্বই ছুঁই-ছুঁই। কোমর ভেঙে গেছে। চোখেও ভালো দেখেন না। দুগ্গা ঠাকুরের মতো পানপাতা মুখ, আর কোমর ছোঁয়া ঢেউ খেলানো চুলে, এককালে ডাকসাইটে রূপসী ছিলেন কাকিমা। একসময়ে এই কাকিমার প্রেমেই পাগল ছিলেন রায় কাকু। সেই কাকুই কিনা পুরোনো টান ভুলে বিদেশিনির মোহে দেশছাড়া হয়ে গেলেন! ছেড়ে গিয়েছিলেন কেবলমাত্র একখানা চিঠি। যাতে স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি তিনি কাকিমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন।

কাকিমার কথা ভাবলে খুব খারাপ লাগে। কত অভিমান যে পাথরের মতো বুকে চেপে বসে আছে কাকিমার। এখনও অপেক্ষা করে আছেন, যদি কখনও স্বামী ফিরে আসেন। শেষ দেখাটুকু যদি দেখে যেতে পারেন। মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি কাকু যেন সত্যিই ফিরে আসেন, এই শেষবেলায় যেন কাকিমা দেখে যেতে পারেন ওনাকে।

সাত-পাঁচ ভাবছি, এমন সময় রিচার চিল চিৎকার শুনে ছুটতে ছুটতে নীচে নেমে এসে দেখি বাবার সঙ্গে খুনশুটি চলছে। আঠারো পেরিয়ে সবে উনিশে পড়বে এই শ্রাবণে, কিন্তু আচার ব্যবহারে এখনও শৈশবেই যেন আটকে আছে মেয়েটা। দেখেই মাথাটা গরম হয়ে গেল।

‘কতবার বলেছি না তোমাকে, মেয়েদের এভাবে গলা চড়িয়ে কথা বলতে নেই। কিন্তু  তুমি শুনলে তো। তুমি তো ঠিকই করে নিয়েছ আমার কোনও কথাই শুনবে না।’

দুজনের কেউ-ই খুব একটা আমল দিল বলে মনে হল না। নিজেরা নিজেদের মতো এককোণে দাঁড়িয়ে একে- অপরের কানেকানে ফিসফিস করতে থাকল। অদ্ভুতভাবে দুজনেরই ঠোঁটের কোণায় তাচ্ছিল্যের হাসি। সহ্য করতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘ভদ্রতা, সভ্যতা তো হারিয়েই বসে আছ। তা এবার কী পাকাপাকি ভাবে পড়াশোনাটাও ছেড়ে দিলে। আর ভাস্কর তোমাকেও বলিহারি যাই, উঠতি বয়সের মেয়ের সঙ্গে কেউ এভাবে…’ চেষ্টা করেও নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। রাগের মাথায় কদর্য সত্যিটা খানিকটা হলেও বেরিয়েই এল।

বরাবরই আমি শান্ত প্রকৃতির। কোনও চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুনলেই হাত-পা কাঁপতে থাকে। সেখানে এমনভাবে সহজ সত্যটা বেরিয়ে আসায় বুকের ভিতর কেমন যেন অস্থির করতে থাকল। মনটা দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। এত কিছুর পরেও দুজনের চোখে-মুখে প্রতিক্রিয়ার লেশমাত্র নেই। ক্রমশ নিরস্ত হয়ে পড়ছিলাম। সবার মাঝে থেকেও একাকীত্ব ঘিরে ধরছিল আমায়। ভীষণ অসহায়বোধ করছিলাম। নিজের অজান্তেই দু-চোখ ছলছল করে উঠল আমার।

‘নূপুর হঠাৎ এত ওভার রিঅ্যাক্ট করছ কেন? কী হয়েছে তোমার?’– আমার দু-কাঁধে হাত রেখে, ‘আমি তো আগাগোড়া এভাবেই…। রিচা যতই বড়ো হোক না কেন, ওতো আমার কাছে সেই ছোট্ট তাতাই-ই রয়ে গেছে। বাবা-মায়ের কাছে বাচ্চারা সারাজীবন ছোটোই থাকে।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু…’ হঠাৎই মুখে যেন কেউ তালা লাগিয়ে দিল। পুরুষদের যতই বয়স বাড়ুক, তারা কি কমবয়সি কোনও নারীর সঙ্গলাভের প্রলোভন এড়িয়ে যেতে পারে? অন্তরের কথা অন্তরেই থেকে গেল। শত চেষ্টা করেও কিছুতেই কুরুচিকর সত্যিটা বলে উঠতে পারলাম না। অথচ সেই সত্যিটাই আমাকে নিরন্তর কুরে কুরে খাচ্ছিল। মনে মনে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম আমি।

‘আজকাল তুমি অল্পেই রেগে যাচ্ছো। সব সময় খিটখিট করছ। কী হয়েছে? জানি না কেন, মনে হচ্ছে তুমি ভিতরে ভিতরে কিছু একটা নিয়ে খুব বিব্রত হয়ে আছো।’ আমার হাতটা ধরে সোফায় বসাল ভাস্কর।

‘সমস্যাটা কী? পরিষ্কার করে না বললে বুঝব কেমন করে!’

‘কিচ্ছু না।’ এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আজকাল ভাস্করের এই আদিখ্যেতাগুলোকে বড়ো মেকি মনে হয়। মনে হচ্ছিল ঘর থেকে বেরিয়ে যাই। যত তাড়াতাড়ি বাড়িটা ছেড়ে বেরোনো যায় ততই ভালো। স্কুলের ছেলেমেয়েগুলোর প্রতি তো কিছু কর্তব্য রয়েছে আমার। বাদ-বিবাদে এমনিতেই খানিক দেরি হয়ে গেছে। রেডি হয়ে বেরোতে হবে এক্ষুনি। যেই উপরের ঘরের দিকে পা বাড়াতে যাব, অমনি রিচা পিছন থেকে হাতটা টেনে ধরল, ‘মা, আগে খেয়ে নাও। তারপর তৈরি হয়ে একেবারে বেরিয়ো।’

‘হাতটা ছাড়। আমার খিদে নেই।’

‘খিদে নেই বললে তো চলবে না।’ একপ্রকার জোর করেই টেবিলে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল রিচা।

‘মা, কেন জানি না, মনে হয় তুমি সবসময় আমার বিয়ে নিয়ে টেনশন করো। কিন্তু কেন মা? আমার এখন কতই বা বয়স! তাছাড়া আমাকে দেখতে শুনতেও খারাপ না যে আমার জন্য পাত্র খুঁজতে অসুবিধা হবে! কী বলো বাবা?’

‘একদম ঠিক বলেছিস। তোর মতেই আমার মত। অ্যাতো তাড়াহুড়ো কীসের আমি তো সেটাই বুঝতে পারছি না!’

ক্ষণিক আগেই যিনি আমার চিন্তায় মরে যাচ্ছিলেন, রিচার কথায় সে-সব কাটিয়ে একেবারে চনমনে হয়ে উঠলেন।

‘তবে রিচা, একটা কথা কিন্তু ঠিক। তুই যেভাবে আড়েবহরে বেড়ে চলেছিস, তাতে করে সুপাত্র পাওয়া সত্যিই মুশকিল হবে।’

‘মা, দ্যাখো না বাবা সবসময় আমাকে মোটা-মোটা বলে।’  আমার প্লেটে রুটি, আলুর দম আর গাজরের হালুয়া দিতে দিতে বলল রিচা। ‘জানো মা, আমি মোটা হয়ে যাচ্ছি বলে বাবা আমাকে একটুও খেতে দিল না। আমার থেকে সব কেড়ে নিয়েছে। মাসি এই ডিশটা কত ভালো বানায় বলো। কাল কাজল মাসির কাছে আবদার করেছিলাম বলেই মাসি ওটা বানিয়েছিল। আর আমিই খেতে পারলাম না। সেই জন্যই তো বাবার সাথে ঝগড়া করছিলাম। তুমিই বলো, আমি কি এতই মোটা?’

রিচার কোনও কথার জবাব না দিয়েও আচার-ব্যবহারে বুঝিয়ে দিলাম যে, ওর এই সমস্ত কথা আমার একেবারেই পছন্দ হচ্ছে না। গলা দিয়ে খাবার নামছিল না। থালা সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।

‘উঠে পড়লে যে, কিছুই তো খেলে না। সব পড়ে রইল। হালুয়াটাতে তো হাতই দিলে না।’

‘সকাল সকাল মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করছে না।’

‘একটু অন্তত…’

‘ছেড়ে দে রিচা, তোর মা বোধহয় ডায়েটিং-এ আছে। ফিগার মেনটেইন করতে হবে না!’ ভাস্করের কথা শুনে রিচা হাসতে শুরু করল। দুজনের আচরণ দেখে মনে হচ্ছিল কেউ যেন ফুটন্ত তেল ঢেলে দিয়েছে আমার সারা শরীরে। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে উপরে উঠে যাচ্ছিলাম। হঠাৎই কী মনে হল সিঁড়ির মুখটাতেই থেমে গেলাম। ‘রিচা, তুমিও রেডি হয়ে নাও। যাবার পথে কলেজে ড্রপ করে দিয়ে যাব।’

‘রিচাকে আমি ছেড়ে দেব। তুমি যাও। কেউ যদি আমার ফুলের মতো মেয়েটাকে বিয়ে করবে বলে, তুলে নিয়ে যায়।’ বলেই দুষ্টুমিভরা হাসি হেসে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রিচাকে কাছে টেনে একেবারে দু-হাত দিয়ে জাপটে ধরল ভাস্কর। দৃশ্যটা সহ্য করতে না পেরে একপ্রকার ছুটতে ছুটতে উপরের ঘরে চলে গেলাম। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই রেডি হয়ে সোজা স্কুলের পথে রওনা দিলাম।

কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারলাম না। সারাক্ষণ ভাস্করের রিচাকে জড়িয়ে ধরার দৃশ্যটা ঘুরপাক খেতে থাকল চোখের সামনে। বাবা, মেয়ের মধ্যে এমন গাঢ় বন্ধুত্ব থাকবে, সেটাই তো স্বাভাবিক, কিন্তু ভাস্কর তো রিচার নিজের বাবা নয়… সৎ বাবা। এই কথাটা চেষ্টা করেও একটি মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারিনি।

পুরোনো স্মৃতিগুলো মনের আনাচেকানাচে ভেসে বেড়াতে থাকল। সতেরো বছর আগেকার কথা। রিচা তখন মাত্র দুই। একদিন বিকেলে মেয়েকে নিয়ে খেলা করছি, এমন সময় ভাস্করই দুঃসংবাদটা নিয়ে এল। রোড অ্যাক্সিডেন্ট-এ দেবাশিস মারা গেছে।

ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। ওই একটা দুধের শিশুকে নিয়ে একা কীভাবে সামলাব। সংসারে তো দ্বিতীয় আর কেউ নেই। বাচ্চা সামলে স্কুল করব কীভাবে? ওদিকে স্কুল ছেড়ে দেব যে, সে উপায়ও নেই। জমানো পুঁজিতে কতদিনই বা চলবে। একদিন না একদিন তো কলসি খালি হবেই। ওপরওয়ালা যেমন এক হাতে কেড়ে নেয় তেমনি বোধহয় অপর হাতে দেয়ও। তখন এই কাজলদিই আশার আলো দেখিয়েছিল। ওর হাতেই মেয়ের সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে স্কুল সামলেছি।

তারপর যা হয় আর কী, সময় ধীরে ধীরে সব শোক ভুলিয়ে দেয়। অর্থনৈতিক সাপোর্ট-টা ছিল বলে পথ চলতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। ভাস্করকে সময়ে-অসময়ে পাশে পেয়েছি।

ভাস্কর দেবাশিসের-ই অফিসের বন্ধু। সেই সূত্রেই আগে আলাপ ছিল। দেবাশিসের পাওনাগন্ডা মিটিয়ে দেবার ব্যাপারে ভাস্করই অফিসের সঙ্গে মধ্যস্থতা করিয়েছিল। সেখান থেকেই সম্পর্ক গড়ে ওঠা। দেবাশিসের পরে আমার আর রিচার সমস্ত দায়ভার ও নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। তারপর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। কিন্তু মানুষের মুখ আর মুখোশে যে বিস্তর ফারাক সেটা কালে কালে বুঝছি। তখন ওর মিষ্টি কথায় ভুলে গিয়েছিলাম। ওর ছবিটা সত্যি-ই অন্যরকম ছিল। আমার আঘাত লাগলে ওর চোখেমুখে ব্যথা প্রকাশ পেত। ভাবটা এমন যেন আমাকে পেয়ে ও পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষ। আমাকে নিয়ে বেশ অহং কাজ করত ওর মধ্যে। ওর বন্ধুবান্ধব সার্কেলের মধ্যে আমি ছিলাম সবথেকে সুন্দরী। অবশ্যই ওর কথায়। তার উপর স্কুলে চাকরি করি। সব সময় আমার মধ্যে ডুবে থাকত ও। আমার গায়ে নাকি অদ্ভুত একটা মিষ্টি গন্ধ আছে। যেটা ওকে টানত।

আমার সুখের কথা ভেবে দ্বিতীয়বার বাচ্চার জন্যও বলেনি আমাকে। কী করে বুঝব যে এগুলো নাটক ছাড়া আর কিছু ছিল না। আজ বুঝতে পারছি ওটা আমার জীবনের সবথেকে বড়ো ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। বুকের ভিতরটা টনটন করতে থাকে মেয়েটার জন্য। কী যে করছে… কলেজে গেল কিনা? নাকি বাড়িতেই রয়ে গেল দুজনে।

কাজলদি-টাও তো আর পেরে উঠছে না। অসুখে একেবারে কাবু হয়ে পড়েছে। কাজটা ছেড়েই দিত হয়তো, শুধু মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে দু-বেলা একটু রান্না করে দিয়ে যায়। মেয়ের যে আবার মাসি ছাড়া কারও হাতের রান্না মুখে রোচে না। না হলে আগের মতো যদি দিদি সারাদিন থাকত, তাহলে তো চিন্তার কোনও কারণ-ই ছিল না।

টিচার্স রুমেই চোখবুজে বসেছিলাম। সম্বিৎ ফিরল ফিজিক্স টিচার কাবেরীদির ডাকে।

‘শরীরটা খারাপ নাকি নূপুরদি?’

‘ওহ্। কাবেরীদি। ওই একটু…’

‘না, মানে ক্লাস নিতে যাওয়ার সময়ও দেখলাম এইভাবে চোখবুজে বসে আছেন। তাই জিজ্ঞাসা করলাম। ক্লাসও তো নিতে যাননি আজকে।’

‘আরে না না ঠিক আছে। মাথাটা ধরেছে বুঝলে।’

‘সুতপাকে বলব চা দিয়ে যেতে?’

‘আরে আপনি বসুন। আমি বলছি।’

চা দিয়ে যাওয়ার পরে মনটা অন্যদিকে ঘোরাতে একটা দৈনিক পত্রিকা নিয়ে বসলাম। কাগজটা হাতে নিতেই মাথাটা যেন দপদপ করতে লাগল। প্রথম পাতাতেই বড়ো বড়ো হরফে লেখা ‘বাবার দ্বারা মেয়ে ধর্ষিতা’। বিগত পাঁচ মাস ধরে ক্লাস এইটের এক ছাত্রীকে তার বাবা ধর্ষণ করে গেছে। এতদিন বাবার ভয়ে মুখ খুলতে পারেনি সে। অবশেষে শিক্ষককে চিঠি দিয়ে তার নির্মম কাহিনি তুলে ধরেছে কিশোরীটি। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল, ‘হায় ভগবান।’ এ কোন সমাজে বাস করছি আমরা! মানুষ কি তাদের বিকৃত কামনা-বাসনা চরিতার্থ করতে…। না আর ভাবতে পারছি না। মাথাটা অসহ্য যন্ত্রণা করছে। ক্লাস পর্যন্ত নিতে যাইনি।

না না এসব কী ভাবছি আমি। সবাই কি সমান? সমাজের কয়েকটা বিকৃত মানুষের জন্য ভাস্করকেও এমন ভাবার… না না… এত নেগেটিভ ভাবছি কেন? নিজেকে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। ক্ষণিকের জন্য বোঝাতে পারলেও, পরমুহূর্তেই আবার মনে হচ্ছে– কিন্তু সেদিনের দুপুরের ঘটনা।সেটা কেমন করে ভুলব?

ভাস্কর যে এখন মাঝেমধ্যেই ছুটি নেয়, সেটা বিলক্ষণ আমি জানি। শরীর একটু খারাপ লাগলেই ব্যস আর অফিসের নাম মুখেও আনে না। সারাক্ষণ মেয়ের সঙ্গে হাহা-হিহি চলতেই থাকে। তখন দেখে মনেই হয় না, এই লোকটা অসুস্থতার কারণে অফিস যায়নি।

টিচার্স-ডে-র দিন বেশ কয়েকঘন্টা আগেই বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। অন্যান্য দিনের মতোই বাড়িতে কেউ নেই ভেবে দরজা খুলে নিজের ঘরে গিয়ে দেখি রিচা বেহুঁশ হয়ে ঘুমোচ্ছে আর ভাস্কর নীচু হয়ে ওর গালে চুমু খাচ্ছে। আমাকে দেখে কেমন যেন চমকে উঠল ভাস্কর। তারপরেই হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সেদিন থেকেই মনের মধ্যে একটা অশঙ্কা বাসা বেঁধেছে। সৎবাবা আর মেয়ের মধ্যে কোনও অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি তো?

রিচাকে ভালো-মন্দের শিক্ষা দিতে দিতে ফেড-আপ হয়ে গেছি। কতবার ইনিয়েবিনিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছি নারী-পুরুষের মধ্যে ন্যূনতম ব্যবধান থাকাটা জরুরি। কিন্তু ও মেয়ে বুঝলে তো! বরং দিন দিন আবিষ্কার করছি আমাদের তিনজনের সংসারে আমিই অপাঙ্ক্তেয়। রিচার কাছে ভাস্করই সব, আমি কিছু বলতে গেলেই ওর ব্যাপারে হস্তক্ষেপ হয়ে যায়। সেই কারণেই কখনও ছাদে, কখনও বাগানে দুজনের ফিসফিসানি চলতেই থাকে। কখনও কখনও লোকলাজ ভুলে প্রকাশ্যেই একে-অপরকে আলিঙ্গন করতে শুরু করে।

আমার অজান্তেই গাল বেয়ে জল নেমে আসছিল। ইচ্ছে করছিল ডাক ছেড়ে কাঁদি। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে এটা একেবারেই শোভনীয় নয়। কোনওমতে নিজেকে সামলে রাখলাম।

সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মেয়েটাকে পাত্রস্থ করার। সেইমতো অফিস কলিগ থেকে শুরু করে কাছের আত্মীয়স্বজন সকলকেই বলে রেখেছি ছেলে দেখার জন্য।

দেয়াল ঘড়ির দিকে চোখ যেতে দেখলাম পাঁচটা বেজে গেছে। বাড়ি যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। এই কয়েকদিনে ‘বাড়ি’-র পরিভাষাটাই বদলে গেছে আমার কাছে। কেমন যেন একটা অনীহা তৈরি হয়েছে এই শব্দটার প্রতি। স্নেহ, ভালোবাসা, একে-অপরের প্রতি বিশ্বাস, ত্যাগ না থাকলে ঘরের মানেটাই বদলে যায়। সেই ঘরে কারই বা ফিরতে ভালো লাগবে? কিন্তু ফিরতে তো হবেই, এই ভেবে উঠে দাঁড়ালাম।

বিয়ে ঠিক না হওয়া পর্যন্ত মেয়েটাকে অন্য কোথাও রাখার ব্যবস্থা যদি করা যেত। অনেক ভেবে ঠিক করলাম যদি কোনও লেডিস হোস্টেলে থাকার একটা বন্দোবস্ত করা যায় বা কোথাও পড়তে পাঠিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে নিশ্চিন্ত হতে পারি। এছাড়া কোনও পথও যে খোলা নেই। কিন্তু ভাস্করকে কী বলব। রিচাকে হঠাৎ করে বাড়ির থেকে দূরে কেন রাখব তার একটা যথাযথ কারণ তো দেখাতে হবে। রিচাকে বাড়ির থেকে দূরে রাখব– এটা কিছুতেই ও মেনে নেবে না। অযথা অশান্তি করবে।

সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে বাড়ি পৌঁছে গেছি টেরই পাইনি। গাড়িটা পার্ক করে ঘরে ঢুকতে যাব দেখি ভাস্কর বারান্দায় পায়চারি করছে। পরনে কুর্তা পাজামা। বারবার গেটের দিকে তাকাচ্ছে আর দু-হাতের আঙুল মোচড়াচ্ছে। মনে হল কোনও কিছু নিয়ে খুব চিন্তিত। আজ বলে নয়, আগাগোড়াই দেখেছি টেনশন হলেই এইরকম আচরণ করতে থাকে। একবার মনে হল জিজ্ঞাসা করি টেনশনের কারণটা কী? কিন্তু পরমুহূর্তেই আর ইচ্ছে হল না, ভাস্করকে না দেখার ভান করে সোজা নিজের ঘরে চলে গেলাম। মনে হল ডাকল। গুরুত্ব না দিয়েই ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লাম। কখন যে চোখ লেগে গেছে বুঝতে পারিনি।

‘নূপুর ওঠো না। কথা আছে।’ বলে আমাকে একপ্রকার ধাক্বা দিয়েই ঘুম থেকে উঠিয়ে দিল ভাস্কর।

‘কী হয়েছেটা কী? কী এমন কথা যে একটু ঘুমোতে দেওয়া গেল না। এবাড়িতে কি এটুকুও স্বাধীনতা নেই আমার?’

‘নূপুর প্লিজ, শোনো তো।’ হঠাৎ করে ‘প্লিজ’ শব্দটা বেশ অবাক করে তুলেছিল আমায়।

‘এই ভাবে বোকার মতো তাকিয়ে থেকো না, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। নীচে অতিথিরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।’

আরও অবাক হয়ে গেলাম। ‘অতিথি?’

‘হ্যাঁ, অতিথি। রিচার হবু স্বামী আর তার মা-বাবা এসেছেন।’

‘কী?’ বিস্ময়ের পর বিস্ময়।

‘আগে বলোনি কেন?’

‘আমি আর রিচা তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার প্ল্যান করেছিলাম। সেইজন্যই আগে থেকে কিছু জানাইনি। রিচা নিজেই পছন্দ করেছে ছেলেটাকে। দিন কুড়ি-বাইশ আগে যেদিন প্রথম ছেলেটার কথা জানাল, সেদিনই ঠিক করেছিলাম আগে নিজে যাচাই করব ছেলেটা কেমন। যদি রিচার যোগ্য পাত্র হয় তবেই তোমাকে জানাব। নচেৎ এমনিতেই তুমি যা টেনশন করো। তোমাকে আর বাড়তি চাপ দিতে চাইনি আমি।’

ভালোমন্দ বোধটাই বোধহয় হারিয়ে ফেলেছিলাম। তা নাহলে পৃথিবীর সবথেকে মিষ্টি সম্পর্ক নিয়ে এমন সন্দেহ মনে ঠাঁই দিই। … ছিঃ.. ছিঃ। শুধুমাত্র আমার বুদ্ধিবিভ্রম-এর জন্য এমন একটা সরল সম্পর্ককে কিনা… আসলে দোষটা আমারই। কোনওদিন ভাস্করকে দেবাশিসের জায়গায় বসাতে পারিনি। আমারই ভালোবাসায় কোথাও একটা ফাঁক থেকে গিয়েছিল। মানুষটার কাছে আমাদের খুশির থেকে বড়ো আর কিছু নেই। অথচ তাকেই, কী ভুলটাই না ভেবেছিলাম আমি। মরমে মরে যাচ্ছিলাম।

ভাস্করের প্রতিটি কথায় তখনও মেয়ের প্রতি উদ্বেগ আর ভালোবাসা ঝরে পড়ছিল। ও-ওর মতোই সহজ ভাবে বলে যাচ্ছিল। ‘পনেরো দিন ধরে সমানে এর-ওর থেকে সুজয়ের সম্পর্কে খোঁজখবর করেছি। বছর দেড়েক হল ডাক্তারি পাশ করেছে। আরজি কর মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি করছে। ভীষণ ভালো ছেলে। সকলের সঙ্গে কথা বলে আশ্বস্ত হয়ে তবেই ওদের আসতে বলেছি। দ্যাখো এবার তোমার কেমন লাগে। তারপরে না হয় বিয়ের কথা এগোনো যাবে। আফটার অল মেয়ের মা বলে কথা, তোমারও তো একটা মতামত থাকবে।’ বলে আমার গাল দুটো একটু টিপে মুচকি হাসল। পরক্ষণেই আবার সিরিয়াস হয়ে গেল। চোখের কোণায় চিকচিক করছে জল। ‘মেয়েটা চলে গেলে ঘরটা খুব ফাঁকা হয়ে যাবে না, নূপুর।’

নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। গাল বেয়ে জলের ধারা নেমে এল। আজ বুঝছি এ পৃথিবীতে আমার থেকে বড়ো সুখী আর কেউ নেই। খামোখাই ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করছিলাম।

নীচে রিচার গলার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। ভাস্কর অধৈর্য হয়ে বলে, ‘চলো নূপুর, ওরা অপেক্ষা করছে যে!

ছায়া ছায়া পাপ

এই ভর সন্ধেবেলায় হঠাৎ বাবুর ঘরে ডাক পড়ল কেন ভেবে পেল না দেবু। সন্ধের গা ঢাকা অন্ধকারে ত্রিপলের ছাউনি দেওয়া লরি থেকে ষোলো বস্তা চিনি আর আট টিন সরষের তেল সবে গুনে গেঁথে ঢুকিয়েছে গোডাউনে, এমন সময় দিনুদা এল, ‘এই দেবা– বাবুর সঙ্গে দেখা করিস একবার।’

সরষের তেলের টিন গুনতিতে ব্যস্ত দেবু ঘাড় না ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবু কোথায়?’

‘গদিতে।’ এটুকু বলেই পিছন ফিরল দিনুদা। এমনিতেই কম কথার মানুষ। তবু ঝড়াং করে পিছন ফিরতে মনটা ‘কু’ গাইল দেবুর। চট্ করে গোনাগুনতির কাজটা ভোম্বলকে বুঝিয়ে দিয়ে সঙ্গ নিল দিনুদার। হাজার হোক বাবুর খাস লোক বলে কথা!

‘কী ব্যাপার দিন্দা?’

‘কী ব্যাপার– আমি কোথ্থেকে জানব? কত্তাবাবুর কথা তো জানিস!’ উত্তর আরও ভাসাভাসা করে দিনুদা এগিয়ে গেল চত্বর ছেড়ে।

গদি বলতে গোডাউন চত্বর-এর এমুড়ো ওমুড়ো ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা খানদশেক লরি আর ম্যাটাডোর ভ্যানের ফাঁকফোকর দিয়ে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যে ব্রিটিশ আমলের অ্যাসবেস্টস শেড দেওয়া ঘরটি তার কথাই বোঝাচ্ছে। দেখতে তেমন আহামরি না হলে কী হয়– ওই ঘরটিই এই আমোদঘাটার সামন্তবাড়ির প্রাণভোমরা। এখান থেকেই নকুল সামন্ত’র মাকড়সার জাল বিস্তার। ওদিকে কাশ্মীর, পঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি থেকে শুরু করে এদিকে অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড আর পাশের রাজ্য বিহার পর্যন্ত বাবুর সাম্রাজ্য ছড়ানো। সেই ঘরে ডাক পড়েছে দেবুর। বুক একটু ধড়াস ধড়াস তো করবেই।

ঘরে ঢোকবার আগে দরজার কাচে নিজের ধুলোমাখা চেহারাটা একবার জরিপ করে নিল তাই। অন্ধকার মাখামাখি হয়ে কাচের গায়ে নিজেকে পরিষ্কার দেখতে পেল না। পাশে এখন কেউ নেই দেবুর। থাকলে নির্ঘাত বুকের ধুকপুকুনি শুনতে পেত।

একটু ইতস্তত করে কাচের দরজাটা আলগা হাতে ঠেলল। ভেতরে পা রাখতে ঠান্ডা এক ছোঁয়া পেল শরীরে। ঘরে মিহি করে এসি চলছে।

ধোপদুরস্ত ধুতি-পাঞ্জাবিতে বাবুর দুধসাদা গায়ের রং খোলতাই হয়েছে খুব। ঠিক মাঝবয়েসি এক রাজা যেন। মাথার কোঁকড়ানো চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। ডান আর বাঁ-হাতের আঙুলগুলোয়  রংবেরঙের পাথর বসানো আংটি। সোনার ঘড়িতে ঘরের আলো চমকায়। মুখে অনবরত চিবিয়ে চলা সুগন্ধি পান। গন্ধে ঘর ম’ ম’ করছে।

একটা তাকিয়ায় কনুই রেখে মোবাইল কানে চেপে কার সঙ্গে বাবু কথা বলে চলেছে নীচুগলায়। দেবুকে ঘরের মধ্যে ঢুকতে দেখে আঙুলের ইশারায় বসতে বলল সামনের নীচু বেঞ্চটায়। শরীরের অস্বস্তি চেপে সাবধানে বসল দেবু। সামনে শুধু ওর নয়, ওরই মতো অন্তত একশো লোকের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা– আমোদঘাটার মুকুটহীন সম্রাট নকুল সামন্ত। বিনবিন করে কপালে ঘাম ফুটছে এই এসির ঠান্ডাতেও, টের পেল দেবু।

ঘরে এখন কেবল দু’জন। প্রথমে একটু ভয়ই করছিল। কে জানে কীসের জন্য এমন জরুরি তলব। দু’একদিনের মধ্যে বেফাঁস কিছু করে ফেলেছে কিনা মনে করবার চেষ্টা করল প্রাণপণে। কথায় বলে, বাবুর চোখ আর বাঘের চোখ!

এমন সময় কত্তাবাবুর নীচুগলায় বলা কথাগুলো শুনতে পেল, ‘গোডাউনের কাজকম্ম কেমন চলছে দেবু?’

টাকরার কাছে শুকিয়ে আসছিল যেন। চেষ্টা করে বলতে পারল, ‘আজ্ঞে ভালোই। এই তো আমোদপুরের লরি আনলোডিং হচ্ছিল!’

নাকের সামনে থেকে মাছি তাড়ানোর মতো ভঙ্গি করে বাবু থামিয়ে দিল ওকে, ‘জানি-জানি। সেজন্যে ডাকিনি তোকে!’ তবে কীসের জন্যে এই অসময়ে ডাক? দমবন্ধ হয়ে আসছিল দেবুর। আজ ঘাড়ে মুণ্ডু নিয়ে ফিরতে পারলে হয়। নকুল সামন্ত মনে হয় মানুষের মন পড়তে পারে। পাশে রাখা ঠান্ডা জলের বোতলটা হাত বাড়িয়ে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘একটা কাজ করতে হবে দেবা!’

‘আজ্ঞে বলুন!’ গলা রীতিমতো কাঁপছিল ওর। হাতের বোতলটাও।

‘ব্যাপারটা কিন্তু খুব গোপনীয়!’ ফিসফিসে গলায় বলা বাবুর কথাগুলো কানের কাছে হিম হয়ে এল কেমন।

‘কেউ জানবে না আজ্ঞে!’ জলে ভেজানো গলায় বাবুকে আশ্বস্ত করবার চেষ্টা করল দেবু।

‘ঠিক বলছিস?’ সামন্তকত্তার গলায় আশঙ্কা আর উৎকণ্ঠার মিশেল।

‘আজ্ঞে ঠিক।’ একটু জোরের সঙ্গে বলল দেবু।

‘তবে এদিকে আয়।’ তাকিয়া ছেড়ে সোজা হয়ে বসল কত্তা। দেবুও বেঞ্চ ছেড়ে ফরাসের একধারে উঠে এল। পাঁচ বছর চাকরি করছে বাবুর এখানে। কোনওদিন এমন করে সামন্তবাবুর কাছটিতে বসতে পারবে ভাবেনি দেবু।

আরও মিনিট কুড়ি পার করে যখন কত্তার কাছ থেকে ছাড়া পেল তখন দেবুর বুকপকেটে দুটো একশো টাকার নোট। কড়কড়ে। দোমড়ানো মোচড়ানোর কোনও সিন নেই। একেবারে বাবুরই মতো ঝকঝকে। ফিট। যা শুনেছে সব মনে মনে রাখবার দাম। পরে আরও পাওয়া যাবে। নকুল সামন্ত ফালতু বকোয়াস করে না। ভূতগ্রস্ত মানুষের মতো এলোমেলো পায়ে গদিঘর থেকে নিজের ডেরার দিকে চলল দেবু ওরফে দেবিদাস পুরকাইত। আজ, এই এখন থেকে পরীক্ষা শুরু হল ওর।

দুই

‘দিন যায়, রাত না ফুরায়।’ ছেলেবেলায় দেখা কৃষ্ণযাত্রায় বিরহিণী রাধার গানের বাণী যেন অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে রিখিয়ার জীবনে। মাঝে মাঝে একলা ঘরে সাজপোশাক ছেড়ে সামন্তবাড়ির বউমা দেয়ালজোড়া বেলজিয়াম কাচের আয়নার সামনে দাঁড়ায়। একেবারে একা।

নিজের অপ্সরা-শরীরের যেখানে যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি দেবার সেগুলিকে নিপুণহাতে যিনি তৈরি করে পাঠিয়েছেন, তাঁকে ধন্যবাদ দেবার পাশাপাশি নানাভাবে অভিসম্পাতও দেয় রিখিয়া। কী দরকার ছিল ভগবানের ওকে এত সুন্দর করে গড়ে তোলবার! মাথায় প্রপাতের মতো একঢাল চুল, টানাটানা চোখ, সুগোল দুটি স্তন এবং সুশোভন শ্রোণিদেশ– এসব কী কাজে লাগল ভগবান?

যে-মানুষটার কোনও ক্ষমতা-ই নেই, সেই মানুষটা বিছানার সঙ্গী হয়ে আছে এই সত্যটা অনেক দাম দিয়ে বুঝতে হল রিখিয়াকে। নিশ্চুপ পড়ে থেকে সামন্তবাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী দীপেনের আঁচড় কামড় সহ্য করতে করতে গোটা বছর ধরে এই অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হল রিখিয়াকে।

গরিব বাবার একমাত্র মেয়ে। তায় যথেষ্ট সুন্দরী। কলেজের ক্লাস শুরু করতে না করতেই উঠেপড়ে লেগেছিল অচিনপুরের কৃষ্ণদাস বৈরাগ্য। খোঁজ খোঁজ করতে করতে কোনওমতে আমোদঘাটার ডাকসাইটে ব্যবসায়ী নকুল সামন্তর নজরে মেয়েকে এনে ফেলা হতেই, বাবা হাত তুলে সোজা হরিদ্বারের পথে। মেয়ে ভাসল কি ডুবল পিছু ফিরে আর দেখার প্রয়োজন মনে করল না। শুধু বড়ো সামন্ত’র অঢেল পয়সা, রঙিন আলোর রোশনাই, গ্রামসুদ্ধ লোক খাওয়ানো আর মেয়ের সর্বাঙ্গ মুড়ে দেওয়া গয়না দেখেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল, এ বিয়ে সুখের না হয়েই যায় না। হায়– এত সহজেই যদি সব সুখ কেনা যেত বাবা!

অনেক দুঃখে মনের অসুখ মনেই চেপে রাখে রিখিয়া। সব ছেড়ে যে-মানুষটা ওকে সুখী মনে করে অনেক দূরে সরে গেছে, সেই বাবার উপরও কোনও অভিমান রাখেনি। শুধু একটাই প্রশ্ন মাঝে মাঝে বিব্রত করে রিখিয়াকে, মা বেঁচে থাকলেও এতটাই নির্লিপ্ত থাকতে পারত বাবা? কে জানে, হয়তো পারত।

গত বৈশাখে ওর বিয়ের পর থেকে এবছর অঘ্রাণ পর্যন্ত মাত্র দুবার ফোন করেছে বাবা। হাসি হাসি মুখে নিজের কাল্পনিক সৌভাগ্যের কিছুটা হলেও সত্যি খবর পৌঁছে দিয়েছে রিখিয়া। ফোনের ওপারে মানুষটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলেছে, ‘সব তোর কপাল মা! নইলে নকুল সামন্তর ছেলের সঙ্গে বিয়ে– হয়!’

হাসি বজায় রাখবার চেষ্টা করতে করতেই রিখিয়া বলেছে, ‘সত্যি বাবা– সবই আমার কপাল। সঙ্গে তোমার আশীর্বাদও ছিল তো!’

মানুষটা কী বুঝল কে জানে। কৃষ্ণনাম করতে করতেই ফোন রেখে দিয়েছিল। সেই শেষ। ইচ্ছা করেই আর রং মিলন্তির খেলায় নামেনি ও। এ বছর বৈশাখ পার হয়ে অঘ্রাণ আসতে এত দেরি হল কেন নিজের মনেই সে প্রশ্ন করে মাঝে মাঝে। বিশাল ফ্রেঞ্চ উইনডোর ধারে একলা দাঁড়িয়ে বিধুর প্রকৃতির কাছে জানতে চায় রিখিয়া, ‘ও অঘ্রাণ– অচিনপুরের মাঠে কি ধান পেকেছে এখন? ঝরতি পড়তি ধানের শিষ এখনও কি আগের মতো তুলে নিয়ে গর্তে ঢোকে মেঠো ইঁদুর? বলো না ও অঘ্রাণ, এখনও কি বাসস্ট্যান্ডের পাশে ‘সত্যনারায়ণ টকিজ’-এর অন্ধকার হলে পাশাপাশি বসে পরস্পরের শরীরের ওম-এ উত্তাপ খুঁজে নিতে থাকে সুদর্শন, দেবিকা, সৌভিক কিংবা দয়াময়ীর মতো আমার বন্ধুরা– আগেকারই মতো?

ও অঘ্রাণ, তুমি কি বলতে পারো একটা শূন্য কলশির সঙ্গে ঘর করতে হলে মেয়েদের আরও কত কী মেনে নিতে হয়? অথচ কলশিটা বিশ্বাসই করতে চায় না তার শূন্যতা। এরপর কী করবার থাকে আর?’

প্রশ্নের পর প্রশ্ন ভাসে বাতাসে। উত্তর আসে না। চেষ্টা করতে করতে হাল ছেড়ে দেয় রিখিয়া। সামন্তবাড়িতে শাঁখ বাজল। শাশুড়ি-মা সন্ধে দিলেন। খাটের উপর হারমোনিয়ামের সামনে এসে বসল রিখিয়া। মনের আগল খুলে দিল গানের সুরে, বাণীর নির্যাসে, ‘আমায় অনেক দিয়েছ নাথ।’ শাশুড়ি-মা’র পায়ের শব্দ ঘরের দরজার বাইরে এসে থামল।

তিন

বিকেলের পড়ন্ত রোদের এক আলাদা মায়া আছে। একটু পরেই পাটে বসতে চলেছেন সূর্যদেব। হিমের আঁশমাখা সেই রোদ একটু একটু করে গায়ে মাথায় মেখে নিলে একধরনের আমেজ আসে শরীরে। বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে সেই রোদের আমেজ নিচ্ছিল সায়ন।

একসময় দামোদর ছিল গোটা রাজ্যের দুঃখ। দুঃস্বপ্নের নদ। এখন বললে লোকে হাসবে। নদের খাত জুড়ে বালি আর বালি। লরির পর লরি দাঁড়িয়ে। সেই বালি তুলে নিয়ে বাজারে ঢেলে দিয়ে আসবে। তৈরি হবে আকাশচাটা ফ্ল্যাটবাড়ি। আশ্চর্য এক লেনদেনের সম্পর্ক যেন। তুমি দেবে আর আমি নেব। অথবা উলটোটা। বাঁধের একপাশে বটগাছের কোল ঘেঁষে তৈরি হয়েছে চায়ের দোকানটি। সেটি বেশ পরিচ্ছন্ন দেখে একপলকেই পছন্দ হয়ে গেল সায়নের। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের হোস্টেল হলেও যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন ওদের রোজের থাকা-খাওয়ার পরিবেশ। সেই অভ্যাস বাইরেও। চায়ের দোকানি উনোনে আঁচ দিয়েছিল। ধোঁয়া কুণ্ডলি পাকিয়ে পাকিয়ে এলাকা ছাড়া হয়ে নদীগর্ভের দিকে। গরম চায়ের আহ্বানে এই বাঁধের দিকের দোকানটিতে। নাহলে আমোদঘাটায় চায়ের দোকানের কমতি নেই। তবে রিখিয়ার এসএমএস অনুযায়ী লোকালয় থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকাই ভালো। আপাতত সেই চেষ্টাতেই সায়ন।

‘এখানে কাদের বাড়ি এসেছেন?’

বাঁধের পাশের মাঠটিতে ছেলেদের ব্যাটিং, বোলিং আর ফিল্ডিং দেখতে দেখতে এতই মগ্ন হয়ে পড়েছিল সায়ন যে, প্রশ্নটা শুনতেই ভুল হয়ে গেল প্রথমে। দ্বিতীয়বার আবার জিজ্ঞেস করতে তবে শুনতে পেল।

ঘাড় ঘুরিয়ে সাদা প্যান্ট শার্টের সঙ্গে মাথায় কাউন্টি ক্যাপ চাপানো ভদ্রলোককে দেখতে পেল সায়ন। ঝোঁকের মাথায় বাঁধের দিকটায় চলে এসেছে বটে কিন্তু এমন একটা সমস্যা যে হতে পারে সেটা ভেবে দেখেনি। অথচ পরিষ্কার নির্দেশ আছে কোনওমতেই সামন্তবাড়ির নাম নেওয়া চলবে না।

অগত্যা আমতা আমতা করে বলল, ‘এই চা খেতে আর কী!’ সম্ভবত এমন উত্তর প্রত্যাশা করেনি কাউন্টি ক্যাপ। তাই সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া হল ‘অহ্!’

একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করল লোকটা, ‘থাকেন কোথায়?’

এতো মহা ফ্যাসাদ হল। টুকটুক করে খুঁটিনাটি সব জানতে চাইছে। তাড়াতাড়ি ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের একটা জবাব দিল সায়ন, ‘কলকাতা!’

কাউন্টি পরা লোকটা বেশ খানিকক্ষণ হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। বোধহয় সায়নের মাথার ঠিক – বেঠিকত্ব নিয়ে সন্দেহ হল। ট্রাউজারের পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখ মুছতে মুছতে মাঠের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে সায়নকে ভালো করে মেপে নিয়ে বলল, ‘ধান্দা যে অন্যকিছু আছে সেটা বুঝলাম। সেজন্যেই এমন ভাসানো জবাব। ঠিক হ্যায়, আমিও কালো ঘোষ। এত সহজে আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারা যাবে না।’

কথা বলতে বলতে নিজের বড়াই করা লোকটার স্বভাব বুঝতে ঠিকই পারল সায়ন। কিন্তু এখনই লোকটির থেকে দূরত্ব তৈরি করতে না পারলে ওর সমূহ বিপদ। এটুকু বুঝতে দেরি হল না মোটেই।

রিখিয়ার জরুরি এসএমএস পাবার পর ওর মনে হয়েছিল এসব বড়োলোকের বাড়ির বউয়ের খামখেয়ালিপনা ছাড়া কিছু নয়। সঙ্গে সতর্কবার্তা সামন্তবাড়ির কেউ কোনও অবস্থাতেই যেন জানতে না পারেন সায়নের ধারণাটাকেই পোক্ত করেছিল শুধু। কিন্তু এখানে এই আমোদঘাটায় এসে রিখিয়ার সঙ্গে বারদুয়েক মোবাইলে কথা বলবার পর সেই ধারণাটা ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে।

‘বিনোদিনী গার্লস উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়’- এর চৌকাঠ টপকে অচিনপুর মহাবিদ্যালয়ে পা দেওয়া সদ্য যুবতি রিখিয়া নামের মেয়েটি যে ভিতরে ভিতরে এতখানি দুঃসাহসী হয়েছে, মনটাকে করেছে ইস্পাতের মতো দৃঢ়- সেকথা জেনে এখন নিজেরই কেমন ভয় ভয় লাগছে সায়নের।

অথচ বিয়ের রাতে সব বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে এমন একটা পরিস্থিতি যে তৈরি হতে পারে, স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি কেউ। দিব্যি সকলের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলেছে মেরুন-রঙা বেনারসি আর আগাপাশতলা গয়নার অ্যাড-এর মতো কনের থ্রোন-এ বসে থাকা পরিটি। কই, কোথাও তো কোনও সিঁদুরে মেঘ নজরে পড়েনি। বরং বরের রাজপুত্তুরের মতো চেহারা নিয়ে দেবিকা আর দয়াময়ীরা যখন ঠাট্টা তামাশা করেছে, তখনও লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিয়েছিল রিখিয়া। সেটাও নজর এড়ায়নি ওদের। অথচ এক বছরের একটু বেশি সময়ের মধ্যে সবকিছু পালটে যায় কী করে। এ এক আশ্চর্য রহস্য!

সে রহস্য যাই হোক। এখন এই ভদ্রলোককে অবিলম্বে পাশ কাটানো দরকার। না হলে সব বরবাদ হতে সময় লাগবে না বিশেষ। মাথায় একটা প্ল্যান আসতে সেটারই প্রয়োগ শুরু করে দিল সায়ন।

‘ছেলেগুলি কিন্তু দারুণ!’

‘মানে?’ ঘাবড়ে যেয়ে ভদ্রলোক চোখ তুললেন ওর দিকে।

‘মানে বুঝলেন না? প্রত্যেকেই দারুণ প্লেয়ার!’ বিশদ হল সায়ন।

‘বলছেন?’ প্রশংসায় আপ্লুত হয়ে পড়েছেন ভদ্রলোক বুঝতে ভুল হল না ওর।

‘বলব না মানে–! মাঠের দিকে যে তাকাবে সে-ই বলবে। ওয়েল ডিসিপ্লিন্ড!’

কালো ঘোষ এতক্ষণে হাতে চাঁদ পেল যেন।

‘এই– লাখ কথার এক কথা বলেছেন! আরে বাব্বা– ডিসিপ্লিন না থাকলে চলবে কেন? নিজের হাতে তৈরি করেছি মশাই এদের! ফি বছর এখান থেকেই তিন-চারজন ডিস্ট্রিক্ট টিমে–!’

ভদ্রলোককে আর বাড়তে দেওয়া উচিত নয়। মাঠের একেবারে দূরতম প্রান্তে প্রায় নদীর কাছাকাছি লং অন-এ ফিল্ডিংরত ছোকরাকে দেখিয়ে বলল, ‘কেবল ওই যে ছেলেটিকে ফিল্ডিং করতে দেখছেন– ওই ছোকরার নড়াচড়া বেশ স্লো। দেখুন-দেখুন!’ সায়নের পাশে এসে চোখের উপর হাত এনে ছোকরাকে ভালো করে লক্ষ করল কালো ঘোষ। তারপর সায়নের দিকে ফিরে বলল, ‘গুরু লোক ভাই আপনি! ঠিকই ধরেছেন। ও ব্যাটা হিরন্ময়– চিরকালের ফ্ল্যাটফুটেড!’

কথা বলতে বলতে মাঠের দূরতম প্রান্তে নদীর কাছাকাছি যাবার জন্যে হাঁটা দিলেন ভদ্রলোক।

মনে মনে হিরন্ময় নামের ছেলেটির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিল সায়ন, ‘ক্ষমা করিস ভাই। এছাড়া আর উপায় ছিল না আমার। এখন আমায় অন্য একজনকে সময় দিতে হবে।’ চায়ের দোকানি ততক্ষণে চা-এর কাপ হাতে ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে। নদীর বুক থেকে হামাগুড়ি দিয়ে ততক্ষণে কাকের ডানায় অন্ধকার উঠে আসছে।

 

চার

 নেহাত দেবার কপাল খারাপ তাই। নইলে এসব পরের বউয়ের ওপর নজরদারি করবার লোক-ই নয় ও। তার সঙ্গে স্বয়ং বড়ো সামন্তর কথাও মাথায় রাখতে হচ্ছে।

দেবার প্রাণভোমরা বাপঠাকুরদার ভিটেটুকু পর্যন্ত হাতফেরতা হতে হতে এখন বড়ো সামন্তর হেফাজতে। কোন কুক্ষণে মোদোমাতাল বাপটা টিপছাপ দিয়ে ওকে রাস্তায় বসিয়ে রেখে গেছে এমন করে ,কিছুই জানা নেই। আসল সত্যিটুকু জানে শুধু নকুলবাবু। সামন্তগুষ্টির এখনকার চাঁই। সে যে মুখ ফুটে বলবে, সে গুড়ে বালি।

ঝ্যাঁটা মারো, জুতোপেটা করো অমন মদখেকো বাপকে। নেশার জন্যে যে কিনা ছেলে-বউয়ের কথা ভাবে না। কোথায় থাকবে, কীভাবে থাকবে ভাবনা নেই। শুধু নিজের নেশার বস্তুটি চাই। নেশার ঘোরে মা-র গায়ে বাবার হাত তোলা ছায়া ছায়া মনে পড়ে দেবার। তারপর তো এক বর্ষায় মা বর ছেড়ে, ছেলেকে ছেড়ে দূর আকাশের বাসিন্দা হয়ে গেল। দেবু তখন এগারো কি বারো। সেই শুরু সামন্তর তাঁবেদারি। চলছে তো চলছেই। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। বছরের পর বছর। দেবুর মুখে রা’টি নেই। যদি বাবুর মতিগতি ফেরে। যদি কোনওদিন দেয়ালের চোরা কুঠুরি থেকে ঈশ্বর বিশ্বম্ভর পুরকাইতের নামের বাড়ির দলিল দেবুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বাবু বলে, ‘এই দেবা– এটা নিয়ে যা!’

আরও কিছুক্ষণ হয়তো চলত চিন্তার নদীতে দেবিদাসের সাঁতার, যদি না জঙ্গলের বাইরে ঘাসজমিতে উতলমাতাল ঝড় উঠত। ঘাসবনে দুটি ছায়াশরীরের তুমুল ওলটপালট। কেউ কাউকে যেন ছাড়তেই চায় না। চকাস্ চকাস্ শব্দ। সব, সবই ঘটে চলেছে মাত্র কয়েকহাত দূরে। অথচ শব্দ করবার উপায় নেই। এমনকী পায়ের গোছে বিছুটি পাতার ঘষা লেগে জ্বলছে বেশ। তবু হাত পা নট্ নড়নচড়ন। পাছে নড়াচড়ার এই চক্বরে ধরা পড়ে যায় ওর গোয়েন্দাগিরি।

বাবুর কড়া নির্দেশ বউদিমণি কোথায় যাচ্ছে, কী করছে সব খবর দিতে হবে। এদিকে একজোড়া শরীরের হাঁসফাঁস করা শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ। বউদিমণির মুখে সুখের একটানা ‘উঁ’ ‘উঁ’ শব্দ। এসব কীসের ঠিকই বোঝে দেবু। আর বোঝে বলেই ওর যন্ত্রণা বেশি। বিয়ের পর মেয়েমানুষ কীসে সুখী হয় সবচেয়ে বেশি, তা কি বাবু জানে না?ওর মতো উদ্গান্ডু বোঝে আর আমোদঘাটার বেতাজ বাদশা নকুল সামন্ত বোঝে না এটা বিশ্বাস করে না দেবু।

সামন্তদের আড়তের দেড়তলায় আট ফুট বাই দশ ফুট যে -খুপরি ঘরটায় এতদিন থেকে এল দেবু, মাঝে মাঝে একলা সময়ে সেই ঘরটাই কেমন অচেনা মনে হয়। যেন গিলে খেতে আসে রাক্ষুসে হাঁ করে। অনেক রাতে নিজের চেনা শরীরের মধ্যে অচেনা এক শরীর জেগে উঠলে কেমন হন্যে হয়ে ওঠে দেবু। হাত বাড়িয়ে সরু বিছানায় পাশে কোনও জ্যান্ত শরীরের স্পর্শ পেতে চায়। ঘুম ভেঙে সেই ‘অন্য’ আর একজনের মুখোমুখি হয়। প্রশ্ন করে নিজেকে, ‘তোর কীসের এত জ্বালারে দেবা? গড়িয়ে গড়িয়ে বছরগুলো তো কাটালি এখন আর মাত্র ক’টা বছর কাটিয়ে দিলেই তো–!’ প্রশ্নটার ঝুঁটি ধরে ঝাঁকুনি দেয় আদত দেবা, ‘কী বললি হতচ্ছাড়া! এ জ্বলন কীসের তা যদি জানতিস!’ হাজার বোঝালেও বুঝতে চায় না শরীরের মধ্যে জেগে ওঠা অবুঝ অথচ তেজিয়ান সেই ঘোড়া। ঘাসে ঢাকা মাঠে দৌড় শুরু করবার জন্যে ছটফট করতে থাকে।

বাধ্য হয়ে বাকি রাতটুকু উপুড় হয়ে শুয়ে থেকে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করে যায়। বড্ড কষ্ট হতে থাকে তখন। গোটা শরীর যেন তেতে আগুন হয়ে ওঠে। জঙ্গলের মধ্যে মশার কামড় কিংবা বিছুটি লেগে যে জ্বলন তার চেয়েও ভয়ংকরতর এক জ্বলুনিতে জ্বলতে থাকে দেবু।

বড়ো কত্তা যতই ওকে নতুনবউদির ওপর নজর রাখবার কথা বলুক, এসব কথা দেবা কখনও জানাবে না। মেয়েমানুষের জ্বলন বলে কথা! যদি ঘরের ওষুধে না সারে তাহলে তো বাইরের ডাক্তার ডাকতেই হয়। এর মধ্যে কোনও দোষ দেখতে পায় না দেবু। ক্ষমতা থাকলে ছোটোকত্তা দীপুবাবুকে সামলে নিক বড়োবাবু। তা নয়– যত্তোসব!

আস্তে আস্তে নতুনবউদির কথা ভেবে মনটা নরম হয়ে এল খুব। আহারে, কতই-বা বয়স! কত স্বপ্ন নিয়ে সোয়ামির ঘর করতে এসেছিল গরিবের ঘর থেকে। পয়সার জোরে আর যা-ই হোক মন তো কিনতে পারেনি কত্তা!

ততক্ষণে ঘাসবনে ঝড় থেমেছে। আকাশে চাঁদ না থাকলেও দেবুর সামনে তখন বনজ্যোৎস্না। দুটি তৃপ্ত হৃদয় অস্ফুটে তাদের মনের কথা বলে। সবটা না হলেও সেই কথার টুকরোটাকরা পাখনা মেলে উড়ে আসতে থাকে কানে।

‘এভাবে কতদিন চালাবে বলো রিখি?’

চট্ করে একথার জবাব দেওয়া মুশকিল। নতুনবউদিও অনেক সময় নিয়ে বলল, ‘দেখি কতদিন চালানো যায়।’

‘ব্যাপারটা তোমার পক্ষে খুব রিস্কি হয়ে যাবে না তো?’

‘হলে হবে। পরোয়া করি না। বাড়ির কথা এরা জানাজানি হতে দেবে ভেবেছ!’

নতুনবউদির ভয়হীন গলা শুনে চমকে উঠল দেবু। মেয়ের সাহসকে পেন্নাম জানাতে হয়! এ তো দেখছি বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা! ‘জানাজানি হলে কী হতে পারে ভেবে দেখেছ?’ ছেলেটির গলায় অজানা আশঙ্কা।

‘কী আবার হবে– শূলে চড়াবে নয়তো ফাঁসি। তবু এই নিত্য যমযন্ত্রণার চেয়ে ঢের ভালো হবে!’ প্রায় কান্নাজড়ানো গলায় বউদিমণির জবাব শুনতে শুনতে জঙ্গলে একহাত জিভ কাটল দেবু। এসব কি বলছ গো বউদি! তোমার দুখ্যু আমি বুঝি। হাজার প্রশ্নেও আমার মুখ থেকে একটি কথাও বেরোবে না আর– দেখে নিয়ো! পাশাপাশি পড়ে থাকা দুটি ছায়াশরীর আবার মুহূর্তের অবকাশে এক হয়ে যায়। জঙ্গলের মধ্যে মানুষপ্রমাণ শর গাছ। তার মধ্যে এক নিঃশব্দপ্রায় দেবতা। দুটি চোখ মুদে। স্বর্গীয় এক দৃশ্যের মধ্যে ডুব দিয়েছে। ঘাসবন থেকে আর একবার চকাস্ করে ভেসে আসা শব্দ শুনল দেবু। অদ্ভুত এক তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটে। ঘরছাড়া, দিকহারানো একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে বিপদ মাথায় নিয়ে কেমন করে বাঁচতে হয় শিখিয়ে দিয়ে গেল যেন।

জামাকাপড় পরে নেবার ঘসঘস আওয়াজ হল। আবছা অন্ধকারে চুড়ির রিনরিন। আরও একটু পরে নতুন বউদির গলা শুনতে পেল, ‘আবার কবে দেখা হবে– জানিয়ে দিয়ো!’

ছেলেটির গলা স্বপ্নালু মানুষের মতো শোনায়, ‘পরের বার কবিতা সংকলনটা নিয়ে আসব।’

‘সত্যি?’ বউদিমনির গলায় চাপা উচ্ছ্বাস।

‘সত্যি! ওটাতো তোমাকেই উৎসর্গ করেছি রিখি!’

এমন জটিল বাংলা শব্দ ‘উৎসর্গ’ বাবার জন্মে শোনেনি দেবু। তবু আবার এক চকাস্ শব্দ ওকে বুঝিয়ে দিল সেটা ভালো কিছুই হবে।

কতক্ষণ আবেশে বুঁদ হয়েছিল খেয়াল ছিল না দেবুর। সম্বিত ফিরল যখন অদ্ভুত এক সুগন্ধ ছড়িয়ে বউদিমণি চলে গেল মাঠ ফাঁকা করে। ওকে উতলমাতাল করে রেখে।

আবিষ্টের মতো দুটি হাত কপালে ছোঁয়াল দেবু। আহা গো বউদিমণি, তোমার কষ্ট আর কেউ না বুঝুক এই ছাই-ফেলতে ভাঙা কুলো দেবা বোঝে। তুমি সব্বোসুখি হও গো। প্রাণ থাকতে আমি তোমার সুখের রাস্তায় কাঁটা হয়ে দাঁড়াব না কখনও!

শরগাছের বন ছেড়ে বেশ কয়েক পা এগিয়ে এসেছে দেবিদাস, এমন সময় মোবাইলে আলো জ্বলে উঠল। স্বয়ং বড়োকত্তা। খুব সন্তর্পণে কথা বলতে লাগল দুজন।

‘কী রে, সব ঠিক আছে?’

‘হুঁ।’ উত্তর সংক্ষিপ্ত করল দেবু।

‘বউমা?’

‘এই তো আট চক্বর শেষ করে মাঠ থেকে বাড়ির দিকে গেল।’ যতদূর সম্ভব গলা স্বাভাবিক রেখে উত্তর দিল দেবু ওরফে দেবিদাস পুরকাইত।

সামন্তবাড়ির লক্ষ্মী সহায় থাকলে ওর ভাগ্য ফিরতেও দেরি হবার কথা নয়। চাই কি, বসতবাড়িটার হাতবদলও হয়ে যেতে পারে। খুশি খুশি মুখে ফোনশুদ্ধ দুটি হাত আকাশে বসে থাকা অথচ এখনও অদেখা মানুষ নাকি দেবতাটির উদ্দেশে, এবার তুলল দেবু।

একটি মৃত্যু

সকালে অতুলবাবু খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে সবে বসেছেন, রতনবাবু ডাক দিলেন,

-অতুল আছো নাকি ?

অতুলবাবুর সঙ্গে রতনবাবুর ভালোই সম্পর্ক। বিপদে আপদে সর্বদাই থাকেন। পাশেই বাড়ি, ইন্ডিয়ান স্টাটিস্টিক্যালে চাকরি করেন, লাইব্রেরিতে। স্বভাবে খুবই ভালো, হোমিওপ্যাথি ডাক্তারিও করেন। অতুলবাবুর বাড়ির মাঝে রাস্তা , তার ওপারে রতনবাবুর বাড়ি।বেশ ভালো বাড়ি৷ বাবার অনেক টাকা ছিল, তা দিয়েই বানানো। নিজে কিছু করেননি । দুই মেয়ে,একজন কলেজে,একজন স্কুলে । স্ত্রী বেশ সুন্দরী, নাম রমলা। বর্ধমানের মেয়ে। এই নিয়েই সংসার রতনবাবুর।আজ ছুটি, মহরম। তাই সকালেই গল্প করতে চলে এলেন।

অতুলবাবুর কাগজটা আর পড়া হল না।অতুলবাবুর একটা বইয়ের দোকান আছে।বাড়িতে ড্রয়িং রুম থেকে শোবার ঘর— সব জায়গায় বই খাতা ভর্তি। অগোছালো ঘর , মেঝের ওপর বই খাতার স্তুপ। তার মাঝে অতুলবাবু বসে খবরের কাগজ পড়েন রোজ। রতনবাবুর এই পরিবেশটাই নাকি খুব ভালোলাগে।

-হ্যাঁ আসুন-

দরজাটা খুলেই অতুলবাবু চমকে উঠলেন। রতনবাবুর চোখে মুখে উদ্বেগের ছায়া।

-কী ব্যাপার?

-বড়ো মেয়েটা কাল থেকে বাড়ি আসেনি। সকালে কলেজ গেছে, আজ ছুটি…

-দেখো কোনও বন্ধুর বাড়িতে. . .

-এ কী বলছ অতুল, আমার মেয়ে এমন না ।

-আরে না না তা বলিনি , বলছি কোনও বান্ধবীর বাড়ি যদি গিয়ে থাকে।

-ফোনটাও ধরছে না, সব খবর নিলাম কোথাও নেই।

রতনবাবু কেঁদে ফেললেন ।

-আরে একী করছ? আগে খুঁজে দেখি কী হল।

রতনবাবুর মেয়ে সুছন্দা ভালো মেয়ে, দেখতে শুনতেও ভালো, কোনও দিন কোনও ব্যাপারে কারওর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েনি।

পড়াশোনা ছাড়া কোনও গল্পগুজব করতে দেখিনি, হঠাৎ কী হল কাল, যে বাড়ি ফিরল না!

-গতকাল ওর জন্মদিন ছিল, ওর মা পায়েস করে বসে ছিল সারা রাত। মেয়ে এই আসবে এই আসবে করে ঘুমোতেই যায়নি। সকালে পর্যন্ত অপেক্ষা করেও মেয়ে আসেনি৷ হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিয়েছে, আমি কী করি বলো তো?

-হাসপাতালটা খোঁজ নেওয়ার দরকার।

– হ্যাঁ ওর মামা আসছে দেখি যাব।

– আমি কি যাব ?

অনিচ্ছা সত্বেও কথাটা বলতে হল , কারণ রতনবাবু  খুব পুরোনো বন্ধু । ছুটির দিন, অতুল ভেবেছিলেন বাড়িতে একটু আরাম করবেন, বিকালে বইয়ের দোকানে যাবেন, কিন্তু হল না।

-চলো তোমার সঙ্গে যেতেই হবে, তোমার যা মনের অবস্থা দেখছি…

-চলো না ভাই, তুমি গেলে একটু সাহস পাই।

-সে আর বলতে।

অতুল মনে মনে ভাবলেন, বইয়ের দোকানে আর যাওয়া হল না , এ যা দেখছি সারাদিনের ব্যাপার ।

-রতন তোমার মেয়ের কোনও ছেলে বন্ধু ছিল না তুমি জানো তো? জানি এসব কথা এ সময় তোমার শুনতে ভালো লাগছে না কিন্তু জানো তো এখনকার মেয়েরা খুব চাপা গোছের হয়।

-তা হয়তো হবে. . .

দরজায় আবার কে যেন বেল দিচ্ছে। উঠে দরজা খুলে দেখলেন, রতনবাবুর স্ত্রী ও ছোটো মেয়ে সুনন্দা।দুজনেরই কাঁদো কাঁদো মুখ ।

-দাদা একটু দেখুন না কী হল? মেয়েটা তো এমন নয়, কোনও দিন এমন হয়নি, কী যে করি?

– আরে বৌদি চিন্তা কেন করছেন? আমি দেখছি কী করা যায়।

সাহস দিলেন বটে কিন্তু কী করবেন তিনি নিজেই জানেন না । ওদেরকে বাড়িতে বসিয়ে , তিনি আর রতনবাবু বেরিয়ে পড়লেন৷ প্রথমে সরকারি হাসপাতালগুলোতে খোঁজ করতে গেলেন।আর জি কর, মেডিকেল,নীলরতন- কোথাও সুছন্দার খোঁজ পেলেন না । সুছন্দা মানে রতনবাবুর হারিয়ে যাওয়া মেয়ে ।
হতাশ হয়ে রাতে ফিরে এলেন বাড়িতে,রতনবাবুকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে।

ঘরে ঢুকলেন,সারাদিন খাওয়া দাওয়া নেই, শরীরটাও ভালো ঠেকছে না। মর্গে মর্গে ঘুরে ঘুরে গা ঘিন ঘিন করছে অতুলের। বউ বলল,

-ভালো করে স্নান করে নাও, খেয়ে নিয়ে চিন্তা করো কী করবে ? দুদিন হল মেয়ের কোনও খোঁজ নেই যখন, তখন দেখতে হবে ক’দিন, নইলে পুলিশে খবর দেওয়া ছাড়া আর কোনও রাস্তা দেখছি না ।

রতনবাবুর কথা ভাবতে ভাবতে সবে খেতে বসতে যাবেন, টেলিফোনটা বেজে উঠল।

-হ্যালো।

-দাদা আমি সুছন্দার মা বলছি ,

-কী ব্যাপার ?

-ওনাকে কি বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেছিলেন?

-হ্যাঁ

-কিন্তু ওনাকে তো দেখতে পাচ্ছি না-

-সেকি! সেকি আবার কোথায় গেল! বাথরুমটা দেখুন।

– না নেই!

-তাহলে হয়তো আবার বেরিয়েছে। ঠিক আছে রাখুন, আমি খেয়ে উঠে দেখছি।

খাওয়া আর হল না। রতনবাবু কোথায় গেলেন দেখতে হবে । এই বা-বেটি মিলে কী শুরু করল ? এক বার বাপ্, একবার বেটি।
যাইহোক বেরিয়ে পড়লেন, ফোন করলেন বার কয়েক৷ কোনো রেসপন্স নেই । রাত হয়ে আসছে, দিশাহীন ঘুরে বেড়ালেন অতুল। থানাতেও গেলেন। যদি ডাইরি করতে এসে থাকেন । কিন্তু না, তা আসেননি । মুদিদোকান, বাজার, সব ঘুরে রতনবাবুর বাড়ি গেলেন। অতুলবাবুকে দেখেই রতনবাবুর স্ত্রী আরও কান্না জুড়ে দিল।

-কী হল? রতনবাবু এখনও আসেননি?

-না,

-তাহলে?

-দেখুন তো কী করে বসল মেয়েটা !

-কী হয়েছে ?

-ফোন এসেছিল

-কার ?

-সুছন্দার .

– ভালো খবর তো?

-জানি না দাদা, এভাবে কোনও দিন ওকে দেখিনি, ওর বাবা হয়তো একটু বেশি শাসন করত, তাই বলে ও আমাদের কিছু না বলে, এমন কাণ্ড করবে, জানা ছিল না!

-কী হয়েছে, বলুন তো?

-সুছন্দা বিয়ে করেছে।

-যাক তবু একটা খবর তো পাওয়া গেল৷ এখন রতনবাবু — তিনি আবার কোথায় গেলেন? আচ্ছা আমি বাড়ি যাই, চিন্তা করবেন না।রতনবাবু নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন কিছুক্ষণ পরেই৷

বাড়ি এসে অতুলবাবু খাওয়া শেষ করে টিভিটা চালিয়ে বসেছেন ,হঠাৎ কলিংবেল । দরজা খুলে দেখেন,রতনবাবুর স্ত্রী এসে হাজির ।

– কী ব্যাপার?

-দাদা ওকে এখনও ফোনে পাচ্ছি না।

-সে কী! দাঁড়ান আমি করে দেখি৷ হয়তো রাগের মাথায় ধরছে না।

বহুবার চেষ্টা করলেন অতুল, কিন্তু কোনো রেসপন্স নেই৷ এ আবার কী সমস্যা? মেয়ের খবর পাওয়া গেল তো  বাবা হাওয়া!

-দাদা মেয়ে ফোনে জানাল যে সে কাল বিয়ে করে শিলিগুড়িতে আছে, ছেলের পিসিমার বাড়ি।
কিন্তু এখন বাবা ! তার তো কোনও খবর নেই ।

বাইরে শোরগোল শুনে উঠে পড়লেন আতুলবাবু । মোড়ের মাথায় খুব ভিড় , পুলিশ ঢুকছে রতনবাবুর বাড়িতে। অতুলবাবুর সঙ্গে সঙ্গে রতনবাবুর স্ত্রীও বেরিয়ে এলেন । হাউমাউ করে উঠলেন – পুলিশ কেন?
একজন পুলিশ অফিসার বললেন,
-শুনুন, একটি লোক মেট্রো রেলে ঝাঁপ মেরেছে।পকেট থেকে এই চিরকুট পাওয়া গেছে।
-এইটা যে ওনার বাড়ি কী করে জানলেন?
-পকেটে শুধু এটা নয়, মোবাইলটাও ছিল৷ কীভাবে যেন মোবাইলটা অক্ষত আছে৷ওখান থেকেই ঠিকানা বার করেছি।তাই সরাসরি বাড়িতেই চলে এলাম৷

-কিন্তু আমরাও তো বারবার ফোন করছি, কেঁদে উঠলেন রতনবাবুর স্ত্রী৷
অতুলবাবু পুলিশ ভদ্রলোকের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন,

-কই চিরকুটটা দেখি৷

সেটা একটা ছোট্ট চিঠি৷ লেখা–

বাবা ,
আমি তোমার মুখ রাখতে পারলাম না কিন্তু আমি কী করব? আমি যে ভুল করে ফেলেছি বাবা, আমি অন্তঃসত্তা। বিয়ে না করলে আরও কাউকে মুখ দেখতে পারব না । তাই আমাকে ক্ষমা করো, আমি ভালো থাকব।
   সুছন্দা।

গণেশ এসেছে

গণেশ এসেছে। এসে চেয়ারে না বসে, বসেছে চেয়ারের হাতলে। কাঠের এই চেয়ার বহু বছরের পুরোনো। শক্তপোক্ত, দু’পাশে হাতল। হাতলগুলো চওড়া। চেয়ারটাকে রাখা হয়েছে খাটের গা ঘেঁষে। যাতে ডাক্তারবাবু, আত্মীয়স্বজন, বাড়ির লোকজন রোগীর কাছে বসতে পারে। গত চার মাস, না চার মাস নয়, গত চার মাস এগারো দিন এই ব্যবস্থা চলেছে। প্রথম প্রথম এঘর, ওঘর থেকে মোড়া, চেয়ার, এমন কী টুল পর্যন্ত টেনে আনা হচ্ছিল। পরে দেখা গেল, সিচুয়েশনের অবনতি হচ্ছে। ঘরে ডাক্তার, ভিজিটর বসবার জন্য পাকাপাকি ব্যবস্থা রাখতে হবে। বারান্দায় রাখা চেয়ারটাকে মুছে-টুছে ঘরে আনা হল। আজ থেকে আর এই চেয়ারের দরকার হবে না।

গণেশ যখন এল তখনও আলো ফোটেনি। ফুটব ফুটব করছে। দূরে একটা দুটো কাক ডেকে উঠল। আড়মোড়া ভাঙা ডাক। রাস্তা দিয়ে ঝনঝন আওয়াজ করে চলে গেল দুধের গাড়ি। রমাকান্তবাবু পাশ ফিরতে গেলেন। একটু পারলেন, বেশিটা পারলেন না। পাশ ফেরবার শক্তি মানুষটার আর নেই। শ্বাস নিতেও কেমন যেন অসুবিধে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কেউ নব ঘুরিয়ে ঘরের বাতাসের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। খানিক আগে বুকের ভিতরে একধরনের চাপা ধড়ফড়ানি শুরু হয়েছে। শরীর জানান দিয়ে দিচ্ছে, সময় ফুরিয়ে গেল… সময় ফুরিয়ে গেল…। পরিস্থিতি যা তাতে মনে হয়, আজই কিছু একটা হয়ে যাবে। কখন হবে? বেলাবেলি? নাকি দুপুরের পর? দুপুরের পর হলে ভালো। বাড়ির সবার খাওয়া-টাওয়া হয়ে যাবে। নইলে রাত পর্যন্ত আটকে থাকা। মরা বাড়িতে হাজার ফ্যাঁকড়া। এইটা করা যাবে না, ওইটা করা যাবে না।

মাধবীর আলসারের সমস্যা আছে। বেশিক্ষণ কিছু না খেলে পেটে ব্যথা হয়। তারও তো বয়স কম হল না। স্বামীর মৃত্যুর পর আলসারে কাবু স্ত্রীদের জন্য কি কোনও ছাড় আছে? হালকা কিছু খেতে পারে? পারা উচিত। যাই হোক, সবথেকে ভালো হয় ঘটনা বিকেলের দিকে ঘটলে। তবে সে তো আর কারও হাতে নেই যে সকলকে স্নানটান করিয়ে, মাছের ঝোল ভাত, কাঁচা আমের চাটনি খাইয়ে, ছোট্ট একটা ভাতঘুম দিয়ে তবে ঘটবে। মৃত্যু কখন আসে কেউ বলতে পারে না। জন্ম-মৃত্যু খুবই অনির্দিষ্ট একটা বিষয়। তারা স্বেচ্ছাচারী। নিজের খুশি মতো চলতে পছন্দ করে।

রমাকান্তবাবু ঠোঁটের ফাঁকে হাসতে চেষ্টা করলেন। একটু পারলেন, একটু পারলেন না। আর কোনও কিছুই সবটা পারবার সময় নেই।

মুক্তি… মুক্তি। রোগ, যন্ত্রণা থেকে মুক্তি। মুক্তি দীর্ঘ জীবন বয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিশ্রম আর ক্লান্তি থেকে। মুক্তি বেঁচে থাকবার যাবতীয় গ্লানি, অবহেলা থেকে। আহ্! রমাকান্তবাবু আবার হাসবার চেষ্টা করলেন। মুক্তির হাসি।

মুক্তি শুধু নিজের নয়, মুক্তি বাড়ির লোকেদেরও। তারাও এবার যবনিকাপতন চায়। নিজের মধ্যে একথা বলাবলিও করছে। পরশু রাতেই বড়ো ছেলে শুভ দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে তার বউকে চাপা গলায় বলছিল। শুভ ভেবেছিল, বাবা ঘুমিয়ে পড়েছে। শুনতে পাচ্ছে না। রমাকান্তবাবু সবই শুনেছেন, জেগে ছিলেন। শুনতে ভালোই লেগেছে। এখন আর স্ত্রী ছেলেমেয়ে, পুত্রবধূ, জামাইরা কী বলল সেটা আসল কথা নয়, আসল কথা হল, এখনও তারা কাছে আছে। তাদের চোখে দেখা যায়, গলা শোনা যায়, ছোঁয়া পাওয়া যায়। কয়েকমাস ধরেই এই অনুভূতিটা হচ্ছে। বারবার মনে হয়েছে, বেশিদিন নয়, এবার দূরে চলে যেতে হবে। অনেক দূরে। কতদূরে তাও ঠিক মতো জানা নেই। হাজার চেষ্টা করলেও ভালোবাসার মানুষদের সঙ্গে আর দেখা হবে না, গলা শোনা যাবে না। বিগত কটাদিন বেশিরভাগ সময়ে রমাকান্তবাবু আধো ঘুম আধো জাগরণের মধ্যে কাটিয়েছেন। চোখ বুজে পড়ে থেকেছেন। সবাই ভেবেছে, রোগী ঘুমোচ্ছে। শরীর বোধহয় খানিকটা ভালো। রমাকান্তবাবু ভুল ভাঙাননি। ভাঙাতে গেলেও বিশ্বাস করবে না। ভাববে, অসুস্থ মানুষ ভুল বকে। ঘুমোলেও বলে ‘জেগে ছিলাম’। তার থেকে চুপ করে থাকাই ভালো।

মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের কাছে ঘুম আর জেগে থাকার মধ্যে বিশেষ ফারাক নেই। কে বুঝবে একথা? এ এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। সবাইকে বলবার মতোও নয়। বোঝানো তো যায়ই না। আর দরকারই বা কি? সেদিনও রমাকান্তবাবু তাই ছিলেন। বড়োছেলে আর তার বউয়ের কথা কানে এসেছে সব।

শুভ তার বউকে বলেছিল, ‘উফ্ আর কতদিন বলো তো? এ তো আর টানা যাচ্ছে না। টাকার পর টাকা গলে যাচ্ছে। ডাক্তারবাবু তেমনি। আরে বাবা, যদি চান্স না থাকে তাহলে এত দামি দামি মেডিসিন দেবার মানে কী? আর কতদিন বলো তো?’

বউমা বিরক্ত গলায় বলল, ‘আমাকে বলছ কেন? বাবা তোমার, কবে মরবে, কবে বাঁচবে তুমিই জানো। আমি কী করে বলব?’

বড়োছেলে মুখে ‘ফুঃ’ ধরনের আওয়াজ করে বলল, ‘এমন ভাবে বলছ ঝুমা, যেন তোমার বাবার মৃত্যুর ডেট তুমি জেনেশুনে বসে আছো। বাবা হলেই সব জানা যায়?’

ঝুমা ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘আমার বাবার কথা আসছে কোথা থেকে? আমার বাবাকে টানছ কেন? বালাই-ষাট সে মরবে কীসের জন্য? সে তো আর শ্বশুরমশাইয়ের মতো চার মাস বিছানায় কেতরে নেই। ডাক্তার, বদ্যির পিছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকাও খসাচ্ছে না, ছেলেমেয়ে, পুত্রবধূ, জামাইদের ছুটিয়েও মারছে না। সে আছে নিজের মতো।’

বড়োছেলে বলল, ‘আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার বাবা হলেন বিরাট পরোপকারী। আমার বলাটাই ভুল হয়েছে। আই অ্যাম সরি।’

ঝুমা গজগজ করে বলল, ‘কথায় কথায় আমার বাবাকে টানবে না। নিজের বাবাকে নিয়ে ঝামেলায় পড়েছ, যা বলবার তাকে বলো।’

‘কী বলব?’

ঝুমা রাগ রাগ গলায় বলল, ‘কী আবার বলবে, অনেক সমস্যা করেছেন এবার শেষ করুন।’

শুভ অবাক গলায় বলল, ‘বাবাকে বলব, শেষ করুন! মানে তুমি মরে যাও! এসব কী বলছ ঝুমা!’

ঝুমা নিজেকে সামলে নিতে নিতে বলল, ‘মরে যাও বলবে কেন? বলবে…  বলবে, এবার ভালো হয়ে ওঠো। তোমার সেবাযত্ন করতে করতে তো বাড়িশুদ্ধ সবার নাজেহাল অবস্থা। টাকাপয়সাও তো জলের মতো বেরিয়ে যাচ্ছে। এত বয়স হয়েছে, এটা বুঝতে পারছ না?’

বড়োছেলে চুপ করে থেকে চাপা গলায় বলে, ‘অ্যাই ঝুমা, ঝুমা, অ্যাই ঝুমা…’

‘ধেড়ে বয়েসে বারবার বউয়ের নাম বলে আহ্লাদ করছ কেন? কী বলবার বলে ফেল।’

বড়োছেলে ফিসফিস করে বলে, ‘একটা কাজ করো না।’

ঝুমা সন্দেহ ভরা গলায় বলল, ‘কী কাজ? শ্বশুরমশাইকে বিষ খাওয়াব?’

শুভ বলল, ‘উফ্ তোমার মুখে কিছু আটকায় না। তুমি ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করবে?’

ঝুমা বলল, ‘কী জিজ্ঞেস করব?’

শুভ কিছু একটা বলল। রমাকান্তবাবু শুনতে পেলেন না। যদিও গত চার মাস ধরে কান খুব ভালো সার্ভিস দিয়েছে। প্রকৃতির কি এটাই মজা? শরীরের সব অঙ্গ কাহিল করে দিয়ে একটাকে তরতাজা করে রাখে? তার বেলায় যেমন শ্রবণ ক্ষমতাকে রেখেছে? মনে হচ্ছে, যুবক বয়েসের কান ফিরে পেয়েছেন। দূরের কথাও শুনতে সমস্যা নেই।

ঝুমা খানিকটা জোর গলায় বলল, ‘একথা তুমি জিজ্ঞেস করতে পারছ না? ডাক্তারবাবুকে ফোন করে  জিজ্ঞসা  করো।’

শুভ ‘শ্শ্শ্’ আওয়াজ করে বলল, ‘এই আস্তে, বাবা শুনতে পাবে।’

‘শুনতে পাবে না। অনেকক্ষণ থেকে ঘুমোচ্ছে। আজকাল তো বেশিরভাগ সময়টা ঘুমিয়েই থাকে। জিজ্ঞেস করলে বলে ঘুম হয় না। তুমি বরং এখনই ডক্টর রায়কে ফোন করো।’

শুভ আমতা আমতা করে বলল, ‘আমার বলাটা কি ঠিক হবে ঝুমা?’

ঝুমা অবাক গলায় বলল, ‘কেন? হবে না কেন? তুমি তার ছেলে। তুমি জিজ্ঞেস করতেই পারো। তাছাড়া তুমি তো আর মরবার কথা বলছ না। বলবে, দেখুন ডাক্তারবাবু আমাদের তো একটা প্ল্যানিং করতে হবে। উনি আর কতদিন এভাবে কষ্ট পাবেন যদি জানতে পারি সুবিধে হয়… এত টাকাপয়সা খরচ… জোগাড়ও তো করতে হবে। তার থেকে বড়ো কথা… আমরা এই কষ্ট চোখে দেখতে পারছি না। আমার স্ত্রী তো… আমার স্ত্রী তো রোজ কান্নাকাটি করে।’

‘তুমি আমার মরণাপন্ন বাবার জন্য কান্নাকাটি করো? এতবড়ো একটা মিথ্যে কথা বলা কি ঠিক হবে ঝুমা?’

ঝুমা চাপা গলায় স্বামীকে ধময় দেয়।

‘চুপ করো। বেশি ঢঙ দেখিও না। তোমার মা কী বলছেন?’

শুভ বলল, ‘কী বলেছেন?’

রমাকান্তবাবু কান খাড়া করলেন। মাধবী বলেছে! সে আবার কী বলল!

ঝুমা বলল, ‘কাল বিকেলে ঘরে ডেকে আমাকে বলল, বউমা তোমার শ্বশুরমশাইয়ের হাগামোতার কাপড় আমি আর ধুতে পারব না। এক-দুদিন হলে হয়, মাসের পর মাস হলে হয় না। খোকাকে বলো, লোক রাখতে। সে বড়ো হয়েছে, রোজগারপাতি করে। বাবার হাগামোতার পিছনে পয়সা খরচ করতে পারবে না এমন নয়। সংসারে অনেক ঝি-গিরি  করেছি, আর নয়। তোমার শ্বশুরমশাই চলে গেলে, নিজের মতো একটু হাত-পা ছড়িয়ে থাকব। নিজের স্ত্রী-ই তো এসব বলছে। আমি কেন কাঁদতে যাব?’

শুভ বলল, ‘আচ্ছা আচ্ছা, চুপ করো। আর মায়ের নিন্দে করতে হবে না। আমি দেখছি।’

শুধু স্ত্রী, বড়োছেলে-বউমা নয়, রমাকান্তবাবুর মেয়ে জামাইও খুব অসুবিধেতে রয়েছে। কাজকর্ম ফেলে তাদের ছুটে ছুটে আসতে হচ্ছে। তার ওপর টাকাপয়সা নিয়েও একটা টেনশন আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। শুভ যে-কোনও সময় তার দিদির কাছে হাত পাততে পারে। বলা যায় না, হয়তো আয়া রাখবার টাকাটাই চেয়ে বসতে পারে। এই ক’দিনে রমাকান্তবাবুকে নিয়ে মেয়ে জামাইয়ের মধ্যেও ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে। সেদিন তো পাশের ঘরে দুজনে খুব একচোট চ্যাঁচামেচি করল। করবারই কথা। একজন যদি চার মাস ধরে ‘মরছি মরব’ করে শুয়ে থাকে তাহলে সকলেরই সমস্যা। তার ওপর রমাকান্তবাবুর জামাই কোনও হাবিজাবি লোক নয়। সে নামকরা মানুষ। তার একটা পরিচয় আছে। কলেজে পড়ায়। সেটা বড়ো কথা নয়, বড়ো কথা হল তাকে প্রায়ই টিভিতে দেখা যায়। আলোচনায় চান্স পায়। নির্যাতিত, নিপীড়িত, মানুষের জন্য গলা ফাটায়। কখনও সরকারের বিরুদ্ধে, কখনও বিরোধীদের বিরুদ্ধে। যে- চ্যানেল যার কথা বলতে বলে সেই চ্যানেলে গিয়ে তাই বলে। যাওয়ার আগে দাড়ি, চুল শ্যাম্পু করে ফুরফুরে করে নেয়। রঙচঙে জামা পরে। মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ঝগড়া করে। রমাকান্তবাবু যখন সুস্থ ছিলেন, মুগ্ধ হয়ে জামাইয়ের প্রোগ্রাম দেখতেন। গিন্নি ঝামেলা করত। রিমোট টিপে সিরিয়াল দেখতে চলে যেত।

‘আহা করো কী, শ্যামলের কথা শুনছি।’

গিন্নি ধাতিয়ে উঠত, ‘রাখও তোমার জামাইয়ের কথা। খালি বকবক আর বকবক। কে আমার বক্তিতে দেওয়ার লোক এল রে! ওর লেকচার কেন শুনতে যাব? দেশের জন্য কোন কম্মটা করেছে তোমার জামাই? এমন ভাবে দাড়ি নেড়ে কথা বলে মনে হয়, টেগার্ট সাহেবকে বোম মারবে।’

‘মেয়ে কিন্তু রাগ করবে। সে রাতে ফোন করে জিজ্ঞেস করবে, তার বরের কথা শুনেছি কিনা।’

গিন্নি আরও রেগে যেত।

‘বনির আশকারাতেই তো জামাইটা গোল্লায় গেল। ঘরের কাজ করে না, কলেজে যায় না, খালি ক্যামেরায় মুখ দেখানোর জন্য ছোকছোকানি। ছিছি। এই সব ছেলেকে মারতে হয় চড়।’

সেদিন মেয়ে জামাইয়ের ঝগড়া পুরোটা না হলেও, কিছু কথা ভেসে আসছিল। আজকাল কেমন শীত শীত করে। রক্তের জোর কমে গেছে। সেদিন শীত ভাবটা বেশি ছিল। চাদর গায়ে দিয়ে গুটিয়ে শুয়েছিলেন রমাকান্তবাবু। সেই অবস্থাতেই শুনলেন, জামাই বনির ওপর চ্যাঁচাচ্ছে।

‘কী মনে করছ কী? আমার কোনও কাজ নেই? কলেজ, সেমিনার, ছাত্রছাত্রী, টিভি সব ফেলে এখানে এসে তোমার বাবার নাড়ি ধরে থাকব আর আহা উহু করব?’

বনি বলল, ‘রোজ কোথায় আসছ? সপ্তাহে তো মোটে একদিন আসো। বড়োজোর দু’বার। তাতেই এত বিরক্ত! দাদা তো সব সময় রয়েছে। সবকিছু সামলাচ্ছে।’

জামাই রাগি গলায় বলল, ‘তোমার দাদার কাজটা কী? দশটা পাঁচটার অফিস করেই খালাস। তাও মাথার কোনও কাজ নেই। মাথা থাকলে তো কাজ থাকবে। মাছি-মারা কেরানি।’

বনি বলল, ‘ইস্ আমার দাদার মাথা নেই, আর ওনার বিরাট মাথা।’

জামাই বলল, ‘তাছাড়া তোমার দাদা রমাকান্ত রায়ের ডাইরেক্ট পুত্র। পুত্র, পিতার রোগশয্যার পাশে সর্বদা থাকবে এটা আর নতুন কথা কী?’

বনি তেড়েফুঁড়ে বলল, ‘এখন পুত্রই সব করবে, আর সেদিন যে বড়ো বলছিলে, অ্যালার্ট থেকো বনি। তোমার বাবা মনে হচ্ছে আর বেশিদিন নেই। যে-কোনও সময় ফুটুস হবেন, এরপরেই কিন্তু সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে গোলমাল লাগবে। তোমার মায়ের পোরশনটা বাদ দিলে বাকিটা কিন্তু তুমি আর তোমার দাদা ফিফটি ফিফটি। কই তখন তো ডাইরেক্ট পুত্র বলে দাদাকে পুরো সম্পত্তি দেওয়ার কথা বলোনি। বলেছিলে?’

জামাইয়ের সব কথা কানে এল না। ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু শুনতে পেলেন।

‘আমি তো আইনের কথা বলেছি বনি… নারীর সমঅধিকারের কথা… তুমি মেয়ে বলে তোমাকে বঞ্চনা আমি সমর্থন করব না… কোনও নারীর ওপর অন্যায় আমি মানি না… শুধু তুমি নও… টিভির অনুষ্ঠানে কি আমি মুখ দেখাতে যাই?… যাই বলো?… ন্যায়ের কথা বলতে যাই…।’

বনি দাবড়ে ওঠে, ‘বাজে কথা বন্ধ করো। বাবাকে নিয়ে আর পারছি না। খুব জ্বালাতনে পড়লাম। তুমি দাদাকে বুঝিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে দাও। হাসপাতালে সেজেগুজে দেখতে যাব। না গেলেও কিছু নয়।’

‘খেপেছ? হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেই তোমার দাদা টাকা চেয়ে বসবে। আমার কাছে টাকা কোথায়? তোমাদের ফিফটি আগে পাই তারপর…।’

অন্য সময় হলে এসব কথা শুনে মাথায় আগুন ধরে যেত। ইচ্ছে করত, পিছনে একটা লাথি মেরে জামাইকে বাড়ি থেকে বের করে দিই। যাবার সময় মেয়েকেও গলাধাক্বা লাগাই। জীবনের এই পর্যায়ে কোনও কথাতেই আর রাগ হয় না। এখন আত্মীয়স্বজন, কাছের মানুষের গালমন্দও ভালো লাগে। মনে হয়, সবই মায়া।

বাইরে আলো ফুটছে। ঘরেও আলো এসেছে। পায়ের কাছে জানালাটা খুলে দিতে পারলে ভালো হতো। ঠান্ডা হাওয়া ঢুকত। বুক ভরে শ্বাস নেওয়া যেত। শুধু কাক নয়, আরও নানারকম পাখির ডাক ভেসে আসছে। কোথায় একটা ঘুঘু ডাকছে না? এত সকালে কি ঘুঘু ডাকে? নাকি ভুল শুনছেন? মৃত্যুর দোরগোড়ায় এসে ভুল শোনাটা আশ্চর্যের কিছু নয়। ডান হাতটা খাট থেকে ঝুলে পড়েছে। রমাকান্তবাবু হাতটা তুলতে গেলেন। ঝিনঝিন করে উঠল। ভারী লাগছে। মৃত্যুকালে শরীরের ওজন কি বেড়ে যায়? হতে পারে। আবার না-ও হতে পারে। যে-পেশি দিয়ে নিজের হাতটাকে তুলবেন তার শক্তিও তো ক্ষীণ হয়ে এসেছে। ইস্, কেউ হাতটা তুলে দিতে পারলে ভালো হতো।

এমন সময় গণেশের দিকে আবার নজর পড়ল রমাকান্তবাবুর।

গণেশটা কী করছে? মিটিমিটি হাসছে কেন? এসে হাতটা তুলে দিতে পারে তো? বেটা চেয়ারের হাতলেই বা বসেছে কেন? হারামজাদার বদভ্যাসটা গেল না। কখনও ভদ্র সভ্য হয়নি। স্কুলে এসে বেঞ্চের মাথায় বসত। বাইরে গেলে পাঁচিলের টঙে উঠে পা দোলাত। একবার গাছে বসে পেয়ারা খেতে গিয়ে পড়ে গেল। পা ভাঙল। কোন ক্লাসে যেন? সিক্স? নাকি সেভেন? বকাঝকা কম খায়নি। তাও শিক্ষা হয় না ছেলেটার।

‘কী রে রমা, কেমন আছিস?’

রমাকান্তবাবু একথার জবাব দিলেন না। বিরক্ত গলায় বললেন, ‘চেয়ারের হাতলে বসেছিস কেন? নেমে বস। কেউ দেখলে কী ভাববে।’

গণেশ ফিচ্ করে হেসে বলল, ‘হাতলে বসলেই তো মজা। কেউ দেখলে বয়েই গেছে।’

রমাকান্তবাবু বিড়বিড় করে বললেন, ‘মারব, একটা চড়। এটা তোর নলিনীবালা হাই স্কুলের ক্লাসঘর নয় যে বেঞ্চের মাথায় থাকবি। এটা ভদ্রলোকের বাড়ি।’

গণেশ মাথা কাত করে চোখ পিটপিট করে বলল, ‘ভদ্রলোকটা কে?’

রমাকান্তবাবু চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘কেন! তোর কি আমাদের ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছে না?’

গণেশ হাতল থেকে নেমে খাটের পাশে এসে বসল। রমাকান্তবাবু হাঁই হাঁই করে উঠলেন, ‘অ্যাই করিস কী! করিস কী! জুতো পরে রোগীর বিছানায় বসছিস! কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই! জুতো খোল, আগে জুতো খোল। মাধবী যদি দেখে…।’

গণেশ থমকে গিয়ে বলল, ‘উফ্ বড্ড জ্বালাস।’

গণেশ জুতো খুলে খাটের তলায় রাখল। ছোটো মাপের স্কুলের জুতো। ধুলো মাখা। ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের কাছে তাপ্পি। গণেশটা বিরাট পাজি। শুধু স্কুলের জুতো নয়, স্কুল ড্রেসও পরে এসেছে। খাকি রঙের হাফপ্যান্ট, নীল রঙের জামা। তার কি অন্য কোনও পোশাক নেই? এত বছর পর বন্ধুর বাড়ি এলি, একটু সেজেগুজে, চুল আঁচড়ে আসতে অসুবিধে কোথায়? বদের ধাড়ি একটা। বেটা খাটে পা গুটিয়ে আরাম করে বসেছে দ্যাখো, যেন একটু পরেই ক্যারাম খেলা শুরু হবে।

রমাকান্তবাবুর গায়ে হাত রেখে নরম গলায় গণেশ বলল, ‘বললি না তো আছিস কেমন?’

রমাকান্তবাবুর রাগ হচ্ছে। এই ছেলে তো মহা ঝামেলা পাকাচ্ছে। একটু পরেই মাধবী ঘরে আসবে। সে এসে যদি দেখে রোগীর বিছানায় কেউ বসে আছে, রাগারাগি করবে। গত মাস পর্যন্ত মাধবী এ ঘরেতেই ক্যাম্প খাট পেতে শুত। ঘুমের অসুবিধে হয় বলে নিজের ঘরে চলে গেছে। ঠিকই করেছে। চার মাস ধরে রাতে রোগীর ঘরে শুয়ে থাকা অসম্ভব। স্বামী হলেও অসম্ভব। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ওঠো রে, জল দাও রে, গায়ের চাদর ঠিক করো রে, বুকে পিঠে হাত বুলিয়ে দাও রে, ইউরিন পট ধরো রে, ওষুধ খাওয়াও রে। তাহলে ঘুমোবে কখন? শুভ বলেছিল, ‘এক কাজ করা যাক। মা যখন শুচ্ছে না, আমি একজন নার্সকে বলি। রাতে এসে বাবার ঘরে থাকবে। যদি তোমরা রাজি হও বলতে পারি।’

নার্স মেয়েটি এসেছিল। কম বয়েস এবং দেখতে শুনতে ভালো। ঝুমা তাকে পত্রপাঠ বিদায় করে। স্বামীকে সে বিশ্বাস করে না।

তারপর থেকে রাত একাই কাটান রমাকান্ত। ভালোই লাগে। একা থাকলে, নিজের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া যায়।

গণেশ ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘কেমন আছিস বলবি না?’

রমাকান্তবাবু রাগ দেখিয়ে বললেন, ‘দেখতেই তো পাচ্ছিস। বারবার এক কথা জিজ্ঞেস করিস কেন?’

গণেশ হেসে বলল, ‘আমার তো মনে হচ্ছে ভালোই আছিস।’

রমাকান্তবাবু বললেন, ‘অবশ্যই ভালো আছি। একটু শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে এই যা।’

গণেশ বলল, ‘ও কিছু নয়, একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে। আমি যখন জলে ডুবে যাচ্ছিলাম তখনও শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। পরে ঠিক হয়ে গেল।’

রমাকান্তবাবু বললেন, ‘বুঝলাম। এবার আমার হাতটা তুলে দে দেখি।’

গণেশ হেসে বলল, ‘থাক। খাট থেকে হাত ঝুলিয়ে মরলে একটা নাটক নাটক ভাব হবে।’

রমাকান্তবাবু চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘ফাজলামি করবি না গণেশ। ফাজলামির জন্য তোর সঙ্গে কতবার মারপিট করেছি মনে পড়ে? ক্লাস এইটে একবার আমার পেনসিল নিয়ে পালিয়েছিলি। তোকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছিলাম। তোর মাথা ফুলে আলু হয়ে গেল। মনে পড়ছে?’

গণেশ হেসে বলল, ‘না, মনে পড়ছে না। আমি তো আর তোর মতো মরতে বসিনি, যে পুরোনো কথা মনে পড়বে।’

ঘরের আলো আরও বেড়ে গেছে। আজ বোধহয় খুব রোদ উঠবে। এও একটা মুশকিল। সবাইকে গরমে বেরোতে হবে। শুভটার আবার অ্যালার্জির ধাত। বেশি গরমে গায়ে অ্যালার্জি বেরোয়। অবশ্য এখন তো ডেডবডি ঘাড়ে করে শ্মশানে নিয়ে যাবার ব্যাপার নেই। কাচে ঢাকা গাড়ি আছে। তাও একটা ছোটাছুটি তো থাকে। ঘর বার করতে হয়।

‘আমার অসুখের খবর তোকে কে দিল গণেশ?’

‘বাবলুদা।’

‘বাবলুদা! হার্ট অ্যাটাকে যে মারা গেছে সেই বাবলুদা?’

গণেশ একটা হাই তুলে বলল, ‘হ্যাঁ। রঞ্জনাও বলল। রঞ্জনাকে মনে আছে? বিষ খেয়েছিল।’

রমাকান্তবাবু একটু চুপ করে থেকে নিচু গলায় বললেন, ‘মনে আছে।’

গণেশ ফিচ করে হেসে বলল, ‘তোর সঙ্গে প্রেম ছিল না? বিয়ে করলি না কেন? বেচারি এভাবে মরত না।’

রমাকান্তবাবু গণেশের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘রঞ্জনা তোকে কিছু বলে?’

গণেশ নাক টেনে বলল, ‘বলে না। তবে বুঝি তোর ওপর খুব অভিমান। পাগলি একটা। সেই কবে কলেজের প্রেম…। এখনও জিইয়ে রেখেছে।’

রমাকান্তবাবু বললেন, ‘ওরা সব আছে কেমন?’

গণেশ বলল, ‘ভালো আছে।’

রমাকান্তবাবু আবার একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘তুই কেন এসেছিস?’

গণেশ সহজ ভাবে বলল, ‘তোকে নিতে এসেছি। অনেকটা পথ। দুজনে গল্প করতে করতে চলে যাব।’

‘তুই কি আমাকে বিকেল পর্যন্ত সময় দিবি গণেশ? বাড়ির সবাই খেয়ে-টেয়ে নিত… সারাদিন ধকল যাবে… বিকেল বিকেল হলে রোদটাও কম হতো…।’

গণেশ বলল, ‘না, মৃত্যু সময় দেয় না। আমাকেও দেয়নি।’

মাধবী ঘরে ঢুকলেন। ঢুকেই থমকে দাঁড়ালেন। কেমন একটা গন্ধ না?

রমাকান্তবাবু হেসে বললেন, ‘এসো মাধবী। তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। আমার স্কুলের বন্ধু গণেশ। খুব পাজি। বেটা ক্লাস এইটে পড়বার সময় জলে ডুবে ফট করে মরে গেল। সাঁতার জানত তবু মরল। ডাক্তারবাবু বললেন, গণেশ নাকি সাঁতার দেবার সুযোগই পায়নি। মাঝপুকুরে পেৌঁছোতেই হার্টফেল করে। বেঁচে থাকা কী কঠিন বলো মাধবী। সব আয়োজন, প্রস্তুতি নিয়েও বাঁচা যায় না।’ কথা শেষ করে জোরে হেসে উঠলেন রমাকান্ত। বললেন, ‘যাবার আগে ওকে একটা জোর ধমক দাও তো মাধবী। রোগীর বিছানায় ওঠবার জন্য ওর ধমক খাওয়া উচিত।’

মাধবী চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। তিনি ঘরে ঢুকেই বুঝতে পেরেছেন, রমাকান্তবাবু মারা গেছেন। ঘরে মৃত্যুর মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে চলে গেছেন।

পরদিন সকালে রমাকান্তবাবুর খাটের তলা থেকে এক জোড়া জুতো পাওয়া গেল। ছোটো জুতো। ধুলোমাখা, ডানপায়ে তাপ্পি।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব