অচেনা শৈলশহর মেনপট

অম্বিকাপুর থেকে ৪৫ কিমি দূরে অবস্থিত মেনপট। স্বপ্নময় শৈলশহর।ছত্তিশগড়ের সরগুজা জেলার এই অপূর্ব স্পটটি লোকচক্ষুর আড়ালে রয়েছে বলেই, এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এতটুকু খর্ব হয়নি। গত পাঁচ দশক ধরে তিব্বতিরা বসত গড়েছেন এই মেনপট-এ। কার্পেট বোনা, ম্যাট তৈরি করাই এঁদের মূল আয়ের আধার। এছাড়া যারা এখানকার আদিবাসী, সকলেই নাকি মহাভারতের যুগ থেকে বসবাস করছেন এখানে। প্রচুর পরিমাণে বক্সাইট মেলে এ অঞ্চলে। আর প্রকৃতি ঢেলে সাজিয়েছে চিত্রপট।

Travel
Menpot

থাকার জায়গা পেয়েছি শৈল টুরিস্ট রিসর্ট-এ। ২২ টি কটেজ-যুক্ত এই রিসর্ট আমাদের অবসরযাপনের জন্য আদর্শ। অপূর্ব নৈসর্গিক শোভা, পাখির ডাক, মনোরম বনস্থলি– সব মিলে জবাব নেই মেনপট-এর। ভোর বেলায় কুয়াশামাখা পথ ধরে হেঁটে গেলাম ছোট্ট একটা গ্রামে। গ্রামীণ জীবনের স্বাদ নিয়ে ফিরে এলাম একটা মনভালো করা ব্রেকফাস্টের টানে। বিকেলে ঘুরে নিলাম আকরিক জলের হ্রদ তপ্তপানি। অপূর্ব নিসর্গে মনের রিজুভিনেশন হয়ে যায় অচিরেই।

Travel
Menpot

মেনপট-এ কয়েকটি সুন্দর সাইট সিয়িং রয়েছে। পরের দিনটা বরাদ্দ ছিল সেই জন্যই। একটা গাড়ি ভাড়া করে ঘুরে নিলাম জায়গাগুলো। প্রথমেই মছলি পয়েন্ট। এটা একটা ঝরনা, উচ্চতা প্রায় ৪৮ মিটার। মছলি নদীতে গিয়ে মিশেছে এই ঝরনা। জায়গাটার দৃশ্যপট অনবদ্য। জঙ্গলের পথ ধরে ছোট্ট ট্রেক করে পৌঁছোনো যায় এখানে। ঝরনায় স্নান করতে করতে প্রচুর মাছ দেখতে পাবেন পাথরের খাঁজের মধ্যে।

গভীর জঙ্গল পেরিয়ে গাড়ি পৌঁছোল আরও একটি অপূর্ব দ্রষ্টব্য, টাইগার পয়েন্ট-এ। এটাও একটি ঝরনা, যার দ্বারা তৈরি হয়েছে মহাদেব মুড়া নদী। বর্ষার জল পেয়ে নদীটি বেশ স্ফীত। কাছেই ‘ফায়ার ওয়াচ টাওয়ার’। উপর থেকে চারপাশের জঙ্গল ও উপত্যকার অপূর্ব রূপ মন কেড়ে নেয়।

Travel
Menpot

মেহতা পয়েন্ট আমাদের পরের গন্তব্য। চারপাশের পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য এ জায়গাটার তুলনা নেই। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। পর্যটকদের জন্য কয়েকটি শেড তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, যেখানে বসে অনেকটা সময় কাটিয়ে দেওয়া যায় প্রকৃতির কোলে।

এরপরের স্পটটা খুব ইন্টারেস্টিং। নাম জলজলা। একটি নদীর উপর আচ্ছাদন তৈরি করেছে একফালি জমি। এই জমির উপর লাফালে সেটা কাঁপে। ছোটো বড়ো সকলেই এই অনুভূতির শরিক হয়ে বেশ মজা পান। বৃষ্টি নেমে যাওয়ায় জায়গাটার সৌন্দর্য যেন আরও বেড়ে গেল। একটা চায়ের দোকানে গরম গরম ভুট্টা আর চা খেয়ে সময় কাটালাম।

দেখার জিনিস আরও আছে মেনপট-এ। তিব্বতিদের পাড়ায় আছে একটি বুদ্ধমন্দির। আদিবাসী সংস্কৃতি ও তিব্বতি সংস্কৃতির একটা মিশ্রণ নজরে পড়ে এই বৌদ্ধ বিহারে। শান্ত পরিবেশে মন অপার আনন্দের খোঁজ পায় যেন। তিব্বতিদের গ্রাম দেখতে দেখতে প্রেয়ার ফ্ল্যাগের রঙিন অনুষঙ্গে পথটা মায়াময় হয়ে উঠেছে।

পরদিন আমাদের রায়পুর ফেরা। পথে দেখার মতো কয়েকটি জায়গা রয়েছে। টিনটিন পাত্থর তার অন্যতম। একটা আশ্চর্য পাথর, যা থেকে ড্রামের আওয়াজ নির্গত হয়। ছোটোরা ওই পাথর বাজিয়ে গান শুরু করে দিল। এ এক মজার অভিজ্ঞতা।

পালি মেন রোডের উপর পড়ল একটি মহাদেব মন্দির। এই প্রাচীন মন্দিরের শান্ত পরিবেশ মন কেড়ে নিল। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে সংরক্ষিত এই মন্দিরে শিবের অধিষ্ঠান। দরজায় গঙ্গা ও যমুনার বিগ্রহ।

এবার আর থামা নেই, গন্তব্য রায়পুর। ছোট্ট ছুটি কাটিয়ে অবশেষে আমরা ঘরমুখো। ছত্তিশগড়ের এই নিরালা সফর আজীবনের সঞ্চয় হয়ে রইল।

মেঘালয়ের মেঘতালুক-এ

মেঘের দেশের রাজধানী শিলং, তার মাথায় মেঘালয়ের রানির শিরোপা। মেঘালয়ের আদি বাসিন্দারা হল খাসি, গারো ও জয়ন্তী এই তিনটি উপজাতি। ১৯৭১ সাল। অসম রাজ্যের খাসি, গারো ও জয়ন্তীয়া পাহাড়কে নিয়ে একটি পৃথক রাজ্য গঠনের প্রক্রিয়া শেষের মুখে। এই সময় প্রশ্ন উঠল নতুন রাজ্যের নামকরণ নিয়ে। এই জন্য গঠিত হল একটি কমিটি। তার অন্যতম সদস্য ছিলেন স্বনামধন্য ভাষাবিদ ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়। অনেক আলোচনার পর স্থির হল রাজ্যের নাম মেঘালয়। ১৯৭২ সালের ২১ জানুয়ারি, মেঘালয় ভারতের একুশতম পূর্ণ রাজ্যরূপে আত্মপ্রকাশ করল।

মেঘালয় বলতে শুধু শিলং নয়। উদ্দেশ্য শিলং-কে কেন্দ্রে রেখে, মাওলিনং, নারটিয়াং, চেরাপুঞ্জি প্রভৃতি স্থান দেখে নেওয়া। ফেরার পথে উমিয়াম লেক রিসর্টে এক রাত কাটিয়ে গুয়াহাটি ছুঁয়ে ফিরে যাব কলকাতার উদ্দেশে। সময় বাঁচানোর জন্য কলকাতা থেকে গুয়াহাটি আসার ব্যবস্থা হয়েছে আকাশপথে।

গুয়াহাটি বিমানবন্দরে বেরিয়ে এসে দেখি যে সেখানে শিলং যাওয়ার গাড়ির বড়োই আকাল। একটি দুটি গাড়ি যেতে রাজি হলেও সেগুলি সব ছোটো গাড়ি আর ভাড়াও চাইছে অনেক বেশি। তাই স্থির করলাম মালপত্র নিয়ে চলে যাব গুয়াহাটি রেলস্টেশনের কাছে পল্টনবাজারে। সেখানে শিলংয়ের গাড়ি পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। দুটি ছোটো গাড়িতে মালপত্র নিয়ে চলে গেলাম পল্টনবাজার। গাড়ির স্ট্যান্ডের বাইরে ‘শিলং-শিলং’ বলে লোক ডাকছে। শুধু শিলং ড্রপ নয় পুরো সফরের জন্য টাটা সুমো সার্ভিসের সঙ্গে গাড়ির চুক্তি করে নিলাম। ভাড়াও বেশ ন্যায্য বলে মনে হল। গাড়ি শিলংয়ের হোটেলে নামিয়ে দিয়ে চলে যাবে। পরদিন থেকে ভ্রমণ শুরু।

গুয়াহাটি থেকে সড়কপথে ১০৩ কিমি দূরবর্তী শিলং পৌঁছোতে সময় লাগবে তিন থেকে চার ঘন্টা। গুয়াহাটি থেকে শিলং যাত্রার পথে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ স্থান হল জোড়বাট– গুয়াহাটি থেকে ১৬ কিমি দূরে। এখানে পথ দুভাগ হয়ে গেছে। তেজপুর, কাজিরাঙা, জোরহাট এবং ডিব্রুগড় যেতে হলে বাঁদিকের পথে যেতে হবে আর শিলংয়ের পথ সোজা। জোড়বাট থেকে শিলংয়ের দূরত্ব ৮৩ কিমি। জোড়বাটকে পিছনে ফেলে রেখে, হালকা চড়াই পথ ধরে শিলংয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে একে একে পেরিয়ে এলাম বেশ কয়েকটি ছোটো বড়ো জনপদ– বার্নিহাট, উমলিং, নংপো আর উমসনিং। এর পরেই পথের ডানদিকে পড়ল অপরূপ উমিয়াম লেক যা স্থানীয়দের কাছে বড়াপানি নামে পরিচিত। রাস্তা থেকে একটি ভিউপয়েন্ট চোখে পড়ল। এই কৃত্রিম কিন্তু অপূর্ব লেকটি দেখতে দেখতে আরও এগিয়ে যাই। উমিয়াম লেক থেকে মওলাই হয়ে শিলংয়ের দূরত্ব প্রায় ১৬ কিমি।

শহরে ঢোকার মুখে একটু যানজট কাটিয়ে সন্ধের আগেই পৌঁছে গেলাম আমাদের আগামী চারদিনের ঠিকানা অর্কিড হোটেলে। হোটেলটি সরকারি, দাম একটু বেশি কিন্তু ঘরগুলি বড়ো, অন্যান্য ব্যবস্থাও বেশ ভালো। হোটেলটি পোলো রোডে একটু নিরিবিলিতে। বাজার দোকান সবই পুলিশ বাজারের দিকে, এই জায়গাটি পুলিশবাজার থেকে একটু দূরে। গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হল, শর্তানুযায়ী পরদিন সকাল সাড়ে আটটায় হোটেলে রিপোর্ট করবে। আমাদের গন্তব্য মাওলিনং ও ডাওকি।

ভোরে উঠে স্নান, ব্রেকফাস্ট সারা হয়ে গেল সকাল ৮টার মধ্যে। ব্রেকফাস্টে টোস্ট, মাখন-জ্যাম, ওমলেট আর কলকাতা থেকে আনা মিষ্টি, চা-কফি তো আছেই। সকালে হালকা ঠান্ডা, একটা হাফ হাতা সোয়েটার পরলেই চলে যায় এই অক্টোবরের সকালে। গাড়িও এসে গেল সময়মতো। আমরা ন’টার আগেই মাওলিনংয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। শিলং থেকে মাওলিনং ৯০ কিমি। ইতিমধ্যে খেয়াল হল আকাশ মেঘে ঢেকে গেছে, ঠান্ডা বাতাস দিতে শুরু করেছে। মেঘলা থাকুক অসুবিধা নেই কিন্তু বৃষ্টি হলেই বিপদ। মাওলিনং একটি ছোট্ট খ্রিস্টান আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম যা সম্প্রতি এশিয়ার সবচেয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন গ্রাম হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে। শিলং থেকে মেঘালয় পর্যটনের বাস সারাদিনের প্রোগ্রামে এই গ্রাম দেখিয়ে আনে তবে নিজস্ব গাড়ি নিয়ে এলে অনেক স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করা যায়।

শিলং থেকে চেরাপুঞ্জির পথে আমরা চলেছি। খানিক দূর যেতেই সাইনবোর্ডে এলিফ্যান্ট ফলসের দিকনির্দেশিকা নজরে এল। মূল রাস্তা থেকে ৫০০ মিটার দূরে। ফলসের গা বেয়ে সিঁড়ি আছে নীচে নামা যায়। তবে আজকে আমাদের এ পথ নয়। চেরাপুঞ্জির পথে যেতে যেতে উমতিয়াংগির কাছে রাস্তা দুভাগ হয়ে গেছে। একদিকে সোহরা বা চেরাপুঞ্জি অন্য পথটি ডাওকির দিকে। ডাওকির পথেই পড়বে মাওলিনং। কমলালেবুর জঙ্গল ছেড়ে এবার গাড়ি পাইন ও ফারের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলেছে। ইতিমধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে টিপটিপ করে। গাড়ি থেকে নেমে আর ছবি তোলার উপায় রইল না।

উমতিয়াংগি নদীর বাঁকে জানলা খুলে ছবি তুলতে গিয়ে হুড়মুড় করে বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিল ক্যামেরা, জামাকাপড়। পূর্ব খাসি পাহাড়ের বুক চিরে কখনও বা ঘন জঙ্গল কখনও বা রুক্ষ পাহাড় আবার কখনও সবুজ উপত্যকা পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। গাড়ি ধীরে ধীরে পাহাড় থেকে উপত্যকার দিকে নেমে আসছে। পেরিয়ে চলি ছোটো ছোটো গ্রাম– লাতেনলিগট, পাইনুরসুলা প্রভৃতি। বৃষ্টির জন্য গাড়ি থেকে নামার উপায় নেই। চলতে চলতে দেখছি গ্রামের বাড়িঘর দোকানপাট আবার অনেক বাড়ির দাওয়ায় ফুলঝাড়ুর স্তুপ। ড্রাইভার দেখাল রাস্তার দুপাশেই ফুলঝাড়ু গাছের জঙ্গল।

পমটুং ব্রিজ পেরোতেই ডান দিকে রাস্তা ঢুকে গেছে মাওলিনং গ্রামের দিকে– এখান থেকে আরও ১৮ কিমি। আরও আধঘন্টা পরে পৌঁছে গেলাম মাওলিনং গ্রামে। গ্রামে ঢোকার আগে থাইলং নদী তবে তার জলধারা বেশ শীর্ণ। এখন বৃষ্টি থেমেছে তবে আকাশ এখনও মেঘে ঢাকা, আবার যে-কোনও সময়ে নামতে পারে।

গাড়ি এসে থামল গ্রামের বাইরে। অনেকটা ফাঁকা জায়গা জুড়ে অনেক গাড়ি বাস দাঁড়িয়ে আছে– সবই পর্যটকদের নিয়ে এসেছে। এই অল্প পরিচিত স্থান হঠাৎই কী করে এত জনপ্রিয় পর্যটনস্থল হয়ে উঠল বুঝতে পারলাম না। বাংলা কথাবার্তা বুঝিয়ে দিচ্ছে অনেক পর্যটকই বাঙালি তবে স্থানীয় মানুষরা অনেকেই হাজির। এখানকার অধিকাংশ মানুষই খাসি সম্প্রদায়ের, খাসি ভাষায় কথা বলে তবে ইংরেজিও জানে কেউ কেউ।

ডানদিকে নাহোয়েট গ্রাম আর বাঁদিকে মাওলিনং। গাড়ি থেকে নেমে আমরা প্রথমে চললাম নাহোয়েট গ্রামের পথে। কারণ এখানে রয়েছে একটি একতলা রুটব্রিজ। খুব বেশি হাঁটতে হবে না বলে আশ্বাস পেলাম। একটা ঢালু অসমান পাথুরে পথে এগিয়ে চলি। রাস্তার একপাশে দোকান, সেখানে চা কফি স্ন্যাক্স ছাড়াও নানা ধরনের হাতের কাজের উপহার সামগ্রী পাওয়া যাচ্ছে। খাসিদের হাতের কাজ খুব সুন্দর।

এই লিভিং রুট ব্রিজ সম্বন্ধে দু-এক কথা না বললে অন্যায় হবে। এই শিকড় সেতু সম্পর্কে আমাদের ড্রাইভারের কাছ থেকে আগেই কিছুটা জ্ঞান লাভ করেছি। মেঘালয়ে এই রুট ব্রিজ একেবারেই তাদের নিজেদের সৃষ্টি। নদী পারাপারের জন্য প্রকৃতি আর মানুষের বুদ্ধি মিলে রূপ পেয়েছে এই জীবন্ত শিকড় সেতু। খাসি উপজাতি মানুষেরা লক্ষ্য করেন এক বিশেষ প্রজাতির রবার গাছ যার নাম ফাইকাস ইল্সটিকা, যার মূল শিকড়গুলি অন্যান্য গাছের মতো মাটির নীচে থাকলেও বয়ঃপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে শাখাশিকড়গুলি আড়াআড়ি মাটির ওপর বেড়ে ওঠে। কাজে লাগানো হয় সুপারি গাছকে। এই গাছের কান্ডের অর্ধাংশকে তারা এই কাজে ব্যবহার করেন। কাণ্ডগুলিকে ফাঁপা করে ঢোকানো হয় বেড়ে ওঠা রবার গাছের শিকড়। ফাঁপা সুপারি কাণ্ডকে অবলম্বন করে বাড়তে থাকে শিকড়। নদীর এক প্রান্ত থেকে এগিয়ে চলা শিকড় একসময় নদীর অপর প্রান্তের পাড়ে উপস্থিত হয়। ফাঁপা কাণ্ড ছেড়ে মাটি স্পর্শ করে। মাটিতে শিকড় ভালো ভাবে ঢুকে গেলেই ফাঁপা সুপারিকাণ্ড কেটে ফেলা হয়। এইভাবে একাধিক শিকড়কে নদীর দুই প্রান্তের মাটিতে গেঁথে দিয়েই সেতু তৈরি। সেতুর মাঝের ফাঁকফোকর পাথর কাঁকর ইত্যাদি দিয়ে ভরাট করা হয়। গোটা প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হতে কুড়ি থেকে পঁচিশ বছর সময় লাগে। এই ব্রিজের বয়স তিনশো বছর পেরিয়ে গেছে বলে শুনলাম। একসঙ্গে ৬০ জন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের ভার বইতে সক্ষম এই জীবন্ত সেতু।

ঢালু পথ বেয়ে নামতে শুরু করেছি। সরু পথ, রাস্তার ধারের দোকানপাট এখন আর নেই, একপাশে খাদ আর অন্যদিকে পাহাড়ি জঙ্গল আর তার সঙ্গে মানুষের ঢল। শিলং-এ তো টুরিস্টদের এত ভিড় দেখিনি। এর মধ্যে শুরু হল বৃষ্টি এবার ঝমঝমিয়ে। ছাতা এক হাতে আর ক্যামেরার ব্যাগ অন্যহাতে, ভিড় সামলে এগিয়ে চলি।

পৌঁছে গেলাম লিভিং রুট ব্রিজে। পাহাড়ি নদী থাইলং-এর ওপর এই ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। ব্রিজের ওপর ছবি বা সেলফি তোলার জন্যে খুব হুড়োহুড়ি, ঠেলাঠেলি। অগত্যা ব্রিজ পেরিয়ে থাইলং নদীর ধার ধরে একটু হাঁটতে শুরু করলাম’ বৃষ্টি পড়েই চলেছে। নদীর জল কিন্তু খুব গভীর নয়, নুড়ি পাথর বোল্ডারের মধ্যে দিয়ে ধীর লয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই রুট ব্রিজ ভ্রমণার্থীদের এক অন্যতম আকর্ষণ তো বটেই তার সঙ্গে গ্রামবাসীদের কাছে এক পরম আশীর্বাদ। যেহেতু গাছটি থেকে সমানে ঝুরি উৎপন্ন হচ্ছে সেহেতু নতুন ঝুরি এসে পুরোনো ক্ষয়ে যাওয়া ঝুরিগুলির স্থান দখল করছে। ফলে আরও সুদৃঢ় হচ্ছে বাঁধন। ভিড় একটু হালকা হতে ব্রিজের ছবি তুলে ফেরার পথ ধরি। এবার চড়াই পথে ফেরা। কিছুটা এগিয়ে একটা দোকানে এক কাপ চা খেয়ে গলা ভেজালাম। তারপর আবার উপরে ওঠা।

রুট ব্রিজের আরও বড়ো আকর্ষণ আছে চেরাপুঞ্জি থেকে ১৪ কিমি দূরে লাইতা কিনাসিউ গ্রামের কাছে। সেখানে রয়েছে ডবল রুট ব্রিজ। এই রুট ব্রিজ দেখতে হলে ৫ কিমি চড়াই উৎরাই পথ অতিক্রম করতে হবে।

এবারে মাওলিনং গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করি, তখনও প্রবল বেগে বৃষ্টি পড়ছে। সরু রাস্তায় প্রচুর গাড়ির মেলা। গাড়ি পার্ক করাও এক দায়, তার ওপর এই প্রবল বৃষ্টি। দুপুর হয়ে গেছে এবার যা হোক কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

ভাতের হোটেল এখানে হাতে গোনা সেখানেও প্রচুর ভিড়। হোটেলে খাওয়ার বুকিং করে গ্রাম দেখতে বেরোই। গ্রামবাসীদের মিলিত প্রচেষ্টায় রাজ্যের এক কোণে পড়ে থাকা মাওলিনং, মেঘালয়ের পর্যটন মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে। ল্যান্ডস্কেপে ধরা দেয় ছোটো-বড়ো খাসি পাহাড়ের সারি। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এই গ্রাম আজ সারা বিশ্বের আলোচনার বিষয়। গ্রামবাসীর সমবেত প্রয়াসে এটা সম্ভব হয়েছে। গ্রামকে পরিচ্ছন্ন রাখতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গ্রাম জুড়ে বেতের তৈরি ডাস্টবিনের ছড়াছড়ি। কোথাও ময়লা জমলেই স্থান হয় এই ডাস্টবিনে। এই কারণেই মাওলিনং এশিয়ার সবচেয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন গ্রামের শিরোপার অন্যতম দাবিদার।

এখানে মানুষেরা ফুল ভালোবাসেন। মাওলিনং গ্রামে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে ছোটো-বড়ো ফুলের বাগান। যাদের জমির অভাব তারা বারান্দায় টব ঝুলিয়ে ফুল ফোটাচ্ছেন। নানাবর্ণের বোগেনভিলিয়া, বিভিন্ন ধরনের দুষ্প্রাপ্য অর্কিডে মোড়া মাওলিনং-এর পথঘাট।

বৃষ্টি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য একটি বাড়ির শেডের নীচে দাঁড়ালাম। বাড়ির বারান্দায় বসা এক বয়স্ক মানুষ সাদর আমন্ত্রণ জানালেন ভিতরে। হাতে বেশি সময় নেই তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই তার সঙ্গে ভাঙা হিন্দি ও ইংরেজিতে আলাপ জমাই। তার মুখেই শুনি মাওলিনং-এর এক টুকরো ইতিহাস। একশো বছর আগে থেকেই মাওলিনং গ্রামে চলছে পরিচ্ছন্নতার ও পরিবেশ সচেতনতার কার্যক্রম। ২০০৩ সালে মাওলিনং গ্রামের চার্চে কাজ করতে আসা এক মেমসাহেবের নজরে পড়ে পুরো বিষয়টা। তাঁর আমন্ত্রণে ডিসকভারি চ্যানেল এসেছিল মাওলিনং সম্পর্কে ফিল্ম তুলতে। তাতেই বিশ্বের দরবারে পৌঁছে যায় মাওলিনং।

এরপর পিচের রাস্তা তৈরি হয়েছে। নিজেদের গ্রামকে আরও বেশি সুন্দর করে রাখার দায়িত্ব তুলে নিয়েছে স্থানীয় মানুষ। নিজেদের ক্ষেতের কাজ, ফুলঝাড়ু চাষ এসবের মধ্যেও রয়েছে গ্রাম পরিষ্কার রাখার লক্ষ্য। শুধু এই গ্রাম নয় আশপাশের গ্রামেও সেমিনারের বা আলোচনার মাধ্যমে প্রচার করে তাদের কর্মসূচী। প্লাস্টিক বর্জনও তারা রূপায়িত করেছে, যা আমরা এখনও পারিনি। মাওলিনং এ বাড়ি আছে একশোর কাছাকাছি, গ্রামবাসী পাঁচশো। এরা যদি পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা সারা বিশ্ববাসীকে দিতে পারে, তাহলে আমরাই বা পারব না কেন?

কিছু ছবি তুলে ফিরে আসি খাবার হোটেলে। ভিড় একটু হালকা হয়েছে। আমরা খেতে বসার সুযোগ পেলাম, কিন্তু খাবার তো বাড়ন্ত। আরও দশ মিনিট অপেক্ষা করতে হল ভাত সিদ্ধ হবার জন্য। তবে মেনু খুবই সাধারণ– ভাত, ডাল, আলুভাজা আর কপির তরকারি, ডিমের যোগানও ফুরিয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লাম কারণ মাওলিনং-এ আরও কয়েকটি দ্রষ্টব্য বাকি।

রাস্তার ধারে ব্যালেন্সিং রক। তারও দেখার প্রবেশমূল্য ১০ টাকা। রাস্তা থেকে একটু নীচে বিশাল এক চ্যাপটা গোলাকার শিলাখণ্ড, মাঝখানে একটি ছোট্ট পাথরের খন্ডের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে মাটির ওপর। পাথর ও মাটির মধ্যে প্রায় দু ফুটের ব্যবধান আর এর চারপাশে নীচু গ্রিল দিয়ে ঘেরা। এই ছোট্ট পাথরখণ্ড কীভাবে বছরের পর পছর এই বিশাল পাথরের চাতালকে বহন করে যাচ্ছে তা সত্যিই বিস্ময়কর এক প্রাকৃতিক আশ্চর্য। আর একটু এগিয়েই রাস্তা থেকে দেখা যাচ্ছে মাওলিনং চার্চ, সামনে এক বড়ো ঘাসজমি। কিন্তু রাস্তার কাছে গেট তালাবন্ধ। চার্চের কাছে গিয়ে ছবি তুলতে হলে গ্রামের ভিতর দিয়ে যেতে হবে। বৃষ্টি তো পড়েই চলেছে। চার্চের ছবি তুলে ফিরে আসতে মিনিট দশেক সময় লাগল, তখনও গাড়ি ফিরে আসেনি। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে আরও দশ মিনিট রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার পর গাড়ি এল। বৃষ্টিতে জামা প্যান্ট ভিজে সপসপে।

এবারের গন্তব্য রিওয়াই গ্রামের স্কাই ভিউপয়েন্ট। এখানেও প্রবেশ মূল্য আছে ২০ টাকা। বৃষ্টি বোধহয় একটু কমেছে। খাসি ভাষায় এই ভিউপয়েন্টের নাম ‘ব্রন খংমেন’ (টিকিটের গায়েই মুদ্রিত)। টিকিট কেটে বাঁশের তৈরি এক অদ্ভুত সিঁড়ির সামনে দাঁড়ালাম। সিঁড়ি বাঁশের তৈরি আর তার বাঁধন হল বেতের। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকি। এ যেন অনেকটা গাছবাড়ির মতো তবে অনেকটাই বিস্তৃত তার প্রেক্ষাপট। একতলায় গাছের গুঁড়ি, বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছোলাম গাছের ডালের গায়ে ঘরে। একদিকে এক লম্বা বারান্দা শেষ হয়েছে একটা ছোট্ট বাঁশের খুপরিতে, সেটাই হয়তো একদিকের ভিউপয়েন্ট। আর এক দিকের বাঁশের বারান্দার ধারে একটি ঘর সেটি আবার তালাবন্ধ। এই রকম হেলানো বাঁশের সিঁড়ি চলে গেছে তিনতলায়। সিঁড়ির ধারে বাঁশের কঞ্চির হাতল। প্রথমে একটু ভয় করলেও সাহস করে উঠে গেলাম। তিনতলার মাচা থেকে পুরো গ্রামটাই দেখা যায়। আবার শুরু হল বৃষ্টি। তাড়াতাড়ি নীচে নেমে এলাম।

বিকেল চারটে বেজে গেছে। আমাদের ড্রাইভার জানাল এই বৃষ্টি বাদলে অবেলায় ডাউকির পথে আর যাওয়া যাবে না। এখান থেকে ডাউকি যাতায়াত ৪০ কিমি, তারপর মাওলিনং থেকে শিলং ফেরা। এই বৃষ্টির মধ্যে অন্ধকারে ফেরা খুবই বিপজ্জনক। অতএব আর দেখা হল না সীমান্তের ইয়ামপোর্ট নদী। একটি সুন্দর জলপ্রপাত আর ডাউকির অনন্য প্রকৃতি। গাড়ি মুখ ঘোরাল শিলংয়ের দিকে। জলে ভেজা অবস্থায় যখন হোটেলে ফিরলাম তখন মনে হল সার্থক হয়েছে রাজ্যের নাম মেঘালয়।

হোটেলে ফিরে শুকনো হয়ে গরম গরম কফি আর পকোড়া দারুণ জমে গেল। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময়েও বৃষ্টি চলছে। মনে আশঙ্কা নিয়ে ঘুমের দেশে চলে গেলাম।

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মনটা ভালো হয়ে গেল। আকাশ পরিষ্কার সূর্য উঠছে, নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে। স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট। আজকের মেনু পুরি, সবজি, কেক আর তার সঙ্গে চা, কফি। আজকে আমাদের সফর সূচীতে আছে মেঘালয়ের আর এক অল্প পরিচিত স্থান নারটিয়াং। জয়ন্তিয়া পাহাড়ের কোলে নারটিয়াং, জোয়াই অঞ্চলে অবস্থিত। নারটিয়াং, শিলং থেকে ৬৫ কিমি, সেখান থেকে জেলা সদর জোয়াই আরও ২৪ কিমি।

যথাসময়ে আমাদের যাত্রা শুরু হল। হয়তো গতকালের বৃষ্টির জন্যেই আজকের আবহাওয়া একটু শীতল। বেশ আরাম লাগছে। শিলংয়ের শহুরে অঞ্চল ছেড়ে গাড়ি চলেছে এক সবুজ প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে। মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো গ্রাম, ফসলের জমি আবার কখনও বা ছোটো ছোটো টিলা। জয়ন্তিয়া পাহাড় মেঘালয়ের একেবারে পুব দিকে অবস্থিত। উন্মুলং গ্রাম পেরিয়ে আমরা জয়ন্তিয়া হিলস্-এর এলাকায় প্রবেশ করলাম। সারা অঞ্চল জুড়ে ঢেউ খেলানো পাহাড় আর সবুজ উপত্যকা, তবে উঁচু পাহাড়ের শিখর এদিকে নেই। আজকে আমাদের প্রথম দ্রষ্টব্য থাডলেসকেইন লেক। পাঁচিল ঘেরা এই লেকের কাছে আমাদের গাড়ি এসে থামল। এই লেকের এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। জয়ন্তিয়া রাজবংশের এক রাজার সেনাপতির নির্দ্দেশে এই লেকটি খনন করা হয়। রাস্তার ধারেই চির-পাইনে তিনদিক ঘেরা এই ছোটো লেক। একসময়ে এখানে রেস্তোরাঁ আর জলে বোটিংয়ের ব্যবস্থা ছিল। বর্তমানে অবশ্য তা বন্ধ আছে, তবে এই লেক আবার নতুন করে সেজে উঠছে। লেক ঘিরে তৈরি হচ্ছে নতুন রাস্তা। সেই কারণে অনেক মহিলা শ্রমিক এখানে কাজ করছে। লেকের এক ধারে বোট হাউস, তবে বোটই না চললে বোট হাউসে কী হবে?

গাড়ি এগিয়ে চলে জোয়াইয়ের দিকে। আমরা শিলং থেকে ৫০ কিমি-র বেশি পেরিয়ে এসেছি। এবার এক মাঠ ঘেঁসে গাড়ি থামল। ড্রাইভার জানাল আমরা যাব তিরসি প্রপাত দেখতে। তবে এই বিশাল মাঠ পেরিয়ে হাঁটতে হবে প্রায় এক কিলোমিটার। সবুজ আর হলুদে মোড়া শষ্যক্ষেত্রের আলপথ ধরে আমরা হাঁটছি। কোথাও বা বৃষ্টিতে আলপথ ভেঙে গেছে তখন মাঠের মধ্যে দিয়েই আমাদের পথ। ড্রাইভারই আমাদের পথ প্রদর্শক।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম প্রপাতের দোরগোড়ায়। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হবে প্রপাতের ভিউপয়েন্টে। বেশ বড়ো চাতাল রেলিং দিয়ে ঘেরা, একদিকে দেখা যাচ্ছে প্রপাতের উপরের অংশ আর অন্য দিকে নকশা করা কাঁথার মতো নানা রঙের শষ্যক্ষেত্র। একটি ফলকের লিপি থেকে জানা গেল এই তিরসি প্রপাতের সৌন্দর্যায়ন হয়েছে ২০০৬ সালে সরকারি প্রকল্পে। প্রপাতের পূর্ণ রূপ দেখতে হলে সিঁড়ি দিয়ে অনেকটা নীচে নামতে হবে। রডোডেনড্রন গাছের জঙ্গল ঘিরে রেখেছে জলের ধারাকে তবে গাছে এখন ফুল নেই। একেবারে নীচের তলা থেকে প্রপাতের প্রবল বেগে অবতরণ দৃশ্য দেখে মন বিমোহিত হল। বাতাসে ভাসছে অসংখ্য জলকণা। একটা স্নিগ্ধ শীতলতা ও স্যাঁতসেঁতে ভাব রয়েছে প্রপাতের নীচের তলায়।

এবার আমাদের যাত্রা নারটিয়াং গ্রামের দিকে। জোয়াইয়ের পথে আরও ১৫ কিমি এগিয়ে তারপর বাঁদিকে আরও ৫ কিমি পথ পেরোলে নারটিয়াং গ্রাম। এক সময় জয়ন্তিয়া রাজাদের রাজধানী ছিল এই নারটিয়াং। এখানে ছড়িয়ে আছে জয়ন্তিয়া রাজত্বের নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। নারটিয়াংয়ের খ্যাতি তার ঐতিহাসিক মনোলিথ পার্কের জন্য। মনোলিথ হল সংরক্ষিত বড়ো আকারের প্রস্তরখণ্ড, যেগুলিকে স্মৃতিস্তম্ভ বলা চলে। মনোলিথ পার্কে ঢুকতে কোনও টিকিট কাটতে হয় না। প্রবেশ করলাম এই পাথরের পুরাতাত্ত্বিক বাগানে। চারদিকে নানা আকারের ও উচ্চতার পাথরের স্ল্যাব পোঁতা রয়েছে। আঁকাবাঁকা রাস্তা চলে গেছে সেই প্রস্তর-অরণ্যের মধ্যে দিয়ে। নারটিয়াং গ্রামের এই অঞ্চলটির নাম অ্যাওমুলং– এখানেই এই রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মনোলিথ দেখতে পাওয়া যায়। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাসে মৃতের স্মারকরূপে মনোলিথ স্তম্ভ সৃষ্টি করা হয়। পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা লম্বা মনোলিথ এই অঞ্চলেই রয়েছে। জয়ন্তিয়া উপকথা অনুযায়ী, বীর যোদ্ধা মারফালিস্কি ২৬ ফুট লম্বা সাড়ে ৬ ফুট চওড়া ও দেড় ফুট মোটা মনোলিথটি একহাতে খাড়া বসিয়েছিলেন। স্থানীয় রাজাদের গৌরবময় স্মৃতিতে এই সব মনোলিথ ১৫০০ সাল থেকে ১৮৮৩ সালের মধ্যে বসানো হয়েছিল।

মনোলিথ পার্কের পাশেই নারটিয়াং লেক তবে তার গেট তালাবন্ধ রয়েছে। গেটের ফাঁক দিয়ে যেটুকু দেখা যায় তাতে বোঝা গেল বেশ লম্বা জলাশয়, তার পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে, একটি বিশ্রামকক্ষও রয়েছে। তবে অযত্নের ছাপ চারদিকে, বড়ো বড়ো গাছের সঙ্গে ঝোপঝাড়ে ভরে গেছে চারদিক। আমরা এবার চলেছি নারটিয়াং দুর্গামন্দিরের উদ্দেশ্যে। গ্রামের মধ্যে দিয়ে পথ। দুর্গামন্দিরটি একটি উঁচু জমির ওপর, গাড়ির রাস্তা অনেকটাই নীচে। রাস্তা থেকে সিঁড়ি বেয়ে মন্দির চত্বরে প্রবেশ করতে হল। লাল-সাদা রঙের দুর্গামন্দির। লাল রঙের পতাকা উড়ছে মন্দিরের সামনে, বিভিন্ন তিথিতে বেশ জাঁকজমক করে পূজা হয় এই হিন্দু মন্দিরে।

খাসি পাহাড়ের বাসিন্দারা দেবদেবীর মূর্তি পূজায় বিশ্বাসী নয় বলে গাঁদাফুলের বেদীর ওপর বসানো একটি কাঠের গুঁড়িকে দুর্গার প্রতিরূপ হিসাবে পূজা করে। প্রচলিত কাহিনি অনুযায়ী এক জয়ন্তিয়া রাজা তাঁর হিন্দুধর্ম গ্রহণ উপলক্ষে এই দুর্গামন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, প্রথমে মন্দিরটি গড়া হয় খাসিদের খড়ের চালের আদলে পরে আবার নতুন করে গড়া হয়। প্রাচীনকালে জয়ন্তিয়া রাজা, পূজা-পাঠের জন্য হিন্দু-ব্রাহ্মণদের নিয়ে আসেন এখানে। তাদের বংশধররাই আজও মন্দিরের পূজারি। এখানে একসময়ে নরবলির প্রচলন ছিল কিন্তু ইংরেজ আমলে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

দুর্গামন্দির ছাড়া এখানে একটি শিবমন্দিরও রযেছে। দুর্গামন্দির থেকে একটু খাড়াই পথে পড়ে সেই শিবমন্দির। এই মন্দিরেও হিন্দু পূজারীই পূজা-পাঠ করে। নারটিয়াং-এ খাওয়ার কোনও হোটেল নেই, তাই শিলংয়ের অভিমুখে গাড়ি মুখ ঘোরাল। জোয়াই যাওয়ার চুক্তি আমাদের গাড়ির সঙ্গে হয়নি তাই মরিংনেং গ্রামের কাছে হাইওয়ে ধাবায় দুপুরের খাওয়া সাঙ্গ করে শিলংয়ে ফিরে চললাম।

 

সোনার বাংলার পথে

কলকাতা থেকে ছেড়ে ভূতল পরিবহনের বাস যখন পেট্রাপোল সীমান্তে পৌঁছোল, তখনও সীমান্ত শহর পুরোপুরি জেগে ওঠেনি। চোখেমুখে নজরে আসে আলসেমিভাব। এক্ষুনি প্রবেশ করব বাংলাদেশের যশোর জেলায়। ওই দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ! পশ্চিমবঙ্গের মতো গাছপালা, মাটির রং, ভাষা এক, অন্তরঙ্গতায় এক, তবুও আলাদা দেশ– ভাবলেও মন হয়ে ওঠে ভারাক্রান্ত। মাঝে ‘নো ম্যান’স ল্যান্ড’, তার এপাশে বিএসেফ এবং ওপারে বিডিআর-এর রক্তচক্ষু। আমরা যারা ভিসা নিয়ে চলেছি ভ্রমণে, তারা যেন অপরাধ করে ফেলেছি! কাস্টমসের ঝামেলা অতিক্রম করতে পেট্রাপোল ও বেনাপোল মিলিয়ে ৩ ঘণ্টা লেগে গেল। পেট্রাপোল উত্তর ২৪ পরগণা জেলায় এবং বেনাপোল বাংলাদেশের যশোর জেলায়। ছুটে চলল বাস। দেড় ঘণ্টা চলার পর মগুরা পৌঁছে মধ্যাহ্নভোজনের বিরতি। বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম অন্নগ্রহণ করলাম।

travelogue
Bangladesh

ভায়ানা মোড়ে পৌঁছে তেল ভরে বাস ছুটে চলল ঢাকার দিকে। গড়াইনদী অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে আমরা প্রবেশ করলাম ফরিদপুর জেলায়। বাবা-মামা-দাদু-মাসি, প্রত্যেকের কাছে শোনা বাংলাদেশের সব কাহিনি মনে পড়ে যায়। এই সেই ফরিদপুর! একটা চৌমাথা থেকে ডানদিকে ঘুরে সোজা বাস ছুটে চলল বিপুলা পদ্মার দিকে। গোয়ালন্দকে অতিক্রম করে পৌঁছে গেলাম দৌলতদিয়া ঘাটে। গোয়ালন্দ পৌঁছে মনে পড়ে গেল, বাংলা বিভাজনের সময় সবাই যখন বাংলাদেশ ছেড়ে পালাচ্ছিল তখন এই গোয়ালন্দ হয়েই সিংহভাগ লোক পাড়ি দিয়েছিল অন্য বাংলায়, বহু প্রাণহানিও হয়েছিল। ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায় যেন চোখের সামনে খুলে যায় একটু একটু করে। পৌঁছে যাই দৌলতদিয়া ঘাট। সামনে দিগন্তবিস্তৃত পদ্মা। বাস বার্জে উঠে গেল। বিরাট বড়ো বার্জ। পদ্মা অতিক্রম করে বার্জ যখন অপর পাড়ে মানিকগঞ্জ জেলার পাটুরিয়া ঘাটে পৌঁছোল, ঘড়ির কাঁটায় তখন ঠিক চারটে বাজে। পদ্মার বুকে ভাসতে ভাসতে শুনলাম পদ্মা নাকি আগে অনেক বেশি চওড়া ছিল। অতিক্রম করতে সময় লাগত প্রায় ঘণ্টা খানেক, এখন আধঘণ্টার মতো লাগে। গভীরতাও অনেক কমে গেছে।

travel
Bangladesh

ঢাকার কমলাপুরের আন্তর্জাতিক বাস টার্মিনাসে সৌহার্দ্য যখন আমাদের নামিয়ে দিল, বাংলাদেশে ঘড়িতে তখন সময় দেখাচ্ছে সন্ধ্যা ৭টা। পৌঁছে গেলাম সোনার বাংলার রাজধানীতে।

ঘুরে ফিরে ঢাকা

ঢাকা শহরের সর্বত্র ইতিহাসের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। তবে একটা কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, রিকশা হল ঢাকা শহরের প্রাণ-ভোমরা। এই শহরের বিখ্যাত স্থানগুলি ঘুরে দেখতে কমবেশি ৩ দিন সময় লাগবে। শহরটির পরতে পরতে ইতিহাস ছুঁয়ে রয়েছে।

ধানমণ্ডি বঙ্গবন্ধু জাদুঘর

ঢাকা শহরের সবচাইতে বিখ্যাত স্থান হল ধানমণ্ডি। কারণ ধানমণ্ডিতেই ছিল বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের নিবাস। বর্তমানে সেই নিবাসটিকে জাদুঘর করা হয়েছে। এতে রয়েছে মুজিবসাহেবের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ও ছবির প্রদর্শনী। যেখানে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়েছিল অর্থাৎ সিঁড়ির উপর, সেখানে রয়ে গেছে রক্তের দাগ, যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু-সহ ১৭ জনকে, তা নৃশংসতার ইতিহাসে নৃশংসতম। চেষ্টা করা হয়েছে সবকিছুই অবিকৃত রাখার। মন কেমন ভারাক্রান্ত হয়ে যায় এখানে এলে, চাণক্যের কথাই সত্য মনে হয় যে, মানুষ সাপের চাইতেও নিষ্ঠুর। বঙ্গবন্ধু জাদুঘর প্রতি বুধবার বন্ধ থাকে এবং নামমাত্র প্রবেশ মূল্য দিতে হয়।

আহসান মঞ্জিল

সদরঘাটে বুড়িগঙ্গানদীর তীরে গোলাপি রঙের অপূর্ব এই প্রাসাদটি অবস্থিত। এটিও বহু ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। পূর্বে আহসান মঞ্জিলের নাম ছিল কুমারটুলি মহল্লা। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খাজা আলিমুল্লাহ। বর্তমানে এটি একটি সংগ্রহশালা তথা যাদুঘর হিসাবে পরিণত হয়েছে। এতে ৩১টি ঘর ও ২৩টি গ্যালারি রয়েছে, রাখা রয়েছে প্রচুর ঐতিহাসিক চিত্রকলা, আসবাবপত্র, নবাবদের ব্যবহার করা বাসনপত্র ইত্যাদি। ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনাবলী লিখে রাখা হয়েছে দেয়ালে। এখানে এসেই জানতে পারি ঢাকায় প্রথম পানীয় জলের সরবরাহ ব্যবস্থা চালু হয় ১৮৭৪ সালে নবাব আব্দুল গনির অনুদানে এবং প্রথম বিদ্যুৎ আসে ১৯০১ সালের ৭ ডিসেম্বর। আহসান মঞ্জিলকে সবাই নবাব সলিমুল্লাহের প্রাসাদ নামেই চেনে। হাতির একটি কঙ্কাল আছে ভিতরে, অ-সা-ধা-র-ণ!

সদরঘাট

ঢাকা শহরের ফুসফুস এই সদরঘাট। বুড়িগঙ্গানদী বয়ে গেছে এখান থেকে। সদরঘাট থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন দিকে বড়ো বড়ো স্টিমার ছাড়ে। স্টিমার যায় বরিশাল, খুলনা, বাগেরহাট, চাঁদপুর, সুন্দরবন, পটুয়াখালি, বগা, গলাচিপা, খেপুপাড়া আরও নানা দিকে। ছোটো ছোটো নৌকা তীরবেগে অতিক্রম করে বুড়িগঙ্গা। সদরঘাটের ব্যস্ততা দিনের ২৪ ঘণ্টাই বজায় থাকে। মালবাহী স্টিমারে ফল, সবজি প্রভৃতি আসে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরটি সম্পূর্ণ ঘুরে দেখতেই একদিন লেগে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই রয়েছে জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলামের সমাধি। ঠিক তার বিপরীতে ঐতিহাসিক রেড ক্রস উদ্যান। মুজিবর রহমান এবং ইন্দিরা গান্ধির এখানেই প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল

বাংলাদেশে। দেখে নিতে পারেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত নানা স্তম্ভ এবং ভাষা শহিদ স্মৃতিস্মারক। নজরুলের সমাধিস্থল থেকে সামান্য এগিয়ে জাতীয় গ্রন্থাগার।

ঢাকেশ্বরী কালীবাড়ি

ঢাকা শহরের সর্বশ্রেষ্ঠ দর্শনীয় স্থান পবিত্র ঢাকেশ্বরী কালীবাড়ি। বাংলাদেশের জাতীয় মন্দির হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে ঢাকেশ্বরী কালীবাড়ি। সকাল ৭টায় মন্দির খোলে, অন্নভোগ হয় বেলা ১টায়। শুক্রবার সন্তোষী পূজা হয় সকাল ১০ টায়, আরতি প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭ টায় এবং রবিবার হরিসেবা হয় বিকেল থেকে রাত ৯টা অবধি। শনি পূজা হয় সন্ধ্যা ছ’টায়। মন্দির চত্বরটি ভীষণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। মন পবিত্র হয়ে যায়। একদিকে রয়েছে বলি দেওয়ার স্থান। শনি ও মঙ্গলবার বেশ ভিড় হয় মন্দিরে। মূল ঢাকেশ্বরী মায়ের মূর্তি কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছে শুনলাম। পাশেই রয়েছে শিবমন্দির। শান্তিতে পূজা দেওয়া যায়।

শাঁখারি বাজার

ঢাকায় হিন্দুদের অবস্থান সবথেকে বেশি এই শাঁখারি বাজার এলাকায়। অসংখ্য শাঁখার দোকান। সবগুলিই জমজমাট। সরু একটি গলি, সবসময় কর্মমুখর, পাশেই রয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং পোগোস স্কুল। এখানে পড়াশোনা করেছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। এখানেই কৈলাস ঘোষ লেনে বাঙালিদের অবস্থান চোখে পড়ার মতো, এর গায়েই জজ কোর্ট।

ঢাকা থেকে দূরে বারদি

বারদি লোকনাথ বাবার মৃত্যুস্থান। নারায়ণগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। ঢাকার সায়দাবাদ থেকে বাস ছেড়ে সরাসরি বারদি যায় ঘণ্টা দেড়েক সময় নিয়ে। লোকনাথ বাবার জন্মস্থান পশ্চিমবঙ্গের কচুয়া এবং তাঁর সমাধিমন্দির এই বারদিতে। রয়েছে রাজভোগ, অন্নভোগের ব্যবস্থা। বেলা ১১টা থেকে অন্নভোগ বিতরণ করা হয়। থাকবার জন্য রয়েছে গিনোরিয়াদেবী যাত্রী নিবাস।

এরপর চলে যাওয়া মেঘনানদী দেখতে, গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ ধরে। মেঘনায় চড়া পড়ে আর কিছু নেই, কিন্তু বর্ষাকালে এই নদী ভয়ংকর। পিছিয়ে এসে দেখে নিলাম জ্যোতি বসুর বাড়ি তথা জন্মস্থান। এখন আর বসু পরিবারের কেউ থাকে না।

যমুনা সেতু

বাংলাদেশিদের সবচাইতে গর্বের সেতু হল যমুনা সেতু, যে-সেতু টাঙ্গাইল জেলার সঙ্গে সিরাজগঞ্জ জেলার যোগসূত্র ঘটিয়েছে। তবে যমুনা বহুমুখী, দেখতে হলে ট্রেনে করে যেতে হবে, বাসে গেলে কোনও মজাই নেই। আমরা দিনে দিনে ঘুরে, ফিরে এসেছি। ঢাকা থেকে যমুনা সেতুর দূরত্ব ১১৯ কিমি। সেতু ৪.৮  কিমি চওড়া। সেতুর এপারে টাঙ্গাইল জেলার সায়দাবাদ স্টেশন এবং ওপারে সদানন্দপুর। সিরাজগঞ্জ জেলায় গ্রাম্য পরিবেশে, অসাধারাণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে সাময়িক বিরতি। আমরা ৫ কিমি দূরের স্টেশন জামতৈল গেলাম ফিরতি ট্রেন ধরতে। ঢাকা থেকে সকাল ৯টায় ছেড়ে যাওয়া দিনাজপুরগামী একতা এক্সপ্রেস ধরে সদানন্দপুর বা জামতৈল পৌঁছে দুপুরের দিনাজপুর-ঢাকা দ্রুতযান এক্সপ্রেস ধরে সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসা যায় ঢাকায়। তবে দ্রুতযান এক্সপ্রেস সদানন্দপুর থামে না। জামতৈল থেকেই ধরতে হবে।

কেনাকাটি

সংগ্রহ করতে পারেন ঢাকাই জামদানি, টাঙ্গাইলের গামছা, লুঙ্গি। তবে পদ্মার ইলিশ নিয়ে কিন্তু সীমান্ত অতিক্রম করতে পারবেন না। ওখানে যত খুশি ইলিশ ক্রয় করুন এবং রসনার তৃপ্তি করুন।

কীভাবে যাবেন

ঝামেলা এড়াতে যেতে হলে চলুন কলকাতা-ঢাকা বাস সার্ভিসের মাধ্যমে। সোম-বুধ-শুক্র ছাড়ে পশ্চিমবঙ্গ ভূতল পরিবহণ নিগমের বাস এবং মঙ্গল-বৃহস্পতি-শনি ছাড়ে

বাংলাদেশ সরকারের বাস। আসা-যাওয়ার ভাড়া দিয়ে টিকিট কাটতে হবে। ভারতীয় মুদ্রায় ভাড়া ১৬২৫ টাকা। ব্রেকফাস্ট দেওয়া হবে বাসে। তবে নিজের স্ব-খরচায় মধ্যাহ্নভোজন করতে হবে মাগুরায়। ভারতীয় সীমান্ত পেট্রাপোল ও বাংলাদেশের সীমান্ত বেনাপোল। মাঝে ‘নো ম্যান’স ল্যান্ড’। তবে মনে রাখবেন, যে-দেশের বাসে যাবেন, সেই দেশের বাস ধরেই ফিরতে হবে।

কোথায় থাকবেন

ঢাকা শহরে থাকবার জায়গার অভাব নেই। বিশদ বিবরণের জন্য যোগাযোগ করতে পারেনঃ

বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন, ন্যাশনাল টুরিজম অর্গানাইজেশন

২৩৩, এয়ারপোর্ট রোড, ঢাকাঃ ১২১৫

ফোনঃ৮১৭৮৫৫-৯, ৮১৯১৯২

কীভাবে বেড়াবেন

ঢাকা শহর ঘুরে নিতে পারেন রিকশা বা লোকাল বাসে করে অথবা গাড়ি ভাড়া করে।

বাংলাদেশের বাস সার্ভিস খুব ভালো। যমুনা ব্রিজ দেখতে হলে ট্রেন ধরুন কমলাপুর স্টেশন থেকে। কনডাক্টেড টুরে যেতে হলে খোঁজ নেবেন সংস্থাটি টুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের সদস্য কিনা।

কলকাতা-ঢাকা বাসের ব্যাপারে খোঁজ নিন ০৩৩-২৩৫৯৮৪৪৮ নম্বরে।

দূরত্ব (কিমি-তে)

ঢাকা থেকে যশোহর-২৭৩, বরিশাল-২৭৭, ফরিদপুর-১৭৫, মানিকগঞ্জ-৬৮, আরিচা ঘাট-১০০, নারায়ণগঞ্জ-১৭, রাজশাহি-২৭২, চট্টগ্রাম-২৬৪, কক্সবাজার-৪১৫, সিলেট-২৭৮, খুলনা-৩৩৫, ময়মনসিংহ-১২৩, বগুড়া-২২৮, দিনাজপুর-৪১৪, কুমিল্লা-৯৭, নোয়াখালি-১৯১।

মনে রাখবেন

বাংলাদেশের সময় ভারতীয় সময় থেকে ৩০ মিনিট এগিয়ে।

ডলার নিয়ে গেলে সোনালি ব্যাংক থেকে ভাঙাবেন।

ইতিহাসের খণ্ডচিত্র বিজাপুর ও বাদামি

বেঙ্গালুরু থেকে খুব দূরে নয়। তাই চড়ে বসেছি গোলগাম্বাজ এক্সপ্রেসে। ১৫ ঘন্টার সফরের পর পৌঁছে গেলাম বিজাপুর। ইতিহাস মাখা শহরের সর্বত্র দেখার মতো একাধিক রাজকীয় সৌধ। এ যেন ইতিহাসের হাত ধরে পথ হাঁটা।

travel
Bijapur and Badami

বিজাপুর বা বিজয়পুর একসময় ছিল চালুক্যদের দখলে। পরে তা রাষ্ট্রকূট, হয়সল ও যাদবদের অধীনে যায়। পরবর্তী সময়ে মোঘলরা তাদের আধিপত্য বিস্তার করে। যুগের পরিবর্তনে নানা সৌধ তৈরি হয়েছে বিজাপুরে। সেই দেখতেই আসা।

প্রথমেই বেরিয়ে পড়ি গোলগাম্বাজ দেখতে। আদিল শাহ’র সমাধিক্ষেত্র হিসাবে পরিচিত এই সৌধ। একটি মিউজিয়াম ও সৌধটি দেখার জন্য গেটে টিকিট কেটে ঢুকে পড়া গেল। এই বিশাল টুম্বটির গোলাকার ছাদে পদ্মের বিন্যাস। চারপাশে সাতমহলা মিনার। উপরের গোলাকার ছাদ থেকে গোটা বিজাপুর শহর পাখির চোখে দেখা যায়।

travel
Bijapur o Badami

পরের গন্তব্য ইব্রাহিম রৌজা। অনেকটা তাজমহলের আদলে তৈরি জোড়া সৌধ, মধ্যে ফোয়ারা। দেয়ালজোড়া পারসি লিপি। সেই পরিচিত পদ্মের কারুকাজ ও মিনার ঘেরা স্থাপত্যশৈলী।

দেখার জিনিস আরও আছে বিজাপুরে। তার মধ্যে উপলি বুর্জ একটি ৮০ ফিট উচ্চতার টাওয়ার ১৫৮৪-তে নির্মিত, ৭০টি সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠা যায়। এর অদূরেই ঐতিহাসিক কামান মালিক-এ-ময়দান। ১৪.৬ ফিট লম্বা, ৪.৯ ফিট চওড়া এবং ৫৫ টন ওজন এটির।

Travelogue
Bijapur and Badami

বড়া কামান নামের একটি হলও আছে ৭টি আর্চ যুক্ত যেখানে আলিরেজা ও তাঁর পরিবারের ১১ জন স্ত্রীলোক কবরে শায়িত। দেখলাম জুমা মসজিদ। টাঙায় চড়ে চললাম দেখতে। আদিল শাহ বিজয় নগর অধিকার করার পর নির্মিত। কিন্তু আদিল শাহ হাম্পির বহু ক্ষয়ক্ষতি করেছিলেন যেটি সমর্থনযোগ্য নয়। জুমা মসজিদের স্বর্ণালি চূড়া এখনও তাঁর বীরকীর্তির সাক্ষ্য বহন করে। এরপর গেলাম জোড়া গম্বুজ দেখতে। এটি এখন দরগায় রূপান্তরিত। নবাবি বিরিয়ানি দিয়ে দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে ফিরে আসি হোটেলে। পরদিন আমাদের বাদামি যাওয়ার প্রস্তুতি।

পরদিন একটা গাড়ি ভাড়া করে শুরু হল বেড়ানো। বাদামি-বনশংকরি-আইহোল-পাট্টাডাকাল ও মহাকূট বাদামি এই হল আমাদের গন্তব্য। চালুক্যদের রাজপাট আইহোল থেকে বাদামি হয়ে পাট্টাডাকাল-স্ল স্থানান্তরিত হয়। ফলে ইতিহাসের নানা সাক্ষ্য বহন করে আছে জায়গাগুলি। এই জায়গাগুলির একটি বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথম রেখনাগরি শৈলীতে এখানকার মন্দিরগুলি নির্মিত হয় যেটি প্রচ্ছন্নভাবে দক্ষিণ ও উত্তর ভারতের স্থাপত্য শৈলীর ফিউশন।

এই গোটা ভ্রমণ-সার্কিটে অবশ্যই মন কেড়ে নেবে বাদামি কেভস, বাদামি ফোর্ট ও অগস্ত লেক। বাদামি এখন মূলত ধ্বংসপ্রায়। গুহাচত্বরে ঢুকেই চোখে পড়ে বিশাল জলাধার, অগস্তহ্রদ। এই হ্রদকে ঘিরেই বাদামি গুহা, লাল পাথরের পাহাড় ও ভূতনাথ কমপ্লেক্স। পাথরের উপর অনবদ্য সব শিল্পকর্ম দেখতে দেখতে সময়টা কোথা দিয়ে যেন কেটে যায়। মন্দির শিল্পে এক অনন্য নিদর্শন বাদামি। একটি আস্ত পাথরে বিষ্ণু, গণেশ, বরাহ অবতার, নৃসিংহ অবতার। শিবলিঙ্গ এবং নন্দী মূর্তি– ভেবে অবাক হতে হয় শিল্পীদের দক্ষতা।

অদূরেই পাহাড়ের মাথায় বাদামি দুর্গ। উপর থেকে গোটা বাদামি শহরটা দেখা যায়। মন্দির, ছোটো ছোটো বাড়ি– সব মিলিয়ে এ যেন এক ঐতিহাসিক খণ্ডচিত্র। যারা ইতিহাস ভালোবাসেন এই জায়গাগুলোয় না এলে সত্যিই মিস করবেন!

অপরূপ অরুণাচল

নেফা, অরুণাচল প্রদেশের আগের নাম। জায়গাটা কতটা সুন্দর, কতটা স্বপ্নিল, সেটা না গেলে বুঝতেই পারবেন না।

গুয়াহাটি পৌঁছে সেই রাতেই উঠে পড়ুন বাসে। গন্তব্য তেজপুর। রাতশেষে তেজপুর পৌঁছোবেন। এখানে নেমে একবার বাস পালটাতে হবে। এবার ধরবেন ভালুকপঙের বাস। আগে চা-জলখাবার খেয়ে নিন। তারপরই বাস ছুটবে ভালুকপঙের উদ্দেশে। বালিপাড়া ছাড়ানোর পরই, বাসের তীব্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটবে দু’ধারের ঘন জঙ্গল। তেজপুর থেকে ৫৬ কিমি পথ। ঘণ্টা-দেড়েকের মধ্যেই পৌঁছোবেন ভালুকপঙ। এখানে রয়েছে দারুণ সুন্দর টুরিস্ট বাংলো। পাশেই ঢাল নেমেছে কামেংনদীর বুকে। ভালুকপঙ-ই অরুণাচলে ঢোকার প্রবেশপথ। সকালে ভালুকপঙ ঘুরে দেখুন।

দুপুরে খাওয়ার পর বাংলোর পাশের ঢাল বেয়ে নীচে নেমে যেতে পারেন নদীর তীরে। নদীর ওপারে ঘন জঙ্গল। অরুণাচলের জঙ্গল বিরাট ও বিচিত্র। প্রচুর পাখি ও বন্যপ্রাণী ঘুরে বেড়ায় এখানে। এখানে ভালো বেত চাষ হয়। বেতের তৈরি জিনিসপত্রের দোকানও পাবেন বেশ কিছু। দর করলে অন্য জায়গার তুলনায় সস্তাতেই পাবেন।

পশ্চিম কামেং ও তাওয়াং জেলা অরুণাচল প্রদেশের সবচেয়ে প্রচলিত রুট। ভালুকপঙ চেকপোস্ট রয়েছে অরুণাচল প্রদেশে প্রবেশের জন্য। চেকপোস্টের ঝামেলা কাটিয়ে আপনার বাস রওনা দেবে ১০০  কিমি দূরে বমডিলার উদ্দেশে। এখান থেকে টিপির অর্কিড রিসার্চ সেন্টার ৫ কিমি পথ। প্রায় ৩০০ প্রজাতির অর্কিড দেখবেন এখানে। এখান থেকে ২৪ কিমি পর পড়বে শেসা স্যাংচুয়ারি। শেসার প্রাকৃতিক দৃশ্য মনোরম ও উপভোগ্য।

এরপর ফের চলুন সবুজের বুক চিরে। ডানপাশে নিত্যসঙ্গী কামেংনদী। টেঙ্গা, রূপা পেরিয়ে বেশ ঘন রাতে পৌঁছোবেন বমডিলায়। ৮৫০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত বমডিলা, পশ্চিম কামেং জেলার সদর। সকালে সূর্যোদয়ের পর দেখবেন পাহাড়ের ঢালে সাজানো অতি সুন্দর ও মনোরম এই বমডিলা শহরটিকে। এবার ঝটপট দেখে নিন আপার মনাস্ট্রি। তারপর বাসে চেপে বসুন।

যাওয়া যাক ১৮৩ কিমি দূরে তাওয়াং-এর দিকে। পথে পড়বে তুষারশৃঙ্গ কাটোং ও গোরিচেন। যতক্ষণ দেখা যাবে এদুটি, ততক্ষণ আর কোনওদিকে চোখ ফেরাতে পারবেন না আপনি। বমডিলা থেকে অনেকটা নেমে ৪২ কিমি দূরে দিরাং। ৫০০০ ফুট উঁচুতে থাকা পাহাড়ি শহর, পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে দিরাংনদী। এখানে সাড়ম্বরে বুদ্ধ মহোৎসবও পালিত হয়।

দিরাং থেকে পথ উঁচুতে ওঠে তাওয়াং-এর দিকে। মাঝে সেলা পাস পেরিয়ে যেতে হবে তাওয়াং-এ। এখানে আপনার বাস ধীরে ধীরে আরও উপরে উঠবে। হঠাৎই চোখে পড়বে রাস্তার ধারে বরফ। হাড়কাঁপানো শ্বেত নিস্তব্ধতা গ্রাস করতে আসবে। পথে যেতে যেতে দেখেতে পাবেন প্রচুর বাংকার। এখন পরিত্যক্ত। সেলা পাসে পৌঁছোবেন প্রায় বেলা তিনটের সময়ে। দেখবেন একটা বিশাল গেট, তাতে তাওয়াং জেলা অভ্যর্থনা জানাচ্ছে আপনার শুভাগমনকে।

১৩৭০০ ফুট উঁচুতে কুয়াশা ও মেঘের স্তর ভেদ করে যেন স্বপ্নরাজ্যের প্রবেশপথ এটি। নেমে পড়ুন বরফের গালিচায়। হঠাৎ দেখবেন, মেঘ কুয়াশা সরে গিয়ে সূর্য যেন আকাশটার মেজাজ পালটে দেবে। মেতে উঠুন বরফ নিয়ে খেলায়। চারদিকে দেখতে পাবেন রুক্ষ পাহাড়, তাতে কিন্তু বরফের চিহ্নও নেই। রোদ পড়ে সেগুলোকে সোনার মতো চকচক করতে দেখবেন। সেলা পাস, সেলা টপ, নোরা টপ পেরিয়ে বরফ-রাজ্যের ভিতর দিয়েই আপনার বাস যাবে জং-এর দিকে।

Travelogue
Beautiful location of Arunachal

আন্দাজ সন্ধে সাতটা নাগাদ, জং পেরিয়ে পৌঁছোবেন তাওয়াং-এর টুরিস্ট বাংলোর সামনে। সময়টা নতুন বছরের শুরুতে হলে, এখানে দেখতে পাবেন ন্যওকুম ইয়ল্লো উৎসব। সূর্য ও চাঁদের উপাসক নিশি প্রজাতিরা প্রধানত অরুণাচলের জিরো পাহাড়ে বাস করে। কিন্তু তাওয়াং-এর কমিশনার এই প্রজাতিরই একজন বলে, এখানেও এই ন্যওকুম ইয়ল্লো ধুমধাম করে পালিত হয়।

এবার চলুন তাওয়াং দেখতে। যেমন ট্র্যাডিশনাল আর্ট সেন্টার, তাওয়াং এম্পোরিয়াম, ওয়ার মেমোরিয়াল ও তাওয়াং মনাস্ট্রি। বড়ে গুম্ফা থেকে চলে আসুন তাওয়াং এম্পোরিয়ামে। ভিতরে বিশাল হলঘর। সেই হলটি অরুণাচলের বিভিন্ন জেলার নামে ভাগ করা। সুবনসিরি, দিরাং, কামেং, সিয়াং, সুন্দর নাম জেলাগুলির। এইসব ভাগগুলিতে নির্দিষ্ট জেলার কাপড় ও অন্যান্য হস্তশিল্পের জিনিস বিক্রি হচ্ছে।

পরদিন ব্রেকফাস্ট সেরে উঠে পড়ুন গাড়িতে সাইট-সিইংয়ে। তাওয়াং ছাড়িয়ে ৫ কিমি এগিয়েই চেকপোস্ট। সেখান থেকে দুটো রাস্তা। একটা অ্যান্নি গুম্ফা ও থুকজে চুয়েলিং নানারির দিকে চলে গেছে। অন্যটি গেছে বুম-লা অর্থাৎ চিন সীমান্তের দিকে। মাত্র ৩৭ কিমি দূরে বুম-লা অ্যাকসিস। চেকপোস্টের মিলিটারিদের সঙ্গে একরকম জোরাজুরি করেই অনুমতি আদায় করতে হবে। তারপর চলুন অ্যান্নি গুম্ফার পথে। একটু চলার পরই বরফঢাকা রাস্তায় এসে পড়বেন। হাঁটু ডুবে যাওয়া বরফ থাকলে অবশ্য অ্যান্নি গুম্ফায় পৌঁছোনো যাবে না। এরপরে থুকজে চুয়েলিং নানারি ছোট্ট সুসজ্জিত নানারি। অবিন্যস্ত সংকীর্ণ বরফঢাকা পথ বেয়ে মঠ দেখে আসুন। বাসে এবার চেকপোস্টের কাছে ফিরে এসে চিন সীমান্তগামী পথটা ধরুন।

এ পথেই আছে দুটো লেক PTSO ও YJNI। মিনিট পাঁচেক এগলেই বরফ রাজ্য অনেক বেড়ে যাবে। আরও উঁচুতে আর একটা চেকপোস্ট আছে। এই চেকপোস্ট মারাঠি গ্রাউন্ড নামেই পরিচিত। উচ্চতা ১২,৪০০ ফুট। এখান থেকে PTSO মাত্র ৫ কিমি দূরে কিন্তু খাড়া চড়াই রাস্তা। বাসের গতি হবে শ্লথ। ক্রমশ আরও গভীর বরফের রাজ্য। মাইলস্টোনেরবোর্ড দেখে বুঝতে পারবেন ত্নথ্বত্রত্থ পৌঁছে গেছেন। বাস থেকে নেমে একটু ঘুরে নিন চারপাশে।  আকাশ পরিষ্কার থাকলে দারুণ পরিবেশ। এই গহন বরফের মধ্যে পাবেন এক অদ্ভুত সৌন্দর্য।

কীভাবে যাবেনঃ  সরাইঘাট এক্সপ্রেসে চলুন গুয়াহাটিতে। এবার কেবল বাস যাত্রা। প্রথম গন্তব্য তেজপুর তার ক্রমে ভালুক পং, বমডিলা, তাওয়াং, তাওয়াং চেকপোস্ট, অ্যানি গুম্ফা, বুম-লা অ্যাকসিস, লেক PTSO ও YJNI ।

যাওয়ার সময়ঃ বরফ পেতে চাইলে বছরের গোড়ার দিকে যাওয়াই ভালো। আর এপ্রিল-মে মাসে গেলে রডোডেনড্রন আপনাকে স্বাগত জানাবে।

বিশদে জানতেঃ যোগাযোগ করুন অরুণাচল ভবন, ব্লক-সিই ১০৯, সেক্টর-১, সল্টলেক, কলকাতা – ৯১, দূরভাষঃ ২৩৩৪ ১২৪৩, ২৩২১ ৩৭২৭।

সিকিম

ঝিরঝিরে বৃষ্টি ঝাপটা মারছে জিপের উইনডস্ক্রিনে। যতদূর চোখ যায় শুধুই দেবদারু আর পাইনে ছাওয়া পথ, আর খাড়াই পাহাড়। কলকাতা থেকে কাঞ্চনকন্যায় শিলিগুড়ি নেমে, এসএনটি বাসস্ট্যান্ড থেকে সওয়ার হোন জিপে। সেবক রোডের মসৃণ পথ পেরিয়ে মহানন্দার জঙ্গলের সবুজ শ্যামলিমা গায়ে মেখে পৌঁছে যাবেন সিকিমের প্রবেশদ্বার রংপোতে। পথে আর থামা নেই, সোজা জোড়থাং। পাহাড় ঘেরা ছোট্ট জনপদ। গরম মোমো দিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে এগিয়ে চলুন গেজিং-এর দিকে। পথের মাইল স্টোন জানিয়ে দেবে আপনার গন্তব্য পেলিং, খুব দূরে নয়।

কাঞ্চনজঙঘার মাথায় যদি সোনার মুকুট দেখতে চান, তবে পেলিং -এর চেয়ে আদর্শ জায়গা আর হতে পারে না। হোটেলের জানলা খুললেই যেন কাঞ্চনজঙঘা হুড়মুড় করে ঢুকে পড়বে আপনার ঘরে। তাই পরের দিনের সূর্যোদয় দেখুন হেলিপ্যাড গ্রাউন্ড -এ। আর সারাদিনটা রাখুন অপূর্ব কিছু লোকেশন দেখে নিতে।

আপনার প্রথম গন্তব্য হোক খেচিপেরি হ্রদ। পবিত্র হ্রদ, হয়তো সেইজন্যই পাখিরাও সদা সতর্ক, একটি পাতাও ফেলে না হ্রদের জলে। হ্রদের কোলে বিশাল পাহাড় যার ওপারে চিন। খেচিপেরি গুম্ফা ও লেক দেখে চলুন কাঞ্চনজঙঘা জলপ্রপাত দেখতে। সর্পিল পথ পেরোনোর সময় একটু যেন ভয় ভয় করে। রোমাঞ্চকর এই অনুভূতি নিয়েই হঠাৎই এসে পড়বেন এক পাগলা ঝোরার সামনে, যার নাম কাঞ্চনজঙঘা জলপ্রপাত। জলকণায় সাতরঙা রামধনুর খেলা আর নীচ দিয়ে বয়ে চলা অবাধ্য রিম্বিনদী।

আপনার দ্বিতীয় দিনের যাত্রা হোক পেমিয়াংশির উদ্দেশে। সাতহাজার ফুট উচ্চতার এক মনেস্ট্রি। তিব্বতীয় দেবদেবী আর অপূর্ব কাঠের প্যানেলগুলি দেখে এক আশ্চর্য প্রশান্তি নিয়ে চলে আসুন এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্রিজ ‘সিনসোর’ দেখতে। সরু সুতোয় ঝুলতে থাকা ব্রিজটি দেখে বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই পাড়ি দিন পাহাড়ের বাঁকে অবস্থিত সিকিমিজ গ্রাম ডেনথাম-এ।

পরদিন পায়ে পায়ে বেড়িয়ে নিন সাঙ্কাডেলিং মনেস্ট্রি। এটির ভিতরের অলংকরণ ও পদ্মসম্ভবের মূর্তি দীর্ঘদিন মনে থাকবে। এবার একটা ছোট্ট ট্রেক রাবডান্টসে -এর উদ্দেশে। সিকিমের প্রাচীন রাজপ্রাসাদের ধবংসাবশেষ। কাঞ্চনজঙঘার কোলে এই উচ্চতম স্থান থেকে পাখির চোখে দেখে নিন সিকিমের একটা বড়ো অংশ।

ধবংসাবশেষ দেখতে একটা অদ্ভুত শিহরণ হয়, রাজপাট গেছে, শুধু স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে রাজার পাথুরে সিংহাসন।

এ যাত্রায় সিকিমের সফর অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি নিরিবিলি ছোট্ট পাহাড়ি জনপদ রাবাংলা না ঘুরে নেন। পেলিং থেকেই জিপে সওয়ার হয়ে চলে আসুন রাবাংলায়। টেমি চা-বাগানের ঢাল বেয়ে নেমে যাওয়া হরিয়ালি, দূরে সবুজ পাহাড়ের সারি অচিরেই মন কেড়ে নেবে। আর আছে হাতের কাছেই বুদ্ধ পার্ক। মনকাড়া পরিবেশ।

পায়ে জোর থাকলে আর বুক ভরা সাহস থাকলে, ট্রেক করে আসতে পারেন মৈনামের জঙ্গুলে পথ বেয়ে। বন্য জন্তু আর অচেনা গাছে ভরা পথের এই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, সারাজীবনের সঞ্চয় হয়ে থাকবে।

কীভাবে যাবেন – শিয়ালদহ থেকে দার্জিলিং মেল, তিস্তা তোর্সা, উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস, কাঞ্চনকন্যা বা হাওড়া থেকে কামরূপ কিংবা সরাইঘাট এক্সপ্রেসে নিউ জলপাইগুড়ি। সেখান থেকে রিকশায় শিলিগুড়ি। সিকিমের বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস বা জিপে সরাসরি পেলিং যেতে পারেন, অথবা নামচি হয়ে পাড়ি দিতে পারেন রাবাংলার উদ্দেশে।

কখন যাবেন – বর্ষাকাল বাদ দিয়ে যে-কোনও সময় যাওয়া যায় সিকিম। তবে এপ্রিলে গেলে রোডোডেনড্রন বা গুরাসের শোভা আপনাকে মুগ্ধ করবে।

 

রাজমহল

ফারাক্বা থেকে গাড়ি লেফ্ট টার্ন নিতেই রাস্তার চরিত্র বদলে গেল। পরিষ্কার আকাশ, ঝকঝকে আবহাওয়া, চোখ ধাঁধানো রোদ। মে মাসের শেষ সপ্তাহ। গরমে শরীর চিড়বিড় করছে। তারপর দুর্বিষহ জার্নি। এনটিপিসি পার করতে আরও খারাপ হাল রাস্তার। কোনও কালে পিচ পড়লেও এখন চিহ্নমাত্র নেই। রুক্ষ মাঠের মতো মেটে রঙের রাস্তায় এখানে সেখানে বড়ো বড়ো গর্ত। সন্তর্পণে গর্ত বাঁচিয়ে গতিবেগ কুড়ির উপর উঠছে না। সাত কিলোমিটার এভাবে হোঁচট খেতে খেতে এগোনোর পর ‘ওয়েলকাম টু ঝাড়খণ্ড’ লেখা বোর্ড। গ্রামের নাম পূরণচাঁদিপুর। ছোটো একটা কালভার্ট। বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমান্ত।

কালভার্ট পেরোতেই ভোজবাজির মতো বদলে গেল রাস্তার চরিত্র। পিচঢালা মসৃণ এন এইচ ৮০। বদলে গেল চারপাশের পরিবেশ। সবুজ গাছপালা, লাল মোরাম বিছানো রাস্তা, ছোটো ছোটো গ্রাম– পরবর্তী চব্বিশ কিলোমিটার রাস্তা দেখতে দেখতে পেরিয়ে এলাম। বারহারোয়া সাহেবগঞ্জ জেলার সদর। হাওড়া থেকে দূরত্ব ২৮৫ কিলোমিটার। রেলপথে যোগাযোগ আছে হাওড়া এবং কলকাতার সাথে। যদিও আমরা বেরিয়েছি লং-ড্রাইভে। বন্ধুরা মিলে হইচই করতে করতে। বারহারোয়াকে পেছনে ফেলে আরও ২৭ কিমি অতিক্রম করে রাজমহল পৌঁছোই ন’টা নাগাদ। আমাদের মূল গন্তব্য। রাজমহলকে কেন্দ্র করে দেখে নেব আশেপাশের আরও অনেক জায়গা।

travel
Beautiful location

হোটেলে উঠে স্নান-খাওয়া সেরে ঘণ্টা দুয়েকের বিশ্রাম। কাল সারারাত রাস্তায় কেটেছে। কলকাতা থেকে প্রায় ঘণ্টা সাতেকের রাস্তা। সকলেই কমবেশি ক্লান্ত। বিশেষ করে ড্রাইভার ছেলেটি। ওর নাম ডালটন। বেশ মিশুকে। বিছানায় শরীর এলাতেই চোখের পাতা বুজে এল।

ঘণ্টা দু’য়েকের ভাতঘুম দিয়ে তিনটে নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম। রাজমহল খুব ছোটো শহর। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে দেখে নেওয়া যায় একদা বিহার, বর্তমানে ঝাড়খণ্ড– সাহেবগঞ্জ জেলার গঙ্গা তীরবর্তী ঐতিহাসিক শহর রাজমহল। বহু পুরোনো রাজমহলের ইতিহাস। এক ঝলক সেই ইতিহাসের দিকে না তাকালে রাজমহলকে চিনতে অসুবিধা হবে।

খ্রিস্টের জন্মেরও আগে গ্রিকদূত মেগাস্থিনিস সেলুকাসের বর্ণনাতে রাজমহলের উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে (৬৪৫  খ্রিঃ) চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে তেলিয়াগড়ি ফোর্ট ও রাজমহলের উল্লেখ করেন। তাঁর বর্ণনা থেকেই জানতে পারি কোনও একসময় এখানে বৃহদাকার বৗদ্ধবিহার ছিল। তেরোশো শতাব্দীতে দিল্লিতে তুর্কি শাসনকালে বকতিয়ার খিলজি বাংলা আক্রমণ ও দখল করেন। ১৫৭৬ সালে আক্রমণ করেন মোগলরা। রাজমহলের যুদ্ধে তারা জয়লাভ করলে বাংলায় মোগল শাসনের ভিত্তি স্থাপিত হয়। আকবরের বিশ্বস্ত সেনাপতি মানসিংহকে পাঠানো হয় শাসনভার দিয়ে। রাজমহলে তিনি রাজধানী স্থাপন করেন। যদিও অল্প কিছুদিনের জন্য। পরবর্তীকালে (১৬৫৯ খ্রিঃ) শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র সুজাকে বাংলার শাসক হিসাবে পাঠালে পুনরায় তিনি রাজমহলে রাজধানী স্থাপন করেন এবং শাসনকার্য চালান।

Travelogue
Beautiful location

ইতিহাস প্রসিদ্ধ রাজমহলের সঙ্গে যে-মানুষটার স্মৃতি সবচেয়ে বেশি জড়িয়ে আছে, তিনি অবশ্যই মহম্মদ সুজা। বৈচিত্রে ভরা তার শাসনকাল। ১৬৪২ সালে বাংলার সাথে ওড়িশার শাসনভারও তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়। ১৬৫৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শাহজাহান গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে, জেষ্ঠপুত্র দারাশিকোকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন এবং সাম্রাজ্যের শাসনভার তার উপর ন্যস্ত করেন। প্রসঙ্গত বলে রাখি, মুঘল বংশে জেষ্ঠ পুত্রকে সিংহাসনে বসানোর কোনও বাঁধাধরা নিয়ম ছিল না। স্বাভাবিক ভাবেই সিংহাসনের দখল নিয়ে শাহজাহান-পুত্রদের মধ্যে শুরু হল দ্বন্দ্ব। শেষপর্যন্ত বহু রক্তক্ষয়ের পর সিংহাসনের দখল নিলেন ঔরঙ্গজেব। সুজাকে তিনি বাংলা, বিহার ও ওড়িশার শাসনভার অর্পণ করলেন। সুজা কিন্তু খুশি হলেন না। তাঁরও লক্ষ্য ছিল দিল্লির মসনদ। বেশ কয়েকবার তিনি দিল্লি অভিযান করেছেন এবং মাঝপথে শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়ে রাজমহলে ফিরে এসেছেন, কোনওদিনই দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছোতে পারেননি। এমনকী রাজমহলকেও রক্ষা করতে পারেননি। ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে মীর জুমলা রাজমহল আক্রমণ ও দখল করলে স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে সুজা পালিয়ে যান। এরপরের কাহিনি আরও করুণ। তানডা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম হয়ে একসময় আরকান রাজ্যে উপস্থিত হন এবং সপরিবারে রোসাঙ্গ রাজের আশ্রয়ে থাকেন। সে আশ্রয়ও নিরাপদ হয় না। স্ত্রী-কন্যারা রোসাঙ্গরাজের লোভের শিকার হয়। পরবর্তীকালে সুজা-পত্নী পরীবানু এবং তার কন্যাদের করুণ পরিণতি নিয়ে গড়ে ওঠে পালাগান এবং গীতিকা। সেসময় লোকের মুখে মুখে ফিরত সে কাহিনি–পাইক পহল ভালা থাকে গাছত বাসা বাঁধি।

বাদশার পোলা দেশে দেশে ঘুরে কাঁদি কাঁদি।।

মৈমনসিংহ গীতিকার চতুর্থ খণ্ডের দুটি পালা ‘পরীবানুর হাঁহলা’ এবং ‘সুজা তনয়ার বিলাপ’-এ সুজার সেই করুণ পরিণতির কথাই ধরা পড়েছে।

মোগলযুগের পরেও প্রলম্বিত রাজমহলের ইতিহাস। পলাশির যুদ্ধে পরাজয়ের পর পলাতক নবাব সিরাজদৗল্লা ধরা পড়লে, কিছুকাল এই রাজমহলেই তাঁকে বন্দি করে রাখা হয়। ব্রিটিশ সেনাপতি মেজর অ্যাডাম ও মীরকাশিমের যুদ্ধ হয় এই রাজমহলে, উদয়নালার তীরে। এখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন মীরন।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অনগ্রসর এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা এলাকাগুলোকে নিয়ে পৃথক রাজ্যের দাবিতে আদিবাসীদের আন্দোলন ছিল দীর্ঘদিনের। অবশেষে সেই দাবিকে মান্যতা দিয়ে বিহারকে দ্বিখণ্ডিত করে ২০০০ সালের ১৫ নভেম্বর পৃথক রাজ্য হিসেবে ঝাড়খণ্ডের জন্ম হয়। বর্তমানে রাজমহল ঝাড়খণ্ডের অন্তর্গত।

রাজমহলের দীর্ঘ ইতিহাসের অধিকাংশ স্মৃতি গঙ্গাগর্ভে লীন হয়ে গেলেও কিছু কিছু এখনও টিকে আছে। যাদের মধ্যে অন্যতম মান

সিংহের তৈরি সিংহীদালান। যদিও সিংহীদালানের বেশির ভাগটাই নদীর গর্ভে হারিয়ে গেছে, আছে কেবল মূল ফটকটি। ১৫৮০ সালে তৈরি কালো মর্মরে ত্রিতল সিংহীদালান থেকে গঙ্গার শোভা দর্শন এবং অভ্যাগতদের সমাদর জানাতেন রাজা। এছাড়াও মান সিংহের তৈরি বিশাল শিবমন্দির এবং টিলার টঙে রাধাকৃষ্ণের মন্দিরটি আজও আছে।

রাজমহলের অন্যতম প্রধান দ্রষ্টব্য জুমা মসজিদ। মোগল স্থাপত্যের এটি একটি অন্যতম নিদর্শন। রেল স্টেশন থেকে ৬ কিমি দূরে শাহ সুজা এই মসজিদটি তৈরি করান। এছাড়াও আছে আকবরি মসজিদ, ময়না বিবির সমাধি এবং মীরনের সমাধি।

মীরনের প্রসঙ্গ এলে উদয়নালার কথা আসবেই। এখানেই ইংরেজদের সাথে মীরকাশিমের যুদ্ধ হয়। ইতিহাসে যা উদয়নালার যুদ্ধ হিসাবে পরিচিত। যুদ্ধে মীরকাশিম পরাজিত হন এবং মীরন নিহত হয়। ভারতে ইংরেজ শাসন আরও খানিকটা দৃঢ় হয়। ইতিহাসের সাক্ষী এই উদয়নালার সামনে দাঁড়িয়ে মনটা কেমন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে।

কথিত আছে নীলাচলের পথে শ্রীচৈতন্যদেবও এসেছিলেন রাজমহলে। স্মারক হিসাবে পাথরে তাঁর পায়ের চিহ্ন আজও আছে। কানাই নাটশালার টিলার টঙে বৈষ্ণব মন্দিরে সযত্নে রক্ষিত আছে সেই পাথরখণ্ড।

আজকের মতো রাজমহল দর্শন শেষ করি বিন্দুবাসিনী মন্দির দিয়ে। বারহারোয়া থেকে দু’কিমি দূরে ছোট্ট একটা পাহাড়ের মাথায় এই মন্দির। স্থানীয় মানুষের কাছে অত্যন্ত পবিত্র এবং জাগ্রত। রামনবমী উপলক্ষ্যে বহু ভক্ত সমাগম হয়। মেলা বসে। ন’দিন ধরে চলে উৎসব। বিন্দুবাসিনী পাহাড়ের আর এক আকর্ষণ বিশালাকার বাহুবলী মূর্তি। মন্দিরের অদূরে পাহাড় চূড়ায় পবনপূত্রের অবস্থান। বহুদূর থেকে মূর্তিটি চোখে পড়ে।

রাজমহলকে কেন্দ্র করে আশেপাশে দেখার জায়গা অসংখ্য। আমরা এসেছি উইক এন্ড টুরে, মাত্র দু’দিনের জন্যে। ইচ্ছা থাকলেও সবজায়গা দেখা হবে না। প্রয়োজন ছিল আরও দুটো দিনের। রাতে হোটেলে ফিরে বহু তর্ক-বিতর্কের পর পরবর্তী গন্তব্য ঠিক হল তিন পাহাড় এবং মোতি ঝরনা।

পরদিন সকালে স্নান-খাওয়া সেরে ন’টার মধ্যে বেরিয়ে পড়ি। বারহারোয়া থেকে ২৭ কিমি দূরে তিন পাহাড়। পাহাড়ের পাদদেশে রেল স্টেশন। বেশ ঘিঞ্জি। স্টেশন সংলগ্ন বাজার ছাড়িয়ে যে-কোনও দিকে কিছুটা গেলেই আবার অন্য পরিবেশ। এখানকার জলবায়ু স্বাস্থ্যপ্রদ, হাওয়া বদলের উপযুক্ত। তিন পাহাড়ের চারপাশ জুড়ে অনুচ্চ রাজমহল পাহাড়শ্রেণি। আসা যাওয়ার পথে চোখে পড়ে বেশ কিছু পাথর খাদান। খাদানের শ্রমিক মূলত আদিবাসী নারী-পুরুষ। মহিলার সংখ্যাই বেশি। তিন পাহাড়ের প্রধান আকর্ষণ তার প্রাণবন্ত সবুজ প্রকৃতি। যেন পটে আঁকা ছবি। এছাড়াও আছে রাজবাড়ি বা প্যালেস।

তিন পাহাড় দর্শন শেষ হলে রওনা দিই মহারাজপুরের উদ্দেশ্যে। মহারাজপুর পাহাড়ি গ্রাম। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা। এখান থেকে মোতি ঝরনার দূরত্ব মাত্র চার কিমি। শেষ দু’কিমি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে রাস্তা। মোতি ঝরনার প্রধান আকর্ষণ তার প্রাকৃতিক সৗন্দর্য। জঙ্গলের ভেতরে পাহাড়চূড়া থেকে জল নামছে ক্ষীণ ধারায়। কারণ এটা গ্রীষ্ম। বর্ষায় এই ঝরনারই রূপ বদলে যাবে। অনেকটা জায়গা নিয়ে প্রবল ধারায় জল নামবে। প্রায় এক কিলোমিটার দূর থেকে শোনা যাবে সেই প্রপাতের শব্দ। আজ অবধি এই ঝরনার উৎস খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঝরনার ঠিক নীচেই আছে শিবমন্দির। সেখানে নিত্য পূজার ব্যবস্থা। মন্দিরে আস্তানা গেড়ে আছেন এক সাধুবাবা, তিনিই সব করেন। ঝরনার সামনে বড়ো বড়ো তিনটে জলাধার, কংক্রিটের। তিনটের গভীরতা তিন রকমের। সুবিধামতো একটায় নেমে স্নান করে নেওয়া যায়। স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে এটা একটা জনপ্রিয় পিকনিক স্পট। দূরে পাহাড়ের গায়ে ছোটো ছোটো আদিবাসি গ্রাম। মূলত এই সব গ্রামে মাল পাহাড়িয়া শ্রেণির আদিবাসীদের বসবাস। পুরো রাজমহল পাহাড়েই মাল পাহাড়িয়াদের বসবাস। আদিকাল থেকে এরা এখানে বসবাস করছে। হাতে সময় থাকলে ঘুরে আসা যায় এসব গ্রামের কোনও একটায়।

রাজমহলে আজই আমাদের শেষ দিন। অদেখা রয়ে গেল অনেক কিছু। যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ শিবগাদি। বারহারোয়া থেকে ২৭ কিমি মাত্র। পাহাড়ের গুহায় অবস্থিত শিবমন্দির। দেবতা এখানে স্বয়ম্ভু। পাহাড়চূড়া থেকে প্রাকৃতিক ভাবেই জলের ধারা নামছে শিবলিঙ্গের মাথায়। শিবরাত্রি এবং সমগ্র শ্রাবণ মাস জুড়ে এখানে বহু ভক্ত সমাগম হয়। মেলা বসে।

উদয়া পাখিরালয় ঝাড়খণ্ডের একমাত্র পক্ষীনিবাস। রাজমহল থেকে দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার। পেতৗদা লেককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পাখিদের এই আস্তানা। শীতকালে সুদূর ইউরোপ এবং সাইবেরিয়া থেকে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি আসে। স্থানীয় এবং পরিযায়ী মিলিয়ে প্রায় শতাধিক পাখির দেখা মেলে। যারা পাখি দেখতে ভালোবাসেন এবং বার্ড ফটোগ্রাফিতে উৎসাহী, তাদের জন্য উদয়া পাখিরালয় স্বর্গরাজ্য।

আর আছে তেলিয়াগড়ির দুর্গ। জনৈক তেলি জমিদার এটা তৈরি করেছিলেন। পরবর্তীকালে শাহজাহানের আমলে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। সাহেবগঞ্জের ঠিক আগের স্টেশন কারমাটোলায় এই দূর্গের অবস্থান। নিরালা নির্জন কারমাটোলার চারপাশ পাহাড় দিয়ে ঘেরা। সেকালে বাংলার বিস্তার ছিল এই দূর্গ পর্যন্ত। ৭৪ ফুট উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দীর্ণ এই দূর্গ অতীতের বহু যুদ্ধ জয়ের স্মারক হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে।

কিছু প্রয়োজনীয় তথ্যঃ

কীভাবে যাবেনঃ  যারা লং-ড্রাইভ পছন্দ করেন তারা গাড়ি নিয়ে যেতে পারেন। আছে রেল যোগাযোগ। হাওড়া-কিউল-সাহেবগঞ্জ লুপ লাইনে বারহারোয়া পৌঁছোতে পারেন। দূরত্ব ২জ্জ্ব৫ কিমি। এছাড়াও যাচ্ছে শিয়ালদা-জয়নগর গঙ্গাসাগর এক্সপ্রেস, হাওড়া-গয়া এক্সপ্রেস, জামালপুর এক্সপ্রেস, হাওড়া-বারানসী এক্সপ্রেস এবং শিয়ালদা-বারানসী এক্সপ্রেস।

কোথায় থাকবেনঃ  বারহারোয়া এবং রাজমহলে বেশ কিছু মধ্যমানের হোটেল আছে। ইদানীং এসব অঞ্চলে টুরিস্ট-এর তেমন চাপ নেই। বাঙালি হয়তো ভুলেই গেছে তাঁদের কোনও এককালের রাজধানী রাজমহলকে। তাই আগে থেকে হোটেল বুক না করে এলেও হবে। কেবল উৎসবের সময় এলে হোটেল বুক করে আসা উচিত হবে।

কখন যাবেনঃ  বছরের যে-কোনও সময় যাওয়া যেতে পারে।

সতর্কতাঃ  এখানকার জংলি মশা ম্যালেরিয়ার বাহক। সঙ্গে ওডোমস রাখবেন, পারলে মশারি টাঙিয়ে শোবেন। আর হ্যাঁ, শরীর ঢাকা পোশাক পরা ভালো। মশা ছাড়াও আছে জঙ্গলের বিভিন্ন পতঙ্গ।

বি.দ্র. রাজমহলের মিষ্টি বিখ্যাত। স্বাদ নিতে ভুলবেন না। বিশেষ করে টকদই রসগোল্লা সহযোগে।

 

 

 

যে যায় লংকায়

শারদোৎসবের গন্ধ তখনও মিলিয়ে যায়নি। সেই সময়ে আমাদের, রাবণ রাজার দেশ ভ্রমণের সুযোগ ঘটল। যাতায়াত, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাপনার ভার দেওয়া হয়েছে কলকাতারই এক নামি ভ্রমণসংস্থার ওপর। মিহিন লংকা এয়ার বাস ইন্ডাস্ট্রির সরাসরি উড়ান রয়েছে কলকাতা থেকে কলম্বো। তবে যাত্রা শুরু গভীর রাতে– রাত দুটো। কলম্বো পৌঁছোতে লাগবে তিন ঘণ্টার কিছু বেশি।

রাত বারোটার মধ্যে পৌঁছে গেছি কলকাতা বিমানবন্দরে। আমাদের দলে রয়েছে পাঁচজন। বিমানবন্দরের আনুষঙ্গিক কাজকর্ম সেরে বিমানে আরোহণ। ঠিক সময়েই বিমান ছাড়ল, বিমানসেবিকা সামান্য কিছু খাবারও পরিবেশন করল। তারপর বসে বসেই কিছুক্ষণের জন্যে ঘুমের দেশে চলে গেলাম।

রাতের অন্ধকার চিরে সাগর পেরিয়ে কলম্বোর বন্দরনায়েকে বিমানবন্দরে পৌঁছোলাম ঠিক ভোর পাঁচটায়। মালপত্র নিয়ে বেরোতে আরও ঘণ্টাখানেক। তারপর ভ্রমণসংস্থা নিয়োজিত গাইডের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা গেল। শুধু গাইড নয়– ড্রাইভার কাম গাইড, নাম হেমন্ত একেবারে গাড়ি নিয়ে হাজির। প্যাকেজটুরে বুকিং করলেও স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরার জন্য আমরা আলাদা গাড়ির বুকিং করেছি। এয়ারপোর্ট থেকে বেরোনোর আগে মানি এক্সচেঞ্জ কাউন্টার থেকে টাকা ভাঙিয়ে নিলাম। একশো মার্কিন ডলারের বিনিময়ে চোদ্দো হাজারেরও বেশি শ্রীলংকার রুপি।

কলম্বোর রাস্তাঘাট বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, খানা-খন্দ গর্ত একেবারে নেই। গাড়িতে যেতে যেতেই হেমন্তর কাছে শুনে নিয়েছি ‘কলম্বো’ শব্দের অর্থ। প্রচলিত অর্থ বন্দর তবে আর একটা অর্থও আছে। সিংহলি ভাষায় কোলাম্বা মানে আমগাছের পাতা। আর তার থেকে কলম্বো।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম আমাদের জন্য নির্ধারিত হোটেল পার্ল গ্র্যান্ড হোটেল। অবশ্য তার আগে পথে একটা রেস্তোরাঁয় আমরা ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়েছি।

শ্রীলংকাতেও পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ। তবে রাস্তায় কি কেউ ধূমপান করছে না? করছে তবে একটু আড়াল আবডালে। সেরকমই একটু আড়ালে ধূমপান পর্বটা মিটিয়ে নিলাম। স্টার ক্যাটেগরি হোটেল এই পার্ল গ্র্যান্ড। আমাদের স্থান হল চারতলা আর পাঁচতলায়। প্রত্যেক ঘরের ব্যক্তিগত বারান্দা থেকে ভারত মহাসাগরের এক ঝলক দেখা যায়। আর এক দিকে কলম্বোর রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, হোটেল পাখির চোখে দেখা যায়। স্নানপর্ব শেষ করে ঘরেই রাখা সরঞ্জাম দিয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে খেয়ে নিলাম। লিফটে করে নীচে নেমে এসে দেখি সবাই হাজির, হেমন্ত গাড়ি নিয়ে প্রস্তুত। একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁয় পরোটা-চিকেন মশালা খেয়ে নেমে পড়লাম কলম্বোর সাইটসিইংএ।

কলম্বোতে ঘোরাঘুরি শুরু করার আগে তার ইতিহাস একটু জেনে রাখা ভালো। পঞ্চম শতাব্দী থেকে এশিয়া ও পশ্চিম দেশগুলির জলপথে ব্যাবসায় সিংহল ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। অষ্টম শতাব্দীর গোড়ায় আরব ব্যবসায়ীরা বন্দরের কাছাকাছি বসতি স্থাপন করে প্রাধান্য বিস্তার করতে শুরু করল। পর্তুগিজদের আবির্ভাব সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এলাকার কর্তৃত্ব চলে আসে ওলন্দাজদের হাতে। তারা এখানে দারুচিনি চাষে নিয়োজিত করে স্থানীয় মানুষদের। তবে এলাকাটি শহর হিসাবে পরিগণিত হতে শুরু হয় ব্রিটিশদের আগমনের পর থেকে।

বেশ কয়েক বছর ধরে চলে অশান্তির রাজনীতি। সিংহলের নতুন নাম হয় শ্রীলংকা তবে এই শ্রী শব্দটি থেকেই শুরু অশান্তির। অতীতে সিংহল চারটি সাম্রাজ্যে বিভক্ত ছিল। দশম খ্রিস্টাব্দে রাজা পরাক্রমবাহু চারটি সাম্রাজ্যকে একত্রিত করে অখণ্ড রাষ্ট্রে পরিণত করেন– নাম হয় সিংহল। সিং অর্থে দেশ আর হাল অর্থে চার। ‘শ্রী’ একটি সিংহলী শব্দ যার অর্থ সম্পদ, সৌন্দর্য, সাফল্য।

সংখ্যালঘু তামিলরা এতে ক্ষুব্ধ হল, বঞ্চিত বোধ করল আর শুরু করল প্রতিবাদ। প্রতিকারের দাবিতে প্রভাকরণের নেতৃত্বে লিবারেশন টাইগার অফ তামিল এলাম অর্থাৎ এলটিটিই গঠিত হল ১জ্ঝজ্জ৩ সালে। তারপরে হিংসার রাজনীতির কথা তো সবাই জানে। তবে শ্রীলংকা আজ শান্ত, বিদেশি পর্যটকরা নির্ভয়ে ঘোরাঘুরি করতে পারছে।

আমাদের টয়োটা গাড়ি চলছে কলম্বোর তকতকে রাস্তা গল রোড ধরে। এখানে ছোটো গাড়ি সবই বিদেশি প্রধানত জাপান, কোরিয়া, জার্মানি, আমেরিকায় তৈরি। তবে বাস ট্রাক লরি ইত্যাদি বড়ো গাড়ি সবই ভারত থেকে আমদানি। অটোও চলছে প্রচুর তার রংও নানা রকমের– লাল, হলুদ, সবুজ, নীল। হেমন্ত জানাল লাল রঙের অটোর ভাড়া সব থেকে বেশি আর নীল সব থেকে সস্তা। এর কারণ অবশ্য তার কথায় বিশেষ পরিষ্কার হল না।

কলম্বোর ফোর্ট এলাকা শহরের সবচেয়ে ঐতিহ্যশালী এলাকা হিসাবে চিহ্নিত। ইউরোপীয় রাজত্বকালে ফোর্ট অঞ্চলে সত্যিই দুর্গ ছিল, তার দুদিকে সমুদ্র আর ডাঙার দিক ঘিরে পরিখা। বর্তমানে এই অঞ্চল কলম্বোর সমৃদ্ধির কেন্দ্রবিন্দু যেখানে প্রাচীন ঐতিহ্যশালী ইউরোপীয় প্রাসাদ সদৃশ অট্টালিকা নতুন করে মেরামত করে সাজানো হয়েছে তার সঙ্গে রয়েছে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের মতো নব্য স্থাপত্য। গাড়ি প্রথম থামল সমুদ্রের তীরে গলফেস গ্রিনে।

TRAVEL
Beautiful location

সমুদ্রের তীরে ৫ হেক্টর জুড়ে বিস্তীর্ণ এক সবুজ মাঠ। হেমন্ত জানাল আগে এই জায়গা গল্ফ খেলা ও ঘোড়ার প্রতিযোগিতার জন্য ব্যবহূত হতো এখন ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিস, রাগবি, পোলো সব কিছুর জন্য ব্যবহূত হয়। শুধু খেলা নয় সাধারণ মানুষের অবসর বিনোদনের জন্য এই পার্কের খ্যাতি। পারিবারিক পিকনিক বা যুগলের নিভৃত আলাপের জন্য এই স্থানটি যেন আদর্শ– জলের উচ্ছ্বাস দেখতে দেখতে কেটে যায় অনেকটা সময়।

সমুদ্রের তীরে হু হু করে হাওয়া বইছে সেই হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে রং বেরঙের নানা আকৃতির ঘুড়ি। ঘুড়ি নিয়ে বিক্রেতারাও হাজির এই পার্কে। খাবারের স্টলও রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সমুদ্রের ধারে বাঁধানো পাড় থেকে বাচ্চা ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়ছে জলে– সমুদ্রের ঢেউ-এর তালে তালে। রাস্তার ওপারেই তাজ সমুদ্র হোটেল। তাও এক দর্শনীয় স্থাপত্য। হেমন্ত জানাল সপ্তাহান্তে বা ছুটির দিনে এখানে এলে মনে হবে একেবারে পিকনিক স্পট। তখন গাড়ি পার্ক করার জায়গাও পাওয়া যায় না।

গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। চ্যাথাম স্ট্রিট ও কুইন স্ট্রিটের (জনধিপতি মওয়া) সংযোগস্থলে ক্লক টাওয়ার। আগে লাইটহাউস হিসাবে ব্যবহূত হতো। গাড়িতে চলতে চলতে দেখা হল পুরোনো পার্লামেন্ট, সেন্ট্রাল ব্যাংক বিল্ডিং, লয়েডস বিল্ডিং অ্যান্ড ওরিয়েন্টাল হোটেল– এগুলি সব ইউরোপীয় আমলের অট্টালিকা যা পরবর্তী সময়ে মেরামত করে অপরূপ স্থাপত্যকলায় হেরিটেজ বিল্ডিং হিসাবে ভূষিত হয়েছে।

শ্রীলংকায় বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলিম, হিন্দু সব ধর্মের মানুষের সহাবস্থান। তাই হেমন্তকে অনুরোধ করি কলম্বো বা তার আশেপাশে এই সব ধর্মের উপাসনা স্থল অন্তত একটি করে আমাদের দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। প্রথমে সেন্ট অ্যান্টোনিস চার্চ। বাইরে থেকে একটি সাধারণ পর্তুগিজ ক্যাথলিক চার্চের মতো দেখতে যদিও অন্দরের ব্যবস্থাপনায় ইউরোপীয় রীতির তুলনায় এই উপমহাদেশীয় ধাঁচই বেশি। সামনেই সেন্ট অ্যান্টনির মূর্তি। এই চার্চ নাকি খুবই জাগ্রত– নানা ধর্মের মানুষ, তাদের আশা আকাঙক্ষা নিবেদন করতে এই চার্চে উপস্থিত হন, তাদের প্রার্থনা পূরণও হয়েছে বলে শোনা যায়।

শ্রীলংকার সবচেয়ে বড়ো চার্চ হল সেন্ট লুসিয়া ক্যাথিড্রাল। এই ক্যাথলিক উপাসনালয়টি অবশ্য আমাদের দেখা সম্ভব হয়নি।

যে বৌদ্ধ মন্দির কলম্বো সফরকারীর তালিকায় সবসময় স্থান পায় তা হল গঙ্গারামায়া বৌদ্ধমন্দির। শহরের মধ্যেই একশো বছরের প্রাচীন এই বৌদ্ধমন্দির। এই বৌদ্ধমন্দিরে প্রাচীন স্থাপত্যরীতির মিল খুঁজে পাওয়া ভার। আধুনিক রীতিতে নির্মিত এই মন্দিরে শ্রীলংকার স্থাপত্য রীতির সঙ্গে চিন, থাইল্যান্ড, বর্মা ও অন্যান্য বিভিন্ন দেশের স্থাপত্য রীতির মিশ্রণ হয়েছে। প্রবেশমূল্যও কম নয়, শ্রীলংকা টাকায় ৩০০ রুপি। এই মন্দির পরিচালনা করেন বৌদ্ধভিক্ষুরাই। এই মন্দিরে অন্তর্গত রয়েছে লাইব্রেরি। মিউজিয়াম আর অসাধারণ কিছু দামি পাথর ও সোনা-রুপার তৈরি উপহার সামগ্রী– যা উপহার দিয়েছেন নানা দেশের ভক্তবৃন্দ ও শুভানুধ্যায়ীরা। নবম পোয়াতে (পূর্ণিমায়) ফেব্রুয়ারি মাসে এখানে উৎসব হয়। বিশাল ঐতিহ্যমণ্ডিত বর্ণময় মিছিলের পথেই পড়ে এই বৌদ্ধমন্দির।

Travelogue
Beautiful location of Srilanka

হেমন্ত দেখিয়ে দিল পুরোনো ডাচ হসপিটাল। নামেই হাসপাতাল– অসাধারণ কারুকার্যময় অট্টালিকা যা ইদানীং কালে পরিমার্জন করা হয়েছে। অট্টালিকার নীচের তলায় দোকান কাফে রেস্তোরাঁর রঙিন হাতছানি। আমাদের তালিকায় আর এক বৌদ্ধমন্দির আছে– কেলানিয়া রাজা মহাবিহার। তবে তা কলম্বো শহর থেকে প্রায় ১২ কিমি দূরে। কেলানিয়া বিহার দর্শন পরের দিনের সূচীতে রেখে আমরা পরবর্তী গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলি। হেমন্ত এবার একটি মসজিদের কাছে গাড়ি দাঁড় করাল। আর সঙ্গে সঙ্গেই তাড়া লাগাল, তাড়াতাড়ি দেখে নিন। বাইরে থেকে ছবি তুলেই মসজিদ দেখা শেষ হল। তবে মসজিদটির অপূর্ব স্থাপত্যরীতি মনে দাগ কাটে।

কলম্বোর টাউন হল এক ঐতিহাসিক স্থাপত্য। টাউন হলের মোটা মোটা থামের সারি যেন পুরোনো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বা কলকাতার জিপিও-কে মনে করিয়ে দেয়। বাইরে সবুজ লন তবে ভিতরে একটি দিকে কোনও সরকারি অফিস বসেছে আর অন্যদিক বন্ধ। তবে বাইরে থেকে টাউন হল ঘুরে দেখতেও মন্দ লাগে না। দুধসাদা এই স্থাপত্যের আর এক নাম হোয়াইট হাউস। টাউন হলের ঠিক বিপরীতে রাস্তার ওপারেই বিহারামহাদেবী পার্ক। কলম্বোর সব থেকে বড়ো পার্ক এটাই।

এই পার্কের নাম ছিল রানী ভিক্টোরিয়ার নামানুসারে– ভিক্টোরিয়া পার্ক। বর্তমানে রানি বিহারাম দেবীর (রাজা দুষ্টুগেমুনু) নামে পার্কটির নামকরণ হয়েছে। পার্কের মধ্যে দিয়ে অনেকগুলি আঁকাবাঁকা রাস্তা চলে গেছে কখনও সবুজ লনের মধ্যে দিয়ে বা কখনও ফুলের বাগানের মধ্যে দিয়ে। রয়েছে বেশ কয়েকটা ফোয়ারা, একটি সুন্দর বুদ্ধমূর্তি। ছোটোদের খেলার ব্যবস্থাও রয়েছে কলম্বোর এই বৃহত্তম পার্কে। বড়ো বড়ো গাছ তাদের ডালপালা ছড়িয়ে পাতার বিস্তারে প্রকৃতির হিল্লোলে জড়িয়ে রেখেছে এই উদ্যানটিকে। শহরের কেন্দ্রস্থলে প্রায় অফিসপাড়ার মধ্যে প্রকৃতি তার সঙ্গ থেকে বঞ্চিত করেনি শহরবাসীকে। বেইরা লেকের তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল জোড়ায় জোড়ায় প্যাডেল বোট নিয়ে জলবিহার। হাঁসের দলও জলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেন হাঁস আর নৗকাগুলি একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী।

গাড়ি এবার ঢুকল এক বিশাল গেট পেরিয়ে এক পাঁচিল ঘেরা চত্বরে। গাড়ি থেকে নেমে আমরা পৌঁছে গেলাম এক সুন্দর ফোয়ারার সামনে। ফোয়ারার তলায় জলের পুল সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে বড়ো বড়ো মাছ খেলা করছে। কোনও খাবার ফেললেই উপরে ভেসে ওঠে। তবে এখানে ফোয়ারাই প্রধান দ্রষ্টব্য নয়, পিছনে রয়েছে এক অপূর্ব আধুনিক নির্মাণ স্থাপত্য– বন্দরনায়েকে কনফারেন্স সেন্টার। সরকারি, বেসরকারি স্তরে নানা বড়ো বড়ো কনফারেন্স, মিটিং, সেমিনার এখানে অনুষ্ঠিত হয়। তবে অনেকেই গাড়ি নিয়ে এটিকে বৈকালিক সান্ধ্য ভ্রমণের স্থান হিসাবে বেছে নিয়েছেন। বেশ কয়েকটা ছবি তোলাও হল এখানে।

আবার পথে বেরিয়ে গাড়ি থেকে দেখা গেল এক ফোটা ফুলের আকৃতির স্থাপত্য (পদ্ম) ‘নেতুম পাকুনা’ কনফারেন্স হল। এটির আর ছবি তোলার সুযোগ হল না। সূর্য পাটে নামছে, কলম্বোয় সন্ধ্যা নামছে। আমরা এসে পড়েছি আজকের শেষ দ্রষ্টব্য ইন্ডিপেন্ডেন্স্ মেমোরিয়াল হলে। এটি কলম্বোর ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্কোয়ারে অবস্থিত। সান্ধ্য ভ্রমণের আর একটি নিরিবিলি স্থান। এখানে একটি মিউজিয়ামও আছে। সেখানে প্রদর্শিত হয়েছে ব্রিটিশ শাসনকালে স্বাধীনতা বিপ্লবীদের স্মৃতি। এমনকী তার পরবর্তীকালে আতঙ্কবাদীদের সঙ্গে যুদ্ধে যেসব মানুষ জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদেরও স্মরণ করা হয়েছে।

ইন্ডিপেন্ডন্ট স্কোয়ার থেকে বেরিয়ে আসার সময় দেখি নানা চিত্রে চিত্রিত হুড খোলা এক লাল রঙের ডবল ডেকার বাস। দেখেই স্মৃতিতে হাতছানি দেয় কলকাতার লালরঙের বাঘমার্কা ডবল ডেকার যা অধুনা বিলুপ্ত। শ্রীলংকার পর্যটন দফতর এই হুড খোলা ডবল ডেকার বাসে পর্যটকদের নিয়ে কলম্বোর সাইট-সিইং-এর (সিটি টুর) ব্যবস্থা করেন। ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্কোয়ারে সেই সাইট-সিইং-এর শেষপর্ব চলছে।

হেমন্তর গাড়ি এখন হোটেলের পথে ফিরছে। তাকে মনে করিয়ে দিই– আমরা কিন্তু কোনও হিন্দু মন্দির এখনও দেখতে পাইনি তাছাড়া কেলানিয়া মহাবিহারও অদেখা রয়ে গেল। হেমন্ত কথা দেয় পরদিন সকালেই এগুলি দেখে তবেই অনুরাধাপুরের দিকে যাত্রা করবে। এরপর আমরা কলম্বোর বিখ্যাত ম্যাজেস্টিক মল একটু ঘুরে ফিরে দেখলাম। সেরকম আহামরি কিছুই মনে হল না। কেনাকাটা খুব একটা কিছু হল না। তবে পরবর্তী সময়ে শ্রীলংকার বিখ্যাত দামি পাথর আর চা-পাতা আমরা কিনেছিলাম।

ফিরে আসি পার্লগ্র্যান্ড হোটেলে। এইহোটেলে সব ব্যবস্থাই উত্তম। গরম জলে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে রাত ৯টা নাগাদ আমরা ডাইনিং হলে এলাম। একটা গানের হালকা সুর বাজছে। ডিনার প্যাকেজের অর্ন্তভুক্ত। ডাইনিং হলে বসতেই সকলকে স্যুপ পরিবেশন করল। তারপর সবাইকে আলাদা ভাবে খাবারের পছন্দ জিজ্ঞাসা করল– কন্টিনেন্টাল, চাইনিজ, মোগলাই…। আমি একাই কন্টিনেন্টাল পছন্দ করলাম বাকিরা সবাই মোগলাই। খাবারের স্বাদ খুবই ভালো, পরিমাণ এতটাই বেশি যে দুজন খেয়েও শেষ করতে পারা যাবে না। সার্ভিসও বেশ তাড়াতাড়ি। ডিনার শেষ করেই যে যার ঘরে, আমরা আজ সত্যিই খুব ক্লান্ত। বিছানায় শোয়া মাত্রই ঘুমের দেশে চলে গেলাম।

পরের দিন সকালে কলম্বোকে বিদায় জানিয়ে মালপত্র নিয়ে সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে কেলানিয়া বৗদ্ধমহাবিহার। শহর থেকে প্রায় ১২ কিমি দূরে। ঐতিহ্যমণ্ডিত এই প্রাচীন বিহারটি প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন বলে দাবি করা হয়। বৌদ্ধস্তুপ ও মন্দির একই সঙ্গে রয়েছে এই চত্বরে। স্থাপত্যও অসাধারণ। মন্দিরের অন্দরে অপূর্ব কারুকার্য ও মূর্তি। তার মধ্যে শায়িত বুদ্ধের এক বিশাল মূর্তিও এক কথায় অনবদ্য। দেয়াল জুড়ে অসংখ্য পেন্টিং। বৌদ্ধ জাতকের গল্প অনুযায়ী এই সব চিত্রাবলি। চত্বরে রয়েছে এক বিশাল বৌধবৃক্ষ। তার নীচে বসে ভক্তরা প্রার্থনা করেন।

প্রধান ফটকের কাছে চেনে বাঁধা একটি বিশাল হাতি শুঁড় তুলে দর্শকদের সেলাম জানাচ্ছে। কথিত আছে গৌতম বুদ্ধ তৃতীয়বার সিংহলে যখন আসেন তখন এই মন্দিরে পদার্পণ করেছিলেন। এর পর কয়েকবার শত্রুর দ্বারা মন্দিরটি আক্রান্ত হলেও তা পুননির্মাণ করা হয়। প্রথমে ভারতীয় আক্রমণকারীরা মন্দিরটি ক্ষতিগ্রস্ত করে। আবার পুনর্নির্মাণের পরে ষোড়শ শতকে পর্তুগিজদের হাতে বিধবস্ত হয়। তবে অষ্টাদশ শতকে ওলন্দাজরা তা সারিয়ে দেয় স্থানীয় মানুষদের খুশি করে সুসম্পর্ক স্থাপনের জন্য।

প্রতি জানুয়ারি মাসে এখানে উৎসব হয়। হেমন্তর কাছে এই উৎসবের বিবরণ শুনতে থাকি। শ্রীলংকায় পূর্ণিমা, পোয়া নামে পরিচিত। সারাবছর প্রতিটি পোয়া বৌদ্ধদের ছুটির দিন। সেইদিনে তারা সাদা পোশাকে প্রার্থনা, উপাসনা করতে পবিত্র বৌদ্ধমন্দিরগুলিতে যায়। ডুরুমু পোয়া বৌদ্ধদের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী প্রথম পোয়া– যা এই দেশে বুদ্ধের প্রথম পদার্পণ সূচিত করে। কেলানিয়া মন্দিরে এই উপলক্ষে ‘পেরাহেরা’ অর্থাৎ মিছিল করে উদ্যাপন করা হয়। মিছিল জুড়ে থাকে স্থানীয় পোশাকে সজ্জিত নৃত্যকুশলীরা, নাচতে নাচতে ড্রাম বাজাতে বাজাতে তারা মিছিলের পুরোভাগে থাকে। একদল পটকা ও আতসবাজি ফাটাতে ফাটাতে চলে আর এক দল নানারকম দৈহিক কসরত দেখায়। সবশেষে আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বোধহয় সুসজ্জিত হাতির মিছিল। এই উৎসব সত্যিই এক অপূর্ব দ্রষ্টব্য।

গাড়ি আবার এগিয়ে চলে অনুরাধাপুরার উদ্দেশ্যে। পথে আমাদের হিন্দু মন্দির দর্শন। হেমন্ত তার কথা রেখেছে। মন্দিরটি মুরুগান অর্থাৎ কার্তিকের। তবে মন্দিরটি নবীন। বাইরে কার্তিক, শিব ও হনুমানের মূর্তি। মন্দিরে অনেকেই দর্শন ও পুজো

দিতে আসছে। অন্দরে রয়েছে কার্তিক ছাড়াও গণেশ, শিব, দুর্গা, সরস্বতী, লক্ষ্মী, হনুমানের মূর্তি। তবে মন্দিরের ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ।

মন্দির দর্শন শেষে গাড়ি এগিয়ে চলে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য অনুরাধাপুরার দিকে।

প্রয়োজনীয় তথ্য

প্যাকেজ টুরে বিদেশ ভ্রমণ করতে চাইলে শুধু পাসপোর্ট থাকলেই চলবে বাকি সব দায়িত্ব পর্যটন সংস্থার।

বিভিন্ন ভ্রমণ সংস্থা শ্রীলংকা সফর করায় ৬ দিন থেকে ১০ দিনের মধ্যে। সেই অনুযায়ী ভ্রমণসূচী ও আর্থিক মূল্যও পরিবর্তিত হয়।

তবে শ্রীলংকা ভ্রমণে কলম্বো দিয়ে ভ্রমণ শুরু করতে হবে কারণ প্রধান বিমানবন্দর এই কলম্বোতেই।

শ্রীলংকা ভ্রমণে ভিসা করার হাঙ্গামা নেই, খরচও নেই পাসপোর্ট থাকলেই হবে।

প্যাকেজ টুরে হোটেল গাড়ি খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। ভ্রমণ সংস্থাই সব দায়িত্ব নেবে।

বসন্তে রাঙামাটি

রায়মাটাং-এর ডেরা ছেড়ে রাঙামাটি পরের ঘাঁটি। গাড়িতে উঠতে যাব, সরযু কারকি তার সোমত্ত মেয়েটিকে গুঁজে দিয়ে বলল, ওকে হাটের মুখে নামিয়ে দেবেন। এদিকে হাট কোথায় আজ? এই পাহাড় উতরোলেই বুধবারের জটারে হাট। ‘জটারে’ শব্দটায় মুখে মৃদু হাসির লক্ষণ ফুটে উঠল তার। গাড়িতে ততক্ষণে সতেরো বছর বয়সি চন্দ্রা কারকি ঢুকে পড়লে অনিল ভান্ডারি তার গাড়িটি সচল করল।

দু’ধারে গভীর বন। পাথুরে পথে বোলেরো মাতালের মতো টালমাটাল নামতে থাকে। এ পথে শ্বাপদের সন্ত্রাসে চলাচল বড়ো সাবধানে, ভান্ডারি বলছিল। বিশেষ করে গউর, শুয়োর, হাতি। হাতির হান্ডায় (দল) পড়ে গেলে জীবন চৌপাট। চন্দ্রাদের চলাচল এ ভাবেই? মেয়েটি বলে পথ তো একটাই। তোমাদের পড়াশোনা? আমাদের হ্যামিলটনগঞ্জে আসল বাড়ি। ওখানে থেকে কলেজের ফার্স্ট ইয়ার। দাদা ইংরেজি অনার্স করছে। রায়মাটাং-এ তিরিশ বিঘে জমি লিজ নিয়ে ট্যুরিস্ট রিসর্ট গড়ে বাবা-মা পাহাড়ে। আমরা ভাই বোন হ্যামিলটনে। আর ছুটি পেলেই ছুটি রায়মাটাং। বাঃ! ব্যবস্থা তো বেশ। কোথায় বেশ? দেখছেন তো রাস্তা।

ততক্ষণে গাড়ি নেমেছে গেলডুং নদীতে। তারপর আরও দুই নদী, রায়মাটাং ও পানা। চন্দ্রা বেশ বলিয়ে মেয়ে। বলে– ট্যুরিস্ট বুকিং হ্যামিলটনে বসে আমিই সামলাই। পাহাড়ে তো প্রায়শ টাওয়ার ফেল। নদীতে গাড়ি থামাতে হল। নদীকে ঘিরে ধরেছে কয়েকটি দামাল পাহাড়। তাদের ফাঁস কেটে বেরিয়ে গেছে গেলডুং। ছবিবাজ বন্ধুটির শার্টার পড়তেই থাকে। সেই প্রকৃতির মাঝে নেমে এসেছে লেমন রং মেয়ে চন্দ্রা। তার বেশ খানিক উচ্চতা, হৃষ্ট স্বাস্থ্য, পেলব শরীর। মাথায় ওড়নার গুন্ঠনে হাসিখুশি দাঁড়ায় যেন বিউটি কনটেস্টে। ছবি ওঠে এক…দুই…চার নানা মুদ্রায়। নদী-পাহাড়ের জট কাটিয়ে গাড়ি নেমে এল সমতলে। এখানে ফৗজিদের ব্যারাকের সামনেই মদো মাতালের হাট। জটারে অর্থে নেপালিতে তাই বোঝালেও শাকসবজি, শুকনো মাছ, প্রসাধনী, এনামেল বাসন থেকে জুতো জামা, সবই স্বল্প সাধ্যের। তারই ভাঁজে ভাঁজে পেঁয়াজি আলুবড়া আর ঝাঁঝ পানি। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গণতান্ত্রিক নেশাভূমি। জায়গাটা খোলামেলা। হাট ঘেঁষে চা বাগান। মনোরম পরিবেশে কঞ্চির বেঞ্চে মার্চের দুপুরে বসে আমরাও এনার্জি টনিক নিয়ে ফেলি কয়েক চুমুক করে। অর্থাৎ ছোটো কাচের গেলাসে খয়েরি চা। একেবারে চা বলয়ে বসে চা নামক যে তরলটি গলধঃকরণ করি তাতে না স্বাদ, না গন্ধ। চন্দ্রাকে ছেড়ে এবং জটারে থেকে গাড়ি ছাড়ে। ভান্ডারি ভাষ্য দেয়– এবারে চা বাগানের চ্যানেলে পড়ে গেলেন। আর যে নেশাটি না হলে সকাল-বিকেল বিকল, তাদের জন্মভূমি প্রাণ ভরে দেখে নিন। সত্যিই তো যত দূর দৃষ্টি যায় সবুজ সমুদ্র। নিথর, নিস্তব্ধ। এটা রাধারানি চা বাগান। এই গাছগুলির বয়স কত হবে আন্দাজ দিন তো? কত? বারো-পনেরো বছর? না মশায়, ন্যূনতম পঞ্চাশ। আমাদের নেশার যোগান দিতে গাছগুলির অবিরাম আত্মবলিদান, ভাবুন তো। ভান্ডারি ধরিয়ে দেয় ভাবনাটা। ঠিক। ছাঁটাই কলে না পড়লে একটা গাছ কতদূর বাড়তে পারে? কুড়ি ফুট তো হামেশাই। বীজের জন্যে সংরক্ষিত গাছের ফল সংগ্রহ করতে গাছে চড়তে হয়।

চা-চক্বরে পড়ে ভুলেই গেছি যে গাড়ি থেমেছে। পাইলট বেরিয়ে এসে বলে, একটা অবাক মানুষ দেখে যান। অবাকই বটে। পিপুল আর ময়না গাছের জোড়ের মুখে প্রায় ২৫ ফুট উঁচু কোটরে ১৪ বছর ধরে বাস করছে এক গাছ-বুড়ো ওরফে জী ভাইয়া। তাকে পেয়েও গেলাম গাছের নীচে। বয়স অনুমান ৭০ বছর। ক্ষয়াটে, ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি আনুমানিক উচ্চতা। বসত গড়তে তোমার ভিটে মাটি জুটল না হে? জুটল কোথায় স্যার? চুয়াপাড়া বাগানের মজদুর ছিলাম। নোকরি ছুটে গেল! ছোটো একটি ঝুপড়ি বানিয়ে থাকছিলাম। বন দপ্তর থেকে এসে তুলে দিল। ভাবলাম মাটিকেই ত্যাগ দেব। তাই এই ব্যবস্থা। গাছ-ঘরে সুখ-সুবিধা? বড়ো সুবিধা জমি দখলের মামলা নাই। বান বন্যায় হ্যানস্তা নাই। জানোয়ারের তরাস নাই। সাপ শ্বাপদ আছে, তারা উপর ডালের ভাড়াটে। শত্রু-মিত্র এক সঙ্গে থেকে আপস করে ফেলেছি। একখানা ভাম দখল নিতে চেয়েছিল, তো মানুষ দেখে বিপদ মানল। হর দিন তোমার পেট চলে কি করে? গাছ-বুড়ো একটু হেঁয়ালির আশ্রয় নেয়– বৃক্ষেতে বাস, ভিক্ষেতে গ্রাস। গাছের নীচটায় বসে ভিক্ষান্ন ফুটিয়ে খাই। আতান্তরের দিনেতে বনের ফল ফলারে আহার। কি সিমপ্লিফায়েড জীবনাচার জী ভাইয়ার। সত্যি কত রঙ্গ চলে দুনিয়ায়।

আবার গাড়ির ছুট। বাঁ দিকে চলছে রাধারানি, ডান দিকে নয়া বস্তি ফরেস্ট রেঞ্জ। সামনে এক নদীর নোটিস পড়েছে– পানা। কিছু আগে এর সঙ্গে জুড়েছে স্ফীতকায় বসরা নদী। ফলে মার্চেও পানায় ভালো জল। পেরোবে কি ভাবে? ভান্ডারি বলে– এ স্যার বোলেরো, জল-জঙ্গল, পাহাড় ডোন্ট কেয়ার। কিন্তু তার আগে এক দফা থামতে হবে যে। এখানে তো কিছু নেই স্যার। কেন? নদী আছে। বিকেলের নরম আলো কিছু পরেই ডানা গোটাবে। সেই গেরুয়া আলোয় পানাকে দেখব না? নদী যদি বলেন পাশাখাকে দেখাব চলুন। সে-ও হবে।

নদীর পিঠে ছড়ানো বোল্ডার বেছে নিয়ে বসেছি। মাথার উপর দিয়ে ঘর-মুখো ময়না উড়ে গেল শান্ত রাধারানি বাগান ছুঁয়ে। আর পাথুরে নদী পানার ভাঁজে ভাঁজে যে রহস্য লুকোনো আছে, প্রকট হল বিকেলের মরা আলোর কমলা টাচ্-এ। কিন্তু সময় যে বাদ সাধল। গাড়িতে গিয়ে বসতেই কয়েক হ্যাঁচকা টানে জল পেরিয়ে ওপারে গিয়ে উঠলাম। নদী পেরোতেই জঙ্গল এসে হাজির। নিরঙ্কুশ সেগুনের বন। রাঙামাটির রেঞ্জে পড়ে সে এক অনন্ত সেগুন যাত্রা। কোথায় চলেছ হে পাইলট? রহস্যে ঝুলিয়ে রেখে সে বলে একটা মজার গ্রাম দেখাই আপনাদের। আবার মজা? মজা ঠিক নয়, সাজা বলতে পারেন। সাজার গ্রাম? হ্যাঁ তো দেখুন আগে।

জঙ্গলের পেটের মধ্যে গ্রাম ভুত্রি। আর গ্রামের পাশে শুয়ে আছে সেই পানা নদীটা। একদিকে বনের শ্বাপদ, অপর দিকে নদীর বিপদ। গাড়ি থেকে নেমে পড়েছি গ্রামের পথে। সুপুরি ছায়ায় গ্রাম। ছিটে বেড়ার দেয়াল, মাথায় টিন। নিকোনো উঠোন, তুলসী মঞ্চ, রাঙচিতায় উঠোন ঘেরা। মেটে পথের দু’ধারে গেরস্ত বাড়ি। কে বলবে আষাঢ়-শ্রাবণে ডুয়ার্সে যখন অঝোরে বৃষ্টি, বসরা পানার পেট ফুলে এখন-তখন দশা, নদীর সেই দুর্জয় বিক্রম আছড়ে পড়ে ভুতরি গ্রামে।

কথা হচ্ছিল কেদার দাজুর সঙ্গে। ছোট্ট ছিমছাম কাঁচা বাড়ি তার। ফলন্ত লাউ মাচা, সিম, বেগুন কেয়ারি। এক-ঘরা হোম স্টে করেছে। এ গ্রাম স্যার দুনিয়ার বার। দেখছেন তো পূব দিকে অতবড়ো নদী, শিয়রে ঘন বন। দিনে রাতে হাতি-হাঙ্গামা। জীবনের সব প্রয়োজনে নদী পেরিয়ে, চা বাগান পেরিয়ে কালচিনি বাজার ১২ কিমি। সময়ে অসময়ে যাতায়াত? এ ক্ষেত্রে বাইক বড়ো অমায়িক, কত সংকট উৎরে দেয়। নদীর বুকে চলা, তাই বর্ষা ব্যতিরেকে। তো, আপনার হোম

স্টে-তে থাকতে গেলে কী করতে হবে? খুব সিম্পল, থাকতে হবে। আজই থেকে যান। দু’কদম এগোলে বসন্তের বন। জঙ্গলে ফুলের জলসা লেগেছে। লাটোরে এখন ফুল ঝরার পালা। সাদা ফুলে ভরে আছে ডালি। দুধি লতায় ফুল আসছে। লসুনিতে ফুল ফুটছে। জঙ্গলে আছে দমাই গাছ। এর পাকা ফল খেতে সুস্বাদু। লিচুর মতো ফল ফালাসে। আরও পাবেন কুটমেরু, গিনার, ময়না, পড়াবি, চিকরাশি আরও কত। আমার ঘর থেকে দেড় কদম এগোলে পানা। মার্চের নদী এখন পোষ-মানা ময়াল, কোনও ফোঁসফাঁস নেই। দেদার অফার দিয়ে বসলেন কেদার। আমাদের যে পরের ঝাঁপ পাশাখা, তারপর রাঙামাটি। এদিকে বেলা গুটিয়ে এসেছে। লোভ দমন করে দাজুবাবুকে বিদায় দিয়ে ভুতরি ছাড়লাম।

বেলা ডুবে এসেছে। ভান্ডারি ক্ষ্যাপা শার্দুলের মতো তার বাহনটিকে ছুটিয়ে দিল। আমরা এবারে চা বাগানের প্যাঁচে পড়ে গিয়েছি। সেন্ট্রাল ডুয়ার্স চা বাগান। অনেকটা সময় ধরে চা বাগানের কেয়ারি ধরে ছুটে বেড়ায় গাড়ি। এক সময় বেশ খানিক চড়াই টেনে বাগানের মধ্যেই গাড়ি ভিড়িয়ে দিল ভান্ডারি। নেমে এসে বলল, দেখুন স্যার। নিঝুম পরিবেশ। চারিদিকে অথৈ সবুজে সেন্ট্রাল ডুয়ার্স গ্রিন ওসান। সান্ধ্য পাখিরা ডানায় ঢেউ-এর ছন্দ নিয়ে উড়ে যাচ্ছে ভুটান পাহাড়ে। ভান্ডারি বলে নীচে তাকিয়ে দেখুন একবার। এতক্ষণ নজরে আসেনি, অ-নে-ক নীচে দিয়ে বয়ে চলা একটি নদী ওপারের পাহাড়ের পা চেটে দূরে মিলিয়ে গেছে। ও পাশাখা। ডানদিকে কোনাকুনি ভুটানি এক সিমেন্ট কলের চিমনি দিয়ে ধোঁয়া উগরে আন্তর্জাতিক সীমানার বেড়া ভেঙে ভারতের আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। নদী-পাহাড় আর ধোঁয়ার বাহার এক ফ্রেমে জুড়ে নিয়ে দেখতে থাকি। অভ্রর ছবি-যন্ত্র ঘন ঘন ক্লিক দিচ্ছে। পাহাড়ের ঢালে মুঠো মুঠো ঘর বাড়ি ঝুলে আছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকি স্রেফ এক নদী-ঝাঁপের এ-পার ও-পারে দুই দেশ। এক দেশের মানচিত্রে পর্বত প্রমাণ সমস্যা। আর ওই দেশটিতে দেখেছি শিষ্টাচারে বাঁধা সহজ সরল খুশিয়াল জীবনের বহতা। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ফুটে থাকা মানব-কুসুম।

চকিতে তাকিয়ে দেখি পশ্চিম দিগন্তে বেলা ডুবছে। আর আমাদের ছবিওয়ালার যন্ত্রে মুদ্রিত হচ্ছে বেলা শেষের নরম আলোয় চা-সমুদ্রে ভাসমান এক বালিকার ছায়া-ছবি (সিল্যুট)। মেয়েটি সপ্রতিভ পদক্ষেপে এগিয়ে এসে পরিচয় দেয়, আমি নন্দিনী ছেত্রী। সেন্ট্রাল ডুয়ার্সে থাকা হয়। সে কথা বলে অভ্রর সঙ্গে। আমি দূর থেকে দেখি বাগানের নরম সবুজের মাঝে অপরাহ্নের ম্রিয়মান আলোয় মাখামাখি একটি আহেলি যৗবনের রূপশ্রী। দেখি তার কাঁধ ছাপানো চুলের ঢেউ, টানা ভ্রু যুগল, কথার উচ্ছ্বলতায় চোখ দুটি টলটল নীল সায়রের জল। সেই জলে যেমন মৃণাল ফোটে, তার অগোচরে বুঝি ভুজঙ্গের উদ্যত ফণাও। মেয়েটির বাবা চা বাগানের আপার গ্রেড কর্মী। সে পড়ে দার্জিলিং-এর এক অভিজাত স্কুলের উপর ধাপে। থাকে মিশন হস্টেলে, আর ছুটিতে ছুটে আসে চা বাগানে।

নন্দিনী ইংরিজি-হিন্দি-বাংলার মিক্সচারে বলে, ডুয়ার্স আমার প্রথম প্রেম। আমি এখানকারই ভূমিকন্যা। চা বাগানেই জন্ম। চা-মেয়েদের অনেকেই আমার বন্ধু। অভ্র প্রশ্ন রাখে– তোমার ঘর থেকে মেনে নেয় কুলি ব্যারাকের সঙ্গে এই মাখামাখি? আমার ড্যাড-ই বরং বলে, মানুষকে কাজ দিয়ে তার বিচার কোরো না, তার আসল পরিচয় মনুষ্যত্বে। সব সময় চেষ্টা করবে অসময়ে এই মানুষগুলির পাশে দাঁড়াতে। এই শ্রেণির মেয়ের মুখে এমন অবাক করা কথা শুনে সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। বাতাসের খুনসুটিতে তার কেশরাশি ব্যতিব্যস্ত প্রায়। কারণে অকারণে হাসিতে ঝলকায় বিদ্যুৎ। অল্প অনুরোধেই সে সহজ ভঙ্গিতে দাঁড়ায় লেন্সের সামনে। কথার মাঝে তার প্রতিটি মুড খোদাই হতে থাকে যন্ত্রে।

নদীর উপরে আঁধার নামছে। পাহাড় ঢেকেছে অন্ধকারে। পাশাখার ছলাৎ-ছল শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। আমি মুখোমুখি হই নন্দিনীর– বেলা যে পড়ে এল, একা ফিরবে কি করে? আমার উৎকণ্ঠায় সে সহজ ভঙ্গিতে বলে, একা কোথায় আঙ্কল? সঙ্গে রাজু আছে না? ও কুলি লাইনেরই ছেলে। পড়াশোনায় ব্রিলিয়ান্ট। এতক্ষণে নজরে এল লাল বাইকে অপেক্ষারত একটি যুবক। ও তোমার কে হয়? এমন আচমকা প্রশ্নে নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। নন্দিনী আলতো এক হাসি ভাসিয়ে দিয়ে উঠে বসল বাইকের পিছনে এবং হুস করে অদৃশ্য হয়ে গেল। সেই হাসিতে বুঝি তার মনের গোপন কথাটি রহে না গোপনে। ছটফটে মেয়েটির এই হঠাৎ চলে যাওয়া প্রকৃতিকে যেন শূন্য করে দিয়ে গেল!

রাঙামাটির জন্য সময় উৎরে গেছে। নতুন স্পটে রাতের আঁধারে গিয়ে লাভ কি? ভান্ডারি উস্কে দিয়ে বলে রাঙামাটিকে দেখতে বেরিয়ে ফাউ দেখে ফিরবেন– সে কেমন হল স্যার? তা হলে তোমার কি বক্তব্য স্যার? সে বলে– উঠে বসুন। সন্ধে এখনও তেমন পাকেনি। মাথার উপরে চাঁদ আছে, রাঙামাটি দেখিয়ে দিই আপনাদের।

চাঁদনি রাতে চা বাগানের ব্যারিকেড ভেঙে গাড়ি ছুটছে। মার্চের সন্ধ্যায় হিমেল বাতাস মন্দ নয়। আর জানলা দিয়ে পিছলে যাচ্ছে জ্যোৎস্না ধোয়া চা বাগান। অনেকটা সময় ঘুরে পাইলট থামল একটি চা শপে। এতক্ষণে মনে পড়ল চায়ের তেষ্টা। দোকানে বেশ কিছু ক্রেতা সমাগম। তাঁদের কেউ একজন কৗতূহলী প্রশ্ন ছুড়ে দেন– এদিকে কোথায় পাক খাচ্ছেন বলুন তো? বার তিনেক একই পথে দেখছি ঘোরাঘুরি করতে। ভদ্রলোকের প্রশ্নটা ভান্ডারিকে চালান করে দিই। সে নিরুত্তর। গভীর মনোযোগে চায়ের পাত্র শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলুন স্যার। সময় অপচয় না করে আমরাও উঠে পড়েছি। ঘড়িতে যত সময় এগোচ্ছে, আমরা বুঝি পিছিয়ে পড়ছি। গাড়ি চা বাগানের প্যাঁচে পড়ে লাট খাচ্ছে। এবারে চালককে সরাসরি শুধোই– তুমি রাঙামাটি চেনো তো হে? ভান্ডারি এবারে হেসে দেয়– কি যে বলেন স্যার। হাসিমারার ছেলে আমি, রাঙামাটি চিনব না? এ লাইনে তেরো বছর হয়ে গেল। তা হলে ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন?

ভুলভুলাইয়ার দাঁবে পড়ে গেছি যে।

সেটি কে?

চা বাগানের ভূত। চাঁদনি রাতের নির্জন বাগানে ওরা ঘোরে, মানুষকে বাগে পেলে এভাবে…। এখন উপায়? ওর জাল কেটে বেরোবার ফিকির খুঁজছি। আপনারা স্থির হয়ে বসুন স্যার। সন্ধে খুব একটা পাকেনি এখনও। ভূতের উপরে ভবিষ্যৎ ছেড়ে দিয়ে বসে থাকি। জ্যোৎস্না ভেজা চা বাগান এতক্ষণ আমাদের কাছে স্বর্গীয় মনে হচ্ছিল, তাকেই এখন ভৗতিক মনে হয়। প্রতিটি বাঁকেই বুঝি ঘোমটা টানা সাদা থান পরা কেউ চকিতে মিলিয়ে গেল! ফলে সফরে জুড়ে গেল রোমাঞ্চ। সেই রোমাঞ্চের মাত্রা চড়ছে আকাশে মেঘ-আলোর কারসাজিতে। অকারণে চা গাছগুলি নড়ে উঠছে কেন ভান্ডারি? চালকের মুখে চাবি পড়ে গেছে। আমরা তো আগে থেকেই পাষাণবৎ হয়ে আছি। বাইরে বোর্ডে নজর পড়ল লেখা– তোর্সা চা বাগান। তার চ্যানেল দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ছুটে বেড়িয়ে ভান্ডারি মুখ খুলল– ঘড়িটা দেখুন তো স্যার। সময় এখন ছ’টা চল্লিশ মিনিট। ব্যাটা ছেড়েছে এতক্ষণে। আমাদের একজন কৗতূহলী প্রশ্ন ছুড়ল– ভুলভুলাইয়া ব্যাটা না বেটি ও ভাই ভান্ডারি? চাপা গুমোট কেটে গাড়ির মধ্যে মৃদু হাসির কুহর উঠল।

অবশেষে রাঙামাটি বনবাংলো। দোতলা বাংলোর উপরের ব্যালকনিতে বসে দেখি মাথার উপরে আলো ঝলমল একটি পাহাড়ি জনপদ। চৗকিদার বিক্রম লামা চিনিয়ে দেয়– ওই হল স্যার ভুটানের ফুন্টশিলিং। এদিকটা বাংলার জয়গাঁ। এ তো হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাচ্ছে ভাই। হবেই তো দূরত্বটা দেখুন, মাত্র ৪ কিমি। আমাদের এখান থেকে হাসিমারা ১৪ কিমি। হ্যামিলটন ৩০ কিমি। আর কালচিনি বাজার? আর ৪ কিমি জুড়ুন। রাঙামাটি পর্যটন মানচিত্রে ব্রাত্য কেন? কোনও উত্তর পাইনি। এর চারিদিকে মোটামুটি চা বাগান অঞ্চল। যার অর্থ সকাল হলেই হুটার বাজিয়ে বাগান চালু হল। কুলি লাইন থেকে বেরিয়ে আসে মেয়েরা। দলবদ্ধ ভাবে চলে প্লাকারের দল তাদের বাগানে। সকাল থেকে বিকেল, দুই পাতা এক কলির খেলা চলে কয়েক খেপে। বেলা গুটিয়ে এলে ফের হুটার বাজিয়ে ছুটি।

সেই বেলায় আমরাও ফিরছিলাম রাঙামাটি চা বাগানের পাশ দিয়ে। দেখলাম মেয়েরা কাপড়ের ঝোলায় কাঁচা পাতা নিয়ে বসে আছে। গাড়ি থামিয়ে নেমে আসি ওদের কাছে। তোমাদের কাজ তো শেষ, ঘর যাবে না? একজন মাঝ বয়সি মদেশীয় মহিলা বলে– ওমনি ঘর যাব? কাজের রেকর্ড করাব না? প্রতিদিন তিন দফা পাত্তি ওজন হবে, নামে নামে রেকর্ড হবে তবে না হপ্তা পাব। বসে আছি, পাত্তি কাঁটায় উঠছে। বইদার রেকর্ড করছে। কাজ শেষ হলে তবে না ফেরা। ঘর কোথায়? রাঙামাটির কুলি লাইন, খোখরা বস্তি। ওদের সারাদিনে সংসারের কাজের জন্য বরাদ্দ শুধু বিকেলটুকু। ঘরে ফিরেই রাতের রান্না, পরের দিনের দুপুরের খাবার তৈরি করে রাতের খাওয়া সাঙ্গ করে সমগ্র চা পাড়ায় ব্ল্যাক আউট। পরদিন ভোরেই যে আবার হুটারের শমন।

ব্যতিক্রম শুধু হপ্তা দিনে। বাগান মজদুরের পেমেন্টের দিন। ওই দিন বাগানের গেটে হাট বসে। কামিনরা টিপ ছাপের হপ্তা নিয়ে ঘরে ফিরে চেহারায় কলি ফিরিয়ে দলবদ্ধ ভাবে হাট করতে এসে সারা সপ্তাহের বরাদ্দ তুলে নিয়ে যায়। পরদিন সানডে, অর্থাৎ নিয়ম মতো সকালেই গির্জায় যেতে হবে। প্রসঙ্গত বলা– ডুয়ার্স বাগানগুলির বেশিরভাগ মজদুর আজ যিশু সাহেবের কবলে। বাগানের হপ্তা দিনে পুরুষ মজদুরদের মেজাজ থাকে চড়া মাত্রায় বাঁধা। তাদের মজুরির বেশিটাই যায় আফগান ব্যাংকের ধার শুধতে। বাকিটা সুরা এবং জুয়ায় উড়িয়ে দিয়ে নিঃস্ব হরিদাস হয়ে ঘরে ফেরা। এক দিকে চা মেয়েদের নিত্যকর্ম পদ্ধতি শুনি। ওদিকে মেয়েদের হরেক মুড খোদাই হয়ে চলে ছবি যন্ত্রে।

রাঙামাটির ভৌগোলিক অবস্থানটি হল– পূর্ব দিকে রাঙামাটি চা বাগান, বসরা নদী। পশ্চিমে তোর্সা চা বাগান। উত্তরে জয়গাঁ, ফুন্টশিলিং। দক্ষিণে দলসিংপাড়া, হাসিমারা। এদিকে চা বাগানই মুখ্য। চাষাবাদ সামান্য। নেপালি প্রধান অধিবাসী। রাঙামাটি থেকে নিত্য বাজার, মল্লিক বাজারের দূরত্ব  ৩ কিমি। যাতায়াতের অটো আছে। শনি-মঙ্গলে মঙ্গলাবাড়িতে ছোটো হাট বসে। এদিকে গাড়ি নিয়ে ঘুরতে পারেন চা বাগান, বসরা নদী, ফুন্টশিলিং, হাসিমারা হয়ে কোদালবস্তি, এসডি রোড হয়ে চিলাপাতার তোর্সা রিভার ঘুরতে চাইলে বাড়তি রোমাঞ্চ। সঙ্গে মেন্দাবাড়িও জুড়ে নিন।

রাঙামাটি ছেড়ে ওঠার মুখে আমাদের মধ্যে ভূত-ভীতু সঙ্গীটি প্রশ্ন করে বসে– তোমাদের চা বাগানে ভূতের প্রকোপ কেমন হে? ভূত? কই শুনিনি তো! খানিক বিস্ময়ের সুরেই বলল সুকুমার গুরুং। ভাওয়া ওঁরাও ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে ঠিক বলেছেন স্যার। রেডিও কার্জির মেয়ে জার্লিনা প্রেম ঘটিত ব্যাপারে খুন হয়ে তিন দিন পড়েছিল সেন্ট্রাল বাগানে। তার আত্মা নাকি খুনের বদলা নিতে ভুলভুলাইয়া হয়ে ঘুরে বেড়ায় বলে শুনেছি। তবে রাঙামাটিতে তার কোনও ছায়া পড়েনি। কেন স্যার? পড়েছিলেন ওর পাল্লায়? না-না তেমন কিছু নয়। ভান্ডারির মুখে শুনছিলাম চা বাগানের ভূতের কথা, তাই…। আমাদের রাঙামাটি আবিষ্কার শেষ করে উঠে বসলাম গাড়িতে।    প্রয়োজনীয় তথ্য

শিয়ালদা থেকে রাতের কাঞ্চনকন্যায় উঠে পরদিন সকালে হাসিমারা স্টেশনে নেমে ১৪ কিমি দূরত্বে রাঙামাটি। স্টেশনেই ভাড়া গাড়ি পাওয়া যাবে। চমৎকার দ্বিতল বাংলোয় উপর নীচে ঘর। বুকিং দেবেন ডিএফডি, বক্সা টাইগার রিজার্ভ-পশ্চিম। পোস্ট-আলিপুরদুয়ার কোর্ট। জেলা-আলিপুরদুয়ার।

 

আলেকজান্ডারের আপন গ্রামে

জায়গাটির নাম মালানা। কুলুর খুব কাছেই এই গ্রাম। শুধু সৌন্দর্যের জন্যই নয়। এর অন্য দুটি খ্যাতিও আছে। প্রথমত এই গ্রামটিকে বলা হয় লিট্ল গ্রিস ইন হিমাচল প্রদেশ। এর কারণ হল এই গ্রামের বাসিন্দাদের শরীরে বংশ পরম্পরায় যে-রক্ত বয়ে চলেছে, তা নাকি আলেকজান্ডার-এর। মালানা নালার কোল ঘেঁষে অবস্থিত মালানা, পার্বতী উপত্যকার এক অপরূপ স্পট যার অদূরে চন্দ্রখনি ও দেওটিক্বা পিক। দ্বিতীয় যে-কারণটা মালানাকে খ্যাতি দিয়েছে, তা হল ‘মালানা ক্রিম’ বা হাশিস। পৃথিবীর উচ্চতম মানের চরসের ফলন হয় মালানায়। তাই ফরেন টুরিস্ট ও হিপিদের স্বর্গ মালানা। এই গ্রামটি যেন ভারতবর্ষের অংশ হয়েও পৃথক এক শাসনব্যবস্থা, নিয়মশৃঙ্খলা ও পারম্পরিক ঐতিহ্যে বাঁধা। গ্রামে টুরিস্ট হিসাবে ঢুকলেও কোনও কিছু স্পর্শ করলেই ফাইন দিতে হবে– এই ফতোয়া জারি করা রয়েছে গ্রামের প্রবেশ পথেই।

মালানা যাব ঠিক করে প্রথমেই সিমলা থেকে কুলুর পথে পাড়ি দিয়েছিলাম। মণিকরণ যাবার আগে ভুনটার-এ নেমে গাড়ি ভাড়া করে কাসোল পৗঁছোলাম। কাসোল বস্তুত সার পাস ট্রেক, ইয়ংকার পাস ট্রেক, পিন পার্বতী ও ক্ষীরগঙ্গা ট্রেকের বেসক্যাম্প করার জায়গা। প্রচুর হোটেল রয়েছে কাসোল-এ। এখানে থেকেই মালানা বেড়াব, এটাই ছিল প্ল্যান।

কাসোল-কে মিনি ইজরায়েল বলা হয়। এখানকার অধিবাসীরা অনেকেই ইজরায়েলি। জায়গাটায় বিশ্বের নানা প্রান্তের টুরিস্টের সমাগম। তাই নানা ধরনের খাবার পাওয়া যায় এখানে। জার্মান বেকারি তার অন্যতম। কাসোল থেকে পরদিন আমরা তোশ গ্রামটি বেড়াতে গেলাম। লোকাল বাসে করে ভারশেনি বলে প্রান্তিক স্টপেজে নেমে অল্প কিছু পথ ট্যাক্সি করে পৗঁছোনো যায় তোশ-এ। একটা ছোট্ট কাঠের সাঁকো পেরিয়ে ঢুকতে হয় গ্রামে। সাদামাটা থাকার হোমস্টে-তে রাতের আস্তানা গেড়ে, গ্রামটা ঘুরে নিলাম। অপূর্ব নিসর্গের মাঝে যেন এক টুকরো স্বর্গে এসে পড়েছি।

পরের দিনটি আমার লিস্টের সেরা ডেস্টিনেশনের জন্য রাখা ছিল। কাসোল থেকে ভাড়া গাড়িতে দেড় ঘন্টা পথ পেরিয়ে পৗঁছোলাম মালানা। শেষের চার কিমি পথ পায়ে হেঁটে যেতে হয়। সময় নেয় ঘন্টা আড়াই। গ্রামে ঢুকতেই অঞ্চলের মানুষজন অনেকেই হাশিস বিক্রি করতে এগিয়ে এল। এক অস্ট্রেলিয়ান পর্যটক দল দেখলাম নেশা করে বুঁদ। পাশেই জুয়ার আসর বসিয়েছে গ্রামের তরুণরা। এ যেন এক অন্য পৃথিবী। ঢিলে-ঢালা লাইফস্টাইল, তার নিজস্ব গতিতে চলে এই গ্রাম। অপূর্ব কাঠের কাজ করা প্রাচীন মন্দির, পশুর মাথা ও হাড় দিয়ে সাজানো ঘর বাড়ি, গ্রামের মানুষজন, এসব দেখেই কেটে গেল দিনটা। ফিরতে হবে সেই কাসোল। তাই আবার হেঁটে অনেকটা নেমে এসে, নদীর গাঁ ঘেঁষে চড়াই পেরিয়ে ট্যাক্সিতে বসলাম কাসোলের উদ্দেশে।

 

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব